অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২২, ২০২৪
৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২২, ২০২৪
৬ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আবদুল মতিন -
আষাঢ়ে গল্প

পরেশদা ওদের মাঝে বড় রসিক মানুষ। কথায় কথায় উপমা প্রয়োগ করা কিংবা ছোটখাটো গল্পের অবতারণা করা ইত্যাদিতে তার জুড়ি মেলা ভার। দেহটাও হাতি মার্কা, দিলটাও উদার। ওদের নিয়ে সবসময় হাসি-ঠাট্টায় ডুবে থাকে সে। ওরাও যখন তখন পরেশদার রুমে হাঁটু গেড়ে বসে থাকে। সাধারণত আড্ডাটা রাতেই জমে বেশি। এধরনের ছোকরাদের আড্ডার বিষয়বস্তুর যে কোনো মা-বাপ থাকে না তা তো সকলেরই জানা।

এই যদি শুরু হল রাজনীতি নিয়ে, পরক্ষণেই চলে আসবে সমাজনীতি। সমাজনীতি যখন শুরু হলো তো হুট করে এসে পড়বে ধর্মনীতি এবং অবশেষে হয়তো বিজ্ঞের মতো কেউ একজন বলে বসবে : আরে ভায়্যা আমরা যত কিছুই বলি না কেন, সকল নীতির সেরা হলো পেটনীতি।

এখানেই শেষ নয়। পেটনীতির সূত্র ধরেই নারী-পুরুষ, প্রেম-টেম, ছেলেপেলের জন্ম— মানে একটা জগাখিচুড়ি ব্যাপার আর কী।

ওরা সাতজনে মিলে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। সকলে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জনপদ থেকে এসেছে এবং সকলেই ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনন্দমোহন কলেজে অনার্স পড়ে। ওদের মাঝে পরেশদা বয়সে সবার বড়। অন্যরা ক্লাসের সিনিয়রিটি অনুসারে এক দুই বছরের বড় ছোট। বয়সের এই যৎসামান্য পার্থক্যকে ওরা একেবারেই আমলে নেয় না— সকলে সমবয়সী হয়ে আড্ডা মারে। অবশ্য বয়সের বিচারে পরেশদা একটু বেশি সিনিয়র হওয়ায় তাকে কিছুটা সমীহ করতে চাইলেও পরেশদা কিন্তু বয়সের ভেদাভেদটাকে একেবারেই মেনে নিতে পারে না, ওদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারে। সে নিজে সিগারেটের পোকা, ওদেরকেও দিনে দুই তিন প্যাক উপহার দেয়। মাঝেমধ্যে ‘মাল’ নামের তরল জিনিসেরও ব্যবস্থা করে। তবে তরল পানের বিষয়টি তার একান্ত ব্যক্তিগত, এখানে অন্য কাউকে আমন্ত্রণ করে না। এসব পান-টানের পরেও পরেশদা দিব্যি সুস্থ থাকে, কোনোরকম পাগলামি করে না। ধূমপান বা তরল পান, কোনোটাকেই সে পচে যাওয়া মনে করে না। এ জাতীয় পানাহার ছাড়া পরেশদার মাঝে আর কোনো নেতিবাচক দিক নেই, অন্তত কেউ কোনোদিন দেখেনি।

পরেশদা আগে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই ফাটাফাটি রেজাল্ট করেছিল, কিন্তু এইচএসসি পাস করার পর পরই প্রেমিকার ছ্যাঁকা খেয়ে জীবনটাকে স্পয়েল করে দিয়েছে। কোথাও ভর্তির চান্স না পেয়ে শুরুতে বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও আনন্দমোহন কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ছে এখন— সেই কখন থেকে, সে নিজেও হিসেব না করে বলতে পারে না। কিন্তু ফাইনালটা আর দেওয়া হচ্ছে না।

পরেশদার সকল গুণই সাব্বিরের ভালো লাগে কিন্তু এইখানটাতেই তার সাথে গরমিল দেখা দেয়, ‘কোথাকার এক রত্তি বেহায়া মাইয়া তাকে পায়ে দলে দিব্যি এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে ঢুলুঢুলু করছে, আর তিনি কিনা সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছেন। যত্তসব! এই প্রেমিকগুলো যুগে যুগে এমনভাবেই পচে মরবে। শালার প্রেম! গুল্লি মারি এমন প্রেমের—’ নিজের সাথেই নিজে বিড়বিড় করে সাব্বির। লীলার কথা মনে পড়লে একইভাবে নিজ মনে বিড়বিড় করতে থাকে, ‘খানকি মাইয়া, আগে যদি জানতে পারতাম তবে তোমার প্রেমের নামে নষ্টামির মর্ম বুঝিয়ে দিতাম। তোমার মসৃণ, গোলাপি গালটিতে এমন দাগ বসিয়ে দিতাম যাতে আর কোনো পুরুষের সাথে প্রেম প্রেম খেলতে পারতে না’।

কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে এলে হাসি পায় তার। মনে মনে বলে, ‘সব ব্যাটা মজনু হয়ে এখানে এসে জমেছে’।

আজ সারা দিন ধরেই টিপটিপ বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে, তবুও যেন ব্যাটা মেঘদূতের তৃপ্তি মেটেনি। বরং সন্ধ্যার দিকে মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। গতানুগতিক ধারা অনুযায়ী সকলেই ভিড়তে শুরু করেছে পরেশদার রুমে। মজমাটা জমবে ভালো। কিন্তু সাব্বিরের উপর ভার রয়েছে মেসের মিল তদারকি করার। সকলে ওকে বিশ্বাস করে, সৎ মনে করে। তাই মিল ম্যানেজারের পদটি ওর জন্য চিরস্থায়ী হয়ে আছে।

নুরির মা ওদের মেসের পাক করার মেয়ে। নুরি নামের এই ডিমটি জন্মের পর জামাই যে কোথায় হুট করেছে কেউ তার হদিস জানে না। নুরির মা বেশভূষায় অপরিষ্কার হলেও দেখতে কিন্তু সেই রকম— যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। আজ সারাদিন বৃষ্টির ঝনঝনানিতে সাব্বিরের মনটা যেন পাগলা ঘোড়া হয়ে আছে। দুপুরবেলায় মন্টুকে নুরির মা’র সাথে গুজুরগুজুর করতে দেখেছে সে। মন্টুটা এ কাজে পাকা ওস্তাদ, যে কোনো মাইয়ামানুষকে পটিয়ে ফেলা তার কাছে ওয়ান টুয়ের ব্যাপার। নুরির মা’র সাথে মন্টুর সম্পর্কটা শুধু গুজুরগুজুরের মাঝেই সীমাবদ্ধ বলে মনে হয় না তার কাছে। ‘নুরির মাকে একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়’— নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখে সাব্বির। কিন্তু ভরসা পায় না। একদিন তো একটু ইঙ্গিত দিয়েছিল। তাতেই যেভাবে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল!

মজমা ততক্ষণে শতমুখী প্রতিভায় উদ্ভাসিত। নুরির মাকে চাল ডাল সব বুঝিয়ে দিয়ে সাব্বির এতক্ষণে যোগ দিল। আলোচনার বিষয়বস্তু সেই একই ধারায় এগিয়ে চলেছে। এসব রাজনীতি, পেটনীতি বা প্রেমনীতি শুনতে শুনতে কানের পর্দা ঝাজরা হয়ে গেছে সাব্বিরের। এবার নতুন একটা কিছু শোনা দরকার। তাই সকলকে থামিয়ে দিয়ে পরেশদাকে অনুরোধ করল আলোচনায় নতুন কিছু যোগ করতে। সাথে সাথে দুই একজন মাথাও নাড়ল প্রস্তাবের সমর্থনে। পরেশদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ‘ঠিক আছে আজ এই বাদল রাতে একটি গল্পের আসর জমাতে পারি আমরা’। সকলে একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। সাব্বির প্রস্তাব করল, ‘পরেশদা, রাতটা বাদলা, মাসটা আষাঢ়। তাই আমাদের গল্পের শিরোনাম হোক— আষাঢ়ে গল্প’। পরেশদা বলল, ‘ঠিক আছে গল্পের শিরোনাম ‘আষাঢ়ে গল্পই’ রইল। কিন্তু আমি ঠিক করেছি, আজ আমি তোমাদের কোনো হাস্যরস না শুনিয়ে এমন একটা গল্প বলব, যা তোমরা শুনে মনে করবে এটা কোনো আধুনিক তরুণ গল্পকারের লেখা বাস্তব গল্প’।

মন্টু এতে আপত্তি জানায়। বলে— পরেশদা, এসব নিরস গল্প আমার একদম ভালো লাগে না। বরং দুই একটা ইয়ে টিয়ের কথা বলুন। রাতটা বাদলা, জমবে ভালো।

‘এই মন্টুর বাচ্চা, থামলি! জীবনে তো শিখেছো একখান। ইয়ে টিয়ে ছাড়া আর তো কিছু বোঝ না সোনা’— ধমকে উঠে সাব্বির। এদিকে মন্টু বরাবরই কিছুটা ভীতু প্রকৃতির। কারও সামান্যতম চোখ রাঙানি দেখলে ভয়ে একেবারে কুঁচকে যায় সে।

সকলে একটু নড়েচড়ে বসে। পরেশদার গল্প, সেটা যে কোনো বিষয়ের উপরই হোক না কেন একেবারে যে বাজিমাত করে ছাড়বে সে বিশ্বাস সকলেরই আছে। শুরুতে সাব্বির বলল, ‘পরেশদা, আপনি যদি সকলের সার্টিফিকেট কুড়াতে পারেন তবে কাল সকলকেই আমি ভরপেট চাইনিজ খাওয়াব। অবশ্য যদি টাকাটা আপনি দেন’। পরেশদা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, তুমি চাইনিজ খাওয়াতে পারবে আর আমি টাকা দেওয়ার মতো সামান্যতম সাহসটুকু দেখাতে পারবো না! বাপের একমাত্র ডবল সাইজ সন্তান আমি। বাপের এত টাকা খাবে কে?’

পরেশদার কথায় সকলে হে হে করে ওঠে।

গল্পটি শুরু হয় এভাবে—

এই শহর থেকে ২০-২৫ মাইল দূরে ছোট্ট একটি গ্রাম হরিপুর। ওই গ্রামেরই কেন্দ্রস্থলে ছিল সুফিয়াদের বাড়ি। সংসারে ছিল সুফিয়ার বাবা নইমুদ্দিন মুন্সী আর তার মা-মরা মেয়ে সুফিয়া। অর্থাৎ সুফিয়াকে নিয়ে ছিল তার বাবার সংসার আর বাবাকে নিয়েই ছিল সুফিয়াদের সংসার। জন্মের পর মাকে কখনো দেখেনি সুফিয়া। বাবার কাছে শুনেছিল যে তার পৃথিবীর বুকে আগমনের কারণই নাকি মায়ের ধরণী থেকে নির্গমনের কারণ। কিন্তু কি কারণে যে মায়ের নির্গমন হলো তা সুফিয়ার কাছে আজও স্পষ্ট নয়। স্পষ্ট নয় বাবার কাছেও। গ্রামের ডাক্তার নাকি বাবাকে বলেছিল, ‘এনিমিয়া’। গ্রামের অধিকাংশ ক্ষেত্রে যা হয় আর কী। কিন্তু এনিমিয়া কাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কী কী, তা সুফিয়া কেমন করে জানবে? পরেশদার কথা শুনে সকলে আবার হে হে করে হেসে ওঠে।

পরেশদা আবার শুরু করল—

মা-মরা মেয়েটাকে নইমুদ্দিন মুন্সী মায়ের স্নেহ দিয়েই সংসারের দুঃখ-কষ্ট থেকে সামলে রেখেছিল। সুফিয়ার বাবা নইমুদ্দিন মুন্সী ছিল গ্রামের মসজিদের ওয়াক্তিয়া নামাজের ইমাম। আয়ের উৎস ছিল এই একমাত্র ইমামতি। তবে মিলাদ, নবান্ন ইত্যাদি উপলক্ষে মাঝে মাঝে গেরস্থের বাড়িতে তার দাওয়াত পড়ত। সহায় সম্পত্তি বলতে ছিল দুটি কুঁড়েঘর সমৃদ্ধ এক ফালি জমির উপর স্থাপিত বাড়ি ভিটাটুকু। আর কিছু না থাকলেও নইমুদ্দিন মুন্সীর ছিল পাকা ঈমান। ঈমানদার বলে গায়ের ছোট বড় সকলেই তাকে এক বাক্যে স্বীকৃতি দিত।

গল্পের মাঝখানে সাব্বির টিপ্পনি কাটে, ‘পরেশদা, মালাউন এর মুখে শেখের গুণ কীর্তন, দুই বিপরীত স্রোত একসাথে মিশে গেছে বলে মনে হচ্ছে না’? মন্টু বলে উঠল, ‘একথাটিই যদি আমি বলতাম, তাহলে সাব্বির এতক্ষণে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে বসত’।

এবার সকলে চুপ থাকলেও পরেশদা একা হে হে করে ওঠে।

গল্প চলছে :

নঈমুদ্দিন মুন্সীর বাড়ির সামনেই ছিল গায়ের মাথা গফুর মণ্ডলের প্রকাণ্ড বাড়ি। গফুর মণ্ডলের ছিল তিন বউ। এই তিন বউয়ের বড়টি হয়তো রাতে এক খারাপ স্বপ্ন দেখেছে, আর অমনি সকাল হতে না হতেই খবর চলে গেছে নইমুদ্দিনের কাছে— আজ তাকে মিলাদ পড়ে আসতে হবে। মেঝ বউয়ের মেঝ ছেলেটার গা জ্বর জ্বর করছে। হয়তো খারাপ কোনো বাতাস লেগেছে। কাজেই নইমুদ্দিন মুন্সীকে কিছু সুরা কেরাত পড়ে একটু উতার পানি দিতে হবে। তৃতীয়জন হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়েছে। কাজেই নইমুদ্দিন মুন্সীকে একটু ঝাড়ফুঁক করতে হবে, ইত্যাদি নানা কারণে নইমুদ্দিন মুন্সীর বাড়ি আর গফুর মণ্ডলের বাড়ির মধ্যে সব সময় একটা লেনদেন চলে আসছিল। আর এই লেনদেনের মাধ্যম ছিল মণ্ডল বাড়ির বিশ্বস্ত চাকর চানমিয়া।

পরেশদা অনবদ্য ভাষায় বলে চলেছে :

সবল সুঠাম দেহের অধিকারী ও সুদর্শন চানমিয়ার পিতৃ-মাতৃকুলের তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। পরিচয়ের মধ্যে শুধু এইটুকুই যে, চানমিয়া যখন তার মায়ের সাথে মণ্ডল বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন তার মাত্র আট বছর বয়স। স্বামী মারা যাওয়ার পর চানমিয়ার অসহায় মা, ভাত কাপড়ের সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘোরার পর শেষে মণ্ডল বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই গফুর মণ্ডলের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল চানমিয়ার মায়ের উপর। আর এই কারণেই এক ঘটনার জের হিসাবে চানমিয়ার মাকে প্রাণ দিতে হলো। কিন্তু গফুর মণ্ডলের লোকবল ও অর্থবলের দাপটে প্রকৃত ঘটনা চাপা পড়তে বাধ্য হলো। তবে গফুর মণ্ডল নিজের কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়ে পিতৃমাতৃহীন চানমিয়াকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। এ থেকেই চানমিয়া মণ্ডল বাড়ির নুন-পানি খেয়ে মানুষ।

সদা বিনয়ী ও কিছুটা সরল-সহজ চানমিয়া, ছোটকাল থেকেই ছিল নইমুদ্দিন মুন্সীর স্নেহের ধন। তাই ছোটকাল থেকেই, দিন রাতের যেকোনো সময়ে চানমিয়ার জন্য নইমুদ্দিন মুন্সীর বাড়ির দরজা খোলা থাকত। এইভাবে যখন চানমিয়া খোলা দরজা দিয়ে সুফিয়ার হৃদয়কুঠুরিতে প্রবেশ করল এবং দুই হৃদয় একসাথে কথা বলে উঠল তখন সুফিয়ার বয়স চৌদ্দ ডিঙ্গিয়ে পনেরোতে ছুঁই ছুঁই করছে।

গল্পটি মন্টুর মতো সাব্বিরের কাছেও কেমন যেন একঘেঁয়ে একঘেঁয়ে ঠেকছিল। এবার হুট করে প্রেমের কথা এসে পড়াতে অবশিষ্ট মনোযোগটুকুও নিঃশেষ হয়ে গেল। প্রেম নামের অদৃশ্য বস্তুটিকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। প্রেমের কথা শুনলেই লীলার লীলাময়ী মূর্তিটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আর তখনই এটাকে গলা টিপে ধরতে ইচ্ছে করে।

সাব্বিরের দৃষ্টি চলে যায় পরেশদার পড়ার টেবিলে। সেখানে মন্টু পেন্সিল দিয়ে কী যেন আঁকাআঁকি করছে। কাছে গিয়ে দেখে, সে আবক্ষ নগ্ন এক তরুণীর ছবি আঁকায় মগ্ন। প্রায় শেষ হয়ে আসা ছবিটা মনে লেগে গেল সাব্বিরের।

‘শালার প্রতিভা আছে’— বলতে বলতে ছবিটা ওর কাছ থেকে খপ করে নিয়ে এসে পরেশদার চোখের সামনে মেলে ধরে বলে, ‘শিল্পাচার্য মন্টু আবেদিনের তুলির পরশে ফুটে উঠেছেন উনি’। কিন্তু পরেশদার চোখ তা দেখেও না দেখার ভান করল। তার মুখে যেন কথার খৈ ফুটছে, আর শ্রোতাগণও এমন গভীর মনোযোগে পরেশদার মুখের দিকে চেয়ে আছেন, যা দেখে সাব্বিরের মনে হলো যেন ওনারা বেহেস্তের হুরপরীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন। অতঃপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও সাব্বিরকে পুনরায় আসরে যোগ দিতে হলো।

সাব্বির যখন যোগ দিল তখন গল্পের নায়িকা চিলেকোঠার আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে নায়কের আগমনের অপেক্ষায়। তার বাবা নইমুদ্দিন মুন্সী গঞ্জে গেছে মেয়ের জন্য কাপড় কিনতে। কাজেই মনের মানুষের সাথে মিলিত হওয়ার এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না সে। কিন্তু নায়িকা সুফিয়া হঠাৎ করে যাকে আসতে দেখল সে তো নায়ক চানমিয়া নয়, সে হলো মণ্ডলের বড় বউ সুরতজান বিবি।

মণ্ডলের বউদেরকে কঠোরভাবে পর্দা মেনে চলতে হতো। যখন-তখন বাড়ির বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে কঠোর বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো। তাই সুরতজান বিবিকে তাদের বাড়িতে আসতে দেখে সুফিয়ার চোখের সামনে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ভেসে উঠল। ভেসে উঠাটাই স্বাভাবিক। কারণ সুফিয়া ও চানমিয়ার সম্পর্কের কথা সুরতজান বিবি জানত এবং এ ব্যাপারে ওদের রীতিমতো খোঁজখবর নিত। আসলে সুরতজান বিবি ওদের মাঝে সম্পর্ক গড়তে যথেষ্ট অবদান রেখেছে।

পরেশদার গল্পের চরিত্রাভিনেত্রী সুরতজান বিবি যখন সুফিয়াদের আঙ্গিনায় পা রাখল, তার বেশ খানিক আগেই সূর্যটা পশ্চিম আকাশে ডুব দিয়েছে। সুফিয়া তড়িঘড়ি করে পিঁড়ি এনে সুরতজানকে বসতে দিল। কিন্তু সুরতজান না বসে, এদিক ওদিক উঁকি মেরে লোকজন দেখে নিয়ে অতি সন্তর্পণে সুফিয়াকে ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। এবার সুফিয়ার কানের কাছে গিয়ে তার আগমনের হেতু বলতে শুরু করে দিল, যার সারমর্ম হলো :

চানমিয়া ও সুফিয়ার ঘটনা মণ্ডল জেনে ফেলেছে। তাই মণ্ডল এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করবে সুফিয়াকে পাওয়ার জন্যে। অনেকদিন থেকেই সুফিয়ার ওপর মণ্ডলের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে আছে। কিন্তু কিছুতেই কোনো সুবিধা করতে না পারায় এবার সে এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না। মণ্ডল ফন্দি করেছে, সে চানমিয়াকে হত্যা করে সুফিয়ার বাবাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবে। ফলে বাবাকে ছাড়িয়ে আনার যে কোনো প্রস্তাব সুফিয়া মাথা পেতে নিতে বাধ্য হবে। এই সুযোগে মণ্ডল তার চতুর্থ বিয়ের সাধ পূর্ণ করবে।

পরেশদার জোরাল ভাষায় শ্রোতাগণ মোহগ্রস্ত। সে বলে চলেছে :

সুফিয়ারও আজকাল মনে হয় তাকে নিয়ে পাড়ায় কানাঘুষা চলছে। তাকে দেখলে পাড়ার বয়স্ক গোছের মহিলারা কেমন যেন সন্দেহজনক আচরণ করে। তাহলে কি তাদের সম্পর্কের কথা পাড়ায় রটে গেছে? যদি তাই হয় তাহলে তো মণ্ডলের কারসাজিতে চানমিয়ার প্রাণ যাবেই, তদুপরি পাড়াপড়শিরাও বিশ্বাস করবে যে, ক্রোধের বসে তার বাবাই চানমিয়াকে হত্যা করেছে। তখন সুফিয়ার ভাগ্য তো সত্যি সত্যিই গফুর মণ্ডলের পদতলে গড়াগড়ি যাবে। না, না একথা সুফিয়া ভাবতেও পারে না। মণ্ডলের চার নম্বর বউ হওয়া তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব না। চানমিয়া তার জীবন, চানমিয়া তার বেঁচে থাকার আশা। চানমিয়াকে ছাড়া সে বাঁচতে পারবে না। কিন্তু এখন উপায় কী হবে? সুফিয়া জানে গফুর মণ্ডলের নজর একবার যেহেতু তার উপর পড়েছে তাই মৃত্যু কিংবা পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার সামনে অন্য কোন রাস্তা নাই। কিন্তু মৃত্যুতে কোনো সমাধান খোঁজে পায় না সে। মৃত্যু মানে পরাজয়, গফুর মণ্ডলের প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে নতি স্বীকার। এর চেয়ে পালিয়ে যাওয়া শ্রেয়। কিন্তু বৃদ্ধ বাবাকে একা ফেলে পালিয়ে যাওয়াটাও তার জন্যে সহজ কোনো বিষয় নয়। যে বাবা ছোটকাল থেকে তাকে একই সাথে বাবা ও মায়ের আদর দিয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে, তার সামান্যতম ক্ষতি হোক, সেটা সুফিয়া কল্পনাও করতে পারে না।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় সুফিয়া সুরতজান বিবির বুকে মাথা রেখে বেদনায় ভেঙে পড়ে। নিঃসন্তান সুরতজান বিবি সুফিয়াকে নিজের মেয়ে হিসেবে কল্পনা করে তার শূন্য বুকটা কিছুটা ভরে রাখত। সুফিয়ার এতটুকু ক্ষতি হোক তা সুরতজান বিবি চাইত না, তাই সুরতজান ওদের সাহায্যে এগিয়ে এল।

সাব্বির শুনতে পেল পরেশদার সৃষ্টি সুফিয়া সুরতজান বিবির সহায়তায় রাতের আঁধারে বাড়ির অদূরে পুরোনো শিমুল গাছটার তলায় বসে চানমিয়াকে স্বামী হিসেবে কবুল করল। শুধু তাই নয়, সে তার একমাত্র বৃদ্ধ পিতাকে ছেড়ে স্বামীর সঙ্গে অজানার উদ্দেশ্যে চিরদিনের মতো আশৈশব লালনভূমি পরিত্যাগ করল। এমন সময় সাব্বির অনুভব করল, তার মধ্যে মেয়েটির জন্যে একটি সফট কর্নার সৃষ্টি হয়ে গেছে। ওদিকে পরেশদার নায়িকা সুফিয়ার বাবা ওদের পালিয়ে আসার সাত দিনের মাথায় পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিল।

পরেশদার গল্পে কীভাবে গফুর মণ্ডলের প্রচেষ্টায় নইমুদ্দিন মুন্সী এক ঘরে হলো এবং ক্ষোভে, অপমানে কীভাবে তার জীবনলীলা সাঙ্গ হলো তার বর্ণনা চলছিল। শ্রোতাগণ ইলেকট্রিসিটির শক খাওয়া রোগীর মতো পরেশদার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। সাব্বিরের অবচেতন মন তখন সুফিয়ার পবিত্র প্রেমের জন্য এক লাখ ধন্যবাদের দ্বারা একটি মালা গাঁথতে শুরু করেছে। এমন সময় সে লক্ষ করল, সকলের মাঝ থেকে মন্টু কখন যেন চোরের মতো কেটে পড়েছে। মনটাতে কেমন যেন একটা সন্দেহের দোলা লেগে যায় তার।

মনে মনে বলে, ‘তুমি যে কোন দোজখে গেছ, তা কি আমি বুঝি না’?

রান্নাঘরের দরজাটা ভিতর থেকে ভেজানো দেখে সাব্বিরের সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হয়। দ্রুত কাছে এসে দরজায় কান লাগাতেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কিছু উত্তেজনাকর শব্দ শুনতে পায়। এক উন্মত্ত উত্তেজনায় শরীর কাঁপতে থাকে তার। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলতেই ভূত দেখার মত আঁতকে উঠে মন্টু ও নুরির মা। সাব্বিরের দেহে তখন পশুর উন্মত্ততা বিরাজমান। এক লাফে রান্নাঘরে ঢুকেই খট করে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।

রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসার সময় পেছন থেকে নুরির মা’র শ্লেষ মিশ্রিত কণ্ঠে সাব্বির শুনতে পেল, ‘আফনেরে তো এই লাগাত মানুষই মনে করতাম, আইজকা তো দেহি আফনেও একটা কুত্তা’।

সাব্বির যখন আসরে যোগ দিল পরেশদার গল্প তখন ক্লাইমেক্সে এসে পৌঁছেছে। পরেশদা তার নায়িকা সুফিয়াকে এই শহরেরই কোনো এক বস্তিতে এনে থেমে গেল। শ্রোতাগণ তখন সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল : তারপর কী হলো, তাড়াতাড়ি বলুন। পরেশদা বলল : আগে বলো সার্টিফিকেট কুড়াতে পেরেছি কিনা। শ্রোতাগণ এক বাক্যে বলে উঠল— হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর। পরেশদা এবার সাব্বিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

সাব্বির তখন সুফিয়া ও নুরির মার মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পেয়ে এর নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে। এমন সময় পরেশদার প্রশ্নে সে চমকে উঠল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল— হ্যাঁ, কু-কু-ড়াতে পেরেছেন।

শ্রোতাগণের একজন বলল : তারপর বলুন, সুফিয়ার কী হবে?

পরেশদা বলল : তারপর আর কী হবে? সুফিয়ার একটি সন্তান হবে। বোকা কিসিমের চানমিয়ার দুটি পাখা গজাবে এবং একদিন সাত সমুদ্দুর, তেরো নদী পাড়ি দিয়ে কোথায় যে লাপাত্তা হবে, কেউ তার হদিস পাবে না।

গল্প শেষ হওয়ার সাথে সাথে নুরির মা এসে জানাল, রান্না হয়ে গেছে। নুরির মা’র দিকে তাকাল সাব্বির। সেখানে কোনো পরিবর্তন দেখতে পেল না। অন্যদিনের মতো আজও নুরির মা হেসে বলল— রান্দা অইয়া গ্যাছে। সাব্বিরের তখন কেবলই মনে হতে লাগল, কাজটা বোধহয় সে ভালো করেনি।

নুরির মাকে দেখে পরেশদা রস মিশিয়ে অপেক্ষাকৃত নিচু গলায় বলল : তারপর সুফিয়া একদিন নুরির মা হয়ে এই মেসে আসবে, আর সেই থেকে মাঝে মাঝে আমাদের মন্টু মিয়ার ইয়ে হবে।

মন্টু বলল : এখন থেকে কাজটি সাব্বিরের সাথে ভাগাভাগি করে নেব।

পরেশদা বলল : তা আর হবে না। এমন কাজ সাব্বির আর কখনো করবে না। তোমার ভাগেও আর যাতে শিকে না ছেঁড়ে, সে ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করা হচ্ছে।

অন্যেরা কিছু বুঝতে না পেরে পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। এদিকে সাব্বির অপরাধী হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল, আর মনে মনে ভাবতে থাকল— পরেশদা’র চোখ একই সময়ে চারদিকে এমন সমান গতিতে দৌড়ায় কেমনে!

পরেশদা উঠতে উঠতে বলল : কাল তোমরা সকলে প্রস্তুত থেকো, সাব্বির আমাদের চাইনিজ খাওয়াবে।

সাব্বির বলল : তাহলে টাকাটা আজই দিয়ে দিন।

গল্পের আসর শেষ হলো, রাতের খাওয়াও শেষ হলো। এদিকে আষাঢ়ের বাদল দিন শেষে বাদল রজনীও বয়ে চলল, কিন্তু ঝরোঝরো বাদল ক্লান্তিহীন ঝরেই যাচ্ছে, থামার নামটি নেই।

এমন বাদল রজনীতে ঘুমের মজা লাখ টাকা দিয়েও কেনা যায় না। তাই মেসের বাসিন্দাগণ লাখ টাকার সুখ বিনে পয়সায় ভোগ করতে যে যার রুমে চলে গেল। নুরির মাও যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো। এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, দিনরাতের বিরতিহীন বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট জলে ডুবে একাকার। বাইরে কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই।

পরেশদা বলল, ‘নুরির মা, এই দুর্যোগে রাস্তায় বাইর হওয়া তোমার ঠিক হইব না, বিপদ হইতে পারে। তুমি বরং ঐ পাটিটা রান্নাঘরে বিছায়া নিয়া রাত্রিটা এইখানেই কাটায়া দেও’।

নুরির মা বলল, ‘না না, এইরহম কানা রাইতে আমার নুরি একলা থাকবার পারত না, মাইয়াডা ডরেই মইরা যাইবগা। তাছাড়া রাস্তায় আমার আর ডর ক্যার লাইগ্যা, আমার আর আরানির কিছু বাহি আছেনি’। এই বলে নুরির মা সাব্বিরের দিকে আড়চোখে তাকায়। নুরির মা’র দিকে না তাকিয়েও তার চোখের ভাষা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না সাব্বিরের।

পরেশদা বলে, ‘তোমার হারানোর কিছু নাই, তা বুঝলাম; কিন্তু দেহের ভিতরে তোমার যে জানখানা আছে তার মূল্য তোমার কাছে না থাকলেও তোমার নুরির বাঁইচা থাকার লাইগা খুবই মূল্যবান। তাছাড়া তুমি তো এর আগেও থাকছ। তোমার বস্তির ঘরের পাশের ঘরে যে খালা থাকে বলছিলা, সেই তোমার মেয়েকে তার রুমে নিয়ে রাখবে’।

পরেশদা যে ঠিক বলেছে, তা নুরির মাও বোঝে। তার নিজের হারানোর কোনোকিছু না থাকলেও একমাত্র কলিজার ধন নুরির জন্যে হলেও হারানোর অনেক কিছুই এখনো তার কাছে আছে। সে না থাকলে এতিম মেয়েটা কোথায় যাবে, কী খাবে, কে ওকে দেখে রাখবে? না না, কেউ দেখবে না, কেউ রাখবে না বরং রাস্তার কুত্তাগুলো তার অসহায় মেয়েটাকে খোবলে খোবলে খাওয়ার জন্যে জিহ্বা তেতিয়ে রাখবে। তাই ঠিক করল, এমন দুর্যোগ মাথায় নিয়ে সে আজ আর বের হবে না। পাশের ঝুপড়িতে যে খালা থাকে, বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে সে কোনো কামকাজ করতে পারে না। নুরির মতো এরকম আরও অনেক মেয়েকে সে দেখেশুনে রাখে। বিনিময়ে সবাই মিলে তাকে একটা মাসোহারা দেয়। এই মাসোহারা দিয়েই আধপেটা করে তার দিন চলে যায়। কোনো দিন, কোনো কারণে ঘরে ফিরতে না পারলে কিংবা ফিরতে দেরি হলে খালা তার মেয়েটাকে তার ঘরে নিয়ে রাখে। নুরির মা তাই থেকে যাওয়ার জন্যে অনেকটা সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। পরেশদা তখন আরও জোরালভাবে তাকে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিল। অতঃপর নুরির মা পাটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

এতক্ষণ ডাইনিং টেবিলের এক কোণে বসে মন্টু আয়েসের সাথে সিগারেট টানছিল। সাব্বির লক্ষ করল, নুরির মা’র রাতে থেকে যাওয়াতে মন্টুর চোখের কোণে কী যেন একটা খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠল। সাব্বির তখন রাগে কটমট করে মন্টুর দিকে তাকিয়ে তার রুমে চলে গেল। অতঃপর মন্টু আর পরেশদাও তাদের নিজ নিজ রুমে ঢুকে গেল।

বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি দিচ্ছে সাব্বির। বাইরে আষাঢ়ের তুমুল বৃষ্টি, মাঝে মাঝে বিজলি দিয়ে বজ্রপাত আর থেমে থেমে দমকা বাতাস বইছে। এমন রাতে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর মজাই আলাদা। কিন্তু সাব্বিরের ঘুম আসছে না। পরেশদার আষাঢ়ে গল্পের নায়িকা সুফিয়া, বারবার তার ঘুমের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নুরির মা’র শ্লেষ মিশ্রিত সেই ঘৃণাভরা উক্তি, যা আজ সন্ধ্যারাতে সে নুরির মা’র মূল্যায়ন থেকে অর্জন করেছে। এটা সেটা ভাবনার মধ্যে অনেক দিন পর আজ তার প্রয়াত বাবা, বিধমা মা আর অতি আদরের ছোট্ট বোন সাইমার কথাও মনে আসতে লাগল। ছোটো বোন সাইমা আর তার মাঝে বয়সের পার্থক্য চার বছর হলেও, ছোট বেলা থেকেই দুই ভাইবোনের মাঝে এটা সেটা নিয়ে সারাক্ষণ খুনসুটি লেগেই থাকত। এসব খুনসুটিজনিত অভিযোগ আর পালটা অভিযোগের মীমাংসায় মাকে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতে হতো। আর এসব খুনসুটির ভিতর দিয়ে বড় হতে হতে, একমাত্র ছোট বোনটি স্নেহ, আদর, ভালোবাসার দাবি নিয়ে তার অস্তিত্বের সবটুকুই দখল করে নিয়েছে।

সাব্বির শৈশবে যে খুব একটা ডানপিটে ছিল, তা কিন্তু নয়। অথচ একবার পাড়ার এক বখাটে তার বোনটিকে উত্যক্ত করছে, এমন অভিযোগ পেয়ে ছেলেটিকে এমন মার দিয়েছিল যে ওকে শেষ অবধি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। অথচ নিজ বোনের জন্য এমন দরদি ভাই কিনা একটি অসহায় মেয়ে— নুরির মাকে… না না সে আর ভাবতে পারছে না। নুরির মার সাথে এমন আচরণ করায় তার এখন খুবই খারাপ লাগছে, প্রচণ্ড অনুশোচনা হচ্ছে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একবার সে নিষিদ্ধ পাড়ায় গিয়েছিল, কিন্তু যে উৎসাহ আর জৈবিক তাড়না নিয়ে গিয়েছিল সেখান থেকে ফিরে এসে ততোধিক অনুশোচনায় ভুগেছিল অনেকদিন। তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল, বাকি জীবনে সে আর কোনোদিন ওই পাড়ায় যাবে না। তার এ প্রতিজ্ঞা এখনো সে রক্ষা করে চলেছে। সার্বিক বিচারে সে নিজেকে পরিমাপ করে দেখতে পেল, ছেলে হিসেবে সে এতটা খারাপ না, যদিও সঙ্গদোষে দুই একবার গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়েছিল। যেমন আজ এমনি একটি গর্হিত কাজ করেছে কেবল সঙ্গদোষে— মন্টুর কারণে। এ মুহূর্তে মন্টুকে খুন করতে ইচ্ছে করছে তার, মনে মনে ভাবছে— এই হারামিকে খুন করতে পারলে আজকের এই বাদল রাতের ঘুমের মজাটা পুরোপুরি উপভোগ করা যেত। আজ এ মুহূর্তে সে আবারও প্রতিজ্ঞা করল— আজ সন্ধ্যায় নুরির মা’র সাথে যে অপকর্ম করেছে, এমন অপকর্ম ভবিষ্যতে আর কোনোদিন করবে না সে। আরও ঠিক করল, সকাল হলে তার এমন অপকর্মের জন্যে সে নুরির মা’র কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।

হঠাৎ সাব্বিরের ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। এতক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না বলে সুইচ অফ করতে ভুলে গিয়েছিল। বাতি নেভাতে গিয়ে মনে হলো, হিসু করতে হবে। ওয়াশরুমটা ডাইনিং ও রান্নাঘরের পরে। রাতে সাধারণত ডাইনিংয়ের বাতি সারারাত জ্বালানো অবস্থায় থাকে। কিন্তু আজ সেটি নেভানো দেখতে পাচ্ছে। নিজের ঘরের আলোতে কিছুটা আলোকিত হওয়ায় ডাইনিং স্পেসের বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন মনে করল না সে। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল রান্নাঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে এবং ভেতরে কিছুটা চাপা কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ লাগাতেই দেখে মন্টু ভেতরে। মন্টু অনেকটা জোরপূর্বক নুরির মাকে কাছে টানতে চাচ্ছে, কিন্তু নুরির মা কাছে আসতে চাচ্ছে না— বাধা দিচ্ছে। ওদের চাপা উত্তেজনার কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল সে— হ্যাঁ, এই তো ভালোই শুনতে পাচ্ছে।

মন্টু বলছে : তোমার নুরির অসুখের সময় যে টেকাগুলো নিছিলা তার একটেকাও তো শোধ দেও নাই। সে না হয় না দিলা, অসুবিধা নাই। আমি সে টেকা ফেরত নিতেও চাই না। কিন্তু এর বদলে একটু, আধটু সুযোগ তো দিবা।

জবাবে নুরির মা বলছে : আমার নুরির ব্যারামের সময় যে টেকা দিছিলাইন, তা শোধ দিতে পারছি না দেইখাই তো আইজ সন্ধারাইত লাগাতরি সুযোগটা লইছুইন। আমিও সুযোগ দিছি। কী করবাম, পেট চালাইতে পারি না, টেকা শোধ দিবাম কই থাইক্যা? কিন্তুক অতদিন যে সুযোগ নিছুইন, তা দিয়া পাওনা দাওনা শোধবোধ, আর না।

মন্টু বলছে : আচ্ছা তোমার কথাই ঠিক, আগে যা দিছি তা এতদিনে শোধবোধ। কিন্তু তোমার মেয়ের স্কুলের বেতন যে আটকায় গেছে, সেইটা কেমনে দিবা? একটু সুযোগ দেও, আমি সব বেতন ক্লিয়ার কইরা দিব।

নুরির মা বলে : না, তা আর অইব না। দরকার অইলে নুরির লেহাপড়া বন্ধ দিবাম, তাও আর এই কাম করতাম না।

মন্টু এবার জোর খাটায়, ধ্বস্তাধস্তি শুরু হয়। নুরির মা অনড়, এ কাজ সে আর করবে না। কিন্তু মন্টু এবার নাছোড়বান্দা। সে নুরির মাকে জাপ্টে ধরে। নুরির মা উপায়ান্তর না দেখে পাশে থাকা মাছ-মাংস কাটার দা হাতে উঁচিয়ে ধরে, বলে— খবরদার, আর এক পাও আগাইলে খুন কইরালবাম।

কিন্তু ক্ষীণকায় নুরির মা তার সংকল্পে যতটা অনড়, তার দা তাকে ততোটা সহায়তা দিতে পারেনি।

এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য ধারণ করেছিল সাব্বির, কিন্তু আর পারল না। সাব্বির সজোরে দরজায় লাথি দিল, দরজা খুলে গেল। এক লাফে ভেতরে ঢোকেই সে মন্টুর হাত থেকে নুরির মাকে ছাড়িয়ে আনল। তারপর মন্টুকে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি মারতে শুরু করল। ঘটনার আকস্মিকতায় মন্টু প্রথমে একটু ভড়কে গিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিল, কিন্তু আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে উঠে সেও সাব্বিরের উপর পাল্টা আঘাত শুরু করল। দেহের গঠন কাঠামোর কারণে সাব্বির মন্টুর সাথে পেরে উঠছিল না। সুঠাম দেহের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এক অজানা কারণে মন্টু সাব্বিরকে ভয় পেত। অথচ এ মুহূর্তে সে মন্টুর হাতে এমন বেপরোয়াভাবে মার খাচ্ছে, যা তার ইগোতে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করল। সে নিজেকে সামলাতে না পেরে নুরির মা’র হাতে থাকা দা’টি একটানে নিজের হাতে নিয়েই এক ঘা বসিয়ে দিল। দা’টি মন্টুর বুকের বাম পাশ বরাবর বসে গেল। তাৎক্ষণিক ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করল। মন্টুর দেহের রক্তে সাব্বিরের এবং নুরির মা’র দেহও ভিজে ছোপ ছোপ হয়ে উঠল। নুরির মা চিল্লায়ে উঠল, ‘হায় হায়! এইডা কি করলাইন, খুন কইরালছুইন? অহন কী অইব’! এই বলে সে সাব্বিরের হাত থেকে দা কেড়ে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিল, কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তা ঘটে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সাব্বির কী করবে, কিছুই বুঝতে না পেরে ঘরের মেঝেতে বিমূঢ় হয়ে বসে পড়ল।

নুরির মা’র চিল্লানো আর মন্টুর আর্ত চিৎকারে মেসের সকলে এসে রান্নাঘরে জড়ো হলো। মন্টুর বুক থেকে তখনো ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, সে রক্তে পুরো মেঝে সয়লাব। সাব্বির তখনো থ’ মেরে মেঝেতে বসে আছে, পাশেই নুরির মা দাড়িয়ে কাঁপছে আর মন্টু তার দুই হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে গোঙাচ্ছে— কোনো কথা বলতে পারছে না। এদিকে রক্তমাখা দা-টি মেঝেতে পড়ে অপরাধবোধ নিয়ে ওদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। পরেশদা স্বগতোক্তি করে বলল, ‘আমি আগেই আন্দাজ করছিলাম, আজ এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। শেষে আন্দাজের চেয়েও বড় ঘটনা ঘটল। এতদিন মন্টুটাকে শোধরানোর একটা উপায় খুঁজছিলাম, কিন্তু তার বুঝি আর প্রয়োজন থাকল না। যাকগে, এখন অন্য কোনো কিছু ভাবার বা জানার সময় নাই। মণ্টুকে হাসপাতালে নিতে হবে এখনই’।

সাব্বিরকে তার রুমে আর নুরির মাকে অন্য একজনের রুমে তালাবদ্ধ রেখে পুলিশ কল করা হলো এবং মেসের দুই সদস্যকে এদের পাহারায় রাখা হলো। পরেশদা নিজে অন্য আরো দুইজনের সহায়তা নিয়ে মন্টুকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দিল।

মন্টুর গোঙানি ততক্ষণে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এসেছে,একটা হালকা গোঙানির আভাস ছাড়া তেমন কোনো আওয়াজ নেই। বৃষ্টি কিছুটা থামলেও টিপটিপানি থামেনি। শহরের অলিগলিসহ মেইন রোড পানির নিচে তলিয়ে আছে। রাস্তায় রিকশা, টেম্পো কোনোকিছুরই অস্তিত্ব নেই। নিস্তেজ হয়ে আসা মন্টুর শরীরটাকে আগপাছ করে দুইজনের কাঁধে করে ওরা হেটে যাচ্ছে হাসপাতালের দিকে। এমন সময় আবার বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে হাটতে হচ্ছে তাদের, কাজেই হাঁটার গতি মন্থর। পরেশদা মোবাইল ফোনের আলোতে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে পৌঁছাতে ওদের অনেকটাই সময় লেগে গেল। ততক্ষণে মন্টুর দেহ একেবারেই নিস্তেজ, কোনো গোঙানির শব্দ নেই। দ্রুত ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানাল— আর নেই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অতঃপর লাশ মর্গে রেখে ওরা মেসে ফিরে এল।

পুলিশ ততক্ষণে এসে গেছে। ঘটনার আলামত, সাব্বির আর নুরির মাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও মেসের বাদবাকি সদস্যদের বক্তব্যে নিশ্চিত হয়ে নুরির মাকে পরেশদার জিম্মায় রেখে সাব্বিরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, পুলিশের অনুমতি ছাড়া কেউ যেন কোথাও না যায়।

থানার গারদে অন্ধকার কক্ষে সাব্বির বসে আছে। এতক্ষণ সে যা কিছু করেছে সব যন্ত্রচালিতের ন্যায় করে গেছে, কোনোকিছুর ভাবনাই তার মাঝে কাজ করেনি। কিন্তু এখন আস্তে আস্তে নানান ভাবনা তার মাঝে এসে ভর করছে। সন্ধ্যায় গল্পের আসর থেকে শুরু করে শেষ অবধি ঘটনাগুলো একে একে মনে করতে থাকল সে। এসব ঘটনায় চারণ শেষে তার মন চলে গেল গ্রামের বাড়িতে। বছরখানেক হলো বাবা গত হয়েছেন। একমাত্র আদরের ছোট বোনটি এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে। তার নিজের লেখাপড়ার খরচ, বোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতে গিয়ে বিধবা মা যে কতটা হিমশিম অবস্থায় দিন পার করছেন তা ভাষায় কাউকে বোঝানো সম্ভব না। সামনে তার অনার্স ফাইনাল। এরপর মাস্টার্স শেষে সে চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে, সে আশায় অসহায় মা বুক বেঁধে বসে আছেন। এমেই যখন অবস্থা, তখন আজ এই সময়ে সে খুনের আসামি। আজ সন্ধ্যায় যে ছিল গল্পের আসরে, সে কিনা শেষরাতে এসে জীবনের এক কঠিন বাস্তবতায় জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে!

এ খবর তার বিধবা মা আর আদরের ছোট বোন যখন শুনবে, তখন কীভাবে তারা তা সহ্য করবে সেটা ভেবেই তার কাতর মন অস্থির হয়ে উঠল।

সাব্বির লক্ষ করল অন্ধকার কক্ষটা আস্তে আস্তে আলোকিত হচ্ছে, এতক্ষণ নিজের শরীর নিজে দেখতে না পেলেও এখন হালকা দেখা যাচ্ছে। জানালাবিহীন কক্ষটার দেয়ালে জায়গায় জায়গায় ফুটো করে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারই একটি দিয়ে বাইরে একটি নাম না জানা গাছের কয়েকটি পাতাসমেত একটি ডালের অংশ দেখা যাচ্ছে। পাতাগুলো সূর্যের কিরণে চিকচিক করছে। তার মানে বাইরে বৃষ্টিহীন আকাশে নতুন দিনের বার্তা নিয়ে আকাশে সূর্যোদয় হয়েছে, কিন্তু তাতে তার জন্য নিশ্চিতভাবেই কোনো শুভবার্তা নেই।

লোহার গরাদে ঠেস দিয়ে উল্টোদিকের দেয়ালের দিকে মুখ করে বসেছিল সাব্বির। হঠাৎ পেছন থেকে পরেশদা ডাক দিল : সাব্বির, এদিকে তাকাও, দেখ সুফিয়া তোমাকে দেখতে এসেছে।

চমকে উঠল সাব্বির। গতরাতের আষাঢ়ে গল্পের নায়িকা সুফিয়া বাস্তবে তাকে দেখতে এসেছে! চকিতে ফিরে তাকায় সে। কিন্তু কই সুফিয়া? সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে তো নুরির মা আর তার পাশে আট/নয় বছরের একটি ছোট্ট মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত সে নুরি হয়ে থাকবে। কিন্তু আর তো কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে! তার কৌতূহল থামিয়ে দিয়ে নুরির মা’র প্রতি ঈশারা করে পরেশদা বলল : কাকে খুঁজছ তুমি, এই হলো আমাদের সুফিয়া।

মলিন হাসে সাব্বির। বিমর্ষ বদনে বলে : পরেশদা, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, পরম বাস্তবতা মোকাবেলা করার এই সময়ে, আপনার আষাঢ়ে গল্প শোনার ইচ্ছে এখন আমার নেই।

পরেশদা বলল : না সাব্বির, আমি তোমাকে কোনো আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছি না। তাছাড়া আমার গতরাতে বলা গল্পটাও আষাঢ়ে গল্প ছিল না। এটা ছিল একটা গ্রাম্য মেয়ের বাস্তব জীবনের গল্প আর সে গল্পের বাস্তব চরিত্র সুফিয়া এখন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে— আমাদের নুরির মা। আর এই যে ছোট্ট মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছ, সে হলো নুরি— নূরুন্নাহার, সুফিয়ার মেয়ে। ঘোরতর বিপদের মাঝেও সাব্বিরের অবচেতন মন কৌতূহলে লাফিয়ে উঠল— তাহলে চানমিয়া কোথায়?

‘দুর্ভাগ্যক্রমে চানমিয়া মাদক চোরাকারবারের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল। চোরাকারবারিদের এক অন্তরকোন্দলে জড়িয়ে বোকা চানমিয়া খুন হয়েছে।’ পরেশদা জানায়।

‘কিন্তু কীভাবে’? আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করে সাব্বির।

‘সে কাহিনী শোনা, তোমার জন্যে এখন জরুরি নয়।’ পরেশদা মৃদু ধমকে ওঠে।

তারপর গলার আওয়াজ যথাসম্ভব নিচে নামিয়ে বলে : শোনো, তোমার জন্যে একটা বিশেষ খবর আছে। আর তা হলো মন্টুকে তুমি খুন করোনি। খুন করেছে সুফিয়া। সুফিয়া তার সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে তার হাতে থাকা দা দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মন্টুকে আঘাত করেছিল, কিন্ত তাকে খুন করার কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। মন্টুর দুর্ভাগ্য, সে মরে গেল। আর একটি কথা, গত সন্ধ্যায় সুযোগ নিয়ে সুফিয়ার সাথে তুমি যা করেছ, তা সে মনে রাখেনি। তোমাকে সে ক্ষমা করে দিয়েছে। তবে এই ক্ষমার পেছনে একটি শর্ত আছে, তা হলো— জন্মগতভাবে নুরি হার্টের রোগী। তাই কিছুদিন পরপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কিন্তু আর্থিক অসামর্থ্যের কারণে সে মেয়েটির যথাযথ চিকিৎসা করাতে পারেনি। টুকটাক চিকিৎসা খরচ মেটাতে আমি যতদূর সম্ভব সাহায্য করেছি। আরও সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু লাজুক সুফিয়া বারবার আমার কাছে হাত পাততে লজ্জা বোধ করত। তাই সহজ-সরল সুফিয়া আমার অজান্তেই মন্টুর খপ্পরে পড়েছিল। তোমার নিকট সুফিয়ার প্রত্যাশা, তুমি তার মেয়েটিকে যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তুলবে।

ব্যস্ত হয়ে সাব্বির কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু পরেশদা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল : এখানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। খুন কে করেছে, তা আমরা কেউ নিজ চোখে দেখি নাই, মন্টুও নিজ থেকে কারও নাম বলে যায়নি। কাজেই সম্ভ্রম বাঁচাতে সুফিয়াই হাতে থাকা দা দিয়ে মন্টুকে খুন করেছে, এটাই বিশ্বাসযোগ্য। নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে খুনের দায়ে সুফিয়ার ফাঁসি হবে না। তবে খুনের দায়ে সাজা হবে, এমনকি যাবজ্জীবন হতে পারে। সে জন্যে বড়ভাই হিসেবে তোমার উপর এটা আমার আদেশ হিসেবে থাকল— নুরির লেখাপড়া, চিকিৎসা ও ভরণপোষণসহ তার সকল কিছুর ভার তোমাকে বহন করতে হবে। ঘণ্টা দুই পরেই তোমাকে আদালতে তোলা হতে পারে। তোমাকে আদালতে তোলার একই সময়ে আদালতে হাজির হয়ে সুফিয়া খুনের দায় স্বীকার করে হলফনামা দেবে। এর আগেই আমরা শহরের সবচেয়ে নামকরা উকিল নিয়োগ করতে যাচ্ছি। কাজেই এ মুহূর্তে অন্য কিছু ভাবার মতো সময় আমাদের হাতে নাই। ও হ্যাঁ, তোমার মা আর বোনকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা তোমার সাথে দেখা করার জন্যে রওনা দিয়েছেন।

কথাগুলো একনাগাড়ে বলে সাব্বিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সুফিয়াকে নিয়ে পরেশদা বেরিয়ে গেল।

ওরা চলে গেল। ঘটনাগুলো এত দ্রুত একটার পর একটা ঘটে যাচ্ছে যে কোনো কিছুর ভাবনাই এখন সাব্বিরের মাথায় কাজ করছে না। তবে এর মাঝেও দুটি বিষয় তার মস্তিষ্কে বারবার আঘাত করছে, কোনটি গ্রহণ করবে সে— তার বিধবা মা, আদরের ছোট বোন আর পরেশদার আদেশে সদ্য দায়িত্ব পাওয়া নুরির বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে জীবনের দিকে আগানো, নাকি পরম সত্যটাকে স্বীকার করে নিয়ে নির্দোষ সুফিয়াকে তার মেয়ের অবলম্বন করে তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া।

কোনটি সে গ্রহণ করবে? নিজেকে নিজে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে, কিন্তু নিশ্চিত সমাধানসূচক জবাব আসছে না ভেতর থেকে।

ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে অনেকটা জোর করেই সে একটা সিদ্ধান্তে এসে গেল— নিজের জীবন লাভের বিনিময়ে নির্দোষ, অসহায় সুফিয়ার জীবনকে কোনো বিচারেই সে দুর্বিষহ করে দিতে পারে না; পারে না নুরি নামের ছোট্ট এই মেয়েটিকে তার মায়ের আদর স্নেহ থেকে তাকে বঞ্চিত করতে।

এক অসহায়, নিঃসম্বল নারী নুরির মা, পদে পদে নিগৃহীত হওয়া ছাড়া জীবনে যার অন্য কোনো প্রাপ্তি নেই, সেই কিনা এত অবলীলায় অন্যের খুনের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে নিতে চায়! নুরির মা’র পক্ষ নিয়ে সে মন্টুকে প্রতিহত করেছিল বটে, আর তাতেই নুরির মা তার প্রতি সাব্বিরের কিছুক্ষণ আগের অপকর্ম সব ভুলে গেল! কত সহজেই না ওরা ওদের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায় ভুলে যেতে পারে! এটা ঠিক যে, খুনের ঘটনাটি ঘটেছে নুরির মা’কে ঘিরেই, কিন্তু খুন তো নুরির মা নিজে করেনি। তাকে বাঁচানোর জন্যে নুরির মা’র এমন মহানুভবতার কাছে পরাজয় বরণ করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। তাই সত্য আঁকড়ে ধরে থাকাই শ্রেয়।

অবশেষে নিজের মনকে নিশ্চিত করল সাব্বির— সত্য আঁকড়ে ধরেই থাকবে সে। সত্য ধরে থাকার ভাবনায় মনকে যখন তিন সত্যি নিশ্চিত করতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে অতি পরিচিত এক আর্তচিৎকারে ফিরে তাকাল সে।

‘ভাইয়া, এইটা তুই কী করলি রে, কী করলি?’ বলে ডুকরে কেঁদে এগিয়ে আসছে অতি আদরের বোন সাইমা আর তার পেছনে ‘এইডা ক্যামনে অইল রে বাবা, ক্যামনে অইল!’ বলে বিলাপ করতে করতে এগিয়ে আসছে মমতাময়ী মা।

হঠাৎ মা আর বোনকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে সাব্বিরের কাতর মন আবার বিচলিত হয়ে ওঠে। তাদের আহাজারির কোনো জবাব দিতে পারে না, কেবল অপলক দৃষ্টিতে নির্বাক তাকিয়ে থাকে।

আবদুল মতিন

আবদুল মতিনের জন্ম ১৯৬৪ সালে, ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলাধীন উচাখিলা নামক গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক। অতঃপর ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৎস্যবিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। সাবেক ব্যাংকার। বর্তমানে সোনালী ব্যাংক পিএলসি থেকে ডিজিএম হিসেবে অবসর উত্তর ছুটিতে আছেন।

প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোনোর পরপরই সাহিত্য জগতে পদচারণা শুরু করেন। কবিতা দিয়ে লেখালেখির জগতে প্রবেশ ঘটলেও ছোটগল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী সবকিছুতেই বিচরণ রয়েছে। ইতোমধ্যে তার ‘ক্রোধ’ (প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন) ও ‘দীক্ষা’ (প্রকাশক : নবসাহিত্য প্রকাশনী) নামে দুটি কবিতার বই এবং ‘মন মাঝে মনকথন’ (প্রকাশক : অনার্য পাবলিকেশন্স লি.) নামে একটি প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই কন্যাসন্তানের জনক।

 

Print Friendly, PDF & Email
আবদুল মতিন

আবদুল মতিন : জন্ম ময়মনসিংহ জেলার উচাখিলা নামক গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক, অতঃপর ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী আনন্দমোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাৎস্য বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। পেশায় ব্যাংকার। ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড-এ কর্মরত।

ব্যাংকারের কঠিন, নিরস ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিয়োজিত থাকার কারণে পেশার বাইরে সাহিত্য সাধনার মতো কাজের জন্য সময় বের করা খুবই দুরূহ ব্যাপার, তথাপি লেখালেখি করেন নিজের সাহিত্য রসের তাড়না থেকেই। নিজের খেয়ালে লিখেন গল্প, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে। ইতোমধ্যে 'অনুপ্রাণন প্রকাশন' হতে 'ক্রোধ' নামে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে তিনি দুই কন্যাসন্তানের জনক।

Read Previous

কৃষ্ণচূড়া

Read Next

ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ : ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *