
বাংলা কবিতাকে নিজস্ব স্বকীয়তা স্বতন্ত্র বোধের ধারায় বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতির সম্ভাবনা নিয়ে গতানুগতিক কাব্যধারার আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা থেকে বের হয়ে স্বকীয় স্বতন্ত্র পথ নির্মাণে প্রতিশ্রুশীল সিপাহি হিসেবে যিনি আমাদের সামনে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়িয়ে যান তাকে শাহীন খন্দকার হিসেবেই জানি। তিনি তারুণ্যের জোছনাবিলাস নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হন আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা সম্মোহন হতে থাকি। আধুনিক বাংলা কবিতার শূন্যের হাহাকার বলে ঠাট্টার ছলে আমরা যাকে অকুণ্ঠ চিত্তে অবগাহন করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে থাকি তিনি হলেন কবি শাহীন খন্দকার। সময়ের বিপন্নতা যিনি সুনিপুণ আলপনায় এঁকে যান আপন মহিমায় মহিমান্বিত কবিতা সুন্দর বউ!
বাংলা কবিতা যখন বাঁক বদলের প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির তখন একঝাঁক তারুণ্যের তুর্কি শূন্যের সাহিত্যকাশে নক্ষত্র রাতের স্বপ্ন নিয়ে ভিন্ন চিত্রকল্পের রঙে রাঙিয়ে নতুনধারায় কবিতা বিনির্মাণে লাল দুলদুলের পিঠে সওয়ার হয়ে সীমাহীন স্বপ্নচারী হয়ে ছুটে চলছে। কবি শাহীন খন্দকার তাদের মধ্য অন্যতম। বোধের দেওয়াল যখন শকুনের খাদ্য তালিকা হয়, ক্লাস্টার বোমায় বিদীর্ণ সভ্যতার আদি ভূমি, তখন শ্যামল মায়ের সন্তানের হৃদ চূর্ণ বক্ষ ক্ষরণে বেরিয়ে আসে সভ্যতার কঙ্কাল স্কেচ, গ্রন্থিত হয় বিকারগস্ত সভ্যতার ব্রেকফাস্ট খণ্ডচিত্র…
‘ছোট্ট ছিন্নভিন্ন দেহটি একটি কালো পলিথিনে করে ফেলে দিয়ে আসলেন নাজাফের নার্স
পাশে একটি কুকুর খাদ্যের খোঁজে…
কুকুরটি ক্ষুধার্ত
কুকুরটির চোখে একটি কালো পলিথিন
কুকুরটি হিংস্র
কুকুরটির চোখে শিশুটির শাদা হাত
কুকুর জানে না মুখে তার মনিবের হাত
আমিষের ঘ্রাণে অভুক্ত সে করে ফেলে পেটের আবাদ।’
[সভ্যতা/ শাহীন খন্দকার]
বিকারগস্ত সভ্যতা বোমা বোঝে মানুষ বোঝে না তাই তো কবি নব্য উপনিবেশবাদের নখরে রক্তাক্ত জনপদের পর জনপদের করুণ আর্তি কাব্যিক মুন্সিয়ানায় তোলে আনেন। কবি পাঠককে সাথে নিয়ে মানবিক জাহাজে করে দরিয়া থেকে দরিয়া চষে ফেরেন, কবির ঝাপসা চোখ লোনাজলের জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়। কবির কাঙ্ক্ষ্মিত যুদ্ধবিহীন, বৈষম্যহীন পৃথিবীর ক্ষতজুড়ে আজ ফাঙ্গাসের বসতি… দু’চোখ পুড়ে থাকে সারি সারি উদ্বাস্ত শিবির…
এই সব নক্ষত্রহীন মেঘলা আকাশে কবি শাহীন খন্দকার সময়ের দেওয়ালে বুনে যান কবিতার মায়াজাল আমরা শোকাভিভূত হই আবেগে আপ্লুত হই…
হাড়ের দৌরাত্ম্যে মা শান্তির লবণ হারিয়েছেন— দুর্ভিক্ষের হাট। ত্রাণ নিয়ে এবার বেরিয়ে পড়ব। যে হাড়গুলো শুয়ে আছে মা’র কোলে তাকে বোন বানাতে মরুর কৌশলপত্রে স্বাক্ষর করি। এবার ত্রাণ নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। দুধের সংকটে ঘুমাও ক্ষুধার চোয়াল নিয়ে ছোট্টবোন সাবসাহারা।
দুধের নগর নিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি..
নাসপাতি চুম্বন তাড়া করে তাকে বিস্তীর্ণ জলের সান্নিধ্য। তার জন্য জলের ভাতার নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। রুটির বাজার বসিয়ে বিনিময় হবে দাসত্বের তিলক। আর এখন প্রার্থনা ও দয়ায় হাড় ও অস্থিগুলো অসুস্থ পরস্পর। আমরা উপযুক্ত দাওয়ায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। সাবসাহারা গিলে খাক দুর্ভিক্ষের হাট। আর মানবিক কাঁচুলি খুলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি…
(এখানে ভাঙা মাস্তুল, কীভাবে প্রাণময় করি আশার সাঁতার—
কেবল ডুবে ভাসে আহা সনাতন সাবসাহারা।)
আমাদের ত্রাণ কোনোদিন পৌঁছে না
জলের সান্নিধ্য, দাওয়ায় কোনোদিন পৌঁছে না
আমাদের কান্নাগুলো কোনোদিন পৌঁছে না
তবু পরমায়ু পেয়েছে বোন। হাড় গুনে গুনে সযত্নে রাখি তার রুটির বিকার সভ্যতার ব্রেকফাস্টে…
[একটি নতুন মানচিত্র হবে দুগ্ধবতী গাভীর বিপরীত/ শাহীন খন্দকার]
কবি শাহীন খন্দকার কখনো বিপ্লবী কখনো মানবতাবাদী কখনো প্রেমিক পুরুষ! মসলিনের উত্তরাধিকার বহনকারী কারিগর, সুনিপণ মহিমায় একেবারেই নিজস্ব ঢংয়ে প্রেম/ দ্রোহ/ মানবিকতা একই ফ্রেমে সুবিন্যস্ত করে পাঠকের সামনে হাজির করেন। যা তার ব্যতিক্রম উপমা, চিত্রকল্প, শব্দগঠন ও উপস্থাপনায় সাবলীলতায় নিজে আলাদা করে পাঠকের মননে কবিতার সৌরভে আন্দোলিত করে তোলেন… কবিতা প্রেমিকের দল বিস্ময়ে তাকিয়ে রয় আর শাহীন খন্দকার খুতবার মতো আওড়াতে থাকেন…
‘সারাটা শহর উষ্ণতা খুঁজে খুঁজে ফিরে গেছে সংঘের চাকুরে।
শহরের কোত্থাও আর এতটুকু উষ্ণতা নেই।
আগুন নেই।
রোদ নেই।
রেড ওয়াইনের গ্লাসে করে রোদের অবশেষটুকু নিয়ে গেছে আমেরিকান জাহাজ।
হোয়াইট হাউস উষ্ণ হবে। তারপর আবার ব্রুম ব্রুম…
আমি প্রচণ্ড শীতার্ত বাঁকা হেসে তোকে স্পর্শ করি…
তোর বন্দরেও কোন জাহাজ এসেছিল চুপি চুপি, কাল রাতে!’
