অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খাতুনে জান্নাত -
নুশান : দ্যা স্পেশাল চাইল্ড— দ্বিতীয় পর্ব

(পূর্বের পর্বের পর। পূর্বের পর্বের লিংক নিচে দেওয়া হলো)।

৫.

জুলাই মাসে প্রচণ্ড গরম ইলিবিলি কাটছে শরীরে। মিষ্টি গরম ছাড়িয়ে এবার প্রকৃতি রেগে উঠলো আগুন রঙে রেঙে উঠল। ব্রিটেনের অধিবাসীদের কালেভদ্রে এমন গরমের দেখা মেলে। প্রথম গ্রীষ্মের শুধু ফুলের বৃক্ষ এখন ফুল-পাতায় সেজে উঠেছে। পুড়ে যায় কিনা ভয়ে সরকার পার্কে পার্কে পানি ছিটাতে শুরু করেছে। হেলিকপ্টারে করেও পানি ছিটাচ্ছে। গাছের মতো গরমের উত্তাপ মানুষেরও নরম ত্বকে প্রভাব ভালোই ফেলে। ঘাম কম হয়, শরীর জ্বলে। মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। সাড়ে নয়টায় সন্ধ্যা।  দীর্ঘ দিনের ভেতর গরমের হাঁসফাঁস বাংলাদেশের গ্রীষ্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যেন শরীর ডুবিয়ে রাখা পুকুর চাই। বনের ভেতর ঘুরে বেড়ানো নূপুর পা ও বাতাসের ঘুঙুর চাই। কড় কড় কড়াৎ বজ্রপাতের সাথে কালবৈশাখী ঝড়ের ও আম কুড়ানোর  উদ্দামতা চাই। মনের ভেতর ঘুঘু পাখি ডাকে, হরিয়াল, ময়না, টিয়া ডাকে— আহ!

শীতের দেশে রোদের প্রত্যাশা নিয়ে বেঁচে থাকে মানুষ। গায়ে ঘাম ঝরানোর কসরত জীবন বর্ধনকারী মহৌষধ। ধানকাটা খেতের ফসলের অপেক্ষার মতো আমুদে মন। ঝিরিঝিরি বাতাস, ফুলপাতার দোলা, পাখিদের গান মনের প্রকৃতিও করে বৈঠার আবাহন। যদিও শীতকেও উদযাপন করে হিটার আর মদের আসর সাজায়। ঘরে, বারে, ক্লাবে নৃত্যের আয়োজন। রাস্তায় ছোটে উদ্দাম। দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আস্তে আস্তে হাঁটা যায় না শরীর জমে যাবে। দৌড়ে গিয়ে হিটারের ঘরে ঢোকে। অফিসে, দোকানে, বাসে, ট্রেনে, সর্বত্র হিটার উত্তাপ আয়োজন। শীত-গ্রীষ্মের ঘরে বেশির ভাগেরই একটি ছোট টেবিল ফ্যান ও ফ্যানহিটার। সিলিং ফ্যান লাগানোর সিস্টেম নাই বেশির ভাগ ঘরে। ৩১ ডিগ্রি ফারেনহাইটে ঘেমে যায় শরীর। না ঘামলেও জ্বলন হয়। পার্কে, সাগরের পাড়ে বেড়ে যায় ছোট ছোট পোশাক বাহার। ষাট-সত্তর দশকে পুরো উদোম হয়ে একসাথে সানবাথ ও বাথ করত  পরিবারসহ। মুসলমানদের আগমনের পর থেকে তাদের ধর্মীয় কৃশদৃষ্টির কোপে পড়ে সংস্কৃতি বদলেছে এখন বিকিনি পরেই সাগরপাড়ে ভিড় করে। আনন্দে ডুবে যায়।  যদিও দূর চোখে ওদের কেউ কেউ দেখে। রঙিন পোশাক আর খেলনার ঝলক সাগরের পাড়কে চকচকে রোদের লন্ডন করে তোলে। চারপাশে সবুজ আর সবুজ আর রঙিন ফুলের আন্দোলন। আকাশ নীল তাই সাগরও নীল। জল যেন কাচের স্ফটিক, শরীর যেন মৎস্যকুমার ও কুমারী। শিশুরা জলজ সংসার। অবারিত মায়া-ছায়া।

নুশানের পরিবার এসেছে ডোবার সাগরপাড়ে। ডোভার প্রণালী (ইংরেজি : Strait of Dover) গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপকে ফ্রান্স তথা ইউরোপীয় মহাদেশীয় ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নকারী সমুদ্রপ্রণালী। এটি ইংলিশ চ্যানেল তথা আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে উত্তর সাগরের সংযোগসাধন করেছে। ফরাসিরা এটিকে কালে প্রণালী (ফরাসি : Pas-de-Calais; আ-ধ্ব-ব: [pɑdə kalɛ]) নামে ডাকে। পাড় অনেকটাই খাড়া। খাড়া থেকে পানি। বালিয়াড়ি ততটা নয়। নুশান ও তার বাবা আনন্দ ঝরঝরে লরেল পাতার মতোই হাসছিল উদ্দাম খুশিতে। মেঘগুলো চকচকে যেন সাদা পাখি উড়ছে মনের খুশিতে। অথবা সাদা রঙের তুলি আকাশের গায়। পাড়ের সবুজ ঘাস, পালতোলা নাও। নীরবতা ভঙ্গকারী স্পিড বোটের গরর গরর। মা একটু আতঙ্কে। আতঙ্ক তাকে খামচে ধরে আছে জন্ম-জড়ুলের মতো। এত ভিড় মানুষদের শোয়া-বসা কলরোল। এসব থেকে দূরে তাকতে চায় কিন্তু পারে না। ডাক্তারদের কথা ‘ওকে বেশি বেশি মানুষের মধ্যে রাখতে হবে।’ তাই তো নিয়ে যায় চিল্ড্রেন সেন্টারে। যেমন আজ নিয়ে আসে সাগরপাড়ে। সাগরের উত্তাল জলরাশি মন উদার না করে কেন যে সঙ্কুচিত করে রাখে বোজা শামুকের মতো। ‘ও মন তুই হারিয়ে যা ঢেউয়ে ঢেউয়ে জলকেলি কর।’ ভাবতে না ভাবতেই বাগি থেকে নামানো বাবার ধরা হাত থেকে ছুটে এক দৌড়ে সাগরে নেমে গেল নুশান প্যান্ট-জুতাসহ কোমর জলে। একটি পরিবারের শিশুদের উপর পড়ল ধুমাধুম। পানিতে ডুবডুবি। আহা! নিয়ম মানে না গো! বুকের ভেতর ধপাস ধপাস। ‘হে শিশু তোমার ইচ্ছের অধীন নয় তোমার জীবন। তোমার ইচ্ছের অধীন নয় সমাজ-সংসার। হে শিশু পৃথিবীর দিকে তাকাও। এখানে নিয়ম আছে, ব্যবহারের সীমা আছে, সীমার পরিসীমা আছে। লোকে মন্দ বলবে। মা বাবাকে দোষ দেবে। তুমি কি কিছুই শেখো নাই?’ মা-বাবা আসার আগেই দুজন গাইড এগিয়ে এসে টেনে  তোলে। চোখের পলকে দুই হাতে দুটো ঠাস ঠাস করে থাপ্পড় পড়ল গাইডদের চোখে-মুখে। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গাইডের হাত ছাড়িয়ে দৌড় দেয় জল ছিটাতে ছিটাতে কয়েকজনের পানীয় ও খাবারের বিছানা মাড়িয়ে। কিছু সময় শোরগোল।

—ও হোয়াট ইস দিস?

—দ্যা বেবি ইজ নট নরমাল।

—সেড।

—ও হি ইজ অটিজম বেবি!

নুশান একটি গেমস দেখে। একজন পুরুষ (বদলে নারীও করা যায়) সাগরের পাড়ে শুয়ে-বসে থাকা মানুষদের আছড়ে পাছড়ে মারে। সে দৃশ্যটাই ঘটাতে চেয়েছে কিনা সে! অঘটন ঘটিয়ে মেজাজ ফুরফুরে হলো। তারপর বাবা-মায়ের হাত ধরাধরি করে হাঁটে নুশান। ভেজা কাপড় পাল্টে দেয় মা। তারপর তার বাগিতে বসিয়ে খাবার খায়। কেউ আর জলে নামার কথা ভাবে না। এত হৈচৈ আনন্দ সমাগম তাদের জন্য নয়। বাবা ও নুশান খুব আনন্দিত, ঝকঝকে। যেন কিছুই হয়নি, ঝনাৎ করে ভাঙেনি মায়ের মন, সাজানো বাগানটায় একঝলক উল্টেপাল্টে দেওয়া সবুজ সমাহার।

বিভিন্ন ভাষায়, সুরে গাইছে নুশান। কিছু শব্দ বোঝা যায়, কিছু দুর্বোধ্য। অচেনা জগতের কোনো ভাষা নয়, তার প্রতিদিনের লেটার ও নাম্বারের, দিনের কিংবা রঙের গান। তার ফর্সা গাল দুটো সামার রোদে টকটকে হয়ে উঠলো। দাঁতগুলো চকচকে সাদা। সাদা টিশার্ট বুকে টমাস-ট্রেনের নীল ছবি। মায়ের কালো প্যান্ট, ছোট লাল-নীল প্রিন্টের শার্ট। হাতের ভাঁজে কালো পাতলা জ্যাকেট। বাবার পরনে শিকদের তৈরি উলেন সুয়েটার। নীল-হলুদ সুয়েটারের পেছনে একটি লম্বা লেজওয়ালা টুপি ঝুলছে। তার পাঞ্জাবি বন্ধু রয়ের  দোকান থেকে কেনা। পাঞ্জাবিদের তার খুব পছন্দ। তাদের গল্প করতে গেলে চোখ বড় হয়ে যায়। মুখের হাসি বিস্তৃত হয়। টাক মাথায় উলেন একটি কালো টুপি। কয়েকবার বলার পরও খুলল না। ঘাম, গরমকে নাকি এনজয় করছে।

—এনজয় এনজয় জীবন তো এরই নাম। কেউ পার্কের বেঞ্চে দিনভর বসে থেকে এনজয় করে একাকিত্ব। কেউ বার, ক্লাবের উদ্দামতায়। নারী বা পুরুষ সেক্স সঙ্গীকে নিয়ে এনজয়ও একসময় পুরোনো হয়ে যায়। তখন দেশ ছেড়ে চলে যায়। আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যে নয়তো ভারতের, কাশ্মিরে বরফ সংযোগে,  চেন্নাইয়ে সাগরের পাড়ে বা মহারাষ্ট্রের অজন্তা-ইলোরা।

বাসায় ফিরে মা চুপচাপ থাকে। মনটা যেন এঁদোডোবায় ডুবে আছে। তোলার চেষ্টা করেও বিফল হয়। চুপচাপ থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। টেলিভিশন দেখারও উপায় নাই। এটা এসময় বাপ-বেটার জন্য বরাদ্দ। কারও সাথে কথা বলা দরকার? কে সে আপনছায়া আপনমায়া। বছরের পর বছর পাশাপাশি থেকেও দূরত্ব রয়ে যায়। মাঝখানে বাঁধ। নদী ও পাড়ের ব্যবধান সংসারে দুজনের মধ্যে। দেশে কথা বলবে। উপেক্ষার উপেক্ষিত দুটো শিশু মায়ের অপেক্ষায় দিন গুনছে। তাদের সে অপেক্ষার অবসান কিভাবে হবে? মা জানে না। জীবনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শুধু। ধু-ধু বালিয়াড়ি। চলার পথ মসৃণ হবে কবে?

ভাবনার বাঁধ ভেঙে খেলনা ভাঙার শব্দ আসে। সাথে বাবার চিৎকার। নুশানের খিধে পেয়েছে। ইংরেজিতে কিছু প্রশ্নবান ছুটে ঘুরপাক খায়। তাই তো রান্নাঘরে ছুটতে হবে। খাবার তৈরিই থাকে। প্রতিদিন রান্নার আয়োজন হয় না এখানে। একদিন রেঁধে দুদিন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

ধুম ধুমধুম। নুশান লাফাচ্ছে। রান্নাঘর ও রুমের মাঝখানের কার্পেটমোড়া স্পেসটা নড়ছে ধুপ ধুপ লাফানোর ভঙ্গিতে।

নুশানকে কিছু না বলে বাবা এসে মাকে বকতে লেগে গেল।

—তোমার ইমোশন কন্ট্রোল করো। আজ তোমার জন্যই নুশান এত কাণ্ড করল!

—সে তো তোমার হাতধরা ছিল?

খেয়াল রাখো নাই, উদাসীন আনমনা। কী ভাবো? এসব ছাড়ো। বি প্রাকটিক্যাল। শুধু কবিতা লিখলে হবে না।

আমি তো কবিতাই লিখতে চেয়েছিলাম। জীবন সংসার নিয়ে ভাঙচুর করে করে, নিজেকে ভাঙতে ভাঙতেও ভেবেছি কবিতার  কোমল পাপড়ির বুকে কলি হব আমি। আমার সত্তা আমার আমিত্ব নিয়ে মাথা তুলে না দাঁড়াক, আপন গহনে ডুবে থাকবে আত্মরোমন্থনে। মনের কথা মুখে কি বলা যায় শুধু বলে— আমি কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম। কেন এসেছ তোমরা? কেন বারবার আসো আমাকে ডোবাতে থাকো।

—তুমি বিশ্বকবি। কেউ মানুক বা না মানুক আমি জানি। কিন্তু সংসার ও সন্তানও তোমার। আমিও তোমার।

—সারাদিন মনে করাতে হবে?

—সাধারণ মানুষ আর কি কাজ? মহামানবীর সেবা করা উচিত কিন্ত উল্টো আমাদের সেবা করতে হয় বিশ্বকবিকে! চোখ টিপে, জিহ্বা বের করে কামড় দেয়। ভেঙেপড়া অনেক দাঁতের মাড়ি দেখিয়ে হাসে।

মায়ের মন নরম হয়ে যায়, হাসে।

বাঁধতে চেয়েছিল কবিতার শব্দে শব্দে বন্দি থাকা জীবন। আগে হয়নি, এখনো হয় না আর কবে হবে? হবে না। কারও কারও যে হয় না তা মেনে নিতে পারে না মন! আবেগ, মোহ, ক্লান্তি একসাথে কোলাকুলি করে বিবশ করে রাখে সময়। জীবন এক ভারবাহী পা ভাঙা অশ্ব। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে গিয়ে উষ্টা খেয়ে পড়ে। ক্ষত হয়, আবার ভাঙে। জোড়া দিতে দিতে তালি বাড়ে।

রাতের আঁধারে কবিতার বই মেলে ধরে। নিজেকে ফিরে পাওয়ার একটুকরো জলাশয়। কিন্তু লাইট জ্বললে বাচ্চা উসখুস করে। বাচ্চার চেয়ে বাপের ভাব বেশি। সিটিং থেকে উঠে আসে। অনিয়ম করা চলবে না। দিনের কাজ দিনে। কিন্তু কখন হয় লেখা বা পড়ার সময় জানে না মা। দিনের গামলা উপচেপড়া কাজ। খালি কর, আবার ভরে আবার খালি করার তোড়জোড়।

৬.

দেখতে দেখতে মাস পেরুল। আগস্টে নুশানের স্কুল পাল্টানোর পালা। তাকে সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে হবে। আগের স্কুল নুশানের জন্য ভালো ছিল।  শিক্ষকদের জন্য অসাধারণ মায়া ছিল।  কিন্তু প্রাইভেট স্কুলে স্পেশাল ডাক্তার যাবে না। আগের মতোই  এটাও প্রি প্রাইমারি। একটাই ক্লাস। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার যোগ্য করে তোলা। চার বছর শেষ হলেই ওরা ভর্তি নেয়। সরকারি স্কুল মানে নয় আমাদের বেঞ্চ আর ব্ল্যাকবোর্ডের সরকারি স্কুল, আর বেত হাতের শিক্ষক মহাশয়। দেখতে যেমন নয়নাভিরাম তেমনই তার আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা। এখানে নিয়মিত ডাক্তার ও একজন সেবাশিক্ষকের দায়িত্বে থাকবে। এ স্কুল বেশ বড়। ভেতরে খেলার মাঠ, একপাশে ঘাসের গালিচা, একপাশে স্তূপীকৃত ইট। একপাশে বালির স্তূপ তারই পাশ ঘেষে টিউবওয়েল ও ছোট একটি কুয়ো। কুয়োতে ফোয়ারা। টিউবয়েলের জল চাপলে তা গড়িয়ে কাটা বাঁশের ভেতর দিয়ে পড়ে কুয়ায়। গ্যারেজে ছোট ছোট গাড়ি, খেলনা বাগি, সাইকেল, বাইক। কাঠের,  বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে কাঠের টানেলের ভেতর দিয়ে ওপাশে স্লাইড। জায়গায় হেল্পিং শিক্ষক রয়েছেন। স্কুলটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন শিক্ষক নিহা মাথুর। তার ধারাল চোখ, নাক। স্মার্ট, সুন্দরী নিহা সচেতনও। সতর্ক চোখ রাখছে নুশানের উপর। স্কুল নিয়ে এখানে কম্পিটিশন নেই। বাড়ির ঠিকানা অনুযায়ী স্কুল নির্ধারিত থাকে। দুই বছর থেকেই এ ‘নিউ কিড’  স্কুল জানে এ বাড়িতে একজন বড় হচ্ছে। প্রতি বছর ফরম পূরণ করে নিয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিল অফিসের রেকর্ডে আছে জন্ম ও যাবতীয় বৃত্তান্ত। স্কুলের ভেতর সারি সারি কক্ষ, দেয়ালে ফোমের বোর্ডে বাচ্চাদের ছবি ও পেইন্টিং লাগানো ছোট পিন দিয়ে। ছোট ছোট বেসিনে সাবানের বাবল ফুলিয়ে খেলতে দেয়। তখন প্লাস্টিকের একটা জ্যাকেট পরায়। বিশ মিনিট পর নতুন ক্লাস। কাঠের কাটা ডিজাইন দিয়ে ঘর বানানো বা ব্লক  দিয়ে বিল্ডিং। শিশুরা মনের আনন্দে খেলতে থাকে। খেলতে খেলতে শেখা। তারপর কাগজ কেটে ফুল বানাও বা কাটাকাটি শেখ। পেন্সিল কাগজও উঠে আসে। যে যা পারে লেখে। আরও আগে খেলনা গেম বা ফ্লিপচার্ট, কার্টুন থেকে তারা শিখে ফেলেছে বর্ণমালা। যারা লিখতে পারে না তারা আঁকে। গোল আঁকে, তিনকোনা আঁকে। কাটাকাটি আঁকে। এ পর্বের শেষ ক্লাস পেইন্টিং। যার যেমন খুশি আঁকো। রয়েছে ক্রেয়ন, রঙ তুলি ব্রাস। ইজেলে রয়েছে টানানো কাগজ। মাঝখানে টিফিন ব্রেক ও খেলাধুলা। তারপর গানের ক্লাস। কখনো প্র্যাকটিস রুমে করা হয়। রুমটা অনেক লাইট ও মিউজিকের সমন্বিত রূপ। অসুস্থ, দুষ্টু, বাচ্চাদের এখানে বেশি রাখে। আগের স্কুলে এক একটা ক্লাস ছিল এক একটা টেবিল। এখানে কক্ষ। দৈন্যেও সৌন্দর্য রক্ষা চলে। সৌন্দর্যে থাকে প্রেরণা। শিক্ষকগণ দায়িত্বশীল ও পরিশ্রমী। আজকাল হিজাবি শিক্ষকও ঢুকছে। টাওয়ার হ্যামলেটসের মতো নিউহামও ইসলাম ধর্মীয় পাড়া। এটা পাকিস্তানি পাড়া। বাঙালিও আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে উঠে আসছে শিক্ষক। সব শিক্ষক মহিলা। শুধু গার্ডেনে একজন পুরুষ। সে ইংলিশ হলেও তার রয়েছে বিশাল দাড়ি ও গোঁফ। দাড়ি গোফের ফাঁকে মিটিমিটি হাসি। শিশুদের নিয়ে মজা করে, গল্প করে।  শিশুদের শেখান ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে কীভাবে মানুষ হতে হয়! ধর্মের কথা বলা নিষেধ। ধর্ম নিয়ে কাউকে ছোট করা নিষেধ। ধর্ম পড়ে থাকুক সকলের অগোচরে। ওকে বের করে আনলেই বিভেদ শুরু হয়।

পরিচয় দিতে শুরু করলে শুরু হয় বিপত্তি। তাছাড়া রঙ। গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলা যাবে না। প্রতিবন্ধীদের জন্য অফুরান ভালোবাসা। তাদের রয়েছে আলাদা স্কুল। তবে অটিজম এলাউড। অটিজম বাচ্চাদের জন্য রয়েছে একজন আলাদা আলাদা শিক্ষক। তারা শেখে কীভাবে লাইন ধরতে হয়। মুখের শেখায় কাজ না হলে শিক্ষক লাইন করে নিয়ে যান ফুটপাতে। রাস্তা পারাপারের লাইট জ্বালিয়ে রাস্তা পার হয়। সেখানে লাইন হবে পাশাপাশি। দোকানে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা হয়।

অনেকগুলো বই দেওয়া হয়েছে নুশানকে। রঙের বই, রাইমের বই, গল্পের বই। অঙ্কের বই। শুধু ছবি আঁকা থাকে। রঙ করতে হবে। বই নিয়ে বসলে নুশান পাশেই আসে না। নতুন বইয়ের মনমাতানো গন্ধ। মা কাছে ডাকে।  সে ব্যস্ত থাকে খেলাধুলায়, লাফ-ঝাঁফ। চার বছরের ছেলে কে গুনে বয়স! জোরে ডাকলে কাছে আসে হাসতে হাসতে চোখের নীচটায় ছোট একটি চিমটি কেটে দিয়ে যায়।

মা বসে থাকে কার্পেটের মেঝেতে। জীবন বিছিয়ে আছে যেন। সোজা করার মন্ত্র জানা নাই। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।  পথের গতি কত? এত ক্লান্তি কেন? ‘কতদূর আর কতদূর বলো মা’ হেমন্ত গেয়ে উঠে বুকটা মুচড়িয়ে। ভালো লাগত নুশানের বাবার সাথে সহজ সরল আলাপ করতে পারলে। কিন্তু তার ভাব নুশান সুস্থ। আমরাই অটিজম আক্রান্ত। কোথায় ব্যবধান? বয়সের,  সময়ের!  দেশের! দেশান্তরের! না এখানেই সমস্যা?  অটিজমের জেনেটিক জোন। নতুন এ ভাবনায় মনে আনন্দের ঝিলিকও খেলে যায় কোনো দূর প্রান্ত থেকে।  তাহলে নুশানও একদিন সব ভাবালুতা অর্বাচীনতার ঘাড়ে শক্ত পা ফেলে দাঁড়াবে। স্কুলফেরত, কলেজফেরত ঘরে ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে ডাকবে,  মা!

ডাকটা বুকের ভেতর নড়ে চড়ে কম্পন তোলে। যারা ডাকত, প্রাণ খুলে ভালোবাসত কতদূরে তারা! কবে দেখা হবে?  যখন দেখা হবে তারাও বদলে যাবে বয়স কেড়ে নেবে কত মিঠে রঙ। তাই তো রোজ সকাল হলেই ফোন হাতে নিয়ে বসে। একটু কণ্ঠ শোনে।  কখনো রাত একটায়ও ফোন করে। সকালে স্কুলের সময় হয় যে। —শুভ সকাল সোনামনিরা আমার।

———————————————–
নুশান- দ্যা স্পেশাল চাইল্ড— প্রথম পর্ব
https://magazine.anupranon.com/ধারাবাহিক-উপন্যাস/নুশান-দ্য-স্পেশাল-চাইল্ড/

 

+ posts
কবি ও সাহিত্যিক খাতুনে জান্নাত ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতি; দুর্বলের প্রতি সহিংসতা ও অভিন্নতার মুক্তি চান তিনি। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদমুক্তির ও উজ্জীবন মূলক। কবির জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার, ঘিলাছড়া ইউনিয়নে। তবে তাঁর পৈতৃক ও মাতৃক ঠিকানা: লক্ষ্মীপুর জেলাধীন লক্ষ্মীপুর থানার গোপীনাথপুর গ্রামে।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি(২০১৬), নিসর্গে নিমগ্ন নামতা(২০২২),
উপন্যাস গ্রন্থ:শিউলির কথা (২০১৯), বিলেতের বাউরি বাতাস(২০২২)।
নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩, অনুবাদ ব্রজেন চৌধুরী।
লিটলম্যাগ ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। বাংলাদেশ ভারত, যুক্তরাজ্যসহ,যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের জাতীয় দৈনিক, ব্লগ ও অনলাইন পত্রিকায় বাংলা ও ইংরেজি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।তিনি গান, শিশুতোষ ছড়া, সাহিত্য ও নারী বিষয়ক প্রবন্ধ , নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করছেন।

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *