অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. এমদাদ রহমান -
রফিক আজাদের চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া : উত্তর-ঔপনিবেশিক মনন

রফিক আজাদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম পথিকৃৎ কবি। ছয়ের দশকে বাংলা কবিতাকে যাঁরা নতুনরূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন, রফিক আজাদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা কবিতার ঐতিহ্য ও গতিপ্রকৃতিকে আত্মস্থ করেই তিনি স্বীয় সৃজনশীলতার চর্চায় মনোনিবেশ করেন। শুধু একজন লেখক হিসেবে রফিক আজাদ কবিতাকে লালন করেন না, বরং আত্মিকতার জায়গা থেকে কবিতার নির্মাণকে বিশিষ্ট করে তোলেন। সে কারণেই প্রকৃত কবি হয়ে ওঠার প্রবণতা রফিক আজাদের লেখায় বিদ্যমান। রফিক আজাদের রচিত কবিতার বিষয়ে সমাজ, জীবন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, পুরাণ, দেশপ্রেম প্রভৃতি বিষয় দৃশ্যগোচর হয়। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার দরুণ তাঁর কবিতা থেকে বিদ্রোহীচেতনাও বাদ পড়েনি। এমনকি স্বাধীন দেশেও তাঁর প্রতিবাদ থেমে থাকেনি, বরং তিনি একজন প্রকৃত কলমসৈনিক হিসেবে কবিতায় নিজের উপস্থাপনে আজীবন নিরালস ছিলেন। জন্মসূত্রে তিনি ঔপনিবেশিক সময়ের জাতক। পরাধীন ভারতে উপনিবেশ শাসনে তাঁর জন্ম হলেও, প্রথম লেখা শুরু করেন পরাধীন বাংলাতে। ছয়ের দশকে তিনি যখন লেখালেখি শুরু করেন ‘বাংলাদেশ’ তখন ‘পূর্ব-পাকিস্তান’ নাম ধারণ করে পাকিস্তানের হাতে বন্দি। নব্য-উপনিবেশবাদের সময়ে যখন সকল চেতনা আধুনিক দাসত্বে বন্দি, তখনো তিনি উপনিবেশের বিরুদ্ধে গিয়ে কবিতা রচনা করেন। এই জটিল সময়পর্বে তিনি ফিরিয়ে আনতে চান তাঁর অতীত ঐতিহ্যকে, লালন করতে চান আপন সংস্কৃতিকে। যা হয়তো হাজার বছরের চর্যাপদ থেকে গেঁথে আছে মানুষের মনে, কিংবা তারও বহুপূর্বে থেকে যে পৌরাণিক আবহ বাংলার লোকায়ত জীবনকে ধারণ করেছে তার মধ্য দিয়ে। রফিক আজাদ তাঁর ইতিহাসকে লালন করেন কবিতার বুননে, যে কারণে তাঁর কবিতায় আরোপিত উপনিবেশ থেকে বের হয়ে উত্তর-উপনিবেশ সময় গড়ে তোলার আশা ব্যক্ত করতে দেখা যায়।

রফিক আজাদ যখন কবিতা রচনা করেন, তখন তিনি শুধু নিজের সময়কে বাঁধার চেষ্টা করেননি, বরং তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে আপন মননকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। উপনিবেশ শাসনের ভেতর দিয়ে শৈশব পার করে, যৌবনে পরাধীন রাষ্ট্রের গ্লানি ভোগ করে একসময় তিনি কবি হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ তাঁর সচেতনতার উপলব্ধি, কিন্তু পাকিস্তানি শাসনের ধর্ম ভিত্তিক গড়ে তোলা উপনিবেশ তাঁর সজাগ আত্মোপলব্ধি। এ বিষয়গুলো তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় সচেতনভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়। চেতনার মজ্জাগত অবস্থান থেকে তিনি যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ের জাতক এবং ভাবের দ্যোতনায় তিনি যে তাঁর আদিম ঐতিহ্যে ফিরে যেতে চান, তা তাঁর অনেক রচনার মধ্য দিয়েই তা পরিস্ফুটিত হয়। আর এই মননকে বিশ্লেষণ করার জন্যই উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তা কাঠামোর বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে এবং এরই সূত্রে রফিক আজাদের কবিতায় প্রতিফলিত কবির মননের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব।

রফিক আজাদের উত্তর-ঔপনিবেশিক মনন চিহ্নিত করার জন্য ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কাব্য বিবেচনা করা যেতে পারে। মূল আলোচনা ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ কাব্যে প্রবেশ করা যেতে পারে। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যবর্তী স্থানে কবিতাসমূহের রচনা এবং কাব্যটি ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশ পায়। স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের নানা চড়াই-উতরাই পার করে কাব্যটির প্রকাশ। লেখকের মনন সত্তা এ কারণে এখানে তীব্রভাবে প্রভাব বিস্তার করে। উত্তর-ঔপনিবেশিক-মনন হিসেবে আমরা যখন চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যগ্রন্থটিকে বিষয় নির্বাচন করি তখন সেখানে বিষয়গুলোর একটা স্পষ্ট ছাপ লক্ষ করা যায়।

চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যের মাঝে উত্তর-উপনিবেশী মন অনুসন্ধান করার পূর্বে ‘চুনিয়া’ এবং ‘আর্কেডিয়া’ নাম দুটি বিশ্লেষণ জরুরি। চুনিয়া ছিল একটি গ্রাম যাকে কবি দেখেছেন এবং কোনো একটি দৃষ্টিকোণ থেকে তা আর্কেডিয়ার সাথে মেলাতে চান। অন্যদিকে প্রাচীন গ্রীসে পেলেপ্পনিসের কেন্দ্রীয় জেলার নাম ছিল আর্কেডিয়া। সমুদ্র আর প্রকৃতি দিয়ে ঘেরা আর্কেডিয়া অঞ্চল ছিল আঙ্গুর রসের জন্য বিখ্যাত। ডোরিয়ান শাসনকাল অবধি আর্কেডিয়া যথার্থই আর্কেডিয়া ছিল। কিন্তু স্পার্টার শাসকদের ক্ষমতার চূড়ান্ত বিকাশের সাথে সাথে আর্কেডিয়া বিজিত হলো। পরবর্তীকালে এ অঞ্চলের অবক্ষয় শুরু হয়। বিদ্রোহ এবং শাসন-শোষণ এ অঞ্চলকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে কালের বিবর্তনে অঞ্চলটি অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া মোট ছেচল্লিশটি কবিতার সমন্বয়ে গড়ে তোলা কাব্য। সভ্যতার সাথে চলমান জীবন এবং ফেলে আসা জীবনের যত দ্বন্দ্ব সংঘাত, তা তিনি এই কাব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন।

অর্থাৎ ‘চুনিয়া’ যেখানে বাংলাদেশেরই বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল যাকে কবি নিজে অনুধাবন করেছেন এবং দেখেছেন অন্যদিকে ‘আর্কেডিয়া’ বহু দূরদেশের অঞ্চল যাকে কবি কখনো দেখেনইনি, কেবল ইতিহাস আশ্রিত হয়ে হয়তো অনুধাবন করেছেন। এই দুই অঞ্চলকে কবি যখন একই ধারায় বেঁধে একটি নতুন বিষয় সৃষ্টি করতে চান, তখন সেখানে উপনিবেশের সূক্ষ্ম প্রবেশ ঘটে এবং কবি তা থেকে উত্তরণের জন্যই কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, যার কারণে এর মধ্য দিয়ে কবির উত্তর-উপনিবেশী মননের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এখানে কবির কবিতার অংশ বিশেষকে বিষয়ভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো—

ক.

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে দ্যাখে খুব

গাঢ় নিদ্রা থেকে সহসা উত্থিত হ’তে;

সুন্দরের দিকে চোখ রেখে মুগ্ধ মরামানুষেরা

মধ্যদিন আর মধ্যরাত্রির তফাৎ ভুলে যায়;

(‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

খ.

স্তর-পরম্পরাক্রমে এতোদূর এসেও মানব

কতটুকু এগিয়েছে? —প্রকৃতির সঙ্গে অবশেষে

সমস্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে নাকি? —…

(‘উদ্ভিদেরা সহজ সরল নয়’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

উপনিবেশ সবসময় রমণীয় হয়, তার বাইরের চাকচিক্য আকর্ষণ করার মতন। অনেকটা রূপসী নারী দেখে তার প্রতি লোভাতুর হয়ে ওঠা, তবে তা কেবল ক্ষণিকের ঘোর। তাই কবি তার বক্তব্যের ভেতর দিয়ে উপনিবেশিত মানুষকে সচেতন করে তুলতে চান। কেননা উপনিবেশিত হয়ে যদি উপনিবেশকেই পূজা করতে হয় তবে সেখানে নিজের ঐতিহ্য ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবার উপনিবেশের পথে চলতে চলতে মানুষ তার নিজেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। উদ্ধৃতি ‘ক’ অংশকে যদি এখানে আমরা আকর্ষণ হিসাবে দেখি, তবে উদ্ধৃতি ‘খ’ অংশকে আমরা বোধের উপলব্ধি হিসেবে ব্যক্ত করতে পারি। উপনিবেশের আকর্ষণ ভুলিয়ে দেয় সমস্ত কিছু কবি যে গাঢ় নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন তা কেবল বোধের জাগরণ আর মামলার নিষ্পত্তি তাঁর চিন্তার স্ফুরণ। বিষয়টিকে আরও সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে আরও কিছু উদ্ধৃতি আনা যেতে পারে। প্রসঙ্গত—

ক.

অস্পষ্ট বিদেশি হাওয়ায়

এসে পৌঁছেছেন…

‘পদব্রজ’ শব্দটির বড় পিছুটান,

(‘পদব্রজে’ না ‘পায়ে হেঁটে? : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

খ.

শব্দেরা সব জোট বেঁধেছে, একলা একা

আসেনি কেউ— আগের মতো!

(‘শব্দবন্দী’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

গ.

কবির কর্তব্য হলো

খুব দ্রুত শাদা পাতাগুলো

ভরে ফেলা !

(‘কবির কর্তব্য’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

ঘ.

শব্দকে বিন্যস্ত করে তবেই সংস্কৃতি,

তা-না হলে শব্দ সে তো মৃত অভিধান;

(‘প্রকৃতি ও সংস্কৃতি’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

উপনিবেশের শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে সমালোচকগণ ভাষার কথা ব্যক্ত করেছেন। কবির ভাবনাতেও সেই ভাষার চিন্তা নানা আঙ্গিকে ঘুরে বেড়ায়। চিরায়ত ‘পদব্রজ’ শব্দটাকে কবি যখন তাঁর আপন সত্তার সাথে মিলিয়ে নেন তখন সেখান থেকে কবি মন পিছু ছুটে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়। শব্দরা জোট বেঁধে আসে কিন্তু সে শব্দ হয়ে থাকে নিজের এবং স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে। কবি তাই শব্দ দিয়ে শাদা পাতা ভরিয়ে তুলতে চান, অন্য কারো প্রভাব সেখানে যেন কার্যকর না হয়।

কবি যে সংস্কৃতির কথা বলেন তা একটি সুনির্দিষ্ট পন্থা ও তাঁর একটি অভিধান আছে যে কারণে কবির উপনিবেশ আর সত্তার ভেতর বাস করে। কবি যখন তাঁর শব্দের প্রতি খেয়ালী হয়ে ওঠেন তখন বোঝাই যায় যে অন্য কোনো ভাষা বা শব্দ তাঁর স্থান যেন দখল না করে কবি সে বিষয়ে বিশেষ খেয়াল রাখেন। কবির মানস অভিযাত্রায় প্রতিনিয়ত যে উত্তর-ঔপনিবেশিক স্বপ্নের স্পন্দন পরিলক্ষিত হয়, সে প্রসঙ্গে কবিতায় তিনি বলেন—

ক.

আমি ‘পদব্রজ’ কথাটির প্রতিই আমার

পক্ষপাত দেখাতে চাই—

হ্যাঁ, পদব্রজেই আমি এই এদ্দূর এসেছি।

(‘পদব্রজে’ না ‘পায়ে হেঁটে? : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

খ.

অসম্ভবের দীর্ঘ এক পরিব্যাপ্ত বেলাভূমি থেকে

পানীয় জলের জন্যে খালি পায়ে এসেছে মানব!

(‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

গ.

আমার কৈশোর : গ্রীষ্মে নগ্ন পায়ে মর্নিং ইস্কুল

শিশিরে গন্ধভরা অন্তহীন পায়ে-চলা পথ,

(‘আমার কৈশোর’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

ঘ.

মানব সভ্যতা আর শৈশবের

কথা খুব মনে পড়েছিলো;

(‘মধ্যরাতে শোকগাঁথা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

কবি তাঁর অতীতকে স্মরণ করেন তীব্রভাবে। সাধারণ বক্তব্যে তিনি যখন ‘পায়ে হেঁটে’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘পদব্রজ’ শব্দটি ব্যবহার করেন তখন বোঝা যায় তিনি তাঁর অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে চান, তাও একটি চিরায়ত বিষয়কে কেন্দ্র করে। যার মূলে রয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধর্মপ্রচার। কবির এই অতীত ধারা তাঁর চিরায়ত চেতনাকে উজ্জীবিত করে। প্রাচীন বাংলার পদব্রজ তাঁর কৈশোরের স্কুলে হেঁটে যাওয়ার আকুতি সাথে তুলনা কবির চেতনায় একটি মিশ্রণ সৃষ্টি হওয়া, যেখানে কবি তাঁর ভাবনাতে একটি বিস্তৃত সময় নিয়ে বিচরণ ঘটে।

কবির অতীত আর শৈশব এক হয়ে যাওয়া মানেই কবির কবির চেতনায় উত্তর-উপনিবেশ বিচরণ করে। উক্ত কবিতা অংশগুলো কবিকে তাঁর নিজস্ব উপনিবেশে দাঁড় করিয়ে দেয় যেখান থেকে কবি তাঁর মননকে উপনিবেশ থেকে সরিয়ে নিজস্বতার স্থানে দাঁড় করানোর সুযোগ পায়। আবার উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশ বিপরীত অবস্থানে থেকে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করে, যা নিম্নের উদ্ধৃতিতে দেখা যায়—

ক.

দুই মল্ল ভীষণ দ্বৈরথে

একে অপরের প্রতি তীব্র ঘৃণা হানে।

(‘ভালোবেসে বোকা থাকতে চাই’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

খ.

পরের জমি-জমার দিকে ফিরে

নজর দিই না যে,

একটিমাত্র ক্ষেত্রটিকে ঘিরে

ব্যস্ত থাকি : কাজে।

(‘অনভিভূত চাষা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

গ.

কোনটি মুখ আর মুখোশ কোনটি;

কারু মুখোশ মুখের মতোই

….

ঘাপলা কেবল বেড়েই যাচ্ছে,

মুখ ও মুখোশ এক বস্তু নয়।

(‘মানুষ দেখি’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

ঘ.

শুয়োরের বাচ্চাদের সব কাণ্ডকীর্তি দেখা থেকে

অন্তত নিষ্কৃতি পাবো, আর কোনো লাভ না-ই থাক

আপাতত এটুকুই লাভ। —আমার যুগের কিছু

প্রকৃতি প্রতিভা আজ সঙ্গত কারণে চলে গেছে

(‘চ’লে যাবো সুতোর ওপারে’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

উপনিবেশ ও উপনিবেশিত কেউ কারও পরিপূরক নয় বরং দুইটি ভিন্ন সত্তা। যে কারণে তাঁদের মাঝে সর্বদা বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করে। উপনিবেশ যখন জোরালো হয়ে ওঠে উপনিবেশিত তখন তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করে এবং নিজেকে অতীতের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। কবির মুখ আর মুখোশকে আমরা উপনিবেশ আর উত্তর-উপনিবেশের মধ্য দিয়ে তুলনা করতে পারি যা ভিন্নতার রূপে আমাদেরকে গ্রাস করার চেষ্টা করে।

কবি তাঁর কবিতার অংশে যখন ঘাপলা শব্দটি ব্যবহার করে তখন আমরা অজানা একটি আশঙ্কা দেখতে পাই। কবি সুতোর ওপারে যাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তার মানে তিনি কোনো একটা বাধা অতিক্রম করতে চান। নিষ্কৃতি পেতে চান বাঁধা পড়া জীবন থেকে। পাশ্চাত্য জঞ্জালকে তিনি অনেকটা গালির ভাষায় প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর যুগের যা হারিয়ে ফেলেন মানে নিজস্বতার জায়গাটা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে যায়। এ কারণে সুতোর ওপারে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি নতুনত্ব আনতে চান যা দিয়ে হয়তো নিজের স্বকীয়তা আনা সম্ভব।

ক.

তুমি চাও শান্তিচ্ছায়াঘন এক

আদিম অরণ্য

(‘তুমি চাও’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

খ.

তুমি যেখানেই যাও

এসবের কিছুই পাবে না;

(‘তুমি চাও’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

উক্ত কবিতাংশের বিষয়ের আঙ্গিকে বলা যায় অতীতের কাছে ফিরে যাওয়া, আধুনিকতার উপনিবেশের মাঝে বন্দি হয়ে দাসত্ব নয় বরং উপনিবেশ থেকে মুক্তি নিয়ে আদিম অরণ্যেও স্বাধীন জীবনকে গ্রহণ করতে পারলেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অরণ্যেও বিচরণ একটি রূপকতা এর দ্বারা মূলত আদিম জীবনের ইঙ্গিত বোঝানো হয়। কলের যন্ত্রণার নিষ্পেষণ নয়, শান্তির অরণ্যই আমাদের কাম্যতা।

ক.

পিছনে ফেলে আসি :

একটি বাড়ি—

নিকানো নয়, পরিত্যক্ত, ভাঙা ইটের সারি;

বয়ঃপ্রাপ্ত কিছু বৃক্ষ, শুকনো ডালপালা;

(‘পিছনে ফেলে আসা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

খ.

তুমি যেখানেই যাও

এসবের কিছুই পাবে না;

সঙ্গে সঙ্গে যাবে এক বেতারগ্রাহকযন্ত্র,

নোংরা ড্রেন, পচা জল, হলুদ পত্রালি, ক্বাথ, চিমনির ধোঁয়া

দূষিত বাতাস আর ঘভীর রাত্রিতে ভারী বুটের আওয়াজ।

(‘তুমি চাও’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

গ.

এমন কাউকে খুঁজি

যে হবেক আমার

বোধের অংশীদার

(‘এমন কাউকে খুঁজি’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

নিজের নিজস্বতা কখনো উপনিবেশের কাছে পাওয়া যায় না উপনিবেশ সর্বদা নতুনত্ব নিয়ে আসে, ভেঙেচুড়ে গড়তে চায়। এ কারণে মনের মাঝে উত্তরর-উপনিবেশ মনন ধারণ করা জরুরি। কবি রফিক আজাদ যখন আধুনিকতা হিসাবে উপনিবেশকে ধারণ করেন তখন তাঁর স্বজাত্যবোধ অতীতে চলে যায়, যে কারণে তিনি বুঝতে পারেন তাঁর অতীত ফিরিয়ে আনা জরুরি।

নিজের যা কিছু অতীত হতে পারে তা পুরাতন, জীর্ণ, ভাঙা এবং বয়ঃপ্রাপ্ত কিন্তু সর্বদা নিজের। উপনিবেশের চাকচিক্য থেকেও নিজের প্রাক-উপনিবেশর অতি আদরণীয়। কবির বোধের উপলব্ধি তাঁর চেতনার জাগ্রত অবস্থা, বলা যেতে পারে কবির এই উপলব্ধি তাঁর মননকে উপনিবেশের প্রভাব থেকে বের করে নিয়ে আসে।

ক.

আমার কৈশোর : স্বপ্নময়; আরব্য মরুভূমি নয়,

অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতে সোঁদাগন্ধী প্রিয় মাতৃভূমি;

উপেন্দ্র কিশোর আর ‘বুড়ো আংলা’ অবন ঠাকর

(‘আমার কৈশোর’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

খ.

মানব-সভ্যতা আর তার শৈশবের

কথা খুব ক’রে মনে পড়েছিলো;

(‘মধ্যরাতে শোকগাঁথা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

মানবসভ্যতা আর শৈশব যখন একই ধারায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয় তখন বোঝা যায় সভ্যতা উপনিবেশের কাছে বন্দি এবং শৈশব অতীত। কবির যখন সে কথা খুব মনে পড়ছে তার মানে তার অতীতে ফিরে যাওয়ার আকুতি তীব্রতর। অর্থাৎ কবি উপনিবেশের আধুনিক সভ্যতা থেকে মুক্তি নিয়ে উত্তর-উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করতে চান পাশ্চাত্যের উপনিবেশ কবিকে গ্রাস করতে পারে না, যে কারণে তিনি স্বপ্নের মাঝে আরব ভূমির স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত নন।

কবির স্বপ্নে বৃষ্টি আসে, উপেন্দ্রকিশোর আর অবন ঠাকুরের গল্পের চরিত্রগুলো আপনসত্তা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। উক্ত অংশের ‘ক’ ও ‘খ’ দ্বারা শৈশবস্মৃতির কথা ব্যক্ত করা হচ্ছে। আর স্মৃতির রোমন্থনই পারে ব্যক্তিতে তাঁর নিজস্বতার স্থানে সঞ্চালিত করতে।

ক.

কাঠুরের ঘরে জন্মে বেছে নিই চাষীর জীবন!

(‘বিপরীত জীবন-যাপন’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

খ.

কৃষকের হাতের লাঙল উত্তরাধিকারসূত্রে

পায় তার প্রিয় সন্তানেরা;

(‘নর্তকী’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

কবি তাঁর বক্তব্যে অতীত পেশাগুলোর আঁকার চেষ্টা করেন। কাঠুরের ছেলে অধিক উন্নত কোনো পেশা গ্রহণ না করে যখন কৃষিকে গ্রহণ করে নেয় তখন সেখানে স্বজাত্যে ফিরে যাওয়ার আহ্বান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবি শুধু অতীত পেশার প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করেন না, তিনি একই সাথে লাঙলের প্রতি একটি ভিন্ন দৃষ্টি উত্থাপন করার মাধ্যমে লোকজীবনকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কবির এ ভাবনাগুলোকে আমরা শিকড়সন্ধানী হিসেবে ব্যক্ত করতে পারি।

শিকড়েরা চলে গেছে স্তরপরম্পরাক্রমে

মৃত্তিকার গভীরে গহক্ষরে,

ডানা মেলে পাখিদের মতো উড়ে-উড়ে ঢুকে গেছে

পাললিক স্তর ভেদ ক’রে— বহুদূরে— স্বাদু জলে,

(‘শিকড়েরা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

শিকড়ের গভীরে চলে যাওয়া এবং পাখির উড়ে এসে পাললিক স্তর ভেদ করার দৃশ্যাঙ্কন করার মধ্য দিয়ে কবি মূলত উপনিবেশিত ও উপনিবেশের অবস্থান তুলে ধরেন। স্বজাতির বা উপনিবেশিতের মূল্যবোধ ও চেতনা এবং সাহিত্য সংস্কৃতির ভিত্তি থাকে গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন তা উপনিবেশের হাতে এসে পৌঁছায় তখন সেখানে একটি মিশ্র আবহ তৈরি হয়। কিন্তু কবি তাঁর গভীরের বিষয় নিয়ে সচেতন।

ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা জন্মাবধি জলেরা দেখেছে;

অন্যদিকে, বাংলার স্যাঁতসেঁতে আর্দ্র আবহাওয়া

শিকড়গুলোর পশ্চাতে লেগেছে খুব—

খর্খরে শুকনো পোড়ো জমি

(‘শিকড়েরা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

বাংলার চিরায়ত চিরায়ত বিষযগুলো চিরন্তন এবং গভীরে তার অবস্থান। স্যাঁতসেঁতে আর্দ্র আবহাওয়া হলেও উপনিবেশ তার পিছু পড়ে যায় এ কারণে উপনিবেশের সাথে তার বিরূপ সম্পর্ক তৈরি হয়। উপনিবেশের জন্ম থেকেই এ অঞ্চলের লোকায়ত মানুষের সাথে চিরন্তন এক দ্বন্দ্ব। কবির উপলব্ধি অতীতের বিষয় সৃজন করে নবজন্মের ভাব ঘটাতে চায়।

ক.

অন্য পুরুষের ছোঁয়া লেগে

সুখদ মসৃণ ঊরু সরু হয়ে যাবে;

একমাত্র আমার পৌরুষ পারে

পৌঁছে দিতে তোমাকে তৃপ্তির তীরে; আনন্দভবনে।

(‘বৃক্ষের যেমন অবস্থা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

খ.

ক্রমান্বয়ে ব্যবধান বেড়ে যায় এ-পারে

পাল্টে যেতে থাকে ভাষা, উভয়ের জীবনযাপন….

(‘যোগাযোগ’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

গ.

হয়তো বা তার প্রিয় পুরুষটি এখন বিদেশে

কিংবা সে নিজেই নিদ্রারোগী

(‘মধ্যরাতে শোকগাঁথা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

উপনিবেশ কেবল ছিনিয়ে নিতে শেখে জাতির বিবেক থেকে মানুষের অবস্থানকে, ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে মানুষের ধ্যান-ধারণাকে। প্রিয়তমার কাছ থেকে প্রিয় মানুষটিকে কেড়ে নেওয়ার উপমা দিয়ে লেখক সে কথাই ব্যক্ত করেন। উপনিবেশ বিভেদ সৃষ্টি করলেও উপলব্ধি সেই মনকে তাঁর নিজস্বতার স্থানে ফিরিয়ে আনে। উক্ত কবিতাংশগুলি দ্বারা যে ব্যবধান ও বিভেদের তথা বলা হয় তা দ্বারা আমরা উপনিবেশ ও উত্তর-উপনিবেশকে মূল্যায়ন করতে পারি।

বৃক্ষ ও উপনিবেশ দু’টিই সমান যখন তা নিজের থাকে তার প্রতি যত্ন নেওয়া হয় কিন্তু যখন তা অন্যের হয়ে যায় তা তা অনাদরণীয় হয়ে ওঠে। নিজের ইতিহাস-সাহিত্য সংস্কৃতিও তেমন উপনিবেশ যখন তা দখর করে নেয় তখন তা অবহেলিত হয়ে ওঠে উপনিবেশের নতুনত্ব হয়তো ঘোর সৃষ্টি করে উপনিবেশিত ছোঁয়া ছাড়া তা অনাদরণীয়।

স্বজাত্যবোধ কখনো নিঃশেষ হয় না হয়ত ক্ষণিকের জন্য লুপ্ত হয়। কেননা তা একটি ধারায় প্রবহিত হয়, উত্তরাধিকার সূত্রে তা প্রদান করে প্রতিটা মানুষকে।

ক.

পুরানো হৃদয়পুরে সর্বদা সে যাতায়াত কর,

অনিবার্য উপস্থিতি ঘটে প্রত্যহ প্রতিটি গৃহে;

(‘সুন্দরের ফেরিওয়ালা’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

খ.

খুঁজে পেতে অনেকেই লাঙলের ফলা আঁকড়ে ধরে—

সত্যের বদলে কিছু উঠে আসে সুন্দরের সীতা !

(‘সুন্দরের দিকে চোখ রেখে’ : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

গ.

লাঙলের দীর্ঘ ইতিহাস পড়াশোনা ক’রে

বনাঞ্চল আর বিন্যস্ত বাগান দেখে-দেখে

সমভূমি থেকে দূরে এই উষ্ণ প্রস্রবণের ধারে এসে গেছি;

(‘পদব্রজে’ না ‘পায়ে হেঁটে? : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

কবি যখন সুন্দরের ফেরিওয়ালা কবিতায় পুরানো হৃদয়পুরের কথা ব্যক্ত করেন তখন ভেবে নিতে হয় কবির অতীতে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। এ কারণে প্রতিটা হৃদয় যেন সচেতন হয়ে যায় তাঁর প্রাক ঐতিহ্য সম্পর্কে। কবির হৃদয় সর্বদা অতীতকে আশ্রয় করে বাঁচতে চায় যে কারণে সেখানে লাঙলের ফলার কর্ষণ দৃষ্টান্তস্বরূপ আমাদের চোখে বিধৃত হয়।

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট কিন্তু ভেতরে-ভেতরে

খুব শক্তিশালী

মরণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে

(‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যের নামকবিতা চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কবিতায় যখন আমরা প্রবেশ করি তখন বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। স্বদেশের চুনিয়া আর বৈদেশের আর্কেডিয়া যখন একসূত্রে গাঁথা হয় তখন উপনিবেশ আর উত্তর উপনিবেশের একক সমন্বয় সাধিত হয়। কিংবা যখন বলা হয় চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, অর্থাৎ যে চুনিয়া কবির নিজের তবে কেন সেই চুনিয়া আর্কেডিয়াতে রূপান্তরিত হচ্ছে? হয়তো চুনিয়ারও পবির্তন ঘটতে চায় নিভৃতে কিন্তু নিজস্বতার স্থানে চুনিয়াকে কেউই টলাতে পারে না যে কারণে তা চুনিয়াই থেকে যায়।

চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্য সমাজের

কারু-কারু মনে,

কেউ-কেউ এখনো তো পোষে

বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া।

(‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

কিংবা কবি যখন চুনিয়ার মাঝ দিয়ে সকল দ্বেষ ভুলে সকলকে এক হওয়ার জন্য আহ্বান করেন তখন তখন একটি আত্মবিশ্বাসেই সবাইকে টেনে নেন শেষ বিশ্বাস আর তা হলো হিংসা-দ্বেষ ভুলে অতীতকে আহ্বান করা।

কবি চুনিয়াকে শান্ত দেখায় আবার ভীষণ উন্মাদে জেগে ওঠার চিত্রও অঙ্কন করেন। চুনিয়াকে মানুষের আবিষ্কৃত হিসেবে ব্যক্ত করেন আবার একই সাথে যারা চুনিয়াকে ধ্বংস করার জন্য এগিয়ে আসে তাদের অস্ত্রগুলো ভূমধ্যসাগরে নিক্ষেপ করতে উদ্ধত হয়। অর্থাৎ যারা শান্তির স্থানে অস্ত্র নিয়ে আসতে পারে তারাই উপনিবেশ আর তাদের প্রতিহত করে যখন একটি সুন্দর পৃথিবীর আহ্বান করা হচ্ছে তখন উত্তর-উপনিবেশকেই আহ্বান করা হচ্ছে।

চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত

মরণাস্ত্রগুলো

ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।

রক্তমাখা হাত ধুয়ে তারা দীক্ষা নিক।

(‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া : চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া )

কবি তাঁর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উপনিবেশের প্রভাবকে দেখিয়েছেন আবার তা থেকে ফিরে আসার আহ্বানও জানান। বিদেশি হাওয়া বা পাশ্চাত্যের আভিজাত্যের মাঝে একধরনের ভিন্নলাগা কাজ করে। তবে তার ভেতর নিজেকে এলিয়ে দেওয়া মানে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা। লেখক তাঁর অতীত বা পিছুটান ভুলতে নারাজ এ কারণেই তিনি প্রাক-উপনিবেশকে অনুসন্ধান করে চলেন।

রফিক আজাদ চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া আলোচনা করতে গিয়ে অনেক স্থানে ‘লাঙল’ শব্দটি ব্যবহার করেন আবার তিনি পৌরাণিক বিষয়গুলো আনার চেষ্টা করেন। ‘অহল্যা’, ‘প্রণয়-সংহিতা’, ‘পুরাণ’, সংস্কৃতি প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই। যা থেকে কবির মননের চিন্তা উত্তর-ঔপনিবেশিকের পথে ধাবিত হওয়ার প্রয়াস পায়। কবির প্রয়োগকৃত ভাষা এবং শব্দভঙ্গিমা উপনিবেশের বিরূপতাকে দূরে সরিয়ে নিজের লালিত স্বপ্ন এবং ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করে, যে কারণে চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া উত্তর-উপনিবেশ বিরুদ্ধচারণের কাব্য হয়ে ওঠে।

উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের গন্তব্য সর্বদা লেখকের নিজস্বতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। যেখানে লেখক তাঁর নিজের উপনিবেশকেই সর্বাত্মকভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। অতীতের ফেলে আসা স্মৃতি এবং বর্তমানের আবহকে একত্রে সন্নিবেশ করে ঔপনিবেশিকতার রেখে যাওয়া দাগ মুছতে চেষ্টা করে। রফিক আজাদের চুনিয়া অতীতের কোনো সভ্যতা নয় বরং বর্তমানে আবহে গড়ে ওঠা কবির খুব পরিচিত একটি গ্রাম। রফিক আজাদ সভ্যতাকে দেখার চেষ্টা করে নিজস্ব আঙ্গিকে, যে কারণে তাঁর উপনিবেশ গড়ে ওঠে বাংলার ফেলে আসা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে। রফিক আজদের সৃষ্টি করা উত্তর-উপনিবেশ কোনো একটি বিষয়কে রেখে নিজস্বতাকে গ্রহণ নয়, বরং উপনিবেশ এবং প্রাক উপনিবেশকে একত্রে উপস্থাপন করে উত্তর-উপনিবেশের একটি নবরূপায়ণ।

রফিক আজাদ তাঁর চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যে যে রূপক, সঙ্কেত ও উপমা ব্যবহার করেন, তাই আমাদের উত্তর-উপনিবেশ চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। কোথাও কোথাও পারিভাষিক শব্দ কিংবা ইংরেজি শব্দের প্রভাব লক্ষণীয়, কিন্তু এখানে তা বিষয়ের প্রতিফলন হিসেবে আনা হয়েছে। ভাবের অবতারণা আর নিজস্বতার সম্মিলন ঘটাতেই কবির এই প্রচেষ্টা, মূলত তিনি উত্তর-ঔপনিবেশিকাতেই চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া কাব্যের কবিতাসমূহের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চান। রফিক আজাদ শেষপর্যন্ত সকল ধূসরতা মোকাবেলা করেন তাঁর দেখা কৃষক, চাষি, নদী, সেতু কিংবা সম্পূর্ণ কোনো নারীর উপমাচিত্র এঁকে। এর সবটাই তাঁর সাংকেতিক মীমাংসা। যেখানে ‘বিধবার শাদা শাড়ি’, ‘পবিত্র পুরাণ’, ‘পিদ্দিম’, ‘ধানের আঁটি’ কিংবা ‘লাঙল’ তাঁর চিরায়ত জীবনের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। আর কবি যখন এ সকল বিষয়কে ধারণ করে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেন তখন উপলব্ধি করা সহজ হয় কবি উপনিবেশকে দূরে রেখে উত্তর-ঔপনিবেশিক মননকেই প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

প্রাথমিক উৎস

রফিক আজাদ/ চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া। ঢাকা : বিভাস প্রকাশনী, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ।

সহায়ক গ্রন্থ

নুরুল করিম খসরু/ দশজন কবি। ঢাকা : শিল্পতরু প্রকাশনী, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ।

শিমুল মাহমুদ/ কবিতা শিল্পের জটিলতা। ঢাকা : গতিধারা, ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ।

দিলারা হাফিজ/ বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ। ঢাকা : বাংলা একাডেমি, ২০০২ খ্রিস্টাব্দ।

রফিকুল্লাহ খান/ বাংলাদেশের সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর। ঢাকা : একুশে পাবলিকেশন্স, ২০০২ খ্রিস্টাব্দ।

ফয়েজ আলম/ উত্তর-উপনিবেশী মন। ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৬।

ফকরুল চৌধুরী (সম্পাদিত)/ উপনিবেশবাদ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক পাঠ। ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ২০১১ খ্রিস্টাব্দ।

আল মুজাহিদী (সম্পাদিত)/ নতুন এক মাত্রা। তৃতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা। বসন্ত, মার্চ-এপ্রিল ২০১৭।

চন্দনীমহল, দিঘলিয়া, খুলনা থেকে

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

বোধনের আগেই নিরঞ্জন

Read Next

হিন্দি চলচ্চিত্র ও অবিবাহিতা মায়েদের মাতৃত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *