বাগেরহাটের পথে-১
টুঙ্গিপাড়া থেকে বাগেরহাট কতটা দূরে জানতাম না। বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স ঘুরে দুপুরের আহারে বসেছি বাসস্ট্যান্ডে। ছিমছাম ছোট্ট হোটেল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খাবারও চমৎকার। আমরা নিলাম উচ্ছে ও আলুভাজি, দেশি কৈ মাছ, পালং শাক দিয়ে, আর ডাল রান্না অমৃতসম। খেতে খেতে বাগেরহাট যাওয়া ফাইনাল। পরিতৃপ্তির আহার শেষে গাড়ি খোঁজ করি কিন্তু ডাইরেক্ট গাড়ি নেই। তাতে কী, আমরা যাব ইনশাআল্লাহ। একটি বাহনে টুঙ্গিপাড়া ব্রিজ পেরিয়ে অন্য একটি গাড়িতে চিতলমারী বাজার রাস্তার দুপাশে ঘন সবুজ গাছপালা মাঝখান দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা কালো পীচের রাস্তা। নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছা, যাত্রা বিরতি হলে চা দিল দোকানি। শেষ বিকেলের নরম আলো পায়ের কাছে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে চনমনে হয়ে ওঠে শরীর মন পথের ক্লান্তি ভুলে যাই। আবারও যাত্রা শুরু বেলা ডুবে যাওয়া আগেই বাগেরহাট পৌঁছে গেলাম। হোটেলে ওঠে গরম পানিতে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম। রাতে খোলা রিকশায় চড়ে রাতের শহর দেখে নিলাম। বাসস্ট্যান্ডের পাশে দাদা-বৌদির হোটেলে গরম গরম সেদ্ধ আটার রুটি আর সবজি খেয়ে চা পান করে হোটেলে ফিরে আসি একটা টানা ঘুম। ফজরের আগেই ঘুম ভেঙে যায়, ওঠে যাই গোসল নামাজ সেরে ভোর ছয়টায় বেরিয়ে যাই। সেই দাদা-বৌদির হোটেলে আমি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আলুভর্তা সবজি ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে নেই। তারপর চা খেয়ে হযরত খানজাহান আলীর দরগার উদ্দেশ্য বেরিয়ে যাই ভাড়া গাড়িতে।
দরগায় যখন পৌঁছাই তখন লোকজন তেমন একটা নেই। শান্ত সিগ্ধ অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। বিশাল দিঘি মসজিদ দরগা আমরা জিয়ারত করে দিঘির পাশে বসি। এখানে বাস করত বিশাল কুমির যাদেরকে নিজের হাতে খাবার খাওয়াতেন তিনি। পরবর্তীকালে মিউজিয়ামে তাদের মমি দেখতে পাই। সুন্দর সকালে একটি পবিত্র মন নিয়ে দরগা থেকে বেরিয়ে আসি। পথের ক্লান্তি ভুলে পথের পাশের চায়ের দোকানে অবশেষে।
বাগেরহাটের পথে-২
হযরত খানজাহান আলীর দরগার বাইরে পথের পাশের চা দোকান থেকে চা পর্ব শেষ করে, আবারও ভাড়া গাড়িতে করে চললাম নয় গম্বুজ মসজিদ দেখতে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। টিলার উপর সেই মসজিদ কিন্তু পরিত্যক্ত নয়। নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। নির্জনতায় ছেয়ে আছে চারপাশ। ঘনবনরাজি পাহাড়ি নদী বা খাল বয়ে যাচ্ছে। ভীষণ ভালো লাগছিল। উঠে আসতে মন চাই ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় এমন নির্জনতার কাছে। এ-জীবনে আর যাওয়া হবে কিনা জানি না, তাই মনভরে বসে উপভোগ করি প্রকৃতির শোভা তাতে কেউ বিরক্ত হয় না। আসলে ভ্রমণের জন্য যথেষ্ট সুস্থতা দেখার চোখ আর উপভোগ করার মন থাকা চাই।
এই পাহাড়ি পথে আর কিছু দরগা ও কবর দেখলাম। সত্যিই ইবাদতের জন্য উপযুক্ত জায়গা।
অবশেষে আবারও পথচলা নির্জনতার কোলে জিন্দাপীরের দরগায় এলাম প্রায় সাতশ বছর আগের সমাধি সাথে প্রাচীন কিছু পাকা কবর সুলতানি আমলের স্থাপত্যকলার অনুকরণে। ইনারা শুধু ধর্ম প্রচার করতে আসেননি যথেষ্ট প্রভাবপ্রতিপত্তি ছিল। টিলার উপর ইমারত মসজিদ নির্মাণ প্রতিটি দরগার পাশে। মন না চাইলে ও আসতে হলো এবার প্রাচীন এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ দেখলাম। ষাট গম্বুজ মসজিদের বিপরীতে আরও একটি মসজিদ দেখে রাস্তা পার হয়ে ষাট গম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্সের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাগেরহাটের পথে-৩
টিকিট কেটে ষাট গম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্সের ভেতরে প্রবেশ করে, চোখ জুড়িয়ে গেল। অবারিত সবুজ আর সবুজ। সুবিন্যস্ত বাগান। মাঝে মাঝে কারুকার্যময় বেঞ্চপাতা দেখলেই বসতে ইচ্ছে করে। আমি একটু হাঁটলে ক্লান্ত হয়ে যাই তখনই বসে যাই। ঠাণ্ডা হাওয়া মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। এই নির্জনতা ভেঙে যায় পাখির কলরবে। উদার নীল আকাশ ঝকঝকে সোনালি রোদ গায়ে মেখে এগিয়ে যাই ষাট গম্বুজ মসজিদ চত্বরে। তোরণ দিয়ে প্রবেশ করতে দু’পাশে খান জাহান আলী সাহেবের ভক্তদের সমাধিস্থল। মসজিদের চারপাশে ঘুরে দেখলাম, অনেক দর্শনার্থীরা দেশ বিদেশের না না প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে। আমরা পেছনের গেট দিয়ে বিশাল দিঘির পারে শানবাঁধানো ঘাটে এসে বসলাম। লাল শাপলা ফুটে আছে দিঘিময়। বসে ছিলাম দীর্ঘ সময় মনে হচ্ছিল এ এক অপার শান্তির জায়গা। চারপাশে ছায়াময় মায়াময় বৃক্ষরাজি।
আবার ভেতরে যাই এতক্ষণে যাদুঘর খোলার সময় হয়ে গেছে নব্বই দশকে নির্মিত মোঘল ঘরানার আদলে গড়া বিল্ডিংটি। প্রদর্শনীতে আছে নানা তৈজসপত্র, বিভিন্ন সময়ের খনন করে পাওয়া মাটির পাত্রসমূহ। এখানে আছে দরগার দিঘিতে পোষা কুমিরের মমি। আছে দর্শনার্থীদের মন্তব্য খাতা, সেখানে আমি অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ পেলাম। তারপর বেরিয়ে এলাম। আবারও সেই ভাড়া গাড়িতে পথে ছয় গম্বুজ মসজিদ দেখে হোটেলে ফিরে আসি। খানিক বিশ্রাম নিয়ে দুপুর বারোটার বাসে রওনা হই, শুকনো খাবার ফল-মিষ্টি কিনে নিই। বাসে বসে খেয়ে নিই।
বিকেল নাগাদ ঢাকায় পৌঁছে যাই। হরতাল অবরোধের ভেতর স্বল্পপরিসরে ভ্রমণ সার্থক।