
কবি মাহমুদ কামাল। টাঙ্গাইলের সাহিত্য উদ্দীপনার একজন অবিসংবাদিত সেনাপতি। ২০০৭ সালে কবি মাহমুদ কামাল সম্পর্কিত একটি নিবন্ধে বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক অরুণাভ সরকার লিখেছিলেন, ‘মাহমুদ কামাল-এর কথা বলতে হলে টাঙ্গাইলের কথা বলতে হয়; আবার টাঙ্গাইলের প্রসঙ্গে বললেও মাহমুদ কামাল’র কথা এসে যায়। এ দুটি নাম এখন যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ টাঙ্গাইলের সাহিত্যচর্চাকে সংগঠিতকরণ থেকে শুরু করে সাহিত্য-শিল্পের বিকাশ, অনুশীলন, উৎকর্ষ সাধন, সাহিত্য আন্দোলন, সাহিত্যের শিল্পমান-ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার ও সমৃদ্ধায়নে টাঙ্গাইলকে আরও বেগবান, গতিচঞ্চল ও প্রতিযোগিতামুখর করার লক্ষ্যে অক্লান্ত যোদ্ধার মতো প্রতিনিয়ত যে ভূমিকা তিনি রেখে চলেছেন এবং সাহিত্যকেন্দ্রিক এই কর্মকাণ্ডকগুলোকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য তাঁর মধ্যে মৌলিক ও অভিনব চিন্তা, বিষয়ানুসারী নানা পরিকল্পনা, নতুন নতুন উদ্ভাবনী কৌশল, সৌন্দর্যদীপ্ত সৃজনশীলতা, মৌলিকত্বের নান্দনিকতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা, স্বকীয়তার যে সাক্ষর আমরা দেখতে পাই, তাতে উক্তিটি যথার্থ নিঃসন্দেহে। যদি বলা হয় যে মাহমুদ কামাল শুধু টাঙ্গাইল নয়, দেশের চৌষট্টি জেলার জন্য আদর্শ উদাহরণ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে; সেটিও সম্ভবত বাহুল্য কিংবা বাড়িয়ে বলা হবে না। একজন মানুষ অন্যের কাছে অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন তখনই, যখন তিনি নতুন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন কিংবা করতে সক্ষম হন এবং দৃষ্টান্ত হওয়ার মতো কোনো সঙ্গত গুণ, কারণ, বৈশিষ্ট্য ও আত্মত্যাগের প্রচণ্ড সাহস তার মধ্যে থাকে; যেটি কবি মাহমুদ কামালের মধ্যে যথেষ্ট রয়েছে।
একজন কবি মানে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ; একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে এর সর্বোচ্চ অর্জনটিকে স্পর্শ করার আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াস কম-বেশি প্রায় সব কবি-লেখকেরই থাকে। সেই সূত্রপথ ধরে কবি মাহমুদ কামালও সর্বদা নিজের সাহিত্য-চর্চা, নিজস্ব সৃজনভাবনা, ধ্যান-জ্ঞানে নিমগ্ন কিংবা বিভোর থাকতে পারতেন; সবটুকু দিয়ে শুধু তাঁর নিজস্বতাকেই সুবিস্তৃতকরণে ব্যস্ত থাকতে পারতেন। জনে জনে পরিচিতি লাভের প্রাবল্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও চালাতে পারতেন। প্রচেষ্টাকে আরও ব্যাপকতর এবং সফল করে তোলার জন্য নানা সংঘ-সমিতি, সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ ইলেকট্রনিক নানা মিডিয়ার কভারেজ-এর হৈ-হট্টগোলেও মিশে যেতে পারতেন। কেননা তাঁর কাব্যকুশলতা অসাধারণ! যথার্থ, নিষ্ঠাবান, বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বলতম কবি হিসেবে সাহিত্যবোদ্ধা ও অনুরাগী মহলে তাঁর বেশ নামডাকও রয়েছে। এমনকি যে সকল কবির শিল্পিত হাতের ছোঁয়ায়, হৃদয়জুড়ানো শব্দবিন্যাস ও বহুমাত্রিক নান্দনিকতায় সমকালীন আধুনিক কবিতার ঘরানা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, কবি মাহমুদ কামাল তাঁদের মধ্যেও অনিবার্য একজন। কিন্তু তারপরও তিনি সেটা করেননি, কখনো হাঁটেননি সে পথে; বরং মিডিয়া কিংবা প্রচার মাধ্যমের চোখ থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রেখে কাজ করে যাচ্ছেন টাঙ্গাইলের সাহিত্যকর্মীদের সামাজিক পরিচয় ও মর্যাদা সৃষ্টি-বৃদ্ধিতে। নিজের সৃষ্টিশীলতা কিংবা ব্যক্তিগত সাহিত্য রচনায় প্রতিবন্ধক হচ্ছে জেনেও তিনি এ কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ, আত্মকেন্দ্রিক কিংবা ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে অর্জনের সমগ্রতা কিংবা সামষ্টিক অর্জনকে অনেক বড় করে দেখেছেন তিনি।
টাঙ্গাইলকে বলা হয় ‘কবিধাম’। এখানে সেই মধ্যযুগীয় সময় থেকে সাহিত্য চর্চার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস, রয়েছে ঐতিহ্যও। আর আধুনিক যুগ তথা বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর প্রাক্কাল পর্যন্ত সময় হচ্ছে টাঙ্গাইলের সাহিত্য ঐতিহ্যের রেঁনেসাকাল। এই সময়টাতে জাতীয় পর্যায়ে টাঙ্গাইলের কবি-সাহিত্যিকদের যেমন দুর্দান্ত বিচরণ ও ব্যাপক জয়জয়কার ছিল, তেমনি পূর্ব-পশ্চিম উভয় বঙ্গে বিখ্যাত ও সমাদৃতও হয়েছেন অনেকে; এমনকি বিদেশবিভুঁইয়েও অনেকে হয়েছেন সুনামধন্য। একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও অর্জন করেছেন অনেকে। এই সময়ে টাঙ্গাইলের সাহিত্যাকাশে এত সংখ্যক উজ্জ্বল কবি-লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে যে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ টাঙ্গাইলকে ‘কবিধাম’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর উঠোনে পা রেখে সেই সাহিত্য ঔজ্জ্বল্য, ঐতিহ্যের প্রবহমানধারা মৃতপ্রায় তটিনীর মতো ক্রমশ যেন ক্ষীণস্রোতা, সংকুচিত, লুপ্তপ্রায় এবং সাহিত্যকেন্দ্রিক কর্মতৎপরতার ঘাটতি ব্যাপকতর হয়ে উঠছিল। টাঙ্গাইলের সাহিত্য ঐতিহ্যের একজন ধারক-বাহক হিসেবে কবি মাহমুদ কামাল এমনটা হতে দিতে চান না কখনো; তিনি চান এই নিস্তরঙ্গ দশা কেটে গিয়ে সেই দুর্দান্ত সময় আবার ফিরে আসুক। আর তাই টাঙ্গাইলে তরুণ প্রজন্মের যারা কবি-লেখক হয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে কিংবা টুকটাক লেখালেখি করছে তাদের মধ্যে প্রাণপণ প্রচেষ্টা জাগ্রতকরণে মূল চালিকাশক্তি এবং সাহিত্য অঙ্গনে গতিদান কিংবা প্রাণসঞ্চারকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন; অর্থাৎ একটা অপরিচিতি প্রতিভাকে গণ-মানুষের সম্মুখে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, তার মধ্যে সত্যিকারের কবি-সাহিত্যিক হয়ে ওঠার অদম্য প্রবণতা জাগিয়ে তোলা, তাকে দিয়ে ভালো কিছু লিখিয়ে নেওয়া, তার সেই লেখা প্রকাশের নানা প্লাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া, সেই কবি বা লেখকের মেধা-শ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন এবং তাকে পুরস্কৃত করা, পুরস্কারের যাবতীয় আয়োজন ও জোগাড়যন্ত্রের ব্যবস্থাপনা, পৃষ্ঠপোষকতা, দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে দায়িত্ব পালনের যাবতীয় সব কিছুতে তিনি রয়েছেন অগ্রভাগে। তাঁর নেতৃত্বেই টাঙ্গাইলে দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্য শিল্পের চর্চা ও বিকাশের নিয়মিত নানা আয়োজন, জাগরণ খরস্রোতা তটিনীর মতো সরব, সক্রিয়, জোরাল ও প্রবহমান।
উদাহরণস্বরূপ : একটা জেলা শহরে সাহিত্য-শিল্পের কোনো ছোটখাটো আয়োজনই যেখানে কল্পনা করা কঠিন, সেখানে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার বিস্তৃত পরিসরে বর্ণাঢ্য, আড়ম্বর ও জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে (দুই দিনব্যাপী) দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে সাহিত্য সম্মিলন/ কবিতা উৎসব-এর আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন তিনি; বিশেষ করে ২০২০ ও ২০২২ সালে মুক্ত প্রাঙ্গণে বিশাল প্যান্ডেল করে ডিজিটাল ফরমেটে (৩ দিনব্যাপী) বিশাল কবি সম্মিলনের আয়োজন করে যে চমক তিনি দেখিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করার মতো। মানুষ গাঁটের পয়সা খরচা করে কবিতা শুনবে, এমন ভাবনা মনে পোষণ করাটা অলীক স্বপ্নের মতো মনে হতে পারে, কিন্তু ১৯৮০ সালে বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আয়োজন করে ইতিহাস গড়েন তিনি। দৈনিক ও সাপ্তাহিক মিলিয়ে টাঙ্গাইলে অনেকগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হয়, কিন্তু সেগুলোতে সাহিত্যের কোনো পাতা নেই; কোনো কোনোটিতে বিশেষ দিনগুলোতে সাহিত্যের আয়োজন থাকলেও তা নিয়মিত নয়, ফলে টাঙ্গাইলের তরুণ ও নবীন কবি-সাহিত্যিকরা তাদের সৃজন-মেধা বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। কবি মাহমুদ কামাল তাদের এ দুর্ভাগ্যদশা দূরীকরণে প্রকাশ করা শুরু করেন সাহিত্যপত্রিকা ‘অরণি’; পত্রিকাটি আজ টাঙ্গাইলের নবীন/ তরুণ প্রজন্মের কবি-লেখকদের লেখালেখির জন্য একটি অনন্য আশ্রয়স্থল। টাঙ্গাইলের কবি-লেখকদের সৃজনশীলতাকে দেশের পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরা এবং সাহিত্য কীর্তিমানদের স্মৃতির পাতায় কিংবা কালের ফ্রেমে জীবন্ত করে রাখার প্রয়াসে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ (যেমন— ‘টাঙ্গাইলের কবি ও কবিতা’, ‘টাঙ্গাইলের গল্পকার : নির্বাচিত গল্প, ‘টাঙ্গাইলের নির্বাচিত ছড়া’, ‘কবিদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (টাঙ্গাইলের), ‘সব্যসাচী আবু কায়সার’, ‘কামাক্ষা নাথ সেন স্মারকগ্রন্থ’ ‘শ্যামল সেনের কবিতা’ ইত্যাদি) সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন তিনি।
তাঁর নেতৃত্বেই শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের যে সকল গুণী ব্যক্তিত্ব জাতীয় পর্যায়ে অবদান এবং তরুণদের মধ্যে যাঁরা লেখালেখিতে মেধার স্বাক্ষর রাখছেন, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে টাঙ্গাইলে সুদীর্ঘকাল ধরে ‘অরণি’ (পত্রিকা ও সংগঠন) ‘অরণি সাহিত্য পুরস্কার’ এবং টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ ‘সাহিত্য সংসদ পুরস্কার’ পুরস্কার প্রদান করে আসছে। এমনকি ‘টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ’-এর উদ্যোগে প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি সময় ধরে নিয়মিতভাবে ‘পাক্ষিক স্বরচিত কবিতা পাঠ প্রতিযোগিতা’র যে আসর আয়োজিত হয়ে আসছে, যা কিনা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রেকর্ড স্থাপন করতে চলেছে, এটাও হয়ে আসছে তাঁর নেতৃত্বেই। এটি শুধু কোনো সাদামাটা প্রতিযোগিতার আসর নয়, এখানে কবিতা পাঠের পাশাপাশি চলে সাহিত্যের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ; প্রতিটি আসরে আমন্ত্রণ জানানো হয় প্রতিথযশা, দেশবরেণ্য কবি-সাহিত্যিক ও গুণী ব্যক্তিদের, যাঁরা তাঁদের আলোচনায় নিজস্ব সাহিত্য ভাবনা, সাহিত্যের সেকাল-একালের নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরাসহ সাহিত্যচর্চার নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। আসরটি তাই একজন উঠতি কিংবা নবীন কবি/ লেখকের জন্য তাদের জানার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধকরণ, সাহিত্য দক্ষতা উন্নয়নের পাঠশালা এবং বহুজনের ভাব চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিতি লাভের মধ্যে দিয়ে আরও ক্ষুরধার সৃজনীশক্তির ইন্ধন লাভ ও নতুন কাব্যিক অভিযাত্রায় শামিল হওয়ার জন্য অপরিহার্য তীর্থক্ষেত্রও। বহু নবীন কবি-লেখকের জন্মও হয়েছে সংগঠনটির কর্মতৎপরতাকে ঘিরে। মোদ্দাকথা, টাঙ্গাইলের সাহিত্যকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডসমূহ সুচারুভাবে সম্পন্ন করা এবং এখানকার সাহিত্য চর্চাকে গতিশীল রাখার জন্য যে উষ্ণতার জোগান দিয়ে যাচ্ছে ‘টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ’, কবি মাহমুদ কামাল হচ্ছেন সেটার নিষ্ঠ নাবিক। একটাই প্রত্যাশা তাঁর, এই সংগঠনকে ঘিরে জন্ম নেওয়া নবীন কবি-লেখকেরাই একদিন সাহিত্য জগতের আলোকবর্তিকা হবেন।
পরিশেষে টাঙ্গাইলের তরুণ প্রজন্মের কবি-লেখকদের কাছে মেরুদণ্ড, কাণ্ডারি, দিকপাল পুরুষ, কবি সৃষ্টির মহান কারিগর/ ‘পাঠশালা’ হিসেবে পরিচিত এই মানুষটি সম্পর্কে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক চপল বাশার-এর একটি উক্তি তুলে ধরা জরুরি মনে করছি। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় অন্তত একজন করে মাহমুদ কামাল থাকলে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা জাতীয়ভাবে আরও সমৃদ্ধ ও গতিশীল হতে পারত।’
শুভ কামনা কবি মাহমুদ কামালের জন্য।