অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ১৮, ২০২৪
২রা কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মঈনুস সুলতান -
মরক্কোর দুর্গম এক পর্বতের পথে-প্রান্তরে

মরক্কোর মারাকেশ নগরীর বুনিয়াদি কেতার নকশায় তৈরি মদিনাতে গলিঘুঁজি অনেক, তবে ভোরবিহানে ট্র্যাফিকের ঝুটঝামেলা থাকে না একেবারেই। চেজ ব্রাহিমের রিয়াদে বা সরাইখানায় লেটনাইট পার্টির কারণে আমরা খানিক ক্লান্ত, তাই পয়দলে একটি ব্লক পাড়ি দিয়ে মাইক্রোবাস পাকড়াতে বিরক্ত লাগে। আজ আমাদের গন্তব্য— জাবলে আটলাস নামে আফ্রিকান মাগরেবের বিরাট একটি মরু-পর্বত। আমরা— জনা সাতেক পর্যটক একত্রে জোট বেঁধে কোন ট্যুর-গাইড ছাড়া মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাত্রার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের সহযাত্রী সেনেগালের মেয়ে হাবিবাতু হুব্বা শেষ মুহূর্তে ট্যুর ক্যান্সেল করতে বাধ্য হয়। পেশায় ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ী হাবিবাতু যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী, সে সিঙ্গেল মাদার, মায়ের সফরজনিত দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তার ছেলেটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় হাবিবাতুকে তাবৎ কিছু ক্যান্সেল করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে হলো। মেয়েটি হাসিখুশি মেজাজের, যাত্রাপথে গান গেয়ে হাসিঠাট্টায় মাতিয়ে রাখতে পছন্দ করে। আজ আমাদের সঙ্গে সে জাবলে আটলাসে না যাওয়াতে তৈরি হয়েছে এক ধরনের শূন্যতা।

তবে হাবিবাতুকে বাদ দিয়ে আমরা বাকি ছ-জন পর্যটক মাইক্রোবাসে জুত হয়ে বসতেই, ব্রিয়না ‘লেটস্ বিগিন আওয়ার সাইকোডেলিক ট্রিপ টু দ্যা মাউন্ট আটলাস’, বলে হাঁক দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার ইশারা দেয়। অস্ট্রেলিয়ার নারী ব্রিয়না বছর দেড়েক ধরে বসবাস করছে মরক্কোতে। নেশায় প্রকৃতি পর্যবেক্ষক এ মেয়েটি ট্র্যাভেল রাইটার হিসেবে মাঝে-মধ্যে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে। মরক্কোর ট্যুরিস্ট স্পটগুলো সে ভ্রমণ করেছে একাধিকবার, তাই আজকের সফরের খুঁটিনাটি সমন্বয় করতে আমরা তাকে দায়িত্ব দিয়েছি। ব্রিয়না সামনের সিট থেকে গ্রীবা বাঁকিয়ে আজকের আটলাস-সফরের লজিস্টিকস্ নিয়ে মৃদুস্বরে কিছু বলে। কিন্তু ঘুমচোখে আমি মনোযোগ দিতে পারি না। কেন জানি খানিক বিরক্তও লাগে।

কিন্তু ভেজা-টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ মুছে শহর ছেড়ে উপত্যকায় চলে আসতেই আশপাশের অলিভ কুঞ্জের দিকে তাকিয়ে মেজাজ ভালো হয়ে ওঠে। ঘোড়ার গড়িতে করে নগরীর দিকে চালান দেওয়া হচ্ছে ফুলকপি, শালগম ও পুদিনা। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস বয়ে আনে তাজা ভেষজের গন্ধ।

রিয়াদ বা সরাইখানা থেকে শুধু যানবাহনই সরবরাহ করা হয়নি, সাথে জোগান দেওয়া হয়েছে ফরাসি ও ইংরেজি বোলচালে দক্ষ ড্রাইভারও। সুদর্শন চালক বয়সে তরুণ, তার নামটিও জমকালো, আবদেনবি আমজানি শব্দ দুটি বারবার না জপলে মনে রাখা মুশকিল। ড্রাইভ করতে করতে আবদেনবি সেলফোনে খুটখাট করতে পছন্দ করে, এবং তাকে কোনো প্রশ্ন করলে ভারি সুন্দর করে হেসে বলে, ‘আই উইল এক্সপ্লেইন ইট লেইটার।’

মাইক্রোবাসটি সুপরিসর, তবে কী কারণে জানি পুরো একটি সিট খালি রেখে একেবারে পেছনে সেঁধিয়ে বসেছেন, ইলিয়ট ল্যাজারস ও ইয়ানুস কুশনার। প্যারিসের বুকিনিস্ত বা গ্রন্থবণিক ইলিয়ট আমার পূর্বপরিচিত। নানাদেশের বিচিত্র সব সূত্র থেকে তিনি খরিদ করেন শত বছরের পুরোনো সব বইপত্র। এগুলো নিজহাতে বাঁধাই ছাদাই করে প্যারিসে আগত পর্যটকদের কাছে তা চড়ামূল্যে বিক্রি করে থাকেন। তিনি ব্যাকপ্যাকে ক্যারি করছেন বেশ কতগুলো জনপ্রিয় গ্রন্থের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় সংস্করণ। মাস দেড়েক ভ্রমণ করে এ ভদ্রসন্তান প্রায় কপর্দক-শূন্য। আমি তাঁকে রাহাখরচ বাবদ বেশ কিছু টাকা ধার দিয়েছি। ইলিয়ট তক্কে তক্কে আছেন ইয়ানুশ কুশনারের কাছে বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত একটি কেতাব বিক্রির।

হাই পাওয়ার লেন্সের চশমা পরা ইয়ানুস কুশনারের পারিবারিক নিবাস আর্জেন্টিনিয়ার বুয়েনেস আইরেসে। পিতা ইনভেস্টার। ধর্মবিশ্বাসে উদারনৈতিক ইহুদি ইয়ানুস পেশায় একজন মেরিন বয়োলজিস্ট। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন। এন্টিকোয়েরিয়ান বা বহু বছরের পুরোনো এবং বহুল ব্যবহৃত বইপত্র কালেকশনে তাঁর আগ্রহ অশেষ। আমিও প্রত্যাশা করছি, যদি-বা তিনি একটি গ্রন্থ খরিদ করেন, তাহলে ইলিয়ট হয়তো আমার ধার শোধ করতে আগ্রহী হবেন।

সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন ডেভিড-নিওম আলদ্রিদি। যুক্তরাষ্ট্রের এ নাগরিকের জননী তিউনিসিয়ার নারী, সে সুবাদে তিনি আরবি বলেন চমৎকার। পেশায় আলদ্রিদ্রি মিউজিক জার্নালিস্ট, তবে নেশায় তাকে মেকানিক বলা চলে, মোটরকার থেকে কম্পিউটার— হেন বস্তু নেই যা তিনি সারাই করতে অপারগ। প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলদ্রিদ্রি ঘোরাফেরা করেন, তাঁর প্রখর পার্সোনালিটি কখনোসখনো হয়ে ওঠে রীতিমতো সমস্যা। আলদ্রিদ্রির শরীর ঘেঁষে বসেছে ব্রিয়না, আটলাস পর্বতের মানচিত্র মেলে ধরে সে খুঁটিয়ে কিছু দেখছে, তার একটি হাত ডেভিড-নিওমের আংগুরিতে গাঁথা আনকাট ডায়মন্ডটিও টিপে-টুপে বোধকরি পরীক্ষা করছে হীরকের স্থীতিস্থাপকতা। আন্দাজ করি, মিশ্র রক্তের সুদর্শন পুরুষ আলদ্রিদ্রি নিঃসঙ্গ ব্রিয়নার দেহমনে নীরবে ছড়াচ্ছেন তাঁর রোমাঞ্চকর সম্মোহন।

আমার পাশে বসেছে ইসাডোরা ডি’সান্তোস নামে ব্রাজিলের অ্যামাজনিয়া অঞ্চলের এক তরুণী। মেয়েটির পিতা পুর্তুগিজ বংশোদ্ভুত সিনর ডি’সান্তোস বছর দশেক আগেও ব্রাজিলের অ্যামাজন রেনফরেস্ট থেকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সংগ্রহ করতেন মেহগিনি ও রোজউড। গেল কয়েক বছর ধরে তিনি কাঠজাত পণ্য রফতানির ব্যবসা স্থগিত রেখে রেনফরেস্ট সংরক্ষণে ব্রতী হয়েছেন। মেয়ে ইসাডোরার জননী অ্যামাজনিয়া অঞ্চলের আদিবাসী রমণী। ইসাডোরা ব্যালে নাচের অ্যাডভান্স লেভেল ট্রেনিং নিতে বছর খানেক কাটায় যুক্তরাষ্ট্রে। কোমরে ইনজুরি হওয়াতে আপাতত সে নৃত্যমঞ্চ থেকে বিরতি নিয়ে বসবাস করছে গ্রীসের ম্যাকনস আইল্যান্ডে।

ইসাডোরা এ মুহূর্তে বটুয়া থেকে বের করে মুখে পুরছে একটি-দুটি কাজুবাদাম। প্রান্তর কেটে গড়িয়ে যাওয়া পিচঢালা সড়কে বেজায় জোশে ছুটছে মাইক্রোবাস। ডেভিড-নিওম সিডি হাতে ঘাড় বাঁকিয়ে ব্যারবার গোত্রের হাদ্দা ওয়াক্কি নামে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক গায়িকাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁর কথাবার্তা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছে বলে মনে হয় না, তবে সিডিটি অন করতেই পরিসর ভরে ওঠে ভোকাল মিউজিকের অসামান্য ঝংকারে।

জানতে পারি, হাদ্দা ওয়াক্কির লিরিকের বিষয়বস্তু আটলাস পর্বত। তাঁর কণ্ঠস্বরে যুক্ত হলে রহস্যময় প্রতিধ্বনি, আমার চোখজুড়ে ভেসে যায় এল মাকঝেন পাস নামক গিরিপথের ইন্টারনেটে দেখা আলোকচিত্র। লিরিকটির মর্মার্থ আমি বুঝতে পারি না, তবে ভারি দরদ দিয়ে বারে বারে উচ্চারিত ‘ইমতাউনে’ শব্দের অনুরণন আমার মধ্যে তৈরী করে আবেগ-আর্দ্র আর্তি।

জানতে চাই, ‘আলদ্রিদ্রি, কী জপছেন হাদ্দা ওয়াক্কি?’ তিনি ‘ইমতাউনে’ শব্দটির তর্জমা করেন ‘টিয়ার্স’, জানালা দিয়ে কিছু দেখতে দেখতে ডোরা ভারি ইনোসেন্টভাবে হাসে, তার চোখের বাসি মেকাপ ছাপিয়ে ফুটে ওঠেছে অশ্রুবিন্দু, মনে মনে ভাবি, সামওয়ান জাস্ট মেড মাই ডে। আলদ্রিদ্রি ফের ঘাড় বাঁকিয়ে জানতে চান— ‘সুলতান, ডু ইউ ওয়ান্ট অ্যা পিকচার অব হাদ্দা ওয়াক্কি?’

জবাব দিই, ‘নট রিয়েলি, বাট অ্যা লিংক অব হার ইউটিউব সং উড বি গুড?’ তিনি ‘আই উইল ডু দ্যাট,’ বলে তিনি ম্যাপ গুটানো ব্রিয়নার হাতটি মুঠোয় নেন।

দেখতে দেখতে দুপাশের উপত্যকা ভরে ওঠে বুনোফুলে। একটি কাঁটাওয়ালা গাছের তলায় গাড়ি সাইড করে ব্রেক কষে ড্রাইভার আবদেনবি আমজানি। চেজ ব্রাহিমের রিয়াদ থেকে দেয়া হয়েছে মুচমুচে কেঁয়াসো ধরনের চিজব্রেড ও থার্মস্ ভর্তি কফি। তো আমরা নেমে পড়ি। উষর প্রান্তরে যা ফুটেছে, তাকে দূর থেকে ওয়াইল্ড টিউলিপের মতো বর্ণাঢ্য দেখায়। আবদেনবির কাছে ফুলটি নাম জানতে চাইলে সে হাসি মুখে জানায়, ‘আই উইল নাউ এক্সপ্লেইন অল আবাউট আটলাস মাউন্টেন।’

দিগন্তজুড়ে চুপচাপ বসে যেন জাবর কাটছে পাথরের অতিকায় কয়েকটি প্রাগৈতিহাসিক উট। আমরা ওই বিশাল জগদ্দলের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ কফি পান করি। আবদেনবি মনে হয় কোনো খোশখবর দিচ্ছে, এরকম প্রফুল্লভাবে কিছু বেসিক তথ্য দেয়। ২,৫০০ কিলোমিটার কিংবা ১,৬০০ মাইলজুড়ে বিস্তৃত এ পর্বতমালা মামলুকাতে মরক্কোকে কেটে দু-টুকরা করলেও কেবল এদেশে তার বিস্তার থেমে থাকেনি, এটি সাহারার বালুকাময় প্রান্তিক অতিক্রম করে সম্প্রসারিত হতে হতে ঢুকে পড়েছে পাশের দুটি দেশ— তিউনিসিয়া ও আলজিরিয়াতেও। জাজিরাতুল আরব থেকে এ আত্রাফে তেজারতিতে আসা মুসাফিররা এ পাহাড়ের বিরাট বিস্তারে এতই বিহ্বল হয়েছিলেন যে, তাদের বিবরণে তারা একে উল্লেখ করতে থাকেন ‘জাবল আল আটলাস আল কাবির’ বলে, কালে কালে যা বিবর্তিত হয়ে হালফিল পরিচিত হচ্ছে জাবলে-আটলাস নামে। তবে এ পাহাড়ে যারা বসবাস করছেন, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে তারা হচ্ছেন মূলত ব্যারবার গোত্রের মানুষজন। তাদের কাছে আটলাস পর্বতের পরিচিতি হচ্ছে, ‘ইদ্রায়েন দ্রায়েন’ বা ‘মাউন্টেন অব দি মাউন্টেনস্’ ।

সড়কটি পিচঢালা, তবে সম্পূর্ণ মসৃণ না, তাই মাইক্রোবাসটি চলছে ঢিমেতালে। সামনের সিটে ডেভিড-নিওম ও ব্রিয়না ফরাসি ভাষায় পল ভেরলেইনের একটি রোমান্টিক কবিতা নিয়ে কথা বলছেন। পেছনের সিটে হঠাৎ করে বাতচিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেছেন ইলিয়ট ল্যাজারস। তিনি ইয়ানুস কুশনারকে দেখাচ্ছেন আগাথা ক্রিস্টি রচিত গ্রন্থ ‘মার্ডার অন দি ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস’। এ বইটি সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল, এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। ল্যাজারস যে সংস্করণটি দেখাচ্ছেন তা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার সামান্য দিন আগে। পুস্তকটির পাতা বেজায় ঝরঝরে, কিন্তু বয়সের কারণে বাজার দর বিপুল। তাদের বাতচিতও চলছে ফরাসি ভাষায়, কে কী বলছেন, সব কিছু ভালো করে বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করি, দর কষাকষির পালা শেষ, ক্যাশে লেনদেন হতে চলছে।

আবদেনবি আমজানি গাড়িটি সাইড করে আমাদের নামতে ইশারা দেয়। নামতেই দেখতে পাই, চোখের সামনের সবুজ পাহাড়গুলো ফিকে নীলাভ হতে হতে রূপান্তরিত হচ্ছে, বৃক্ষলতাহীন উষর খয়েরিতে রোদ ঝলসানো ধূসর এক পর্বতে। আবদেনবি খুশি খুশি ভাব চাপতে না পেরে বেয়াক্কেলের মতো হেসে বলে, ‘দিস ইজ ইদ্রায়েন দ্রায়েন, মাউন্টেন অব দি মাউন্টেস্… জাবলে-আটলাস।’

ইসাডোরা বলে ওঠে, ‘সো উই আর নিয়ার দ্যা সাহারা ডেজার্ট, রাইট?’

আলদ্রিদ্রি রেসপন্স করেন, ‘ইয়েস ডোরা, উই আর ভেরি ক্লোজ, দিস এরিয়া ইজ নৌন এ্যজ প্রি-সাহারা।’ তারপর অজানা এক উচ্ছ্বাসে আওয়াজ দেন, ‘লেটস্ গো এন্ড হিট দ্যা হাই আটলাস।’ ব্রিয়না পর্বতের বিরাট বিস্তার থেকে চোখটি ফিরিয়ে কুটুস করে ডেভিড-নিওমকে চুমো খায়। তখনই অনুভব করি, ল্যাজারসের হাত আলগোছে ঢুকছে আমার সাফারি-ভেস্টের পকেটে। চোখ ফেরাই, দেখি ইয়ানুস কুশনার ‘মার্ডার অন দি ওরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস’ বইটির পৃষ্ঠা সাবধানে উল্টাচ্ছেন। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আমি পকেট হাতড়াই, ইউরোর কড়কড়ে কয়েকখানা নোট দেখে বুঝতে পারি, কেতাবটি শুধু বিক্রিই হয়নি, ল্যাজারসের হাতে কড়িপাতি আসা মাত্রই তিনি ঋণটিও পরিশোধ করে দিলেন।

মাইক্রোবাস এবার সবুজাভ একটি ফুটহিলকে চক্রকারে ঘেরা সড়ক বেয়ে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। উঠতে উঠতে সামান্য কিছু গাছপালার সবুজাভ রঙ বদলে গিয়ে রূপান্তরিত হয় নিষ্পত্র ধূসর-রুপালিতে। অনুভব করি, চোখের সামনে রোদের স্বর্ণালি উজ্জ্বলতা ফিকে হতে হতে বিবর্তিত হচ্ছে জাফরানি আভায়। পাশ থেকে ডোরা, ‘এভরিথিং ইজ বিকামিং সো ম্যাজিক্যাল,’ বলে চোখ মুদে।

সড়কের এদিককার সুইচব্যাকগুলোতে গাড়িকে অতিক্রম করতে হয় বেশ কয়েকটি অর্ধবৃত্তাকার টার্ন, কিছু দূর সামনে গিয়ে ঘোড়ার নালের আকারে ফিরে এসে আবার মাইক্রোবাসটি জড়িয়ে পড়ে হেয়ার-পিন টার্নের চক্রধাঁধায়। চোখ সামনে ফুটহিলসের যৎসামান্য ঝোপঝাড় সম্পূর্ণ দূরীভূত হলে, আমাদের বাহন পাহাড়ের প্রান্তিক ঘেঁষে এমনভাবে আগায় যে, নিচের দিকে তাকালে শিউরে উঠে দেহমন। আমি জানালা থেকে চোখ ফেরাই। স্পিড স্লো করে, থমকে থমকে, বিপুল গর্জনে লো গিয়ারে টার্ন নিয়ে মড়ির গন্ধ পাওয়া শার্দুলের মতো ফের দ্রুত গতিতে গাড়িটি ছোটে। সচেতন হই যে, আমার সহযাত্রী ডোরা লজ্জাবতী লতাটির মতো মিইয়ে গিয়ে ঘুমে বারবার ঢলে পড়ছে।

আমিও একটু ঝিমিয়ে নিই। মাইক্রোবাসটি থেমে পড়তে চোখ খুলি, দেখি, চলে এসেছি একটি শুখা নদীর কাছাকাছি। উষর এ মরুস্কেপের মায়া আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাই নেমে হাঁটাচলা করে হাত-পায়ের খিল ভাঙি। পাথুরে পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন, নীল গিলাফে মুখ-মাথা প্যাঁচানো এক ব্যারব্যার পুরুষ। হাতের কেতলিটি দেখিয়ে বলেন, ‘কাম কাম.. ড্রিংক সাম মিন্ট-টি।’ হাই এলিভেশনের জায়গাটিকে ঠিক মরুদ্যান বলা যায় না। কবে যে রুকাশুকা নদীতে বয়েছে জল, তাও আমাদের অজানা থেকে যায়, তবে প্রচুর পরিমাণে পুদিনা চুবানো চা-পানের ছোট্ট স্মৃতিটি বেশ গাঢ়ভাবে আঁকা হয়ে যায় হৃদয়ের গভীর-গহনে।

গাড়ি এবার গার্ডরেলহীন সড়কের প্রান্ত ঘেঁষে চলছে। তাই আমি জানালা থেকে চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকাই। ডোরার পায়ের আংগুলে পরা জোড়া টো-রিং থেকে দুটি পাথর কেবলই ঝিকমিক করে। ব্রিয়না ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ‘দিস ইজ দ্যা মোস্ট ডেনজারাস্ রোড অব আটলাস, গাইজ, প্লিজ পুট অন ইয়োর সিট বেল্ট।’

গিলাফে মুখ-মাথা প্যাঁচানো কেতলি হাতে

ব্যরব্যার পুরুষ (Tea Hospitality)

ইয়ানুস সিটবেল্ট এডজাস্ট করতে করতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলেন, ‘লুকস্… সাচ অ্যা মাইন্ড ব্লোয়িং ডাউন দেয়ার।’

ড্রাইভার আবদেনবি রিং হতে থাকা সেলফোনটি কানে লাগিয়ে ‘অ্যালো অ্যালো… মেরহাবা মেরহাবা’ বলতে বলতে গাড়িটি মেনুভার করছে। বেমক্কা ভাবে মৃদু টার্ন নিয়ে খানিক স্কিড করে, বিপুল জার্কিংয়ে দুলে ওঠে মাইক্রোবাসটি। তারপর এক পাশ কাত করে কায়ক্লেশে রক্ষা করে নাজুক ভারসাম্য, খানিক কসরতে আবদেনবি এবার ব্রেক কষে। আমার গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে ডোরা চোখ দুটি বড় করে জানতে চায়, ‘হোয়াট হেপেন্ড?’

অল্পের জন্য আমরা পর্বত থেকে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে ব্রেকের কল্যাণে বেঁচে গেছি। আবদেনবি ফের স্টার্ট দিতে গেলে আলদ্রিদ্রি তাকে থামিয়ে দিয়ে সকলকে গাড়ি থেকে নামতে অনুরোধ করেন। হাই আটলাসের বৃক্ষলতাহীন পরিসরে দাঁড়িয়ে আমরা মরু-পাহাড় কেটে তৈরি বিপজ্জক সড়কটির দিকে তাকাই। জায়গাটি নির্জন, তবে রাজপথের বাঁকে একটি বাসকে ফার্স্ট গিয়ারে গর্জন সামলিয়ে আগ বাড়তে দেখি। ঠাণ্ডা মাথায় আলদ্রিদ্রি ড্রাইভার আবদেনবিকে, পিচঢালা সড়ক থেকে নুড়িকাঁকড়ময় জমিতে নেমে যাওয়া সামনের চাকাটি ফের সড়কে তুলতে সাহায্য করেন। তারপর হাত বাড়িয়ে তার পকেট থেকে দু-দুটি সেলফোন তুলে নিয়ে, তা টার্নড্ অফ করে নিজের ব্যাকপ্যাকে রাখেন। অবদেনবি প্রতিবাদ করে, জবাবে তিনি তাকে আরবি ভাষায় কড়াভাবে এমন কিছু বলেন যে, তরুণটি আর চু-চেরা না করে চুটপাট ফের গাড়ি স্টার্ট করে।

ছাদহীন সুভিনিওর শপে সাজানো পাথরের নেকলেস

মিনিট দশেকের ভেতর আমরা চলে আসি একটি লুকআউট পয়েন্টে। সড়কের পাশে পাথরের দেয়াল তুলে তৈরি করা হয়েছে অবজারভেশন স্পেস। আমরা নেমে পড়ে মরুসাহারার দিকে গড়িয়ে যাওয়া পর্বতমালার দিকে তাকাই। এখানে ছাদহীন একটি সুভিনিওর শপও পাওয়া যায়। দোকানটিতে সুভিনিওর বলতে কেবল রঙিন পাথর দিয়ে তৈরি নেকলেস ও ব্রেসলেট ডিসপ্লে করা হয়েছে। জানতে পারি যে, নানা বর্ণের জেসপার, আকিক, এ্যগেট পাথরের চাকলাগুলো সবই সংগ্রহ করা হয়েছে পর্বতের গুহাকন্দর খুঁড়ে। পাথরগুলো রঙে-রেখায় জেল্লাদার এবং বাহারে বটে, তবে এগুলোর সারফেস ঠিক স্মুদ না। ডোরা, ও ব্রিয়না মনোযোগ দেয় নেকলেস বাছাইয়ে। ইয়ানুস রুপালি বলয়ে পাথরের চাকলা বসানো ব্রেসলেটের দামদর করছেন।

আমি রকওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে চেষ্টা করছি, জাবলে তোবকাল নামক পর্বতচূড়াটি লোকেট করতে। পাশে এসে দাঁড়ান ইলিয়ট ল্যাজারস। তিনি চিরকুটে প্যারিসের একটি ঠিকানা লিখে দিয়ে অনুরোধ করেন, চিয়াংমাইয়ে থাই রাজার সিংহাসন আরোহণের পূর্তি উপলক্ষে তৈরি মন্দিরের ছবি পাঠাতে। ঘটনা হচ্ছে, গতকালকের লেটনাইট পার্টিতে ওই মন্দিরের কথা আমি গল্পচ্ছলে বলেছিলাম। মনে হয়, ল্যাজারস কোনো পর্যটন-পুস্তকে মন্দিরটির বিষয়ে কিছু পড়েছেন, তাই আমার জবানে মন্দিরের বর্ণনা শুনে কেন জানি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। তো সাত-পাঁচ ভেবে বলেই ফেলি, ‘ইলিয়ট, চাইলে আপনি ইন্টারনেট থেকে মন্দিরের শুধু ছবিই না, কীভাবে ওখানে যেতে হয়, তার ইন-ডিটেইল ডিরেকশনও পেতে পারেন অনায়াসে।’

ফিসফিসিয়ে তিনি জানান, ‘দেয়ার ইজ অ্যা রিস্ক ইনভলভ ব্রউজিং ইন দ্যা ইন্টারনেট। আমি যে ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্য সংগ্রহ করেছি, এটার তো রেকর্ড থেকে যাবে, কোনো পুলিশি ইনকোয়ারি হলে আইন প্রয়োগকারীরা অনায়াসে ট্রেস করতে পারবে, আই অ্যাম টেলিং ইউ ম্যান… দিস ইজ টু রিস্কি।’

জানতে চাই, ‘মাই ডিয়ার ল্যাজারস, আপনি কেন থাই রাজার মন্দিরে যেতে চাচ্ছেন? দিস আর অল অপেন ফর টুরিস্টস্, ঠিক বুঝতে পারছি না, এখানে রিস্কটা কোথায়?’

ফিসফিসিয়ে ইলিয়ট আমাকে যা জানান তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে, তিনি কোথায় যেন পড়েছেন যে, ওই মন্দিরে থাই রাজা ভূমিবলের প্রয়াত জননী নাকি ডোনেট করেছেন অনেকগুলো তালপত্রের পাণ্ডুলিপি। তিনি অন্তত একটি পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের তালে আছেন, জুতমতো একটি পাণ্ডুলিপি জোগাড় করতে পারলে, প্যারিসের পুরোনো বইপত্র বিষয়ক আন্ডারওয়ার্ল্ডে এর বাজার দর এত চড়া যে, তিনি অতি সহজে এটার প্রফিট ব্যবহার করে, ‘ম্যান ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, আই ক্যান ইজিলি এফোর্ড টু রাইড অ্যা ক্রুজ শিপ অল দ্যা ওয়ে টু এ্যান্টার্কটিকা।’

এ্যান্টার্কটিকা বা উত্তরমেরুতে ক্রুজ-শিপে যাওয়ার বিপুল ব্যয় সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল, দরিদ্র ইলিয়টের অ্যাডভেঞ্চার ট্র্যাভেলে আগ্রহের প্রতিও আমি শ্রদ্ধাশীল, তারপরও থাই রাজার স্মৃতিতে উৎসর্গিত মন্দির থেকে তালপত্রের পুঁথি লোপাট করার ঝুঁকি সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করা ভিন্ন গত্যান্তর দেখি না। বলি, ‘মাই ডিয়ার ইলিয়ট, থাই পুলিশ আপনাকে যাবজ্জীবন খাটিয়ে ছাড়বে, ফর দ্যা লাভ অব গড, প্লিজ বি কেয়ারফুল।’ তর্জনি তুলে আমাকে শাসিয়ে তিনি বলেন,‘আই লাইক ইউ সুলতান, বাট নেভার এভার গিভ মি এনি অ্যাডভাইস আবাউট মাই বুক বিজনেস, দিস ইজ মাই লাইভলিহুড, পিওর ফাকিং লাইভলিহুড।’

আবদেনবি সেলফোন দুটি ফেরত পায় না, আলদ্রিদ্রি তাকে কড়া ভাষায় এবার সতর্কভাবে ড্রাইভ করতে উদেশ দেন। খানিকটা পথ অতিক্রম করার পরই গাড়ি ট্রাবোল দিতে শুরু করে। ততক্ষণে আমরা এসে পড়েছি আরেকটি লুকআউট স্পেসে। এদিকে পিচঢালা সড়কের পাশে বেশ খানিকটা খালি জায়গা, তাই নুড়িপাথর ছিটকিয়ে এখানে সাইড করে গাড়িটি দাঁড় করাতে কোন অসুবিধা হয় না। কাছেই একটি রোডসাইড শপে বিক্রি হচ্ছে আটলাস পর্বতের পাথর কুঁদে তৈরি মূর্তি ও জিওড বা পাথরের গোলাকার খণ্ড। আলদ্রিদ্রি স্বয়ং মাইক্রোবাসের ইঞ্জিন চেক করতে শুরু করেন। তো আমরা সকলে রওনা হই রোডসাইড শপের দিকে।

রোডসাইড শপের দোকানি জিওড দেখাচ্ছেন

দোকানটিতে জিওডের পশরা দেখে আমার তাক লেগে যাওয়ার দশা হয়! জিওড হচ্ছে গোলাকার ধূসর রঙের পাথরখণ্ড, সচরাচর পাওয়া যায় মরু অঞ্চলে। এগুলো ভাঙলে দেখা যায়— ভেতরের কোয়ার্টজ্ ক্রিস্টাল ফর্মেশন বা স্তরে স্তরে সাজানা স্ফটিকের বর্ণিল বিন্যাস। আটলাস পর্বতে প্রাপ্ত জিওড সম্পর্কে শুনেছি অনেক, কিন্তু চাক্ষুষ করিনি কখনো। বৃত্তাকার ধূসর পাথরখণ্ডের ভেতরে শুধু কোয়ার্টজ ক্রিস্টালই না, ঝলমল করছে ডলামাইট, আরাগনাইট ও এ্যাগেট প্রভৃতি পাথরের স্ফটিক হয়ে ওঠা রত্নসম্ভারও। দ্রব্যগুলো দামেও বেজায় সস্তা।

কয়েকটি জিওড সিলেক্ট করতে গিয়ে মনে ফিরে আসে হাবিবাতুর হুব্বার প্রসঙ্গ। নানাদেশ ভ্রমণের সময় মেয়েটি যাচাই বাছাই করে খরিদ করে এক্সোটিক সুভিনিওর। এগুলো স্যুটকেসে করে নিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ওখানে রক-মিনারেল স্টোর কিংবা সুভিনিওর শপে জিওডের শুধু কদরই না, এগুলো চড়া দামে বিক্রিও হয়। হাবিবাতু হাই আটলাসের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সস্তায় কিনতে চেয়েছিল বেশ কতগুলো জিওড।

আলদ্রিদ্রি মনে হয় আবদেনবিকে ডিসমিস করে নিজে গাড়ি সারাইতে হাত লাগিয়েছেন। তো আবদেনবি এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অনুনয় করে, যাতে আমি তার সেলফোন দুটি ফিরে পেতে সাহায্য করি। দোকানি জিওডগুলোকে ‘ড্রাগনস্ এগগ’ নাম দিয়ে কিছু বলেন। আবদেনবির তর্জমায় জানতে পারি, কোন পাহাড়ি-খেতে ফলন ভালো না হলে চাষিরা নাকি জমিতে রেখে দেয় জিওড খণ্ড। রাতবিরাতে জ্যোৎস্নার আলোয় পাথরগুলো ঝলমল করে ওঠলে, তাতে উড্ডয়নরতা পরীদের নজর পড়ে। তখন তারা জমিতে ল্যান্ড করে পরাগায়ণে সক্রিয়ভাবে সহায়তা দেয়। শুধু তাই নয়, অসুখ-বিসুখে রোগীর শিয়রে জিওড রেখে দিলেও নাকি সুফল পাওয়া যায়।

নিজস্ব বাগিচায় জিওড ছড়িয়ে পরীদের আকর্ষণ করে পরাগায়ণে পারঙ্গম প্রজাপতিদের বেকার করে দেওয়ার কোনো আগ্রহ আমার নেই। তারপরও কিনি গোটা তিনেক জিওড। গাড়িটি সফলভাবে সারাই সেরে আলদ্রিদ্রি আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমি অবদেনবির হয়ে তাদবির করি। তিনি সরাসরি আমার সুপারিশ নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘নট সো সুন, করুক না আবদেনবি একটু সাফার, এত তাড়া কীসের? অপদার্থটা বিবাহিত, দুটি শিশু সন্তানের পিতাও, তারপরও ড্রাইভ করতে করতে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সেলফোনে চ্যাট করছে। লেট মি টিচ হিম অ্যা লিটিল লেসন।’

আমার কেনাকাটা সারা হয়েছে। গাড়িতে ফিরতে যাই। আলদ্রিদ্রি ফিসফিসিয়ে জানান, ‘টিউলিপগুলো হাবিবাতুর আপার্টমেন্টে ডেলিভারি দেয়া হয়েছে, একটু আগে আইফোনে ডেলিভারির কানফারমেশন পেলাম। আই হোপ ফ্রেস ফ্লাওয়ার উইল মেক হাবিবাতু হেপি।’ মারাকেশে বসবাসের দিনগুলোতে আলদ্রিদ্রি হাবিবাতুর সঙ্গে আউটিংয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে গড়েও ওঠেছে বেশ খানিকটা অন্তরঙ্গতা। তো কথা শুনতে শুনতে আমি নীরবে তাঁর ফুল পাঠানোকে আপ্রিসিয়েট করি, কিন্তু কিছু বলি না। তিনি ফের জানতে চান, ‘ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড জিওড? ভাবছি, হাবিবাতুকে কয়েকটি জিওড ক্যুরিয়র-পার্সেলে পাঠাব।’

রেসপন্সে আমি এমেথিস্ট পাথরের স্ফটিক ঝলসানো জিওডগুলো দেখিয়ে তাকে বলি, ‘ডেভিড-নিওম, দিস আর এক্সট্রিমলি রেয়ার, এগুলো আপনি কিনতে পারেন।’ গোটা ছয়েক জিওড কিনে গাড়িতে ফেরার পথে আলদ্রিদ্রি জানতে চান, ‘তোমার কী মনে হয় সুলতান, হাবিবাতুর ছেলের জন্য কিছু পাঠালে সে খুশি হবে।’ জবাবে বলি, ‘ডেভিড-নিওম, চিন্তাভাবনা করে একটু পর জবাব দেই।’

মাইক্রাবাসের বনেটে ঠেকা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রিয়না। সে ছুটে এসে আলদ্রিদ্রির চোখে এসে পড়া চুলের গুচ্ছ সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘হোয়ার আর ইউ ওয়ান্ডারিং হানি? হ্যাট ছাড়া এত চড়া রোদে ঘোরাফেরা করছ কেন?’ ডেভিড-নিওম কিছু না বলে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেন ব্রিয়নার গণ্ডদেশ। তাদের প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য আমি মুখটি অন্য দিকে ফিরিয়ে গাড়িতে উঠি। সিটবেল্ট আটকাতে আটকাতে ভাবি, একটু আগে ডেভিড-নিওম হাবিবাতুর দুর্দিনে টিউলিপ পাঠানোর কথা জানিয়েছেন, এদিকে তিনি দ্রুত ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন ব্রিয়নার সঙ্গে, বিষয়টি জোরালো পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।

আবদেনবি সেলফোন দুটি ফেরত পাওয়া নিয়ে আলদ্রিদ্রির সঙ্গে মিনমিনিয়ে ফের দেনদরবার করলে, তিনি তাকে কড়া ভাষায় ধমক দিয়ে স্বয়ং গিয়ে বসেন ড্রাইভিং সিটে। ভেজা বিড়ালের মতো আবদেনবি এসে আমাদের সঙ্গে পেছন দিকের সিটে চুপচাপ বসে। মাইক্রোবাসটি ফের ছোটে হাই আটলাসের শিরদাঁড়া কেটে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

সম্পাদকীয়, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল অনুপ্রাণন ৬ষ্ঠ সংখ্যা

Read Next

আবু আফজাল সালেহ – যুগল কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *