অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৮, ২০২৪
৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৮, ২০২৪
৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বশিরুজ্জামান বশির -
মাতৃভাষা, ভাষাশহীদ ও বাংলাদেশ

মায়ের মুখে আমরা যে ভাষা শিখি বা ব্যবহার করি তাকেই আমরা মাতৃভাষা বলি। এই মাতৃভাষার  জন্য প্রাণ দিয়েছেন অনেক ভাষাশহীদ। সেই থেকে আমরা পালন করি মাতৃভাষা দিবস। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা সবাই শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করি। সবাই একত্রিত হয়ে শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই, কিন্তু অনেকেই আমরা জানি না ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কতজন ছাত্র ও জনতা প্রাণ দিয়েছিলেন। এটা অবশ্যই আমাদের সবার জানার দরকার রয়েছে। আমাদের বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয়, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সে সময় কতজন শহীদ হয়েছিলেন তা সঠিকভাবে বলা আজ কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিনা উসকানিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক উদ্দিন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় পুলিশের গুলিবর্ষণের অব্যবহিত পরেই সশস্ত্র পুলিশের দল রাস্তার পাশে পড়ে থাকা গুটিকয়েক লাশ তাদের ভ্যানে করে সরিয়ে নিয়ে যায়। সে সময় রাস্তার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে সে রূপ জবানবন্দি পাওয়া গেছে। পরবর্তীতে এদের কাছ থেকে জানা গেছে, আহতদের সংখ্যা ন্যূনতম ১০০ জন হবে। এ ছাড়াও ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে সেসব সশস্ত্র পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা একযোগে হামলা চালিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল মর্গে থেকে শহীদদের বেশ কয়েকটি লাশ সরিয়ে নিয়েছিল। সে জন্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মৃতের সঠিক সংখ্যা বলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। একুশের সকল ইতিহাসগ্রন্থ খুঁজে যতটুকু সম্ভব তুলে ধরা বা নতুন প্রজন্মকে জানানো জরুরি মনে করছি।

এ ছাড়াও শুনেছি গুলিবর্ষণে আহতদের মধ্যে অপারেশন থিয়েটার ও হাসপাতালে পরবর্তীকালে যারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তাদেরও সঠিক হিসাব সংগৃহীত হয়নি বলা চলে। বিশেষজ্ঞদের মতে ৮ জন ছাত্র-জনতার মৃত্যুর খবর সন্দেহাতীতভাবে পাওয়া যায়। ৮ জন শহীদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা ইত্যাদির সন্ধান পাওয়া গেলেও তাদের বংশপরিচয় ও বিস্তারিত বিষয়াদির মধ্যে অনেক ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। তবে ৮ জনের মৃত্যুর তথ্য বিশেষভাবে গুরুত্ব বহন করে। মহান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ৮ জন শহীদের পরিচিতি যতটুকু সম্ভব এখানে তুলে ধরা হলো।

১. আবুল বরকত শহীদ হয়েছেন ২১-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। পরিচয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসের ছাত্র। পিতার নাম : মৌলভী শামসুজ্জোহা ওরফে ভুলু মিয়া (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) মাতার নাম : হাজী হাসিনা বিবি (১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে আবুল বরকত ছিলেন পিতা-মাতার চতুর্থ সন্তান। জন্ম : ১৬ জুন ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে, জন্মস্থান— গ্রাম : বাবলা ভরতপুর, জেলা : মুর্শিদাবাদ, রাষ্ট্র : ভারত।

২. আবদুল জব্বার শহীদ হয়েছেন ২১-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। পরিচয় : সাধারণ গ্রামীণ কর্মজীবী মানুষ ছিলেন, পিতার নাম : মরহুম হাছেন আলী (১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু), মাতার নাম : সফাতুন্নেসা (১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আবদুল জব্বার ছিলেন দ্বিতীয়। আবদুল জব্বারের স্ত্রীর নাম আমেনা খাতুন ও তার একমাত্র ছেলের নাম নূরুল ইসলাম বাদল (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভাষা আন্দোলনের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ মাস) জন্ম : ১৩ আগস্ট ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে। জন্মস্থান : পাঁচুয়া, ইউনিয়ন : রাওনা, উপজেলা : গফরগাঁও, জেলা : ময়মনসিংহ।

৩. রফিক উদ্দীন আহমদ শহীদ হয়েছে ২১-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। পরিচয় : মানিকগঞ্জ জেলার দেবেন্দ্রনাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয়  বর্ষের ছাত্র। পিতার নাম : মরহুম আবদুল লতিফ (১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু), মাতার নাম : রাফিজা খানম (মৃত্যু ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে), জন্ম : ৩০ অক্টোবর ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। গ্রাম : পারিল, উপজেলা : সিঙ্গাইর, জেলা : মানিকগঞ্জ। রফিক উদ্দীন আহমদের ছোট ভাইয়ের নাম খোরশেদ আলম। শহীদ রফিক উদ্দীন আহমদ ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক পান।

৪. আবদুস সালাম গুলিবিদ্ধ হন ২১-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৭-৪-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বেলা ১১টায় মৃত্যুবরণ করেন। পরিচয় : ডাইরেক্টর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অফিসে রেকর্ড কিপার পদে চাকরি করতেন। পিতার নাম : মরহুম মো. ফাজিল মিয়া (১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) মাতার নাম : দৌলতন নেছা (১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আবদুস সালাম সবার বড়। জন্ম : ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে, জন্মস্থান : গ্রাম : লক্ষণপুর, ইউনিয়ন : মাতৃভূঞা, থানা : দাগনভূঞা, জেলা : ফেনী।

৫. শফিউর রহমান শহীদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে, পরিচয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ক্লাসের প্রাইভেট ছাত্র ও ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী। ঢাকার বংশাল রোডের মাথায় শহীদ হন। পিতার নাম : মরহুম মাহবুবুর রহমান, মাতার নাম : মরহুমা কানেতাতুন্নেসা শফিউর রহমানের স্ত্রীর নাম আকিলা খাতুন। শফিউরের ছেলের নাম শফিকুর রহমান ও মেয়ের নাম আসফিয়া খাতুন। তারা ছিলেন সবাই উত্তরা মডেল টাউনের বাসিন্দা। জন্ম : ২৪ জানুয়ারি ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে, জন্মস্থান— গ্রাম : কোন্নাগর, জেলা : হুগলি, রাষ্ট্র : ভারত। ১৯৯০ সালে শহীদ শফিউর রহমানকে মরণোত্তর একুশে পদক দেওয়া হয়।

৬. আবদুল আউয়াল শহীদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। (বর্তমান ঢাকা রেল হাসপাতাল কর্মচারী সংলগ্ন এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর মোটর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু)। পরিচয় : রিকশাচালক, পিতার নাম : মো. আবদুল হাশেম, জন্ম : ১১ মার্চ ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে (আনুমানিক), জন্মস্থান : সম্ভবত গেন্ডারিয়া, ঢাকা।

৭. মো. অহিউল্লাহ শহীদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। ঢাকার নবাবপুর এলাকার বংশাল রোডের মাথায় সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হন এবং তার লাশ পুলিশ অপহরণ করে।  পরিচয় : শিশুশ্রমিক, পিতার নাম : হাবিবুর রহমান, পিতার পেশা : রাজমিস্ত্রি, জন্ম : ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে (আনুমানিক)। জন্মস্থান : অজ্ঞাত।

৮. অজ্ঞাত বালক শহীদ হয়েছেন ২২-২-১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যু : সম্ভবত কার্জন হল এলাকায় মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায়। পরিচয় : সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে শোক মিছিল বেরিয়েছিল এই অজ্ঞাতনামা বালক ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিল। মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য মিছিলের মধ্যখানে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী ট্রাক চালিয়ে দিলে এই অজ্ঞাতনামা বালকটি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে যেসব ছাত্র, জনতা, সাধারণ মেহনতি মানুষ জীবনকে বাজি রেখে তুচ্ছ জ্ঞান করে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে এনেছেন ইতিহাসের যুগ সন্ধিক্ষণে তাদের আমরা আজ হৃষ্টচিত্তে অভিবাদন জানাই। আমাদের মহান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে ঘোষণা করা হয় ইউনেস্কোভুক্ত বিশ্বের ১৮৮টি দেশে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে পালনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে চরম আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এটি সমগ্র বাঙালি জাতির গর্বের বিষয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির জাগ্রত চেতনার পথ ধরেই ১৯৭১ সালে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। এদেশের বুকে লেখা হয় নতুন ইতিহাস, শুরু হয় রক্ত অক্ষরে লেখা ভাষা আন্দোলনের নতুন অধ্যায়। বর্তমানে ‘একুশ’ শব্দটি কিংবদন্তির খ্যাতি পেয়েছে। এটি বাঙালির জীবন দর্শন এবং বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস। ৫২’র একুশ বাঙালিকে দিয়েছে আপন সভ্যতা আবিষ্কারের মহিমা। একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমেই আমরা অর্জন করেছি স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা। মহান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বীর শহীদদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ : পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামিকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার, সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানিকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ববাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এমএ ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ২৩ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা প্রবর্তিত হয়। সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা  গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তার দাবি অগ্রাহ্য হয়। ফলে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত হয়েছিল৷ ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্বপাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ এই কর্মসূচি পালনে বড় ভূমিকা পালন করে। শেখ মুজিব, শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিগুলো ছিল— ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে। পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।

আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে। পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাওয়ার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করা হবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ‘রাষ্ট্রের দুষমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই’ এই মর্মে মুখ্যমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দেবেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখেও ধর্মঘট ঘোষিত হয় এবং ঐদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে এবং অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে। তমদ্দুন মজলিস ঐ সময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশ ঘটে। ঐ সভায় দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং শামসুল আলম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এ পরিষদে অন্যান্য সংগঠনের দুইজন করে প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সেখান থেকে ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানায়। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিটি তখন পর্যন্ত মেনে নেওয়া হয়নি। চুক্তিতে আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তিনি কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নভেম্বর তারিখে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। এর কিছুদিন পরই, পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়। বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রণয়ন করে; তবে এটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি।

অনেক সংগ্রাম আন্দোলনের পর আবুল বরকতের পরিবার শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে। কাজ শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেওয়া হয়, যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয় ঐ দিনই। ‘শহীদ বীরের স্মৃতিতে’ শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর। মিনারটি তৈরি হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বারো নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে।

২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ‘একুশ’ নিয়ে প্রথম গান রচনা করেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। গানটি হলো— আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। গানটিতে প্রথমে সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে করাচি থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন করে সুরারোপ করেন। সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাতফেরির গান। বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর করা গানটিই গাওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকতা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গানটির সুনাম বাড়তে শুরু করে। আমরা বুক ফুলিয়ে কথা বলি মায়ের প্রিয় মাতৃভাষায়।

তথ্যসূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারি ও মাতৃভাষাবিষয়ক ইতিহাসগ্রন্থ, উইকিপিডিয়া

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *