
ম্যানেজার বেচারা ঠিক বুঝতে পারছেন না, আমাকে নিয়ে কী করবেন! কী শাস্তি দিলে আমাকে ঠিকঠাক শায়েস্তা করা হবে।
মাঝবয়সী গোলগাল চেহারার ম্যানেজার সরু চোখে তাকিয়ে আছে।
—আপনার পকেটে টাকা নাই, খাইতে আসছেন কোন সাহসে?
মিনমিন করে বললাম, সাহস করে আসিনি, খিদের তাড়নায় এসেছি। গতকাল থেকে আমার পেটে কিছু পড়েনি। গোস্তাকি মাফ করবেন হুজুর!
ম্যানেজার কষে আমার গালে একটা চড় মেরে বলল, কুত্তার বাচ্চা মিথ্যুক… তোরে আমি…!
চড় খুব একটা লাগেনি। তাছাড়া গোলগাল মানুষের গায়ে শক্তি থাকে কম। ম্যানেজার সাহেবের গায়েও শক্তি কম। একটা চড় মেরেই ম্যানেজার হাঁপাতে লাগলেন। হাঁপাতে-হাঁপাতে এক সময় শুরু হলো কাশি। মনে হয় শ্বাসকষ্ট আছে।
বললাম— ম্যানেজার সাহেব, মারতে চাইলে আরও মারেন, বিনা পয়সায় খেয়েছি, আমার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার।
ভেবেছিলাম, দু-চারটা চড় থাপ্পড় মারলে মানুষের রাগ কমে; এরও কমবে। কিন্তু না ম্যানেজার সাহেব আর মারলেন না। কাশতে কাশতে বললেন, হারামজাদারে দড়ি দিয়া বাইন্ধা রাখ। স্যার আসুক, তারপর বিধি-ব্যবস্থা!
ম্যানেজারের কথামতো দুইজন আমাকে পিছমোড়া করে বেঁধে, স্টোর রুমে আটকে রাখল। স্টোর রুম মানে তরি-তরকারি, আটা-ময়দা, তেল-সাবানের ঘর। ঘরজুড়ে একটা গুমোট গন্ধ। ইঁদুর-তেলাপোকার বিষ্ঠার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।
স্যার বলতে মনে হয় মালিকের কথা বুঝিয়েছে। স্যার কখন আসবে কে জানে! কিন্তু স্যার না আসা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হবে না এটা কনফার্ম। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নাই। কিন্তু এই দীর্ঘ সময় কাটবে কীভাবে!
ঘুমের চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রচণ্ড বৈরী পরিবেশে ঘুমিয়ে পড়ার অসাধারণ ক্ষমতা আছে আমার। কিন্তু না এখন ঘুম আসছে না। মনে হয় সূক্ষ্ম অপমানবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
এটা ঠিক যে জীবনে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু এরকম পিছমোড়া করে বেঁধে রাখার পরিস্থিতিতে কখনো পড়িনি।
ঘটনা মামুলি অনেকদিন থেকেই ভাবছি সুলতানস-এর বিরিয়ানি খাব। কিন্তু টাকাপয়সার অভাব; ঠিকমতো ভাতই জোটে না তার উপর আবার বিরিয়ানি। বেকারজীবন টিউশুনি করে পাই পাঁচ হাজার টাকা। মেস ভাড়া দুই হাজার, মাকে পাঠাই দুই হাজার, বাকি থাকে এক হাজার। ওটা দিয়ে না হয় খাওয়া, না হয় পকেট খরচ। তাই মাঝে মাঝেই সমীরের কাছে হাত পাততে হয়। একই গ্রামের একই ক্লাসের হওয়া সত্ত্বেও সমীরের ইনকাম বেশি। কারণ সমীর সায়েন্সের টিচার। সমীর চাওয়া মাত্রই টাকা দেয় না। আজ না কাল, কাল না পরশু বলে দুইদিন ঘুরিয়ে তারপর দেয়। সমীরের এই টেকনিকটা আমি জানি; তাই প্রয়োজনের এক সপ্তাহ আগে টাকাটা চাই। সুলতানস-এর বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য গত সপ্তাহে ধার চেয়েছি; সমীর আজ দুই হাজার টাকা দিয়েছে।
কোনোদিকে না তাকিয়ে সুলতানস-এর দিকে রওনা হয়েছি। পথে রিয়াজের সাথে দেখা। রিয়াজের ভয়াবহ জুয়ার নেশা। বলল, হবে নাকি একদান?
জুয়ার নেশা বড় নেশা। আমি সেই নেশা সম্বরণ করলাম।
—কী দিয়ে খেলব? টাকাপয়সা নাই।
—আরে ধুর… খেলতে আবার টাকা লাগে নাকি! আমার কাছে আছে, চল যাই।
—না রে, আমার কাজ আছে, যেতে হবে। এখন খেলব না।
রিয়াজ আমার হাত চেপে ধরে বলল, না খেললেও আমার সাথে থাক। তোর রাশি ভালো। জিতলে বিরানি খাওয়াব।
অগত্যা যেতে হলো।
জুয়ার আড্ডা বসেছে শওকতের ঘরে। রিয়াজ খেলছে, আমি পাশে বসে আছি। রিয়াজের আজ হাত খুলে গেছে। একটার পর একটা দান মারছে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, তুই লাকি… তুই লাকি…।
আমার ভাগ্যে রিয়াজের জেতা দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। আমিও খেলা শুরু করলাম। প্রথম দানেই এক হাজার টাকা লাভ। উৎসাহিত হয়ে আবার খেললাম; আবারও লাভ। ওদিকে রিয়াজ হারা শুরু করেছে। আমি শুধু জিতছি আর জিতছি। একসময় রিয়াজ ফতুর আর আমার হাতে নয় হাজার টাকা।
বললাম, বন্ধু আর না, আমাকে যেতে হবে।
এখন শওকত আর রিয়াজ একদল।
শওকত চিৎকার করে বলল, যাবি মানে… খেলা তো এখনো শেষ হয়নি।
রিয়াজ বলল, আমাদের সবাইকে ফতুর করবি, তারপর যাওয়া।
সুতরাং খেলা শুরু হলো। এক ঘণ্টার মধ্যে আমি ফতুর; সব টাকা শওকতের পকেটে।
পরাজয়ের দুঃখ সইতে না পেরে রিয়াজ চিৎকার চেঁচামেচি করে চলে গেল। পরাজিত আমিও ধীরে ধীরে বেরিয়ে পড়লাম।
কিন্তু সুলতানস-এ বিরিয়ানি খাওয়ার নেশাটা আবার ফিরে এল। উপায় কী?
ঠিক করলাম যা থাকে কপালে, আজ বিরিয়ানি খাবই খাব। পরেরটা পরে দেখা যাবে। যেই কথা সেই কাজ। সুলতানসে বসে পেটপুরে বিরিয়ানি খেলাম। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। এখন আমি হোটেলের গুদামঘরে; চারিদিক অন্ধকার, হাত পিছমোড়া করে বাঁধা।
দরজায় খুটখাট শব্দ, মনে হয় দরজা খোলা হচ্ছে। রিনরিনে নারী কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে— ভাত চোর মানে… ভাত আবার কীভাবে চুরি করে?
ম্যানেজারের তেলমিশ্রিত কণ্ঠস্বর, ভাত চোর না ম্যাডাম… বিরানি চোর…
দরজা খোলার সাথে সাথে একরাশ আলো এসে পড়লো আমার মুখে; আলোর ঝলকানি ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে দিলো। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না শুধু একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছি।
—কোথায় তোমাদের বিরানি চোর… দেখি দেখি…
কিছুক্ষণ চুপচাপ; মনে হয় আমাকে দেখছে, এরপর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল— ওমা, এতো দেখছি একটা মানুষ…হি হি হি…।
কণ্ঠটা এত পরিচিত যে, মনে হচ্ছে এই কণ্ঠধারী আমার অনেকদিনের জানা, অনেকদিনের পরিচিত। এত বেশি পরিচিত যে, আমি কণ্ঠধারীকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লাম।
চোখে আলো সয়ে যাওয়ার পর দেখি, আমাকে বিস্ময়ের সাগরে ডুবিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিমু। পাশে মোটাসোটা চেহারার একজন লোক। সম্ভবত এটাই শিমুর হাজব্যান্ড। বয়সে নির্ঘাত শিমুর চেয়ে দশ বছরের বড়।
মোটাসোটা বলল, অসুধ ঠিকঠাকমতো দিছ তো?
ম্যানেজার কণ্ঠে আরও তেল মিশিয়ে বলল, না স্যার। এখনো শুরু করি নাই। আপনে উদ্বোধন করলে আমরাও শুরু করব।
মোটাসোটা আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর বলল— ফরিদ, মালেশিয়া থিকা একটা বেত আনছিলাম না?
—জি স্যার…।
—যাও, বেতটা নিয়ে আসো।
ফরিদ বেত আনতে চলে গেল। আমার মাথায় এসব কাজ করছে না। আমি শুধু শিমুকে দেখছি। দশ বছর পর শিমুর সাথে দেখা। কোনো পরিবর্তন হয়নি মেয়েটার। যেমন ছিল তেমনি আছে।
ফরিদ বেত নিয়ে চলে এসেছে। মোটাসোটা বেতটা হাতে নিতেই শিমু বলল, কী আশ্চর্য… তুমি একে মারবে নাকি?
মোটাসোটার নির্বিকার উত্তর— চুরি করছে, শাস্তি হওয়া লাগব না?
শিমু বলল, না না ছুঁচো মেরে হাত নষ্ট করার দরকার নাই। পুলিশের হাতে তুলে দাও।
ম্যানেজার ফরিদ দাঁত কেলিয়ে বলল, পুলিশ এগোরে কিচ্ছু কয় না ম্যাডাম… এগো দরকার মাইর। একদিন ঠিক মতো বানানি দিলে, জীবনে এই কাম করব না।
—না না। কোনো মারপিটের দরকার নাই। দেখছ না অপুষ্টিতে ভোগা শরীর, উল্টো-পাল্টা মারলে মরে যাবে।
আশ্চর্য শিমু আমাকে চিনতেই পারছে না। আমার চেহারার কি এতই পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা সত্য যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের চাপে আমার চেহারা আর আগের মতো নেই, কিন্তু তাই বলে একদম না চেনার মতোও হয়ে যাইনি!
এরপর আমাকে পিটুনি দেওয়া হবে কি হবে না, এটা নিয়ে দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক চলল এবং সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় আমাকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে সবাই চলে গেল। না চিনলেও শিমুর হস্তক্ষেপে আপাতত পিটুনির হাত থেকে রক্ষা পেলাম। কৃতজ্ঞতায় আমার চোখ ভিজে গেল।
আজ থেকে দশ বছর আগে শিমুকে আমি পড়াতাম। গুলশানে শিমুদের বিশাল বাড়ি। বাবা হাইকোর্টের উকিল। আইনজীবী সমিতির নেতা। বিচারকদের সাথে হট কানেকশন; কন্টাক্টে কেস ডিল করেন। লাখ লাখ টাকা রোজগার। মাসের এক তারিখের মধ্যে বেতন পেয়ে যেতাম। এছাড়া প্রতি সন্ধ্যায় নাস্তার নামে ডিনার খেয়ে আমার রাতের খাওয়া খরচটাও বেঁচে যেত।
শিমু ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী। আমার কিছুই পড়াতে হয় না, সে একাই একশ’। আমি কেন, কোনো টিচারেরই দরকার নেই। আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি শিমু ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এইচএসসি পাস করবে। কলেজের মধ্যে ফার্স্ট হলেও আমি অবাক হব না। এইরকম একজন ছাত্রীর জন্য কোনো প্রাইভেট টিউটরের দরকার নাই, তারপরও আমাকে রাখা হয়েছে।
আমার ধারণা শিমুর ট্যালেন্টের বিষয়ে ওর বাবা-মার কোনো ধারণা নাই। ধারণা থাকার কথাও না। একজন আছে মামলা-মোকাদ্দমা নিয়ে, আরেকজন আছে রাজনীতি নিয়ে। শুনেছি শিমুর মা শীঘ্রই সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হতে যাচ্ছেন। সুতরাং মেয়ের ট্যালেন্ট যাচাইয়ের সময় কারও নেই।
তবে শিমু যদি একবার বলে যে, আমার টিউটর দরকার নেই, তাহলেই আমার দফা-রফা। কিন্তু শিমু সেরকম কিছু করবে না। যেকোনো কারণেই হোক সে আমাকে পছন্দ করে। পছন্দের রকম সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নাই। এটা পছন্দ না বলে দয়া-মায়াও বলা যেতে পারে।
কারণ এ যাবত শিমুর কাছ থেকে আমি যত টাকা ধার নিয়েছি, তার একটি টাকাও সে ফেরত নেয়নি। টাকা ফেরত দিতে গেলেই সে বলে, এখন না স্যার, পরে নেব।
—পরে আর কবে নেবে?
—জমুক স্যার… একসাথে নেব… সুদে আসলে…।
তারপরও আমি একদিন জোর করে টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ফলাফল ভালো হয়নি। দেখলাম সে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখে রাগ না ক্ষোভ কিছুই বুঝতে পারছি না।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললাম, সব সময় টাকা থাকে না শিমু, এখন আছে দিয়ে রাখি, না হলে খরচ হয়ে যাবে। শিমুর চোখে যেনো শ্রাবণধারা নেমে এল। রক্তজবার মতো লাল টকটকে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল।
এরপর আমি আর চেষ্টা করিনি। সত্যি বলতে কী, শিমু টাকা না নেওয়ায় আমার উপকারই হয়েছে। চার মাসের মেস ভাড়া আর মুদি দোকানের বাকি সব সেই মাসে শোধ দিয়েছি।
কেউ টাকা ফেরত না নিলে তার কাছে আর টাকা চাওয়া যায় না। আমিও চাইতাম না। কিন্তু মেয়েরা বিস্ময়কর মমতা ও পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে জন্মায়। শিমু আমাকে প্রতিমাসেই কিছু না কিছু টাকা দিয়েই ছাড়ত। না নিলে কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ করে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকত।
মিটিং-সিটিংয়ের ফাঁকে কখনো কখনো শিমুর মা বিষয়টি টের পেতেন।
মহাসঙ্কট নিয়ে তিনি আমার কাছে আসতেন এবং অসহায় কণ্ঠে বলতেন, দেখো দেখি মেয়ের কাণ্ড, কী হয়েছে কিছু বলবেও না, আবার খাবেও না। মহাযন্ত্রণা করে মেয়েটা। দ্যাখো তো বাবা, কিছু করতে পারো কিনা!
আমি জানি, কী করতে হবে।
শিমুকে গিয়ে বললাম— শিমু, আমার মায়ের ভীষণ অসুখ; এখন তখন অবস্থা! কিছু টাকা না পাঠালেই নয়। পারলে কিছু টাকা দাও।
শিমু হাসি মুখে টাকা বের করে দিয়ে, ডাইনিং টেবিলে খেতে বসত।
এভাবেই শিমুর সহযোগিতা চলতে থাকল দিনের পর দিন। দরিদ্রতা আমার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। আত্মসম্মান বোধ থাকলে কবেই শিমুর টাকা ফেরত দিয়ে টিউশুনি ছাড়তাম।
শিমু প্রায়ই আমাকে নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরতে যায়। আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও শিমুর অনেক বন্ধু-বান্ধব। শিমুকে আড্ডাবাজ মেয়ে বললে ভুল হবে। তবে শিমুর মধ্যে একটা বোহেমিয়ান ব্যাপার আছে। নিরিবিলি কোনো স্থান চোখে পড়লেই শিমু গাড়ি থেকে নেমে যায়। একা একা হাঁটতে থাকে। নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি ওর পিছে পিছে থাকি।
শিমু বলে, স্যার দেখেছেন জায়গাটা কী সুন্দর আর নিরালা?
—নিরালা তোমার ভালো লাগে?
শিমুর পাল্টা প্রশ্ন, আপনার লাগে না?
—আমারও লাগে।
শিমু ঠোঁটে আঙুল চেপে বলে, তাহলে আর কোনো কথা বলবেন না। একদম চুপ।
আমরা চুপচাপ হাঁটতে থাকি। নিস্তব্ধ চরাচরে শিমু কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করে।
আমার কৌতূহল হয়।
—কী শুনছ?
মুখে আঙুল চেপে ফিসফিস করে বলে, দোয়েলের শিস শুনতে পাচ্ছেন না?
আমি কান পাতি, দূরে কোথাও থেকে সত্যি সত্যিই দোয়েলের শিস ভেসে আসছে।
মেয়েটার পর্যবেক্ষণ শক্তি অসাধারণ। মনটাও খুব নরম। আমি মনে মনে শিমুর প্রশংসা করি।
শিমুর বাবা-মা আমাকে সন্দেহ করে কিনা জানি না, তবে শিমুর ড্রাইভার আমাকে চোখে চোখে রাখে। এটা কতটা ড্রাইভারের সতর্কতা আর কতটা শিমুর পরিবারের সাবধানতা সেটা জানা সম্ভব না। আমি চেষ্টাও করি না। তবে আমি জানি শিমুর সাথে প্রেম-ভালোবাসার ঘটনা ঘটলে আমার লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসবে। তাছাড়া প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারে আমার আগ্রহ কম। আমার ব্যাপারেও মেয়েদের খুব একটা আগ্রহ চোখে পড়েনি। শিমুর ব্যাপারটা আলাদা। সে আমাকে পছন্দ করে, সে আমাকে মায়া করে।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন; কিন্তু সুখ বেশিদিন থাকে না, আমারও থাকল না।
শিমু একদিন একটা সুন্দর পাঞ্জাবি দিয়ে বলল, স্যার দ্যাখেন তো পছন্দ হয় কিনা?
—হঠাৎ পাঞ্জাবি?
—এবার পহেলা বৈশাখে আপনার সাথে ঘুরব, স্যার।
ঢোক গিলে বললাম, আমার সাথে?
শিমু নির্বিকার চোখে তাকিয়ে আছে, কোনো অসুবিধা আছে, স্যার?
আমতা আমতা করে বললাম, না না, কীসের অসুবিধা, কোনো অসুবিধা নাই।
তাহলে পহেলা বৈশাখে আপনি এই পাঞ্জাবিটা পরবেন। আমি ম্যাচিং করে শাড়ি পরব, তারপর দুজন হাত ধরে রমনা পার্কে হাঁটব।
আমি বুড়িগঙ্গায় আমার ভাসমান লাশ দেখতে পাচ্ছি। অস্ফুট স্বরে বললাম, হাত ধরে হাঁটব?
শিমু খিলখিল করে হেসে বলল, ভয় পাবেন না স্যার, ভুল বুঝবেন না…।
—না মানে…
—আপনার সাথে কোনো প্রেম-ভালোবাসা করব-টরব না, সো ভয় পাওয়ারও কিছু নেই।
—না মানে…
শিমু বলল, কোনো মানে টানে নাই… আমি আমার কয়েকজন বান্ধবী মিলে ঘুরব, সাথে একজন পুরুষ থাকলে ভালো হয়, এই জন্যই আপনাকে রাখা।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মিনমিন করে বললাম, ঠিক আছে। অসুবিধা নাই।
আমি এমনিতে পাঞ্জাবি-টাঞ্জাবি পরি না। কেন জানি না পাঞ্জাবি পোশাকটার সাথে একটা সুখী সুখী বড়লোকি ভাব আছে, যেটা আমার সাথে একদম যায় না। কিন্তু শিমুর আদেশ বলে কথা। নির্দিষ্ট দিনে পাঞ্জাবি গায়ে বটমূলের সামনে দাঁড়ালাম।
শিমুর আসার কথা সকাল ৮টায়। আমি ৭টার সময় হাজির। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন চোখ চেপে ধরল। নরম মেয়েলি হাত। কে হতে পারে? এভাবে কোনো মেয়ে চোখ ধরার কথা না। তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেইও। চোখ থেকে হাত সরিয়ে দেখি শিমু!
কী আশ্চর্য শিমু আমার আগেই এসে হাজির। লাল হলুদ শাড়িতে শিমুকে পরির মতো লাগছে। আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
শিমু ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, আমাকে কেমন লাগছে, স্যার?
ঢোক গিলে বললাম, ভালো।
—শুধুই ভালো?
—হ্যাঁ ভালো…ভালোই তো…।
শিমু সরাসরি তাকিয়ে বলল, ভালো করে দেখে বলেন স্যার, শুধু ভালো, নাকি খুব ভালো?
শিমুকে আজ কথায় পেয়েছে, আমার মুখ থেকে ও আসল সত্যটা বের করে আনতে চায়।
বললাম, খুব ভালো… খুব ভালো… খুব ভালো লাগছে তোমায়।
লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মেয়েটি, মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক য়ু স্যার, থ্যাঙ্ক য়ু।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম শিমুর কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই, শিমু একা, একদম একা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, তোমার বন্ধুরা কোথায়?
শিমু বলল, কেউ নাই, আমি একা…
—তুমি না বললে, তোমার বন্ধুরা আসবে?
—মিথ্যে-মিথ্যি বলেছি স্যার, কেউ আসেনি, কাউকে আসতে বলিনি।
—মানে?
—কোনো মানে নাই স্যার, আজ আপনি আর আমি ঘুরব, আর কেউ থাকবে না।
বুড়িগঙ্গায় আবার আমার ভাসমান লাশ দেখতে পেলাম। ভয়ে এদিক-ওদিক দেখছি, ড্রাইভার রমজান কোথা থেকে ফলো করছে।
শিমু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, চিন্তার কিছু নাই, গাড়ি নিয়ে আসিনি, আজ রমজানের ছুটি।
তারপরও আমার ভয় কাটে না। আমি শুধু ঢোক গিলছি।
—আপনি এতো ভীতু কেন, বলেন তো স্যার?
—না মানে…
—আর শিখেছেন এককথা, না মানে! না মানে জিনিসটা কী বলেন তো আমাকে?
এরপর আর কথা চলে না। আমিও কথা বন্ধ রাখলাম। শিমু আমাকে নিয়ে লেকের পাশে বসল। লেকের জলে মৃদুমন্দ বাতাস। বাতাসে শিমুর চুল উড়ছে। শিমুর শরীর থেকে পারফিউমের সুবাস ছড়াচ্ছে। আমি প্রাণভরে সেই সুবাস গ্রহণ করছি।
শিমু লেকের জলের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন বালিকা। ধনীর আদুরে কন্যা। চাওয়া মাত্র সবকিছু হাজির। তার আবার চিন্তা কী! শিমু হঠাৎ আমার হাত ধরল। চমকে গিয়ে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম, কিন্তু শক্তি পাচ্ছি না। এই হাত যেন আমার হাত না।
শিমু বলল, এইভাবে হাত ধরে পাশাপাশি বসে থাকার চিন্তাটা কিন্তু আমার অনেক দিনের।
—অনেক দিনের মানে?
—আমার বয়স যখন নয় বছর, ছোট মামার সাথে বেড়াতে এসেছিলাম। মামা মামির হাত ধরে এখানে বসেছিলেন, মামি এক মনে লেকের জলের দিকে তাকিয়ে ছিল।
আমি অবাক। শিমু সম্পর্কে আমি তো কিছুই জানি না। এ তো সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য। এতটা বছর একটা স্বপ্ন সে মাথায় নিয়ে ঘুরছে।
শিমু বলল, তখনই ভেবেছিলাম, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির হাত ধরে একদিন আমি এখানে এসে বসব।
শিমু হাত ধরেই আমার দিকে তাকাল, তার চোখে জল টলমল। আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। শিমু জানল না, আজ আমায় বোবায় ধরেছে।
আমার মতামতের অপেক্ষা না করে শিমু বলল, আজ আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো। থ্যাঙ্ক য়ু স্যার।
শিমু আমার লাশ বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়েই ছাড়বে। প্রাণের মায়া বড় মায়া। শিমুর হাত থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম— চল শিমু, বাসায় যাই।
শিমু বলল, এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাব কেন?
—না মানে তোমার মা তো চিন্তা করবে।
শিমু উঠে হাঁটতে শুরু করল, মা চিন্তা করবে না। মা-বাবা কেউই বাসায় নেই।
—যদি হঠাৎ এসে পড়ে?
—এলেও অসুবিধা নেই, মাকে বলেই এসেছি।
নিরুপায় আমি বললাম, ও আচ্ছা।
শিমু হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, একদম মুখোমুখি। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। একটু ভড়কে গেলাম। ঢোক গিলে বললাম, কী হলো শিমু?
—স্যার একটা প্রশ্ন করব?
—কী প্রশ্ন?
—সত্যি জবাব দেবেন?
—কেন দেব না!
শিমু আবার হাঁটতে লাগল। আমি ওর প্রশ্নের অপেক্ষায় হাঁটছি। শিমু একা একাই কথা বলছে।
—আমি অবশ্য মোটামুটি কনফার্ম, আপনার এ ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতা নাই!
শিমু কীসের অভিজ্ঞতার কথা বলছে বুঝতে পারছি না। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেও বিপদ। তার চেয়ে মুখ বন্ধ রেখে শুনে যাওয়াই ভালো। শিমু একমনে কথা বলছে আর হাঁটছে। যেন একটা ঘোরলাগা পরি; হাঁটছে না বাতাসে ভাসছে। বৈশাখের এই কাঠফাটা দুপুরে স্নিগ্ধ মায়া ছড়িয়ে চলেছে সে। হঠাৎ শিমু দাঁড়িয়ে গেল এবং আমার দিকে ঘুরে বলল— আচ্ছা স্যার, আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?
সরাসরি এমন প্রশ্নে আমি ঘাবড়ে গেলাম। এমন একটা প্রশ্ন শিমু করতে পারে আন্ধাজ করতে পারলেও এভাবে সরাসরি করবে সেটা মাথায় আসেনি। আমি গোবেচারা গরিব টিউটর দিন আনতে রাত ফুরায়; আমার গার্লফ্রেন্ড আসবে কোত্থেকে! কিন্তু সে কথা শিমুকে জানানোর দরকার নাই। কারণ আমার প্রতি শিমুর যে দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে সেটা যদি প্রশ্রয় দেই, ভবিষ্যৎ খারাপ। তারচেয়ে এই সুযোগে মিথ্যে হলেও একটা প্রেমের গল্প ফেঁদে শিমুকে বিমুখ করতে হবে।
আমি পাকা অভিনেতার মতো বললাম, বিবাহিত মানুষের গার্লফ্রেন্ড থাকবে কেন?
বৈশাখের প্রচণ্ড গরম। এম্নিতেই জবুথবু অবস্থা। আমার কথা শুনে শিমু আকাশ থেকে পড়ল।
—বিবাহিত মানে? কে বিবাহিত?
—আমি বিবাহিত। তোমাদের বলা হয়নি। গত সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখে আমি কেয়াকে বিয়ে করেছি।
রক্তশূন্য মুখ। পাথরের চোখে শিমু তাকিয়ে আছে।
—কেয়া কে?
আমি সাবধান ওভার অ্যাকটিং করা যাবে না। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি আর কেয়াকে নিয়ে গল্প তৈরি করছি। কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব করে বললাম, কেয়া আবার কে! কেয়া আমার ছাত্রী!
আচমকা আঘাত মেয়েরা সইতে পারে না। সামান্য দুঃসংবাদেই তারা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায়। শিমুরও তাই হলো। সে একটা গাছ ধরে বসে পড়ল, মনে হলো থরথর করে কাঁপছে। শিমুকে চূড়ান্ত আঘাত করার সুযোগটুকু হাতছাড়া করলাম না।
ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, কী বলব তোমায়! একটা লটরপটর অবস্থা…।
শিমু আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখে শ্রাবণধারা।
বললাম, আসলে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক… আমরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। দুই বছর লিভ টুগেদার করেছি। হঠাৎ কেয়া বলল, তার শরীর খারাপ, সে কনসিভ করেছে।
আমি আর কিছু না বলে আনমনে সিগারেট টানছি। শিমু এখন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে আছে। প্রচণ্ড ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ। ভীষণ খারাপ লাগছে। শিমুকে এভাবে আঘাত করা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি নিরুপায়। এইরকম চালচুলোহীন জীবনের সাথে শিমুকে জড়ানোর কোনো মানে হয় না। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে বলতে পারব না।
হঠাৎ দেখি শিমু উঠে হাঁটতে শুরু করেছে। টলতে টলতে হাঁটছে; আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। কাছে গিয়ে বললাম— শিমু, শরীর খারাপ লাগছে?
শিমু কোনো জবাব দিল না। হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
পরদিন শিমুর বাসায় গেলাম। কাজের মেয়ে জরিনা চা-নাস্তা দিয়ে গেল।
বলল, আপার শরীল খারাপ, আইজ পড়ব না, আপনেরে খাইয়া যাইতে বলছে।
—কী হয়েছে শিমুর?
—অসুখ-বিসুখ জানি না, সারাদিন শুইয়া রইছে…।
বললাম, আমি কি একবার দেখা করতে পারি?
জরিনা বলল, একদম না, আপার কড়া নিষেধ, কেউ যেন না যায়।
এরপর আর কথা চলে না। আমিও কথা বাড়ালাম না। বুঝতে পারলাম গতকালের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে শিগগিরই কাটিয়ে উঠবে। ধনীর ঘরের মেয়ে, একটা জিনিস নিয়ে বেশিদিন পড়ে থাকার সময় কোথায়!
কিন্তু আমার ধারণা ঠিক না। এরপর আর কোনোদিনই শিমু আমার সামনে আসেনি। দিনের পর দিন ওদের বাসায় গিয়ে বসে থেকেছি শিমুর অপেক্ষায়; কিন্তু শিমু আসেনি। ফোন করলেও রিসিভ করছে না শিমু।
একদিন জরিনা, একটা সুদৃশ্য প্যাকেট এনে রাখলো সামনে।
—এটা কী?
—জানি না… আপায় দিছে…।
—কিন্তু জিনিসটা কী?
জরিনা হেসে বলল, ভাবির জন্য একটা শাড়ি আর আপনের জন্য একটা পাঞ্জাবি…।
নিজের বলা মিথ্যে কথা কারও মনে থাকে না, আমারও নাই।
বললাম, কার ভাবি?
—আমাগো ভাবি… আপনের বউ তো আমগো ভাবিই হইব। আর এইটা হইল আপনেগা হানিমুনের টিপস… খালাম্মা দিচ্ছে।
বলেই একটা খাম রাখলো আমার সামনে। কী বলব বুঝতে পারছি না। ভীষণ কান্না পেল আমার। শিমুকে দেখার জন্য ছটফট করছে মন। কিন্তু উপায় নেই; শিমু আমার সঙ্গে কোনোদিন দেখা করবে না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি শিমুকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিমুর জন্য যে হৃদয়ে এতটা ভালোবাসা ছিল তাও জানা ছিল না আমার।
এরপর আমি শিমুদের বাসায় যাওয়া বন্ধ করলাম। যোগাযোগ বন্ধ করলাম। কিন্তু শিমু বন্ধ করল না। আমার বেতন ঠিকই আসতে থাকল। প্রতি মাসের এক তারিখে রমজান মেসে এসে আমাকে একটা খাম ধরিয়ে দিত। খামের মধ্যে এক হাজার টাকার পাঁচটা নোট। আপত্তি করলে রমজান বলত, ম্যাডামের অর্ডার। না নিলে বিপদ আছে।
আমি আর বিপদ বাড়াতে চাইনি। দ্বিতীয় মাসেই আজিমপুর মেস ত্যাগ করে, মতিঝিলে চলে এলাম, মোবাইল ফোনের সিম চেঞ্জ করে নতুন নম্বর নিলাম। শিমুর সাথে সব যোগাযোগ শেষ হয়ে গেল। দশ বছর পর আজ দেখা। তাও চোরের পরিচয়ে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আমার।
খুটখাট শব্দ হচ্ছে। কেউ একজন দরজা খুলছে। আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আমি বিচলিত হয়ে পড়লাম। দুজন পুলিশ এসেছে, সাথে ম্যানেজার ফরিদ।
ফরিদ বলল, স্যার এই যে, এইটাই সেই মাল…।
পুলিশ নির্বিকার আমার কোমরে দড়ি বাঁধল, তারপর টেনে বাইরে নিয়ে এল। সবাই আমাকে দেখে হাসছে। পেছনে দু-একটা কিল-ঘুষিও পড়ছে। কিন্তু আমার চোখ শুধু শিমুকে খুঁজছে। না, শিমু কোথাও নাই। এসব ছোটখাটো বিষয়ে হয়তো তার থাকার কথাও না। আমি চুপচাপ পুলিশ ভ্যানে উঠে গেলাম।
পুলিশ আমাকে কিছু বলল না। শুধু নাম ঠিকানা ও ফোন নম্বর রেখে ছেড়ে দিল।
ছাড়ার সময় এসআই বলল, আমাদের না বলে কোথাও যাবেন না।
আমি বললাম, আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, স্যার।
দুদিন পরের কথা। ভোরবেলা টিউশনির জন্য বের হব। কাপড়-চোপড় পরে রেডি হচ্ছি। কলিং বেল বেজে উঠল। এতো সকালে আবার কে? নির্ঘাত বাড়িওয়ালা। দুই মাসের ভাড়া বাকি। পালিয়ে পালিয়ে কাটাচ্ছি। আজ আর পারা গেল না। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি দরজার সামনে শিমু দাঁড়িয়ে। কিছুই বুঝতে পারলাম না, শিমু কেমন করে এখানে! তাছাড়া শিমু তো আমাকে চিনতেই পারেনি সেদিন।
শিমু বলল, কেমন আছেন স্যার?
—স্যার মানে? আমাকে বলছেন?
শিমু ঘরের মধ্যে ঢুকে চেয়ারে বসল।
—হ্যাঁ আপনাকেই বলছি। কেমন আছেন স্যার?
—ভালো আছি।
—কেয়া কেমন আছে?
আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। শিমু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকিয়ে আছি মাটির দিকে। কারও মুখে কোনো কথা নাই; যেন অনন্তকাল আমরা দুজন দুদিকে তাকিয়ে আছি।
—আমি দুঃখিত শিমু…।
শিমুর দিকে তাকাতেই দেখি, শিমুর চোখে অঝোরে জল ঝরছে।
শিমুর চোখে তাকাতে পারছি না। আমার চোখ কচকচ করছে। কান্না ভাইরাসের মতো, একজনের কান্না আরেকজনকে সংক্রমিত করে। শিমুর কান্না আমাকে সংক্রমিত করছে ক্রমশ।
শিমু বলল, এত বড় মিথ্যে কথাটা না বললে কী হতো, স্যার?
কী বলব বুঝতে পারছি না। শিমু সব জেনে গেছে। নতুন করে মিথ্যে বলে কোনো লাভ হবে না। সুতরাং সবকিছু স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
—আমাকে ক্ষমা কর শিমু…।
চোখ মুছে ধরা গলায় শিমু বলল, আপনাকে তো কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি, স্যার। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করবে কে? আমি যে আমাকে কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারছি না!
—তোমার কোনো দোষ নেই শিমু, সব দোষ আমার।
শিমু বিড়বিড় করে বলল, আমি কেন আপনাকে বুঝতে পারলাম না, কেন বুঝতে পারলাম না আপনাকে? এত বড় ভুল হলো কেমন করে!
—সব দোষ আমার শিমু… সব দোষ আমার।
শিমু কোনো কথা বলছে না। মনে হয় আবার কাঁদতে শুরু করেছে। মেয়েদের নিঃশব্দ চোখের জল খুব মারাত্মক; সবকিছু দ্রবীভূত করে দেয়। আমাকেও দ্রবীভূত করেছে। কোনো কথা বলতে পারছি না, বুকের মধ্যে কান্না দলা পাকাচ্ছে অবিরত। ঘরের মধ্যে রাজ্যের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। শুধু নষ্ট সিলিং ফ্যানটার একঘেয়ে ক্যাচর-ক্যাচর শব্দ নিস্তব্ধতাকে ব্যঙ্গ করছে অবিরাম।
শিমু আমার পাশে এসে বসল; তারপর আমার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ধরে থাকল নিঃশব্দে। সেই পরিচিত ঘ্রাণ, সেই পরিচিত স্পর্শ, সেই চেনা শ্বাস-প্রশ্বাস। শিমুর হাতের ছোঁয়ায় কী যেন সঞ্চারিত হচ্ছে আমার ভেতর।
আমি ক্রমশ ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি আর দিব্য চোখে দেখছি, পহেলা বৈশাখের রমনা বটমূল, মানুষে মানুষে ভরা চারিদিক। লেকের পাশের সিমেন্টের বেঞ্চিতে হাতে হাত রেখে বসে আছি আমরা দুজন, আমি আর শিমু। পাখির ডাক এবং বেলুন বাঁশির সুরে ভাসিয়ে দিচ্ছে আকাশ বাতাস আর সারি সারি হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে দিঘির জলে।
মানিক মানবিক
মানিক মানবিক মূলত চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। নির্মাণের প্রয়োজনে প্রচুর কাহিনীচিত্র লিখেছেন। লিখেছেন মঞ্চ, একক ও ধারাবাহিক নাটক। ‘কোথাও তো নেই কেউ’ নামে কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে একটি; উপন্যাস ‘জীবন যৌবন এবং জলাঞ্জলি’। রম্যরচনায়ও রয়েছে সমান আগ্রহ।