
মুভি রিভিউ – জংলি, চক্কর ও দাগি
২০২৫ এর ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত তিনটি ছায়াছবি-
মোজাফ্ফর হোসেন
ঈদে মুক্তি পাওয়া আলোচিত ৪টি মুভির মধ্যে মধ্যে ৩টি দেখেছি। সেগুলি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এক ধরনের তুলনামূলক আলোচনা করছি। তবে আমি সিনেমার ক্রিটিক বা একাডেমিক কেউ নই, এই আর্টের অনুশীলনকারীও নই। স্রেফ সিমেনাপ্রেমী দর্শক। খুব সামান্য যা বুঝি সেটা হলো গল্প, তাই গল্পকে কেন্দ্র করেই কিছু কথা।
কাহিনি, স্ক্রিনপ্লে :
জংলি :
সিনেমার প্রটাগনিস্ট জনি ওরফে জংলি একদিকে ‘গুড প্যারেন্টিংয়ে’ ব্যর্থ এক পিতার সন্তান এবং অন্যদিকে সে নিজে সার্থক বাবা, মানবিক মানুষ। সমাজে যে জংলি সেই আবার অনেকাংশে মানুষ হিসেবে সবচেয়ে সফল। অন্যরা সভ্য হয়েও মানুষ হিসেবে অনেকাংশে ব্যর্থ। মোটা দাগে সিনেমার গল্পটা তাই ব্যর্থ সন্তানের না, ব্যর্থ বাবা-মায়ের। আবার বিপরীতে গল্পটা আদর্শ বাবারও, যেটা জনির সঙ্গে পাখির সম্পর্কের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। জন্ম দিলেই ভালো বাবা বা মা হওয়া যায় না, অন্যদিকে জন্ম না দিয়েও সন্তানের সার্থক প্যারেন্টস হওয়া সম্ভব। আমরা একটি প্রজন্ম নষ্ট হওয়ার পেছনে সব সময় সন্তানদের দায়ী করি। কথায় কথায় বলি, এটা একটা ‘স্পোয়েলড জেনারেশন’। কিন্তু এর পেছনে যে ব্যর্থ বাবা-মা বা ‘স্পোয়েলড প্যারেন্টস’ থাকতে পারে, সেটি কখনো ভাবি না। সিনেমার গল্পে আরো কিছু নান্দনিক দিক আমার চোখে পড়েছে। সম্পর্ককে সহজভাবে নেওয়ার বিষয়টি যেমন। জনি বাইক ওয়ার্কশপে কাজ করে জেনেও মেডিকেল পাস নায়িকার পরিবার ওদের সম্পর্ককে সহজভাবে নিয়েছে। সাংবাদিক চরিত্রে অভিনয় করা রাশেদ মামুন অপুর চরিত্রের বিবর্তনটাও আমাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠেছে। শিল্পের কাজ যেমন একটা নষ্ট সমাজে যা যা ঘটে সেটা নগ্নভাবে দেখানো, তেমনি সেই সমাজ ভালো হয়ে ওঠার জন্য যে পরিবর্তনগুলি কাম্য সেগুলিও তুলে ধরা। সম্প্রতি গোটা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছে নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘অ্যাডোলেসেন্স’। বলা হচ্ছে প্রতিটি বাবা-মায়ের দেখা উচিত। এই মুভিটির ক্ষেত্রেও সেটা বলা যায়। নিউজে দেখলাম, সিনেমাটি দেখার পর নিঃসন্তান এক দম্পতি সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা ভাবছেন। পিতৃত্ব, মাতৃত্ব শুধু রক্তসূত্রে হয় না, সম্পর্কসূত্রেও হতে পারে। কখনো কখনো সেটা বেটারও হতে পারে। এই সম্ভাবনার গল্পটি কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু শুধু বক্তব্য প্রকাশ করাই সিনেমার কাজ না। বিনোদন সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক্ষেত্রেও সিনেমাটি মোটামুটি সফল; আবার এই কারণেই আর্টের দিক থেকে ব্যর্থ হয়েছে কিছুটা। চিত্রনাট্যেও কিছু সমস্যা আছে। শেষের দিকে খুব তাড়াহুড়ো