অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উৎপল দত্ত -
অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর : প্রত্যয়ী পদাতিকের পরিভাষা

ভূ-মূলে প্রোথিত গাছই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে,

টবের বৃক্ষেরা একদিন ঠিক টের পায় শেকড়ের অস্তিত্ব সংকট।

(ফাঁকি, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর— বিনয় কর্মকার)

এক.

কবি নিরাকার, বস্তু ও নির্বস্তুকে আকার দেবেন তাই। কবি সৌম্য, সাম্যের অভিযাত্রায় চেলাকাঠের প্রজ্জ্বলন হৃদয়ে ধারণ করেন বলেই হয়তো। কবি ধৃতিমান, ধী-শক্তিকে ধারণ করেন বলেই। কবি আপাত নিরীহ— তাকে তা হতেই হয় নির্মিতির প্রশ্নে। কবি নির্বিষ, অন্তর্দাহকে গোপনে পুষে রাখেন, না-হলে বলার শক্তি ক্ষীণ ও স্তিমিত হয়। কবি অন্তঃসারশূন্যতার মধ্যে অনন্তের উড়াল-পালক খোঁজেন।

এবং কবি নির্বিকার, অসময়ে আকাশমুখো, অথচ ভেতরে তার শালপ্রাংশু হৃদয়।

বেশুমার বয়ানে কবিকে ধরার চেষ্টা করা যায়, তবু তার অন্তর্জগত ধরা যায় না। তার অন্তর-উৎসারিত ধ্বনি প্রকাশ পায় তার কাব্যকৃতির মধ্যে। ‘অলক্ষে নির্মিত কাচঘর’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় প্রথাবিরোধী অথচ পরম্পরা ও শেকড়-সংলগ্ন নির্মাণ-কৌশলের প্রত্যয়ী পদক্ষেপ ও পায়ের চিহ্ন পড়েছে।

 

যে-পথে আমার আগেও হেঁটে গেছে অনেকে পথিক

যে-পথে আমার পরেও হেঁটে যাবে অনেক পথিক… …’

উৎসর্গের এই দুই পুষ্ট পংক্তি পরম্পরার প্রতি কেমন হৃষ্ট আঙুল উঁচিয়ে আছে, তার ব্যাখ্যা কাব্যগন্ধী পংক্তিযুগলেই মুখর।

অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর এর কিছু মোহন মুদ্রণ :

ক.

বরফজলে ভাসে যে-জাহাজ; তার বুকেও আগুন থাকে।

গন্তব্যের পথে-পথে মানুষগুলোও রহস্যময়,

প্রেমী; খুনি; কখনো রঙিন, কখনো-বা সাদাকালো—

 

(বিচিত্র বিন্যাস, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

খ.

চার-চারটি সমান বাহু

সমঝোতায় আবদ্ধ হলেই বর্গক্ষেত্রের সরল সংজ্ঞা,

কিন্তু খেয়ালের গণ্ডি পেরোলেই দেখি সীমাবদ্ধতার সূত্র।

 

(সরলরেখা, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

গ.

আমরা কি আর জানি,

কতো সহস্র তাজমহলের যোগফলে একজন মমতাজ?

(মমতাজ, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

দুই.

কবিকে অথবা কবিকল্পনাকে ব্যাখ্যার প্রতিবন্ধকতা অনেক, যেহেতু কবি সরল বাক্যে কিছুই বলেন না। তিনি চিত্রকল্প রচনা করেন, ইঙ্গিত-ইশারা, উপমা-রূপকে তা ভরা। তিনি যা দেখছেন তার উচ্চতা বা কৌণিক অবস্থান থেকে তার সোজাসাপটা জ্যামিতিক ব্যাখ্যা ও পরিমাপ দুরূহ। তাহলে কি কবিতা পড়ব না? অলক্ষে রয়ে যাবে কবি? অলক্ষে রয়ে যাবে তার মুদ্রিত কাচঘর? দেখুন বিনয় কর্মকার লিখছেন কাচঘর যা মুদ্রিত করা যায় না। অথচ তিনি তা মুদ্রিত করেছেন। এবং এই মুদ্রণ তার অলক্ষে ঘটেছে। তিনি তা লক্ষ করেননি অথবা তার দৃষ্টিসীমার বাইরে তা ঘটেছে। তাহলে তিনি তা মুদ্রণ করলেন কীভাবে?

কাচঘর ভঙ্গুর, কাচের এই স্বভাটির চেয়ে বড় স্বভার কাচঘর স্বচ্ছ। ধরা যেতে পারে তিনি তার অলক্ষে স্বচ্ছতার বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাহলে সুস্পষ্ট করে তিনি যা দেখাতে চান, তা তিনি দেখেননি। সরল সমীকরণে তাই প্রতিষ্ঠা পায়। এই সরল সমীকরণ কবিতার দুয়ারে পা রাখে না, তা কবিতার নিমগ্ন পাঠকমাত্রই জানেন। কবিতা বিশ্লেষণের কাঁচিটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মনোজগতকে হয়তো সেই কাঁচি বা টুলস হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অভিজ্ঞতাও এর মধ্যে পড়ে। আরও পড়ে বিগত দিনরাতের জীবনের পদাবলি, মানুষের ইতিহাস, তার সংস্কৃতির কুঠার ও কুশলতা এবং সমকালীনতা।

সমকালীন বোধ, সংবাদ-বিসংবাদ বিনয়ের কবিতাকে বোঝার অন্যতম মাপকাঠি হতে পারে। কবিতার বিষয়বস্তু, প্রকরণ, ও নির্মাণ-কৌশল বিচারে বিনয় কর্মকার প্রত্যক্ষলব্ধ অতীত ও অদেখা ভবিষ্যতের প্রতীতির সমীকরণ করে তার কবিতা নির্মাণ করেন।

অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর এর প্রতিটি কবিতাই রূপক বা মেটাফোরে ঠাসা। এবং ঠাস-বুনটে কবিতার নির্মিতি। রূপকের ব্যবহারে বিনয় কৌশলী এবং এই কৌশল অন্তত এ পর্যায়ে তার নিজস্ব বলেই মনে হয়। প্রথা ভাঙার প্রত্যয়ী পদাতিক বিনয়। কবিতার ফর্মকে গদ্য ছন্দ এবং অক্ষরবৃত্তে রেখেই কবিতাকে প্রচলিত বৃত্ত-পরিধির বাইরে নিয়ে এসেছেন। অন্তত নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কবিতার এমন বদলে-যাওয়া উপরিকাঠামো ও অন্তর্কাঠামো দেখা যায়নি। এটা আনন্দের এবং আকর্ষণীয়।

রিডল (ধাঁ ধাঁ অর্থে নয়, ছায়া-প্রচ্ছায়া অর্থে) দ্বান্দ্বিকতা, সমকালীন স্ফূলিঙ্গ, মুহূর্তের অভিঘাত ও অভিসম্পাত বিনয়ের কবিতায় বারবার মুখ দেখিয়ে যায়। শব্দচয়নে আছে পরিমিতিবোধ। তার শব্দভাণ্ডার এই বাংলার চিরায়ত ঘর-গেরস্থালি। বিকল্প বা প্রতিশব্দ আবিষ্কারের পরিবর্তে কবিতায় শব্দকে ভিন্নমাত্রায় উপস্থপন করার প্রবণতা দেখা যায়। কখনও কখনও তা কবিতার সম্পূর্ণ পংক্তির ক্ষেত্রেও সত্য। একটি সরল পংক্তিকে পুনর্বার পাঠ করলেই তার ভিন্ন দ্যোতনা ধরা দেয়।

অভ্যাসগত, বা সংস্কারপ্রসূত ধারণাকে আলগোছে কবি কুড়িয়ে নেন আমাদের নিত্যচেনা অনুষঙ্গ থেকে। তাকে উপস্থাপন করেন পরিমিত চিত্রকল্পে। পরিচিত অনুষঙ্গ ও উপাদান দৃশ্যকল্পকে পুনর্বার উসকে দেয়, যা পরিণতিপর্বে এসে উপস্থাপিত মৌলিক চিত্রকল্পটির উৎসমূলে কুঠারাঘাত করে। এই আঘাত, প্রত্যাঘাত বা চিন্তার জগতে আলোড়ন তোলার প্রবণতা পাঠকের মনে সংস্কারের যে বদ্ধ জলাশয় থাকে সেখানে তরঙ্গ তুলতে বাধ্য করে।

ঘ.

মা ছিলেন গৃহিণী।

বাণিজ্যিক-করণে রান্নাও শিল্প হয়ে ওঠে!

প্রতিনিয়ত পাল্টে যায় কতশত চাকচিক্য

অথচ, ক্ষুধার কাছে শিল্প, ভীষণরকম হাস্যকর।

 

(ভাত শিল্প, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

ঙ.

আমাদের তো হওয়ার কথা ছিল নিকটবর্তী প্রেম;

অথচ মানুষ আবিষ্কার করে ফেললো ইঞ্চি, গজ, মিটার

দূরত্ব নির্ণয় বাদে যার কোনো ব্যবহার দেখি না।

(অনাত্মীয় দ্রষ্টব্য, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

তিন.

চৈতন্যকে কচলে কবি তার নির্যাস পাঠকের হাতে ‍তুলে দেন– পাঠক সংস্কারের অবগুণ্ঠন থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখতে পায়। বদ্ধমূল ধারণার খোল-নলচে আলগা করার প্রয়াসটি শ্রমসাধ্য বলেই কবিকে রূপক-আশ্রিত হতে হয়। উপমার উঠোনে তল্লাশি করতে হয়, আনুষঙ্গিক চিত্রকল্পের আয়োজন করতে হয়। বিনয়ের কবিতায় রূপকল্পের আয়োজন আয়াসলব্ধ মনে হলেও তা স্বতঃস্ফূর্ত।

চ.

‘সুলভ পণ্যের প্রলোভনে ভুলে থাকি, অন্দরমহল, শ্রাবণদিন।

এভাবে একদিন বৃষ্টি ফোঁটায় খসে পড়ে পলেস্তারা,

ঠিক বেরিয়ে আসে রুগ্‌ণ দালাানের কঙ্কাল।’

(নগ্নতা, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

চার.

কবি চক্ষুষ্মান এবং জন্মান্ধও। অন্ধ তাকে হতেই হয় দ্যুতিময়তাকে চিহ্নিত করবেন তাই।

বিনয়ের কবিতায় রয়েছে প্যারাডক্সের ব্যবহার। আপাত বিরোধী ভাবনা বা বোধ, মনে হতে পারে বৈরী, আসলে শেষবিচারে তা সত্য। সত্য উন্মোচন ও প্রতিষ্ঠা শিল্পের আরাধ্য। প্যারাডক্সের সংজ্ঞা ক্যামব্রিজ অভিধানে এরকম : ‘a statement or situation that may be true but seems impossible or difficult to understand because it contains two opposite facts or characteristics.’ বিনয়ের চিত্রকল্প একটু ভিন্ন স্বাদের। পরিচিত হয়েও অপরিচিত। মনে হতে পারে, নিজের বধূকে আজ এইমাত্র অন্য সাজ-পোশাকে দেখছি।

ছ.

কবিকে পাগল ভাবা তবু নতুন কিছু না।

অথচ;

উদ্ভিদবিজ্ঞানে বাঁশ যেন— কী?

(ব্যতিক্রম দৃষ্টি, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

জ.

অনুষ্ঠানটা বিয়ের হলেও; কারো কারো দৃষ্টি কিন্তু খাবারের দিকে।

নির্দিষ্ট দূরত্বে নাচে যুবতীউচ্ছ্বাস।

লোডশেডিংয়ের পলকে কোথাও ছোঁ-মারে নগ্ন হাত।

 

(উৎসব মঞ্চায়ন, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

ঝ.

শীতের লেপ-ওমে কী-আর বোঝা যায়,

অগ্নীপরীক্ষায় সীতার কতোটা দহনজ্বালা!

(স্বীয় অনুভব, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

মেটাফোরকে সংজ্ঞায়িত করা হয় ফিগার অব ল্যাংগুয়েজ (Figure of Language) অভিধায়। এর কারণ সে আকার-অবয়ব নিয়ে আসে। ভাষা বাক-প্রতিমার মতো হয়, একটি দেহকাঠামো পায়। মনে হয় শুধু পাঠ করছি না, অবলোকনও করছি। সেই অর্থে বিনয়ের কবিতায় মেটাফোর বা রূপকের ব্যবহার একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের সফল।

কবিতার শক্তি অসাধারণ এবং বহুবিস্তারী। কবিতার শক্তিবলয়কে স্পর্শ করা তারচেয়েও দুরূহ। যারা পেরেছেন, তারা ঋষিতুল্য। চর্যাপদে মানুষের চিরায়ত জীবনসংগ্রাম ও জীবনযাপনের কথন তাম্রলিপির মতো গ্রন্থিত। একথা গ্রন্থিকগণ কহেন। কবিতার শেষ অন্বিষ্ট মানুষ এবং মানুষের জগত। কবিতা হিতোপদেশ নয়। কবিতা আলোকসম্পাত করে মাত্র। যার পথ তা সে ঠিক চিনে নিতে পারে। বিষাদকে অমল আনন্দে এবং বিবর্ণকে রূপসী করার জাদুকরী ও ক্ষিপ্র ক্ষমতা রাখে কবিতা। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ আক্ষেপ, বিলাপ ও বিষাদে ভরা অথচ তা তুমুল চিত্তানন্দে রূপান্তরিত। বিষাদের গর্ভ থেকে রূপসী বাংলা বিস্ময়ের ‘কল্কাপেড়ে’ শাড়ি জড়িয়ে উঁকি দেয়। ‘ঝরা পালক’ শব্দ তেমনি ঝরে যাওয়ার দুঃখ উপহার দেয় না, পরিবর্তে অনির্বচনীয় সুখকর কাব্যিক অনুভুতির জন্ম দেয়।

‘এপ্রিল ইজ দ্যা ক্রয়েলেস্ট মানথ।’ এই একটিমাত্র বাক্য দিয়েই আমরা টি এস এলিয়টকে চিনতে পারি। কারণ বাক্যটি মৌলিক, কবির নিজস্ব। খুবই সহজ ও সরল একটি বাক্য। কিন্তু সার কথাটি হলো, বাক্যটি একান্তই টি এস এলিয়টের (ওয়েস্ট ল্যান্ড, টি এস এলিয়ট)।

বিনয়ের কবিতায় মেটাফোর

অনাদী অ্যামিবা, কাচভাঙা জলসায়, স্থবিরতার কীটনাশক, জ্ঞানপথে, কোমল হাতের সংগ্রামী ছোঁয়া, জলের তেষ্টায় নেমে যায় ঘাট, বস্তুত আলো আর ছায়া যদিও জ্যামিতিক, উদ্বায়ু পদার্থগুণে জেনে গেছি যাপন রহস্য, শুধু একটু ট্যাগ লাগিয়ে দিলেই হয়, ও-তো খানকি, ভুল ডিলিটে কতো কি হারাই, এরকম অনেক উদাহরণ তার কবিতা থেকে দেওয়া যায়। পাঠকের জন্য রইল।

পাঁচ.

কবিতার ঘর-গেরস্থালি কতদূর, কোথায় বসতি, আমরা তা জানি না। তবুও নিরুত্তাপ-নির্বিকার পথিকের মতো পথ হাঁটলে দিগন্তরেখায় কোনো অবয়ব, আঁকিবুকির দেখা মেলে। কবিতাগন্ধী খড়-বিচালি অথবা ক্ষয়াটে পাখনা মেলে উড়ে গেল কী আদিকালের দেখা একটি চড়ুই— এমন সংশয় এবং বিশ্বাসও হয়। চিলেকোঠায় দূরাগত শোরগোল, মনে হয় ওই তো শেষবিন্দু, ওখানে আসতে হয়। আসলে তা নয়, এগোলে দিগন্তে আরও দূরে সরে যায় । অবয়ব থাকে কিন্তু অপসৃত হয় না। ফলত, শিল্পযাত্রীর পদক্ষেপ জোরালো হয় অশ্বখুরের মতো। যাত্রাপথের দৈর্ঘ্য বাড়ে। সে থেমে থাকে না। এই পথযাত্রাই হয়তো শেষপর্যন্ত সত্যি। শেষবিন্দুর আদর্শিক কবিতা-বাড়িটি কুহক বা কুহেলিকা হলেও তা লক্ষ্যমাত্র। তাই চলতে হয়, টলতে হয় না। ‘অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর’ হাতে বিনয়ের যাত্রাপথ টলায়মান নয়। তার চলার গতি সাবলীল ও ছন্দিত। যাত্রাপথে লক্ষ্য স্থির। একলব্য না-হলেও অন্তত একরোখা। নেতিবাচক অর্থে নয়, লক্ষ্যভেদী হওয়ার অর্থে। পদাতিক যদি প্রত্যয়ী না হয়, তবে তা হয় না।

নিজের কবিতার ভূগোল নির্মাণের ক্ষেত্রে বিনয় আত্মপ্রত্যয়ী। এ-কথা তার কাব্যিক উচ্চারণের মধ্যেই সত্য। দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই অভীষ্ট আলোকবিন্দুকে তালুবন্দি করার প্রত্যয় নিয়ে বিনয় সাবলীল পদাতিক। তার সামনে ক্রমশ দূরে সরে-যাওয়া কবিতা-গেরস্থালি, কিন্তু চলার পথে তার পদক্ষেপ শক্তপোক্ত। এই পদচ্ছাপ পাঠক পড়ে নিতে পারেন, ‘অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর’ থেকে।

ঞ.

‘ফরমালিন যুক্ত ফলবিক্রেতা ভুলে যায়, তার সন্তানেরও যে ওষুধ লাগে’

(প্রতিপ্রাপ্য, অলক্ষে নির্মিত কাচঘর)

এখানে সুস্পষ্ট সমাকালীন বৈকল্য এবং কন্ট্রাস্ট বা প্রতিকল্প। লক্ষণীয়, কবিতার নামও প্রতিকল্পের কাছাকাছি। কবি তা অলক্ষেই মুদ্রণ করেছেন। কাপলেট বা যুগল পংক্তিতে লেখা তিন স্তবকের এই কবিতর শেষ মোক্ষম উচ্চারণ : ‘ছায়াকে লাথি দেখালে সে নিশ্চয়ই ফুল দেখাবে না।’

কন্ট্রাস্ট বা প্রতিকল্প এখানে ঘনীভূত এবং কেন্দ্রস্থ। লাথি ও ফুলের দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব কতটা তা সহজেই অনুমেয়। লাথি ও ফুল আমাদের চেনা অনুষঙ্গ। রূপকের আড়ালে তার শক্তি বেড়ে গেছে। নিত্যদিনের ঘর-গেরস্থালির শব্দ, রূপকল্প, ব্যবহৃত ভাষাকে কবিতার উচ্চতায় হেঁচড়ে তোলা সহজসাধ্য নয়।

নির্মিতির প্রশ্নে কবিতায় শব্দ ব্যবহারে যে জার্গন (ভাষায় কষ্টকল্পিত অহেতুক জটিলতা) এড়ানো যায়। অপ্রচলিত, অচেনা, মুখরোচক শব্দের দ্বারস্থ হতে হয় না। অভিধানভুক্ত মরচে-পড়া শব্দকে হাতড়ে খুঁজতে হয় না। প্রচলিত, পরিচিত শব্দ ও অনুষঙ্গ ব্যবহার করে বিনয় তা প্রমাণ করেছেন। বিষয়বস্তুর বিচারে, যেন সমকালীন সংবাদটি নিজের অজান্তে চিরকুটে লিখে কবি তার পাশের মানুষটির পকেটে ঠুসে ‍দিচ্ছেন— এই সময়ে এই ঘটছে। সমকালীন সন্দেশ। সমাজ এবং সমাজ-আশ্রিত মানুষের প্রতি কবির দায়বদ্ধতার কাজটি সযত্ন সন্তাপে কবি সম্পন্ন করলেন। পাঠ শেষে ‘আহা’ ধ্বনিপুঞ্জ নিজের অজান্তে বা অলক্ষে ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়তেই পারে।

ট.

যতই শোনাও কুমারী মেরীর গান

মানুষ জেনে গেছে, সন্তানের শেকড়ে শেকড়ে অনিবার্য পিতার বাস।

(আফিমবাদ, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

মিথকে ভেঙে সত্য উচ্চারণের প্রয়াস। এরকম অযুত মিথ ইতিহাসের কচুরিপানার মতো নিরন্তর বইছে আমাদের সমাজে, আমরা চিন্তায়, মননে তাকে লালন করে আমাদেরই ক্রিয়াকর্মে বিষ উগরে দিচ্ছি। কবি ওই মিথকে ভাঙতে চাইছেন। স্বচ্ছ করতে চাইছেন চারপাশ একটি কাচঘরের মতো। একই কবিতায় কবির প্রথম জিজ্ঞাসা,

বানর চিনতে কি লেজের দৈর্ঘ্যের পরিমাপ জানা খুব জরুরি?’ মনে হতে পারে, রিডল বা ধাঁধা। মোটেই না, পুরো পংক্তিটিই মেটাফোর। এবং তীব্র স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গরসে পূর্ণ। পংক্তিটি তাই কবিতায় উত্তীর্ণ। প্রায় কাছাকাছি কথাই আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করি। কিন্তু তা কবিতা নয়। প্রচলিত ও পরিচিত ভাষাভঙ্গিকে বিনয় কবিতায় উত্তীর্ণ করেছেন। কষ্টকল্পিত চিত্রকল্প দিয়ে নয়, পরিচিত অনুষঙ্গ দিয়ে।

রিডল না বলে মিস্ট্রি, পাজল বা প্রোব্লেমও বলা যায়। আরও ভালো হয় ‘অসঙ্গতি’’ শব্দটি ব্যবহার করলে তারপর রিজয়নিং বা যৌক্তিক বিশ্লেষণ ও চিন্তার সংগঠন বা সংশ্লেষ। এই বিশ্লেষণ কবিতার উপকরণ ও সংবেদ দিয়ে— যুক্তিবিজ্ঞান দিয়ে নয়। আর পুরো প্রক্রিয়া অগ্রসর হয় দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায়। একই কবিতার শেষ দুই লাইন—

 

ঠ.

‘নড়বড়ে দাঁতে শক্তহাড় চিবানোর দৃশ্য দেখে অনেকেই হাসে,

আসলে অভিনেতার চেয়ে প্রমটরের স্বর উঁচু হলে, নির্ঘাত যাত্রাপালার ভরাডুবি।’

এখানে ‘নির্ঘাত যাত্রাপালার ভরাডুবি’ অংশটি রিজয়নিং বা সংশ্লেষণ। ‘আসলে অভিনেতার চেয়ে প্রমটরের স্বর উঁচু হলে’ অংশটি ব্যবচ্ছেদ যা রূপকে আচ্ছাদিত। তার আগে ‘নড়বড়ে দাঁতে শক্তহাড় চিবানোর দৃশ্য দেখে অনেকেই হাসে’ পংক্তিটি মূল চিত্রকল্প হিসেবে উপস্থাপিত। কবিতার এরকম নির্মাণ অভিনব, সন্দেহ নেই।

কে অভিনেতা আর কে প্রমটর তা আবিষ্কার করতে পাঠক আসন পিঁড়িতে ধ্যানস্থ হতে পারেন। আনন্দের খোরাক যেমন আছে, তেমন আছে সমাজ-মানস উন্মোচনের প্রতিশ্রুতি। নিজেকেও আবিষ্কার করা যায়। আসলে কবিতায় বিনয় প্রচলিত অর্থে দ্রোহী নয়। দ্রোহের সংজ্ঞা কবিতায় তিনি পাল্টে দিয়েছেন। স্যাটায়ার, দ্বান্দ্বিকতা, কন্ট্রাস্ট ‍বা প্রতিকল্প, এবং অন্যান্য প্রকরণ যা কাব্যরস সৃষ্টির জন্য জরুরি— সব উপাদান দিয়ে জারিত করে তিনি দ্রোহের সংজ্ঞা কবিতায় পাল্টে দিযেছেন। অন্তত এখানে বিনয় কর্মকার অনন্য।

ছয়.

ইংরেজী সাহিত্যে একদল কবি আছেন, যাদের ‘মেটাফিজিক্যাল পোয়েটস’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। জন ডান তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তুলনামূলকভাবে বেশি পরিচিত। অ্যান্ড্রু মার্ভেল, ভন— এরাও মোটাফিজিক্যাল গোষ্ঠীর মধ্যে পড়েন। জন ডান-এর বহুলপঠিত এবং প্রায় সর্বাাধিক আলোচিত কবিতা ‘ক্যানোনাইজেশন’। ক্যানোনাইজেশন কবিতার একটি পংক্তি এরকম—

For God’s sake hold your tongue, and let me love, —`The Canonization’ By John Donne

কবি তার প্রণয়ের আকাঙ্ক্ষা প্রায় ধমকের সুরেই বলেছেন। এর সার্থক অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—

‘দোহাই তোদের একটু চুপ কর/ ভালোবাসিবারে দে আমায় অবসর!’

মেটাফিজিক্যাল কবিকুল কবিতায় এমন উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহার করেছিলেন যা আগে হয়নি এবং তা কবিতার সাথে যায় এরকম কেউ ভাবেননি। তাদের শব্দচয়ন বা ডিকশন, সিমিলি, মেটাফোর মিলিয়ে কবিতার শরীর প্রায় অচেনা হয়ে উঠল। কিন্তু দিল ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন বার্তা, ভিন্ন বাণী কিন্ত কবিতার অভিন্ন সংবাদ। মেটাফিজিক্যাল কবিরা ইংরেজি সাহিত্যে একটি অনন্য এবং স্থায়ী অবস্থান নির্মাণ করলেন। জন ডান তার একটি কবিতায় তার বধূ বা বধুঁয়ার সাথে ভালোবাসার অপরিপক্বতা তুলনা করতে ব্যবহার করলেন ‘দুগ্ধপোষ্য শিশুর’ উপমা।

Did, till we loved? Were we not weaned till then?

But sucked on country pleasures, childishly?

Or snorted we in the Seven Sleepers’ den? The Good-Morrow, John Donne

`weaned’ `Seven Sleepers’ এখানে মেটাফোর বা ফিগারেটিভ ল্যাংগুয়েজ যা বলিষ্ঠ চিত্রকল্প নির্মাণ করেছে।

বিজ্ঞান, ভূগোল, রসায়ন, বাইবেল, অ্যাস্ট্রোনমির মতো বিষয় থেকে শব্দ আহরণ বা আমদানি করে কবিতাকে তারা ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করলেন। তাদের অলঙ্করণ প্রয়াসকে বলা হয় ‘মেটাফিজিক্যাল কনসিট’। পাঠক আনন্দ পেল, ভিন্ন কবিতা পেল। কালের বিচারে মেটাফিজিক্যাল পোয়েমস টিকে রইল। তাদের কবিতায় রয়েছে প্রচুর প্যারাডক্স, কন্ট্রাস্ট ও মেটাফোর এর ব্যবহার।

ড.

গতিবিদ্যার সমাধি পূজারী কি কখনো খেয়াল করে?

যে-বটগাছটা বামে রেখে বাড়ি থেকে বের হলাম;

ফেরা পথে, সে-গাছটাই ডানে পড়ে।

(বৃক্ষভ্রমণ, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

ঢ.

তত্ত্ব-উপাত্তে কৃতজ্ঞতায় উঠে আসে লুই পাস্তুরের নাম।

রেবিস ভ্যাকসিন।

(বিষদাঁত, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

বিনয়ের কবিতাকে ফেনোমেনাল কনসিট বলা যাবে কিনা তা জানি না। আগামীকালের পাঠক-সমালোচক তা নির্ধারণ করবেন। কিন্তু চেনা অনুষঙ্গকে, মুহূর্তের অভিঘাতকে, সমকালীন জীবন ও সমাজ-জীবনকে বিনয় পরিচিত অনুষঙ্গে যে-ভাবে ধরছেন তা একটি ভিন্ন ও স্বতন্ত্র কনসিট বা উপলব্ধি সৃষ্টি করে।

ণ.

বোতাম আর বোতামঘর?

সে-তো, পোস্টমর্টেম শেষে জুড়ে দেয়া একেকটা দরকারি সেলাই।

(শার্ট, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

ত.

আমরা ঘাড় পাল্টাতে পারি-না বলেই;

দুরারোগ্য দাগের ক্ষত নিয়ে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে

কোনো-কোনো শার্টের কলার।

(শার্ট, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

থ.

পানের পিকে সাদা দেয়ালজুড়ে ছোপ-ছোপ দাগ …

এ স্বভাব আমাদের বংশগত না।

শুনছেন, বললাম—

বংশগত ছাড়াও তো বেজন্মা হয়; হয়- না?

(প্রত্যুত্তর, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

সাত.

মিথ আজও জন্মায়, নিরন্তর জন্মায় মিথ ও লেজেন্ড। ফ্যাক্টস থাকে, পাশাপাশি আজও মানুষ প্রতিদিনের জীবনাচারে মিথ নির্মাণ করে। তবুও ‘পৌরাণিক যুগ’ কথাটি প্রচলিত। এক সময় মানুষের জীবনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে পুরাণ। বিনয় পৌরাণিক যুগের সাথে সমকালীনতার যোগসূত্র তৈরি করেছেন তার ‘পৌরাণিক’ কবিতায়। বল্মীক-কাহন ও বাল্মিকী উঠে এসেছে তার কবিতায়। পুরাণ-সূত্র আছড়ে পড়ছে সহস্র বছর পর এ যুগের বিভ্রমের উপকণ্ঠে। ইতিহাস, সময়ের প্রবহমানতা এবং সমকালীন উপাদান একাকার হয়ে যায়। ‘পৌরাণিক’ কবিতার একটি স্তবক এরকম :

দ.

‘হে বাল্মিকী জানি;

কতোটা নিমগ্নতায় উইয়ের ঢিবিতে দেহ ঢেকে যায়,

অথচ অভিজ্ঞতায় আঁকলেন কি-না, নপুংসক রাজকাহিনী।’

(পৌরাণিক, অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর)

ধ্যানস্থ, সত্যসন্ধানী, মাটি-সংলগ্ন এবং বাল্মিকী-সুলভ অভিজ্ঞান থেকে জনমানুষের বৃহত্তর জীবনসংগ্রামের ক্যানভাস প্রত্যাশিত ছিল, ‘নপুংসক রাজকাহিনী’ নয়। ইতিহাসের বিবরণ রাজ-রাজড়ার কাহিনী আশ্রিত, যেমন সেকালে তেমন একালেও। ইতিহাসের পর্যাপ্ত জল গড়ানোর পরও মননের পরিবর্তন কতটা হলো— তা প্রশ্নবোধক হয়ে যায়। যা ফলপ্রসূ নয় তাই তো নপুংসক। ইতিহাসের ইত্যকার বিবরণে মানুষ ও মানুষের যাবতীয় সৃজন উপেক্ষিত— এ-কথা বোঝাতেই বিনয় ‘নপুংসক’ শব্দের ব্যবহারে কুণ্ঠিত নয়, লাগসই শব্দ, সন্দেহ নেই।

এমনও মনে হতে পারে এই একটি কবিতা দিয়েই ‘অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর’ পড়ে ওঠা যায়। তা নয়, একাধিক প্রতিনিধিত্বশীল কবিতা আছে যার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির কৌণিকতা বদল করে কাচঘরে কাব্যিক স্বচ্ছতা দেয়ার প্রয়াস আছে। এই প্রয়াস অগোচরে (পাঠ করুন ‘অলক্ষে’) থেকে যায়। আমারও অগোচরে থেকে যেত। ‘অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর’ একবার নয়, একাধিক পাঠের দাবি করে, কবিতার অভীষ্ট প্রসাদগুণ প্রাপ্তির প্রয়োজনেই।

বাল্মিকী সংস্কৃত সাহিত্যের আদিকবি। মিথ বলছে, কামমোহিত ক্রৌঞ্চমিথুনের একটি নিহত হয়েছিল ব্যাধের শরে। অভিসম্পাত করেন বাল্মিকী। ব্যথা ও ক্রোধে তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল প্রথম শ্লোক, প্রথম কবিতা। পুরাণের সেই বাল্মিকী রূপকের আচ্ছাদনে সমকালীন বার্তা নিয়ে উঠে এসেছে বিনয়ের কবিতায়। ‘অলক্ষে মুদ্রিত কাচঘর’ অগোচরে নিদ্রিত না হয়ে, উন্মোচিত হোক। অচঞ্চল, অনুধ্যান ও একটি নিবিড় আয়োজনে পাঠের পর পাঠকের এরকম উপলব্ধি হবে বলে আস্থা রাখা যায়।

 

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *