
জগৎ আপাত সুখের হলেও দার্শনিক প্রজ্ঞায় জগৎ বস্তুত দুঃখময়। প্রিয় বিচ্ছেদ যেমন দুঃখের তেমনি অপ্রিয় সংযোগও দুঃখের। লুম্বিনীর কাঠগোলাপের ছায়ায় মহাকারুণিক তথাগতের শেষ মানবজন্মে আবির্ভাবের আগে জগতের দুঃখময়তা, দুঃখের কারণ ও দুঃখের নিরোধের বিষয়ে অজ্ঞ ছিল মানুষ। পরম শিক্ষক, অপার করুণা সঘন গৌতমই দুঃখজয়ে মুক্তির সোপান হিসেবে আবিষ্কার করেছেন নির্বাণকে। নির্বাণের পথে অপার মৈত্রী ও করুণার চর্চায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা গৌতম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মনে ও মননে প্রতিনিয়ত বিচরণ করেছেন ঋদ্ধিময় আলোকনে। সেই আলোক উৎসের ঝর্ণাধারাতেই কখনো কখনো রবীন্দ্র রচনা হয়েছে কনকদ্যুতিময়। মানবমুক্তির ইতিহাসে গৌতমের অনন্য আলোকন প্রাপ্তির ইতিবৃত্ত রবীন্দ্র-মনন-সরোবরেও উৎপাদন করেছে প্রজ্ঞা-তরঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁর অন্তরের ভেতর সেই অন্তরতরকে খুঁজে ফিরেছেন বারংবার। ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে’ বলে রবীন্দ্রনাথের বৌদ্ধিক মনন ঋদ্ধ হয়ে অন্তরের ভেতরের নাথের স্মরণ নিয়েছেন। এ নাথ কোনো স্রষ্টা নয়, এ নাথ কোনো দেবতা নয়। এ নাথ সেই অনন্য আলোকনের অপরূপ বিভূতি, যার মাঝে প্রজ্ঞা-পারমিতার স্রোত মিলেছে সমুদ্রে নদীর উপমায়। রবীন্দ্রনাথ তাই গেয়ে ওঠেন, ‘দাও সহ্য দাও ধৈর্য্য হে উদার নাথ।’
অন্তহীন উদারতার আধার বুদ্ধ বলেছেন, ‘মাতা যেমন স্বীয় একমাত্র পুত্রকে নিজের আয়ু দিয়ে রক্ষা করে তেমনি জগতের সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী পোষণ করবে।’ এই বুদ্ধবাণী যেন সর্বদা রবীন্দ্রমননে করুণার ফল্গুধারা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ তাই রাজর্ষি উপন্যাসে পশুবলির বিরুদ্ধে, রক্তপাতের বিরুদ্ধে, অহেতুক প্রাণিহত্যার বিরুদ্ধে রাজা বীর চন্দ্র মাণিক্যকে জাগ্রত করেছেন। তিনি রাজা হয়েও তাই ঋষি, যেমন শাক্যপুত্র গৌতম, যিনি রাজপুত্র হয়েও সন্ন্যাসী, ভিক্ষুজীবনের মহান ব্রতী।
জাতপাতের ব্যবধান বুদ্ধ এসে ঘুচিয়েছেন আজ হতে আড়াই হাজারেরও অধিক বছর আগে। বুদ্ধের শিক্ষায় ক্ষৌরকার পুত্র উপালি কিংবা রূপোপজীবিনী আম্রপালিও সমান আধ্যাত্মিক অধিকার লাভ করে। কারও স্পর্শে কোনো কিছুই নষ্ট হয় না। কেউ কারও নিকট অস্পৃশ্য নয়। বরং মহাপরিনির্বাণের পূর্বে বুদ্ধ চুন্দ শুকরিক নামক অন্ত্যজ এক লোকের বাড়িতে নিমন্ত্রণের আহার খেয়ে অসুস্থ হন। তথাপি তিনি তার প্রধান শিষ্য আনন্দকে নির্দেশ দেন যাতে ঐ অন্ত্যজনের কেউ অনিষ্ট না করে। বুদ্ধের এই চর্চা রবীন্দ্রনাথ তার লেখাতে এনেছেন বহুবার। ‘গোরা’ উপন্যাসে জাতপাতের কথা ভুলে মা পথ হতে কুড়িয়ে নেন সাহেবের ঔরসে জন্ম নেয়া খ্রিশ্চান গোরাকে, তাকে কোলে পেয়ে মা ভুলেছেন তার নিত্য পূজা অর্চনার কড়াকড়ি।
বৌদ্ধিক মননে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় বলেছেন,
‘…। হেনকালে জ্বলি উঠে বজ্রাগ্নি সমান
চিত্তে তাঁর দিব্যমূর্তি, সেই বীর রাজার কুমার
বাসনারে বলি দিয়া, বিসর্জিয়া সর্ব আপনার
বর্তমান কাল হতে নিষ্ক্রমিলা নিত্যকাল মাঝে
অনন্ত তপস্যা বহি মানুষের উদ্ধারের কাজে
অহমিকা বন্দীশালা হতে।— ভগবান বুদ্ধ তুমি,
নির্দয় এ লোকালয়, এ ‘ক্ষেত্রেই তব জন্মভূমি।’
১৯১৬ সালের ১ জুন জাপানে, মুরাইয়ামার বাড়িতে চা-পানের অনুষ্ঠানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি কাগজের উপর তুলি দিয়ে লেখেন ‘নমো বুদ্ধায়’। তারপর নিজের নাম সই করে মুরাইয়ামাকে সেটি উপহার দেন। রবীন্দ্রনাথের এই সৌজন্যেও তার মননে বুদ্ধের আলোকন-মুক্তির চকমকি ঠিকরে বেরোয় যুগের আঁধার চিরে।
মহাকারুণিক তথাগতের একটি বিখ্যাত শিক্ষা হল শত্রুতার দ্বারা শত্রুকে জয় করা যায় না। মিত্রতা দ্বারা শত্রুতাকে জয় করা যায়। অক্রোধ দ্বারা ক্রোধকে জয় করা যায়। সত্য দ্বারা মিথ্যাকে জয় করা যায়। এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ করেছিলেন বিনয়ের সাথে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালে জুনজিরো তাকাসুকু টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের জাপান সফর কালে কবি ত্রিপিটকের একটি বুদ্ধবাণী সিল্কের কাপড়ের উপরে লিখে তাকাসুকুকে উপহার দেন। সেই ত্রিপিটকের বুদ্ধবাণীটি ছিল— ‘অক্কোধেন জিনে কোধং’— অর্থাৎ অক্রোধ দ্বারা ক্রোধকে জয় করা যায়। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধবাণীর চর্চা করতেন বলেই একজন দার্শনিককে মহাদার্শনিকের মহাবাণী উপহার দিতে পেরেছিলেন।
১৮ মে ১৯৩৫ সালে কলকাতা মহাবোধি সোসাইটির বৈশাখী পূর্ণিমা উদযাপনকালে রবীন্দ্রনাথ অভিভাষণ পাঠ করেন। এই অভিভাষণ পরবর্তীতে ‘বুদ্ধদেব’ শিরোনামে নিবন্ধ হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ আষাঢ় সংখ্যায় ১৩৪২ বঙ্গাব্দে। রবীন্দ্রনাথ এতে বলেছেন— ‘আমি যাঁকে অন্তরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি। এ কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের উপকরণগত অলঙ্কার নয়, একান্তে নিভৃতে যা তাঁকে বারবার সমর্পণ করেছি সেই অর্ঘ্যই আজ এখানে উৎসর্গ করি।
একদিন বুদ্ধ গয়াতে গিয়েছিলাম মন্দির দর্শনে, সেদিন এই কথা আমার মনে জেগেছিল— যাঁর চরণস্পর্শে বসুন্ধরা একদিন পবিত্র হয়েছিল তিনি যেদিন সশরীরে এই গয়াতে ভ্রমণ করেছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাইনি, সমস্ত শরীর মন দিয়ে প্রত্যক্ষ তাঁর পুণ্যপ্রভাব অনুভব করিনি?’
রবীন্দ্রনাথ ‘বুদ্ধদেব’ অভিভাষণে আরও বলেছেন, অদ্ভুত অধ্যবসায়ে মানুষ রচনা করলে বুদ্ধ-বন্দনা মূর্তিতে, চিত্রে, স্তূপে। মানুষ বলেছে, যিনি অলোক সামান্য দুঃসাধ্য সাধন করেই তাঁকে জানাতে হবে ভক্তি। অপূর্ব শক্তির প্রেরণা এল তাদের মনে; নিবিড় অন্ধকারে গুহাভিত্তিতে তারা আঁকল ছবি, দুর্বহ প্রস্তর খণ্ডগুলোকে পাহাড়ের মাথায় তুলে তারা নির্মাণ করলে মন্দির, শিল্প-প্রতিভা পার হয়ে গেল সমুদ্র, অপরূপ শিল্প সম্পদ রচনা করলে, শিল্পী আপনার নাম করে দিলে বিলুপ্ত, কেবল শাশ্বত কালকে এই মন্ত্র দান করে গেল; বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।’
বর্ণে বর্ণে, জাতিতে জাতিতে রক্তের হোলি আর ভেদবুদ্ধির নিষ্ঠুর মূঢ়তা দেখে, ধর্মের নামে রক্তে পঙ্কিল ধরাতল দেখে, পরস্পর হিংসার চেয়ে পরস্পর সাংঘাতিক ঘৃণায় পদে পদে অপমানিত মানুষকে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সর্বজীবনে মৈত্রীকে যিনি মুক্তির পথ বলে ঘোষণা করেছিলেন সেই তাঁরই বাণীকে আজ উৎকণ্ঠিত হয়ে কামনা করি এই ভ্রাতৃবিদ্বেষ কলুষিত হতভাগ্য দেশে।’ বুদ্ধের শিক্ষা রবীন্দ্রমননে সত্যিকার মানবতার বাণী ফুটিয়েছিল বিধায় রবীন্দ্রনাথ ‘বুদ্ধদেব’ অভিভাষণে আরও বলেন, ‘আজ সেই মহাপুরুষকে স্মরণ করে মনুষ্যত্বের জগতব্যাপী এই অপমানের যুগে বলবার দিন এলো, বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।’
বুদ্ধের শিক্ষায় ব্রহ্মবিহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১১ চৈত্র, ১৩১৫ এ প্রকাশিত ‘ব্রহ্মবিহার’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধবাণীকে অত্যন্ত কুশলতায় আত্মস্থ করার বর্ণনা দেন। পঞ্চশীলের চর্চা, বুদ্ধভাষিত ‘মঙ্গলসুত্ত’ রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করেন। বুদ্ধকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বহু দেবতা বহু মানুষ যাঁরা শুভ আকাঙ্ক্ষা করেন তাঁরা মঙ্গলের চিন্তা করে এসেছেন, সেই মঙ্গলটি কি? উত্তরে বুদ্ধ আটত্রিশ প্রকার উত্তম মঙ্গলের কথা বলেছেন। বুদ্ধভাষিত এই আটত্রিশ প্রকার উত্তম মঙ্গল ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথেরই মনের কথা। রবীন্দ্রনাথ তাই অতি আপ্লুত হয়ে এই উত্তম মঙ্গলসমূহের বঙ্গানুবাদ করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, বুদ্ধ মানুষের মুক্তির জন্যে গোড়া থেকেই মনকে খোঁড়া শুরু করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘পাণং ন হানে, মুসা ন ভাসে।’ অর্থাৎ প্রাণী হত্যা না করতে এবং মিথ্যা না বলতে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
বুদ্ধের মৈত্রী ভাবনা রবীন্দ্রমননে সর্বদা শান্তির প্রলেপ দিয়েছে। তাই— ‘ঊর্ধ্বে-অধোতে চারদিকে সমস্ত জগতের প্রতি বাধাহীন হিংসাহীন শত্রুতাহীন অপরিমিত মানস এবং মৈত্রী রক্ষা করবে’ —বুদ্ধের এই আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ সাড়া দেন প্রতিনিয়ত।
বৌদ্ধধর্মে ভক্তিবাদ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধকে ভক্তির লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ভক্তিই যে মুক্তির উপায় তা রবীন্দ্রনাথ নিজেও মনে করতেন। বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘ধর্মপদ’। রবীন্দ্রনাথ ‘ধম্মপদং’ প্রবন্ধে নিজেই বলেছেন, ‘জগতে যে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ আছে, ‘ধম্মপদং’ তাহার একটি। ধম্মপদের একটি মৌলিক বাণী ‘মনং পুব্বং গম্মা ধম্মা মনোসেট্টা মনোময়া।’ এই ধম্মপদের বাণী রবীন্দ্রনাথের মনে বিপুল উদ্দীপনা তৈরি করেছে। তিনি তার অনুবাদে বলেন, ‘ধর্মসমূহ মন : পূর্বঙ্গম, মন : শ্রেষ্ঠ, মনোময়।’ অর্থাৎ মন ধর্মেরও পূর্বগামী, মনই ধর্মের উৎপাদন ভূমি এবং মনই শ্রেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে ধম্মপদের এই ধর্মস্কন্ধটি অধিক বিকশিত হয়েছে বলা যায়।
১৯৩১ সালে সারনাথে ধর্মপালের উপস্থিতিতে মূলগন্ধকুটি বিহারের দ্বারোদ্ঘাটন উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ রচিত কবিতাটিতে আমরা পাই—
‘চিত্ত হেথা মৃতপ্রায়, অমিতাভ, তুমি অমিতায়ু, আয়ু করো দান।
তোমার বোধনমন্ত্রে হেথাকার তন্দ্রালস বায়ু হোক প্রাণবান।’
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বৈশাখ ১৩৪৭ এ রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছেন।
‘কালপ্রাতে মোর জন্মদিনে
এ শৈল আতিথ্যবাসে
বুদ্ধের নেপালী ভক্ত এসেছিল মোর বার্তা শুনে।
ভূতলে আসন পাতি
বুদ্ধের বন্দনামন্ত্র শুনাইল আমার কল্যাণে—
গ্রহণ করিনু সেই বাণী।’ (জন্মদিনে)
ঠাকুর পরিবারের আবেষ্টনীর মধ্যেও বৌদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা ছিল। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সত্যেন্দ্রনাথের বৌদ্ধধর্ম নামক উৎকৃষ্ট গ্রন্থখানি। বৌদ্ধসংস্কৃতির প্রতি এই যে আকর্ষণ, তা যে শুধু রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যেই প্রতিফলিত হয়েছে তা নয়। তাঁর নানা কার্যকলাপের মধ্যেও এর পরিচয় মেলে। রবীন্দ্রনাথ সেই যুগের শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের রথীন্দ্রনাথ প্রমুখ ছাত্রদের জন্য বৌদ্ধ শাস্ত্র অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেছিলেন। রথীন্দ্রনাথের ভাষ্যে, ধম্মপদ গ্রন্থখানি আগাগোড়া কণ্ঠস্থ করতে হয়েছিল এবং অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ নামক কাব্যখানি বাংলায় অনুবাদ করতে হয়েছিল। এই অনুবাদ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সংশোধিত হয়ে প্রকাশিত হওয়ার কথাও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এক সময় ধম্মপদের পদ্যানুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, তাঁর এ কাজ সমাপ্ত হয়নি। ধম্মপদের ওই অসমাপ্ত অনুবাদ বিশ্বভারতী পত্রিকায়, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৫৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’, রচিত হয়েছিল বুদ্ধের স্মরণে ১৯৩৩ সালে বুদ্ধ জন্মোৎসব উপলক্ষে। আরও একটি গান রবীন্দ্রনাথ লেখেন যা বুদ্ধদেব গ্রন্থে সংকলিত হয়—
‘সকল কলুষ-তামসহর
জয় হোক তব জয়,
অমৃত বারি সিঞ্চন কর’
নিখিল ভুবনময়।…
রবীন্দ্রনাথ চণ্ডালিকা গীতিনাট্যে বুদ্ধের প্রধান শিষ্য আনন্দ ও চণ্ডাল কন্যা প্রকৃতির কথা লিপিবদ্ধ করেন। চণ্ডাল কন্যার হাতে কেউ জল পান করে না। কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষু আনন্দ চণ্ডাল কন্যার হাতে জল পান করেন। এতে চণ্ডাল কন্যা আনন্দের প্রতি অনুরাগে আসক্ত হন। তার মায়ের মায়ার ছলনায় আনন্দকে প্রেমডোরে বাঁধতে গেলে বুদ্ধের করুণায় তারা পাপমুক্ত হন এবং ভিক্ষুণী সংঘে সমান আধ্যাত্মিক অধিকার লাভ করেন। চণ্ডালিকা গীতিনাট্য রবীন্দ্রনাথের এক অনন্যকীর্তি।
রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধ সংহতির উপাসক। তাই তিনি বলেছেন—
‘ত্রিশরণ মহামন্ত্র যবে
বজ্রমন্ত্র রবে
আকাশে ধ্বনিতেছিল পশ্চিমে পূরবে,
মরুপারে শৈলতটে, সমুদ্রের কূলে উপকূলে,
দেশে দেশে চিত্তদ্বার দিল যবে খুলে
আনন্দমুখর উদ্বোধন।’
রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য বিশ্বমনীষা, এক আশ্চর্য মানবপ্রতিভা। মহাকারুণিকের প্রতি তাঁর অনন্য ভক্তি, অনন্য নিবেদন তাঁর মননের উদারতা ও অসাধারণত্বকে প্রস্ফুটিত করেছে কল্লোলময়তায় মহামৈত্রীর উদ্বোধন ঘটিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির অঞ্জলি নিবেদনে বারে বারে বুদ্ধের মহাকরুণার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ বারে বারে বলেন—
‘পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির—
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠিছে অবিরাম,
অমেয় প্রেমের মন্ত্র বুদ্ধের শরণ লইলাম।’
তথ্যঋণ
১. রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড
২. জগজ্জ্যোতি : রবীন্দ্র মননে বুদ্ধ, সম্পাদক : হেমেন্দু বিকাশ চৌধুরী
৩. সংক্ষিপ্ত ত্রিপিটক, সুদর্শন বড়ুয়া, প্রকাশিকা : শ্রীমতী প্রভাবতী বড়ুয়া
৪. পাষাণের মৌনতটে : বিমলেন্দু বিকাশ বড়ুয়া
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া : কর্ণফুলির নিবিড় মায়ায় চরণদ্বীপ গ্রামে উনিশ শ’ তিয়াত্তরের দশ অক্টোবর জন্ম। পিতা : সুরেশ চন্দ্র বড়ুয়া, মাতা : শ্রীমতী পাখি রানি বড়ুয়া।
বর্তমান নিবাস মেঘনা— নিবিড় ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর। শৈশবে খেলাঘরের সাহিত্য বাসরে ছড়া দিয়ে লেখালেখিতে হাতেখড়ি। এরপর সাহিত্যচর্চা ধীরে ধীরে লাভ করেছে বহুমাত্রিকতা। নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন দৈনিক, ছোটকাগজ ও সংকলনে। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কুড়িটির অধিক।
প্রকাশিত বই : তোমার নিবীতে অন্য কেউ ( কাব্যগ্রন্থ, ২০০৫), আমার মায়ের সুচিকিৎসা চাই (কবিতাপত্র, ২০১০), ইলিশের বাড়ি (ছড়াগ্রন্থ, ২০১৭), শেকড়ের টানে ছড়া অভিযানে (ছড়াগ্রন্থ, ২০১৮), শোকের অর্ঘ্যে বঙ্গবন্ধু (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), প্রণয়কাব্য (কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), ব-দ্বীপ হতে বাংলাদেশ (কিশোর কাব্যগ্রন্থ, ২০১৮), ১০০ কবিতা (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), জনকের অমৃত জীবন (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০)।
সাহিত্যের জন্যে পুরস্কার ও সম্মাননা : জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ রচনা প্রতিযোগিতা, প্রথম স্থান, ১৯৮৯; সেলিব্রেটিং লাইফ গীতিকবিতা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ২০০৯, চতুরঙ্গ সম্মাননা ২০১৪, বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মাননা ২০১৯, ছায়াবাণী সাহিত্য সম্মাননা ২০১৮, নাগরিক বার্তা সম্মাননা ২০১৯, পাঠক সংবাদ সম্মাননা ২০১৫।
রচয়িতা, চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন মেলা থিম সং ২০১৮, জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনার গ্রন্থিত ছড়াকার।
সম্পাদক : সুবর্ণ-শতক (যৌথ), জ্যোতির্ময় মুজিব (যৌথ), বিতর্কায়ন, চাঁদপুর রোটারি ক্লাবের পঞ্চাশ বছর পূর্তি প্রকাশনা, শতার্ঘ্য (চরিত্রগঠন আন্দোলনের শতবর্ষ উদযাপন স্মারক প্রকাশনা)। জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’-এর অন্যতম সম্পাদক।