করা হয়েছে। শহীদুজ্জামান সেলিম গোজামিল দিয়ে কিভাবে যে ভাইরাল হতে চাইলো, বোঝা গেল না। আরো কিছু দুর্বল দিক ছিল। পরিচালক এম রাহিমের দ্বিতীয় সিনেমা হিসেবে বলতে পারি, তিনি ভবিষ্যতে আরো ভালো কিছুর সম্ভাবনা তৈরি করেছেন। শুধু এটুকু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, গল্পের শক্তি থাকলে দর্শককে খাওয়ানোর জন্য বাড়তি মসলার প্রয়োজন হয় না। Adolescence নেটফ্লিক্সের অলটাইম টপ টেনের সেরা তিনে উঠে এসেছে। কোনো খুনোখুনি নেই, হিরোইজম নেই, পুরুষালি হামবড়া ভাব নেই। আছে একটা গল্প, তাও কথিত থ্রিলার গল্প না, টুইস্টহীন ফ্লাট স্টোরি। কিন্তু দেখতে বসলে ওঠা যায় না। জংলি সেরকম ইউনির্ভাল অনুভূতির টাইমলেস সিনেমা হওয়ার মতো গল্প ছিল, কিন্তু মসলা দিয়ে সুস্বাদু চানাচুর করতে গিয়ে সাময়িক হিট বানানো হয়েছে বটে কিন্তু আরো বিরাট সম্ভাবনা চাপা পড়ে গেছে।
চক্কর :
এটা থ্রিলার গল্প, সফট ক্রাইম থ্রিলার। থ্রিলার জনরায় কাহিনি বলা দেওয়া অন্যায়। তবে বলি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়। থ্রিলিং ব্যাপারটা আছে। বাংলাদেশের থ্রিলার হিসেবে ভালো ভালো। মানে একেবারে ডমিস্টিক থ্রিলার হিসেবে বিবেচনা করলে। যেহেতু বাংলাদেশের সিনেমা থ্রিলার জনরাতে এখনো শিশুকাল অতিক্রম করেনি। বিশ্বমান বাদ দিলাম, যারা মালায়ালাম থ্রিলার দেখেন তারা বুঝবেন যে ওখানকার দ্বিতীয় গ্রেডের থ্রিলারগুলোও আমাদের থ্রিলারগুলোর চেয়ে ভালো হয়। Nayattu, Drishyam, Ela Veezha Poonchira, Officer on Duty, Anjaam Pathiraa, Kishkindha Kaandam, Level Cross, Sookshma Darshini এই সিনেমাগুলো যারা দেখেছেন তারা বুঝবেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। আমরা যারা গিয়েছিলাম তারা শুরুতেই ধারণা করতে পারছিলাম খুনি কে হতে পারে। সমস্যা সেখানে না। কেন খুনটা করেছে এবং কিভাবে সেটা বের করা হচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে চরিত্রগুলো ঠিকমতো ডেভেলপ হয়নি। তবে ক্রাইম থ্রিলার হিসেবে বিবেচনা না করে সামাজিক গল্প হিসেবে দেখলে কিছু বিষয় ভালো ছিল। বিশেষ করে ছোটোছোটো সম্পর্কের গল্পগুলো। প্রতিটা সম্পর্কের মধ্যে আলাদা আলাদা দ্বন্দ্ব ও মায়া ছিল। ড্রাগ কিভাবে জেনারেশনকে নষ্ট করে দেয়, সেটা অল্পতে ভালোমতোই উঠে এসেছে। সবমিলিয়ে বলবো, আশা জাগিয়েছে সিনেমাটি। ভালো হয়েছে বলেই প্রত্যাশা করতে পারছি আরো ভালোর। পরিচালক শরাফ আহমেদ জীবনের প্রথম সিনেমা হিসেবে মনে করি অনেক ভালো কাজ করেছেন তিনি।
দাগি :
এই সিনেমার কাহিনি কি বলব বুঝতে পারছি না। দিস ইজ নট মাই কাপ অব টি। কাজেই এটা নিয়ে কথা বলা উচিত হবে না। তবে এটা ঠিক, তিনটি ছবির পরিচালকের মধ্যে শিহাব শাহীন সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সেলিব্রেটেড, ফলে তাঁর উপর প্রত্যাশা বেশি থাকা স্বাভাবিক। ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’ আমার অনেক ভালো লেগেছিল। তাঁর বেশ কিছু নাটক আছে মনে রাখার মতো। সেই অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশার জায়গা থেকে এই সিনেমা আমাকে হতাশ করেছে। প্রথমার্ধ দেখার পর আমরা যে দশজন গিয়েছিলাম ভেবেছিলাম দ্বিতীয় অংশে কিছু নিশ্চয় পাবো, কিন্তু দ্বিতীয় অংশে আরো হতাশ হই। এই হতাশা একমাত্র গল্পের কারণে। নিশোর অভিনয় ছাড়া এই সিনেমায় কিছু নাই। এখনো সেই নব্বই দশকের ড্রামা সিন, ভ্যানে করে গুলিবিদ্ধ নায়ককে নায়িকার বাঁচানোর চেষ্টা। ভিলেন চরিত্রও স্টাবলিশ হয়নি। অ্যাকশন দৃশ্য দুর্বল। শহীদুজ্জামান সেলিমের চরিত্র তো তৈরিই হয়নি। শহীদুজ্জামান সেলিমের ট্রাজেডি হলো, জংলিতেও তাঁর ক্যারেক্টার স্টাবলিশ হয়নি। আর একটা বিষয়, আমি ভুল বুঝলে ধরিয়ে দেবেন, নিশো তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ধর্ষণ করে, সম্ভবত তারই ফলে মেয়েটির জন্ম। কিন্তু ধর্ষণটাকে নিশো বা নায়িকা কেউই ধর্ষণ হিসেবে দেখল না কেন? যে খুনের সাজা সে পেল সেটা অ্যাকসিডেন্টাল, কিন্তু ধর্ষণটা অ্যাকসিডেন্টাল ছিল না, ধর্ষণ কখনো অ্যাকসিডেন্টাল হয়ও না। আর ধর্ষক ওই সন্তানের বাবার সম্মানও পেতে পারে না (দাবি উঠেছিল সেই কারণে বলছি), নায়িকাএনিওয়ে, আমি ভুল বুঝতে পারি।
কিছু বলার অনিচ্ছা থেকেও অনেক কিছু বলা হলো। যে সিনেমা আমার না, সেটা নিয়ে আসলে কথা বলে সময় নষ্ট করা, নিশ্চয় অনেকের ভালো লাগছে, তাদের জন্য হয়তো ঠিকই আছে।
মিউজিক :
জংলি: তিনটি ছবির মধ্যে মিউজিক সবচেয়ে ভালো হয়েছে জংলির। মৌলিক চারটি গানেরই সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন প্রিন্স মাহমুদ। ইমরান, কনা, হাবিব, তাহসানের মতো শিল্পীরা কণ্ঠ দিয়েছেন। গানগুলো দুই দশক আগের বাংলা সিনেমার গান ও গায়কীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
চক্করের সংগীত মোটামুটি। জাহিদ নিরব ও ন্যান্সির কণ্ঠে ‘সম্পর্কের গান’ ভালো লেগেছে। রাজ্জাক দেওয়ানের কাউয়া কমলা গানটা কাজল দেওয়ানের কণ্ঠে ভালো মানিয়েছে।
দাগির তাহসান, মাশার “একটুখানি মন” গানটি মোটামুটি। তবে ‘নিয়ে যাবে কি’ গানটা হলে বসে শুনতে ভালোলেগেছে। বারবার শোনার মতো কোনো গান নেই।
অ্যাকশন :
জংলি: গল্পের মেজাজের সঙ্গে তামিল সিনেমার স্টাইলে অ্যাকশন খুব বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল না। নাম শুনে মনে হলেও এটা প্রধানত অ্যাকশনধর্মী সিনেমা না। হয়তো ‘মসলা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে দর্শক টেনেছেও। কিন্তু আমি মনে করি, সিমেনার শিল্পমান তাতে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে অ্যাকশন আয়োজন ভালো ছিল।
চক্কর: থ্রিলারধর্মী হলেও অ্যাকশনধর্মী সিনেমা এটা না। সফট কিছু অ্যাকশন দৃশ্য আছে, সেগুলো অতিরঞ্জিত না করে ভালো করেছেন পরিচালক। মোশারফকে দিয়ে অকারণে হেরোইক কিছু না করে ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়েছেন। তবে ওভারঅল কাজ দেখে স্বল্পবাজেটের বলে মনে হয়েছে। বাজেট ইস্যু ছিল হয়তো।
দাগি: গল্পে কিছু অ্যাকশন দৃশ্যের প্রয়োজন ছিল কিন্তু দৃশ্যগুলো যথাযথ হয়নি। হালকাচালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। রাশেদ মামুন অপু এবং শহীদুজ্জামান সেলিমের মুখোমুখি গোলাগুলির দৃশ্যটি নাটকের জন্য হলে ঠিক ছিল। সীমান্তে গোলাগুলির দৃশ্য তো কাচা হয়েছে। এক্ষেত্রেও বাজেট ইস্যু হতে পারে। মোট কথা গল্পটা তুলনামূলক দুর্বল, নতুনত্ব কিছু নেই, তারওপর ঠিক মতো হ্যান্ডেল করা যায়নি, শেষটা কোথায় করতে হতো সে ব্যাপারে কনফিউজড মনে হয়েছে।
visual experience-এর সঙ্গে BGM ( Back Ground Music) সবচেয়ে ভালো জংলির। তবে গ্রাফিক্সের কাজের মান জংলিতে ভালো হয়নি। শুরুতে যে ইঁদুর দেখানো হয়েছে, সেটা আরো ভালো করে দেখানো যেত। বাকিগুলোর গ্রাফিক্সের কাজও এভারেজ।
ডায়লগ :
তিনটি মুভিতেই ডায়লগে অনেক কাজ করার সুযোগ ছিল। আরো কিছু উইট বা পাঞ্চলাইন যুক্ত করা যেত। জংলিতে নায়ক যখন মনে আসক্ত ছিল তখন কিছু দৃশ্য সুযোগ করে দিয়েছিল। মদের সঙ্গে পাউরুটি মিশিয়ে খাওয়ার দৃশ্যের আগের পরে ডায়লগে আরো কিছু সুযোগ মিস করে গেছেন পরিচালক। চক্করে মোশারফ করিমের চরিত্রেও সেই সুযোগ ছিল। চক্কর ওভারঅল ডাইলগের দিক থেকে বেটার মনে হয়েছে। গল্প দুর্বল ও ব্যাকডেটেড বলে কিনা জানি না, দাগির ডায়লগ আলাদা করে কিছু মনে হয়নি। তিনটি সিনেমার ডায়লগে কমন সমস্যা হলো পূর্ণাঙ্গ বাক্য বলার প্রবণতা। ফোনের ওপাশ থেকে যদি কেউ বলে কি করছ, এপাশ থেকে বলবে, আমি এখন ভাত খাচ্ছি। অথচ খাচ্ছি বা ভাত খাচ্ছি বললেই হয়ে যেত। অধিকাংশ বাক্যে বাড়তি দু তিনটি শব্দ কানে লেগেছে। আবার ডায়লগে দ্ব্যর্থবোধক বাক্য বা শব্দ খুব কম ছিল। ডায়লগে যে উইট ও হিউমর থাকতে পারে, সেটি তিনটি সিনেমার কোনোটিতেই ভালোমতো মনে হয়নি। অথচ সুযোগ ছিল। প্রতিটা সিনেমায় একটা দুটো করে ক্যারেক্টার ছিল যাদের ডায়লগে আরও সূক্ষ্মভাবে কাজ করা যেত।
অভিনয়/কাস্টিং :
তিনটি ছবিতেই নায়ক চরিত্রে তিনজনই দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। মোশারফ করিমকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নাই, এমনকি নিশোকে নিয়েও। তারা ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম সেরা অভিনেতা। দাগি সিনেমা একাই ধরে রেখেছেন নিশো। আর জংলিতে চমকে দিয়েছেন সিয়াম। নতুন লুকে অসাধারণ করেছেন। সিয়ামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছে ছোট্ট নৈঋতা। কোনো সিনেমাতেই কাস্টিং নিয়ে কোনো সমস্যা মনে হয়নি। তারপরও দাগিতে গাজী রাকায়েত এবং চক্করে তারিন, ইন্তেখাব দিনার ও রওনক হাসানের কাস্টিং ভালো ছিল। চক্করে সুমন আনোয়ারের অভিনয় অসাধারণ ছিল, পর্দায় তার উপস্থিতি আচারের মতো টনিক হিসেবে কাজ করেছে। দাগি কিংবা জংলিতে উপযুক্ত ক্যারেক্টার পাননি শহীদুজ্জামান সেলিম।
পারসনাল রেটিং :
যদি আইএমডিবি-তে রেটিং দিতে হয়, বাংলাদেশের সিনেমার স্ট্যান্ডার্ড ধরে দিলে আমি জংলিকে ৭ দেব, আর বিশ্ব সিনেমার প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করে হলে ৬; ‘চক্কর’কে একই অথবা সামান্য কম দেব, কিন্তু ‘দাগি’কে অনেকটা কম—৫ আউট অব ১০।
প্রসঙ্গ ধরে আরো কিছু কথা :
মোটের উপর ঈদের সিনেমাগুলো আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে, দর্শককে নিয়ে আমি কখনোই নিরাশ নই, ভালো সিনেমা হলে দর্শক হলমুখী হবেই। সমস্যা হলো, বৈশ্বিক মানের জায়গা থেকে ভালো সিনেমা হয় না বললেই চলে, যেটা বাংলাদেশের সবচেয়ে ভালো সিনেমা সেটা আসলে গড়পরতা ভালো। আমরা বাজেট ও টেকনিক্যাল সমস্যার কথা বলি বটে, কিন্তু যতটুকু কাজ করার তাও করি ভুল গল্পে। ইউনিক গল্প চাই, নতুন গল্প, সময়ের গল্প।
ভারতের মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। মালায়ালাম ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা চার কোটির কাছাকাছি। বিপরীতে বাংলা ভাষায় ত্রিশ কোটি মানুষের ভাষা হিসেবে চিন্তা করলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির অনেক এগিয়ে থাকার কথা। কিন্তু না, পিছিয়ে আছে অনেকটা, কতটা চিন্তা করতে কষ্ট হয়। মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির মূল শক্তি হল সিনেমার গল্প। আমরা পিছিয়ে আছি কোথায়? সেই গল্পেই। বাজেট স্বল্পতার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে ভালো গল্প, এমন সিনেমা ঢাকায় পাওয়া মুশকিল। বরঞ্চ দুর্বল গল্পে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালা হচ্ছে এমন উদাহরণ অনেক দেওয়া যাবে।
হলিউড, বলিউড, কোরিয়া, চীন, জাপান, তামিল-তেলেগু ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কথা হচ্ছে না; প্রতিযোগিতা মালায়ালাম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গেও না। আমাদের সেই পরিমাণ বাজেট ও স্টাবলিশমেন্ট নেই। কথাটা বললাম বটে, কিন্তু কেন জানি মানতে ইচ্ছে করে না। আমাদের সত্যজিৎ সিনেমার বিশ্ব মায়েস্ত্রোদের অন্যতম একজন। তিনি তো বাজেট দিয়ে হননি। জাফর পানাহি, আব্বাস কিয়ারোস্তামি কিংবা জহির রায়হান, তারেক মাসুদ তো বাজেট দিয়ে তৈরি হন না। আমার তো মনে হয়, অতিরিক্ত বাজেট চলচ্চিত্রকে (শিল্পের জায়গাটাকে) নষ্ট করে দেয়, যেটা বলিউডের ক্ষেত্রে ঘটেছে। প্রয়োজন একটা দুর্দান্ত গল্প এবং সেই গল্পটি সরল সাধারণভাবে বলতে পারার সক্ষমতা। আলোচ্য সিনেমা থেকে বের হয়ে এত কথা বলার কারণ একটাই। অন্যদের জন্য যা ‘জেনারেল গুড’, সেটাকে আমাদের ‘বেস্ট’ হিসেবে আমি মানতে পারি না। উচ্চাশা করি এই কারণে যে, চলচ্চিত্র ছাড়া একটা দেশের অন্যান্য শিল্পমাধ্যম এগুতে পারে না। এটা মেজর শিল্প। তাই আমাদের এই শিল্প নিয়ে ভাবতে হবে, যারা কাজ করছেন তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে। আমরা পারব, সম্প্রতি সেই সম্ভাবনার আলো কিন্তু জ্বলে উঠেছে।