
স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই ৫০ বছরের যাত্রায় দৃশ্যত নারীর অবস্থান সুসংহত হয়েছে। অনেক বাধা-বন্ধ, প্রতিকূলতা, নিষেধের দেয়াল, কুসংস্কারের আবর্ত পেরিয়ে নারী প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে নিজেকে। তাই সেই ঘোমটা পরা অবদমিত নারী সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যুক্ত করেছে সমাজের মূলধারায়।
নারীর চলার পথটি এই ৫০ বছরে মোটেও মসৃণ বা কুসুম বিছানো ছিল না। কণ্টকাকীর্ণ পথ মাড়িয়েই নারীকে জায়গা করে নিতে হয়েছে। নারী বলতে আজ আর তাই ঘরবন্দি নারীর চেহারা আমাদের সামনে ভাসে না। লাজুক, অবলা, অক্ষম, নির্ভরশীল, কুণ্ঠিত নারীর ছবি আমাদের চোখের সামনে উপস্থাপিত হয় না। নারী আজ আপন শক্তিতে বলীয়ান, আপন মহিমায় দীপ্ত। নারী সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই জায়গা করে নিয়েছে নিজ যোগ্যতায়। এই পরিবর্তনের পেছনে ক্রিয়াশীল ব্যক্তিগত, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। সবার মিলিত চেষ্টাতেই এই অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং মহান জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। কথা সত্য। কিন্তু পুরোটা সত্য নয়। শুধু এই তিনটি পদ নয়, আরো অনেক বড় বড় পদে নারীরা আজ আসীন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগে নারীর পদচারণা গত ৫০ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সহস্রাধিক নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারীরা বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন, বিচারপতি, উপাচার্য, পর্বতারোহী, বিজিএমইএ’র সভাপতি, মেজর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর যথাযোগ্য অবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধারা সন্নিবেশ করা হয়েছে। ১৯ অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা হয়েছে— “জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের ক্ষমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবে।” ২৭ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে— “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী”। এছাড়াও ২৮(১) ২৮(২), ২৮(৩), ২৮(৪), ২৯(১), ২৯(২) ধারায় নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকারের বিধান রয়েছে। ৬৫(৩) ধারায় নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষিত আছে এবং এ ধারার অধীনে নারী স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।
শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইন্সট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭০-৭১ সালে দেশের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশের কিছু বেশি। সরকারের শিক্ষা তথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯-২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৫১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সর্বমোট শিক্ষার্থীর প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংখ্যা কমে সর্বমোট সংখ্যার ৩৮ শতাংশ আছে ছাত্রী। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে সর্বপ্রথম প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছে। এমনকি মাধ্যমিক শিক্ষায়ও আমাদের এই সাফল্য রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ মিলিয়নের মধ্যে ৯৭.৯১ শতাংশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, যাদের ৫০.৯ শতাংশ মেয়ে। মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৫৩ শতাংশ। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২০ সালে মোট শিক্ষার্থীর ৪৫.২৭ শতাংশ ছিল মেয়ে শিক্ষার্থী। কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৪৬ শতাংশ নারী বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারী নেতাদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বলেছেন, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে ৭ম অবস্থানে আছে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রায় ৭০ শতাংশ নারী এবং তারা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে রয়েছে। তৈরি পোশাককর্মীদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। (ডেইলি স্টার, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২১)।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে সংরক্ষিত আসন ও নির্বাচিত ২২ জনসহ ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি আছেন ১২ হাজার জনের মতো।
নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলতে হলে প্রথমেই আসে পোশাক খাতের নাম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরার (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পোশাক খাতের অবদান ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এই খাতে কাজ করা ৪০ লাখ শ্রমিকের ৫৯ দশমিক ১২ শতাংশ নারী। এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট (এসিডি)-র জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট ৪২ লাখ ২০ হাজার পোশাকশ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৮ হাজার। এই খাতে নিয়োজিত নারীকর্মী দেশের শিল্পখাতে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ ভাগ।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। প্রবাসী আয় প্রাপ্তির দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৯২৫, যা মোট সংখ্যার ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট কর্মক্ষম নারীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কৃষিকাজে নিয়োজিত। নারী শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিকাজে। বিবিএসের ২০১৮ সালের তথ্যমতে, দেশের কৃষি খাতে নিয়োজিত আছে ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী।
চা বাগানগুলোতে কাজ করা ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি শ্রমিকের ৭০ ভাগই নারী। বাংলাদেশে ২০১৯ সালে নয় কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। ১৬৬ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয় ২০১৯ সালে। (সূত্র : প্রথম আলো, জুন ২০২০)। প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে নারীর জন্য ৬০ শতাংশ কোটা থাকলেও সেই সীমারেখা বেশ আগে অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ। মাধ্যমিকে শিক্ষক হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ আশানুরূপ নয়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এই হার নগণ্য। (সূত্র : প্রথম আলো)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই খাতে ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী। সেবা খাতে ৩৭ লাখ নারী কর্মরত। ২০২০ সালে নার্সিং ও মিডওয়াফারি অধিদপ্তরের পিএমআইএস তথ্য অনুযায়ী, দেশে পুরুষ নার্সের সংখ্যা মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ৯০ দশমিক ৬ শতাংশই নারী। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন। এদের মধ্যে ডিআইজি দুইজন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি তিনজন, পুলিশ সুপার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০৯ জন ও সহকারী পুলিশ সুপার ১০০ জন। এছাড়া ইন্সপেক্টর ১০৯, এসআই ৭৯৭, সার্জেন্ট ৫৮, এএসআই এক হাজার ১০৯, নায়েক ২১১ এবং ১২ হাজার ৫৯৪ জন কনস্টেবল নারী। প্রশাসন ক্যাডারে বর্তমানে ২৬ শতাংশ নারী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী, ১৪৯ জন ইউএনও ছাড়াও বর্তমানে ১০ জন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ৩৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এবং ১৭৩ জন সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে নারী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া সচিবের মধ্যে ১১ জন নারী। ৫১১ জন অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে নারী ৮৩ জন, ৬৩৬ জন যুগ্ম-সচিবের মধ্যে ৮১ জন নারী।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী আছেন। তবে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে নারীর সংখ্যা ১ শতাংশ বা তারও কম। দেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদেও নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, কারখানায় ২১ লাখ ১ হাজার ৮৩০ জন নারী শ্রমিক রয়েছেন। পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১৯ লাখ ৯৫ হাজার ৫৫৭ জন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত বছরের এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের অবদান প্রায় সমান সমান।
শ্রমবাজারে ক্রমান্বয়ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে নারীদের বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক বা নিম্ন আয়ের ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী। বাকিরা শিক্ষকতা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা পেশায় যুক্ত। খেলাধুলায় এগিয়ে গেছে এদেশের মেয়েরা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান উল্লেখ করার মতো। ফুটবল সারাবিশ্বে জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশ জাতীয় চ্যাম্পিয়ানশিপে এখন ৪৪-৪৫টি টিম অংশগ্রহণ করে। অনুর্ধ্ব ১৫ নারী ফুটবল দল সাফ অনুর্ধ্ব ১৫ চ্যাম্পিয়ন হয়।
সংবাদপত্র, মিডিয়া ইত্যাদি চ্যালেঞ্জিং কাজে নারীদের পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি অংশগ্রহণ করেছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি বেড়েছে। বিবিএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল ৪ শতাংশ। এই হার ১৯৮০ সালের দিকে ৮ শতাংশ ও ২০০০ সালে ২৩.৯ শতাংশ, তবে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণে ২০১০ সালে বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ জরিপে নারী হিস্যা ৩৬.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার অনেকগুলো নারীবান্ধব আইন করেছে। কিছু আইন নারীকে সম্মান এনে দিয়েছে। সকল শিশুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকর্ষণীয় করে তুলতে নানারকম সুবিধা প্রদান করছে সরকার। এতে মেয়েশিশুদের বেশি উপকার হয়েছে। নারী উন্নয়নের এই চিত্র দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের নারীরা সত্যিই খুব ভালো আছেন। সম্মানের সাথে আছেন। কিন্তু এটা যে সত্যের পুরোটা নয়, এটাই বাস্তবতা। নারী চাকরিতে শীর্ষ পদে গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন হয়নি। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে শুধু বড় বড় পদে পদে আসীন থাকাকে বোঝায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান কোথায়, নিজ অর্থ নিজে ব্যয় করার সক্ষমতা আছে কিনা সেটা ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় প্রশ্ন। ক্ষমতায়ন আসলে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়া। প্রকৃত ক্ষমতায়ন তখনই হয় যখন নারী নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পেশা নির্বাচনসহ সবক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায়। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সমঅধিকারের ন্যায্যতা পায়। বাংলাদেশে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা এখনো সীমিত। অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন বড় পদে চাকরি করা নারীও নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পান না। মতামত দেন পরিবারের পুরুষেরা। যদি তারা বয়সে ছোটও হন তাহলেও নারীর কথা গ্রাহ্য না হয়ে তাদের কথাই গ্রাহ্য হয়। কারণ তারা পুরুষ। মতামত দিতে গেলে নারী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হন। যে কোনো কাজ, ঘরে বা বাইরে, দেশে বা বিদেশে নারী বলেই সহজ নয়। কিন্তু তাকে যদি কর্ম দিয়ে বিবেচনা করা দেখা যাবে সে পুরুষের সমকক্ষ।
রাজনীতিতে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি নারী অংশগ্রহণ করলেও এ স্থান বৈষম্যহীন নয়। প্রথমত নারী, দ্বিতীয়ত নারীর হাতে টাকা থাকে না বলে এদেশের নারীরা আজও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নীতিনির্ধারণ থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এটা সত্য, রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া নারীর পূর্ণ বিকাশ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সমাজ ও রাজনীতিতে নারীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, কথা বলার অধিকার পেতে হলে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসা ছাড়া বিকল্প নেই। সংখ্যাগত বিচারে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের অনুপাত এখন সমান। কিন্তু নারীকে অধস্তন জ্ঞান করে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। দৃষ্টিভঙ্গির তেমন পরিবর্তন আজও হয়নি। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমাজে এখনো নারী পুরুষ মজুরি বৈষম্য বিদ্যমান। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। পথে ঘাটে, গণপরিবহনে, অফিসে, গৃহে নারীরা নিরাপত্তাহীন। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির দাপটে পারিবারিক সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে কন্যা-শিশুদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বাল্যবিবাহের ফলে নারীর শিক্ষা-জীবন, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। মাতৃ-মৃত্যু, নবজাতক মৃত্যু, অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের প্রভাব সরাসরি পড়ছে নারীর উপর। নারীর ক্ষমতায়ন এককভাবে হয় না। এর সাথে নারী পুরুষের সমতা অর্জন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নারীকে সমান না ভাবায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শারীরিক মানসিক নির্যাতন নিপীড়ন করে পুরুষ। নারী সামনে এগুতে পারে না। ক্ষমতায়ন তো আরও পরের কথা।
একটা সমৃদ্ধ সুখী সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন দরকার। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তাদের বাদ দিয়ে বা পেছনে ফেলে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ জরুরি। বিদ্যমান সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতিনীতি নারীবান্ধব নয়। অগণতান্ত্রিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত অধিকাংশ পুরুষ। নারীকে অবদমিত করে রাখাতেই তাদের আনন্দ। তাই শহুরে নারী কিছুটা পারলেও গাঁও-গ্রামের নারী অধিকার ও স্বাধীনতাবঞ্চিত। পুরুষ নারীকে হীন ও নিচু চোখে দেখছে। তাই আজও নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর ও অশালীন মন্তব্য করতে দেখা যায়। নারীর সাজসজ্জা ও পোশাক নিয়ে কথা হয়। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে নারীরা উপেক্ষিত। নারীর গৃহকর্মের কোনো মূল্যায়ন নেই। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’ অনুযায়ী, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নারী সমতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। এই জেন্ডার গ্যাপ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম। এ সূচকে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে— ক. অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ; খ. শিক্ষাগত অর্জন; গ. স্বাস্থ্য ও বেঁচে থাকা; ঘ. রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা অর্জন করতে হলে এই চার সূচকের সবগুলোর দিকেই নজর দিতে হবে।
এ জন্য জরুরি পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করা। ন্যায্যতা, যুক্তি আর জ্ঞানের ভিত্তিতে সমাজকে গড়ে তোলা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানো। নারীর প্রতি সহিংসতা নির্মূল করা। বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা জোরালো করা। সমাজে নারী-পুরুষের সমতা সাধন। বস্তিবাসীর মধ্যে নারী পুরুষ বৈষম্য প্রকট। বেশির ভাগ মেয়েশিশুকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয় না।
নারীর গুণগত উন্নয়ন প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে সংবেদনশীল কর্মোপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা, নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের পূর্ণ ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নারীবান্ধব আইনগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন দরকার। কর্মক্ষেত্রে পেশার বৈষম্য তীব্র। একই যোগ্যতা নিয়ে নারী পুরুষের অধস্তন হয়ে কাজ করছে। বেতনের ক্ষেত্রেও নারী-পুরুষে সমতা নেই। নারীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবাহের কারণে, সন্তান জন্মদানের কারণে ছুটি না পেয়ে চাকরি হারায়। সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্যে সরকারের নীতিমালা আছে। কিন্তু বাস্তবায়ন তেমন নেই। তারা পিছিয়ে আছে। তাদের জন্যে পরিবেশবান্ধব শিক্ষা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, উপযোগী পরিবেশ দরকার। সমাজ ও পরিবারে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অধস্তন। তাদের জন্য তর্ক করা বেয়াদবি। ছেলেদের তর্ক করা বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়। মেয়েরা অবলা, পুলিশ মারবে না এই ভাবনায় তাদের মিছিলের সামনে রাখা হয়! এখনও পরিবারে পুরুষের ভূমিকা উপার্জনকারী আর নারীকে ভাবা হয় সেবিকা ও উৎসাহদানকারী। এসব দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত নারী-পুরুষের সমতা রক্ষা করা হোক। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ গৃহীত সিডও সনদ বাস্তবায়ন হোক। তবেই বাস্তবিক অর্থে নারী পুরুষ এক কাতারে দাঁড়াতে পারবে।
আফরোজা পারভীন : লেখক ও কথাসাহিত্যিক