কিশোরী বয়েসে সুরভি’র রূপ একটু বেশিই ছিল। তখন তার বাড়বাড়ন্ত শরীরের দিকে সকলের নজর পড়ত। অমন রূপের কারণেই কম বয়েসে সুরভি’র বিয়ে হয় তার এক জ্ঞাতি ভাই হরমুজ আলীর সাথে। হরমুজ আলী অবস্থা বেশ ভালো হওয়া সত্ত্বেও একরকম জোর করে সুরভিকে বউ করে ঘরে তোলে।
বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সুরভি পোয়াতি হন। দিন পড়ে আসার আগেই আট মাসে সুরভি এক কন্যা সন্তান প্রসব করেন। বিড়ালের ছানার মতো ছোট্ট দুর্বল বাচ্চা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বাচ্চা কাঁদল না। সবাই হতাশ হলো। ভাবল সুরভি মৃত সন্তান প্রসব করেছে। ওদিকে মায়ের অবস্থা আরও খারাপ। মাকে নিয়েই সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বাচ্চা বাঁচার আশা সকলে ছেড়ে দিলেও সুরভি’র শাশুড়ি আশা ছাড়লেন না। অনেক চেষ্টা চরিতের পর বাচ্চা চিঁচিঁ করে কাঁদল।
জন্মের পর নাতনি মরমর অবস্থা দেখে সুরভি’র শাশুড়ি নাতনির নাম রাখলেন ‘পুটি’। ভারী ফেলনা নাম। ইচ্ছে করেই এমন নাম রাখলেন, যাতে নাম শোনেই যমের অরুচি হয়। আল্লাহ সহায় অথবা যমের অরুচিতে পুটি বেঁচে গেল। শাশুড়ির যত্নে আদরে মা-মেয়ে দুজনই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল।
একটু চোখ ফুটতেই সকলে দেখল পুটি ভারী দেখতে হয়েছে। মায়ের গায়ের রং আর বাপের মতো বড় বড় চোখ। ভ্রমর কালো চোখে পানি টলমল করে যেন ভালোবাসার ঢেউ লাগলেই জল উপছে পড়বে। কেমন মায়া মায়া চেহারা।
পুটি জন্মের পর সরভি’র স্বামী হরমুজ আলী সুরভিকে ডাকেন ‘পুটির মা’ বলে। তারপর শাশুড়ি ফুলজান বেওয়াও ডাকেন নাতনি পুটির নাম ধরে ‘পুটির মা’ বলে। ক্রমে পাড়া প্রতিবেশি সকলেই ‘পুটির মা’ বলে ডাকতে আরম্ভ করল। অত সুন্দর ‘সুরভি’ নামটি ‘পুটির মা’ নামের আড়ালে ক্রমশ হারিয়ে গেল।
পুটি যত বড় হয় রূপ যেন ধরে না। তার দাদি হাসেন আর বলেন, পুটি মায়ের পেট থেকে সব রূপ চুরি করে নিয়ে এসেছে। সুরভি মেয়ের মাথায় থুতু ছিটায় আর বলে, আম্মা অমন করে বলবেন না। আফনের নাতনির নজর লাগবে তো।
বুড়ি শব্দহীন হাসে। আনন্দে তার চোখ ছলছল করে।
দুপুর বেলা হরমুজ আলী মাঠ থেকে ফিরে এসে গলা ফাটিয়ে চেঁচায়, কই গেলে গো ‘পুটির মা’।
সুরভি কথা বলে না। স্বামীর মুখে ‘পুটির মা’ ডাক অন্যরকম শোনায়। নামের শেষে ‘মা’ ডাকটি শুনতে তার বেশ লাগে ৷
প্রকৃতির নিয়মে জননীসত্তা ধীরে ধীরে সন্তানের মাঝে লীন হয়। দিনের সব কোলাহল মিলায় রাতে আঁধারে। জন্ম মিশে যায় জন্মান্তরে। শান্ত দুপুরে শিমুলের ডালে ঘুঘু ডাকে আপন মনে ‘ঘুঘুর ঘু, ঘুঘুর ঘু’।
One Comment
[…] মোস্তফা খান – পুটির মা […]