অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
জুলাই ৬, ২০২৫
২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
জুলাই ৬, ২০২৫
২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সৈয়দ নূরুল আলম -
দ্বিখণ্ডিত বিকেল

দিনের আলো মরে এসেছে। একটু পরে জানালার ওপাশে বিকেল নামবে। এইমাত্র রুবী রুম থেকে বের হয়ে গেল। ওকে হাসান আজ আপনি থেকে তুমি বলেছে। একত্রে বসে দু’জনে ড্রিংক করেছে। শূন্য দূরত্বে এসেছে কিনা হাসান তা মনে করতে পারছে না। প্রথম দিন, বেহিসেবি হয়ে ও একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিল।

ইদানীং মেয়েরা অফিসে নানা কিছু বিক্রয় করতে নিয়ে আসে। কখনো মোটা মোটা দেশি-বিদেশি বই, কখনো কসমেটিক্স। কখনোবা শাড়ি, থ্রি পিস। অফিসের মেয়ে কলিগরা বেশ উৎসাহ নিয়ে এসব কিনে থাকে। ভাসমান বেচা-কেনা। শো-রুমের দরকার হয় না। কর্মচারী নেই। ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয় না। স্বাভাবিকভাবে এসব জিনিসের দাম কিছুটা কম থাকে। এতে করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের লাভ।

বনানী পনেরো নম্বর রোডে টাচ অ্যান্ড ফেয়ারের অফিস। এরা বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি করে। বছর পাঁচেকের মধ্যে ভালো একটা মার্কেট পেয়েছে। প্রথমে একতলা-দোতলা মিলিয়ে অফিস ছিল। এখন তিনতলাটাও অফিস হিসেবে নিয়েছে। হাসান ভাবছে, আগামী দু’বছরের মধ্যে পাঁচতলা পুরো বাড়িটা-ই অফিস হিসেবে নিতে পারবে।

হাসান এ অফিসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। ডিরেক্টর অ্যাডমিন ও ফাইন্যান্স। ওর ওপরে আছে মল্লিক সাহেব। এ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এ দু’জনই কোম্পানিকে টেনেটুনে, জল-হাওয়া দিয়ে বড় করেছে।

গুলশান এ অফিসের অ্যাকাউন্টস অফিসার। কোম্পানির শুরু থেকে এ অফিসে আছে। নিষ্ঠা ও যোগ্যতা দিয়ে বসদের মন জয় করে আছে। গুলশান, হাসানের রুমে এসে বলে— স্যার, ইনি রুবী আপা। শাড়ি বিক্রি করেন। এ শাড়িটা ভাবির জন্য নিতে পারেন। মিতু ভাবি তো সুন্দর। মানাবে ভালো।

হাসান শাড়ি চেনে না। না সুতো, না রঙ। কিনতে কিনতে মানুষ এসব চিনে ফেলে। কিন্তু হাসান বিয়ের আগে শাড়ির মার্কেটে কখনো যায়নি। এমনকি বিয়ের পরেও না। যা কেনার মিতু নিজেই কেনে। মার্কেটে গিয়ে হাসান শুধু পাহারাদার হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

গুলশান শাড়িটা ভালো বলাতে হাসান আস্থা পায়। বলে, তুমি যখন বলছ, দিয়ে দাও।

রুবী একটা প্যাকেটে শাড়িটা ভরে, হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ধন্যবাদ স্যার।

হাসান বাড়ি ফিরে মিতুকে শাড়িটা দেখালে মিতু খুব খুশি হয় এবং বলে, এক কাজ করলে কেমন হয়, আমি তো বাড়িতে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় মা-ভাবি-মিনু ওদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাই। তুমি এ শাড়িটা অনেক কমে পেয়েছ। এটা বসুন্ধরা মার্কেটে তিন হাজার-সাড়ে তিন হাজারের কমে পাবে না।

‘ঠিক আছে, গুলশানকে বলব।’

‘খালি গুলশান-গুলশান করো কেন?’ ওকে কী দরকার। রুবী না কী যেন মেয়েটার নাম বললে, ওকে বাসায় আসতে বলো। দেখে শুনে পছন্দ করি।’

হাসানের প্রথম ইস্যু। প্রথমবার মেয়েরা মায়ের কাছে যায়। তাই মিতুও দিনাজপুরে মায়ের কাছে যাবে।

হাসান বলে, ঠিক আছে, মেয়েটাকে আগামী শুক্রবারে আসতে বলব।

‘শুক্রবারে কেন? তার আগে আসতে বলো। আমি তো শনিবারে চলে যাব। আর শোনো, অনেকগুলো শাড়ি আনতে বলবা। ওর মধ্য থেকে কয়েকটা বেছে নেব।’

‘শুক্রবারই আসতে বলি। শুক্রবার ছাড়া তো আমি বাসায় থাকি না।’

পরের দিন হাসান অফিসে গিয়ে গুলশানকে শাড়ি নেওয়ার কথা বললে, গুলশান তখনই রুবীকে ফোন করে বলে, ‘শুক্রবারে বেশ কিছু শাড়ি নিয়ে তোমাকে স্যারের বাসায় যেতে বলেছেন। ভাবি নিজে পছন্দ করবেন। স্যারের বাসার ঠিকানা আমি তোমাকে টেক্সট করে দিচ্ছি।’

‘ধন্যবাদ, গুলশান আপা। আপনি আমার জন্য অনেক কিছু করছেন। ওদিন স্যারের কাছে না নিয়ে গেলে, স্ট্রং রিকোমেন্ড না করলে, স্যার শাড়ি কিনতেন?’ রুবী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে।

‘আমি আর কী করলাম! এমনিতে তোমার ব্যবহার ভালো। অল্পতে সবাই গলে যায়। তোমার জন্য শুভকামনা।’

‘ওকে আপা। ভালো থাকবেন।’

কিন্তু শুক্রবার যাওয়ার কথা থাকলেও রুবী ওদিন হাসানের বাসায় যায় না। কোনো সংবাদও দেয় না।

মিতু কুমড়োর মতো মুখ করে বলে— কই, তোমার মেয়েটা তো এল না। এখন! আমি বাড়িতে মা-বোনদের বলে রেখেছি— তোমাদের জন্য শাড়ি নিয়ে আসছি।

এ প্রশ্নের উত্তরে হাসান কিছুই বলতে পারে না। মেয়েটি এমন করবে তা ওর ধারণার বাইরে ছিল।

মিতু ফোঁসফাস করতে থাকে।

হাসান দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, বুঝতে পারলাম না। মেয়েটার কী হলো। ফোন করব তারও উপায় নেই। ওর ফোন নম্বর আমার কাছে নেই। ঠিক আছে, আমি যখন সামনে মাসে তোমাকে দেখতে যাব, তখন নিয়ে যাব।

মিতু হ্যাঁ-না কিছু বলে না। এ সময় রাগ-অভিমান করে শরীরের ওপর চাপ নিতে চায় না মিতু। তাই মন খারাপ করে, পরের দিন বাবার বাড়ি চলে যায়।

ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। হাসান কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে মিতুকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসে। হাসান দিনাজপুর পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল।

মিতু বলেছে, আমি একা যেতে পারব। বাবা তো স্টেশনে এসে নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া তুমি তো ঘনঘন ছুটি পাবে না। দু’সপ্তাহ পরে আমাকে দেখতে যেতে চেয়েছ না?

তবু হাসানের মন খারাপ হয়। এ সময়ে একা একা যাওয়া! যদিও এখন তিন মাস বাকি।

যত সময় ট্রেন না ছাড়ে, হাসান জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন চলা শুরু করলে, হাত নেড়ে মিতুকে বিদায় জানায়।

হাসানের অফিস সকাল ন’টায়। মিতুকে সাতটায় ট্রেনে তুলে দিয়ে হাসান আর বাসায় যায় না। সরাসরি অফিসে চলে আসে। হাসান মাঝে মধ্যে বেশ আগে অফিসে চলে আসে। এসে আগের দিনের জমা ফাইলগুলো ছেড়ে দেয়। গত কালকের দু’টো ফাইল টেবলে পড়ে আছে কিন্তু ফাইল দু’টো দেখতে হাসানের মন চাচ্ছে না। ভেতরটা গজগজ করছে। কতক্ষণে গুলশান অফিসে আসবে।

এ সময় পিয়ন হারুন এসে বলে, স্যার কফি দেব?

‘না।’

‘না’ শব্দে বোম্বাই মরিচের ঝাঁজ ছিল, সেটা বুঝতে পেরে হারুন আর কোনো কথা বলে না। ওদিনের দু’টো নিউজ পেপার টেবিলে রেখে রুম থেকে বের হতে যায়।

হাসান হারুনকে ডেকে বলে, এই শোন, গুলশান ম্যাডাম এসেছেন?

‘জ্বি স্যার।’

‘ডাকো তাকে।’

হারুন গুলশান ম্যাডামের রুমে গিয়ে বলে— ম্যাডাম, হাসান স্যার মনে হয় খুব রেগে আছেন। আপনাকে ডাকে।

গুলশান ভয়ে ভয়ে হাসান স্যারের রুমে ঢুকে বলে, গুড মর্নিং, স্যার।

‘গুড মর্নিং। ওই মেয়েটাকে বলেছিলেন, শুক্রবার বাসায় আসতে?’

‘কেন, যায়নি স্যার! আমি তো বলেছিলাম।’

‘বাসার এড্রেস বলেছিলেন?’

‘জি স্যার। এড্রেস টেক্সট করে দিয়েছিলাম।’

‘ও তো যায়নি। তোমাদের ম্যাডাম তো খুব রাগ করেছে। বাবার বাড়ি খালি হাতে যেতে হলো। ভেবেছিল মা-বোনদের জন্য কয়েকটা শাড়ি নিয়ে যাবে।’

‘স্যার, আমি এখনই রুবীকে ফোন দিচ্ছি।’

গুলশান রুম থেকে বের হয়ে রুবীকে ফোন দেয়। ফোনে উত্তর আসে— সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকবার ফোন দেয়। প্রতিবারই একই উত্তর— সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

গুলশান কাচুমাচু হয়ে, রুমে এসে বলে, স্যার রুবীকে ফোনে পাচ্ছি না। ফোন যাচ্ছে না।

‘লিভ দিস।’

‘স্যার আপনাকে কফি দিতে বলি?’

‘না। যান, কাজ করেন গিয়ে।’

গুলশান মন খারাপ করে রুম থেকে বের হয়ে আসে। হাসান স্যারের কাছ থেকে এধরনের ব্যবহার এই-ই প্রথম পেল।

শুক্রবার হাসানের বাসার ডোরবেল বাজলে, হাসান এসে দরজা খোলে। দরজায় রুবী দাঁড়িয়ে।

‘তুমি!’

হাসান রুবীকে না-চেনার ভান করে বলে।

‘স্যার আমি রুবী। ওই যে অফিসে ভাবির জন্য শাড়ি নিলেন।’

‘তো?’

‘গুলশান আপা ফোন করে আমাকে বলেছিলেন, আরও কয়েকটা শাড়ি নেবেন, তাই…।’

‘ভেতরে আসুন।’

ভেতরে আসুন কথাটা এমন ঝাঁজ মিশিয়ে হাসান বলে, তাতে রুবী বুঝে যায়, সামথিং রং।

রুবী ড্রয়িংরুমের এক কোনে গিয়ে ভেজা বেড়ালের মতো বসে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে পায়ের কাছে রাখে। দু’টো ব্যাগই বেশ ভারি। একটা কাঁধে, একটা হাতে নিয়ে রুবী সবসময় বেরোয়। এতেকরে কেউ বুঝতে পারে না, ও শাড়ি ফেরি করে বিক্রয় করে।

হাসান নিজের রুমে চলে যায় এবং পাঁচ মিনিট পরে ফিরে আসে।

রুবী লক্ষ করে, দরজা খোলার সময় হাসান স্যারের গায়ে গেঞ্জি ছিল। চুল ছিল এলোমেলো। পড়নে ছিল লুঙ্গি। এখন একটা হাফশার্ট পরে, চুল আঁচড়িয়ে, লুঙ্গি পাল্টে, প্যান্ট পড়েছে।

রুবী ভেবেছিল, পোশাকের এ পরিবর্তনের সাথে সাথে, হাসান স্যারের ভেতরের রাগটাও পাল্টাবে। কিন্তু না। হাসান আগের শক্ত স্বরেই বলে, কবে আসবেন গুলশান বলেনি?

‘বলেছিল, শুক্রবার।’

‘তো?’

‘আজ তো শুক্রবার।’

‘শুক্রবার তো মাসে চারটে থাকে। বছরে থাকে অনেকগুলো।’

‘বুঝলাম না, স্যার।’

‘গত শুক্রবার আসার কথা বলেছিলাম।’

‘স্যার, গুলশান ম্যাডাম তো নির্দিষ্ট করে বলেননি। শুধু বলেছেন, শুক্রবার দেখা করতে। বিশ্বাস না হয়, আমার ফোনে রেকর্ড করা আছে, শুনবেন স্যার?

‘দরকার হবে না। তবে যখন বলা হয় শুক্রবারের কথা, তখন পরের শুক্রবারকেই বোঝায়।’

‘স্যরি স্যার। আমি বুঝতে পারিনি। আমি আপার ফোন পেয়ে, আমাদের বাড়ি রাজশাহীতে চলে গিয়েছিলাম, আরও ভালো ভালো কিছু শাড়ি আনতে।’

‘তুমি ফোনও ধরোনি।’

‘স্যার আমাদের বাড়ি রাজশাহী শহর থেকে অনেক ভেতরে। একটা অজপাড়াগাঁয়। ওখানে প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি থাকে না। ফোনে চার্জ ছিল না।’

‘বুঝলাম। কিন্তু যিনি শাড়ি নেবেন, তিনি তো চলে গেছেন।’

‘কোথায় গেছেন স্যার? আসবেন না?’

হাসান একথার আর উত্তর দেয় না। বলে, আজ তুমি ফিরে যাও। তোমার ফোন নম্বর রেখে যাও। প্রয়োজনমতো আমি ডাকব।’

একথা শুনে রুবীর ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। কত আশা নিয়ে এসেছে, সামনে ওর থার্ড সেমিস্টারের ফি জমা দিতে হবে। কয়েকটা শাড়ি বিক্রয় করতে পারলে, বাকিটা টিউশন ফি মিলে হয়ে যেত।

তবে আশার আলো, হাসান স্যার ওকে ‘তুমি’ বলেছে। নিশ্চয় আগের রাগ আর পুষে রাখেনি।

তাই ভেবে রুবী সাহস নিয়ে বলে, স্যার নতুন কিছু শাড়ি এনেছি, আপনি একটু দেখেন।

‘আমি তো শাড়ির কিছু বুঝি না।’

‘স্যার, ম্যাডাম কি ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছেন? কবে আসবেন?’

‘হ্যাঁ। ওদের বাড়ি গিয়েছে। প্রথম ইস্যু। আসতে বেশ দেরি হবে।’

দেরি হবে শুনে রুবী দ্বিতীয়বারের মতো ধাক্কা খায়। ও নিজের বুকের মধ্যে ধকধক ঢেঁকির পাড় শুনতে পায়। ওর সব যোগ-বিয়োগ এলোমেলো হয়ে যায়।

রুবী শেষ চেষ্টা করে বলে— স্যার, এক কাজ করলে হয় না, ম্যাডামকে ভিডিও-তে শাড়ি দেখান।

‘না, সেটার আর দরকার নেই। আমি সামনের মাসে সতেরো তারিখ ওদের ওখানে যাব। তার আগে একদিন আসো। এর মধ্যে আমি একদিন মিতুর সাথে কথা বলে নেব।’

‘কিছু মনে করবেন না স্যার। তার আগে মানে, ডেটটা যদি নির্দিষ্ট করে বলতেন। না হলে, আজকের মতো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে।’

‘সতেরো তারিখের আগে দশ তারিখ, শুক্রবার।’

‘ওকে স্যার। তবে আজ একটু যদি দেখতেন। কষ্ট করে এসেছি, আমার ভালো লাগত। আর ম্যাডামকে কিছু বর্ণনাও দিতে পারতেন।’

কিছু সময় থেমে রুবী আবার বলে, স্যার আমি আরেকটা জিনিস বিক্রি করি।

‘কী?’

‘অভয় দিলে বলতে পারি।’

‘আমি পুলিশ, নাকি র‌্যাব?’

‘না। আপনি পছন্দ করেন, কী করেন না, তাই ভাবছি।

‘আমি তো অভয় দিয়েছি।’

রুবী আর কোনো কথা না বলে, ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে টি টেবলের ওপর রেখে বলে, অনেকে চায়। তাই মাঝে মধ্যে সাথে রাখি।

‘আমি কখনো খাইনি। অভিজ্ঞতা নেই।’

‘তা হলে রেখে দেই।’

‘তাই কর।’

রুবী কোনো দ্বিরুক্তি না করে, যেখানে বোতলটা ছিল, সেখানে রেখে দেয়।

‘স্যার, আজ উঠি তাহলে।’

‘বোতলটা নিতে পারলাম না বলে, মন খারাপ করেছ?’

‘না স্যার। খুশি হয়েছি। আমারই ভুল হয়েছে। আপনার অনুমতি ছাড়া আনা ঠিক হয়নি।’

‘তোমার তো এটা ব্যবসা। নানা ধরনের পণ্য সাথে রাখতেই পারো।’

রুবী হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে— স্যার, আপনি একদিনের জন্যও খাননি?

‘বললাম তো। আমি ওসবের গন্ধ শুকতে পারি না।’

‘স্যার এটা হোয়াইট লেডিস ওয়াইন। খুব সফট। একবার ঠোঁট ছোঁয়াতে পারেন।’

‘না। ওকে।’

‘উঠি স্যার।’

‘অনেক দূর থেকে এসেছ। এক কাপ কফি খেয়ে যাও।’

‘ধন্যবাদ স্যার। আমি কফি খাই না।’

‘তা হলে অন্য কী খাবে?’

‘কিচ্ছু না।’

তুমি বসো, আমি দেখি। এই বলে হাসান ভেতরে গিয়ে কিছু সময় পর দু’টো প্লেট হাতে করে ফিরে আসে। একটায় দু’পিস কেক। অন্যটায় কয়েকটা চকলেট। প্লেটটা রুবীর সামনে টেবলে রাখতে রাখতে হাসান বলে, কোনো বাসা থেকে খালি মুখে যেতে নেই।

ধন্যবাদ, স্যার। না ভাবলাম বাসায় ম্যাডাম নেই। আপনার কষ্ট হবে। রুবী ওড়নার আঁচল খুটতে খুটতে বলে।

কষ্টের অপর নামই তো জীবন। এই যে তুমি কষ্ট করছ না? আচ্ছা, গুলশান বলছিল— তুমি নিজের আয় দিয়ে পড়াশোনা করছ। একটা ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছ।

রুবী হাসানের একথার কোনো জবাব দেয় না। মাথা নিচু করে থাকে।

আরে লজ্জা কীসের! কোনো কাজকেই হালকা করে বা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কাজ তো কাজই। তাছাড়া তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা করছ, এটাতে ভাববার কী আছে। আরও মুখ উঁচু করে বলবে নিজের পড়ার খরচ নিজে জোগাড় করছ।

হাসানের একথায় রুবী মুখ তুলে বলে— স্যার, আমার বাবা তো কোনো টাকা-পয়সা পাঠাতে পারেন না। প্রতি মাসে আমার মামা কিছু পাঠান আর আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার স্যার কিছু পাঠান। বাকিটা আমার টিউশনি আর এই শাড়ি-টাড়ি বিক্রি করে যা হয়।

রুবীর একথা শুনে হাসানের মন নরম হয়। হাসান বলে— শোনো, কখনো মন খারাপ করবে না। কোনো কাজই ছোট না। শোনো তবে, আমি আমার স্কুল-কলেজ জীবনে প্রায় ছ’বছর বাসায় বাসায় পেপার বিলি করেছি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, বাসায় বাসায় পেপার পৌঁছে দিয়ে, তারপর ক্লাসে যেতাম। এতে আমার কোনো লজ্জা ছিল না। এখনো নেই। আমার বাবাও তোমার বাবার মতো গরিব ছিলেন। আমার লেখাপড়ার খরচ দিতে পারতেন না।

হাসানের একথা শোনার পর রুবীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে, স্যার ওই বয়সে আপনি জীবনকে বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আজ এত বড় হতে পেরেছেন।

‘ঠিক তাই। তুমিও একদিন বড় হবে।’

একথা বলে হাসান কী যেন ভাবে। কান চুলকায়। তারপর বলে, ঠিক আছে শাড়িগুলো দেখাতে চেয়েছিলে, দেখাও। আর তোমার পছন্দমতো পাঁচটা শাড়ি রেখে যাও। আমি তোমাকে চেক লিখে দিচ্ছি।

হাসানের একথা শুনে রুবীর চোখ-মুখ সকালের কাঁচা রোদের মতো ঝলমল করে ওঠে। ও খাওয়া রেখে ব্যাগ খুলতে যায়।

হাসান বাধা দিয়ে বলে, আরে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে না। আগে কেক খেয়ে নাও। আর চকলেটগুলো পকেটে ঢোকাও। রুমমেটদের দিও।

লজ্জা ও আনন্দ মিশ্রিত একটা আদল ফুটে ওঠে রুবীর সারা মুখে। রুবী বুঝতে পারে, স্যারের এ ধরনের একটা অতীত আছে দেখে, বিষয়টাকে এত সহজ, এত আন্তরিকভাবে নিয়েছেন।

রুবী একটা কেকের অর্ধেকটা খেয়ে বলে— স্যার, এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে। তবে আমাকে যদি বানাতে দেন, তবে।

‘তুমি যে বললে কফি খাও না।’

‘একেবারে খাই না বললে, ভুল বলা হবে। মানে, পরিবেশ পরিস্থিতি ফেভারে থাকলে মাঝে মধ্যে খাই। তখন খাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক বেড়ে যায়। দমিয়ে রাখতে পারি না।’

‘তাহলে বলতে চাচ্ছো, পরিবেশ এখন তোমার ফেভারে?’

রুবী একথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলে— স্যার, যতই সময় যাচ্ছে, যতই আপনাকে দেখছি, ততই আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে।

হাসান রুবীর একথার কোনো উত্তর দেয় না। দেয় না মানে, কী বলবে খুঁজে পায় না। কয়েক সেকেন্ড দু’জনই নীরব থাকে। পরে নীরবতা ভেঙে রুবী বলে— স্যার, কফি বানানোর অনুমতি দিলেন তো?

‘যাও, কিচেনে সব কিছু আছে। কফি এখন আমি নিজেই বানিয়ে খাই। মিতু যাওয়ার সময়, কাজের মেয়ে হাসিকে ছুটি দিয়ে গেছে। আমি একা থাকব— তাই।

একথা বলে হাসান একটু মৃদু হাসে।

কথার অর্থ রুবী বুঝতে পেরে, রুবীও চোরা হাসি হাসতে হাসতে রান্নাঘরে যায়। চার মিনিটের মাথায় রুবী এককাপ কফি বানিয়ে এনে হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। হাসান তখন একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল। ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে কফির কাপটা নিয়ে বলে, তোমার কফি?

‘স্যার এককাপই বানিয়েছি।’

‘কেন?’

‘স্যার, আপনার সামনে বসে কফি খেতে আমি পারব না, তাই শুধু আপনার জন্য বানিয়েছি।’

‘আমার সাথে বসে কফি খেতে লজ্জা কীসের! তোমাকে তো বললাম। তুমিও ব্যবসা করছ। আমিও ব্যবসা করছি। শুধু তোমারটা একটু ছোট, আমারটা একটু বড়, এই যা পার্থক্য।

হাসান একটু থেমে, কফির কাপে একটা লম্বা টান দিয়ে বলে, ঠিক আছে। কফি না খাও, তোমার ব্যাগে যে লেডিস ওয়াইন আছে, ওটা বের করো। আমরা দু’জনে একটু খাই।

রুবী হাসানের কথা শুনে, হা করে হাসানের দিকে চেয়ে থাকে। চট করে ব্যাগটা খুলতে পারে না। ওর হাত কাঁপতে থাকে।

 

Print Friendly, PDF & Email
সৈয়দ নূরুল আলম

সৈয়দ নূরুল আলম গোপালগঞ্জ জেলায় কাশিয়ানি উপজেলার, চাপ্তা গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। বাবা মরহুম সৈয়দ জহুর আলী, মা মরহুম জাহানারা বেগম। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ সব শাখায় লিখলেও নিজেকে তিনি গল্পকার পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। গল্প দিয়েই তিনি নব্বই দশকের শুরুতে লেখালেখির জগতে আসেন।

এখন গল্প-উপন্যাসই বেশি লিখছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ষোল। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘যুদ্ধের ছবি’, ‘ভালোবাসা(প্রা:) লিমিটেড’ ও  উপন্যাস-‘মেঘের মতো মেয়েরা’, ‘আগুনরঙা মেয়ে’, ‘জাহান ও পিতারমুখ’ বেশ পাঠকপ্রিয়তা পায়।

জাতীয় পর্যায়ে তিনি কবি জসিমউদ্ দীন  পুরস্কার, বিকাশ সাহিত্য পুরস্কার, অধিকোষ পুরস্কার, রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ প্রদত্ত সম্মাননা অর্জন করেছেন।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক কর্মকর্তা। দু’ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া নীনাকে নিয়ে ঢাকা, মিরপুর-১০ এ থাকেন।

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

One Comment

  • I’m extremely impressed together with your writing abilities as neatly as with the structure for your blog. Is this a paid subject or did you modify it yourself? Anyway stay up the excellent high quality writing, it’s rare to look a great weblog like this one today. !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *