
সন্ধ্যার পর থেকেই ফরীদি ভাইয়ের কথা মনে হচ্ছে।
মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন বলে! হয়তো! জীবনের ওপারে থেকে ফরীদি ভাই কী পেলেন এই সংবাদ? নাকি আমাদের রাষ্ট্র খুব ক্রেডিট নিলো তালিকায় তাঁর নামটা রেখে!
২০০৪/০৫ সালের কথা। নাকি ২০০৬! সেলিম স্যারকে দিয়ে বলিয়ে ফরীদি ভাইকে ধ্বনির আবৃত্তি কর্মশালায় আনার একটা চেষ্টা নিয়েছিলাম আমি, জাহাঙ্গীরনগরে।
তো, স্যার বলল, ‘ফরীদি অনেক ব্যস্ত, এমন কাজে আসতে পারবে না। এখন আমি ডাকলেই আসে না’। স্যার হাসল, পুরান কলার সামনে, আমারও সামনে– ‘তবে, তোরা যদি বোতলের কথা বলিস, কিছু কাজ হতেও পারে’। আমি বললাম, ‘স্যার ফোন করে দেন। আমাদের তো চিনেন না, পাত্তাই দিবেন না।’
স্যার ফোন করলেন, তিন-চারবার বাজলো, ওপাশে কেউ ফোন ধরলো না। বললাম, স্যার নাম্বার দেন, আমরা ট্রাই করি।
প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল দশটার দিকে ফোন দেই, কেউ ধরে না। মেসেজ লিখলাম একদিন একটা, “Dear Faridi Bhai, I am from Dhony, Jahangirnagar University, would you please call me back.’
পরদিন সকালে, আমি তখনো ঘুমে, ফোন বাজছে।চোখ মেলে দেখি ফোনের স্ক্রিনে হুমায়ুন ফরীদির নাম ভাসছে। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি না তো! তারাহুড়া করে ফোন ধরতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে গেলো ফোন, নোকিয়া ৩৩১০ পড়েই বন্ধ।
সেট ও ব্যাটারি লাগিয়ে, আবার ফোন করলাম, এবার কেটে দিলেন না কেটে গেলো বুঝলাম না। তবে ফোন করলেন।
হরবর করে বললাম, সেলিম স্যার, ধ্বনি, আমাদের কর্মশালা, আসতেই হবে, ইত্যাদি। উনি শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, জাহাঙ্গীরনগর ডাকলে কখনো আমি না করি না। কিন্তু শরীরটাও ভালো না, আর শ্যুটিংএর ডেইটই দিতে পারছেন না নতুন কাউকে। এবার যেনো উনাকে আমরা ক্ষমা করে দেই, আর একদিন দুম করে এসে আড্ডা দিয়ে যাবেন আমাদের সাথে। আমি খুবই মুগ্ধ হলাম, সারাদিন প্রায় উড়ে বেড়ালাম, ক্যাম্পাসের বন্ধুদের প্রায় সবাইকে বললাম, আরে ফরীদি ভাই ফোন দিছে আমারে, জানস ব্যাটা!
এরপর বহুবার ফরীদি ভাইকে ফোন দিয়েছি আমি, নানা আবদার করেছি, ভাই সামনে উৎসব, বিজ্ঞাপন লাগবে, অমুককে বলে দেন, ভাই খুব মন খারাপ, একটা কবিতা শোনান, ভাই সেলিম স্যার আর আমি হাঁটতেছি, এখন মুক্তমঞ্চে, স্যার আপনার ‘মহামানবের সাগরতীরে’ শুনবে– কত কত আবদার।
ফরীদি ভাই মেজাজী মানুষ ছিলেন, সম্ভবত জাহাঙ্গীরনগরের দাবী ছিলো বলেই কখনো কোনদিন বিরক্ত হন নাই আমাদের ক্রমাগত নানা আবদারে।
তখনো পর্যন্ত আমি ফরীদি ভাইকে সরাসরি দেখি নাই। ফোনে ফোনে কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরের সিনিয়র ভাই মানে ফরীদি ভাই বলেই ডাকি। সেলিম স্যারের বদৌলতেই দেখা হইলো। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। দলবল নিয়া বটতলায় খাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেলিম স্যারের ফোন, “তুই কই? যেখানেই থাকিস, দশ মিনিটের মধ্যে ট্রান্সপোর্টের পুকুরপাড়ে আয়, ফরীদি আসছে”। তখনো ডাল দিয়ে খাই নাই আমি, রাজ্জাক ভাইয়ের দোকান থেকে উঠে দৌঁড় দিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠলাম।
জাকসুর সামনে পুকুরপাড়ে গিয়ে, রাস্তায় রিকশা থেকেই দেখি, ঘাটের অন্ধকারে দুজন মানুষ। বসে আছেন। সেলিম স্যার পা তুলে বেঞ্চিতে বসা, ফরীদি ভাই নিচে, পুকুরঘাটের সিঁড়ির প্রথম ধাপে।
স্যার আমার সাথে ফরীদি ভাইয়ের পরিচয় করায়া দিলেন, পাগলা বইলা। বললেন, তোর মতোই এইটা আরেক পাগলা রে ফরীদি’। ফরীদি ভাইকে আমি ঝুঁকে বললাম, ভাই আপনার পায়ের ধুলা নেই একটু, উনি দাঁড়ায়া টান মাইরা আমারে জড়ায়া ধরলেন, ধুর মিঞা, বুকে আসো’ বইলা।
অনেকক্ষণ আড্ডা হইলো, বিষয়, কিভাবে আবার আন্ত:হল নাট্যোৎসবটা চালু করা যায়। বিষয়, সাংস্কৃতিক জোটের জাকসু চালুর আন্দোলনে কেন থাকা উচিত। আরো বেশি জাহাঙ্গীরনগরের ছেলে মেয়েদের কিভাবে গণমাধ্যমগুলোতে ঢোকানো যায়। বিষয়, ক্যাম্পাসে থাকতে ফরীদি ভাইরা কত দুষ্টামী করেছেন, সেলিম স্যারকে কিভাবে জ্বালাইছেন, রফিক স্যারের বিশেষ পাণীয়ের সাপ্লাই ঠিক রাখতে কত কত চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন, কার গাছের ডাব চুরি করছেন, সালেহীন স্যারকে কিভাবে শীতের সকালে পুকুরে দাঁড় করায়া রাখছেন, কাপড়চোপড় ছাড়া… ইত্যাদি।
একটা ডায়ালগতো এখনো কানে বাজে। পুকুরের দিকে তাকিয়ে থেকে, তখন আমি সিঁড়িতে তার পাশে বসেছি, আমাকে বললেন, এইটাতে নেমেছিস কখনো? আমি বললাম, না। ভারী কণ্ঠে ভাব নিয়া বললেন, ‘নামলে বুঝতি, নিচে কতটুকু কাদা, আর কত কত বাংলার জলের বোতল!’
সম্ভবত ২০০৭ এর উৎসবে আমরা ধরলাম ফরীদি ভাইকে, মুক্তমঞ্চে আমাদের উৎসবে গুণীজন সম্মাননা নিতে হবে। ফোনে বলতেই বললেন, নিজের ক্যাম্পাস থেকে সম্মান নেয়ার কিছু নাই। তোরা যে আমাকে ভালোবাসিস এমনিতেই জানি। বললাম, সেলিম স্যারের হাত থেকে নিবেন না রফিক স্যারের হাত থেকে! রসিকতা করে বললেন, ‘বাপরা জন্ম দিয়া, বড় কইরাই বড় পুরস্কার দিছে রে, এইবার তোদের উৎসবের যে সময়, কোনভাবেই পারবো না, বিশাল এক দলের সাথে শ্যুটিঙে দেশের বাইরে যাচ্ছি।’
এরপর ব্যস্ত ফরীদি ভাই কিভাবে কিভাবে জানি এই দেশ ছেড়ে অনেক দূরের দেশে চলে গেলেন। যেই দেশ থেকে ফোন আসে না, ফোন করাও যায় না। দুমম করে কেউ বলে বসে না, ট্রান্সপোর্টে বা সমাজবিজ্ঞানের ছাদে আয়, তোকে খাওয়াবো। বা, আরে চাকরির কথা ভাবিস না, আমরা আছি না! কবিতা লেখ।
ফরীদি ভাইয়ের একুশে পদকপ্রাপ্তি আজ বড় বেদনার মতো বাজছে আমার বুকে। কত বঞ্চনা আর একাকীত্বের মধ্য দিয়ে যে তার শেষ সময়গুলো কেটেছে, তার কিঞ্চিত জানি আমি। সেলিম স্যার যেবছর একুশে পদক পেলেন, ফরীদি ভাই আমাকে ফোন করে বললেন, ‘ওরে তোরা আনন্দমিছিল কর ক্যাম্পাসে’। কী উচ্ছ্বাস ছিলো গলায়!
আচ্ছা আমি এখন জাহাঙ্গীরনগরে কাকে ফোন করে বলবো, ‘ওরে, আমাদের ফরীদি ভাই একুশে পদক পেয়েছে রে, তোরা আনন্দ মিছিল কর’।
ফরীদি ভাই, প্লিজ, আসেন আরেকদিন, অন্ধকারে ট্রান্সপোর্টের পুকুরপাড়ে গিয়া বসি।