অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪
১২ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মুহসীন মোসাদ্দেক -
বরষা-স্মৃতি : কৈশোরবাস, কদমে প্রেমের সুবাস

মধ্যরাত। একা। নিঃসঙ্গতা অবশ্য নেই! একা মানুষ মানেই নিঃসঙ্গ- এমন কোনো সূত্র কি আছে কোথাও? জানালার গ্রিল ছুঁয়ে রেখেছে হাত, চোখ জানালার বাইরে অন্ধকারে। শহুরে অট্টালিকার ভিড়ে ঠিক জানালার ওপাশে ঝাঁকড়া কোনো গাছ থাকার বিষয়টা অনেকটা কাল্পনিক, কিছুটা অলৌকিক। অথচ আমার পাঁচতলার জানালার ঠিক পাশেই ঝাঁকড়া একটি গাছের ঊর্ধ্ব অংশের অবস্থান একদম বাস্তব! ঠিক পাশে মানে এতটা কাছে নয় যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়! ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ঠিক ততোটা কাছে যতোটা হলে আষাঢ়ের জলে ধোয়া পাতার আর্দ্র সুবাস পাওয়া যায়!

মধ্যরাতে জানালার গ্রিল ছুঁয়ে একা দাঁড়িয়ে বাইরে অন্ধকারে চোখ রেখেও নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে না হওয়ার কারণ- বৃষ্টি! বৃষ্টি আছে সঙ্গে, এখানে। আষাঢ়ের যুবতী বৃষ্টি! জানালার পাশের ঝাঁকড়া গাছটির নাম জানা নেই। শৈশব-কৈশোর কেটেছে মফস্বলে, পিতা-মাতার জন্মস্থান হিসেবে গ্রামের সাথেও খণ্ডকালীন যোগাযোগ ছিল, তবু গাছপালার সাথে যতটুকু পরিচয় তাতে এ গাছটি সে গণ্ডির মধ্যে পড়েনি! শহুরে যান্ত্রিক সম্পর্কে এতটা আন্তরিক আলাপ প্রতিবেশীর সঙ্গে হয় না যে, গাছটির পরিচয় জেনে নেয়া যাবে! সুতরাং গাছটিকে নামহীনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হচ্ছে!

নাম না জানা ঝাঁকড়া গাছটির পাতায় বৃষ্টির ধারা স্পর্শ করার সময় অর্থাৎ বৃষ্টির ধারার সাথে গাছের পাতার আলিঙ্গনের মুহূর্তে আলোড়িত পাতার শনশন এবং জল ঝরে পড়ার ঝুপঝুপ শব্দের মিশ্রণে উৎপন্ন অনুরণিত যে শব্দ কর্ণকুহর ভেদ করে মস্তিষ্কে মাদকতার অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে, সে শব্দের কাছে কখনো কোনো নিঃসঙ্গতা তার অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না! এ শব্দের মাদকতা বিস্তৃতির শক্তি এতোই যে, মস্তিষ্ক থেকে বিস্তৃত হয়ে তা রক্তে ছড়িয়ে পড়ে অচিরেই! আর তাতে শরীরটা শিরশির করে ওঠে, লোমগুলো তালগাছের মতো মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে!

জীবনের গণ্ডি এখন অনেকটাই জানালার এ পাশে! কর্মক্ষেত্র কিংবা বাসা-দুই ভুবনেই জীবনটা এখন জানালার এ পাশে আবদ্ধ! জানালার এ পাশের জীবনে কোনো গ্রীষ্ম নেই, নেই কোনো বরষা-হেমন্ত! এ পাশে কেবল একটাই জীবন-একঘেঁয়েমি! কিন্তু জীবনটা একসময় জানালার ওপাশে ছিল, এমন মধ্যরাতে বৃষ্টির জলে ভেসে ওঠে জানালার ওপাশে ফেলে আসা এক টুকরো বরষা-জীবন! ব্যাপারটা এমন যে, শিরশিরে অনুভূতিটা ছড়িয়ে পড়ার পরই চোখের সামনে দিয়ে জলের স্রোতের মতো ভেসে যেতে থাকে বরষার সাথে লেপটে থাকা ফেলে আসা জীবনের টুকরো অনুভূতিগুলো!

অনুভূতিগুলোর বেশির ভাগটা জুড়েই ছড়িয়ে আছে বাল্যকাল। প্রিয় ছোটোবেলা। আমরা তখন টিনের চালের ঘরে থাকি। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দটা যে কতোটা ছান্দিক, তখন এতোটা অনুভব করতাম না, যেটা এখন করি! বৃষ্টির সময় চোখ বুজে অনুভব করতে চেষ্টা করলেই কানে ভেসে আসে সে শব্দ। দিনের বেলার চেয়ে রাতের বেলার শব্দটা বেশি কানে আসে। বাড়িয়ে বলছি না, টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কখনও বিরক্ত করেনি আমাকে, রাতের যে সময়ই বৃষ্টি আসুক না কেন, টিনের চালের শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেছে বলে অনুভব করিনি কখনো! ঘুম ভেঙেছে সত্য, কিন্তু শব্দের ছন্দে আবার তা জুড়েও এসেছে!

শব্দের মধ্যে মনে পড়ে আরেকটা শব্দের অনুভূতি। সে শব্দ আসলে গান, ব্যাঙের গান। এ শহরে এ গান কানে আসা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার! আমরা নিজেদের আবাসস্থল গড়তে গিয়ে খেয়াল রাখিনি তাদের আবাসের! মুহূর্তের বৃষ্টিতেই যদিও আমাদের চলার পথগুলো নদী হয়ে যায়, সে নদী ব্যাঙের আবাসের উপযুক্ত নয়! কখনও কখনও সুনসান মধ্যরাতে কান খাড়া করলে বহুদূর থেকে কিছু গান কানে আসে বটে, তবে তা কানে কোনো আরাম দিতে পারে না! কান খাড়া করে রাখার যন্ত্রণায় তা মিলিয়ে যায় খুব দ্রুতই! অথচ আমাদের ছোটোবেলায়, মফস্বল কিংবা গ্রামে মুহূর্তের বৃষ্টিতেও শোনা যেতো ব্যাঙের গান। আর তুমুল বৃষ্টির পর চারপাশে থইথই পানি জমে উঠলে বসে যেতো আসর, সে আসর কখনও কখনও রাতভর স্থায়ী হতো! সত্যি বলতে কী, প্রকৃতির এতো কাছে থেকে তখন এ অনুভূতিগুলো এতোটা প্রকট ছিল না! আজ প্রকৃতির সে বাস্তবতা থেকে বহুদূরে বসে স্মৃতি আবাদ করতে গিয়ে চোখে-মনে অনুভূতিগুলো যেন গেঁথে গেছে!

টিনের চালের সে বাসায় মাঝারি একটা উঠোন ছিল। কাঁচা উঠোন। বৃষ্টি হলেই কাদায় মাখামাখি অবস্থা দেখা যেতো। আছাড় খেয়েও পড়তো কেউ কেউ, বিশেষত, যারা বাড়ির নিয়মিত সদস্য নয়, তারা এমন বিপাকে পড়তো বেশি। নিয়মিত লোকেরা এমন এক অভ্যস্ততা অর্জন করে ফেলতো যে, যেভাবেই এবং যে গতিতেই হাঁটুক, ভারসাম্য স্থাপন করে নিতে পারতো! বড়োজোড় এক-দুইবার পা পিছলে যেতো, কিন্তু আছাড়ে রূপ নেয়ার আগেই তার লাগাম টেনে নেয়া যেতো!

উঠোনের পরেই পাঁচিলের ওপাশে একটা ছোট্ট পুকুর ছিল। বরষার দিনে লাগাতার বৃষ্টির ফলে প্রায়ই পুকুরের পানি উঠোন দখল করে নিতো। যদিও খুব অল্প সময়ের জন্য, তবুও আমাদের কিশোর মনের চঞ্চলতা বেড়ে যেতো। পানিতে নেমে আমরা ছুটোছুটি করতাম! কিছু ছোটো ছোটো মাছ চলে আসতো তাদের আবাসের নতুন বিস্তৃত অংশ পর্যবেক্ষণে। আমরা তাদের তাড়িয়ে বেড়াতাম, কখনও ধরেও ফেলতাম, আবার ছেড়ে দিতাম। দুই হাতের তালুর আবদ্ধ অংশে ছোট্ট মাছের ছোটাছুটি একটা শিহরণ জাগিয়ে তুলতো- হাতের মুঠোয় একটা ছোট্ট জীবন ধরে রাখার শিহরণ!

উঠোনে তখন সাপও উঠে আসতো কখনও কখনও। সে সময় আমরা গুটিয়ে যেতাম। সন্তর্পণে পা ফেলতাম উঠোনে! আর ভাবতাম এমন ভালো লাগার ভেতরে এটুকু ভয় না থাকলে কি চলতো না!

বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করতো খুব! শুধু শুধু গাছের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ভেজার ইচ্ছে নয়, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দলবল নিয়ে মাঠে কাদা মাখামাখি করে ফুটবল খেলার ইচ্ছেটা নেশার মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতো সবসময়। বাসায় বেশ কড়া শাসন ছিল! বৃষ্টিতে ভেজা মানে কড়া পিটুনি খাওয়ার বন্দোবস্ত করে রাখা! তবু শাসনের ফাঁক গলে কখনও কখনও ইচ্ছেটা পূরণের সুযোগ হয়েছে। আবার এমনও হয়েছে, ফুটবল ফেলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আশেপাশের কয়েক পাড়া ছুটে বেড়িয়েছি। কী যে মাতাল দিন ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না!

সারাদুপুর এবং বিকেলের প্রথম ভাগ বৃষ্টির টানা নৃত্যের পর কোনো কোনো দিন শেষ বিকেলের রংধনুমাখা আলোয় আমরা শুধু হাঁটতাম। কোনো ছুটোছুটি করতাম না। এমন সময়ে শুধু যে হাঁটার নিয়ম- এরকম কিছু কেউ আমাদের বলে দিয়েছিল ব্যাপারটা এমন নয়! আমরা হাঁটতাম আর দেখতাম- আমাদের খেলার মাঠ পানিতে থইথই, জুতোজোড়া হাতে নিয়ে সে পানি কেটে কেটে আমরা হাঁটতাম। আশেপাশের রাস্তা এবং খানাখন্দের জায়গায় জায়গায় পানি, স্বচ্ছ পানি- সে পানিতে অল্পবিস্তর লাফঝাঁপ দিয়ে পানি ছিটানো খেলা খেলতাম কখনও কখনও। আর এইসব স্বচ্ছ পানির ভেতর থেকে অদ্ভুত এক ঘ্রাণ আসতো, সে ঘ্রাণ নিতেই হয়তো আমরা পানির ভেতর ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটতাম। সন্ধ্যা নেমে এলে বাসায় ফিরে এসে পা ধুতে গিয়ে যখন দেখতাম পায়ের পাতার উপর-নিচের চামড়া ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করে ভাঁজ ভাঁজ আকার হয়ে কুঁচকে গেছে, তখন পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ পড়ে থাকতো কেবল পা লুকোনোর তালে!

কৈশোর পেরিয়ে আসার পর পিতার চাকরিসূত্রে শহর স্থানান্তরের ফলে অপেক্ষাকৃত বড়ো শহরে এসে নাগরিক ব্যস্ততা ও ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার চাপে প্রকৃতির মোহনীয়তা আস্বাদনের সুযোগ কমে গেলো। ফলে অনুভূতি-যাপন বেড়ে যেতে লাগলো এবং স্মৃতি নামের বসত-বাড়ি গড়ে উঠতে লাগলো অনুভূতির জমিনে! এরপর থেকে ফেলে আসা সময়গুলো চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগলো এবং কখনও কখনও নিঃশ্বাসের সাথে ফেলে আসা সময়ের এক প্রকার ঘ্রাণ রক্তে প্রবেশ করে শিহরণ জাগাতে শুরু করলো। বৃষ্টি পড়লেই যেন স্বচ্ছ পানি বা কাদামাটির ঘ্রাণ নাকে আসতো। অবশ্য ঠিক পানি বা মাটির ঘ্রাণ নয়, অবিকল সে ঘ্রাণ নয়, ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিগুলো আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য একেক স্মৃতি একেক রকম ঘ্রাণ হয়ে যেতে লাগলো। কখনো স্মৃতি ঘ্রাণ বয়ে আনতো, কখনো ঘ্রাণ স্মৃতিকে।

কৈশোরের শেষদিকে এবং তারুণ্যের শুরুতে অনুভূতি-যাপন একটি ভিন্ন মোড় নিতে শুরু করলো। বরষার বৃষ্টির জলের সাথে কদমের সুবাস মিশে অনুভূতির জমিনে প্রেমের আবাদ শুরু হলো। বরষার সাথে কীভাবে প্রেমের যোগসূত্র তৈরি হয়েছে বা আদৌ কোনো যোগ আছে কিনা সে বিষয়ে ধারণা না থাকলেও আমার ভেতরে এমন ধারণা চেপে বসে গেল- বরষা মানেই প্রেম! বরষা বা বৃষ্টিকে অনুভব করলে ভেতরে তোলপাড় শুরু হতো এমন কাউকে পাশে পাবার যার চোখের ভেতরে আমার জীবন লুকিয়ে।

 স্কুল বা কলেজ পালিয়ে একবেলা বৃষ্টিতে ভিজবো তার সাথে, দুটো কদম ফুলের একটি গুঁজে দিবো তার খোপায় আর একটি থাকবে তার হাতে। আমরা দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত দুটোকে মেলে দিয়ে দুদিকে একত্রে তাকাবো আকাশের দিকে আর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল গড়িয়ে নামবে আমাদের শরীর বেয়ে পিচঢালা পথে অথবা মাঠের সবুজ ঘাসে কিংবা নদীচরের বালিতে। এরপর আমরা হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকবো ঠিকানাহীন, সে তার হাতের কদম নাড়াতে থাকবে আর আমি ধরে রাখবো তার অপর একটি হাত। তার হাতের কদম থেকে সুবাস হয়ে ছড়িয়ে পড়বে আমাদের প্রেমের অনুভূতি!

জলের স্রোতে একে একে কতগুলো বরষা ভেসে যাওয়ার পর একদিন খেয়ালের এদিন ধরা দিলো হাতে। বিয়ের পর প্রথম বরষা। আমরা দুজন বেরিয়েছি প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো যাবে এমন কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বের হওয়ার সময় আকাশ বা বাতাসের কোথাও এমন কোনো ইঙ্গিত ছিল না যা আমাদের ছাতা নিতে উদ্বুদ্ধ করবে। ফলে জাহাঙ্গীরনগরের সবুজ ঘাস বিছানো মাঠে যখন আমরা পায়ে পায়ে মিলিয়ে হাঁটছিলাম, ঠিক তখনই নেমে এলো বৃষ্টি! প্রকৃতি আমার খেয়ালের চিত্রায়ন এদিনে করবে বলে পরিকল্পনা করেই রেখেছিল হয়তো। হাতে অবশ্য কদম ছিল না, তবু ধরে নিয়েছিলাম হাতে কদম আছে আমার। দুটো কদম- একটি খোপায় দিলাম, একটি হাতে। আমরা আরও ধরে নিলাম, দুজনের কৈশোরকাল এখন। আমাদের পরনে স্কুল ড্রেস, স্কুল পালিয়ে বেরিয়ে পড়েছি আমরা। হঠাৎ নেমে আসা এই ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এগিয়ে চলেছি পথ। আর তার হাতের কদম থেকে সুবাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের প্রেমের অনুভূতি!

০২ জুলাই, ২০২০

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

আমার দিল্লি ভ্রমণ এক বিরল বিজয়

Read Next

হিরন্ময় ভ্রমণস্মৃতি
কেন্ট নারবার্ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *