অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমীর আহমেদ -
শহীদুল জহিরের গল্প : জাদুবাস্তবতার কুহকবিভ্রমে মোড়ানো আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ব্যক্তির বৈচিত্র্যময় মনোজগৎ

১৯৮৫ সালে মুক্তধারা থেকে পারাপার নামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। লেখক শহীদুল হক। পরবর্তীকালে নাম পাল্টে তিনি হয়ে ওঠেন শহীদুল জহির। না, খুব বেশি গল্প লেখেননি শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮)। যা লিখেছেন, তা একেবারেই হাতেগোনা। বলা যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চেয়েও কম। ইলিয়াস গল্প লিখেছিলেন মোট তেইশটি। আর শহীদুল জহিরের গল্প সংখ্যা সাকুল্যে তেইশের চেয়ে কমই হবে। ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প-তে ৮টি, ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প-তে ৬টি (আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস বাদে, কারণ এটি ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত), পারাপার-এর মূল গ্রন্থটি এখন বাজারে পাওয়া যায় না। তবে এর থেকে ২০০৭ সালে পাঠক সমাবেশ প্রকাশিত শহীদুল জহিরের নির্বাচিত গল্প গ্রন্থে ৫টি গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তাহলে তাঁর মোট গল্প পাওয়া যায় ১৯টি। এছাড়া প্রথম গল্পগ্রন্থ পারাপার-এ কিংবা কোনো পত্রপত্রিকায় তাঁর আরও দুই একটি গল্প থাকতে পারে, যা আমার গোচরীভূত হয়নি।

যা হোক, বেঁচে থাকলে, আরও গল্প তিনি লিখতেন, লিখতেন উপন্যাসও, কিন্তু তা-ও ইলিয়াসের গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা ছাড়িয়ে খুব বেশি দূর যে অগ্রসর হতো, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ ইলিয়াস এবং পশ্চিমা দুনিয়ার আর অনেক বড় বড় কথাসাহিত্যিকের মতো তিনিও গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, লেখকের কৃতিত্ব বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধিতে নয়— নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে আপন েস্বরটি বাজিয়ে তোলার মধ্যে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে দেখে তাঁর এই বিশ্বাস হয়তো আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠেছিল। যদিও লেখার ক্ষেত্রে ইলিয়াসকে তিনি ততটা মাথায় রাখতেন না, যতটা রাখতেন, ল্যাটিন আমেরিকার নোবেল বিজয়ী, জাদুবাস্তবতার নেতৃস্থানীয় সার্থক আখ্যানশিল্পী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং আমাদের চেতনাপ্রবাহরীতির প্রবক্তা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে। মূলত জহিরের গল্পবয়নকৌশল, কাঠামোশৈলী, চরিত্রচিত্রণ ও জাদুবাস্তবতার প্রয়োগদক্ষতাই গল্পবোদ্ধাদের মনে করিয়ে দেয় মার্কেসের কথা, তারপর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর। আর পুরান ঢাকার অলিগলি ও চালচিত্র এবং উত্তরবঙ্গ তথা তাঁর জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের জন্য আসে শক্তিমান কথাকোবিদ ইলিয়াসের নাম। এঁদের দ্বারা তিনি কম-বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন, একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে এঁদের ভেঙেচুরে তিনি বাংলা ছোটগল্পভুবনে এমন এক কারুকার্যখচিত বর্ণময় উজ্জ্বল সুউচ্চ সৌধ নির্মাণ করলেন, যা কেবলই, শহীদুল জহিরের, স্বাতন্ত্র্যবৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ধী-শক্তিরই পরিচায়ক। যদিও পারাপার-এর গল্পগুলো গতানুগতিক ধারার, এতে তাঁর তেমন কোনো স্বাতন্ত্র্যসত্তার পরিচয় পাওয়া যায় না, তবে এক শক্তিমান কথাশিল্পীর আগমনের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। স্বাতন্ত্র্যভঙ্গি স্বল্পতার কারণেই হয়তো তিনি পারাপার গল্পগ্রন্থটি পুনর্মুদ্রণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। কারণ ততদিনে বাংলা ছোটগল্পভূবনে তিনি তাঁর জায়গাটি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। লিখে ফেলেছেন ‘আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’, ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’, ‘ডুমুরখেকো মানুষ’, ‘আমাদের কুটিরশিল্পের ইতিহাস’ এসব গল্প, যা আন্তর্জাতিক ছোটগল্পের অঙ্গনে যে কোনো বিবেচনায় তুল্য।

শহীদুলের গল্পের জায়গাজমিন দখল করে থাকে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবর্গের মানুষ, যারা টিকে থাকতে চায়, কিন্তু পারে না বা পেরে ওঠে না। সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের টিকে থাকতে দিতে চায় না। এখানে তারা চরম নিগৃহীত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত, হতভাগ্য মানুষ। এই সব মানুষের জীবনযাপন, কথনশৈলী, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃষ্ট ফাঁদে পড়ে তাদের অস্তিত্ব সংকটের তীব্রতা তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন, বর্ণনাত্মক গল্পবয়ানরীতি এবং অল্পস্বল্প ডায়লগ নির্মাণের মাধ্যমে। প্রমিত এবং কথ্যভাষার সংমিশ্রণে নির্মিত তাঁর গদ্যশৈলী আমাদের দৃশ্যমান জীবন ও সমাজবাস্তবতার অন্তর্কাঠামো এমনভাবে উন্মোচন করে দেয়, আমরা হতবাক বা বিমূঢ় হয়ে যাই, মানুষের মনোজগতের লোভ ও লিবিডোপ্রবৃত্তিজাত তাড়নার বৈচিত্র্যময়তায়, শোষিতের প্রতি শোষকের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতায়। বস্তুত সমাজ ও রাষ্ট্রে নিত্য ঘটমান অসঙ্গতির অন্তর্ক্ষত, ক্ষমতা ও স্বার্থতাড়িত শোষকের সন্ত্রাসের নগ্নরূপ, নরনারীর প্রেম, যৌনতা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন এবং অস্তিত্বের টানাপোড়েনের আদিঅন্ত মোহময় জটিল মোড়কে তুলে ধরেছেন তিনি।

তাঁর গল্পের আরেকটি প্রধান অনুষঙ্গ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরে, তাঁর প্রত্যক্ষিত ঘটনাগুলোই টুকরো টুকরো হয়ে চিত্রিত হয় গল্পে, নিরাবেগ নিষ্ঠুরতায়। ‘গতানগতিক ধারায় উপস্থাপনার পরিবর্তে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও দার্শনিকতায় তিনি বয়ান করেছেন, যা আমাদের আলোড়িত, ভাবিত, তাড়িত ও চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে।’ [[ডুমুখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প : শিল্পের চতুর্মাত্রিকতা : মিহির মুসাকী, লোক] এ কথা শুধু তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ক্ষেত্রেই খাটে না। অন্য গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও বলা যায়।

গল্পবলার প্রচলরীতিকে উপেক্ষা করে, ভিন্নতর বয়ানভঙ্গির ভেতর দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন কুয়াশার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। এ প্রাচীর ভেদ করতে গেলে পাঠকের কিছুটা মগজের প্রয়োজন পড়ে। সব পাঠক তাঁর গল্পপাঠের রস আস্বাদন করতে পারবে না। ‘তবে যেহেতু জহিরের ভাষাটি বেশ সহজ এবং (সিনট্যাক্স) প্রায় কথ্য ঢঙের কাছাকাছি, সর্বোপরি একটা চাপা হিউমার তাতে বিরাজমান থাকে, সেকারণে গল্পটি শেষ না করেও পাঠক স্বস্তি পায় না। পাশাপাশি গল্পে নানান মাত্রার রূপক ও ইলিউশন ব্যবহার করে জহির গল্পকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় দাঁড় করান। সব মিলিয়ে প্রথাগত গল্পের তুলনায় জহিরের গল্প অনেক বেশি স্ক্যাটার্ড।’ {শহীদুল জহিরের গল্প : ‘আটকে-পড়া’ বাঙালির বহুমাত্রিক যুদ্ধ ও আশাভঙ্গের কহনকথা, লোক, শহীদুর জহির সংখ্যা, ২০০৮] তাঁর গল্পের জমিনে নামলেই তা টের পাওয়া যায়। যেমন—

‘আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ (১৯৯২) গল্পটির আখ্যান, আগারগাঁর কলোনির বাসিন্দা চাকরিজীবী আবদুস সাত্তার এবং তার স্ত্রী প্রকৃতি আসক্ত শিরিন বানুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গল্পটির শুরু এ রকম—

‘আবদুস সাত্তার বাসায় ফিরছিল; তালতলায় বাস থেকে নেমে বিকেলের নরম আলোয় পায়ে হেঁটে যখন তার কলোনির বাসার দিকে আসছিল তখন কেউ কেউ তাকে দেখছিল, যদিও শীর্ণ এবং কালো রঙের একজন মধ্য-বয়স্ক কেরানির অপিস শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তনের এই নিত্যদিনের ঘটনা তাকিয়ে দেখার মতো কিছু ছিল না।’

এভাবে সরলভঙ্গিতে গল্পটি আরও কিছুদূর এগোতে থাকে। কাদাপানিতে আছাড় খেয়ে আবদুস সাত্তার বাসায় ফেরে। সেখানে আমরা তার স্ত্রী শিরিন বানুকে দেখতে পাই, যার কিনা রয়েছে নিবিড় নৈসর্গপ্রীতি। সে ‘বাসাটির সর্বত্র টবে লাগানো রকমারি গাছে ভরে তোলে; বারান্দায় নয়নতারা এবং পাতাবাহার গাছের সঙ্গে রজনীগন্ধার চারা লাগায়।’ তার ‘প্রশ্রয়ে তাদের বাসার প্রতিটি দরজায় ঢলো ঢলো পাতাবাহারের বিস্তার ঘটে; বইয়ের তাক আর খাটের মশারিস্ট্যান্ডের ওপর থেকে ঝুলে থাকে সবুজ সাপের মতো মানিপ্লান্টের শাখা।’ থাকে গুল্মজাতীয় ক্যাকটাস। কলোনিতে আসার পর শিরিন বানু ‘চার বছর যাবৎ টবে গাছ জন্মানোর শিল্পের চর্চার চরম বিকাশ ঘটায়’ এবং তা ‘তাদের সীমানা অতিক্রম তাদের প্রতিবেশীদের গৃহে ছড়িয়ে পড়ে।’ এর ফলে ‘কলোনির এই সকল রমণী এবং তাদের পুরুষেরা জীবনের সৌন্দর্যকে শেষপর্যন্ত আষ্কিার করতে শেখে, অর্থহীন এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের বৃক্ষময় অর্থময়তা খুঁজে নেয়,’ অথচ এর মধ্যে আবদুস সাত্তারের সম্পৃক্ততা তেমন লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে না। এরপর আগারগাঁর কলোনির পাশে বিমানবন্দর থেকে একদিন ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি এসে আগারগাঁর কলোনির এই ভবনের সামনে এসে নয়নতারা ফুলকে ঘিরে নাচতে থাকে। বারান্দায় প্রজাপতির ভিড়ের মধ্যে অবস্থান করে আবদুস সাত্তার। এখান থেকেই গল্পটির জাদুবাস্তবতা এবং জটিলতা শুরু হয়। এই দৃশ্যচিত্রে গল্পের প্রধান চরিত্র ‘আবদুস সাত্তার একটি অজর এবং অবশ্যম্ভাবী প্রস্তরখণ্ডের মতো নিশ্চল অস্তিত্ব নিয়ে জেগে থাকে’। কেন তার এভাবে জেগে থাকা? এ প্রশ্নের উত্তর এতো তাড়াতাড়ি এবং এতো সহজে মেলে না। এ জন্য পাঠককে ঘনঘোর রহস্যের ভেতর দিয়ে ক্রমাগত এগোতে হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালা বদল ঘটে। তখন হয়তো সচেতন পাঠক নয়নতারা ফুল এবং প্রজাপতির রহস্যের একটা কূলকিনারা করতে পারে। হয়তো তখন তারা বুঝতে পারে এই নয়নতারা ফুল হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীক এবং পঁচাত্তর-উত্তরকালে এই ক্ষমতাকে ঘিরে প্রজাপতিরূপী ক্ষমতালোভী রাজনীতিক এবং সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলাজনিত অবস্থারই ইঙ্গিত করেছেন জহির। সামরিক শাসনামলেই শুরু হয় ইতিহাস বিকৃতি। প্রকৃত ইতিহাস চেপে রেখে তাতে মিথ্যা, বানোয়াট, অসত্য তথ্য ঢুকিয়ে দিয়ে, প্রকৃত ইতিহাস থেকে মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া অন্যদিকে। জেনারেলদের এই ইতিহাস সংস্কারই হয়তো মিরপুর চিড়িয়াখানার আধুনিকীকরনের প্রতীকী হয়ে উঠেছে শহীদুলের গল্পে। এরপর আবদুস সাত্তারের বারান্দায় বারবার গোলাপ উড়ে এসে পড়ার নামে জহির তৈরি করেন আরেক রহস্যের ঘোর। তার পর্দাও তিনি কিছুক্ষণ পর ছিঁড়ে ফেলেন। তবে আরেক রহস্য সৃষ্টি করে। তখন এই গোলাপ হয়ে ওঠে ক্ষমতাসীন জেনারেলের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নয়, চাটুকারিতা। তবে জেনারেল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না। এ কারণেই প্রজাপতি এবং গোলাপের মধ্যে থেকেও তার সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। একদিন এক আকস্মিক ভূমিকম্পে ‘শহরের সাতাশটি দালানে ফাটল ধরে, রামপুরায় জলার ধারের একটি দালান কাত হয়ে যায় এবং আগারগাঁ কলোনিতে সকল নয়নতারা গাছ এবং আবদুস সাত্তার ভূপতিত হয়। আবদুস সাত্তারের মাথার খুলি থেঁতলে গলার ওপরের প্রান্তে একটি রক্তাক্ত ব্যাঙের ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে, তার মগজ গলে মাটিতে মিশে যায়। আবদুস সাত্তরের দাফন হযে যাওয়ার পর কলোনির শোকার্ত লোকেরা তাদের ধরাশায়ী নয়নতারা গাছগুলো পুনরায় রেলিঙয়ের ওপর তুলে দেয়, কেবলমাত্র বিধবা শিরীন বানুর গাছগুলো নিচে মাটিতে পড়ে থাকে। কয়েকদিন পর গাছগুলো পুনরায় সতেজ হয়ে ওঠে এবং প্রজাপতিরা ফিরে আসে, তখন শিরীন বানু একটু সুস্থ হয়ে ওঠে এবং মাটি থেকে তার নয়নতারা গাছগুলো তুলে এনে নূতন পটে লাগায়; কিন্তু তার এই গাছগুলো রেলিঙের ওপরে সতেজ হয়ে ওঠার বদলে দ্রুত মরে যেতে থাকে।’ এপর চারাগুলো বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হলেও বাঁচে না। কেবলমাত্র আবদুস সাত্তারের রক্ত যেখানে মিশে গেছে, সেখানেই নয়নতারার চারা জীবিত হয়ে ওঠে। তারপর শুকিয়ে মরে যায়। এই রহস্যের কোনো কিনারা করতে পারেন না কৃষি কলেজের প্রবীণ অধ্যাপকও। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর তিনি বলেন যে গাছগুলো স্রেফ আত্মহত্যা করে। তাঁর এই বক্তব্য যে মোটেও বিজ্ঞানসম্মত নয়, তা তিনি নিজেও স্বীকার করেন। তার শেষ পরামর্শ, ‘প্রজাপতি ও মাটির বিষয়ে সাবধান থেকে চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে হয়তো এখানে পুনরায় নয়নতারা ফুল দেখা যাবে।’ তাহলে শেষপর্যন্ত এই নয়নতারা ফুলগাছ শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীকই হয়ে উঠল না; হয়ে উঠল আমাদের প্রকৃত গণতন্ত্র বা স্বাধীনতার প্রতীকও! আগারগাঁ কলোনিতে নয়নতারা কেন ফোটে না, এই রহস্য উদ্ঘাটিত হলেও, গোবেচারা সরকারি কেরানি আবদুস সাত্তারের চরিত্রটির রহস্য স্পষ্ট না হয়ে আরও দুর্ভেদ্যই থেকে যায় পাঠকের কাছে।

‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ (১৯৯২) গল্পটিও জাদুবাস্তবতার রহেস্য মোড়া। দাঁড়কাককে কেন্দ্র করেই এর রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। গল্পের প্রধান চরিত্র সমাজের নিম্নবর্গীয় শ্রেণির নিতান্ত সরল প্রকৃতির ভূমিহীন কাঠুরে আকালু ও টেপি। সিরাজগঞ্জের বৈকুণ্ঠপুরে পরের জমিতে তাদের বাস। দু’জনেরই গায়ের রঙ কালো এবং স্বাস্থ্য খারাপ। দারিদ্র্যের মধ্যেও খেয়ে না খেয়ে তারা উভয়ে সুখেই ছিল বোধহয়। যদিও টেপির মধ্যে কিছুটা পাগলামির স্বভাব লক্ষ করেছে আকালু। মাঝে মাঝে একা একাই বিড়বিড় করে; তারপরও তাকে সে ভালোই বাসত। তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। দুজনের সংসারে, হঠাৎ একদিন সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের প্রতীক হয়ে আসে দাঁড়কাক। এই দাঁড়কাকের সাথেই টেপির বড় ভাব জমে ওঠে। আকালু কাঠের গুড়ি চেরাই করতে যেতে না চাইলেও, দাঁড়কাক আদিষ্ট টেপির অনুরোধে সে গাছের গুড়ি চেরাই করতে যায়। কুড়াল দিয়ে কাঠ চেরাই করতে করতে আকালু খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শেষমেশ গুড়ির ফোকরে একটি টাকার থলে পায়। প্রায় লাখ টাকার মতো। এত টাকা আকালু কোনোদিন দেখেনি। তাই সে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। এত টাকা দিয়ে সে কী করবে, দিশা পায় না। তাই জুতসই পরামর্শের জন্য সিরাজগঞ্জ শহরে যায় একজন উকিলের খোঁজে। উকিলের সন্ধানদাতা সিগারেট বিক্রেতা ও ধুরন্ধর উকিলের দ্বারা প্রতারিত হয়ে সে প্রাপ্ত টাকা, সবই খোয়ায়। ঘটনা জানাজানির আশঙ্কায়, ভূস্বামী ও থানা-পুলিশের ডরে সে টেপিকে নিয়ে পালিয়ে ঢাকা শহরে যায়। সেখানে দেখা মেলে এক বাল্যবন্ধুর সাথে। সে তাদের নিয়ে তোলে বস্তিতে। আকালু বেছে নেয় রিকশা চালানো পেশা। ভালোই চলছিল তাদের। কিন্তু এখানেও এসে হাজির হয় সেই দাঁড়কাক। কোনো অঘটনের ভয়ে আকালু ভীত হয়ে পড়ে। কিন্তু নিয়তিকে সে মেনে নেয়। কদিন পর এক যাত্রী তার রিকশায় টাকাভর্তি একটা মানিব্যাগ ফেলে দ্রুতগামী একটা বাসে উঠে পড়ে। সততা ও পূর্বের অভিজ্ঞতালব্ধ আকালু অঘটনের ভয়ে, সেই টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য থানায় যায়। থানা-পুলিশ তার সব অর্থ ছিনিয়ে তো নেয়ই, বরং উল্টো তাকে আরও টাকা দেওয়ার জন্য অমানুষিক নির্যাতন করে। নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্যই সে তাদের সাজানো নাটকের মহড়ায় অংশ নিতে বাধ্য হয়। চোর না হয়েও চুরির কথা সে অকপটে স্বীকার করে। থানা-পুলিশ তাকে আরও বেশি টাকা দাবি করে তার ওপর নির্দয় চাপ সৃষ্টি করে। তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষপর্যন্ত পুলিশের সাজানো মামলায় আকালু সস্ত্রীক জেলে যায়। সেখানেও দাঁড়কাক গিয়ে হাজির হয়। তার সেলে স্বর্ণের আংটি ফেলে গণ্ডগোল পাকিয়ে তোলে। জেলার সাহেব আকালুর কাছে সব শুনে, আংটিটা রেখে তাকে ছেড়ে দেন। চার মাস জেল খাটার পর আকালু এবং টেপি জেল থেকে মুক্তি পায়। তারপর তারা আশ্রয় পায় জেলার সাহেবের মগবাজারের নয়টোলার একখণ্ড জমির মাঝখানে নির্মিত একটা ঝুপড়িঘরে। এখানে এসে আকালু কামলা খাটার কাজ নেয়। আর টেপি বেছে নেয় বাসাবাড়ির ঝি-এর কাজ। এখানেও সেই কাক এসে হাজির হয়। তখন আকালু আর টেপি, ‘তাদের ভবিতব্যকে মেনে নেয়; দুজনে কাজ করে উপার্জিত পয়সা দিয়ে আকালু বড় বড় বোরাক বাঁশ কিনে আনে এবং তাদের প্রাঙ্গণজুড়ে মাথার ওপর দিয়ে একান্নটি লাইনে, প্রতিটি লাইনে তেরটি করে সর্বমোট ছয়শ তেষট্টিটি আড়া বেঁধে দেয়।’ এরপর দিনের পর দিন এখানে কাকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ‘আকালু দিনমজুরি এবং টেপি বাসায় ঝি-এর কাজ করে সন্ধ্যায় যখন বাসায় ঘরে ফেরে তখন তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক তাদের বাঁশের উন্মুক্ত খাঁচায় ফিরতে থাকে।’ মহল্লার লোকেরা প্রথমে কাকের ব্যাপারে নির্বিকার থাকলেও পরে সচেতন ও ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে, যখন ‘কাকের বাসা ভেঙে আকালু সাড়ে আঠারো মণ সাইকেলের স্পোক, লোহার তার, ইস্পাত খণ্ড বিক্রি করে’। এরপর টেপি মহল্লার রাস্তার ঝাড়ুদারনি নিমফল দাসীকে বাসায় ডেকে নিয়ে কাকের ডিমের ভাজি খাওয়ায়ে বিদায়ের সময় ‘কাকের বাসায় পাওয়া একজোড়া সোনার দুল বের করে’ দিলে মারাত্মক বিপত্তি ঘটে। মহল্লার লোকেরাও আকালু আর টেপির কাছে অনুরূপ সোনার দুল দাবি করে। কেউ কেউ নিজ বাড়িতে কাকের চাষ করতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। সোনার দুল না পেয়ে তারা আকালু আর টেপির ওপর ক্ষেপে যায়। উত্তেজিত জনতার ভয়ে তারা বাইরে বের হয় না। ঝুপড়িঘরেই অবস্থান করে। কেউ কেউ বাড়ির ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু কাকের ঠোকর খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তখন তারা আকালু আর টেপিকে অবরোধ করে রাখে। দিনের পর দিন চলে যায়, তারপরও আকালু আর টেপি বাইরে বের হয় না। তারা কাকের ডিমের ভাজি খেয়ে বেঁচে থাকে। ত্রিশতম দিনে উত্তেজিত অবরোধকারীরা গভীর রাতে ‘আকালুর বাসার চারদিকে শুকনো ঘাস পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আগুন, তাপ আর ধোঁয়া বাড়িটাকে গ্রাস করতে থাকলে কাকেরা ‘বাঁশের আড়া ত্যাগ করে’ চলে যায়। ভোরবেলা সম্পদলোভী মহল্লাবাসী প্রাচীর ভেঙে আকালুর বাসার ভেতরে প্রবেশ করে এবং দেখে যে, ভেতরে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই। সোনার দুলের লোভে তারা ‘ছোট্ট কুঁড়েঘরের বেড়ার প্রতিটি বাঁশের গিট চিরে পরীক্ষা করে, মেঝের মাটি খুঁড়ে উলটপালট করে, কিন্তু তারা সেখানে কিছুই পায় না।’ তখন তারা মনে করে যে বিপুল সম্পদরাজি নিয়ে আকালু আর টেপি পালিয়ে গেছে। কিন্তু এমন একটানা একটা অবরোধ ভেঙে তারা পালিয়ে যেতে পারে, একথা তাদের অনেকেই বিশ্বাস করতে পারে না। বিভ্রান্তিতে পড়ে। তারপর আকালু আর টেপির অন্তর্ধানের ব্যাপারে তারা নিজেরাই একটা মনগড়া গল্প তৈরি করে যে, কাকেরা উড়ে যাওয়ার সময় আকালু আর টেপিকে ঠোঁটে করে নিয়ে গেছে। তাদের এই গল্পকে আরও বশ্বিাসযোগ্য ও রহস্যময় করে তোলে রামপুরায় নৌকার পাটাতনে শুয়ে থাকা লোকেরা। তারা নাকি ‘আকাশের আবছা আলোয় উড়ন্ত পাখিদের ভিড়ে’ ‘দুটো মানুষের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে’ উঠে ‘রামপুরার ঝিলের ওপর দিয়ে ধলেশ্বরীর কুয়াশার ভেতর উড়ে’ যেতে দেখেছিল। তারপর নাকি ঢাকা শহর বহুদিন কাকশূন্য থাকে।

এই গল্পের রহস্য কতটুকু ভেদ করা সম্ভব পাঠকের পক্ষে? আপাতত আমরা ধরে নিতে পারি, বুর্জোয়া সমাজে নিম্নবর্গীয় মানুষের চরম অস্তিত্ব সংকটের কথা। তাদের অস্তিত্বহীন করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আর এক্ষেত্রে আমরা ফ্রান্স কাফকার ‘দি ট্রায়াল’ উপন্যাসের কে চরিত্রটির কথা স্মরণ করতে পারি। ব্যক্তিজীবনকে দুর্বিসহ ও নিরস্তিত্ব করে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত যে কতোটা লম্বা ও শক্তিশালী তা এই উপন্যাসটি পড়লে উপলব্ধি করা যায়।

পাখি ও মনুষ্য সমাজে শ্রেণি বিবেচনায় কাক এবং আকালুরা সমশ্রেণি বা নিম্নগোত্রীয়। বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নিম্নবর্গীয় মানুষের জন্য শোষণ ও বঞ্চনার ফাঁদ পাতা থাকে। নিম্নবর্গের মানুষরা ইচ্ছে করলেও এর থেকে মুক্তি পেতে পারে না। শেষমেশ নিয়তির কাছে হার মানতে তারা বাধ্য হয়। আকালু আর টেপি ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। সমাজ ও রাষ্ট্রে নিগৃহিত, শোষিত ও বঞ্চিত হতে হতে তারা পরিণত হয়েছে স্বপ্নহীন, খোলস মানুষে। এ সমাজে টিকে থাকতে গেলে যে পরিমাণ চতুরতা ও বুদ্ধির দরকার, তা তাদের নেই। এ কারণে কাক তাদের সমব্যথী এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে এলেও তারা নিজেদের ভাগ্যকে বদলাতে পারে না। ক্রমাগত নিরস্তিত্বের দিকেই তাদের যাত্রা। এ যাত্রার শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। বুর্জোয়াবাদীরা এই সব মানুষকে নেয় খেলার পুতুল হিসেবে। নিজেদের প্রয়োজনে তারা তাদের টিকিয়ে রাখে কিংবা নিরস্তিত্ব করে ফেলে। গল্পে জেলারের চরিত্রটি বেশ রহস্যময় ও প্রশ্নবিদ্ধ। তারই বাড়িতে এতকিছু ঘটার পরও গল্পে তাকে আর কোনো ভূমিকায়ই পাওয়া যায় না। এর কারণ কী? জেলার হিসেবে সে কি তাদের তার জায়গায় একধরনের নির্বাসন দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে? এই রহস্য অভেদ্যই রয়ে গেল।

‘ডুমুরখেকো মানুষ’ (১৯৯২) গল্পে শহীদুল জহির আমাদের আরেক রহস্যময় স্বপ্নের জগতে নিয়ে যান। দুর্ভেদ্য রহস্যের পর্দা তিনি বুনে যান জাদুকর মোহাব্বত আলিকে দিয়ে। না, মোটেও অপরিচিত লোক নন মোহাব্বত আলি। আমাদের শহরের ফুটপাতে, অলিগলিতে, গ্রামগঞ্জের হাটবাজারে মোহাব্বত আলির মতো অনেক লোক এখনও গান শুনিয়ে কিংবা জাদু দেখিয়ে মজমা জমিয়ে গাছগাছড়ার ঔষধ, তাবিজকবজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু মোহাব্বত আলি, এ গল্পে, হাড্ডি দিয়ে জাদুপ্রদর্শন করলেও সে তাদের মতো ঔষধপত্তর কিংবা তাবিজকবজ বিক্রি করে না। জমায়েত লোকজনকে জাদুর কসরত দেখিয়ে মুগ্ধ করে। একখানি হাড়ের সাহায্যে সে তাদের নাক, কানসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে পয়সা বের করে আনে। তারপর সে তাদের বলে যে, ‘সে মূলত একটি ফলই বিক্রি করে এবং এই ফলটির নাম হচ্ছে ডুমুর’। তারপর সে ডুমুর বের করে দেখিয়ে বলে, ‘এইটারে কয় জগডুমুর, এই দ্যাশের বনে জঙ্গলে হয়।’ ‘ফরাশগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ঘেঁষে তার একটি প্রাসাদ আছে, সেখানে সে তার স্ত্রী প্রীতিলতাকে নিয়ে বাস করে’। তাদের সাথে আরও একজন থাকে, তার নাম আবদুল। প্রাসাদের পেছনে রয়েছে তার যোজনবিস্তৃত ডুমুর বাগিচা। সেখানে ‘হলুদ রঙের গোল গোল পাকা ডুমুরের গুচ্ছ ঝুলে থাকে; তারা তিনজন শুধুমাত্র এই ডুমুর খেয়ে বাঁচে, তারা আর কিছুই খায় না’। বাড়তি ফল বিক্রি করে তারা তাদের ‘কাপড়চোপড় কেনে আর কেনে বাতির জন্য কেরোসিন, কারণ, তাদের প্রসাদে বিদ্যুৎ নেই। প্রথমে পঁচিশটি ডুমুর সে বিনা পয়সায় বিতরণ শুরু করে। তারপর, বয়স্কদের কাছে দুই টাকায় পঁচিশটি করে ডুমুর বিক্রি করে। যারা একবার তার ডুমুর খেয়েছে তাদের নাম সে ভুলে না। পরবর্তী সময়ে ডুমুরের জন্য তাদেরকে ডুমুরের জন্য বেশি মূল্য দিতে হবে। এজন্য তাদের উচিত কম করে ডুমুর খাওয়া, ‘যাতে করে কিছু ডুমুর জীবনের শেষপর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে।’

পাঁচজন ডুমুরখেকো, যারা তাদের ফলগুলো খুব দ্রুত খেয়ে ফেলে, পরবর্তীকালে চড়া মূল্যের কারণে তারা আর ডুমুর ফল কিনতে সক্ষম হয় না। তাই তারা জাদুকর মোহাব্বত আলির কাছ থেকে ডুমুরের চারা কিনতে চায়। প্রতিটি চারার জন্য তারা হাজার টাকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু মোহাব্বত আলি এতে রাজি হয় না। তাই এই পাঁচজন ডুমুরখেকো মানুষ একদিন সকালে শ্যামবাজারের দক্ষিণে জাদুকর মোহাব্বত আলির প্রসাদে প্রবেশ করে। প্রসাদের সবকিছুই তারা অরক্ষিত দেখতে পায়। কিন্তু ডুমুরের বাগান দেখতে পায় না। তখন তাদের মনে হয় যে, যোজনবিস্তৃত বাগান প্রাসাদের পেছনে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা তারা খুঁজে পায় না। তাই তারা মোহাব্বত আলিকে উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে। তখন মোহাব্বত আলি তাদের ভেতরে যেতে বলে। মোহাব্বত আলির সামনে গিয়ে তারা আবারও ডুমুর গাছ কেনার প্রস্তাব দেয়। তখন মোহাব্বত আলি তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘ডুমুরের গাছ বিক্রি হয় না, তাদের ফিরে যেতে হবে’। তারপরও তারা তাকে বারবার অনুরোধ করতে থাকলে সে ক্রোধে ফেটে পড়ে, তাদের প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে বলে। তখন ‘পাঁচজন অপরিণামদর্শী ডুমুরখেকোর চেতনায় ওলটপালট ঘটে যায়’ এবং তারা তাকে হত্যা করে ডুমুরের বাগানের দিকে এগোয়। তখন ‘চির চির শব্দ করে একটি ডিমের খোসার মতো ইমারতটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়।’ যে-ভাগে তারা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে সিংহ দরোজায় এসে পেছন ফিরে তাকিয়ে তারা প্রাসাদটির কোনো চিহ্নই আর খুঁজে পায় না। তখন তাদের সবকিছু স্বপ্নের মতো হলেও গায়ে রক্তরঞ্জিত জামা দেখে তারা বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারে না। আতঙ্কগ্রস্ত এই পাঁচজন ডুমুরখেকো মানুষ, তারপর, বাড়ি ফিরে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তাদের প্রত্যেকের স্বজনেরা যখন তাদের খোঁজ করে, তখন তাদের কাউকে আর খুঁজে পায় না। বিছানার চাদর সরিয়ে ফেললে তারা শাদা একখণ্ড হাড় দেখতে পায়। ‘এখন মহল্লার এই সব লোকেরা ডুমুর ভক্ষণকারী এইসব লোকের কথা বলে, তারা তাদের ডুমুর খাওয়ার আনন্দ এবং বেদনার কথা বলে, এবং তারা তাদের অপরিণামদর্শিতার কথা বলে।’ জাদুবাস্তবতার মোড়কে টান টান উত্তেজনাপূর্ণ ঠাসবুনোটের গল্পই বটে। কিন্তু এর দ্বারা কী বোঝাতে চেয়েছেন শহীদুল জহির? পাঠককে তখন ভাবতে হয়। গল্পটির পুনর্পাঠ প্রয়োজন পড়ে তার, কিংবা পড়ে না। তবে তাকে তাকাতে হয় আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাসের দিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দিকে। তখন জাদুকর মোহাব্বত আলিকে কী সহজেই না মিলিয়ে ফেলা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। অপরিণামদর্শী পাঁচজন ডুমুর খেকো মানুষকে চিহ্নিত করাও তখন দুঃসাধ্য নয় আর। একটি প্রাসাদ ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার চিত্রও আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে— দ্বিধাবিভক্ত জাতির দুটি ধারা— স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি। বাস্তবতার ভেতর থেকে মোহাব্বত আলিকে তুলে এনে ক্রমান্বয়ে জাদুবাস্তবতার মোড়কে তাকে মুড়িয়ে ফেলে শহীদুল জহির, অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে, আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেন বাস্তবতার অতল গভীরে, অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের দিকে। এতে আমরা পুনর্বার হতবিহ্বল হযে পড়ি।

‘এই সময়’ (১৯৯৩) গল্পটিতে নরনারীর চিরকালীন হৃদয়াবেগের পাশাপাশি, আমাদের সমাজের অন্তর্গত লালসাময় কুৎসিত, বীভৎস রূপটি উন্মোচিত হয়েছে। মাস্তানি বা পেশিশক্তির কাছে প্রেম-ভালোবাসা বা হৃদয়াবেগ অর্থহীন, সত্য উচ্চারণে সমাজের মানুষ কতটা যে অসহায়, তা এই গল্প পড়লে বোঝা যায়।

গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রাজুয়েট হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র পিতৃমাতৃহীন মোহাম্মদ সেলিম। দাদির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সে বেড়ে ওঠে। মা-বাবার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে বাড়িতেই গড়ে তোলে ফুলের বাগান। কিন্তু মহল্লার মানুষ এলার্জিতে আক্রান্ত হলে, তারা ধারণা করে যে এই ফুলবাগানের কারণেই তাদের এলার্জি হচ্ছে। তখন, একদিন মহল্লার মাস্তান তিন ভাই আবু, হাবু আর শফি এসে মোহাম্মদ সেলিমের ফুলের বাগান ধ্বংস করে দিয়ে যায়। পরে মহল্লাবাসী বুঝতে পারে যে এই এলার্জির উৎস ফুলের বাগান নয়, হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি। এরপর মহল্লায় আগমন ঘটে আজিজ মিয়ার বিধবা কন্যা শিরীন আক্তারের। তার রূপ-যৌবনের আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে থাকে মহল্লার বিপত্নীক এরশাদ সাহেব, মেজর ইলিয়াছ, মাওলানা জব্বার ও মাস্তান ভ্রাতৃত্রয়। তারা প্রত্যেকেই শিরীন আক্তারকে পাওয়ার জন্য নিজেদের কামনা-বাসনা ও প্রেমের কথা তাকে বলতে থাকে। মাস্তান ভ্রাতৃত্রয় জানতে পারে যে শিরীন আকতার ফুল পছন্দ করে। এ কারণে তারা মোহাম্মদ সেলিমকে নির্দেশ দেয় প্রতিদিন শিরীনকে ফুল পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। তাদের নির্দেশ আমান্য করার কোনোরকম উপায় থাকে না সেলিমের। সে প্রতিদিন শিরীন আকতারকে ফুল দেওয়ার জন্য তার বাসায় যায়। এভাবে যাওয়া-আসা করতে করতেই, বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও, শিরীন আক্তারের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপর একদিন মাস্তান তিন ভাই আজিজ মিয়ার ঘরে প্রবেশ করে মোহাম্মদ সেলিমের বাহুর ভেতর সুন্দরী শিরীনকে চুম্বনরত দেখতে পেলে ক্রোধে ফেটে পড়ে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা মোহাম্মদ সেলিমকে সেই বাড়িতে আটকে রেখে, তৎক্ষণাৎ কাজি ডেকে এনে, আবুর সাথে শিরীন আক্তারের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শিরীন আকতার বিয়েতে কবুল না বলা সত্ত্বেও তারা জোর করে তাকে বিয়ে করে। তারপর ‘ঘর খালি হলে মেঝভাই হাবু শার্টের কলার ধরে তাকে টেনে ওঠায়, এবং মান্দার পোলা, এইটা তর মা লাগে, যা সালাম কর, বলে ধাক্কা দিয়ে শিরীন আক্তারের সামনে ফেলে দেয়।’

‘পরদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাওয়ার সময় মহল্লার লোকেরা শিরীন আক্তারদের বাড়ির সামনে লাইট পোস্টের সঙ্গে ভোরের প্রকাশ্য আলোর ভেতর, শিরীন আকতারের প্রেমিক এবং গ্রাজুয়েট হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ সেলিমের মৃতদেহ ঝুলে থাকতে দেখে।’ এই মৃত্যুর ব্যাপারে থানা-পুলিশ এলে এরশাদ সাহেব, মওলানা জব্বার, মালেকা বানু, মেজর ইলিয়াছ, তারা সকলে, তাদের কাছে মাস্তান ভ্রাতৃত্রয়কে ভালো ছেলে হিসেবে সাক্ষ্য দেয়। মহল্লাবাসীও এ ব্যাপারে কোনোরকম উচ্চবাচ্য করতে সাহস পায় না। সবকিছু বুঝেও থানাপুলিশ নির্বিকার থাকে। এভাবেই গল্পে পেশিশক্তির কাছে পরাজিত হয় প্রেম, মানবিকতা, সত্য ও ন্যায়ের। আধুনিক উৎপাদনশীল ব্যবস্থায় প্রকৃতির বিপর্যস্ত রূপটিও আর অস্পষ্ট থাকে না। শহুরে হৃদয়হীন ভোগবাদী মানুষের কাছে প্রেম-ভালোবাসার প্রতীক ফুল হয়ে পড়ে নিতান্তই অর্থহীন।

‘মনোজগতের কাঁটা’ (১৯৯৫) গল্পে আমরা আজিজ ব্যাপারির ভাড়াটিয়া সুবোধ চন্দ্র ও স্বপ্নাকে বারবার কুয়োর মধ্যে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে দেখি। প্রথমবার তারা পাতকুয়োর মধ্যে পতিত হয় ১৯৭১ সালে অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময়। তখন পাকিস্তানি মিলিটারি ও রাজাকাররা হিন্দু নিধন শুরু করলে, জীবন রক্ষার্থে সুবোধ চন্দ্র কলেমা মুখস্থ করে এবং মাথায় টুপি পরে মুসলমানের বেশ ধরে। তাতেও তার শেষরক্ষা হয় না। একদিন আবুবকর মওলানার নেতৃত্বে রাজাকাররা তাকে ধরে এনে মুসলমানিত্ব প্রমাণের জন্য পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের সামনে এনে অন্যদের সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন তাদের প্রত্যেককে কলেমা জিজ্ঞেস করে, উত্তর সঠিক হলেও তারা রেহাই পায় না। প্রত্যেককে লুঙ্গি উঁচু করতে বলে। সুবোধ চন্দ্রের পালা এলে তার পাশের একজন তাকে জাপটে ধরে পাতকুয়োর মধ্যে ফেলে দেয়। সেখানে সে মৃত্যুবরণ করে। তার স্ত্রীও কুয়োতে পড়ে আর উঠতে পারে না। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তারা আবার একদিন আজিজ ব্যাপারির ভাড়াটিয়া হিসেবে আসে। মহল্লার লোকেরা তখন বিভ্রান্তিতে পড়ে। তারপর কোনো এক সময় দাঙ্গা বাঁধলে তারা আবার কুয়োতে পড়ে মুত্যুবরণ করে। সাত বছর পর আবার তারা আজিজ ব্যাপারির ভাড়াটিয়া হিসেবে মহল্লায় আসে। মহল্লাবাসী স্বপ্নার হাতের তৈরি নিমকপারা খায়। তারপর ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বারা বাবরি মসজিদ ভাঙা হলে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও রক্ষা পায় না। একদল উত্তেজিত লোক ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দিয়ে আবদুর আজিজ ব্যাপারির বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা স্বপ্নার হাতে ইতিপূর্বে নিমকপারা খাওয়ার কথা ভুলে যায়। তখন সুবোধ চন্দ্র ও স্বপ্না তৃতীয়বার কুয়োর মধ্যে পতিত হয়। ইতিপূর্বে আজিজ ব্যাপারি মহল্লাবাসীদের কাছে তাদের রক্ষার বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও, সে তাদের একবারও রক্ষা করতে পারেনি। হয়তো তার পক্ষে তাদের রক্ষা করা সম্ভব হয় না। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে দুর্যোগকাল অতিবাহিত হলে, তাদের মৃত্যুর পর, প্রত্যেকবারই মহল্লাবাসীরা অনুতপ্ত হয় এবং তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে। বিভ্রান্ত হয় পাঠকও। জাদুবাস্তবতা কৌশল প্রয়োগ করে বিভ্রান্তি তৈরি করে গল্পকে শহীদুল জহিরীয় করাই হয়তো তাঁর উদ্দেশ্য। সময়ের সাধারণ কাঠামো ভেঙে, একটি টানেলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে এনে তিনি আসলে দেখাতে চেয়েছেন তিনটি সময়খণ্ডের ব্যবধানে সংঘটিত ঘটনার মধ্যে বস্তুত কোনো পার্থক্য নেই; মানুষের মনোজগতের কোনো পবিবর্তন ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের সংখ্যালঘুরা যেভাবে এদেশের রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত, নিধন ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে, স্বাধীনতার পরও তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তিনটি সময়খণ্ডের ফলাফল একই। জাদুবাস্তবতা কৌশল প্রয়োগ করে একটি টানেলে সময়ের সরলরেখায় প্রতিস্থাপিত তিনটি ঘটনার চালচিত্র তুলে ধরে শহীদুল জহির মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে কুহকবিভ্রম তৈরি করেছেন। ‘এ বিভান্তির ভেতর’ মহল্লার লোকদের ‘এরকম মনে হয় যে, তারা হয়তো কোনো এক জায়গায় এক স্বপ্নের ভেতর আটকা পড়ে আছে এবং এই স্বপ্নের ভেতর তারা অতীত থেকে ভবিষ্যতে অথবা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে; এবং তাদের মনে হয় যে, সুবোধ ও স্বপ্নার বিষয়টি হয়তো সত্য নয়, স্বপ্ন’। এরপরই তাদের ‘আজিজ ব্যাপারির বাড়ির প্রাঙ্গণে লাগানো স্বপ্নার তুলসীগাছ’ এবং সেই পাতকুয়োটির কথা মনে পড়ে। অর্থাৎ বিভ্রম বা স্বপ্নের ভেতর থেকে মুক্ত হয়ে তারা ঐতিহাসিক বাস্তবতার ভেতর অনুপ্রবিষ্ট হলে নিজেদের সামপ্রদায়িক মনোবৃত্তির কথা তারা অস্বীকার করতে পারে না।

‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ (১৯৯৫) এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হলেও যতিচিহ্নের ব্যবহার শহীদুল জহির নির্দেশিত পন্থায় ব্যবহৃত না হওয়ায় পরবর্তী গ্রন্থ ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প-এ তা অন্তর্ভুক্ত হয়। ডুমুরখেকো ও অন্যান্য গল্প-গ্রন্থে আমাদের ‘কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পে কমা, সেমিকোলন ও দাঁড়ি, তিনটিই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু শহীদুল জহির গল্পটির কোথাও দাঁড়ি ব্যবহার করেননি। টানা প্যারার মাধ্যমে গল্পটি শেষ করেছিলেন কমা দিয়ে। প্রুফ রিডারই মাতব্বরি করে প্যারা ভেঙে নতুন প্যারা করে কমার স্থলে দাঁড়ি বসিয়ে দেন। প্রুফ দেখার সময় শহীদুল জহির যতবারই দাঁড়ি কেটে কমা বসিয়েছেন, ততবারই প্রুফ রিডার দাঁড়ি কেটে কমা বসিয়ে দিয়েছেন। গল্পকারকে প্রুফ রিডার ব্যাকরণ শেখাতে চেয়েছেন যে, কমা দিয়ে বাক্য শেষ হতে পারে না। দাঁড়ি দিতেই হবে। এ কারণে প্রুফ রিডারের সাথে তাঁর বিরোধ বাঁধে। বিরোধে পেরে উঠেননি শহীদুল জহির। জোর করে প্রুফ রিডার নিজের মত বহাল রেখেছিলেন। এ কারণেই পরবর্তী গ্রন্থে টানা প্যারা এবং কমা ব্যবহার করে গল্পটি তিনি পুনর্মুদ্রণ করেন।

যা হোক প্রায় আঠারো পৃষ্ঠার দীর্ঘ বয়ানের গল্পটিতে শহীদুল তুলে ধরেছেন আধুনিক উৎপাদনশীল দুনিয়ায়, পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের এ যুগে, শিল্পায়ন গ্রাস করে ফেলছে আমাদের প্রকৃত মননশীলতা, মানবিকতা ও নৈতিকতাবোধ; প্রাকৃতিক উৎপাদন ও ভোগ প্রক্রিয়ার অবলুপ্তি, ভূমির মালিকানায় আঘাত এবং সর্বোপরি পরিবেশের বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। তার কিছু নমুনা তুলে দেওয়া যেতে পারে—

‘আমাদের সামনে তরমুজ নির্বাচনের এক সঙ্কট উপস্থিত হয়, যা আমাদের পিতাদের ছিল না, তরমুজ তখন, সে সময়, এক রকমের ছিল; তারা এরকম বলেন, যেমন আমরা বলি, গরম পড়তে শুরু করলে তরমুজওয়ালারা তরমুজ নিয়ে আসে, তখন মহল্লায় মাছি বেড়ে এবং আমরা তরমুজওয়ালাদের বলি, মাছির দিনে তরমুজ লয়া আহ ক্যালা! তখন হাজি আব্দুর রশিদ তার লেবেঞ্চুশ কারখানার নির্মাণ কাজের বালু এনে মন্দিরের সামনের রাস্তার ওপর ফেলে এবং মহল্লার বালকেরা মন্দিরের দেয়াল বেয়ে দোতলায় উঠে, নিচে, বালির স্তূপের ভেতর লাফিয়ে পড়ে; হৈচৈ-এর কারণে আমাদের তন্দ্রা ছুটে যায় এবং তরমুজ সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি, আমরা তখন চাকু অথবা বটি অথবা দা দিয়ে তরমুজ কেটে খাই, রাস্তায় বালকেরা তখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং গোল্লা ফেলে রেখে বাড়িতে ফেরে; আমরা এই বিষয়টি খেয়াল করতে পারি না যে, আমরা তরমুজের সঙ্গে অনেক বিচি খেয়ে ফেলি, সেজন্য, অথবা বেশি পরিমাণে তরমুজ খাওয়ার কারণে আমাদের পেটের ভেতরটা মোচড় দেয়, আমরা তরমুজওয়ালাদের কাছে যাই এবং বলি, তরমুজের বিচি হয় ক্যালা! তখন মহল্লায় লেদ মেশিনের শব্দ থেমে যায় এবং আমরা বিষণ্ন হয়ে পড়ি, কারণ, আমাদের তখন মনে হয় যে, তরমুজের বিচির জন্য আমরা মহল্লায় হয়তো একটা গৌরব থেকে বঞ্চিত হযে পড়বো; আমরা জানতে পারি যে, তারা, অর্থাৎ আমাদের পিতারা তখন তরমুজ খায়, গাঢ় সবুজ চামড়ার ওপর পিরামিডের মতো সাদা ফালি, এবং তারা কালো কুচকুচে বিচি খেয়ে ফেলে, ফরে মহল্লার ইতিহাস আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়; তারা বলে, আমরা যা জানি না তা, এবং যা জানি তা পুনরায়; হাজি আব্দুর রশিদের পেটে মোচড় দিলে তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন এবং ভাবেন, আমরা কত রকমের হয় কিন্তু তরমুজ কেবল একরকমের হয় কেন, সেই সময় অন্ধকার ঘরের ভেতর শুয়ে তিনি বুঝতে পারেন যে, তার ছেলে আব্দুর জলিলের জন্য একটি লেদ মেশিন বসানো দরকার;’ কারখানা বসানোর জন্য তিনি মহল্লার নিঃসন্তান বিধবা রহিমা বিবির দেড়কাঠা গ্রহণ করেন। শুধু লেদ মেশিনই না, মহল্লায় বেকারি, লেবেঞ্চুশ এবং হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরিও গড়ে ওঠে। এছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিক নানা অনুষঙ্গ উঠে এসেছে এ গল্পে। কোনো অনুষঙ্গই একেবারে গুরুত্বহীন নয়। তবে চুম্বকীয় অংশ হচ্ছে, অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হাজি আব্দুর রশিদের অকালে বা অমৌসুমে তরমুজ খাওয়ার বাসনা। মৃত্যুশয্যায় তিনি পাঁচবার তরমুজ খেতে চান। কিন্তু মৌসুম না হওয়ায় তার পাঁচ ছেলে এবং তিন মেয়ের জামাই ঠাঁটারি বাজার, রায়ের বাজার, বাদামতলি, শ্যামবাজার ঘুরে ঘুরে একটিও তরমুজ খুঁজে পায় না। খালি হাতে ফিরে আসে তারা। তা দেখে ‘হাজি আব্দুর রশিদ কাতর হয়ে কেঁদে ফেলেন, তারপর ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোক মুছে বলেন, আমি আর বাঁচুম না’। তরমুজ না খেয়েই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছেলেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তরমুজ কৌটাজাত করার জন্য, যাতে সারাবছর তরমুজ পাওয়া যায়। পিতার মৃত্যুর পর ছেলেরা ‘হাজি ফুড প্রোডাক্ট কোম্পানি’ স্থাপন করে। এ কারখানায়ই ‘তরমুজ কাটা, বাছাই ও পরিষ্কার করা, তারপর জীবাণুমুক্ত অবস্থায় কৌটাজাত করার ব্যবস্থা’ হয়। এরপর চমৎকার একটি সমাপনি টেনেছেন জহির। এ প্রসঙ্গে গল্পের ভেতর ননি বসাকের সুন্দরী মেয়ে ঝর্না বসাকের নামও পাঠকের মনে পড়ে যায়। তার প্রতি মহল্লার যুবকদের আকর্ষণ ছিল। তারা ধারণা করত ঝর্না বসাক একদিন সিনেমার নায়িকা হবে। তারপর একদিন সত্যি সত্যি সে সিনেমার নায়িকা হয়ে যায়। সিনেমায় তাকে বারবার দেখেও তারা আনন্দিত হতে পারে না। ক্রমাগত বিষণ্নতার মধ্যে ডুবে যায়। কারণ ঝর্না বসাক অসাধারণ সুন্দরী হলেও, সে তখন, তাদের নয়। গল্পে শেফালী নামের এক তরুণীকে আমরা দেখতে পাই, যাকে বালকেরা ‘এই শেফালি ফুল গাছ’ বলে ব্যঙ্গ করত। গল্পের শেষে সেই শেফালি এবং হাজি আব্দুর রশিদকে যুগপৎ উপস্থাপন করেছে জহির।

‘আমরা মৃত হাজি আব্দুর রশিদের কথা ভুলতে পারি না, আমরা, চিৎকার করে উঠি, এই, শেফালি ফুল গা-ছ, আমরা তাকে আর পাই না, আমরা তাকে হারাই,’

এভাবে যতিচিহ্ন কমার মাধ্যমেই গল্পটি শেষ হয়েছে। তবে এই হারানো যেন শেষ নয়, নগরায়ন ও শিল্পায়নের দাপটে প্রকৃতির অস্তিত্ব ও সৌন্দর্যের বিলুপ্তি প্রক্রিয়া হয়তো চলতে থাকবে অনন্তকাল।

শক্তিমান কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে উৎসর্গিত ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ (১৯৯৭) গল্পে আমরা বামপন্থী আন্দোলনের নেতা আবদুল ওয়াহিদকে একুশ বছর পর সুহাসিনী গ্রামে প্রত্যাবর্তন করতে দেখি। তারপর একবছর পেরোতে না পেরোতেই তাকে ধানখেতে খুন করা হয়। যারা খুন করে তাদের পরিচয়ও অস্পষ্ট নয়, আব্দুর ওয়াহিদের ক্ষতবিক্ষত দেহের গেঞ্জিতে সাঁটা চিরকুটে লেখা ছিল প্রতিশোধ নিয়ে গেলাম। তাহলে প্রশ্ন উঠতে কেন এই প্রতিশোধ? কারণ একুশ বছর আগে আবদুল ওয়াহিদ তার বাল্যবন্ধু আবুল হোসেনের সাথে পড়ালেখার উদ্দেশ্যে সুহাসিনী গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় যায়। পড়ালেখা শেষ করে আবুল হোসেন গ্রামে ফিরে এলেও আবদুল ওয়াহিদ ফেরে না। সে গোপন বিপ্লবী পার্টির সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে। আবুল হোসেন গ্রামে ফেরার পর সুহাসিনী গ্রাম এবং গ্রামের আশপাশে নকশাল আন্দোলনকারীদের নাম ছড়িয়ে পড়ে, যারা গরিবদের কিছু বলে না, কিন্তু বুর্জোয়া শ্রেণিদের নিধন করে। ব্যাঙনাই গ্রামে ইয়াছিন বিশ্বাস এবং তার বড় ছেলে জমিরুদ্দিনকে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়। তখন ইয়াসিন বিশ্বাসের গেঞ্জির সাথে সাঁটা এক টুকরো চিরকুটে শ্রেণিশত্রু খতম করা চলবে লেখা দেখতে পায় গ্রামবাসী। তখন গ্রামে জনশ্রুতি ছিল যে, এই খুনের সাথে মিয়াবাড়ির ছেলে আব্দুল ওয়াহিদ যুক্ত। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, ইয়াসিন বিশ্বাসের স্বজনরাই ওয়াহিদকে হত্যা করেছে?

এই হত্যাকাণ্ড কতো যুক্তযুক্ত, তা ভাবার অবকাশের চেয়ে গল্পে, আবদুল ওয়াহিদকে একতরফাভাবে ভালোবেসে ফেলা নূরজাহানের যন্ত্রণাদগ্ধ মনোজগৎ উন্মোচিত হয়েছে। একুশ বছর আগে, আব্দুল ওয়াহিদ একদিন দুষ্টুমি করে কিশোরী নূরজাহানকে শালিক পাখির ছানা দিয়ে বলেছিল ময়নাপাখি, কথা শিখাইও। তখন থেকেই নূরজাহান গ্রামের কারও কথা না শুনে শালিক পাখির ছানাকে ময়না পাখি ভেবে কথা শেখাতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থতা যে অনিবার্য, তা বলাই বাহুল্য। নূরজাহান যুবতী হয়ে উঠলে আবুল হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। কিন্তু সে তখনও গোপনে লালন করে চলে আবদুল ওয়াহিদের প্রতি প্রণয়াসক্তি। প্রকৃতপক্ষে শালিক পাখির ছানাটিই হয়ে ওঠেছে আবদুল ওয়াহিদের প্রতি তার ভালোবাসা বা প্রেমচেতনা, যা সে আবুল হোসেনের ঘরে আসার পরও সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। বরং একুশ বছর পর আব্দুল ওয়াহিদ গ্রামে ফিরে এলে নূরজাহানের বেদনা ও বিষণ্নতা ঝরে পড়ে, ছোট্ট একটি মাত্র বাক্যে— ‘ম্যাবাই, ময়নার ছাও কয়া আমাকে শালিক দিছিলেন ক্যা?’ এ কথার কী জবাব দিবে ওয়াহিদ? ‘সেদিন, আবুল হোসেন হয়তো বুঝতে পারে যে, সে যেমন পাখিদের কিছু বোঝে না, তেমনি বোঝে না পাখি এবং নারীর মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়’, তাই নূরজাহানের কথা শুনে সে মৃদু হাসে এবং তার সাথে যোগ দেয় ওয়াহিদ এবং নূরজাহানও। নিজেদের ভেতরে গুমরে ওঠা ভালোবাসাই হয়তো শেষোক্ত দুজন আড়াল করেছিল। যা হোক, এরপর একদিন ওয়াহিদ নূরজাহানকে কুয়োতলায় কাঁদতে দেখে প্রশ্ন করে, কান্দেন ক্যা? উত্তরে সম্ভবত নূরজাহান বলে, সুখ নাই জীবনে। এর মধ্যেই নূরজাহানের মনোযাতনা কী সাংঘাতিকভাবেই না ফুটে উঠেছে। আবদুল ওয়াহিদের মৃত্যুর পর এই মর্মযাতনা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন, ওয়াহিদের এক বছরের প্রচেষ্টায় কথা বলতে শেখা পুরুষ ময়নাটি মেয়ে ময়নাটিকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, কান্দন ক্যা? এবং মেয়ে ময়নাটির কাছ থেকে একই রকম জবাব পায়, সুখ নাই জীবনে। তাহলে কী বোঝা যায়, নিশ্চয় ময়না দুটি ওয়াহিদ এবং নূরজাহানের প্রতীক? আর একবছর ধরে ময়না দুটিকে কথা বলা শেখানোর অর্থ হলো, পরস্পরকে উপলব্ধি করে আরও নৈকট্যে আসা। ওয়াহিদ খুন হলে শোকাচ্ছন্ন নূরজাহান মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, ভেতরে ভেতরে বিচ্ছেদযাতনায় কাতর বা জর্জরিত হয়ে পড়ে। মাত্র তিনটি বাক্যের মাধ্যমেই তিনি নূরজাহানের বিধ্বস্ত মনোজগতকে উন্মোচিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

‘চতুর্থ মাত্রা’ (১৯৯৮) গল্পে আমরা আধুনিক নগর মানুষের এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধের মাত্রা উপলব্ধি করতে পারি। আব্দুল করিম এ গল্পের প্রধান চরিত্র। ভূতের গলিতে তার বাস। সে অধিকাংশ সময় বাসায় থাকে। তার সময় কাটে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে কিংবা পেপার পাঠ করে। মাঝে মাঝে কোনো তরুণীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, তার জন্য গোলাপ নিয়ে রাস্তার পাশে বেঞ্চে শুয়ে বা বসে অপেক্ষা করে। যদিও সেই তরুণী তার ফুল নিলেও তার প্রতি তাকে আকৃষ্ট হতে দেখা যায় না। তারপরও সে অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু এভাবে আব্দুল করিমের সময় সহজে কাটতে চায় না। অনন্ত নৈঃসঙ্গ্যযাতনায় সে পীড়িত। এর থেকে মুক্তির জন্য সে হয়ে ওঠে Masochist বা Sadomasochist অর্থাৎ অন্যকে পীড়ন করে যে সুখ পায় বা আনন্দলাভ করে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বা কিশোর-কিশোরীরা যেমন ব্যাঙকে ঢিল ছুড়ে আনন্দ পায় কিংবা প্রজাপতি, ফড়িং কিংবা পাখির পাখা ছিঁড়ে উল্লাস প্রকাশ করে, পাখির বাসা ভেঙে ডিম নষ্ট করে কিংবা বাচ্চা মেরে ফেলার মধ্যে একধরনের আনন্দ পায়, আব্দুল করিমও, নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তির জন্য বেছে নেয়, অনেকটা এরকমই পথ। সে পুরোনো খবরের কাগজ ফেরিওয়ালাদের কাছে বিক্রি করে গ্লাস কিনে। তারপর ইচ্ছে করে সেই গ্লাস ভেঙে বারান্দায় রেখে দেয়। মহল্লায় কটকটি বিক্রেতা এলে, চপলমতি পোলাপান সেই ভাঙা গ্লাস দিয়ে কটকটি কিনে। তারপর কটকটির ভাগ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে মারামারি বাঁধে। রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে। এরজন্য দস্যু ছেলেদের অভিভাবকরা আব্দুল করিমকে অভিযুক্ত করে। ক্ষোভের সঙ্গে, তারা বারান্দায় আরও বেশি ভাঙা গ্লাস রাখার জন্য বলে, চলে যায়। তাদের কথামতো আব্দুল করিম বারান্দায় ভাঙা গ্লাসের সংখ্যা বাড়ায়। আবার অনুরূপ কাণ্ড ঘটে। এভাবে একদিন তার পুরোনো খবরের কাগজের মজুদ ফুরিয়ে গেলে তাকে তার পরিচিত ফেরিওয়ালার কাছ থেকে পুরোনো পেপার কিনতে দেখা যায়। তাঁর নিরন্তর নৈঃসঙ্গ্যচেতনার মধ্যে ক্যাসিও ঘড়ির সময় পার হয়ে যেতে থাকে।

আবার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গল্পটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আব্দুল করিমকে ধরা যেতে পারে রাষ্ট্র বা কোনো দলের প্রধান নেতা। আর ভাঙা গ্লাস তার অতি সামান্য মওকা বা সামান্য সত্যমিশ্রিত আশ্বাস বা স্বপ্ন যার জন্য মহল্লার বালকরূপী দেশের নির্বোধ জনগণ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধায়। আর নেতা তা দেখে আনন্দ পায়।

এই আব্দুল করিমকেই হয়তো আমরা, তাঁর ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৪) গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কোথায় পাবো তারে’র (১৯৯৯) কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপে দেখতে পাই। দুজন আব্দুল করিমের মধ্যে বয়সের ব্যবধান এবং জীবনযাপনের ধরনধারণে যথেষ্ট পাথৃক্য থাকলেও, বস্তুত, নৈঃসঙ্গ্যবেদনায় তারা উভয়ে ন্যূব্জ। এ গল্পে বেকার, ভবঘুরে আব্দুল করিম ময়মনসিংহ যেতে চায়। কেন সে ময়মনসিংহ যেতে চায়, তা নিয়ে সৃষ্টি হয় রহস্য। উঠে আসে মহল্লার নানাবিধ অনুষঙ্গ। তারপর আস্তে আস্তে খোলাসা হয় তার ময়মনসিংহ যাওয়ার আসল কারণ। ‘আব্দুল করিম বলে যে, কোন একদিন দুপুরে তার কোন এক বন্ধুর সঙ্গে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে বেড়াতে গেলে সেখানে তারা এই অল্প বয়স্ক গ্রামের মেয়েটিকে’ অর্থাৎ শেফালিকে দেখতে পায়, ‘মেয়েটি একা এবং সম্ভবত অসুস্থ ছিল। তাদের সামনে গাড়িতে বসে মেয়েটি বাস ছাড়ার আগেই জানালা দিয়ে মুখ বের করে বমি করে, তারপর হয়তো কুলি করার জন্য অথবা পানি খাওয়ার জন্য সে যখন বাস থেকে নেমে আসে তার পা টলমল করে এবং আব্দুল করিম তা দেখে। তখন আব্দুর করিম তাকে তার বাহু ধরে নিয়ে এসে একটা কাঠের বেঞ্চে বসায়, হোটেল থেকে পানি এনে খাওয়ায় এবং তখন সে জানতে পারে যে, মেয়েটার নাম শেফালি; এবং তখন শেফালির সঙ্গে তার অলৌকিক কথাবার্তা হয়।’ তারপর যখন সে বুঝতে পারে যে মেয়েটি একা একাই বাড়ি ফিরছে, তখন সে তাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি একলা যায়া পারবা? আব্দুর করিমের কথা শুনে হয়তো মেয়েটার মজা রাগে, সে বলে, কি কইন, পারতাম না ক্যারে, এলকা কত্তো গেলাম! তখন, তারপর, বাস না ছাড়া পর্যন্ত তাদের দুজনের মধ্যে আলাপ হয় এবং তখন আব্দুল করিম জানতে পারে যে, ময়মনসিংহ ছাড়িয়ে আকুয়া যেতে হয়, তারপর আকুয়া থেকে ফুলবাড়িয়া; সেখানে কত চাল, কত ডযাল, কত আখ এবং গুড় হয়. সেখানে কত আলু সিম এবং বেগুন জন্মে, এবং এ সব জিনিস কত সস্তা দামে ফুলবাড়িয়া হাটে বিক্রি হয়। তখন কোন এক সময় মেয়েটা হয়তো তাকে বলে, আমরার বাইত বেড়াইবার যাইন যে; এবং আব্দুর করিম একটা কাগজে মেয়েটার ঠিকানা লিখে নেয় এবং বলে, মৈমনসিং যাইনিকা কুনো দিন, যুদি যাইবার কও যামুনে একদিন, দেইখা আমুনে তুমারে!’ এ কারণেই সে একদিন সত্যি সত্যি মহল্লার ছেলে দুলাল মিঞাকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ যাত্রা শুরু করে। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তারা যখন শেফালিদের বাড়ির কাছাকাছি যায়, তখন আব্দুল করিম দুলাল মিঞার কথা বা অনুনয়বিনয় অগ্রাহ্য করে ফিরতি পথ ধরে। এমন কি দুলাল মিঞা, আশপাশের কোনো বাজারে জিনিশপত্রের দরদাম দেখার জন্য যেতে চাইলেও আব্দুল করিম তাকে নিবৃত্ত করে বলে যে, আগে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ঢাকার বাস ধরতে হবে, তারপর, সময় থাকলে ঘুরে ঘুরে জিনিশপত্রের দরদাম দেখা যাবে। কিন্তু সেই সময় তারা আর পায় না। লাস্ট ট্রিপে বাসে উঠে ঢাকা চলে আসে। ঢাকা না এসে তার কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে শেফালিকে একবার মাত্র দেখার পর, ঐটুকু পরিচয়ের ভিত্তিতে, নিঃসঙ্গ, বেকার আব্দুল করিম তাকে নিয়ে যে ভালোবাসার কল্পমানবীর ফানুস উড়িয়ে ছিল, বাস্তবে তা যে, একেবারেই অর্থহীন, ঠুনকো ব্যাপার, বাস্তবতার সাথে কল্পনার মানবীকে কোনোভাবেই মেলানো সম্ভব হবে না, আর তা সম্ভব না হলে সে আরেক বিড়ম্বনার মুখোমুখি হবে, অন্তর্গত যন্ত্রণায় কাতর হবে, এ কারণে বাস্তবের রূঢ়সংঘাতে কল্পমানবীর আদল না ভেঙে সে মনের গহনে সংরক্ষণ করে রাখার জন্যই মুখোমুখি হয় না শেফালির, ঢাকা ফেরত আসে। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য, এ তার একধরনের রোমাণ্টিক চেতনাঘোরে স্বপ্নকল্পনার খেল।

‘আমাদের বকুল’ (২০০০) গল্পের পটভূমি সুহাসিনী গ্রাম। এ গ্রামের ভূমিহীন কৃষক আকালু, তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা এবং তাদের একমাত্র মেয়ে বকুলকে কেন্দ্র করে এর উপাখ্যান।

গল্পের শুরতেই আমরা সুহাসিনী গ্রামের লোকজনকে আকালুর প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় থাকতে দেখি। পরের দৃশ্যপটে আকালুকে সন্ধ্যার আগ দিয়ে গ্রামের দিকে ফিরতে দেখা যায়। ‘সেই সময় গ্রামের যারা হেমন্তের বিস্তীর্ণ মাঠে নুয়ে থাকা ফসলের ওপর দিয়ে তাকায়, তারা তাকে বহুদূরে বৈকুণ্ঠপুর গ্রাম পার হয়ে খোলা মাঠের কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে দেখে। গ্রামের এই মানুষ তখন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে, আকালু অস্পষ্ট সোনালি রঙের ঈষৎ ঢেউখেলানো ধানখেতের দূর প্রান্তে যখন উদয় হয় তাকে একটি বিচ্ছিন্ন বিষণ্ন ধলা বকের মতো দেখায়; এবং গ্রামের লোকদের মনে হয় যে, ফাতেমার জন্য সত্যি কি আকালুর হৃদয় কাঁদে! বিশ্বাসপাড়ার কাছে এসে জেলা বোর্ডের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে সে ধানখেতে নেমে আলপথ ধরে; তখন সন্ধ্যার ম্লান আলোর ভেতর তার লম্বা শরীর মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে।’ এই যে তার ফেরা এবং তার জন্য গ্রামের মানুষের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষার কারণ জানা যায় পরবর্তী বাক্যে, ‘সে তার শ্বশুরবাড়িতে তার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী, ফাতেমাকে খুঁজতে গিয়েছিল।’ ফাতেমা কেন হারিয়ে গেল, কোথায়ই বা নিরুদ্দিষ্ট হলো, তা জানার জন্য স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের কৌতূহল বেড়ে যায়। এ জন্য তাকে প্রবিষ্ট হতে হয় গল্পের গভীরে। তখন ‘গ্রামের মসজিদের প্রাক্তন মুয়াজ্জিন, চান্দাইকোণা মাদ্রাসার দাখিল ক্লাশের তালেবুল এলেম রফিকুল ইসলামের কথা’ জানা যায়। ‘সে মিঞা বাড়িতে জায়গির থাকতো, গ্রামের বাচ্চাদের আরবি পড়াতো এবং মসজিদের ইমাম, মোহসিন আলিকে আজান দিয়ে মাহায্য করতো।’ আকালুর নিষেধ অগ্রাহ্য করে ফাতেমা তার যমজ সন্তান বকুল এবং আমিরকে কোরান শরিফ পড়ানোর জন্য মসজিদে রফিকুলের কাছে পাঠাতে চায়। পরবর্তীকালে এই রফিকুল ইসলামের সাথেই হয়তো ফাতেমা ভাব জমে ওঠে। একদিন ফাতেমাকে পিঠা বানিয়ে রফিকুল ইসলামকে খাওয়াতে দেখলে আকালু ভীষণ চটে। ফাতেমার সাথে সে ‘ঝগড়া করে, বলে, তর এই ভাতারেক খাওয়ানের নেইগা পিঠা বানাইবার কইছিলাম!’ হয়তো ফাতেমা এতে খুবই মর্মাহত হয়। তারপর তাকে আর গ্রামে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ফাতেমা নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার পর আকালু আবার বিয়ে করে। তার মেয়ে বকুল ধীরে ধীরে সোমত্ত হয়ে ওঠে। ফাতেমার বাবার কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে প্রাপ্ত বকনা বাছুর ধীরে ধীরে নাদুসনুদুস হয়ে উঠলে, সেই গাভীর দিকে তাকিয়ে যাদের কামোত্তেজনা হয়ে অজু নষ্ট হবার উপক্রম হয়, তাদের চোখও বকুলের ভরাট শরীরে দিকে পড়ে। তারপর একদিন ‘সুহাসিনীর লাল পিঁপড়া বকুলকে খেয়ে যায়।’ অর্থাৎ গ্রামের নারীলোলুপ, রিরংসাতাড়িত পুরুষদের দ্বারা বকুল ধর্ষিত হয়ে মুত্যুমুখে পতিত হয়। আমাদের বুর্জোয়া সমাজে বকুল হয়ে উঠেছে নিম্নবিত্ত ঘরের অরক্ষিত মেয়েদের প্রতীক। যারা সমাজের লাল পিঁপড়া রূপী প্রভাবশালী পুরুষদের লালসার শিকার হয়।

‘মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা’ (২০০০) গল্পে ভূতের গলিতে হঠাৎ করে বানরের উপদ্রুব বেড়ে যায়। বানরেরা মানুষের মূল্যবান জিনিস, যেমন, ঘড়ি, আংটি ও খাবার চুরি করে নিয়ে যায়। আব্দুর রহিমের হাতঘড়ি হারিয়ে গেলে কাজের বুয়া বাসানার মাকে তারা চোর সাব্যস্ত করে ছোটখাটো চড়থাপ্পড় মারে। আকবরকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেয়। তারা যতই বলে যে, ঘড়ি নেয় নাই; ততই তারা তাদের অবিশ্বাস করে। পরবর্তীকালে যখন তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, হারানো দ্রব্যসামগ্রীর জন্য, তারা যাকে বা যাদেরকে চোর সন্দেহ করেছিল, তারা চুরি করেনি, বানরেরা চুরি করেছে, তখন তাদের অনুতপ্ত হওয়ার কথা থাকলেও তারা মোটেও অনুতপ্ত হয় না। বরং বাসার সন্দেহভাজন কাজের লোকেরা তখন আঙুল দিয়ে সত্যটা দেখিয়ে দেয় তখনো তারা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। গল্পে মুক্তযুদ্ধও উঠে এসেছে। জোড়পুল লেনের বিহারিদের দ্বারা হিন্দুদের বাড়ি লুট হয়। মিলিটারির ভয়ে আবু হায়দার, তার স্ত্রী এবং মেয়ে ঝর্নাকে নিয়ে জিঞ্জিরার চরাইল গ্রামে পালিয়ে যায়। বিধবা আমেনা বেগমের ছেলে আব্দুল হালিমও নিখোঁজ হয়। পাকবাহিনীর হাতে ঝর্না বেগম ও আব্দুল হালিম ধরা পড়ে। কিন্তু গুলি লাগার ভান করে আব্দুল হালিম কাত হয়ে পড়ে গেলে, তাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে, ঝর্নাকে তুলে নিয়ে যায় পাকবাহিনী। পরে ঝর্নার লাশ পাওয়া যায়। তাকে জিঞ্জিরায় কবর দিয়ে মহল্লায় ফেরে আবু হায়দার। পরে আব্দুল হালিমও একদিন ফিরে আসে। সবাই ধারণা করে আব্দুল হালিম যুদ্ধে যাবে। একদিন সত্যি সত্যি সে মুক্তিযুদ্ধে যায়ও। কিন্তু নৌকা থেকে পানিতে পড়ে তলিয়ে যায়। আর তার খোঁজ পাওয়া যায় না। দেশ স্বাধীন হলে আব্দুল হালিমের বিধবা মায়ের কাছে থাকে কেবল ঝর্নার চুল বাঁধার একটা লাল ফিতা, যা আব্দুর হালিম প্রথমদিন ঝর্নাদের বাড়ি গিয়ে চুরি করে এনেছিল। ফিতাটা ঝাড়ুদারনি নিমফল দাসীর মেয়ে জবাকুসুম দাসীর মাথার চুলে পাওয়া গেলে বৃদ্ধা মা আমেনা বেগমের তখন আব্দুল হালিমের কথা মনে পড়ে। সে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

এরপর মহল্লায় বানরের উপদ্রুব বেড়ে যায়। বানরেরা একদিন আবু হায়দারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। তারা তখন শুধু মানুষের মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী নিয়েই ক্ষান্ত হয় না, কোথায় থেকে যেন তারা একটা পিস্তলও নিয়ে আসে। তা দেখে মহল্লাবাসী আতঙ্কিত হয়। বংশবৃদ্ধির জন্য বানরেরা প্রজননকর্মে লিপ্ত হয়। আর তখন ‘দূরে মহল্লায় সূর্য ডুবে যায়।’ ব্যস শেষ হয় একটি উপাখ্যান। কিন্তু মগজের মধ্যে প্রশ্ন গেঁথে থাকে, এই বানরেরা কি শুধুই বানর, নাকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি রাজাকার আলবদরদের প্রতীক? গভীরভাবে ভেবে দেখলে তা-ই মনে হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে, পঁচাত্তর পরবর্তীকালে, হঠাৎ করেই স্বাধীনতার শত্রুদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারপর তারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে নিজেরা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং পেশিশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। তাদের হাতেই মুক্তিযোদ্ধারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত হয়। সময় বদলে যাওয়ায়, রাজাকারদের ক্ষমতা ও তামাশা দেখতে দেখতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের বৃদ্ধা মা আমেনা বেগমের কথা সবাই ভুলে যায়। দিনে দিনে রাজাকারদের মতাদর্শীদের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ততই অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং স্বাধীনতাচেতনা। রূপক ও বিভ্রমের ভেতর কী অসাধারণ গল্পই না বুনে গেছেন শহীদুল জহির।

এই স্বাধীনতা বিরোধী কুচক্রীমহল, স্বার্থান্বেষী পেশিশক্তিতে বলীয়ান বাহিনী, স্বাধীনতার অব্যবহিতকাল থেকে আজ অব্ধি, ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ ((২০০২) গল্পে হয়ে উঠেছে বিলাই বাহিনী। আর দেশের নিরীহ আমজনতা, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মুক্তিযোদ্ধারা ইন্দুরের মতো তাদের শিকারে পরিণত হয়েছে। বিড়াল যেমন ইচ্ছে মতো ইন্দুরকে নিয়ে খেলে, ইন্দুরের কিছু করার থাকে না, বিড়াল খেলতে চাইলে ইন্দুরকে খেলতেই হয়, বিড়াল খেলা থেকে অবসর নিলেও, ইন্দুর অবসর নিতে পারে না; তাকে খেলার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত থাকতে হয়। তিনটি সময়খণ্ডকে ধারণ করেছে গল্পটি। স্বাধীনতা-পূর্বকাল, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতা-উত্তরকাল। স্বাধীনতা-পূর্বকালে ভূতের গলিতে নবাগত ছেলেদেরকে বিলাইরূপী বাবুল মিঞা এবং তার দলের কাছে ইন্দুরে পরিণত হতে হয়। বাবুল মিঞারা মহল্লায় আগত নতুন ছেলেদের ইন্দুর ঘোষণা করে এক অদ্ভুত খেলায় মেতে ওঠে। তারা তাদের মারধোর করে। কিলঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে রক্ত ঝরিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে এভাবে— ‘ধর চিকা মার চিকা/চিকার দাম পাঁচ সিকা।’

মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাবুল মিঞারদের এই কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে। তবে এ সময় মহল্লায় বিলাই রূপে আবির্ভাব ঘটে পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার কমান্ডার আব্দুল গনি ও তার দল। মহল্লাবাসীকে তখন ইন্দুর হতে হয়। তারপর চলে খুন, ধর্ষণ ও লুটতরাজের খেলা। পাক কমান্ডার দ্বারা ধর্ষিত হয়ে খতিজা বীরাঙ্গনা হয়। রাজাকার আব্দুল গনির হাত থেকেও সে নিষ্কৃতি পায় না। বাড়িরক্ষার জন্যই খতিজা মহল্লা ত্যাগ করে না। আব্দুল গনির শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত ইজ্জতের বিনিময়েও সে বাড়ি রক্ষা করতে পারে না।

ডিসেম্বর ১৫ তারিখে ভূতের গলির অবস্থা পাল্টে যায়। যারা যুদ্ধে গিয়েছিল তাঁরা কাঁধে রাইফেল, স্টেনগান নিয়ে মহল্লায় ফিরে এলে যুদ্ধের সময় যারা বিলাই ছিল, বিশেষ করে আব্দুল গনি এবং মাওলানা গফুরের দল, তারা খেলা ছেড়ে দিয়ে, মহল্লা ত্যাগ করে আত্মগোপন করে। তারপর ফিরে আসার পরিবেশ তৈরি হলেই ফিরে আসে। মাওলানা গফুর হয়তো জামায়াত নেতা গোলাম আযমের প্রতীক হয়ে ওঠেছে। স্বাধীনতার পরে সে পাকিস্তানে আত্মগোপন করেছিল। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে সে ফিরে আসে। তারপর একদিন তারা ক্ষমতাবান হয়ে উঠলে আবার ইন্দুর-বিলাই খেলায় মেতে ওঠে। তখন মহল্লাবাসী বা এদেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হতে হয় ইন্দুর। এই খেলায় ইন্দুরের প্রাণ যায়, আর বিড়াল থাকে বহুল তবিয়তে।

বয়সের কারণে বিড়ালদের কখনো বৈরাগ্যভাব এলে কিংবা খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা এ খেলা থেকে অবসর নিতে পারে, কিন্তু ইন্দুরেরা পারে না। তখন মহল্লায় বিলাই রূপে উত্থান ঘটে হুমু-জাহুদের। এদেশের সামরিক জেনারেল এবং বেসামরিক জেনারেলরাই তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তারা যাদের প্রতিপক্ষ মনে করে, তাদের ইন্দুর ঘোষণা করে, দৌড়াতে বলে। না দৌড়ালেই তারা তাদের জীবনলীলা সাঙ্গ করে ফেলে। তখন ইন্দুর-বিলাই খেলা ভুলতে বসা ভূতের গলির লোকদের অতীতের কথা স্মরণ হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও যে ইন্দুর-বিলাই খেলার কোনো পরিবর্তন হয়নি, তা তারা বুঝতে পারে। পঁচাত্তর পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস হুমু-জাহুদের গডফাদাররা সবাই মিলে বিকৃত করে। এ কারণেই স্বাধীনতার এতো বছর পরও সমাজে খতিজারা বীরাঙ্গনার মর্যাদা পায় না। ধর্ষিতা রূপে চিহ্নিত হয়। তাদের নিয়ে সমাজে কানাঘুষা চলে। প্রকৃতপক্ষে এ গল্পে, ভূতের গলি হয়ে উঠেছে সমগ্র বাংলাদেশের প্রতীক। ভূতের গলির ‘আলতাফ আলি, মোহাম্মদ সেলিম, মোছা. খতিজা বেগম, চন্দ্রকান্ত ও পূর্ণলক্ষ্মী বসাক’সহ আরও অনেকে এদেশের বিপণ্ন, অসহায় জনতারই প্রতিরূপ। আর ‘বাবুল মিঞা, হুমায়ূন কবির ওরফে হুমু, তার ভাই জাহাঙ্গির হোসেন ওরফে জাহু, আব্দুর জব্বার ওরফে কান কাটা জব্বার, আব্দুর গনি, মওলানা আব্দুল গফুর, শামসুর আলম খান এবং তার ছেলে ইব্রাহিম খান, আব্দুর হাকিম ওরফে হাক্কা, এরা’ সবাই এদেশের রাজনৈতিক প্রতিভূজন এবং তাদের লালিত পালিত ক্যাডার বা সন্ত্রাসী বাহিনী রূপেই ইন্দুর-বিলাই গল্পে চিত্রিত করেছেন জহির। গল্পের প্রথম দুটি চিত্রে দুটি বিলাই তাদের চেয়ে বেশি সংখ্যক ইন্দুরের সাথে খেলায় মত্ত। গল্পের শেষ চিত্রে একটি বিলাই খেলা থেকে অবসর নিলেও আরেকটি বিলাই খেলায় মত্ত। কিন্তু তিনটি চিত্রের একটিতেও ইন্দুর খেলা থেকে বিরত থাকতে পারেনি। একটি বিলাইও যদি খেলতে চায়, তাহলে তাদের খেলতে হয়, জীবনলীলা সাঙ্গের আগ পর্যন্ত। এই ইন্দুর-বিলাই খেলা বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার বাস্তব চিত্র।

‘প্রথম বয়ান’ (২০০২) গল্পে আমরা ভূতের গলির আব্দুর রহমানকে দেখতে পাই, সে ভূতের গলিতে, অনেকদিন আগে, একটা কাঠের খুঁটির মাথায় কাচের বাক্সের ভেতর হারিকেনের বাত্তি জ্বলতে থাকা, সেই পুরোনো খুঁটিটার অবস্থান নির্ণয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার এই বাত্তির খুটি খোঁজা নিয়ে মহল্লাবাসীরা কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়ে। কেন সে খোঁজে খুঁটির অবস্থানটা। তা আস্তে আস্তে খোলাসা করেন জহির। তারপর আমরা জানতে পারি গল্পের নায়ক আব্দুর রহমান আসলে তার নস্টালজিক চেতনার অবগাহনের ভেতর চল্লিশ বছর পেছনে ফেরে প্রথম ভালোবাসার মানবী সুপিয়া বেগমকেই খোঁজে। চল্লিশ বছর আগে যে জায়গায়, একজন লোক এসে খুঁটির মাথায় কাচের বাক্সের ভেতর হারিকেনের আলোটা সারারাতের জন্য জ্বালিয়ে যেত, সেই জায়গায়ই সুপিয়ার সাথে আব্দুর রহমানের তিনবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। আব্দুর রহমান এবং তার বন্ধু আবুল হোসেন প্রতিদিন ওই বাত্তির খুঁটিটার কাছে বসে গল্প করত। বাত্তিটা দেখতে ভালো লাগত আব্দুর রহমানের। আবুল হোসেন এবং আব্দুর রহমান একদিন বসে থাকার সময় সুপিয়া বেগম অসুস্থ নানিকে দেখে বাসায় ফেরার পথে একটা চম্পা ফুলের ডাল ভেঙে আনে। ডালটা হয়তো তাকে ভেঙে দেয় মহল্লার মোচঅলা এক ছেলে, যে কিনা কাজ করে ধোলাইখালের কোনো একটা ওয়ার্কশপে। আব্দুর রহমানদের সামনে দিয়ে বাসায় ফেরার সময় সুপিয়া সেই ডালটা তার কোলের ওপর ফেলে রেখে চলে যায়। সুপিয়া যে তাকে ভালোবাসে, তা-ই জানিয়ে যায়। কিন্তু আব্দুর রহমান তখন সুপিয়া বেগমকে বুঝতে পারে না। সে মজে থাকে বাত্তি দেখার আনন্দে। এভাবে তিনদিন সুপিয়া বেগম তাকে ভাঙা ফুলের ডালটা দিলেও সে আব্দুর রহমানের কোনো সাড়া পায় না। শেষে নানির মৃত্যুর পর সেই মোচঅলা লোকটার সাথে সুপিয়া বেগমের বিয়ে হয়ে গেলে আব্দুর রহমান তাকে আর মহল্লায় খুঁজে পায় না। তখন সুপিয়ার জন্য তার হৃদয়ে ভালোবাসা উথলে ওঠে। তারপর যুদ্ধের সময় সে পাকবাহিনীর ধাওয়া খেয়ে জিঞ্জিরার চরাইল গ্রামে গেলে, সেখানে তার দেখা মেলে সুপিয়ার সাথে। কথাবার্তার পর সে বুঝতে পারে যে সুপিয়া তাকে ভালোবাসত। তারপরই সে বিষণ্ন বা শোকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ তখন সুপিয়া বেগমকে আর কোনোভাবেই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। সে তখন সন্তানের মা হয়ে গেছে। জীবনের প্রয়োজনে, একদিন সে ঝর্না বেগমকে বিয়ে করে, তার সাথে তার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়, কিন্তু তারপরও সে জীবনের প্রথম প্রেমিকা সুপিয়া বেগমকে ভুলতে পারে না। শোক ও স্বপ্ন-ঘোরের মধ্যে সে তাকে খুঁজে ফেরে। নরনারীর প্রেম ও বিচ্ছেদের সম্পর্ককে জহির বিভ্রমের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে হৃদয়ের গভীরের বেদনাকে আগুন জ্বালানোর মতোই উসকে দেন। প্রচণ্ড দাহ সেই অগ্নিতে।

‘প্রথম বয়ান’ গল্পে জহির আব্দুর রহমান ও সুপিয়া বেগমের বিচ্ছেদের বেদনাকে শুধু উসকেই দিয়েছেন, কিন্তু মিলনের কোনো সম্ভাবনা জিইয়ে রাখেননি। কিন্তু প্রেমে বিরহের পর তো মিলনও থাকে। হোক না তা দীর্ঘ সময় পরে। সেই মিলনের সম্ভাবনাই তিনি জাগিয়ে তোলেছেন ‘ডলু নদীর হাওয়া’ (২০০৩) গল্পে। গল্পটির পটভূমি চাটগাঁ। ডায়লগও খাঁটি চাটগাঁর। এ গল্পে আমরা দেখতে পাই, তৈমুর আলি চৌধুরি যৌবনকালে জোর করে বিয়ে করে পাহাড়ি কন্যা মাতৃহীন সমর্ত বানু ওরফে এলাচিংকে। জোর করে বিয়ে করলেও সে এলাচিংয়ের মন বা ভালোবাসা পায় না। সারাজীবন তাকে সমর্ত বানুর কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিষযুক্ত এবং বিষমুক্ত এ দুটি গ্লাসের মধ্যে একটি গ্লাস বেছে নিয়ে অর্থাৎ বিষমুক্ত গ্লাসের পানি পান করতে হয়, বার সন্তানের জন্মদান এবং চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হলে, যেদিন সে গ্লাস নির্বাচনে ভুল করে, অথবা তৃষ্ণার কারণে দুটি গ্লাসের পানিই পান করে ফেলে, সেদিন সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তারপর এলাচিং চলে যেতে চায় আলিকদম। কেন? কারণ সেখানে তার প্রেমিক সুরত জামাল থাকত। হয়তো তার স্মৃতিবিজড়িত জায়গাই জীবনের বাকি দিনগুলো সে কাটাতে চায়। একটা ঘর বানিয়ে ছেলেরা তাকে সেখানে রেখে আসে। ছেলের হাতে, তার বয়সী ঢিলেঢালা আঙুল থেকে সে খুলে দেয় হীরের আঙটিটি, যে আঙটি তৈমুর আলি চৌধুরি অনেক চেষ্টা করেও কোনোদিন খুলতে পারেনি। আঙটিটি তার ছেলে মিরাজ মিঞা জুয়েলার্স-এর কাছে বিক্রি করতে গেলে প্রমাণিত হয় যে সেটা হীরা নয়, কাচ। এতে প্রমাণিত হয় যে, সমর্ত বানু সারাজীবন তার মনের মানুষ নয়, কল্পনার মানুষ নয়, স্বপ্নের মানুষ নয়, ভালোবাসার মানুষ নয়, দানবরূপী স্বামী তৈমুর আলির ঘর করেছে। যদিও আঙটি তাকে পরিয়ে দিয়েছিল তৈমুর আলি নয়, এলাচিংয়ের মা অঙমেচিং। কিন্তু এই আঙটিই ছিল তৈমুর আলির কাছে সুতোয় ঝুলে থাকা জীবন-মৃত্যুর মতো। কারণ তার জানামতে এতে ছিল বিষ। গল্পে গ্লাস দুটিও রূপক অর্থেই ব্যবহৃত। একটি গ্লাসের পানি বিষমুক্ত মানে তৈমুর আলির প্রতি তার যে ভালোবাসা, তা আসলে কৃত্রিম, এই ভালোবাসা সে পোষণ করত সুরত জামালের জন্য। আর আরেকটি গ্লাসে বিষ থাকা মানেই হচ্ছে, জোর করে বিয়ে করায় তৈমুর আলিকে সমর্ত বানু কোনোদিনও ভালোবাসতে পারেনি। আজীবন তার জন্য সে শুধু ঘৃণা জিইয়ে রেখেছে। আর তৈমুর আলি দুটি গ্লাসের পানি পান করার পর যদি মৃত্যুবরণ করে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, শেষ জীবনে সে হয়তো উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, সমর্ত বানু তাকে মোটেও ভালোবাসে না, বরং মনে মনে প্রচণ্ড ঘৃণা করে তাকে। এটা জানার পর যে প্রচণ্ড থাকা সে খায়, তা সে মুহূর্তে সামলে উঠতে পারেনি, মৃত্যুমুখে পতিত হয় কিংবা সে ‘লম্বা রেশমের অদৃশ্য সুতার আগায় ঝুলন্ত মাকড়শার মত সারা জীবন লটকে’ থাকার চেয়ে সমর্ত বানুর ভালোবাসার ‘আগামাথা না বের করতে পেরে মরে’ হয়তো বা আত্মহত্যা করে। যত কুহক বিভ্রমই জহির তৈরি করেন না কেন, চল্লিশ বছর ঘর করার পর সমর্ত বানুর প্রকৃত সত্তা যে সে আবিষ্কার করতে পেরেছিল, তা অস্পষ্ট নয়, এই গল্পে।

গল্পে জাদুবাস্তবতার কুহকবিভ্রমের ভেতর দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং ক্ষয়িষ্ণু জীবনবোধ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রকৃত সত্য তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন শহীদুল জহির। উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন মানুষের ভেতরের মানুষকে। যেখানে ভালোবাসা, ঘৃণা, লোভ, রিরংসা, মমতা, নিষ্ঠুরতা যুগপৎ খেলা করে ওঠে। মানুষের ভেতরের এই বিচিত্র সত্তার উন্মোচনের জন্যই হয়তো তিনি গল্পে বিভিন্ন উপকরণের সমাহার ঘটিয়ে তৈরি করেন ঘনঘোর রহস্যের জাল। হয়তো পাঠকরা এতে গোলকধাঁধাঁয় পড়ে। কিন্তু এই গোলকধাঁধাঁর মধ্যেই একজন শক্তিমান এবং স্বতন্ত্রধর্মী কথাকোবিদ হিসেবে শহীদুল জহিরের প্রকৃত সত্তাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *