সময় কারওর জন্যই থেমে থাকে না, যেমন থেমে থাকেনি আমার জীবনেও। সেবার মালদা থেকে ফিরে, পাড়ার টুর্নামেন্ট নিয়ে মেতে উঠলাম ঠিকই কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য নানান জায়গায় ছোটাছুটি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে, এক স্থানীয় কলেজে আমি ভর্তি হয়ে গেলাম। ইতিহাস নিয়ে পড়ার ইচ্ছা আমার সেই ছোটবেলা থেকে সুতরাং আর দেরি না করে আনন্দের সঙ্গে ইতিহাসকে নিজের কাছে টেনে নিলাম। এদিক, ব্যবসার স্বার্থে বাবা এখন প্রায় মাসের অর্ধেক দিনই কাটান আসানসোলে, ফলে বাড়িতে লোক বলতে কেবল তিনজন। আমি, সমুদা আর গোপাল কাকা। এই গোপাল কাকা আমাদের রান্না থেকে শুরু করে বাড়ির সব কাজই করেন। তাকে সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি সুতরাং সময়ের সঙ্গে তিনিও এখন আমাদের পরিবারেরই এক সদস্য হয়ে উঠেছেন।
সেদিন রাতে দেরি করে ঘুমানোয়, সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছিল, গোপাল কাকা এসে ডাকতেই তড়িঘড়ি ঘুম চোখেই নিচের ঘরে নেমে এলাম। তখন সবে খবরের কাগজে চোখ রেখেছি, এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল।
গোপাল কাকা গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে এক ভদ্রলোক সমুদার খোঁজ করছেন। গোপাল কাকা তাকে আমাদের বসার ঘরে নিয়ে এলেন এবং তিনি পরিচয়সহ সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নমস্কার! আমি প্রভাত সেন। এক সমস্যায় পড়ে আজ আপনার কাছে এসেছি সমরেশবাবু।’
শুনেই সমুদা তাকে প্রশ্ন করল, ‘তা সমস্যাটা ঠিক কী?’
প্রভাতবাবু একটু ঢোক গিলে বললেন, ‘আসলে সমস্যাটা ঠিক আমার নয়, আমার দাদা বনমালী সেনের। তিনিই আমায় আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’
এরই মাঝে গোপাল কাকা, প্রভাতবাবুর জন্য চা নিয়ে এসে হাজির এবং সেই চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে তিনি বাকি কথা বললেন, ‘আমার দাদা কিছু মাস আগে তার বাল্য সময়কার দুই বন্ধুর সঙ্গে পুরুলিয়ায় ঘুরতে গেছিলেন আর সেখানেই তিনি আমাদের পরিবারের এক বহুমূল্য সম্পদ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু সেই হারানোর বোধ, তার হয় এখানে ফিরে এসে। এখন সে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছে না যে ওই জিনিস সে হারাল কীভাবে আর কখনইবা হারাল।’
সব শুনে সমুদা বলে উঠল, ‘আচ্ছা! আপনি সেই জিনিসের বিষয় কিছু জানেন?’
উত্তরে প্রভাতবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! নিশ্চয়ই জানি, তবে সেটা আমার দাদা আপনাকে স্বয়ং নিজের মুখে বলবেন বলে ঠিক করেছেন, তাই সেই কথা নয় আপনি তার মুখেই শুনবেন। দাদার ইচ্ছা, আপনি এই সমস্যার সমাধানের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিন। অতএব আর না করবেন না সমরেশবাবু।’
প্রভাতবাবুর কথা আর ফেলতে পারল না সমুদা। সে বলল, ‘এই তদন্তের ভার নেওয়ার বিষয়টায় যাওয়ার আগে, আপনার দাদার সঙ্গে আমার দেখা করাটা খুবই জরুরি। সুতরাং আপনি ফিরে গিয়ে ওনাকে বলবেন, আমরা আগামীকালই ওনার সঙ্গে দেখা করতে যাব।’
সমুদার কথা শুনে প্রভাতবাবুর মুখে এক চওড়া হাসি লক্ষ করলাম, একইসঙ্গে তাকে সমুদার উদ্দেশ্যে বলতে শুনলাম, ‘আপনার মূল্যবান সময় আমাকে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ সমরেশবাবু। আমি তাহলে দাদাকে গিয়ে জানাব যে আপনি আগামীকাল তার সঙ্গে দেখা করতে আমাদের বাড়ি আসছেন।’
‘হ্যাঁ, আপনি বনমালীবাবুকে গিয়ে বলবেন আমরা সকাল দশটা নাগাদ ‘সেন ভিলা’য় পৌঁছে যাব।’ বলল সমুদা। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রভাতবাবুর প্রস্থান ঘটল আর সেই সঙ্গে আমার মনের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগল। আমি সমুদাকে প্রশ্নগুলো করলামও বটে, ‘আচ্ছা! সমুদা, কী হতে পারে বলত সেই বহুমূল্য জিনিস, যার কারণে আজ প্রভাতবাবুর এখানে ছুটে আসা? আর কেনইবা তিনি ওই জিনিসের কথা বলতে গিয়েও চেপে গেলেন?’
প্রশ্নগুলো শুনে সমুদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো আগামীকালই পেয়ে যাবি। তবে, এখনই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে এইসব মাথার মধ্যে আনিস না। আগে ওনার সঙ্গে কথা বলে দেখি, তারপর এই কেসটা নিয়ে এগবো কিনা ভাবা যাবে।’
হ্যাঁ! সমুদা বরাবর শুরুতে এইরূপ কথা বললেও, শেষমেশ সে তদন্তের ভারটা নিজের কাঁধেই নেয় সুতরাং আবারও এক রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছি ভেবে আমি বেশ উত্তেজিত বোধ করছিলাম।
পরদিন সকালেই সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম ‘সেন ভিলা’র উদ্দেশ্যে। প্রভাতবাবু আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য বাড়ির সদর দরজার সামনে উপস্থিত ছিলেন এবং তিনিই আমাদের নিয়ে গেলেন বনমালীবাবুর ঘরে। বনমালীবাবুকে দেখে মনে হলো, ওই জিনিস হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই যেন ওনার শরীরের অবনতি ঘটেছে।
আমাদের দেখে উনি ভারী খুশি হলেন। সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সমরেশবাবু, আপনি তাহলে এলেন আমার বাড়ি। আচ্ছা! এখানে আসতে আপনাদের কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
উত্তরে সমুদা ওনাক বলল, ‘না! না! একদমই অসুবিধা হয়নি। তবে, এবার যদি আসল বিষয়টা খুলে বলেন।’
সমুদার কথা শেষ হতেই বনমালীবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! নিশ্চয়ই। কিন্তু আপনার সঙ্গে এই বালকটি কে, জানতে পারি?’
‘ও আমার ভাইপো, বঙ্কু। তবে, ওকে বালক বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। বঙ্কু এখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে প্রবেশ করেছে।’ সমুদার কথা শুনে দেখলাম বনমালীবাবু একটু হেসে বললেন, ‘হা হা হা। আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে বঙ্কুবাবু, আমাকে ক্ষমা করে দিও।’
এরপর উনি মূল কথায় ফিরলেন, ‘সেই বহুমূল্য জিনিসে আসলে আমার পিতা স্বর্গীয় দেবেন্দ্রনাথ সেনের অষ্টধাতুর তৈরি এক হনুমানজির মূর্তি।’
কথাটা শুনে আমি বেশ চমকে উঠলাম! ওই বিষয় উনি আরও জানালেন, ‘আসলে ওই হনুমানজির মূর্তি আমার পিতা পেয়েছিলেন ওনার গুরুদেব স্বর্গীয় শ্রী হেমন্ত আচার্যের থেকে। আমার পিতা ছিলেন গুরুদেবের অন্যতম প্রিয় শিষ্য এবং মারা যাওয়ার আগে উনি সেই মূর্তি ওনার হাতে তুলে দিয়ে যান। তারপর থেকে সেই মূর্তি হয়ে ওঠে আমাদের বাড়ির এক বিশেষ সম্পদ। আমার পিতার মৃত্যুর আগে, উনি ওইভাবেই আমায় একদিন ওনার ঘরে ডেকে ওই হনুমানজির মূর্তি তুলে দেন আমার হাতে আর সেই দিন থেকে ওই মূর্তি রয়েছে আমার কাছে। যখনই কোথাও যেতাম, মূর্তিটাও নিয়ে যেতাম আমার সাথে। কিন্তু কি যে এবার হয়ে গেল, সব শেষ হয়ে গেল।’
সমুদা ওনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি সেই মূর্তির কথা এবার কাউকে বলেছিলেন, মানে আপনার ওই দুই বন্ধুকে?’
উত্তরে উনি বললেন, ‘হ্যাঁ! বলেছিলাম। তবে, তাদের যে এই ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ রয়েছে, সেটা আমার অন্তত চোখে পড়েনি।’
সমুদা ফের প্রশ্ন করল, ‘আপনাদের গুরুদেবের আশ্রম কোথায়?’
উনি বললেন, ‘ওনার আশ্রম পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডিতে, সেই আশ্রম বলতে গেলে অযোধ্যা পাহাড়ের একদমই নিকটে অবস্থিত।’
কথা শেষ হতে না হতেই প্রভাতবাবু ও তাদের এক কাজের লোক, আমাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে এসে হাজির। প্রভাতবাবু বললেন, ‘আপনারা আগে এই সামান্য কিছু খেয়ে নিন, তারপর নয় বাকি কথা বলবেন।’ বনমালীবাবুও তার কথায় সায় দিলেন।
আমি আর সমুদা তাদের কথামতো মিষ্টি নিলাম মুখে তুলে আর তারই মাঝে সমুদা বনমালীবাবুকে আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা! আপনার সেই বন্ধুরা কোথায় থাকেন?’
উত্তরটা দিলেন প্রভাতবাবু, ‘প্রতাপদা থাকেন বেহালার দিকে আর ড. ভাদুরী থাকেন হাওড়ার শিবপুরে।’
‘তা কাকে আপনার সন্দেহ হয় বনমালীবাবু?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম আমি বনমালীবাবুর উদ্দেশ্যে।
কিছুটা হাসির ছলেই বনমালীবাবু সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন, ‘দুজনেই আমার পরম বন্ধু কিন্তু কে যে এই কাজ করেছে সেটা বার করার দায়িত্ব তো তোমার কাকার, বুঝলে বঙ্কুবাবু? হা হা হা।’
সমুদা আবারও ওনাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার এই বাড়িতে আর কে কে থাকেন?’
উনি বললেন, ‘আমি, প্রভাত, দুজন কাজের লোক আর বীরেন।’
‘বীরেন কে?’ জিজ্ঞেস করল সমুদা।
তার উত্তরে বনমালীবাবু বললেন, ‘বীরেন হলো আমার সেক্রেটারি, ও আমার বিভিন্ন লেখাপত্র আর অফিস এর কাজ করে দেয়। সেও এই বাড়িতেই থাকে। খুব বিশ্বস্ত।’
ওনার কথা শুনে সমুদার বীরেনবাবুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা হলেও, সেটা তখন সম্ভবপর নয়। কারণ প্রভাতবাবু আমাদের জানালেন, ‘বীরেন তো এখন বাড়িতেই নেই। কিছু দিন হলো একটা কাজে ও কৃষ্ণনগর গেছে।’
সেটা শুনে সমুদাকে বলতে শুনলাম, ‘তাহলে বীরেনবাবুর সঙ্গে পরে আলাপ করা যাবে। তবে, এবার বনমালীবাবু আপনাকে একটু ভেবে বলতে হবে, সেবার পুরুলিয়া পৌঁছনোর পর থেকে, ঠিক কী কী ঘটনা ঘটেছিল?’
বনমালীবাবুকে দেখলাম বেশ দুঃখের সঙ্গে বলতে, ‘সমরেশবাবু, আমরা তিনদিন ছিলাম বাঘমুন্ডিতে কিন্তু ওই তিনদিনের মধ্যে শেষ দু-দিনের কথা আমার একেবারেই মনে নেই। শুধু মনে আছে, ওই দু-দিনের মধ্যে, আমরা একদিন অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে গেছিলাম।’
সমুদা ওনার কথা শেষ হতেই বলল, ‘ঠিক আছে। আপনাকে আজ আর বেশি কষ্ট দেব না। তবে, আপনার দুই বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ওনাদের বাড়ি আমায় যেতেই হবে এবং আশা করি এই বিষয় আপনার কোনো অসুবিধা নেই?’
বনমালীবাবু এক গাল হেসে বুঝিয়ে দিলেন যে ওনার এই বিষয় কোনো আপত্তি নেই। তবে, এটাও উনি সমুদাকে জানিয়ে দিলেন, ‘সমরেশবাবু, একটু খেয়াল রাখবেন যাতে এই তদন্তের জন্য আমার দুই বন্ধুকে যেন অপমানিত না হতে হয়। ওরা আমার খুব কাছের বন্ধু।’
সমুদা ওনাকে সেই আশ্বাস দিলো। আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় যেতে যেতে আমি সমুদাকে প্রশ্ন করলাম, ‘সমুদা, তোমার কী মনে হয়, কে এই মূর্তি চোর?’
কথাটা শোনামাত্র সমুদা আমার দিকে ফিরে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি কি সব ধরা পড়বে রে, বঙ্কু? এর জন্য আমাদের অনেকটা পথ চলতে হবে। তবে, সবার আগে ওনার দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হবে। তাহলেই আসল রহস্যের কিছুটা হলেও অনুমান করা সম্ভব।’
কথাগুলো শুনে আমার কেন জানি না মনে হতে লাগল, এই আসল চোর সেই দুই বন্ধুর মধ্যেই একজন কিন্তু এখানেও রয়েছে এক সমস্যা। বনমালীবাবু এতটাই ওনার দুই বন্ধুকে বিশ্বাস করেন যে উনি ওই মূর্তি হারানোর থেকেও বেশি চিন্তিত ওনাদের অপমানের কথা ভেবে। আর ঠিক এই পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন আমার অদ্ভুত ঠেকছে এবং সবকিছুই যেন যাচ্ছে গুলিয়ে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সমুদা যখন একবার নিজেকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেছে তখন হাজার গণ্ডগোল হলেও আমরা ঠিক আসল অপরাধীকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হব। এই গণ্ডগোলের সূত্রপাত যখন অযোধ্যা পাহাড় দেখতে গিয়েই হয়েছে, তাই এই তদন্তের নাম দেওয়া যেতেই পারে— ‘গণ্ডগোলের অযোধ্যা’।
বাড়ি ফিরে সমুদার সঙ্গে আমার ওই বিষয় আর কোনো কথা হয়নি। পরদিন সকালে অবশ্য সমুদা নিজে থেকেই আমায় ঘুম থেকে তুলতে এল। সে কাছে এসে বলল, ‘বঙ্কু, তৈরি হয়ে নে। আমাদের এখনই বেরোতে হবে।’
কথাটা কানে যেতেই, আমি এক লাফে বিছানা থেকে উঠে নিচে নেবে এলাম এবং সকালের জলখাবার সেরে সমুদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম বনমালীবাবুর বন্ধু প্রতাপ সামন্তের বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের ট্যাক্সি যখন বেহালায় ওনার বাড়ি এসে পৌঁছাল, তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় এগারোটা।
আমরা ওনার বাড়িতে প্রবেশ করতেই একজন এগিয়ে এসে আমাদের বলল, ‘কে আপনারা, কী চান এখানে?’
লোকটার প্রশ্ন শুনে আমাদের বুঝতে দেরি হলো না যে সে এই বাড়ির দারোয়ান। সেই প্রশ্নের উত্তরে সমুদা বলল, ‘আমরা প্রতাপবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, উনি কি আছেন বাড়িতে?’
নিজের বাবুর নাম শুনে লোকটি আমাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। বলল, ‘আপনারা এখানে বসুন, আমি বাবুকে ডেকে দিচ্ছি।’ আমরা ওই ঘরের মাঝে রাখা চারটি চেয়ারের মধ্যে দুটিতে বসালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে এসে উপস্থিত হলেন প্রতাপ সামন্ত।
বাড়িতে হঠাৎ করে দুজন অচেনা ব্যক্তির আগমনে উনি যে একটু বিরক্ত হয়েছেন, সেটা ওনার হাবভাবেই স্পষ্ট। আমাদের উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে আপনারা, আমার সঙ্গে আপনাদের ঠিক কী দরকার?’
আমরা চেয়ার ছেড়ে তখন উঠে দাঁড়ালাম এবং সমুদাকে ওই মুহূর্তে ওনাকে বলতে শুনলাম, ‘নমস্কার! আমি সমরেশ দত্ত আর ও আমার ভাইপো, ভানু কুমার দত্ত।’
সমুদা কথাটা শেষ করার আগেই উনি বলে উঠলেন, ‘গোয়েন্দা সমরেশ দত্ত আপনি?’
উত্তরে সমুদা বলল, ‘হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন আপনি।’
শুনেই প্রতাপবাবু বললেন, ‘তা আমার বাড়িতে কী কারণে এক গোয়েন্দার হঠাৎ আগমন ঘটল জানতে পারি?’
সমুদা তখন ওনাকে সব খুলেই বলল, ‘আপনার বন্ধু, বনমালী সেনের হারিয়ে যাওয়া হনুমানজির মূর্তির তদন্তের স্বার্থেই আজ আমি এখানে ছুটে এসেছি। তাই প্রতাপবাবু, আপনাকে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এই তদন্তের কাজে সাহায্য করতে হবে।’
কথাটা শুনেই উনি যেন চটে গেলেন, ‘মূর্তি হারিয়ে এখন বনমালী কি সবার পিছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে? সত্যি! ওকে নিয়ে আর পারা গেল না, একেবারে ইডিয়ট।’
সমুদাকে ফের বলে উঠল, ‘আপনি দয়া করে এত রেগে যাবেন না, মাত্র কিছু মিনিটের ব্যাপার।’
সমুদার কথা শেষ হতেই উনি সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, ‘ঠিক আছে। বলুন, কী জানতে চান, তবে বাজে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে পাবেন না। এটা আগেই বলে রাখছি আপনাকে কারণ এখনকার গোয়েন্দা মানেই কিছু অবাস্তব প্রশ্নের বাণ ছুড়ে দেওয়া, যাতে ভুলকে ঠিক আর ঠিককে ভুল প্রমাণ করা যায়।’
প্রতাপবাবুর প্রত্যেকটা কথা শুনে আমাদের বুঝতে দেরি হয়নি, উনি গোয়েন্দা শব্দটা একেবারেই পছন্দ করেন না। কিন্তু কী আর করা যাবে, ওনার সেই বিরক্তিসহ মুখে কিছু বিরক্তি সহকারে উত্তর পাওয়া ছাড়া আমাদের যে আর তখন কিছুই করার নেই। সুতরাং সমুদা ওনাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার কি মনে আছে ঠিক কবে নাগাদ, বনমালীবাবু আপনাদের সেই মূর্তিটি দেখিয়েছিলেন?’
প্রতাপবাবু ওনার ভুরু দুটি কুঁচকে উত্তর দিলেন, ‘অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার দিন বনমালী আমাদের ওই মূর্তি দেখিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সেই বিষয় ভাদুরী আর আমার এক বিন্দুও আগ্রহ ছিল না।’
উত্তর পেয়ে সমুদা আবার ওনাকে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে সেদিন আপনাদের সঙ্গে কি এমন কোনো ঘটনা ঘটেছিল, যা আপনার মনে আছে কিন্তু বনমালীবাবুর মনে নেই?’
প্রশ্নটা করা মাত্রই উনি ওনার চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘দেখুন মি. দত্ত। আমি এখন একটু বেরুব, তাই আমাকে আর কোনো প্রশ্ন করা হক, সেটা আমি চাই না।’
ওনার কথার আসল মানেটা বুঝতে পেরে আমি আর সমুদা চেয়ার থেকে উঠে, আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। সমুদার কথামতো গেলাম শিবুদাদুর বাড়ি।
রাস্তায় যেতে যেতে আমি সমুদাকে বললাম, ‘সমুদা, উনি যে আমাদের এইভাবে অপমান করলেন তোমার খারাপ লাগেনি?’
আমার কথার উত্তর সমুদা হাসি মুখেই দিল, ‘খারাপ লাগেনি বললে ঠিক হবে না কিন্তু গোয়েন্দা হতে গেলে যে একটু সহ্য করতেই হবে, বঙ্কু। এটা ভুললে চলবে না, বুঝলি?’
আমি শুধু ঘাড় নেড়ে সমুদার কথায় সায় দিলাম। এরপর সমুদা আরও বলল, ‘প্রতাপবাবু লোকটা খুবই অহংকারী। উনি যে কথাগুলো আমাদের বললেন তার সঙ্গে আসল ঘটনার আদৌ কোনো মিল আছে কিনা তা ড. ভাদুরীর সঙ্গে দেখা করার পরই বোঝা যাবে।’
শিবুদাদুর বাড়ি বেহালাতেই ফলে আমদের সেখানে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। দরজা খুলে আমাদের দুজনকে দেখে শিবুদাদু একগাল হাসি নিয়ে বলে উঠল, ‘আরে, আজ কারা এল আমার বাড়িতে! সমু গোয়েন্দা আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট, বঙ্কু। বাহ! বাহ! তা, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এসো তোমরা।’
হ্যাঁ! আমাদের দেখলে শিবুদাদু বরাবরই আনন্দিত হন। এবারও যে উনি সমানভাবে আনন্দিত হয়েছেন, তা ওনার কথা শুনেই বোঝা গেল। আমরা ওখানেই দুপুরের খাওয়া সারলাম। খাওয়ার পর আমরা শিবুদাদুর ঘরে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটালাম এবং তখনই কথায় কথায়, বেরিয়ে এল সমুদার নতুন তদন্তের কথা।
পুরো বিষয়টা সমুদার মুখে শুনে শিবুদাদু বললেন, ‘সমু, তোর একবার বাঘমুন্ডি ঘুরে আসা উচিত। কারণ আমার মনে হয়, এই গল্পের সূত্র ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে।’
সমুদাকে তার উত্তরে বলতে শুনলাম, ‘হ্যাঁ! আমিও এই একই কথা ভেবেছিলাম কিন্তু তাও বুঝে উঠতে পারছিলাম না, বিষয়টার শুরু কোথায়।’
সমুদার কথা শেষ হতে না হতেই শিবুদাদু মুখে একটু মৃদু হাসিসহ বললেন, ‘আর তাই পরামর্শ নিতেই সমু গোয়েন্দার আজ এখানে ছুটে আসা, তাই তো?’
সমুদাও আর তার হাসি চেপে রাখতে পারল না। সেও হেসে বলল, ‘শিবু কাকা, সত্যি তোমার জবাব নেই। কীভাবে যে তুমি বুঝে যাও।’
আবারও হাসতে হাসতে শিবুদাদু বললেন, ‘হা হা হা! সমু রে এমনি এমনি তো আর মাথার চুলগুলো সাদা হলো না। তোকে সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে আসছি। যখনই তোর মনে কোনো বিষয় নিয়ে দ্বিধাবোধ কাজ করেছে, তখনই তুই আমার কাছে ছুটে এসেছিস। এখন গোয়েন্দা হয়েছিস বলে যে সেই স্বভাব বদলাবে, তেমনটা আমি বিশ্বাস করি না।’
সেদিন শিবুদাদুর থেকে অনেক কিছুই উপলব্ধি হলো, সেইসঙ্গে আমাদের সামনে অনেক বন্ধ দরজাও খুলে গেল যা পরবর্তী সময় এক মোক্ষম ভূমিকা বহন করতে পারে। ওইদিন আমরা আর অন্য কোথাও না গিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম এবং খুব ক্লান্তির কারণে আমি আর অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম কিন্তু সমুদা জানালার সামনে বসে কী যেন চিন্তা করতে লাগল। তার মাথায় তখন এই রহস্যকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা সমীকরণ! এখন তাই বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে এই তদন্ত ক্রমশই জটিল হয়ে উঠছে।
পরদিন সকালে সমুদার সঙ্গে আমি বেরিয়ে পড়লাম বনমালীবাবুর আরেক বন্ধু, ড. ভাদুরীর বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওনার বাড়ি হাওড়ার শিবপুরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, উনি সেদিন খুব ভোরেই চেম্বারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন। তখন আমরা ওনার স্ত্রীর থেকে সেই চেম্বারের ঠিকানা নিয়ে সেখানে গিয়ে হাজির হলাম। আমাদের দেখে ড. ভাদুরী একটু অবাক হলেন প্রথমে কিন্তু পরে আমাদের, বিশেষ করে সমুদার পরিচয় জানতে পেরে খুবই আনন্দিত হলেন। বললেন, ‘আমি আপনার কাজ সম্বন্ধে এত শুনেছি যে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি আপনার ভক্ত হয়ে গেছি। সমরেশবাবু, আপনার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছাটা আমার বহুদিনের আর তাই আজ সেটা পূরণ হওয়ায়, আমি খুবই আনন্দিত।’
নিজের প্রশংসা শুনলে সমুদা যে একটু লজ্জা পায়, সেটা আমার জানা। কিন্তু ওই মুহূর্তে সমুদা নিজের হাসি চেপে আমাদের আসার আসল কারণটা ওনাকে জানাল। পুরো বিষয়টা শুনে ড. ভাদুরী অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বললেন, ‘সমরেশবাবু, কী যে হয়ে গেল কে জানে! বনমালীর আরেকটু সচেতন হওয়া উচিত ছিল। আপনার যদি এই বিষয় কিছু জানতে চাওয়ার থাকে, তাহলে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। প্লিজ ডোন্ট হেজিটেট।’
সমুদা ওনার থেকে যা তথ্য সংগ্রহ করল, তা আমাদের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে একেবারেই অমিল। ওনার কথা অনুযায়ী, অযোধ্যা পাহাড় ঘুরতে যাওয়ার ঠিক আগের রাতেই বনমালীবাবু ওনাদের সেই মূর্তি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতাপবাবু আবার আমাদের বলেছিলেন যে ওনারা ঘুরতে যাওয়ার দিনই সেই মূর্তি দেখেছিলেন।
আর এখানেই ঘটছে যত গণ্ডগোল! দুজনের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ একজন আমাদের ভুল তথ্য দিচ্ছে আর আমার সন্দেহের তীর, সেই আত্মঅহংকারী পুরুষটির উপর।
ড. ভাদুরীর চেম্বার থেকে ফেরার পথে সমুদাকে নিজের সন্দেহের কথা বলতেই, সে বলল, ‘বঙ্কু, নিজের মাথাটা একটু কাজে লাগা নাহলে বুদ্ধি উড়ে যাবে। ডিটেক্টিভ গল্পের বই পড়া কি ছেড়ে দিয়েছিস? অধিকাংশ ডিটেক্টিভ গল্পের মধ্যেই দেখবি, যাকে প্রথমে ভালো ভেবেছিস সেই কিন্তু শেষে গিয়ে আসল অপরাধী রূপে চিহ্নিত হয়েছে।’
কথাগুলো আমি চুপ করেই শুনলাম কিন্তু কেন জানি না মনে হচ্ছিল ড. ভাদুরী অপরাধী নন। বাড়ি ফিরেই সমুদা টেলিফোনে বনমালীবাবুকে জানালেন যে তার তদন্ত অনেকটাই এগিয়েছে সুতরাং সেই বিষয় আরও বিস্তর জানাতে আমরা সেদিন রাতেই ওনার বাড়ি যাব।
তারপর কথামতোই কাজ, আমরা হাজির হলাম গিয়ে বনমালীবাবুর বাড়ি। সেখানে পৌঁছে আমরা সর্বপ্রথম বনমালীবাবুকে চিন্তামুক্ত করলাম, ওনাকে জানালাম যে এই তদন্তের কারণে ওনার কোনো বন্ধুকেই অপমান সইতে হয়নি। কথাটা শুনে উনি স্বস্তিবোধ করলেন ঠিকই, তবে একইসঙ্গে ওনার মূর্তি রহস্যের সমাধান কতদূর হলো তা জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
সমুদা ওনাকে তখন বলল, ‘অনেক কিছুই জানা গেছে বনমালীবাবু কিন্তু এখনই যে আমি মাঝ পথ পেরিয়েছি, তা বললে ভুল হবে।’
কথাগুলো শোনার পর বনমালীবাবুকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হলো। উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘তাহলে হনুমানজির মূর্তি ফিরে পাওয়ার কি আর কোনো আশা নেই?’
সমুদা ওনার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি থাকতে আপনার মূর্তির কিছু হবে না, বনমালীবাবু। আপনি ঠিকই ফিরে পাবেন, তবে তার জন্য আপনাকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে।’
উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এখন তাহলে কী করবেন সমরেশবাবু?’
সামনে রাখা গ্লাসের জলে নিজের ঠোঁট ভিজিয়ে সমুদা বলল, ‘আমার আর বঙ্কুর বাঘমুন্ডি যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে আপনাকে। আসল গণ্ডগোল যখন ওখানে ঘটেছে, তখন এর সমাধানও ওখানেই থাকতে পারে।’
সমুদার কথা শুনে আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম কিন্তু পরে বুঝলাম, এতদিনে আমি হয়তো পাকাপাকিভাবে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে উঠতে পেরেছি। আর তাই সমুদা স্রেফ আমি-র বদলে আমাদের শব্দটা ব্যবহার করল। বনমালীবাবু সমুদার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতবাবুকে ওনার ঘরে ডেকে পাঠালেন। তিনি এসে সমস্ত কথা শোনার পর ওনার দাদার কথামতো আমাদের পুরুলিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
তারপর বাকি কিছু কথাবার্তা সেরে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি, এমন সময় ওখানে এসে উপস্থিত বীরেন মণ্ডল। হ্যাঁ! এই বীরেন মণ্ডলই হলো বনমালীবাবুর সেক্রেটারি। তার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো সে খুবই শান্ত স্বভাবের। বনমালীবাবুকে তিনি নিজের বাবার থেকেও বেশি স্নেহ করেন, যা দেখে সমুদা ফেরার পথে ট্যাক্সিতে আমায় বলল, ‘বনমালীবাবুর প্রতি বীরেনবাবুর এত স্নেহ দেখে মনে হচ্ছে যেন অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ! তা তোর কী মনে হয়, বঙ্কু?’
আমি একটু রেগেই সমুদাকে বললাম, ‘তোমার কি সবেতেই সন্দেহ হয়? সে তো বেশ ভালো মনেই আমাদের সঙ্গে কথা বলছিল এবং দেখলে না বনমালীবাবুকে সে কতটাই না ভালোবাসে, যে এতদূরে নিজের পরিবার ছেড়ে এখানে এসে রয়েছে।’
কথাটা শেষ করতে না করতেই সমুদা বেশ গম্ভীর হয়ে বলে উঠল, ‘ভেবেছিলাম বয়সের সঙ্গে তোর বুদ্ধিটাও বেড়েছে কিন্তু এখন দেখছি সেটা ভুলই ভেবেছিলাম। ওরে, গোয়েন্দাদের এত নরম মনের হলে চলে না।’
উত্তরে আমি বললাম, ‘তার মানে তুমি বীরেনবাবুকেও সন্দেহ করছ?’
সমুদা এবার একটু ঠাট্টার ছলেই আমার প্রশ্নের জবাব দিল, ‘হ্যাঁ! করি বইকি, একশবার করি। সন্দেহ যে সকলকেই করতে হচ্ছে রে বঙ্কু, এমনকি তোকেও।’
আমি রেগে উঠলাম সমুদার কথা শুনে, ‘ঠাট্টা কোরো না সমুদা। আমি কীভাবে নেব ওই মূর্তি!’ আমাদের মধ্যে সেই খুনসুটি চলতেই থাকল এবং সেটা থামল আমাদের বাড়ির সামনে এসে।
ট্যাক্সি থেকে নেবে বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তে আমার প্যান্টের নিচের ভাঁজের দিকে সমুদার নজর পড়ল। কারণ সেই প্যান্টের ভাঁজে লেগে রয়েছে কিছু মাটি, যেই মাটি এখানে খুঁজে পাওয়া প্রায় দুষ্কর ব্যাপার। সমুদা তখন সেই বিষয় আমায় কিছুই বলল না, সে খাওয়ার পর রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমাকে বারান্দায়ে ডেকে পাঠাল।
আমি বারান্দায় যেতেই সমুদা আমাকে বলল, ‘আমার সন্দেহ ভুল নয় বুঝলি!’ কথাটা শোনার পর আমি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। আর তাই সমুদা আবারও বলল, ‘তোর প্যান্টে কীভাবে লালমাটি লাগল আন্দাজ করতে পারছিস?’
আমি তখন কী বলব বুঝতে না পারে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কী করে বুঝলে ওটা লালমাটি?’
সমুদা একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘কোনটা কী মাটি, সেটা বোঝার বুদ্ধি আর বয়স দুটোই আমার হয়েছে, বঙ্কু।’
এরপর সে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘বীরেনবাবুকে তোর তো খুব ভালো লেগেছে, তাই না? তবে, ওর ব্যাগটা কি লক্ষ করেছিলিস? ওতে ভেজা মাটি লেগেছিল আর আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে তোর সঙ্গে কথার বলার সময়, কোনো প্রকারে সেই ব্যাগে লেগে থাকা মাটি তোর প্যান্টের ভাঁজে লেগে যায়। কিন্তু আসল কথা হলো, কী করে এই মাটি ওর ব্যাগে লাগল?’
আমি উত্তরে বললাম, ‘কেন সমুদা, ওটা হয়তো ওর রাস্তাতেই লেগেছিল!’
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সমুদা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! এটাই ঘটেছে। আমার বিশ্বাস, ও নিশ্চয়ই এমন কোথাও গেছিল যেখানে ওই মাটি ওর ব্যাগে লেগে যায় আর হতেই পারে সেই জায়গা পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি কারণ এইরকম মাটি ওই অঞ্চলের কিছু জেলাতেই পাওয়া সম্ভব।’
কথাটা শুনে আমি একদম চমকে উঠলাম। সমুদাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে বীরেনবাবু কি কৃষ্ণনগর যায়নি?’
সমুদা আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিল, ‘বীরেনবাবু যে কৃষ্ণনগর একেবারেই যায়নি, সেটা না জেনে বলাটা উচিত হবে না। সে গিয়েও থাকতে পারে, তবে পুরুলিয়া সে গেছিলই। কারণ তার প্রমাণ তোর প্যান্টে লেগে থাকা এই লালমাটিই বলে দিচ্ছে। এই মাটি কৃষ্ণনগরে পাওয়া অসম্ভব।’
সমুদার সকল কথা শুনে আমার মাথা গেল ঘুরে। আমি যা যা ভেবেছিলাম, তার একশ ভাগের মধ্যে আশি ভাগই একদম হয়ে গেল উলটো। এখন তাই, সেই সম্ভব্য মূর্তি চোরেদের তালিকায় ফেলে দিতেই হচ্ছে বীরেন মণ্ডলকে।
এখন মনে একটাই প্রশ্ন, কে আসল অপরাধী? বনমালীবাবুর দুই বন্ধুর মধ্যে একজন নাকি ওনার সেক্রেটারি অর্থাৎ বীরেন মণ্ডল? আমরা যে ঠিক পথেই এগোচ্ছি সেই বিশ্বাস নিয়ে আমি গেলাম ঘুমাতে কিন্তু সমুদা গেল না, সে আরও কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে রইল বারান্দায়।
পরদিন সকাল হতেই প্রভাতবাবু আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত এবং সমুদার কথামতো আমাদের বাঘমুন্ডি যাওয়ার সব ব্যবস্থাই তিনি সেরে ফেলেছিলেন। আমাদের সেদিন বিকেলেই রওনা দিতে হবে পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে, তবে অল্প সময়ের মধ্যে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়নি, এবার তাই আমাদের বাসেই যেতে হচ্ছে।
সমুদার মুখে বাসে যাওয়ার কথা শুনে আমার খুব মজা হচ্ছিল কারণ নতুন এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে চলেছি। বিকেলের মধ্যেই আমরা ধর্মতলায় পৌঁছে গেলাম এবং সেখানে প্রভাতবাবু আগে থেকেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার সম্মুখে যেতেই জানতে পারলাম যে তিনিও আমাদের সঙ্গে বাঘমুন্ডি যাচ্ছেন। তারপর আর দেরি নয়, উঠে পড়লাম বাসে এবং ঠিক পাঁচটায় ছাড়ল আমাদের বাস পুরুলিয়ার উদ্দেশে।
পরদিন আমরা পুরুলিয়া পৌঁছে এক মোটরগাড়ি ভাড়া করে নিলাম। ওই গাড়িতেই বাকি পথ পেরিয়ে পৌঁছালাম বাঘমুন্ডি। মোটরগাড়িতে সেই যাত্রা ছিল বেশ মনোরম। দু-দিকে সবুজ খেত, তার মাঝে রাঙা মাটির পথ, যার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের মোটরগাড়ি। একটু দূরে তাকালেই দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মধ্যে খেলা করছে আর তারই মাঝে শোনা যাচ্ছে নানান পাখিদের কলকল, মনে হচ্ছে তারা যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।
সত্যি! আমরা শহুরে মানুষেরা প্রকৃতির কত সুন্দর দৃশ্য দেখা থেকেই না বঞ্চিত থাকি। এই সব দৃশ্য না দেখলে মৃত্যুর পরেও জীবন অধরা থেকে যায়! আবার ফেরা যাক গল্পে, সেদিন বাঘমুন্ডি পৌঁছে সমুদার কথামতো শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে, সমুদা তার আগাগোড়া স্বভাবের মতোই আমাদের গেস্ট হাউসের চারিপাশটা ঘুরে দেখতে বেরিয়ে পড়ল। ঘরে বসে রইলাম শুধু আমি আর প্রভাতবাবু। আমি কী করব তা বুঝে উঠতে না পেরে তার সঙ্গে এই পুরুলিয়ার নানান ইতিহাস এবং সেই বিখ্যাত অযোধ্যা পাহাড় নিয়ে গল্পজুড়ে দিলাম।
প্রভাতবাবুর সঙ্গে গল্প করলেও আমার মাথায় তখন শুধুই ঘুরছিল সমুদার কথা। সে কি সত্যের খোঁজে আজই নেমে পড়েছে এই পুরুলিয়ার মাটিতে? নাকি এই রহস্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্য কোনো রহস্যের সন্ধান করছে সে!
সমুদা অনেক রাতে গেস্ট হাউসে ফেরায়, সেই বিষয়টা নিয়ে তার সঙ্গে আর কোনো কথা হয়নি। পরদিন খুব ভোরে আমাদের ঘুম থেকে উঠে পড়তে হলো, প্রভাতবাবু আমাদের ঘরে এসে জানালেন, ‘সমরশবাবু, গতরাতে দাদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং বীরেন বাড়িতে না থাকায়, আমাকে এখনই কলকাতায় ফিরে যেতে হবে।’
পুরো ঘটনা শুনে সমুদা তাকে অবিলম্বে ফিরে যেতে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি এখনই বেরিয়ে পড়ুন। ওখানে আমি যত তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারবেন, ততই ভালো। আর এদিকের সব কাজ আমি সামলে নেব। দরকার পড়লে আপনাদের সঙ্গে ফোনেই যোগাযোগ করব। আর আপনার দাদাকে বলবেন এই তদন্ত শেষ করেই আমি কলকাতায় ফিরব। তাই আপনি নির্দ্বিধায় রওনা দিন।’
সমুদা কথা শুনে প্রভাতবাবুর মনের যে সামান্যটুকু দ্বিধা বোধ ছিল, তা গেল দূর হয়ে এবং সেই আশ্বাস নিয়ে উনি আমাদের বিদায় জানিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্য রওনা হলেন। এদিকে, ওইদিন দুপুরে সমুদা আর আমি বেরিয়ে পড়লাম স্বর্গীয় গুরুদেব শ্রী হেমন্ত আচার্যদেবের আশ্রম দেখতে।
আশ্রমটা বেশ পুরোনো, তার চারিদিকের দেওয়ালে প্রচুর ফাটল ধরেছে আর তাদের মাঝেই বট ও অশ্বত্থের শেকড় যেন উঁকি দিচ্ছে। আমরা প্রবেশ করতেই কিছু লোক আমাদের পরিচয় জানতে এগিয়ে এল। তাদের দেখে আমরা বুঝতে পারলাম, যে তারা এই আশ্রমেরই শিষ্য। ফলে, তাদের কাছে সমুদা আমাদের পরিচয়সহ বলল, ‘নমস্কার! আমি বনমালীবাবুর বন্ধু, সমরেশ দত্ত আর ও আমার ভাইপো। আমরা বাঘমুন্ডি ঘুরতে আসায়, ভাবলাম গুরুদেবের আশ্রম ঘুরে ওনার আশীর্বাদ নিয়ে আসি। তাই ভাইপোকে নিয়ে চলে এলাম।’
বনমালীবাবুর নাম শুনেই তারা আমাদের আরও বেশি করে আপ্যায়ন করতে লাগল। তাদের সেই আপ্যায়ন দেখে আমরা সহজেই বুঝেছিলাম যে বনমালীবাবুর সেখানে বেশ ভালোই নামডাক রয়েছে। আমরা বাকি ভক্তদের সঙ্গে দুপুরের খাওয়া ওখানেই সেরে নিলাম এবং তারপর গেলাম স্বর্গীয় শ্রী হেমন্ত আচার্যদেবের ছেলে তথা আশ্রমের এখানকার গুরুদেব শ্রী সুশান্ত আচার্যদেবের সঙ্গে দেখা করতে।
সেদিন ওনার কাছে শাস্ত্র সম্বন্ধে অনেক জ্ঞান অর্জন করলাম ঠিকই তবে, কথায় কথায় হঠাৎই ওনার কাছে বনমালীবাবুর বাবার কথা শুনলাম। আচার্যদেব আমাদের জানালেন, ‘আমার স্বর্গীয় পিতা তথা গুরুমহারাজ, বনমালীর বাপকে খুবই ভালোবাসতেন। ওর সেবায় প্রসন্ন হয়ে গুরুমহারাজ, ওনার গুরুর দেওয়া একটি হনুমানজির অষ্টধাতুর মূর্তি তুলে দেন ওর হাতে।’
আচার্য মশাই আমাদের আরও জানালেন, ‘ওই সময় বনমালীর বাপের সঙ্গে আরেক শিষ্যও সমানভাবে গুরুমহারাজের সেবা করেছিল, ওর নাম ছিল সুবীর ভাদুরী। কিন্তু সেই মূর্তি উনি দেননি তাকে কারণ একটাই, সুবীর ওনার সেবা করেছিল শুধু ওই মূর্তির লোভে। গুরুমহারাজের মৃত্যুর কিছুদিন আগে, সুবীর আবারও আশ্রমে এসে বনুমালীর বাপের ব্যাপারে নানান কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে এবং জানতে চায় ওর ঠিকানাও। গুরুমহারাজ অত কিছু না ভেবেই তাকে সঠিক ঠিকানা দিয়ে দেন। পরে জানা যায়, বনমালীর বাপের সঙ্গে সুবীর দেখা করে তাকে ওই মূর্তিটি বিক্রি করে দিতে জোর করে কিন্তু সেই প্রস্তাবে সে রাজি না হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ঘোরতর ঝগড়ার সৃষ্টি হয়। ওই রাগে সেই যে সুবীর, তাদের বাড়ি থেকে চলে গেল, তারপর আর দেখা বা শোনা যায়নি ওর বিষয়।’
আচার্য মশাই সেই মূর্তি হারিয়ে যাওয়ায় সংবাদ পেয়ে এখন খুবই মর্মাহত। যা দেখে সমুদা ওনাকে এই বিষয়ে আশ্বস্ত করে বলল, ‘কষ্ট পাবেন না আচার্য মশাই। ওই মূর্তির খোঁজ ঠিক একদিন পাওয়া যাবে আর অপরাধীরাও ধরা পড়বে।’
কথা শেষ হতে না হতেই উনি বলে উঠলেন, ‘আপনার আসল পরিচয় কী সমরেশবাবু?’
উত্তরে সমুদা বলল, ‘আমি একজন গোয়েন্দা, বলতে পারেন এই মূর্তি লোপাট হওয়ার পুরো ঘটনার তদন্তের ভার আমার কাঁধেই রয়েছে।’
আচার্য মশাই সমুদার আসল পরিচয় জানার পর তার কাছে আর্জি করলেন, ‘আর যাই হোক সমরেশবাবু, খেয়াল রাখবেন যাতে সেই মূর্তি যেন কোনো প্রকারেই পাপিষ্ঠ হাতে চলে না যায়।’
সমুদা সেই ভরসা ওনাকে দিল। ওনার আশীর্বাদ নিয়ে আমরা ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। ফিরেই, আমরা বীরনবাবুকে গেস্ট হাউসে দেখে একটু আশ্চর্য হলাম!
‘আপনি এখানে?’ জিজ্ঞেস করল সমুদা। উত্তরে বীরেনবাবু বলল, ‘আজ্ঞে, আপনাদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এখানে তাই প্রভাতবাবুই আমাদের সহযোগিতার জন্য আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।’
সে আরও বলল, ‘প্রভাতবাবুর আজ্ঞামতো তাই আমি কৃষ্ণনগর থেকে আর কলকাতা না ফিরে, সরাসরি এখানে চলে এলাম।’
সমুদা তাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করে আর তখন বিব্রত করল না। আমরা চলে গেলাম নিজেদের ঘরে। আমরা রাতের খাওয়ার নিজেদের ঘরেই সেরে নিলাম। ওই রাতে কিছুতেই আমাদের চোখে ঘুম আসছিল না, সমুদার তখন মস্তিষ্কে কী যে চলছে তা স্বয়ং ভগবানেরও জানার সাধ্যি নেই।
ঘর অন্ধকার করতেই সমুদা জানালার দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘বিপদ কখন, কীভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে তা জানি না রে বঙ্কু, তাই একটু সজাগ থাকিস, বুঝলি?’
কথাটা শুনে আমি শুধু ঘাড় নাড়লাম। তবে, আমি বুঝতেই পেরেছিলাম সমুদা বীরেনবাবুকেই সন্দেহ করছে কিন্তু সেই তালিকার বাকিরা? তারা কি নিরপরাধ? এই ধন্দ নিয়েই, আমি ঘুমিয়ে পড়লাম আগামীদিনের সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, সমুদা অনেক আগেই বেরিয়ে পড়েছেন বাজারে, তবে সেটা যে একদমই বাজার করার জন্য নয়, তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম। সেদিন সারা সকাল আমি বীরেনবাবুর সঙ্গে গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। আমার একবারের জন্যও তাকে অপরাধী মনে হলো না। কিন্তু সমুদার যে সন্দেহের তীর তো তার দিকেই। তাহলে আমাদের কাছে ভালো সেজে থাকা কি বীরেনবাবুর কাছে আমাদের মূল লক্ষ্য থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নিছকই এক মায়াজাল?
সমুদা দুপুরের মধ্যেই ফিরে এলেন। কিন্তু বীরেনবাবু খাওয়ার সময় উপস্থিত থাকায়, সমুদার থেকে সেই বিষয় কিছু জানতে চাওয়ার সাহস দেখালাম না। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো, কিন্তু আমার কাছে তার বাজার যাওয়ার রহস্য অজানাই রয়ে গেল। রাতের দিকে দক্ষিণের বারান্দায় সুন্দর হাওয়া বইত। রাতে তাই দেখি, সমুদা ওই বারান্দায় বসে রয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন কিছু একটা মনে মনে প্ল্যান করছে। আমি উঠে গেলাম তার কাছে এবং জোর দিয়েই বলে উঠলাম, ‘সমুদা, আজ বাজার গেছিলে কেন?’
উত্তরে সমুদা বলল, ‘বাজার করতে যে যাইনি, তা তুই ভালো মতোই জানিস। আমি গেছিলাম বীরেনবাবুর বিষয় খোঁজখবর নিতে। যদিও বা তেমন কিছু হাতে আসেনি, তবু বলতে দ্বিধা নেই যে তোর প্রিয় বীরেনবাবু নিরপরাধ।’
আমি সমুদার কথা শেষ হতেই তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে সমুদা, আসল চোর কে?’
সমুদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই প্রশ্নের উত্তর এত তাড়াতাড়ি দেওয়া সম্ভব নয় রে, বঙ্কু। এর জন্য আরও কিছুটা সময় দিতে হবে। তবে, বলতে পারিস এই রহস্যের তিন ভাগের দু-ভাগ আজই সমাধান হয়ে গেছে।’
সমুদার অর্ধেক কথার কিছুই বুঝতে পারলাম না, যেটুকু বুঝলাম তা থেকে বলতে পারি এই রহস্যের সমাধান, আমাদের থেকে আর খুব একটা দূরে নেই। আর যেটা না বললেই নয়, তা হলো আমার মানুষ চিনতে শেখা। হ্যাঁ! আমিই প্রথমে বলেছিলাম বীরেনবাবু নিরপরাধ, যা আজ সমুদার কাছেও প্রমাণ হলো।
কিন্তু তাকে ঘিরেও যে আমার মনে প্রশ্ন রয়ে গেল। কীভাবে লাগল সেই লালমাটি তার ব্যাগে? আর কেনইবা সে বনমালীবাবুর ভাইয়ের একবার বলাতেই, ওনাকে ছেড়ে এখানে চলে এল। এইসব প্রশ্ন মাথায় নিয়েই, সমুদার হাত ধরে আমি সামনের দিকে আরও কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, সত্যের সন্ধানে।
পরদিন খুব ভোরেই বীরেনবাবু গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন গেছিলেন, তবে সেই বিষয় আমরা একেবারেই অজ্ঞাত। সমুদা দশটা নাগাদ আমাকে ডাকতে এল ঘরে এবং তখনই জানতে পারলাম যে সেদিন আমরা যাব সেই অযোধ্যা পাহাড়ে ঘুরতে।
খবরটা পেয়ে আমি বেশ আহ্লাদিত হলাম একইসঙ্গে সমুদাকে প্রশ্ন করলাম, ‘এটা কি তোমার কোনো নতুন প্ল্যান, সমুদা?’
একটু হেসে সমুদার উত্তর, ‘সবকিছুই প্ল্যানমাফিক করতে হয় রে বঙ্কু, তবে এবারেরটা একটু রিলাক্সেশনের জন্যও বলতে পারিস।’
আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে সমুদার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম অযোধ্যা পাহাড়ের উদ্দেশে। পথে যেতে যেতে সমুদা বলল, ‘ট্রেক করতে গেলে কী কী করতে হয় জানিস তো?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ! জানি, তবে খুবই সামান্য। সেই দিক থেকে আমি অনভিজ্ঞ বলতে পারো।’
আমার কথা শুনে সমুদা হেসে ফেলল। রসিকতার মাঝেই কখন যে এসে পৌঁছালাম সেই বৃহৎ পাহাড়ের সামনে তা একদমই টের পাইনি। সমুদার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে, আমি হাঁটা দিলাম সামনে অবস্থিত এক তাঁবুর দিকে।
আমরা কাছে গিয়ে দেখি, বেশ কিছু পর্যটক তাদের ট্রেক করার জিনিসপত্র সেখান থেকে ভাড়ায় নিচ্ছে, তবে সমুদা যে আমাকে নিয়ে ট্রেক করতে যাবে না, তা আমি ভালোমতোই জানতাম। সমুদার এখানে আসার উদ্দেশ্য একেবারেই আলাদা, সে যে তদন্তের স্বার্থেই এখানে পা রেখেছে, সেটা তার হাবভাব দেখে আমার বুঝতে খুব একটা সময় লাগেনি। মুহূর্তের মধ্যেই সমুদা যেন কী একটা দেখতে পেল।
আমি জিজ্ঞেস করতেই সে বলে উঠল, ‘দূরে ওই গাছের সামনে একজনকে লক্ষ করছিস? ওই লোকটা আজ আমাদের সারা রাস্তায় ফলো করছে।’
আমি তখন একটু ঘাবড়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ! কিন্তু সে তো গুরুদেবের আশ্রমে ছিল। খামোখা আমাদের পেছনে কেন পড়ে রয়েছে, সমুদা?’
সমুদা আমার প্রশ্নের উত্তর খুব একটা স্পষ্ট করে না দিলেও, সে বলল, ‘হ্যাঁ! ঠিক ধরেছিস। লোকটা আশ্রমেই ছিল, তবে এখন ওর দিকে বেশি তাকাস না। আমি যা বলছি, তা মন দিয়ে শোন।’
সমুদা তারপর আমায় বলল, ‘তুই ওখানে, লোকজনের ভিড়ে ঢুকে পর আর ওদের সঙ্গেই হাঁটতে শুরু করবি। তবে মাথায় রাখিস, খানিকটা পথ গিয়ে ওই বড় পাথরটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়বি। আমি সুযোগ বুঝে সেখানেই তোর জন্য অপেক্ষা করব, আর একদম ঘাবড়াবি না।’
সমুদার কথামতো আমি লোকজনের ভিড়ে মিশে গেলাম এবং তাদের অনুসরণ করে হাঁটা শুরু করলাম। এর মাঝেই সমুদা শুরু করল তার অদ্ভুত খেল! কী সেই খেল, তা একটু পরেই তার থেকে জানতে পারলাম যখন পাহাড়ের সেই নির্দেশিত স্থানে আমাদের দেখা হলো। সমুদাকে প্রথমে দেখে একবারের জন্য হলেও আমি তাকে চিনতে পারিনি, সে যে ধরনের পোশাক পড়েছিল, তা একেবারেই সমুদাসুলভ নয়। কপালে তিলক কাটা, পরনে সাদা ঘিয়ে রঙের ফতুয়া আর ধুতি। তার সঙ্গে অবশ্যই ছিল এক গাল ভর্তি দাড়ি। দাড়িখানা যে নকল তা কোনোভাবেই বোঝার অবকাশ নেই। কিন্তু তার কথা বলার ভঙ্গি দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে সে আর কেউ নয় স্বয়ং সমুদা। এরকম বিকট সে সেজেছিল শুধু ওই ব্যক্তির চোখে ধুলো দিতে এবং সেই সুযোগে নতুন কোনো তথ্যের সন্ধান যাতে সে ওই জায়গা থেকে করতে পারে।
সমুদাকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার এখানে আসার প্ল্যানটা একেবারে সফল। তবে, সেই ব্যাপারে আমায় বলে তখন সে আর সময় নষ্ট করতে চাইল না। আমরা ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। ফেরার পথেই, সমুদা নিজের পোশাক বদলে ফেলেছিল এবং সেই কাজে তাকে সাহায্য করেছিল আমাদের গাড়ির চালক, সুখদেব।
ফিরতেই দেখি বীরেনবাবু আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘তা কোথায় যাওয়া হয়েছিল আপনাদের, সমরেশবাবু?’
সমুদা তাকে হেসেই উত্তর দিল, ‘এই ভাইপোকে নিয়ে অযোধ্যা পাহাড় দেখাতে গেছিলাম। কী সুন্দর পরিবেশ, তাই না বীরেনবাবু?’
বীরেনবাবুকে দেখে মনে হলো কথাটা তার ঠিক মনের মতো হলো না। আর তাই সেও হেসেই উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ! যা বলেছেন। খুবই সুন্দর পরিবেশ। তবে কি বলুন তো, এইসব সুন্দর জিনিসও মাঝে মধ্যে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তাই নিজের ভালোর জন্য একটু সাবধানে থাকতে হয়।’
সমুদা তার কথার তাৎপর্য বুঝলেও আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারলাম না। পরে খাওয়ার পর দুপুরে সমুদা বিশ্রাম নেওয়ার সময় আমায় বলল, ‘বীরেনবাবুর কথা কিছু বুঝলি?’
আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, ‘না! গো। কিছুই বুঝতে পারিনি।’
আমার কথা ফুরোতেই সে বলে উঠল, ‘ও আসলে আমাদের সাবধান করে দিচ্ছিল। আমরা যে শুধু পাহাড় দেখতে যাইনি, তা ও খুব ভালো করেই জানে।’
সমুদার কথা কিছু বুঝতে না পেরে আমি তাকে প্রশ্ন করে বসলাম, ‘কিন্তু তুমি যে বলেছিলে ও অপরাধী নয়? তাহলে এখন কেন আবার ওকে সন্দেহ করছ?’
সমুদা আমার কথার উত্তর দিল, ‘ওরে, বীরেনবাবুকে যে সন্দেহ করি না, তা কি আমি একবারও তোকে বলেছি? ও আসল অপরাধী না হলেও তার সহযোগী হতেই পারে? অথবা এই রহস্যের পেছনে লুকিয়ে থাকা অন্য কোনো মুখ।’
সমুদার কথা শুনে মনে হলো এটা তার অনুমান নয়, সে নিশ্চয়ই এমন কিছু হাতে পেয়েছে যা থেকে সে এই কথা, এত জোর দিয়ে বলতে পারছে। তবে কী সেই বিষয়, যা ওই দুপুরে, আমার কাছে অজানাই থেকে গেল?
সন্ধ্যের দিকে সমুদা কাকে যেন ফোনে বাঘমুন্ডি চলে আসার জন্য বলছিল। আমি কাছে যেতেই শুধু কানে এল তার বলা কিছু শব্দ, ‘হ্যাঁ! আপনার হারানো মূর্তির সমাধান প্রায় হয়েই গেছে।’
শোনা শব্দগুলো থেকে আমি অনুমান করতে পারছিলাম যে সমুদা এই রহস্যের সমাধান করেই ফেলেছে এবং সেই ফোনের অপর দিকে যে বনমালীবাবুই ছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এখানেই জাগে যত প্রশ্ন, যদি সমুদা সত্যিই এই মূর্তি চুরির পেছনে থাকা আসল অপরাধীকে ধরতে সক্ষম হন তাহলে কে এই চোর? আর কীভাবেইবা সমুদা ধরল তাকে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সমুদাই দিতে পারবে। কিন্তু তার তো এখন আমার সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার একদমই সময় নেই, সে যে এখন এই তদন্তের নানা সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত। তাই এই তদন্তের শেষ চিত্রটা দেখতে গেলে আমাকে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে এবং সেটা হতেই পারে এক চমকপ্রদ ঘটনা, যার কল্পনা হয়তো আমি স্বপ্নেও করিনি।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে হঠাৎ গেস্ট হাউসের ম্যানেজার আমাদের ঘরে এসে উপস্থিত। তিনি এসে জানালেন কোন এক ব্যক্তি টেলিফোনে সমুদার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কিন্তু সমুদা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই চললেন সেই ফোন রিসিভ করতে। পরে তিনি ফিরে আসার পর দেখি তার মুখ বেশ থমথমে, আমি সেই কারণ জানতে চাওয়ায় সে বলল, ‘ফোনটা মূর্তি চোরই করিয়েছে বুঝলি, বঙ্কু। তবে আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে কারণ আসল চোর কিন্তু এখন জেনে গেছে যে তার সব খেলাই আমি ধরে ফেলেছি।’
আমি মনে সাহস নিয়ে বলে ফেললাম, ‘সমুদা, কে গো এই মূর্তি চোর?’
সেই শুনে সমুদা বিছানায় শুয়ে বলল, ‘কে আসল চোর তা আগামীকালই টের পেয়ে যাবি, তবে এটা যেনে রাখ আসল অপরাধীর এক শাখা, এই গেস্ট হাউসেই আমাদের মধ্যে রয়েছে।’
সমুদার কথা শুনে মনে হলো তার সন্ধেহের তীর বীরেনবাবুর দিকেই, তবে এটা বোঝা খুব মুশকিল যে তিনি কীভাবে এই চুরির সঙ্গে জড়িত। সেই রাতের অন্ধকারে তাই একটু আলোর স্পর্শ খুঁজে পেয়ে, আমি তাকিয়ে রইলাম আগামী দিনের উদ্দেশ্যে।
আমাদের ভোরবেলাই উঠে পড়তে হলো। কারণ গেস্ট হাউস থেকে হঠাৎই বীরেনবাবু নিখোঁজ। খুব স্বাভাবিক, তাকে খুঁজতে আমরা গেস্ট হাউসের আশপাশে বেরিয়ে পড়লাম। তার বিষয় অনেকজনকেই জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু কেউই ঠিকমতো কিছু বলতে পারল না।
আমার মন বলছিল, তিনি সম্ভবত এই অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছেন। তবে, সেই চলে যাওয়া কিন্তু একান্তই চলে যাওয়া নয়, সেটা আসলে পলায়ন। হ্যাঁ! এই পলায়ন হতেই পারে, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় অথবা নিজের প্রাণের দায়ে। এই ঘটনার মাঝেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন, বনমালীবাবু ও প্রভাতবাবু। ওনারা প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলেন না কিন্তু সমুদার মুখে বীরেনবাবুর হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা শুনে ওনারা চমকে উঠলেন এবং এটাও জানতে চাইলেন যে কেন তাদের প্রিয় বীরেন পালাবার পথ বেঁচে নিল।
সমুদা তখন ওনাদের বলল, ‘এর অনুমান আমি অনেক আগেই করেছিলাম কারণ সে বুঝতে পেরেছিল আমি তাকে ধরে ফেলেছি সুতরাং তার আর বাঁচবার কোনো পথ নেই, আমি অবশ্য পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি এবং আশা করি তারা খুব শীঘ্রই বীরেনবাবুকে ধরতে সক্ষম হবেন।’
সমুদার কথা শেষ হতেই বনমালীবাবু বলে উঠলেন, ‘আমার মূর্তি কি তাহলে বীরেনই চুরি করেছিল?’
সমুদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ! অপরাধীদের মধ্যে সেও রয়েছে। আপনারা যখন এখানে শেষবার এসেছিলেন, তখন এই বীরেন মণ্ডলই আপনার হনুমানজির মূর্তি সরিয়েছিল।’
‘কিন্তু বীরেন তো ওই সময় ওর বাবার অসুস্থতার কারণে কৃষ্ণনগর গেছিল, তাহলে ও এখানে এল কীভাবে?’ প্রশ্ন করলেন প্রভাতবাবু।
সমুদা উত্তরে বলল, ‘আপনাদের বাড়িতে বীরেনবাবুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর বাড়ি ফেরার সময়, আমি দেখি বঙ্কুর প্যান্টের ভাঁজে এখানকার লালমাটি লেগে। যেই মাটি আমি ওইদিনই লক্ষ করেছিলাম বীরেনবাবুর ব্যাগেও লেগে রয়েছে আর তখনই আমার সন্দেহ হয় তাকে। কারণ যে ব্যক্তি কৃষ্ণনগর গেছিল তার পক্ষে কখনই একই সময় বাঘমুন্ডিতে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। তারপর এখানে এসে হঠাৎই আপনার দাদার অসুস্থতার কথা জানতে পারি এবং পরের দিনেই বীরেনবাবুর এখানে চলে আসা, পুরোটাই আমাকে এক কঠিনতম প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু অযোধ্যা পাহাড়ে সেদিন ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই আমাকে বাধ্য করল বীরেনবাবুকে অপরাধীদের মধ্যে চিহ্নিত করতে।’
বনমালীবাবু বললেন, ‘কী ঘটনা আপনার চোখে পড়েছিল সমরেশবাবু?’
সমুদা বলল, ‘ঘটনা একটা নয়, বেশ অনেকগুলোই চোখে পড়েছিল। প্রথমত, সেদিন আমি বঙ্কুকে এই ঘটনা থেকে একটু আড়ালেই রেখেছিলাম। তাই এবার শোন বঙ্কু, আসলে সেদিন ওই সাদা পোশাক পরা লোকটাই ছিল বীরেন মণ্ডল। ও সেদিন আমাদের অনেক আগে থেকেই পিছু করছিল। মুখে দাড়ি লাগিয়ে আর মাথায় টুপি দিয়ে সে ভেবেছিল তাকে কেউ চিনতে পারবে না। কিন্তু আমার নজর তার উপর সেই আশ্রমে যাওয়ার দিন থেকেই ছিল। সেদিন ওর এই নজর এড়াতেই আমায় ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, সেদিন বীরেনবাবু গেছিল তার গতবারের অর্ধেক রেখে যাওয়া কাজটি সম্পূর্ণ করতে। আমি তাকে ধন্দে ফেলে দিতেই সে আমাদের ভিড়ের মধ্যে খোঁজার কাজ বন্ধ করে, মনোযোগ দিল তার গতবারের ফেলে যাওয়া মূর্তির পুনঃ উদ্ধারের কাজে। তবে, সেখানে সে একা ছিল না, তার সঙ্গে ছিল আরও দুজন লোক যারা তাকে ওই কাজে সাহায্য করছিল। এখন আশা করি বলে দিতে হবে না, যে সেই কাজ আসলে কী! বীরেনবাবু, গতবার খুব বুদ্ধির সাথেই পাহাড়ের মাটি খুঁড়ে ওই মূর্তি সেখানে পাথর চাপা দিয়ে রেখে গেছিল।’
সব শোনার পর কিছু প্রশ্ন আমার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, ‘তাহলে সেই রাতে সমুদা আমায় কেন মিথ্যে বলল, যে সে বীরেনবাবুকে অপরাধী মনে করে না? এর পেছনে কি তার অন্য কোনো সমীকরণ রয়েছে?’
এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি সমুদার থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেলাম। সে জানালো, ‘হ্যাঁ! আমি এই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম শুধু বীরেনবাবুর দৃষ্টি সরাতে। কারণ আমি ভালো করেই জানতাম যে বীরেনবাবু আমাদের উপর সবসময় নজর রাখছে, এমনকি ঘরের কথাও সে কান পেতে শুনত। এমনকি সেই রাতে আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে সে বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই কান পেতে আমাদের কথা শুনছে। যার প্রমাণস্বরূপ ছিল, ওই সময় উপস্থিত তার শরীরের ছায়া! তার ছায়া আমার নজর এড়িয়ে যায়নি। সুতরাং তৎক্ষণাৎ বুদ্ধির প্রয়োগ করে বিছিয়ে ফেললাম এই মিথ্যের মায়াজাল।’
হ্যাঁ! যেই মিথ্যের মায়াজালে শুধু বীরেনবাবুই নয় এমনকি আমিও গেলাম জড়িয়ে।
সমুদার কথা শেষ হতেই বনমালীবাবু হতাশার সুরে বললেন, ‘সমরেশবাবু, তাহলে কি আর সেই মূর্তি ফেরত পাওয়ার কোনো আশা নেই?’
কথাটা শোনামাত্রই সমুদা বলে উঠল, ‘মূর্তি সত্যিই আমার কাছে নেই, সেটা সম্ভবত বীরেনবাবুর কাছে রয়েছে অথবা রয়েছে এই গল্পের আসল অপরাধীর কাছে।’
চমকে উঠলাম ওখানে উপস্থিত আমরা সকলে। আর তার মধ্যেই প্রভাতবাবু বলে উঠলেন, ‘আসল অপরাধী মানে? এর পরেও কি আরও গল্প রয়েছে?’
প্রশ্নটা শুনে সমুদা একটু মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ! প্রভাতবাবু, গল্প এখনো বাকি। তবে, এই গল্পের শেষ ভাগ জানতে আমাদের আচার্য মশাইয়ের কাছে একবার যেতে হবে।’
সেখানে উপস্থিত আমরা কেউই তার কথার তাৎপর্য খুঁজে পেলাম না সুতরাং আর দেরি না করে আচার্যদেবের আশ্রমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম, সেইসঙ্গে আরও কিছু নতুন সত্য উদ্ঘাটনের অপেক্ষায় রইলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা আশ্রমে এসে পৌঁছলাম এবং আমাদের সকলকে দেখে আশ্রমের দুই শিষ্য এগিয়ে এসে আমাদের আচার্যদেবের কাছে নিয়ে গেলেন। আচার্যদেব তখন ধ্যানে মগ্ন, ওনাকে তাই আর ওইসময় বিরক্ত না করে আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ওনার ধ্যান ভাঙা মাত্রই উনি আমাদের ভেতরে নিয়ে আসার জন্য ওনার শিষ্যদের আদেশ দিলেন।
আমরা ওনার নিকট গিয়ে হাজির হলাম। উনি আমাদের সবাইকে একসঙ্গে দেখে বললেন, ‘বাহ! এ যে দেখছি চাঁদের হাট বসেছে আমার আশ্রমে। তা তোমরা কেমন আছ সবাই?’
উত্তরে বনমালীবাবু বললেন, ‘আমরা কি আর এই মুহূর্তে ভালো থাকতে পারি গুরুদেব? আজ সমস্যায় পড়েই এখানে ছুটে এসেছি।’
কথাটা শুনেই আচার্যদেব তাকালেন সমুদার দিকে। বললেন, ‘সমরেশবাবু, কী হলো মূর্তির? কোনো সন্ধান পেলেন?’
সমুদা ওনাকে বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তার সন্ধানেই তো আজ এখানে আসা আচার্যদেব।’
সমুদা আর অপেক্ষা না করে আচার্যদেবের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি ভালোই জাল বিছিয়েছিলেন কিন্তু এটা বুঝতে পারেননি যে সেই জাল ভেদ করার লোক এই গল্পের মধ্যেই রয়েছে।’
সমুদার কথা শুনে উনি বেশ রেগে গেলেন, ‘কী বলতে চাইছেন আপনি, সমরেশবাবু? একটু পরিষ্কার করে বলবেন।’
তারপর সমুদা সবার সামনে তুলে ধরল এক বিস্ময়কর ঘটনা! যেই ঘটনা বাস্তবে আদৌ ঘটতে পারে কিনা, তা নিয়ে ছিল ওখানে উপস্থিত সবার মনে এক ধন্দ। সমুদার কথায়, সেই বিস্ময়কর ঘটনা আসলে আচার্যদেবকে কেন্দ্র করে কারণ উনিই হলেন এই গল্পের আসল অপরাধী চরিত্র। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে, উনিই হলেন সেই ব্যক্তি যার কথামতো বীরেনবাবু ওই হনুমানজির অষ্টধাতুর মূর্তি চুরি করেছিলেন।
কিন্তু সবার মনে তখন জাগল প্রশ্ন, ‘কেন উনি সেই মূর্তি চুরি করাবেন? কী ওনার উদ্দেশ্য এবং কীভাবেই বা ওনার পরিচয় হলো বীরেনবাবুর সাথে?’
এই সকল প্রশ্নের উত্তর একমাত্র সমুদার কাছেই ছিল। সে বলল, ‘আচার্যদেব প্রথম থেকেই, ওনার স্বর্গীয় পিতার সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ওই মূর্তি অন্য কাউকে দিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি। ফলে, সময়ের সঙ্গে ওনার মনে সেই মূর্তি ফিরে পাওয়ার লোভ ও বাসনা জাগতে শুরু করে আর সেটা ফিরে পাওয়ার আশায়, উনি প্রতি মুহূর্তে তখন নানা ফন্দি করতে লাগলেন। এর মাঝেই যখন উনি বনমালীবাবুর বাঘমুন্ডিতে আসার খবর পেলেন, ঠিক তখনই এই মূর্তি চুরির প্ল্যান উনি কষে ফেললেন।’
সমুদা আরও বলল, ‘খুব বুদ্ধির সাথেই উনি বীরেনবাবুকে কাজে লাগিয়ে ওই কাজ করতে সফল হলেন এবং সেই ঘটনাকে কিছুদিনের জন্য গোপন রাখতে আচার্যদেব, ওই মূর্তিকে পাহাড়ের এক প্রান্তে পাথর চাপা দিয়ে রাখার নির্দেশ দিলেন, যাতে কারওরই কখনও ওনার উপর সন্দেহ না হয়। এই কাজ ওনার হয়ে করেছিলেন বীরেনবাবুই, তাই বর্ষার পর সেই মূর্তি পুনঃউদ্ধারের জন্য তাকেই ফের ডেকে পাঠান এই আচার্যদেব। এরপর উনি যখন জানতে পারলেন এই মূর্তি লোপাট হওয়ার তদন্তে আমি এখানে এসেছি, ঠিক তখনই উনি ছড়িয়ে দিলেন আরেক জাল। উনি শোনালেন ওনারই এক বানানো গল্প যাতে আমার মন অন্য দিকে বাঁক নেয়। সেই গল্পের দ্বারা উনি আমাকে বোঝাতে চাইলেন যে এই চুরির পিছনে হাত রয়েছে ড. ভাদুরীর কিন্তু পরে আচার্যদেব অনুমান করতে পেরেছিলেন যে আমি হয়তো এই গল্পে নাও বিশ্বাস করতে পারি। আর তাই তড়িঘড়ি বীরেনবাবু মারফত সেই মূর্তি লোপাটের প্ল্যান কষে ফেললেন।’
সব শুনে আমার গা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেল! তবে, এবার আসা যাক বীরেনবাবুর কথায়, সমুদা তার বিষয় জানানো যে, ‘বীরেন মণ্ডল আদতে আচার্যদেবের শিষ্য, যাকে উনি ওনার এই মারাত্মক প্ল্যান সফল করার জন্য কিছু বছর আগেই পাঠিয়েছিলেন বনমালীবাবুর বাড়ি, যাতে একই বাড়িতে ওনাদের সঙ্গে থেকে বীরেনবাবু ওনাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে।’
এইসব শোনার পর বনমালীবাবু ও ওনার ভাই থমকে গেলেন। ওনাদের গলা দিয়ে তখন কোনো কথাই বের হচ্ছিল না। বিশ্বাস ভাঙলে যে কী পরিণতি হয়, তারই যেন জলজ্যান্ত প্রমাণ এই দুই ভাই। এর মাঝেই আচার্যদেবের শিষ্যরা আমাদের চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলল।
উনি সমুদার সামনে এগিয়ে এসে বললেন, ‘খেলাটা তো বেশ ভালোই ধরে ফেললেন সমরেশবাবু, কিন্তু এবার যে আপনাকে বলতেই হবে বীরেন কোথায়?’
‘বীরেনবাবু তো মূর্তি নিয়ে আপনার কাছেই এসেছিল আচার্যদেব, তাহলে কেন খামোখা তামাশা করছেন?’ উত্তরে বলল সমুদা।
এদিকে, ঘটনার মাঝেই পুলিশের ভ্যান এসে হাজির হলো। আর ওই দেখে, সেখানে উপস্থিত সব শিষ্যগণ তখন দিল ছুট। কেউ পাঁচিল টপকে আবার কেউ পেছনের দরজা দিয়ে, তবে তারা সকলেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। কিন্তু ঘটনা হলো কে ডাকল এই পুলিশকে? এই প্রশ্নের উত্তরও শীঘ্রই পেয়ে গেলাম। কারণ দারোগাবাবুর সঙ্গে আশ্রমে প্রবেশ করল বীরেন মণ্ডল।
হ্যাঁ! এই বীরেনবাবুই নিজেকে আজ সকালে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল এবং সব ঘটনা তাদের কাছে খুলে বলার জন্যই আজ আমাদের কোনো বিপদের মুখোমুখি হতে হলো না। বীরেনবাবুর চোখে তখন জল এবং বনমালীবাবু ও তার ভাইকে দেখে সে লজ্জায় মাথা নিচু করে ছিল। বীরেনবাবুর বোধগম্য হওয়ায়, সমুদা তাকে ধন্যবাদ জানাল।
তখন সমুদার দিকে চেয়ে বীরেনবাবুকে বলতে শুনলাম, ‘সমরেশবাবু, আমি অনেক ভুল করেছি কিন্তু পরে আপনার কথা ভেবে দেখার পর, এই সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিলাম। ক্ষমা চাইবার কোনো সাহস নেই আমার, তাই বনমালীবাবুর সামনে যেতে পারলাম না। দয়া করে ওনাকে বলবেন, শেষ অবধি কিন্তু বীরেন ওনার ভালোবাসার অমর্যাদা করেনি।’
কথা শেষ হওয়া মাত্রই তিনি সেই হনুমানজির মূর্তি সমুদার হাতে তুলে দিয়ে, নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে দুই পুলিশকর্মীর সঙ্গে আশ্রম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবার আসা যাক আচার্যদেবের কথায়।
ওনার সামনে গিয়ে সমুদা বলল, ‘কী পেলেন আচার্যদেব এইসব করে? আপনার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভক্তি কিছুই যে আর রইল না। শুধু লোভের কারণে আপনি, আপনার পিতার আদর্শ বহন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার আশা করি, আপনার জীবনের শেষ ভাগটুকু আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার মধ্যেই কাটবে।’
কথা শেষ হতেই দারোগাবাবু সমুদাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আচার্যদেবকে সঙ্গে নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। আচার্যদেব একবারের জন্য একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। উনি হাত জোর করে সবার সামনে দিয়ে দারোগার সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। হতে পারে ওনার চৈতন্য হয়েছে এবং নিজের উপর লজ্জায় উনি ওই কাজ করলেন, তবে এর জন্য যে উনিই একমাত্র দায়ী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাদের প্রস্থানের পর সমুদা এগিয়ে গেলেন দুঃখে ভেঙে পড়া বনমালীবাবুর দিকে এবং ওনার হাতে তুলে দিলেন সেই অমূল্য হনুমানজির মূর্তি। উনি দু-হাতে ওই মূর্তি গ্রহণ করলেন এবং বুকে জড়িয়ে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। সেই সঙ্গে সমুদার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ধন্যবাদ সমরেশবাবু, আজ আপনার জন্যই এই মূর্তি আমি ফিরে পেলাম। এটা শুধু মূর্তি নয়, এটা আমাদের বংশের কাছে ঈশ্বরের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।’
সমুদা ওনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘এই সত্যের প্রকাশ হওয়া দরকার ছিল, বনমালীবাবু। কারণ দিনের পর দিন যারা আপনাদের মতো মানুষকে ঠকিয়ে গেছেন, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। না হলে যে মিথ্যে আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে আর পাপে ভোরে যাবে এই সমাজ।’
প্রভাতবাবু এগিয়ে এলেন আমাদের কাছে এবং উচ্চস্বরে খুশিতে বলে উঠলেন, ‘জয় হোক সত্যের! জয় হোক তার কাণ্ডারি, গোয়েন্দা সমরেশের।’
সত্যিই! যতদিন এই সমাজের বুকে পাপীদের বাস থাকবে, ততদিন থাকবে সত্যের জন্য লড়াই করার মানুষ। যাদের কাণ্ডারি রূপে বারবার উঠে আসবে গোয়েন্দা সমরেশ দত্তের মতো নাম।
অবশেষে এই তদন্তের কাজে যবনিকা পড়ল, আমরা দু-দিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরে এলাম। তবে, কলকাতা ফিরেও আমার মনে একটা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছিল। এই বিষয়টা হয়তো ঘটনাচক্রে সবার চোখের আড়াল হয়ে গেছিল কিন্তু আড়াল হয়নি আমার চোখে। সেই প্রশ্ন ছিল, ‘কখন এবং কী এমন কথা সমুদা বীরেনবাবুকে বলেছিল, যার ফলস্বরূপ সে তার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে পুলিশের হাতে তুলে দিল?
এর উত্তর পেতে আমায় খুব একটা সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। কারণ সমুদা নিজেই সেদিন দপুরে খাওয়ার টেবিলে আমায় বলল, ‘আমি জানি তোর মনে এখনও কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই সেই উত্তর এবার দিই তোকে। ওইদিন রাতে তুই যখন অযোধ্যা পাহাড় ঘুরে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলিস, ঠিক সেই রাতে প্রায় দুটো নাগাদ উপরের ঘরের দরজা খোলার শব্দ আমার কানে আসে। সেই শব্দ অনুমান করে আমি বীরেনবাবুর ঘরে গেছিলাম আর তখনই তার হাতে দেখতে পাই ওই হনুমানজির মূর্তি। বীরেনবাবু কিছু বলার আগেই, তার ঘরের দরজাটা আমি ভেতর থেকে বন্ধ করে, তার চৈতন্য ফেরাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ তাকে বোঝানোর পর অবশেষে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। জানাল যে সে আসলে আর কেউ নয়, স্বয়ং আচার্যদের পালিত সন্তান। সে তার পালিত পিতার অসম্পূর্ণ ইচ্ছাকে পূরণ করতেই এই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’
সমুদার থেকে এটাও জানতে পারলাম যে সেদিন সে আমাদের সকলের সামনে বীরেনবাবুর আসল পরিচয় গোপন করেছিল, শুধু বনমালীবাবুর কষ্টের বোঝা কিছুটা কমাতে। সব শোনার পর মনে হলো, এই রহস্য যেন অসমাপ্তই রয়ে গেছিল পুরুলিয়ায়, যার অধরা ভাগটা ওই মুহূর্তে জানা গেল কলকাতায় ফেরার পর।
তবে এখানেই শেষ নয়। সমুদা আরও জানাল, ‘আমিই বীরেনবাবুকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যাতে সে, ওই রাতের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে সেখানকার থানার দারোগাকে সব ঘটনার কথা খুলে বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেয় এবং আসল অপরাধীকে ধরতে তাদের যথাযথ সাহায্য করে। আমার মতে, এটাই একমাত্র পথ ওর কাছে ছিল যার দ্বারা বীরেনবাবু নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারত।’
হ্যাঁ! হয়তো এই কারণেই বীরেনবাবু অপরাধী হলেও, তার প্রতি আমাদের অল্প সহানুভূতি থেকেই যাচ্ছে মনে। সে যে শেষ অবধি নিজের ভুল বুঝতে পেরে, তা শোধরাতে চেয়েছিল সেটাই সবচেয়ে বড় উপলব্ধি এই তদন্তে।
অষ্টধাতুর সেই মূর্তি এখন ফিরে গেছে তার আসল স্থানে এবং অপরাধীরাও পৌঁছে গেছে তাদের সঠিক ঠিকানায়। আর এর সাথেই সমাপ্তি ঘটল আরেক রোমাঞ্চকর ঘটনার, যার দ্বারা সমুদা আবারও নিজেকে প্রমাণ করতে সক্ষম হলো এবং সে আমায় শেখাল কীভাবে মনে সাহস আর জেদ রেখে নানা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়; যাতে জীবনের খেলায় করা যায় আসল কিস্তিমাত।
(সমাপ্ত)