[চোর কিংবা তোর শরীরে লুকিয়ে রাখা উষ্ণতা খেয়ে বেড়ে ওঠা ভয়/ শাহীন খন্দকার]
দ্রোহে ও প্রেম ব্যবচ্ছেদে অন্তরমুখী চেতনা ছিঁড়ে শব্দের মায়াজালের সামিয়ানা ঘিরে শত জন্মের শিকায় তুলে রাখা শোকে কবি আপন মনে ভাবনার কপাটে রেখে দেন।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পাঠক যখন তৃষিত জোসনার বিলাসী দুঃখকাতর হয়ে ওঠেন তখন কবি বোধের পাঠশালায় একান্ত বাধ্য প্রেমিক পুরুষ হয়ে পেস্তা নামক প্রতিবন্ধী তরুণীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। প্রতিবন্ধী মানুষের যাপিত জীবনাচরণ কতটা দুঃসহ বেদনাময় ও করুণ তা স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখিয়ে জাগতিক ঐশ্বর্য তুচ্ছ করে এবং সামন্তবাদী চিন্তা মোহ ছিন্ন করে কবি নেমে আসেন মাটি মানুষে পৃথিবীতে… প্রেমাসিক্ত হৃদয়ের সমস্ত আকুতি ঝর্নার স্রোতস্বিনী হয়ে বয়ে যায় পললের বুকচিরে পদ্মা মেঘনা ও যমুনায়… কবির কলম আকুতির প্রার্থনার নিমগ্ন হয় আর সময়ের গতরে উৎকীর্ণ করে যান ভালোবাসার ধারাপাত…
বহুবিধ শূন্যতা ঘিরে চারদিক রেখে শোকের আলো, নাগরিক বিচ্ছিন্নতা
নিয়ে পরিত্যক্ত জ্যোৎস্না হয়েছ। যমুনার জলে কলোজল খেলাগুলো
কী নিষ্ঠুরের মতো তোমার দীর্ঘশ্বাস হলে, যন্ত্রণার নগরে ফুলেরা সুবাসহীন
বিষাদ উনুনে তোমার সুখগুলো সখি পুড়িয়ে পুড়িয়ে পৃথিবীর সব শোক
শরীরে মাখো। আর সঙ্গমের তাড়াগুলো ধ্বংসের সঙ্গীত শেষে
মৃত্যুশোকের মতো পাথরবন্দনায় পাথরের আত্মা হলে সখি…
আর আমি? কবিতা লেখার জন্য ক-তো হেঁটেছি…
……..
যান্ত্রিক ব্যস্ততার এই যে এইসব এই ভয়াবহ দুর্গন্ধে পাথররানী আর নাইবা হাঁটলে
হুইলচেয়ারটা খুব বোঝা হলে যুবতীপাথর তুমিই আমার কবিতা হও
আর হুইলচেয়ারটা ইতিহাস…
তোমার ভ্রান্তিগুলো ভেঙে ভেঙে সহানুভূতির সংজ্ঞা
যদি বোঝাতে পারতাম, হায়! কবিদের ভালবাসা করুণা নয়।
[পাথর বন্দনা/ শাহীন খন্দকার]
কবিতা নাকি ইদানীং পাঠক বিমুখতার রোগে শোকে ভারাক্রান্ত। কথাটা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রযুক্তির বিপ্লবে মানুষের মনন জগতে যে ধ্বংসযজ্ঞ ক্ষত সাধিত হয়েছে তা বিনির্মাণে একেবারেই নতুন স্বর, নতুন নতুন চিত্রকল্পের দ্রোহ নিয়ে পাঠককে বুঁদ করে রাখতেই শূন্যের অন্যতম কবি শাহীন খন্দকার বাজপাখির ডানায়, মুক্তির আকাঙ্ক্ষাপত্রে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার আওয়াজ তুলে উড়ে বেড়ান দূর দিগন্তে
ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর আর্তনাদ…!’ বাস্তুচ্যুত মিছিলের দীর্ঘশ্বাস! প্রজন্মের উঠোনে দাসত্বের চাষাবাদ বর্ণবাদী মাতাল সভ্যতার মাতৃক্রোড়ে বেড়ে ওঠে সাম্রাজ্যেবাদী অবোধ বালক… ভোরের আলোয় চাষ হয় রোদের সোনালি সোনালি ক্রন্দন। উদ্বাস্তু চোখে বাস্তু হারানোর ভীষণ কষ্ট! গোধূলির মৃত চোয়াল, সন্ধ্যার মতো নেমে আসা ক্লান্তির নিকষকালো অন্ধকার। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এই অদ্ভুত সময়ে কবি হাজির হন— সম্পূর্ণ আলাদা ঢংয়ে আলাদা মাত্রায়…
‘বধূর ওষ্ঠের মতো লোভ নিয়ে সূর্যাস্তে আছি
আমি জানি এভাবেই প্রতীক্ষা করতে হয়…
সভ্যতাকে সভ্য পোশাকে চিনব বলে
বাজার থেকে কিনে আনি প্রথম সূর্যের মতো জামদানি সুতো
পাইজাম চালের মতো ফুরফুরে সুঁচে সেলাই চলুক…
একটা পোশাক তৈরি হবে মানবিক!
যার হাত হবে খোরাসানের… সেলাই চলুক।
গলা হবে গাজা কিংবা নাজাফের… সেলাই চলুক।
সিনা হবে রামাল্লার… সেলাই চলুক।
আমি এ পোশাক পড়েই হবো জাতিসংঘের মহাসচিব।
[রোডম্যাপ/ কবি শাহীন খন্দকার]
জীবনবোধ সমসাময়িক আর্থসামাজিক ও বৈশ্বিক ঘটনা প্রবাহ, প্রতিদিন জীবনের ঘটে যাওয়া আলো-আঁধারি লুকোচুরি থেকে জীবনের নানান অভিজ্ঞতাকে কলমের আঁচড়ে হৃদয়োঙ্গম করে পাঠকের কাছে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপনের সিদ্ধহস্ত কবি শাহীন খন্দকার। শব্দের তুলিতে ভীষণ ভয়ঙ্কর সুন্দর এক উপস্থাপনা আমরা দেখি কবি শাহীন খন্দকারের কবিতায়। সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ
উন্মোচনে কবি সাম্রাজ্যবাদী জড় সভ্যতার ক্রীতদাসরা যখন দাসত্ব কেই ভাগ্যের নির্মমতা বলে মেনে নিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সন্তানদের ঘুমপাড়ানির গান শুনিয়ে ঘুমিয়ে দেয় আর দাসত্বের শরাবে আচ্ছাদিত যখন ঢুলু ঢুলু প্রজন্মের চোখ….
এ চোখকে কবি ভীষণ ভয় পান।। দাসত্বের মনোগত স্পর্শ করে লিখে যান দাস মননের ইতিবৃত্ত আর তাই তো ‘পাহারাদার’ কবিতায় দাসানুদাস বৃত্তান্তর নিয়ে হাজির হন আমাদের সামনে, পাঠকের চোখ বিস্ফোরিত হতে থাকে…। কবি লিখেছেন—
আরব যুবতীর ব্রা’র হুকটা
এই তো খুলে ফেললেন মহাশয়
আজন্ম লোভ এসে তার চোখে
নোঙর ফেললে আহা সুন্দরী
দু’ফোঁটা অমিয় তাকে দাও।
মাঝপ্রাচ্যের নাভিতে তার লোভগুলো
স্নান সেরে নিম্নমুখী হওয়ায়
আরো দু’ফোঁটা…
তোমার লিপস্টিকের স্বাদে পশ্চিমা চুম্বন
অস্থিরতার সাঁতার কেটেছে বহুদিন
রক্তের নগরীফটকে
কান পেতে দেখি আজ
অনুগত শয্যায় বসন ভাঙার আওয়াজ…
আরো ক’ফোঁটা তেষ্টার অমল দিলে গো…
নির্জনপ্রদেশ লোভে
তোমার সালোয়ারের ফিতা
এইমাত্র খুলতে সফল হলেন তিনি
ভয় নেই প্রিয়তমা খোদার কসম
আমাদের লাশগুলো পাহারায় আছি।
[পাহারাদার/ শাহীন খন্দকার]
মানুষ আজন্ম স্বাধীনতা-চেতা, কী করে পরাধীনতা উপভোগ করে তা কবির বুঝে আসে না…
কবি দাসত্বকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। বিক্ষুব্ধ কবি তাই দাসত্বের ললাটে ট্রিগার চেপে ধরেন। স্বপ্নের মাঝে ঈশা খাঁয়ের অশ্ব খুরে তাড়িত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় নিমজ্জিত কবি শাহীন খন্দকার সাম্রাজ্যেবাদী যুদ্ধবাজ মানবতা বলাৎকারীদের কানে ইসরাফিলের ফুঁৎকার মতো শুনিয়ে যান… মুক্তি গান—
‘তারপর আমি হেঁটে যাবো সাবসাহারার দুই লক্ষ কুড়ি হাজার নরকঙ্কাল পায়ে মাড়িয়ে, দেবদূতের মতো আমার হাতে থাকবে লোভনীয় রুটির গন্ধ। মেঘের দঙ্গল থাকবে চোখের মোড়কে। তারপর— আমি হেঁটে যাবো মায়ের মুখের মতো রূপকথা নিয়ে আল-আকসার মহাবিহ্বল প্রান্তরে। সেখানে প্রণয়ের গজল রোপন করে সিত্তুই আর কিরকুকের মহাহিংসা আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকবো আমার পিতার হিস্যার দলিল। সবুজ জরায়ুর আয়ুগুলো, বিপর্যস্ত রক্ত-মাংশের ভূমিগুলো আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকবো নিপীড়িত আগুনের বিদ্যা। তারপর…
একটা পোশাক তৈরি হবে আণবিক!
যার হাত হবে হোয়াইট হাউসের… সেলাই চলুক।
গলা হবে ব্রিটেনের… সেলাই চলুক।
সিনা হবে তেলআবিবের… সেলাই চলুক।
আমি সে পোশাক না পরেই হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক।
জেনে রেখো আজীবন বিক্ষুব্ধ কবিই একদিন ট্রিগার টেনে দেবে।’
[রোডম্যাপ/ শাহীন খন্দকার]
কী ভয়ঙ্কর সুন্দর উচ্চারণ ‘আজীবন বিক্ষুব্ধ কবিই একদিন ট্রিগার টেনে দেবে’। মুগ্ধতার মোহজালে যেন কাব্যআকাশ দুলছে….
কবি শাহীন খন্দকার শব্দকে কবিতার মায়াজালে এমন বুননে পাঠকের সম্মুখে হাজির করেছেন যে, সমসাময়িক প্রতিনিধিত্বকারী দশজন কবির কবিতা একই টেবিলে হাজির করলে অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে অনায়াসে আলাদা করা যায় তার কবিতা যা তার কবিত্ব শক্তির বহিঃপ্রকাশ। স্বল্পভাষী প্রচারবিমুখ এ কবি বুকে এক পাহাড়সম ক্ষত বয়ে বেড়ান, তার বুক যেন একটি বিপন্ন নগরীর মানচিত্র…
সমকালীন রাজনীতি, বিপন্ন সমাজব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মনোবৈকল্য তার কবিতার অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। তিনি সজোরে থাপ্পড় হাঁকিয়ে দেন বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেড়ে উঠা দানব কঙ্কালের গালে কেননা সাম্যহীন এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা কবির নিদহীন রাতের প্রবঞ্চনার মেঘ যেন নীরবতার চাবুক প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করে। তাই কবি শাহীন খন্দকারের কবিতায় আমরা প্রবঞ্চিত গণমানুষের কন্ঠের প্রতিবাদ শুনি, কবি বয়ান করেন—
পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলে একদিন এই লাশগুলো হবে
একটি সমাবেশ। নিহত ব্যথা নিয়েই একদিন ঘুমুতে যাবে
মা, স্ত্রী-পরিজন।
চোখের অজুহাতেই একদিন বাঙালি লজ্জা বানাবে।
একদিন এইসব ক্ষতগুলো থেকে জন্ম নেবে গণতন্ত্র।
সংবিধান একদিন মানুষ হবে।
[বার্ন ইউনিট/ শাহীন খন্দকার]
ঔপনিবেশিক উত্তর বাঙালি মনন গোলামির রাজনৈতিক মুক্তি হলেও এখনও সংস্কৃতিক অর্থনৈতিক আগ্রাসনের জাতাঁকলে নিষ্প্রাণ কখনবা ভৌগোলিক মানচিত্র ঘিরে, কবির ভাষায়—
‘বুঝি প্রিয় বাংলাদেশ সাহস হারিয়ে ফেলছে, এই শঙ্কায়! প্রতিবাদ করতে ভুলে যাচ্ছে এই শঙ্কায়।’
‘ভয় পেতে শুরু করলে দেখবেন একদিন এই এতবড় পৃথিবীটাও ছোট্ট হয়ে আসবে লুকোবার জায়গা পাবেন না।’
শূন্যের শক্তিমান কবি সার্বভৌম চেতনায় ভৌগোলিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাবানলের মতো জ্বলতে দেখি। তাই তো কবি রেহেলে সাজিয়ে রাখা দুঃখবোধকে নিজস্ব ঢংয়ে উপস্থাপন করেন এভাবেই—
বহুদিন পর আব্বা স্বপ্নে আসলেন। আড়মোড়া ভেঙে নামলেন খাটিয়া থেকে। আব্বা আমার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে ভীষণ ক্ষুধা। আব্বা কথা বলেন না। মৃত্যু থেকে জেগে উঠবার পর যেন তিনি বোবা হয়ে গেছেন।
আব্বা আপনি জানেন না, আপনাকে কেউ কেউ এখন বাংলাদেশ ভাবে। আপনি জানেন না, আপনাকে বাংলাদেশ ভাবলে আমি কতোটা দেশপ্রেমিক হয়ে উঠি। আপনার সবিনয় কণ্ঠটা বাংলাদেশের চেয়ে সামান্য বড়। সেই কণ্ঠ আমাকে অমায়িক করে। আমি তাই রেহেলে আপনাকে রেখে পড়ি। আমি তাই রেহেলে বাংলাদেশ রেখে পড়ি।
আমি পড়ি— আব্বা পৃথিবীতে জন্ম নেয়া একটা একাকী নিমগাছ। কারা যেন তার ডাল ভেঙে নিয়ে যায়! আমি পড়ি— বাংলাদেশ পৃথিবীতে জন্ম নেয়া একটা একাকি নিমগাছ। কারা যেন তার ডাল ভেঙে নিয়ে যায়! সেখানে শাহীন নামের পাখিগুলো আর বসতে পারে না। সাথী কিংবা শাহনাজদের জন্য তার আর কোনো সবুজ থাকে না।
বহুদিন পর আব্বা স্বপ্নে আসলেন। বহুদিন পর বাংলাদেশ স্বপ্নে আসলেন। আড়মোড়া ভেঙে নামলেন খাটিয়া থেকে। তার চোখে ভীষণ ক্ষুধা…
আহা স্বপ্নগুলোই পরমাত্মীয়। আহা পরমাত্মীয় স্বপ্নগুলো! স্বপ্নগুলো ভেঙে গেলে আব্বাকে দেখি না। তাঁর কবর দেখি। স্বপ্নগুলো ভেঙে গেলে বাংলাদেশ দেখি না। তার কবর দেখি।
[বাংলাদেশ একটা একাকী নিমগাছ/ শাহীন খন্দকার]
কবিতা অনিন্দ্য সুন্দর কবিতা শাদা কাশফুলের মতো শুভ্র ভয়ঙ্কর তা শূন্যের বাজপাখি শাহীন খন্দকারের কবিতায় আমরা পাই। মুগ্ধতার মোহজালে আধফালি প্লাবিত জোছনা অবিশ্বাস্য শব্দমায়া জালে আমরা বারবার মুগ্ধ পাঠকের কাতারে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যাই…।