১৯৭৯ সালের শেষদিকে টাঙ্গাইলের পাঠ চুকিয়ে ঢাকা চলে এলাম।
বাড়িটা কেনা হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগেই খালি বাসায় তুমুল আড্ডা দিত মুক্তিযোদ্ধারা। আমি বাসায় আসার পর আমার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান আরজু গল্পে গল্পে জানায় মুক্তিযোদ্ধাদের আড্ডার দলে কবি আসাদ চৌধুরীও ছিলেন কয়েকদিন। পুত্রকন্যারা ছোট ছিল বলে কোনো সাহিত্য আসরে অংশ নিতে পারিনি তখন। বইমেলা থেকে বই কেনা পাশের লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ পত্রিকার সাহিত্যপাতা এই ছিল প্রিয় লেখকদের সান্নিধ্য।
আশির দশকে সবেধন বিটিভিতে প্রচ্ছদ নামের অনুষ্ঠানে প্রথম দেখি কবি আসাদ চৌধুরীকে। মিষ্টি মিষ্টি হাসিতে কী চমৎকার গাঁথুনিতে কথা বলে দর্শকের হৃদয়ে আসন পোক্ত করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল কবি আসাদ চৌধুরীর।
‘কোথায় পালালো সত্য’ কবিতাটা তখনই শোনা। মাথায় গেঁথে যায় প্রতিটি পঙক্তি। আমরা তো ডাকঘরের মাধ্যমে লেখা পাঠাতাম, আর পত্রিকার স্টলে দাঁড়িয়ে পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টে নিজের লেখা খুঁজতাম। আমার চেনা জগতও ছিল সীমিত। মিরপুর থেকে শাহবাগের দূরত্বও কঠিন না-বাচক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। সব মিলিয়ে আসা হতো না।
ছেলেমেয়েরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ ছাড়ালে আমিও লাজুক ভীরু পা রাখি সাহিত্যের অনুষ্ঠানে।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখন ছিল একতলা, সেখানে একটা অনুষ্ঠানে বহু রথি মহারথিদের সাথে দেখা হয় কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে।
তারপর নারী গ্রন্থ প্রবর্তনায় মাঝে মাঝে কবি হাসান মাহমুদ আয়োজন করত সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠান। যেখান থেকেই কবি আসাদ চৌধুরীর কাছাকাছি আসা। তিনি মুক্তিযোদ্ধা আমার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি সম্পর্কের বাঁধনকে সুদৃঢ় করেছে।
‘তবক দেয়া পান’ খ্যাত আসাদ চৌধুরী প্রচুর পান খেতেন বলাই বাহুল্য। তার পানের কৌটো থেকে পান সুপারি তুলেও নিতাম অবলীলায়। এই সাহসটা তিনিই দিয়েছিলেন। ভুঞাপুর উপজেলার একটি ইফতার মাহফিলে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা একজন বরেণ্য কবি ও মুক্তিযোদ্ধাকে কাছে পেয়ে খুবই আনন্দিত হলো। বহু অনুষ্ঠানে তার সাথে অংশ নিয়েছি।
আমার লেখা গল্পগ্রন্থ ‘কেন ডাকো বারবার’ তাকে উৎসর্গ করে নিজেকে সম্মানিত মনে হয়েছে।
শিল্পকলার মাঠের একপাশে নান্দনিক কফি হাউজ ছিল। একদিন ধুম আড্ডার মাঝে কবি আসাদ চৌধুরী এলেন। তিনি হাসছেন কিন্তু প্রাণখোলা নয়, একটু বিষাদাক্রান্ত। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন দাঁতের ব্যথায় প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন। সাথে সাথে ফোন দিই বড়কন্যার জামাতা দন্ত চিকিৎসক ডা. রওনক জাহান তমালকে।
এবং সাথে সাথে কবিকে নিয়ে মিরপুরের পথ ধরি। পৌঁছে যাই ডা. তমালের চেম্বারে।
আপডেট ডেন্টাল কলেজের শিক্ষক শেওড়াপাড়ায় চেম্বার আর বাসার নিচতলায় চেম্বার। কবিকে শেওড়াপাড়ায় চেম্বার নয়, ওর বাসার চেম্বারে চিকিৎসা শুরু করেন। কবি চিকিৎসা নেওয়ার সাথে সাথে আমার বেয়াইনের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেন। নরম মখমলের জায়নামাজ পেতে দেন বিশ্বাসী কবির জন্য। আমার কন্যা ডা. সিলভানা ইশরাত সোমাও ঝাল নরম পিঠা আর মিষ্টি কম দিয়ে পায়েস বানিয়ে রাখে।
রোগী আর ডাক্তারের কথা মনে নেই আমার। অনেকদিন পর পাবলিক লাইব্রেরিতে দেখা হয়। সাদা দাঁতে ঝিলিক তুলে প্রাণখোলা হাসিতে জানায় তার দৃষ্টিতে ডা. তমাল সেরা মানবিক চিকিৎসক আর তমালের মা ধার্মিক ও কবিতার বিপরীতের মানুষ হলেও তার দুটো কবিতার বই পড়ে প্রশংসা করেছেন, এমনকি ভাবিসহ এক দুপুরে আতিথ্য গ্রহণ করতেও হয়েছে। বুঝতে পারলাম শহীদ বুদ্ধিজীবীর জি সি দেবের ছাত্রী বেয়াইন দিল রওশন আরা গুলজার আমার চেয়েও তবক দেওয়া কবির ভক্ত হয়ে গেছেন।
কত স্মৃতি কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে!
আমার দেখা ভেতরে তারুণ্যময় কবি সবসময়ই তরুণদের ভরসাস্থল হয়ে তাদের পাশে থাকতেন।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো সাহিত্য আসরে তিনি যেতেন। অতি তরুণদের সাথে তার আচরণ ছিল অভিভাবকতুল্য বন্ধুর মতো, তরুণদের লেখায় আগ্রহী করতে তার এই অনন্য ভূমিকা অসাধারণ এবং অনুকরণীয়। বইমেলায় নজরুল মঞ্চে তিনি বেশির ভাগ তরুণ লেখকের বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন; আশা দিতেন সাহস দিতেন এগিয়ে যাওয়ার।
প্রবাস থেকে ফিরলেন সেটাই তার প্রিয় বাংলাদেশে শেষ ফেরা।
রাইটার্স ক্লাবের একটা আয়োজনে আমাকে যুক্ত করল প্রয়াত সোহাগ সিদ্দিকী। ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ব্যক্তিগত কথা হলো তিনি আগ্রহের সাথে জানতে চাইলেন মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান আরজু (আমার স্বামী) কেমন আছে।
পরদিন ফোন দিয়ে কথাও বললেন সেটা একটু রাতের দিকে কিছুটা অসুস্থ তাই ওষুধের প্রভাবে ভালো করে কথা হলো না, পরদিন ফোনে সংযোগ করিয়ে দিলাম দুই মুক্তিযোদ্ধার। মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটবিষয়ক কিছু কথা হলো, পুরোনো স্মৃতি চারণ হলো।
কবি আসাদ চৌধুরী ষাট দশকের অন্যতম কবি। তিনি একাধারে কবি সাংবাদিক আবৃত্তিকার উপস্থাপক।
সাহিত্যে তিনি গণমুখী নান্দনিক ও রোমান্টিক। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বাংলার লোকায়ত জীবন সবই তার লেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, তার পিতা আরিফ চৌধুরী, মা সৈয়দা মাহমুদা বেগম।
তার পিতা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সখ্যও ছিল। তার পিতা আরিফ চৌধুরীর মৃত্যুর পর, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কবির কাঁধে হাত রেখে সাহস জুগিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনে এই পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে। ১৯৬৪ থেকে ১০৭২ অবধি। তারপর বিভিন্ন সংবাদপত্র সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৮৫ থেকে ১০৮৮ অবধি ভয়েস আব জার্মানির বাংলাদেশ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘদিন চাকরির পর তিনি পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ‘কোথায় পালালো সত্য’ তার খুবই জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি কবিতা।
তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম— তবক দেয়া পান, জলের মধ্যে লেখাজোখা, বিত্ত নেই বেসাত নেই, বাতাস যেমন পরিচিত ভিন দেশের লোক কাহিনি।
শিশুতোষ, কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ সম্পাদনাসহ সব মিলিয়ে তার গ্রন্থের সংখ্যা ঈর্ষণীয়।
অর্জন করেছেন দেশ বিদেশ থেকে অজস্র পদক পুরস্কার সম্মাননা। উল্লেখযোগ্য হলো : বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পদক, জীবনানন্দ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, একুশে পদক।
তার সাথে যেমন অগ্রজ কবি হিসাবে শ্রদ্ধাময় সম্পর্ক ছিল তেমনি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেও সম্মান ভালোবাসাময় সম্পর্ক ছিল।
সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন আমার খুব কাছের মানুষ। আমার স্বামীরও তাই।
২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর তিনি আমাদের শোকসাগরে ভাসিয়ে চলে যান অন্য ভুবনে। বিশ্বাস করি তিনি সেখানে ভালো আছেন, ভালো থাকবেন।