অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ২৭, ২০২৪
১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
জুলাই ২৭, ২০২৪
১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভীষ্মদেব সূত্রধর  -
এক কোণে একাকিত্ব

সম্ভবত পশ্চিম দিক হতে শোঁ-শোঁ ঝপঝপ শব্দ ধেয়ে আসছিল আরও নিকটে, সামিরা বুকে কাপড় দিয়ে বলল, ভাগ ঝর আসতেছে।

যে যার মতো আল ধরে উত্তরে দৌড়তে থাকল। ততক্ষণে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি সবাইকে ভিজিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মাঠের একেবারে গোড়ায় একটা বাড়ি ছিল তারি বারান্দায় সকলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনোরকম গা বাঁচাল। একটা ছাপড়া ঘর ছোট্ট তার বারান্দায় দাঁড়ালে ছাঁট আসে, দুটো কচি শিশু বছর তিনকের, চারটে দশ-এগারো বয়সের বালিকা, দুটো শক্ত পুরুষ, একজন চব্বিশ বয়সী যুবক আর দুটো যুবতী নারী আশ্রিত। প্রকৃতির রুদ্র রূপ সুপারি গাছগুলোকে নাস্তানাবুদ করছে, বজ্রনিনাদ আর সব কাঁপিয়ে বৃষ্টি পড়ছে তুমুল, গেরস্ত নারীটি অবাক হয়েছিল কিনা তাতে কেউ চোখ রাখেনি, বারান্দায় টিকতে না পেরে ঘরে প্রবেশ করল একে একে, অন্ধকার ঘর একটাও জানালা নেই, চালের ফুটো দিয়ে অবিরাম জল পড়ছে, গেরস্ত নারীটির বয়স ঠাওর করা যায় না, সে ফুটোগুলোর নিচে বালতি জগ দিয়ে অনাহূত অতিথিদের সমুখে লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করছে, মেঝেতে শ্রমিকদের ভাতের গামলা তরকারির বাটি ডালের ভাঁড়া এক কোণে, ছোট শিশু দুটি মেঝেতে বসে কীসব খেলছে আর কথা বলছে বোঝা যায় না। গেরস্ত নারীটি চেয়ার টুল পিঁড়ি এগিয়ে দিয়ে সকলকে বসতে বলে ঘরের এক কোণে গোটানো বিছানায় বসে রইল। শিলাবৃষ্টির শব্দে বিভোর প্রকৃতি। বিভাস ও দেনো অর্থাৎ শক্ত পুরুষ দুটি বিড়ি জ্বালিয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন আলাপ সারছে। আর ওই যুবকটি নিত্যগোপাল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একমনে কত রাজ্যের কথা ভাবছে সেই জানে। বাকিরা সবাই গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। বাজার থেকে বেরোবার পর যে তেমাথাটা রাস্তাটি পাই তার উত্তরের একটি রাস্তা কিলোখানেক পথ পরে রাস্তাটি দুভাগে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে, একটি সড়ক চলে গেছে দূর কোনো শহরে আরেকটির পেট চিরে বেরিয়ে এসেছে চেকন রাস্তা যেটি আবার তেমালা গ্রামের বাইরে দিয়ে মিশে গেছে কান্দাইলে। যে বাড়িটিতে সকলে দৌড়ে গিয়ে উঠেছে সেটি গাঁয়ের উত্তরে শেষ বাড়ি ফসলি মাঠের পয়লা বাড়ি। ঝরাতঙ্ক কেটে গেলে সামিরা উচ্চস্বরে বলল, তোমাদের ভাত দেব?

বিভাস বলল, আরেকটু দেখি। বাচ্চা কটাকে দিয়ে দাও।

ঝরে দুটো বেড়া বাইরে পড়ে গেছে, গেরস্তি তাই বলল এবং মৃদু হাসল। নিত্যে ফিরে তাকাল ভাবল, হেসে কী লুকোচ্ছে সে। এ কী হাসবার! গেরস্তি আবার বলল, গরিবের বাড়ি বাপু।

পলি বলল, আরে না না। দিদি আপনি টেনছান কইরেন না।

সামিরাও সায় দিল। বাচ্চা দুটো ও বালিকা চারটে খেয়ে পাথর নকরি খেলছে। ঝড় থেমেছে তবে বৃষ্টি বেড়েছে, কপালে চিন্তার ভাঁজ কপালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দেনোর। চোয়াল শক্ত করে কিছু বলতে চাইল তারপর বিড়িতে টান মেরে বিভাসের কথায় হারিয়ে গেল। নিত্য যার বিঘে চার জমিতে এবার নাবী আলু উত্তোলন করছে, আকাশ ভালো থাকলে তাকে দুই গাড়ি মাল পৌঁছে দিতে হবে হিমঘরে। ও খুব একলাবোধ করছে আজ সাথে ঠাণ্ডাও লাগছে। এমন একলা বোধ আজ কদিন হলো খুব অনুভব করছে। ভিড়ের মাঝেও যে একলা লাগে সে কি জানত! একটা ছেঁড়া আলোয়ান হলেও মন্দ হতো না। জীর্ণ এই কুটিরে আজ প্রকৃতির কেত্তন, শ্রমিকদের অনুভূত আশঙ্কা মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে, সে তো কৃষক নয় বোধহয় ব্যবসায়ীও নয়। দায় একটা ঘাড়ে চেপেছে এই যা। কীসের দায়? সে না হয় আরেকদিন বলব। বৃষ্টি কমলে সামিরা ঘর থেকে বারান্দায় বেরোয়, বাইরে ঘরের কোণ ঘেঁষে একটা পরিত্যক্ত কলের পার আছে যা পলিথিন দিয়ে বেড়া দেওয়া, দরজা নেই, এক পাশে খোলা বাকি তিনপাশে ভাঙা আর ছেঁড়া বেড়া, তাতেই সামিরা পাছার কাপড় সরিয়ে পেচ্ছাব করছে, অনাবৃত নিতম্বে টুপটুপ জল পড়ছে গড়িয়ে, নিত্য দেখল সামিরা বসে আছে, বাতাসে বুকের কাপড় সরে যাচ্ছে, ব্লাউজের ফাঁক গলিয়ে দুটো পুরুষ্ট স্তন বেরিয়ে আছে, লজ্জায় রাঙা হওয়ার কথা ছিল অথচ হলো না নিত্য, কতবার ওর কথা ভেবে হস্তমৈথুন করেছে! হ্যাঁ সামিরাই তো একবার লুকোচুরি খেলবার সময়ে বাড়ির পেছনে নিত্যকে তার যোনি দেখিয়েছিল, হ্যাঁরে নেতু, তুই কখনো নেংটো মেয়ে দেখেছিস?

নিত্য বলেছিল, সাবলিকে দেখছি দিদি।

—হিহিহি। বড় মেয়ে গাধা।

তারপর ফিতে খুলে দেখিয়েছিল, বলেছিল তোরটাও দেখাস।

তারপর মা’র ডাকে সামিরা দৌড়ে গেছিল বাড়ি। ক’বছর পরেই বিভাসের ঘর করতে ছুটতে হয়েছে তাকে, প্রেম করে বিয়ে হয়েছিলো যে ওদের। সামিরা সে সব ভুলে গেছে নিশ্চিত। ভুলে যাওয়াই সমীচীন। শৌচ সেরে নিত্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আয় ভাত খা। ওদের দিছি।

এই অন্ধকারেই গিলছে দেনো বিভাস পলি। নিত্য পেছন ফিরে তাই দেখল। বলল, আমার খিদে নেই দিদি।

সামিরা আর কিছু বলল না, বোধহয় খিদে পেয়েছে তাই মেঝেতে বসেই ভাতের গামলাটা তুলে নিল। বিভাস খাওয়া সেরে পানের বাটি থেকে একটা পানে চুন লাগিয়ে কাঁচা সুপারির চার ফালির এক ফালি তাতে দিয়ে এগিয়ে দিল নিত্যর দিকে। নিত্য খিলি পাকিয়ে মুখে পুরে চিবোতে থাকে, বিভাসও তাই করে, পানের খিলিটা মুখের এক পাশে নিয়ে বলে, অত চিন্তা কইরো না, মেঘ ছাড়লে বস্তা ভরব।

বাতাস আবার চড়াও হয়, বাইরে ভেজা আঙিনায় উড়ে আসা ডাল-পাতা আমের মুকুল ছড়ানো, বাইরের পথে জল লেগে আছে যত্রতত্র। তবে শুধু বাতাস বইছে বৃষ্টির আর মাতম নেই। বালিকা চারটে উল্লাসে বেরিয়ে আসে, সামিরা পলি ওরাও। দেনো আকাশ নিরীক্ষণ করে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। বিভাস একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসে, নিত্য কাদা চেপে উঠোন থেকে বেরিয়ে সামিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমরা এগোয় আমি নছিমন নিয়ে আসছি।

এক পা দু পা করে দক্ষিণ দিকে চলতে থাকে চেকন রাস্তাটি যার পেট থেকে বেরিয়েছে তার দিকে ধীরে ধীরে। একা বড্ড একা লাগছে তার, শরীরে মগজে কর্মে, ঝরের মতো ধেয়ে আসছে একাকিত্ব। গাঁয়ের এক কোণের ওই বাড়িটি আবার নিদ্রাতুরভাবে বসে থাকে কালের চিহ্নে… গেরস্তির খবর কেউ রাখেনি। কে বলেছিল দিদি আসি!

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *