শোনো, খানিকপূর্বে কোনোমতে জান হাতে নিয়ে ফিরেছি গৃহে। কথায় বলে, ‘সব পাখি নীড়ে ফেরে’। নীড়ের যে কী নির্যাস, বুঝলাম আজ বহুদিন পরে। ভাদ্রের এই ভাপসা গরমে সকালবেলার নরম রোদে চারদিক তেতে উঠলেও ভালো লাগছে ভীষণ। মনে হচ্ছে জীবন আর সময় যেন বহতা নদী। ঘোলাটে আকাশে কালো মেঘের টুকরো মাঝে মাঝে সূর্যকে শাসিয়ে যাচ্ছে। একমগ কফি হাতে শহুরে বাড়ির বারান্দায় বাসি কাগজ নিয়ে বসে আছি, এটাও কী তবে নিয়তি! এত বেলা হলো সাজেদুল হকার পেপার দিল না! আজকাল অভিযোগ করতে ভয় পাই। কেননা, আমি তো দেখেছি যে লোকটি চাষ করতে যায় সকালবেলায় সে ঠিক সোজাসুজি মাঠে গিয়ে চাষ শুরু করে না। যে লোকটি আলখাল্লা পরে বৃত্ত-ভিড়ের মধ্যে রসকলি গায় সে প্রথমে জনহীন ফাঁকা পথে আনমনে হেঁটে যায় লঘু পায়ে। আসলে আমরা মূলকে কেন্দ্র করে মরি, মারার বাসনা পোষণ করি। বর্তমানের বাতায়নে চেয়ে দেখি ভবিষ্যৎ কী করে ভেঙে ভেঙে ভেসে আসে ভয়ানক ভদ্রাসনে। অতীতকে অচ্ছুত ভেবে স্বচ্ছতোয়া নদীর কিনারে বসে উজ্জ্বল নারীর মলীন বেদনার কথা ভাবি।
যা হোক এটুকু জানি, গতকাল আমার পথ চেয়ে তুমি সময় বাহিত করেছ এবং এতক্ষণে নিশ্চয় চিন্তাযুক্ত আছো এই ভেবে যে, বড় ভাইজান কেন আসবে বলেও আসলো না! ছন্দে কেন ছেদ পড়ল? তাই দ্রুত পোশাক পাল্টেই এই পত্র লিখতে বসেছি। যদিও একালের কথা লিখতে বসলেই আমার পুরাকালের কথা মনে পড়ে যায়। ভয় পেয়ো না, আমি নিজের দেখা অতীতকালের কথা বলছি না। যে কাল কেউ দেখেনি বলছি সেই কালের কথা। যেখানে আমাদের যৌবন চলে উল্টো দিকে, অভিযান রেখে পরাভবে, স্বপ্ন ছেড়ে আতঙ্কে, জীবন এড়িয়ে শ্মশানে যার গতি হয়। মাঝে মাঝে ভাবি, কোথাও যেন ভুল হয়ে যাচ্ছে আমাদের। গাণিতিক সিঁড়িগুলো সরে যাচ্ছে একে একে। জলের খাতায় কত আর স্রোতের অক্ষর লেখা যায় বলো? আমরা হয়তো ঝরে পড়ছি অসময়ে অজানা পারিজাত হয়ে। আমরা আসলে একে অপরকে বহন করছি প্রতিনিয়ত। নিয়ে যাচ্ছি দূর দেশে, মধুবনি পেরিয়ে, কালাহারি মরুভূমিকে পাশ কাটিয়ে রৌদ্রদগ্ধ আবলুসকালো কাফ্রি বেহারার কাঁধে করে অচেনা কোনো অনাবৃষ্টির দেশে।
শোনো : আমি যথারীতি তোমার ঠিকানা মোতাবেক রওনা দিয়েছিলাম। রাস্তার দু’ধারে বেহাত হয়ে যাওয়া সাঁওতালদের সারি সারি বাড়ি। স্বজন-বিচ্ছিন্ন। আহা! অন্যের দখলে গিয়ে তারা কেমন শ্রীহীন, লক্ষ্মীভ্রষ্ট, করুণ। ট্রেন হতে নেমে গ্রাম্যপথে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। জুলফিকার আকন্দকে মনে আছে তোমার? সেই যে, দেখা হলেই বলত- বাড়ি চলেন, মা মুড়িইলিশ পাকাইছে। টেশ নেবেন, আসেন। কতই না সরল, কোমল আর দেখতে কঞ্চির মতো লিকলিকে ছিল! ওদের বাড়িটা দেখলাম ধসে গেছে। আহা! এই বাড়িতে কতবার এসেছি। কাকি-মা বেঁচে থাকতে একবার গভীর শীতের রাতে। দূরে পৌশালির মোড়ে কুকুর ডাকছে কঁকিয়ে কঁকিয়ে যদিও তাদের উষ্ণতা খোঁজার দিনগুলি শেষ হয়ে গেছে কার্তিক মাসেই। তবুও উষ্ণতাই যে সকল প্রাণির জন্মলগ্ন থেকে সবচেয়ে বেশি কামনার ধন। উষ্ণতাই আসলে জীবন। তোমার মনে আছে কনকনে শীতে যখন ঠকঠক করে কাঁপছিলাম, তুমি বললে- কিছু সুপ্ত শীত আমরা প্রত্যেকেই বুকের মধ্যে অনুক্ষণ বয়ে বেড়াই। সেই শীত প্রাণিত হয়ে আামদের অস্তিত্বের অস্থিমজ্জাকেই হঠাৎ বড় বিপন্ন করে তোলে। স্মৃতিরা আসলে সাধুর মতো। একবার আটকে গেলে দিলের মধ্যে দীর্ঘ আসন গেঁড়ে বসে। দেখলাম- বাড়ির সামনে মলিন এক ক্যানভাস খুঁটিতে পেরেকমারা, তাতে কাঁচা হাতের কষ্টাকালিতে লেখা ‘সাধুসংঘ’। বুদ্ধি খেলেও সন্ধি করতে পারলাম না। দিগন্তঘেরা বাড়ির বাগান পরিচর্যার অভাবে আঁধার-সবুজ রঙে ছেয়ে আছে। কেমন খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। এতটাই পিনপতন নীরবতা। আলেয়ার মতো কেবলই মনে হচ্ছে মানুষের আশ্রয়ের ছাদগুলো খসে পড়ছে। চারদিকে আচমকা আকছার। ভুল করে তাই রাস্তাগুলো বারবার মিশে যাচ্ছে জরাজীর্ণ, অন্ধকার লাশকাটা ঘরের রাস্তায়!
বাড়িটাকে পাশ কটিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে হাঁটছি। আমার পায়ের জুতোয় নতুন বানানো কালভার্টে খটখট আওয়াজ হচ্ছে। পাশের গাছপালায় পাখিরা হয়তো কারণেই কিচমিচিয়ে উঠছে। সূর্য টাটানোর আগেই দিঘির পাড়ে পৌঁছতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেই চেনা দিঘি। আপন বোনের মতো। এপারে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলে ওপারে সাড়া পৌঁছায় না। শুধু জল কেঁপে কেঁপে দু-চারখানা রেখা কাটে। সেই জলে গোটা পুবের আকাশ আয়েশে আটকে আছে। চৈত্র শেষের প্রথম সূর্য লালে লাল করে দিয়েছে পুরো দিঘিকে। পাড়ের মাটি ঢালু হয়ে বিস্তৃত মাঠ। ফসলে সয়লাব। কত-না শস্যের গন্ধে মাতোয়ারা আমার শৈশব হাতছানি দিচ্ছে বারবার। চেনা-অচেনা সকলেই চুপচাপ চলে যাচ্ছে যে যার গন্তব্যে। এদিকে কিছু নতুন বাড়ি উঠেছে। বাগদিদের ছনের চালা আর মাটির দেয়াল। তাতে হাতে আঁকা শিল্পের সামিয়ানায় বন্দি হয়ে আছে কত-না লতাপাতা। কত-না হেঁয়ালি। সেই পাপর, ফুলুরি ময়রার দোকানটা এখনো আছে। পৌষসংক্রান্তিতে মেলা বসে এই মাঠে। এগুলো দেখছি আর হাঁটছি জোর কদমে। এভাবেই মাঠটা জরিপ করে নিচ্ছি মনের গজ ফুটে। দেখি ডান্ডিভাঙা ঝাপসা কাচের চশমা পরে কোমর বেঁকিয়ে হেঁটে আসছে নিতাই কাকা। আমাকে দেখে ফোকলা মুখে কণামাত্র হাসি ফুটিয়ে বললেন- বাবু ভালো আছো? যতটা আছি তারও অধিক বাড়িয়ে বলে বললাম- কাকা, নতুন কিছু ভাবলেন? ‘হ হ, ভাবনার তো শেষ নাই বাবু!’ ভাবছি এবার মেলা বসলে সব দোকানপাটে বঁটি বাড়াব, চাকা ঘোরানি নম্বর মেলানি ফড় পার্টি এলে একদম ফ্রি! তিনদিনের মেলা এবার সাতদিন চালাব। আচ্ছা, তোমার খোঁজে হাতি আছে? একখান হাতি আনতে পারলে কেল্লাফতে। দিনে সাতাশটা কলাগাছ, খাইলে খাবে। কিন্তু মেলা জমবে। জমে ক্ষীর হয়ে যাবে। মেলা নিয়ে মেলা কথার পরে ছকে ছক মিলিয়ে দুজনেই দিঘির দিকে তাকাই। সূর্যটা আলো ছড়িয়েছে আকাশে, না দিঘির জলে ঠিক সমঝে ওঠা যাচ্ছে না। একঝাঁক সাদা বক সকালের চিত্তির বিচিত্তির মেঘ সাঁতরে পাড়ে দম নিচ্ছে। পাড়ের ধারঘেঁষে খুপরি চালা। চালার দোর ঠেলে বাচ্চাকাচ্চারা বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে মা মেয়েরা। স্বল্প বসনে উদোম হুদমো চেহারা। সবারই পাথর কাটা শরীর। ওপারে পুরোনো অর্জুন গাছ, ঝাঁকড়া তেঁতুল ডালপালায় ছায়াময় জঙ্গুলে বসবাস। বাচ্চাগুলো পাড়ে কোমর ঝুলিয়ে বসে দিগম্বর। কল কল কথাবার্তায় পেটের ময়লা চলে যাচ্ছে দিঘিতে মাছেদের পরম খাদ্য হয়ে।
খানিক জিরিয়ে ফের যাচ্ছিলাম। বাংলার প্রকৃতিকে দেখার জন্য একান্ত নিজস্ব এক দিব্যদৃষ্টি দিয়ে। যে দৃষ্টি পাওয়া যায় কেবল প্রকৃতির কাছে উদার হয়ে দাঁড়িয়ে। বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে একা একা হাঁটতে হাঁটতে। ঘাসে ভরা বড় মাঠে অনেকক্ষণ যদি আমরা একলা হেঁটে যাই, মাঠের মধ্যে উঁচুনিচু অনেক ঢেউ খেলানো অঞ্চল পেরিয়ে এগোতে হয় আমাদের। মাঠের ঢেউ মানেই কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু। বুঝলে রকিবুল, সেই নিচু অংশে জমে থাকে অন্ধকার। আসলে হয় কী একটি বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, নিসর্গের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে, একটিমাত্র দৃষ্টিকোণ থেকে যে দৃশ্য আমরা দেখি, তা কখনোই সত্য নয়। কেননা আকাশ বলতে গেলে মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। তবে মেঘ ও রোদ্দুরের হার-জিতের খেলা চলছিল, বিধায় ছাতা নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করিনি। বিলের পাশ দিয়ে বিবিধ বিষয়ের সাহায্যসমেত যাচ্ছি, বাঁয়ে ছয়ফুলদের বাড়ি। শানবাঁধানো পুকুরঘাটে জনৈক রমণী আনমনে হুঁকো টেনে চলেছে। ওদিকে একটা গরু লতিয়ে ওঠা কুমড়ো গাছের লতা টেনে খাচ্ছে। দেখলাম আমেদ আলীর বড় বউ বোধ করি কাজে অবহেলার জন্য তার শিশুটিকে লক্ষ করে সমানে খেউড় আউড়ে চলেছে। চোখ ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু মন তো খোলা থাকে। সেখানে রক্তক্ষরণের যেন শেষ নেই! আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, কোথাও কোনো দুঃখ নেই, একফোঁটা চোখের জল নেই। সাহাদের বাড়ি পেরিয়ে মরা খালে দোদুল্যমান সাঁকো। কেমন কায়দা করে দু’পায়ের ওপর দুটো হাত টানটান করে রেখে অবনিবাবু বসে আছেন। মুখে তার সেই ভুবনমোহিনী হাসি। কেমন আছেন, বলতেই বললেন- ভেবে মরছি গো! একটা গলায় দড়ি কেস ঝুলছে। মুখে সেই হাসিটা লটকেই বললেন, লোকটা জাতখচ্চর। তবে আমিও কাঠপিঁপড়ে। সহজে ছাড়ছি না। আমি থাকি কোঠাবাড়িতে, অথচ সে ব্যাটা আমাকে কোর্ট দেখাচ্ছে! বিরক্ত গোপন করে এগিয়ে গেলাম। দু’পাশের জলায় নাম না জানা ঘাসের ফুল ফুটেছে। ক্লান্তি এলেও চলছি জোর কদমে। গোয়ালাদের বস্তি পার হলেই সরল চওড়া রাস্তা। বহুদূরগামী। মাটির রক্তিম বিস্তার। জনবিরল। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল। মৃদুমন্দ বাতাসে গগনবিহারী ইউক্যালিপটাস তার সুগন্ধ ছড়াল। কালো কালো মেঘের সাথে মেষসকল ডাকতে লাগল। দূর থেকে ছুম ছুম ঘুঙুরের শব্দ কানে দোলা দিচ্ছিল। নিমেষেই পথ হতে সকল পথিক যেন হাওয়া হয়ে গেল। আর অচিরেই বিশ্বাস নেবে না রকিবুল, কী রূপ ঝামার মতো ঝমঝমাইয়া বৃষ্টি নামল। সময় গেল থমকে। চোর আসে তো কনে পালায়, বর আসে তো পুলিশ হাঁপায়! কী করি কী করি! উপায় না বুঝে এক গৃহস্থের গোয়ালঘরে নিলাম ঠাঁই। একদিকে বৃষ্টির ছাঁটা তার ওপরে মলের গন্ধ। প্রাণ আমার যায় যায় অবস্থা। এমনই গৃহস্থ, ভদ্রতাবশত একবারও বলল না- নানা, ভিতরে আসেন। এই তো তোমাদের গ্রামীণ কালচার বাপু! বুঝি না ভাই, বহুত দুঃখ বুকে নিয়ে এইসব লিখছি। তুমি আমার ছোট ভাই বড় কথায় কান দিয়ে মন খারাপ করো না। আসলে পুরুষের শরীর নিয়ে সব পুরুষের মিথ্যে অহমিকা থাকে। পৌরুষ মানে যে, গায়ের জোর নয়, বরং উল্টোটাই, পৌরুষ মানে যে পীড়ন নয়, ফুল-গন্ধ-পীড়িত হওয়া এসব জানলেও বাস্তবে শিখতে পারলাম কই বলো?
জানো তো অতীতকে ভুলে যাওয়াই মানুষের স্বভাব। সে বাঁচে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে কোনোরকমে এগোচ্ছি। মাঝে মাঝে ভেঙে পড়ছে, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ একেবারে হঠাৎই, ভেসে এলো সুর, হালকা বাঁশি আর মাউথঅর্গানের যুগলবন্দি। সংগীত! আহা, আরও একবার সংগীতের ধ্বনি। স্মৃতির পর্দায় কী যেন একটা ভেসে উঠতে চায়। আমার সেই অন্তহীন হতাশা আর অসহায়তার মধ্যে চেতনার অবশ শরীর ভেদ করে কী যেন একটা বিঁধে যায় মনের গভীরে। আশ্চর্য এক অনুভূতি। বড় যন্ত্রণা আর আকুলতার অনুভূতি। আমি যেন পালিয়ে গেলাম, উধাও হয়ে গেলাম। গ্রাম-প্রদেশে এমন সংগীত! যখন হতাশা আর লাঞ্ছনাবোধ অস্তিত্বের এমনি এক তলদেশে আমাদের নিয়ে গেছে, যখন দুর্দশার অনুভূতি এমনই তীব্র যে সংগীতের সুরের সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠা বোধ যন্ত্রণা হয়ে ওঠে, অসহ্য যন্ত্রণা, যন্ত্রণার কষ্ট যেন শারীরিক হয়ে ওঠে। আসলে যাত্রাতে কত যে শিক্ষালাভ হয়! সঞ্চিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মলের গন্ধকে ডাইভার্ট করে মনকে বোঝালাম- তুমি যাচ্ছ বিয়ে বাড়িতে, তীর্থ ও সৌন্দর্যের টানে। যদিও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সৌন্দর্য উপভোগের স্পৃহা দিন দিন কমে যাচ্ছে মানুষের। হয়তো ভোগের বাসনা বৃদ্ধিই এর কারণ হতে পারে। যাহোক একসময় বৃষ্টির ধারা পাতলা হলো। ভগ্নহৃদয়ে ফের উঠে এলাম কাঁচা-পাকা সড়কের সংযোগস্থলে। সেখানে বড় বড় শিরীষ গাছের ছায়ার নিচে গোলাকার বেদির মতো বসার জায়গা। কালের কোলাহলে তাদের জীর্ণদশা। এদিকে সন্ধ্যাও হয় হয়। আঁধারে পথ চিনব কি না এমত দ্বন্দ্বে সাহস প্রকাশ করে যেই না পথে পা রেখেছি, ওমনি আঠাল কাদায় পুরো চিৎপাট হয়ে হড়কে পড়লাম এক হাঁটু কাদার মধ্যে। চারিদিকে কেবলই মাদার গাছ। এ কেমন ধারা! অসময়ে রক্তাক্ত লালফুলে রঞ্জিত হয়ে আছে তারা। হাতে আমার অভিন্ন আনারস। অন্যহাতে মৃগেল মাছ। সমস্তযোগে বলতে গেলে একপ্রকার কাদায় হাবুডুবু খাবার জোগাড়। ভাগ্যিস আঁধার ছিল প্রকৃতিব্যাপী। নইলে লজ্জা আমার চমকে উঠে চিরতরে তার চরিত্র হারাত, যা হোক কাদা-পানিতে মাছ থাকল মাছের মতো, আনারস তার রসসমেত ছিটকে জানি কোথায় গেল! যত ক্ষণস্থায়ীই হোক, সুখ কি সয়, মৃত্যুর শিবিরে? কথাটা পৌঁছে গেল দিক হতে দিগন্তে।
সামলে উঠে তাকিয়ে দেখি উজান ঠেলে হনহন করে বাড়ির পথে হেঁটে আসছে তোমাদের সেই উদয় মাঝি। তোমার মনে আছে নিশ্চয় গত শীতে তার প্রসঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল। ওই যে পোয়াখানেক মধু দিয়ে বলল- বাড়ির গাছের মধু। শুনে আমরা কতই না হাসলাম। আধো অন্ধকারেও তাকে চাঁদের মতো স্নিগ্ধ, কিন্তু সিঁদুরের মতো লাল টকটকে দেখাচ্ছিল। তো এমত অবস্থায় সে আমাকে বলল- খালু, সাগর তো শেষ, সামনে খালি চাম্পাকলার বীথি। অন্ধকারে এ পথে একা একা যান কই? প্রশ্ন বটে! বললাম, কাল তোমাদের রকিবুলের বোনের বিয়ে। যাই তো সেইখানে। শুনে সে কেবলই হাসে। তালাবদ্ধ প্রান্তর ভেদ করে সে হাসি আছড়ে পড়ে নিচু পাঁচিলে দু’পা তুলে লাল জবাফুল সমেত আস্ত গাছ চিবিয়ে খাওয়া প্রান্তিক এক ছাগলের কানে। ভয় ও ভাবনায় বেচারা তীর-ধনুক আঁকা কাঁপতে থাকা এক সাইনবোর্ডের ওপরে লাফিয়ে যেন হাওয়ায় মিলে গেল নিমেষে। আমি তো হতবাকে হতচ্ছাড়া তার কথা শুনে। বলে কিনা সে বিয়ে তো বাজেয়াপ্ত হইছে নানা। আমি মদনার ন্যায় চোদনা সাজিলাম। সে আরও বলল, আপনি আসলেন কীসে মামা? আমি বললাম ট্রেনে। শুনে সে হাসে। বলে এ দিগন্তে ট্রেনলাইন তো নাই কাকা। মিছা কতা কন ক্যান। বলেন প্লেনে আসলেন। বললে আমি কী প্লেন কাইড়া নিতাম! এই বলে সে ফের হনহন করে পথে-প্রান্তরে মিলিয়ে গেল। বিশ্বাস করো রকিবুল ভয়ে আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে কীভাবে যে ফিরেছিলাম সে ব্যাখ্যা অন্য আর একদিন লিখব। বাড়ি ফিরে এখন মনে হচ্ছে, অবাস্তবেরও প্রাণ আছে। শুধু মন দিয়ে অনুভব করতে হয় তাকে। তার বাইরে দুরন্তপনাটা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। যারা চিনেছে তাকে, তাদের সঙ্গে সে খেলা করে। হাসে, কথা বলে। বলে- নিজেকে ভুলে যা, ভুলে যা তোর অভাব-অভিযোগ, ক্ষুদ্রতা-নীচতা। তুই মানুষ, মনুষ্যত্বই তোর সম্পদ। তাই বিলোবি তুই। দিকে দিকে, জনে জনে।
বুঝলে রকিবুল, আমার এ যাত্রাতে সবচেয়ে বেশি দেখেছি আমি প্রাণ, তথা প্রাণিদের। খানিকটা জিরোতে, পানির টানে তিলক জ্যাঠার উঠোনে বসতে বাধ্য হয়েছিলাম। তার নাতি বিমলের ঘরে- দেখলাম, দেয়ালে পিন দিয়ে গাঁথা একটি মথ। পতঙ্গটি মৃত, ছবি দেখে সেটা বুঝতে কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু মথের এই প্রাণহীন নিস্পন্দতাই ছবিটির শেষ কথা নয়। অন্য দুটি উপাদান দেখে বেদনার্ত হয় হৃদয়। মুঠো করা দুটি জীবন্ত শিশুর হাত বেরিয়ে আসছে মথের দুই ডানা ভেদ করে। কিন্তু ওই দুটি হাতের তো কোনো দৃষ্টি নেই। যেন অসহায় হয়ে শূন্যে কাঁপছে দুটি হাত। মথটি মারা যাবার পরও অদ্ভুতভাবে ওই হাত দুটি বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে। এ যেন প্রকৃতিকে দলনের বিরুদ্ধে অভিনব এক প্রতিবাদ।
জানি, মনে আঘাত পেলে বনে যেতে হয়। যেতে হয় সবুজের বিশ্রামে। সেখানে সকল বৃক্ষ উল্লসিত হয়ে একসুরে ডেকে ওঠে- তুমি তো আমাদেরই জীবনসঙ্গী। জানি সবুজ তার প্রাণ-প্রাচুর্যে আমাদের ঘিরে রাখে। জননীর মতো, সখার মতো, প্রেমিকার মতো। তার লয় ও বিলয়ে আমরা বড়ই উদাসীন। দুঃখ হয় সে আজ শহরে উপেক্ষিত, অরণ্যে কর্তিত। যাহোক পত্রবার্তার ভারে ভারাক্রান্ত হলে তার নান্দনিক দিকটি ক্ষুণ্ন হয় বোধ করি। হয়তো একটা একঘেয়েমি চলে আসে। পত্রে আলো-বাতাসের অবাধ বিচরণ থাকতে হয়। সেই স্পেসটুকু দিতে হয়। যেখানেই আকাশ উঁকি মেরেছে এই পত্রে সেখানেই মন আর মননের সুন্দর মাত্রা পেয়েছে। অন্যখানে হাঁপ ধরেছে। আসলে বর্ণনা হলো রেখার খেলা। গানের আলাপের মতো রেখাকে নিয়ে খেলতে হয়। কখনো সাপাট, কখনো চক্রধা। রেখায় থাকে প্রাণের আরোপ। শোনো রকিবুল, রেখার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে হবে। বস্তুজগতের যাবতীয় আকার ও আকৃতি থেকে আলগোছে জ্যামিতিটাকে বের করে আনতে হবে। ভাবনায় ভেসে ভেসে অনেক কথা বলে ফেললাম, যা কিনা নিরালম্ব নারীর মতো নগ্ন, আর্ত। বেলুনের মতো ভাসমান, যা কখনো আকাশে, কখনো জমি থেকে ফুট কয়েক উঁচুতে, কখনো পাশ ফিরে, কখনো হেট মুণ্ডে। জানি, পাঠান্তে বিরক্ত হবে। গলায় মাফলার, গায়ে শাল জড়িয়ে মুড়ির বাটিতে গুড় রেখে হুটহাট উঠে যাবে তুমি। বলি, রাত এলে নিশ্চিন্ত হবে একেবারে আলুথালু নয় এ কথা ভেবে। ফের বাহানা করি- এও সেই অঘ্রাণ, তবে কঠিন বাস্তবের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বরং অন্য এক কার্তিক-অঘ্রাণের গল্প শোনাই। কিন্তু গল্প বললাম কেন? এ তো ঠিক গল্প নয়, তবে অতীতের কথা তো গল্প কথাই হয়ে স্মৃতিতে জায়গা নেয়। সেখানে হারায় না এতটুকুও কোথাও, শুধু মানুষজনই হারিয়ে যায়, অনাদি অতীত কথা বলে।
আসলে আমার তোমার জন্য এখনো কোথাও-না-কোথাও মানুষ বসে আছে। তারা গল্প বলতে বা শুনতে চায়। যে গল্প মহানগরের উড়ন্ত ট্রামে চেপে আসে। আমাদের দিলের মধ্যে ফলার মতো গেঁথে যেতে চায়। তাদের হাসি আর কান্নাগুলো কাঁধের ব্যাগে রাখা কাগজে দ্রুত খসখস করে লিখে রাখি। আমরা বিশ্বাস করি, কালো মেয়েটির দেশেও চাঁদ ওঠে, বৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে মাধবীলতা। যাহোক তুমি কতটা বুঝলে, আমিইবা কতটা বোঝাতে পারলাম, সে হিসাব পরে হবে। পাশের ফ্ল্যাটের বউ ছ’মাসের কন্যাসহ পালিয়েছে বাপের বাড়ি। তোমার ভাবীর মুখে শুনলাম- যাবার আগে শ্বশুরকে পায়ে সালাম করে গেছে। ভাবো একবার, কচুরপাতার মতো টলমল এই তো আমাদের সম্পর্ক! কী আর বলি বলো! কোনো শর্ত নয়, শর্ত এখন সত্যিই দুর্মূল্য এক বস্তু হয়ে উঠেছে।
পুনশ্চ : এর ভিতর যদি রাশেদুল আসে তার হাতে পোয়াখানেক মধু, না থাক! মধুতে কাম নাই পারলে ঘি পাঠাতে পারো। বাকিটা না হয় বিস্তারিত তার মুখেই শুনবে!
One Comment
কবি শিবলী মোকতাদিরের দীর্ঘ গদ্যটি পড়লাম। ভালো লেগেছে। প্রত্যেক কবিরই গদ্য লেখা উচিত। এদিক থেকে কবি শিবলী অনেকটা এগিয়ে রয়েছেন। তাকে অভিনন্দন। লেখাটি পড়ে গদ্য লিখতে আমিও খানিকটা অনুপ্রাণিত হলাম। দেখি পারি কিনা। অনুপ্রাণনের সাথে আছি সবসময়।