টঙের ওপর বসে থেকেই সিরাজুদ্দি লক্ষ করল আশ্বিন-কার্তিক মাসের ম্যাড়ম্যাড়ে রোদের মতো লোকটা এগিয়ে আসছে এদিকে। মুখে কোনো কথা নেই, চোখে কেমন একটা পেলবতা। কী চায় লোকটা ওমন করে, কে জানে। সিরাজুদ্দি চিৎকার করে প্রশ্ন করতেই, লোকটা জানতে চাইল, ফজরালী মুন্সীর বাড়ি কোন দিকে…।
ফজরালী মুন্সীর নাম শুনেই খানিক টানটান হয়ে যায় সিরাজুদ্দি। কে হতে পারে মানুষটা। যে কিনা তার বাপের খোঁজ করছে, গ্রাম তো এখন দিনকে দিন লাফিয়ে লাফিয়ে কেমন বদলে যাচ্ছে। আর গ্রামের মানুষগুলোও সে আর আগের মতো নেই। সহজ সোজা কেতাদুরস্ত ধরনের নরম স্বভাবের মানুষেরাও দিন দিন পালটে গেছে, পালটে যেতে চায়। শহর আর গ্রামের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে অনুমান করা যায়। গ্রাম বলে হয়তো কিছুই থাকবে না, সবই শহর হয়ে যাবে, চাকরিজীবী মানুষের মাথা গোঁজার আশ্রয় যাকে বলে আর কী!
আগন্তুক অকস্মাৎ বলে ওঠে, আমি রহিম বক্স, ফজরালী ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি…।
সিরাজুদ্দি টঙের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই আছে, শুধু রহিম বক্সের দিকে তাকিয়ে মনে-মনে বলল, আজকাল তো মানুষজন বিনা কারণে আসে না, কোনো ধান্ধা ছাড়া কি কেউ সময় নষ্ট করে, বাবা! তারপর বলে, আমি ফজরালীর ছেলে…।
আগন্তুক যেন হাতে স্বর্গ পেল, সময় মতো বৃষ্টি হলে কৃষকের মুখ যেমন আনন্দে ভরে ওঠে, রহিম বক্সের চোখ মুহূর্তে যেন সেভাবেই জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। কিছু বলতে গিয়েও বলতে কেমন বাঁধো-বাঁধো। দূরের মাঠের সবুজ ধান লকলক করছে, আর কয়েকদিনের মধ্যেই ধান কাটা হবে, মাড়াই হবে। ধান মানে তো প্রাণ কৃষকের প্রাণ! আশপাশের জমিগুলো শহরের বড়-বড় প্রমোটর আর শিল্পপতিদের হাতে বন্দি হয়ে গেছে এরই মধ্যে। খুব ঘন-ঘন সীমানা প্রাচীর বা ভাগের পিলার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ঝলমল করছে প্রতিনিয়ত চোখের ওপর বিশাল-বিশাল সাইনবোর্ড। চারদিকে শিল্পকারখানা হবে, দীর্ঘমেয়াদি হাইরাইজ প্রাসাদ উঠবে, নতুন সিটি পা ছড়িয়ে বহুদূরের মানুষকে ডেকে আনবে। এসো অতিথি এসো… এসো অতিথি এসো… পা ছড়িয়ে আয়েস করে হেথায় বসো…
আগন্তুক বেশ সহজভাবেই বলে, তোমার বাপের সঙ্গে বিশেষ জরুরি কথা আছে, মানে গুরুত্বপূর্ণ কাজে এসেছি কিনা।
সিরাজুদ্দি সরাসরি সংক্ষেপে জানায়, বাপে ঢাকা-ফাঁকা কোথাও গেছে, আমাকে বলতে চাইলে বলে ফেলেন!
—না কথা হচ্ছে, তোমার বাপে যে জমি দেখিয়েছিল, সেটা কিনতে চায় তো…
—কিনতে চাইলে কিনবেন। এদিকেই মানুষ এখন ছুটে আসছে।
—হ্যাঁ সিটি কর্পোরেশন বৃদ্ধি হচ্ছে, জমির টান পড়বে।
—তা কতখানি জমি নেবেন আপনারা?
—আমরা মানে প্রমোটরের সহকারী আমি, এখানে বৃহৎ পরিকল্পনা আছে কিনা!
—ও আচ্ছা পানির দরে ওই পানির ভেতরের জমিগুলো কিনবেন। তারপর প্লট-ফ্ল্যাট করে আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি করবেন দূরের ওই সমস্ত উঠতি ধনিকের কাছে…।
—হ্যাঁ-হ্যাঁ ঠিক বলেছ বাবা, ঠিক বলেছ!
—ঠিক তো বলবই, জমি কেনা লোকদের খুব চেনা আছে আমার। ওরা সাপের পাঁচ পা দেখে, আবার রাত্রের জ্যোৎস্নার সঙ্গে বেনোজলে হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
—হ্যাঁ-হ্যাঁ ঠিক বাবা ঠিক বলেছ বটে…।
সিরাজুদ্দি টঙের ওপর বসেই বলল, আপনি কি জানেন এদিকের জমি সবই বেওয়ারিশ খাস জমি। শুনেছি অবাঙালি আর হিন্দু জমিদারদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি নাকি। কোনো কাগজপত্রও নেই তেমন। যে যেমন পারে ভোগ করছে শক্তি খাটিয়ে। এ জমির জন্য যুগ-যুগ ধরে অনেক মারদাঙ্গা-খুন হয়েছে, মামলা-মোকদ্দমা তো লেগেই আছে। এখনো কত লোক জেলের ঘানি টানছে, তারপরও কেউ জমির অধিকার ছাড়বে না… হে হে হে হে…।
রহিম বক্স কিছু শুনল কিছু শুনল না। কিন্তু চোখ চড়কগাছে উঠল তার। শুনেছিল নিষ্কণ্টক জমি, কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই। এখন তো পুরো প্রেক্ষাপট পালটে যাচ্ছে। সত্যিই মানুষ চেনা অনেক কঠিন। গিরগিটির রূপ এভাবেই বদলে যায়, মানুষ শালা গিরগিটি তাহলে। রহিম বক্স খানিক উত্তেজিত হলেও নিজেকে সামলে নেয়, এখানে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। ফল উলটে যেতে পারে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে। জমি-জমা কেনার দিকটা প্রমোটর তাকেই দিয়েছে, তারপরও সবদিক বিবেচনা করে চলাও বুদ্ধিমানের কাজ। প্রাথমিক পর্যায়ে সেই দেখভাল করে বরাবরই, কিন্তু ফজরালী মুন্সীর ছেলের কথা শুনে মাথার তার যেন ছিঁড়ে গেল ওর।
একসময় রহিম বক্স বলে ওঠে, শোনো বাবা ওসব ঝুট-ঝামেলা কোনো ব্যাপারই নয় আমার মালিকের কাছে। তবে তোমার বাপে বলেছিল নিষ্কণ্টক জমি। যাক তোমার বাপ আসলে আমার কথা বলো…।
সিরাজুদ্দি টঙ থেকে লাফ মেরে নেমে বলল, শুনেন-শুনেন কথা আছে, আমার হাতে বেশ কিছু নিষ্কণ্টক জমির খোঁজ আছে…।
রহিম বক্স হাতে যেন চাঁদ পেল এমন দশা হলেও নিজেকে কঠিনভাবে সংবরণ করে বলল, তোমার হাতে তোমার হাতে আছে বাবা?
—হ্যাঁ আছে তো বস, কিন্তু আমাকে কমিশন কীভাবে দেবেন, সেটা খোলাসা করে বলেন দেখি।
—আহা তা হবে না কেন, কেনইবা বলব না পরিষ্কার।
—জমি মানে জমিদারের ফেলে যাওয়া বাড়িসমেত জমি। কবে কোনকালে জমিদার চলে গেছে এখন তো কেউই থাকেও না, দেখেও না…।
—বেশ-বেশ ওসব কোনো বিষয়ই নয় বাবা, কতো জমিদার বাড়ি রাজবাড়ি আমরা পানির দরে কিনেছি… হে হে হে হে….।
—তাহলে তো হয়েই গেল, আরেকদিন সময় বুঝে আসবেন, নিয়ে যাব, একেবারে সরেজমিনে দেখবেন…।
রহিম বক্স আমোদে গদগদে হলেও কোথায় তার একটা অন্যরকম ইঙ্গিত বেশ লক্ষ করে। ছোড়াটা অন্য কোনোভাবে আবার ফাঁসাবে না তো! আজকালকার ছেলে-ছোকরাদের বিশ্বাস নেই। মুখে একটা বলে কাজের বেলায় আরেক ধান্ধা। মনের মধ্যে একটা কী যেন কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে ফিরে যায় সেদিন।
সিরাজুদ্দি মনে মনে বেশ আনন্দ পায় লোকটার কেমন-কেমন ভাব দেখে আর বোকা-বোকা কথা শোনে। এ’ লাইনে বেশ পাকা ষোল মাছ হলেও এখনো সে ভাবে ধুরন্ধর হতে ঢের সময়। সিরাজুদ্দি ভাবে লোকটাকে কঠিনভাবে শাস্ত্রে করা দরকার। পানির দরে জমি নেবে! রাজবাড়ি-জমিদার বাড়ি কিনবে শালা! তার বাপের মতো খটকাবাজ বা পটকাবাজ ঘোরাল ফজরালী মুন্সী গ্রামে আরো হয়তো আছে, কিন্তু সিরাজুদ্দি তাদের মুখোশ খুলে দেবে।
উদার আকাশ সবুজ ধানখেত বাঁশঝাড় পরিত্যক্ত সম্পত্তি খাসজমি সব উজার হয়ে যাচ্ছে প্রমোটরের কাছে, শহর হচ্ছে, আসছে দিন সোনায় মোড়ানো… আহা কী আনন্দ! জলাশয়-নয়ানজুলি খাল-বিল খানা-খন্দর হাওর সমস্ত নিঃশেষ করছে একশ্রেণীর ভূমিদস্যু-ভূমি লুণ্ঠনকারী। আর এদের কারণে বাতাসে আজ বিষ। মানুষ বিষে বিষে বিষাক্ত হয়ে মরছে দিনকে দিন প্রতিদিন প্রতিনিয়ত।
সিরাজুদ্দি মনে মনে হাসে। এবার ঠিকঠিক শিক্ষা দেবে মোক্ষম একটা। শহর বাড়বে মানে জমির টান। জমির টান মানে জলাভূমি-খাসজমি যা পাও সামনে সমস্ত দখল করো। দখলের ঘোড়া ছুটছে দিকবিদিক। দখল না হলে পকেট ভরবে কেমনে। সিরাজুদ্দি ভাবে তার বাপে তো পুরো নষ্ট মানুষদের দখলে, তাকে ফেরানো যাবে না। কারণ তাকে দখল করে নিয়েছে দখলদারেরা। পারলে সে বউ-বেটিকেও বিক্রি করে দেবে। বরং দেশপ্রেমের জন্য তাকেই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। জমির ভেতর যে মেঠো ইঁদুর থাকে, তাকে ছলে-বলে ধরে উচিত শিক্ষা দেওয়া যেমন সঠিক কাজ, তেমনি রহিম বক্সের মতো রক্তচোষা মানুষদের মোক্ষম শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
বিশাল শূন্য মাঠে দাঁড়িয়ে সিরাজুদ্দি ভাবে অনেক কথা। এখানে নগর জেগে উঠবে, ধানের চারা-বীজতলা-ধূধূ ধানের উদার জমিন কোথায় তলিয়ে যাবে। পাখিদের আবাস থাকবে না, গাছ উজাড় হবে, দখিনা বাতাস বন্ধ হবে চিরকালের জন্য, তখন মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে দাঁড়াবে। কে দেবে আশ্রয় কে দেবে সান্ত্বনা। কে সুরেলা গানে মন রাঙিয়ে দেবে। দেশ কালের সমস্ত ঐতিহ্য নাকি ভূমিদস্যুদের কাছে পরাজিত হয়ে ইতিহাস হয়ে যাবে। গড়ে উঠবে বিশাল-বিশাল অট্টালিকা। উঠতি টাকাওয়ালাদের আশ্রয়স্থল। একশ্রেণির ভদ্র পোশাকের রঙিন মানুষের আবাস। মানুষ কি বাজপাখি হবে, মানুষ কি শকুন হবে… মানুষ তাহলে কি হবে… মানুষের পৃথিবীতে আজ মানুষই অন্য এক জীবে পরিণত হতে যাচ্ছে। কে ঠেকাবে, যে যাচ্ছে সে যাবে, তাকে আর ঠেকানোর কিছু নেই।
সিরাজুদ্দি ফলিয়ার বিলে সেদিন কথাটা বলল ময়েজ ওঝাকে। চাচা তোমার এবার ওঝাগিরি নিপাত যেতে বসল বুঝি…
—কেন বাপ, কী হলো…
—আর হবে কী, ভূমিদস্যূরা যেভাবে বিল-হাওর নয়ানজুলি দখল করতে চাইছে, একদিন যে আমরা কোথায় থাকব!
—সঠিক কথা ব্যাটা, তোর বাপও তো ওদের সাথে পা চালিয়ে হাঁটে…
—হ্যাঁ-হ্যাঁ ওইখানেই তো সমস্যা চাচা, কিন্তু আমরা কিছু একটা করতে…
—কী করব… আমরা ঠেকাব…
—না না তাই বলছি ঠেকানো তবে সংঘবদ্ধ হয়ে… ভূমিদস্যুদের আমরা রুখব।
—ওদের টাকা আছে ক্ষমতা আছে ষণ্ডাগুণ্ডা লোকও আছে, আমরা পুঁটিমাছের প্রাণ নিয়ে কতটুকু টিকতে পারব।
—কথা তো ওইখানেই ফিনিস, কিন্তু ফিনিস হওয়ার আগে দু’চারটেকে সাবড়ে দেব। দেখে নিয়ো বলে দিলাম…
—বাপ একলা মাথা গরম করিসনে…
সিরাজুদ্দি বড় বড় কদম ফেলে নটের বিলের ধার ধরে উত্তরের ঘন বাঁশঝাড়ের সরু সড়ক দিয়ে কোবরা চেয়ারম্যানের পানের বরজের ভেতর হারিয়ে গেল। আর ওকে দেখা না গেলেও আন্দাজ করা গেল সে আসলে প্রচণ্ড ক্ষেপেছে আজ। ময়েজ ওঝা কিছুসময় সেদিকে তাকিয়ে তারপর বিষ্ণুপুরের খাঁড়ি জমিটার দিকে যেতে থাকে। মুখে বিড়বিড়িয়ে কী বললেও বোঝা গেল না তেমন কিছুই। কোমরপুরের সাপে চলা সড়ক ধরে নন্দীবাড়ির মেয়েরা কোথায় যেন যাচ্ছে, দিনকে দিন ওরা কমে যাচ্ছে, কোথায় যায়…।
সন্ধ্যার পরপর সাত অঞ্চলে একটা খবর ছড়িয়ে যায় শালজোড়ের বিলে নাকি মানুষের লাশের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে। লাশের গন্ধে শিয়াল-শকুন যেভাবে ছুটে আসে তেমনি করে মানুষের ঢল নামে সেখানে। কোথা থেকে মানুষের লাশের কঙ্কাল এল, কার লাশের কঙ্কাল, কীবা তাদের পরিচয়, এমন সব মোক্ষ মোক্ষ কথা মানুষের ভেতর প্রচার হতে থাকে। সত্যিই লাশের কঙ্কালগুলো নিয়ে গবেষণা তো হতেই পারে। আসলে কীভাবে বিলে এল এত কঙ্কাল। কেউ মেরে কেটে ফেলে রেখে গেলে দু’ একটা হতে পারে, কিন্তু এত এত কীভাবে সম্ভব! কে জানে এর হদিস! কিন্তু কঙ্কাল পাওয়া গেছে, মানে আরও আরও পাওয়া যাবে। শত শত নাকি হাজারে-হাজারে মানুষ সেখানে পড়িমরি করে এসেছে, মানুষের জানার ইচ্ছে তো চিরকালের। সে জানতে চায়, তাকে জানতে দিতে হবে। তার অধিকার। কেউ হয়তো বিশ্বাস করতে নাও পারে, সেও এসেছে সরেজমিনে দেখতে। লোকের মুখে প্রচার পেতে পেতে খবরটা এতখানিই ছড়িয়েছে যে জাতীয় পর্যায়ে ঠাঁই পায় এবং তারপর জাতীয় পত্রিকায় পৌঁছে যায়। মানুষের কঙ্কাল মানে তো বিশাল ব্যাপার। রহস্যটা কালো ঘনায়মান অন্ধকারের মতো জটিল হতে থাকে, তারপর এলাকার লোকে সেলফি তুলে আরও রহস্যময় করে তোলে।
শহর থেকে নেতা-ছাতা সবাই পড়িমরি করে ছুটে আসে, আসতেই থাকে। ঘটনা কী সবাই জানতে এবং জানাতে ব্যস্ত! যে দেশে কুত্তা মরলে খবর হয়, সাপে কাটলে খবর হয়, নদীতে হরিয়াল বা কুমির দেখা দিলেও বড় বড় অক্ষরে খবর হয়। নাক কাটা নাকি কান খাড়া রহিস পুলিশের কাস্টডিতে রাজার হালে থাকে, তাও খবরের শিরোনাম। মহিলা সেলিব্যাটিরা দিনে ক’বার গোসল করে তাও বিনোদন, কোন নায়িকা কতোজন ধনকুবেরের শয্যাসঙ্গী হলো সেটা তো সুপার সেক্সি বিনোদন, এমন রসাল খবর ছাপলে যুবসমাজ পত্রিকা তো কিনবেই, পাশাপাশি অনলাইনে নিউজটা বেশ খাবে পাঠক। মাস্টারবেশনের মতো মোক্ষম বিনোদন জাগ্রত হবে। অর্থাৎ এমন খবরের জায়গায় মানুষের লাশের কঙ্কাল তো চাট্টিখানি বিনোদনের বিষয় নয়। একেবারে তাজা খবর! জাতীয় পত্রিকাওয়ালারা আসতেই থাকে শালজোড়ের চারপাশে। তাদের পর্যবেক্ষণ আর শেষ হয় না। হাজারো তথ্য অন্সেসনে মাঠে নেমে যায়। স্থানীয় প্রশাসন আইন-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাজনিত কারণে পুলিশ পাহারা বসায়। তিন/চার স্তরবিশিষ্ট চৌকি বসে যায়।
বড় বড় হোমড়াচোমড়া মানুষের আগমনে শালজোড় হয়ে ওঠে লোকে লোকারণ্য। অনেক অনেক মতামত-চেতনা চিন্তা আইডোলজি-সাইকোলজি কাজ করে এখানে এসে। এত এত লাশের কঙ্কাল, কঙ্কালের রহস্য উদঘাটন করা অতি জরুরি। মাটির ভেতরে মানুষের কঙ্কাল এতকাল সঞ্চিত ছিল, দেশ-বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এমন রহস্যজনক সংবাদ। এমন সংবাদ একদিন আবার জাতীয় সংসদে উত্থাপন হয়। মাননীয় সংসদ সদস্য মহোদয়রা কেউ কেউ তড়িঘড়ি ছুটে আসে সংবাদের প্রথম পেজে স্থান পাওয়ার বাসনায়। অনেক চেতনাবাহী জীবের স্পর্শ পায় এলাকার লোকে। ধন্য ধন্য করে নিজেকে, এমনও দিন আসবে ভাবেনি কেউই।
সাত তল্লাটের লোকে বা গণ্য-মান্যরা একবাক্যে বলে, একাত্তরের শহীদ সন্তান এরা, অনাবিষ্কৃত ছিল এতকাল। শালজোড় দিঘির ভেতর বর্বর হানাদার বাহিনী বাঙালী বীর সন্তানদের…।
সুন্দর-সুন্দর আগন্তুকরা মাথা চুলকে তারপর নাকের নিচে চশমা রেখে মাথাটা আবার ঝুলিয়ে সাঁই দিল, কি বীভৎস কাণ্ড এখানে ঘটেছে। তাহলে…।
—কতজন মেয়েমানুষ আর কতজন সংখ্যালঘু হবে কে জানে…
—এখানে সবাই সংখ্যালঘুই হবে…
স্থানীয়রা কেউ-কেউ বলে, আমরা তো কস্মিনকালেও জানতাম না, হায় রে মাবুদ দুনিয়ায় কত কিছু অজানা রয়েছে আমাদের…
চেতনাওয়ালা এক বুদ্ধিজীবী জানায়, আপনারা সহযোগিতা করলে ওপর মহলে আলোচনা করে সম্পূর্ণ এলাকাটা একোয়ার করা হবে। এখানে বধ্যভূমি ছিল তা স্পষ্ট… আপাত পুরো জায়গা মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্যাক্স-এ অর্পিত হবে… তারা যাদুঘর করুক বা সংরক্ষিত ভূমি কমিশনের আওতায়…।
ময়েজ ওঝা হাবাগোবার মতো চেহারা করে মশারবিলের রঘু প্রামাণিক এবং রক্ষিতপাড়ার পুরোনো মানুষ আনারুল মাস্টারকে বলল, বুঝতে পারনু না গে… কোন দিকের পানি কোন দিকে চলে গেনু…
আনারুল মাস্টার চোখের ভারী পাওয়ারের চশমাটা মাথায় তুলে উত্তর দিল, বধ্যভূমি মানে তো আরেক তেলেসমাতি, আমরা এখানে থাকতি পারব তো…
মুখজব্বর ফাজেল কর্ণহারের নারায়ণের কানে-কানে কী যেন বলছিল, মুহূর্তে নারায়ণ বলে ওঠে, এতকাল হিদুদের উচ্ছেদ করেছিল, এখন দেখ মুসলিমদেরও তাড়াবে একশ্রেণির মানুষ। এরা এবার জমি-জিরাত আত্মসাৎ করবে।
ফজরালী মুন্সীর ছেলে সিরাজুদ্দি সেদিনও নটের বিলের ওধার দিয়ে মোহনদের পানবরজের ভেতর ঢুকে বাদলে আর দিলবুর কামলাকে ধমকাচ্ছিল। ফজরালী মুন্সী লালগোলার দিকে নতুন ডেরা বেঁধেছে, কয়েক সপ্তাহ কোনো খবর নেই তার। সিরাজুদ্দি এখন তামাম তল্লাট চষে বেড়াচ্ছে, মুখে কোনো কথা না বললেও ফজরালী মুন্সীর বেটা জানে মানুষকে কীভাবে জব্দ করতে হয়। বিষ্ণুপুরের রজবালী একদিন বিমর্ষ হয়ে জানাল, এত কঙ্কাল এল কীভাবে… মানুষের লাশের এই কঙ্কাল এতকাল ধরে…
সিরাজুদ্দি কোনো উত্তর দেয় না। ওর বাপ ওপারে গিয়ে নতুন সংসার সাজিয়েছে, বুড়ো বয়সের ভিমরতি যাকে বলে আর কী! বিয়ে তো এখানেও করতে পারত কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে ভিনদেশে কেন… কোনো উত্তর পায় না। মানুষের ভাবগতিক বোঝা সত্যিই বড় কঠিন।
সিরাজুদ্দি ভাবে এবার তাকে নতুন চালে চলতে হবে। একেবারে নতুন ভাবনা মাথার মধ্যে কেমন কিলবিল করছে তার। মাথা থেকে বের না করতে পারলে স্বস্তি নেই মনে। বুকভরে শ্বাস নিলেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় গোপনে, যার কোনো ভেদ বা উৎস নেই। কর্পূরের মতো হাওয়ায় উড়ে যায়। উড়তে থাকে উড়তেই থাকে… ধূসর রঙা কাক দেখে হয়তো ময়ূর বা চিল মনে হলেও আসলে যে কাক তাকে নতুন করে চেনার আর কী অবশিষ্ট থাকে। কাক হয়তো কাকের মতো থাকে, তাকে কাক বলে মানুষ চিনলেও কাক কখনো আবার দাঁড়কাক হয়ে ওঠে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাক তো কাকই থাকে। সুভদ্র ধূসর ছাইরঙা মায়াবি অবয়বের কাক… অনেক দূরে গেলেও আবার ফিরে আসে চেনা-জানা পরিচিত পরিবেশে। মানুষের কাছাকাছি মানবিক লোকালয়ে। নাগরিক সময়ের শার্শিতে।