অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোহাম্মদ আজম -
ওঙ্কার উপন্যাসের ভাবাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি

আহমদ ছফার ওঙ্কার বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্লাসিক হিসাবে ইতোমধ্যেই মোটের উপর সর্বজনের সম্মতি আয় করেছে। খুবই ছোট আকারের বইটিকে উপন্যাস বলা যাবে কিনা, সে প্রশ্নও আর মুখ্য হিসাবে হাজির নাই। কেউ কেউ নভেলা বা উপন্যাসিকা হিসাবে একে চিনতে চেয়েছেন। তবে উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলার মধ্যে সাহিত্যিক রূপ বিষয়ে সচেতনতার পরিচয় থাকলেও, এ সম্বোধনে সাধারণত গুণ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না। ধরেই নেওয়া হয়, রচনাটি ভারি; আর আকারে ছোট হলেও প্রকারের ওই ভার-ভারিক্কি রচনাটিকে মোটামুটি স্থায়ী মর্যাদার আসন দিয়েছে।

উপন্যাসটি সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি বিদ্বৎজনেরও সমাদর পেয়েছে। সমাদরকারীর তালিকায় অন্য অনেকের মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও রশীদ করীমের নাম শোনা যায়। বিস্তারিত আলাপ করেছেন সলিমুল্লাহ খান। ঢাকার সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাগ্রন্থ আহমদ ছফা সঞ্জীবনী লেখার শ্রম ও আবেগ স্বীকার করে সলিমুল্লাহ খান ছফার কাছে আমাদের সামষ্টিক ঋণের একাংশ শোধের বন্দোবস্ত করেছেন। এ বইয়ে ওঙ্কার নিয়ে দুটি আস্ত প্রবন্ধ আছে। একটির নাম ‘বাংলামদ’, অন্যটি ‘ওঙ্কার : অঙ্গ ও ব্যঙ্গ’। সম্প্রতি পারভেজ আলম প্রচার করেছেন গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘ওঙ্কার ও উন্মোচন’ (প্রতিপক্ষ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১)।

মুখের প্রচারে এবং লেখার সিদ্ধান্তে ওঙ্কার বিষয়ে যে সিদ্ধরস আমাদের পাঠের ভাঁড়ারে জমা হয়েছে, আমরা এ লেখায় তার কোনো ব্যত্যয় ঘটাব না। আমরাও, অন্যদের মতো, একে জাতীয়তাবাদী বয়ান হিসাবেই পাঠ করব। বোবা মেয়েটিকে আমরা বাংলাদেশের প্রতীক হিসাবেই পড়ব— তার বাকস্ফূর্তি লাভের অভাবিত ঘটনাকে পাঠ করব জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার সরব ঘোষণা হিসাবে; আর উপন্যাসের বয়ানকারী তরুণকে পড়ব বাঙালি মুসলমানের প্রতিভূ চরিত্র হিসাবে। মোটা দাগে এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পাঠকসমাজে একটা সার্বিক সম্মতি আছে। আমরা রূপক-প্রতীকের কোনো ঝগড়ায় যাব না; আরো সূক্ষ্ম পাঠভেদের দিকেও আঙুল তুলব না। যে গড়নের কারণে কোনো জাতীয়তাবাদী বয়ান এরকম সর্বসম্মতি পেয়ে থাকে, সে গড়নকে উপন্যাসটির শক্তিমত্তার দিক ধরে নিয়ে আমরা বরং এ লেখায় একটু অন্যদিকে নজর দেব। কথক চরিত্রটির শ্রেণিভিত্তির দিকে নজর রেখে আমরা দেখতে চাইব, সংস্কৃতির কোন ব্যাকরণে ভর করে সে ক্রমশ নতুন জেগে ওঠা জাতীয়তাবাদী জোশে থিতু হতে পেরেছে।

কথক নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে বাঙালি মুসলমান সমাজের একাংশের প্রতিনিধি হিসাবেই উপস্থাপন করেছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচকের; তুলনামূলক পরিবর্তিত পাটাতনে দাঁড়িয়ে সে পিছন ফিরে তাকিয়েছে। তাতে নিজের সংস্কৃতি ও চেতনালোকের বদল যেমন দেখতে পেয়েছে, তেমনি পুরোনো খাসিলতের দিকে ঈষৎ বেদনামাখা তাচ্ছিল্যের চোখেও তাকাতে পেরেছে। সেখানে বড় হয়ে উঠেছে বাবা চরিত্রটি। বাবারা নানা কারণে পুত্রদের সমালোচনার শিকার হয়। ভাবগতভাবে নতুন প্রজন্মের বিপরীতে পিতার প্রজন্মকে নাকাল করা আধুনিক সাহিত্যের রীতিমতো বুনিয়াদি স্বভাব। আমাদের কথকের বেলায়ও কমবেশি সে কথা বলা যাবে। ফারাকের মধ্যে এই, অন্যত্র সাধারণত পুত্র বা পুত্রস্থানীয় নিজেই নতুন স্বভাবের কারিগর হিসাবে আবির্ভূত হয়, আর ওঙ্কারে পুত্রটি প্রায় বাবার মতোই অকাজের। সেক্ষেত্রে বাবার প্রতি তার আপত্তিটা মোটা দাগে দুই কিসিমের। একদিকে উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া সয়-সম্পত্তি খুইয়ে তাকে পথে বসিয়ে বাবা ইহধাম ত্যাগ করেছে; অন্যদিকে, নতুন যে চিন্তায় ও সংস্কৃতিতে পুত্র দাখিল হতে বাধ্য হবে সময়ের আঁচড় এড়াতে না পেরে, বাবা ও বাবাদের অবস্থান তার বেশ কতকটা বিপরীত। ফলে নতুন ভাবধারায় দাখিল হওয়ার জন্য তাকে তুলনামূলক বেশি কসরত করতে হবে। বলার বা ভাবার যথেষ্ট সুযোগ আছে, এই পুত্র নিজ বুদ্ধিতে পিতার রোগ শনাক্ত করার মতো লায়েক ছিল না, বরং সময়ের প্রচণ্ড চাপে নিজ বংশধারার রুগ্‌ণতা শনাক্ত করতে পেরেছিল।

গল্পকথক-যে বাঙালি মুসলমানের সব অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না, সে বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। এ কারণেই সে বারবার ‘আমাদের অংশের’ কথাটা উল্লেখ করেছে। এ অংশের দুই ভাগ। একদিকে তার বাবা। অন্যদিকে কানা মোক্তার সাহেব। দুই অংশই প্রতিক্রিয়াশীল। তার বাবা একালের জন্য একেবারেই অনুপযুক্ত। কারণ, তার পা পেছন দিকে। বর্তমান বাস্তবতা আর উৎপাদনব্যবস্থার সাথে তার কোনো যোগ ছিল না। পরিস্থিতি যে বদলে গেছে, সেটা বোঝার মতো মন-মগজও তার ছিল না। কারণ কী? সে কি বুদ্ধিহীন নিরেট জীব? তা তো নয়। তার সমস্যাটা, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, বিশেষ মানসিকতাজাত। ভূমিনির্ভর সামন্ত মনোভাব দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নতুন জমানায় ভূমিনির্ভর মানুষেরা শিক্ষা ও উৎপাদনের নতুন রকমসকমের সাথে বেশ কতকটা মানিয়ে নিয়েছে, এমন উদাহরণ তামাম দুনিয়ায় আছে, এই বাংলা অঞ্চলেও দেদার পাওয়া যায়। অথচ এ লোকটি সেরকম কিছু তো করেই নাই, উল্টো নতুন জমানায় চালিয়েছে পুরানা কানুন। তা-যে কোনো অর্থেই আর কাজ করছে না, সে বোধটুকুও তার ছিল না। পুত্র তার পিতাকে ‘পবিত্র পশু’ বলেছে এ কারণেই। পশুর মতো প্রবৃত্তির বশেই এই প্রাচীনপন্থি লোকটি মনুষ্যজীবন যাপন করতে চেয়েছে। অস্তিত্বকে চাপা দিয়ে ভাবাদর্শ বড় হয়ে উঠলেই কেবল এ ঘটনা ঘটতে পারে। নিছক শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্য দিয়ে এ অবস্থার ব্যাখ্যা চলবে না।

এ অংশের অন্য শরিক মোক্তার আবুনসর। এই ব্যাটা আবার কানা। এক চোখ দিয়ে সে জাগতিক উন্নতির বেশি আর কিছু দেখতে পায় নাই। মানুষের অস্তিত্বে নৈতিকতা বলে-যে এক বস্তু আছে, আপন-পর ভেদের মধ্যে আপনার অংশটা-যে আরেকটু প্রসারিত করে দেখতে পারা যায়, তার মধ্যে সে বোধ খুব একটা দেখা যায় নাই। কাজেই মামলার শলা-পরামর্শ দিয়ে টাকা কামাই করা, মামলায় ডিক্রি পেয়ে একদা-বন্ধুর জোতজমি দখলে নেওয়া, আর হিন্দু বাড়ি কায়দা করার ফন্দি-ফিকির করা তার জন্য একই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন দিক। এ উপন্যাসের সাক্ষ্য মোতাবেক আইয়ুব শাহি দেশ চালানোর স্বার্থে এ ধরনের লোকদেরই বাছাই করে তুলে এনেছিল ক্ষমতার গোড়ায়। গল্পকথকের বাপের সাথে তার ফারাক ছিল বর্তমানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে। সেখানে একজন বর্তমানকে নীতিনৈতিকতার তোয়াক্কা না করে চুষে-চিবিয়ে খেয়েছে, অন্যজন জুতমতো খানাখাদ্য মেলাতে না পেরে ছিটকে পড়েছে দুনিয়াবি দৌড় থেকে। কিন্তু তলে তলে দুজন তো একই দিকের কুটুম। কাজেই ঘোর অতলে ডুবতে থাকা মানুষকে বেয়াই বানিয়ে জামাইকে সদরে তোলা একদিক থেকে পুরোনো কুটুম্বিতাকে নতুন রূপে ঝালাই করে নেওয়া।

ওঙ্কারের কথক জাতীয় জাগরণের মূল আবহে শামিল হলো কীভাবে? তার তো প্রাণশক্তি বলে কিছু ছিল না। সয়সম্পত্তি কিছু অবশিষ্ট ছিল না বলে বাপের একরোখা একগুঁয়েমি বজায় রাখা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। ভোল পালটে নতুন আবহে নিজেকে বদলে নেওয়ার শক্তিও তার নাই। কিন্তু আন্ধা বাপের রক্ত আর কানা শ্বশুরের কৌশলই তাকে হ্যাঁচকা টানে বসিয়ে দিল রাজধানী ঢাকার কর্মস্রোতে। সেখানে তার ভালোই চলছিল। কিন্তু বোবা বউয়ের ভার তার মতো ভীতু আহম্মকও আর সইতে পারছিল না। বন্ধুরা বউয়ের গল্প করে। অফিসের ছোকরা নৃপেন নতুন বিয়ে-করা বউয়ের কথা-বলার ভঙ্গিমা তাল-লয়-ছকসহ বর্ণনা করে। সেও মাঝে-মধ্যে বন্ধুদের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে তাদের বউদের কথা ও গান শুনে এসেছে। এর ফলে তার মনেও জেগেছে কথা আর গানের পিপাসা। কিন্তু বোবা বউয়ের স্বামীর এ ধরনের শখ জাগার একটাই অর্থ— বউয়ের প্রতি আরও বিতৃষ্ণ হওয়া। যোগাযোগের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে একেকবার সবকিছু ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে শ্বশুরের পাতানো জাল থেকে। ওটা করার মনের জোর আর বাস্তব সামর্থ্য কোনোটাই তার ছিল না।

এত এত অক্ষমতা সত্ত্বেও এই কথক কোন গুণে সে কাজটা করে উঠতে পারল, যা তার বাবা অনেক উদ্যমী হয়েও করতে পারে নাই? সমস্ত বিবৃতি ঝাড়াই-বাছাই করে একটার বেশি গুণ খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে। এ লোকটি বর্তমান জগতে বাস করেছে। তার যাবতীয় দুর্বলতা ও অক্ষমতার মধ্যেও সে কোনো অনুপস্থিত বা অবাস্তব ভাবাদর্শের পেছনে ছোটে নাই। স্রেফ এ গুণ সম্বল করেই সে, তার নিজের ভাষ্য মোতাবেক, পরিষ্কার চোখে গভীরভাবে দেখতে ও বুঝতে শিখেছিল। আমাদেরকে সে যখন নিজের গল্পটি শোনাচ্ছিল, তখন তার-যে দিব্যজ্ঞান হয়েছে, তাতে সন্দেহ দেখি না। তবে তার আরেক প্রস্ত গুণের উল্লেখ না করলে সত্যের খেলাপ হবে। কোনো বিশেষ নাম না দিয়ে নিছক সাধারণ উল্লেখ হিসাবে বলা যায়, তার মধ্যে মানবিক গুণ অন্তত খানিকটা ছিল, যা তার বাপের মধ্যে দেখা যায় নাই। বিরাগপর্ব পার করে বউয়ের অনুরক্ত হওয়ার অবকাশ পাওয়া মাত্রই সে মনকে সেদিকে রুজু করেছে। যোগাযোগ স্থাপনে বউয়ের বাসনা আন্দাজ করতে পেরে সেও জোরকদম এগিয়ে গেছে।

এই সেতুটা প্রাথমিকভাবে তৈরি করে দিয়েছে গান ও কবিতা। প্রত্যক্ষত গান, কিন্তু উপলব্ধির দিক থেকে কবিতা। কথার অনুপস্থিতিতে যোগাযোগ স্থাপনের কলা হিসাবে আহমদ ছফা গানের আশ্রয় নিয়েছেন। স্বামী-যে কথা শুনতে চায়, কথা শুনতে না পেয়ে মর্মজ্বালায় ভোগে, বোবা বউয়ের তা অজানা ছিল না। সে এ বাবদ কথা শেখার বা বলার চেষ্টা করেছে, এমন কোনো নজির আমরা দেখি নাই। কিন্তু স্বামীর বোনের গান শুনে, অথবা তারো আগে বোনকে গান শেখাবার উদ্যোগ নেওয়ার পর বউটি স্বামীর আগ্রহ সম্পর্কে একটা আন্দাজ করে উঠতে পারে। তাকে দেখা যায়, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গলায় গান তোলার অনিঃশেষ কোশেশ করে জেরবার হচ্ছে। তার সে চেষ্টা অব্যাহত ছিল। পুকুরের ঘাটলায় বা জানালার ধারে চলতে থাকে তার বিরামহীন সাধনা। প্রথমে এ সাধনার উৎস ছিল স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা। কিন্তু শীঘ্রই এ চেষ্টা তার নিজের অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে। তখন তার লক্ষ্য আর স্বামী নয়। পুকুরঘাটে এ কারণেই স্বামীকে পাত্তা না দিয়েই সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাকসাধনার কসরত করতে থাকে।

নিজেকে চেনা, অন্যকে চেনাতে চাওয়া এবং পরিণতিতে যোগাযোগের তুলনামূলক কার্যকর উপাদান হিসাবে শব্দোচ্চারণ— এই ক্রমে আমরা এই বোবা মেয়ের সাধনা ও ফলকে চিহ্নিত করতে পারি। তার শুরুটা হয়েছে গানের সূত্রে, কিন্তু প্রকাশ ঘটেছে মুখ্যত কাব্যিক ভাষায়। চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে দুইমাসের অন্তরঙ্গ যাপনের ইনতেজাম করেছিল স্বামী। তাতেই মেয়েটি শুধু রসে-রঙে টইটম্বুর হয়ে ওঠে নাই, নতুন প্রাণের বাহক হয়েও আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন রূপে। এই পরিক্রমার বিবরণে লেখক বিস্তর কাব্যিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। বহুমাত্রিক সে কাব্যসম্ভার। সম্ভবত গদ্য-পদ্য নির্বিশেষ আহমদ ছফার কাব্যোৎকর্ষের সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা আছে এ অংশে। পরিচ্ছন্ন শব্দে বা বিবরণে যা প্রকাশযোগ্য নয় তার প্রকাশ যদি করতে হয়, কাব্যই হতে পারে তার আশ্রয়। ছফা বারকয়েক নামের কথা বলেছেন। বলেছেন, অন্তরের উপলব্ধিকে নাম দিয়ে প্রকাশ করার জন্যই মেয়েটির সাধনা; আর সে কাজে অপারগতাই তার সুগভীর বেদনার কারণ। নাম দিয়ে চিহ্নিত করার মধ্যে-যে যোগাযোগের প্রকট বাধারও সূচনা ঘটে, যেমন ঘটেছে ‘বাংলা’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে, সেদিকটা সম্ভবত এ টেক্সটের সীমার মধ্যে লেখক আঁটাতে চান নাই। আমরাও সে প্রসঙ্গে যাব না। কিন্তু এটা সত্য, প্রকাশের ওই জটিল ও সূক্ষ্ম প্রবাহকে চিনতে ছফা প্রায় সর্বতোভাবে কাব্যকলার আশ্রয় নিয়েছেন। লেখকের দিক থেকে তাতে মুনশিয়ানার প্রকাশ ঘটেছে। বোবা বউয়ের দিক থেকে নতুন জাগরণের আর লকলকিয়ে বাড়তে থাকা জীবনোল্লাসের বাহন হয়েছে এ কাব্যকলা। কিন্তু আমাদের দ্রষ্টা কথকেরও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। দেখা যাচ্ছে, তার সক্রিয়তা মোটেই কম নয়।

জীবনটাকে সে সক্রিয়তার বাইরেই রেখে দিয়েছিল। চারপাশের সবকিছুর ছোঁয়াচ এড়িয়ে শুধু বেঁচে থাকাই ছিল তার লক্ষ্য। জীবের জীবন পার করাটাই ছিল তার চরম। সেখানে পরমের ঠাঁই ছিল না। কিন্তু অস্ফুট বর্তমান আর বাস্তবে মনোযোগী হওয়ার মধ্য দিয়ে সে শুধু মর্মের দিক থেকে বদলে যায় নাই, পরমের নাগালও পেয়েছে। ভীতির স্তর পার হয়ে মিছিলে সৌন্দর্য আবিষ্কার করা ওই নতুন সক্রিয়তারই পরিণতি। আমরা কাজ চালানোর জন্য একে বলতে পারি কথক-চরিত্রটির ‘সংস্কৃতিবান’ হয়ে ওঠা। যদি তাই হয়, তাহলে এও বলতে হবে, এ সংস্কৃতি ধারণের বা চর্চার অন্তর্নিহিত গুণ তার থাকলেও তার জীবনযাপনের মধ্যে এর অস্তিত্ব ছিল না। অভাববোধ থেকেই সে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বোনকে গান শেখানোর এনতেজাম করা তার দিক থেকে সংস্কৃতিচর্চার প্রতীকী সূত্রপাত। বোবা বউয়ের জাগরণ যদি উপন্যাসটির প্রধান ঘটনা হয়, তাহলে বলতে হবে, ওই ঘটনারও উৎসবিন্দু গান। পরিণতির জন্য অবশ্য এই ব্যক্তি-স্তরের মন ও মননশীলতা যথেষ্ট ছিল না। তার জন্য যেতে হয়েছে বাইরে। সমষ্টির কাছে।

বোবা বউয়ের শব্দময় হয়ে ওঠা, বিশেষত ‘বাংলা’ উচ্চারণ, যদি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ও জনমানুষের পরিচয়চিহ্নের স্মারক হয়, তাহলে তার জন্ম নিশ্চিতভাবেই গণ-আন্দোলনে। তার আগে পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। নানা ইতিবাচক উপাদান কাজ করে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। কিন্তু চূড়ান্ত বদলটির জন্য বড় ধাক্কার দরকার ছিল। প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনে বিপ্লবী মুহূর্ত তৈরি হওয়া ছাড়া ওই ধাক্কার বন্দোবস্ত হতে পারত না। অন্তত ওঙ্কার উপন্যাস এবং এ বিষয়ক মূলধারার বিবরণীগুলো সে দাবিই করে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে-বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈয়ার করেছিল, তা কোন কোন দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সমরূপ পরিস্থিতি থেকে আলাদা, কিংবা ফ্যাসিস্ট সামরিক সরকারকে গদিচ্যুত করার আন্দোলন কীভাবে জাতীয়তাবাদী পরিচয়চিহ্ন লাভের আন্দোলন হয়ে ওঠে, সে তত্ত্বতালাশে আমরা এখানে যাব না। কারণ, ওঙ্কার সে আলাপকে জরুরি মনে করে না। বোবা বউয়ের তরফে বা কাহিনিকথকের তরফে এ উপন্যাস আমাদের যে পরিবর্তনের খবর দেয়, তা বৈপ্লবিক পরিবর্তনই বটে। আর বৈপ্লবিক বদল কেবল তখনই প্রাসঙ্গিক ও সম্ভব হয়ে ওঠে, যখন শক্ত প্রতিপক্ষের উপস্থিতি থাকে। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্য সেদিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো : ওঙ্কার উপন্যাসের এই প্রতিপক্ষ কী, কে বা কারা?

কানা মোক্তার আবুনসরের দিকেই এ বিষয়ে পয়লা আঙুল তুলতে হয়। শুধু কুখ্যাত সামরিক শাসক আইয়ুব শাহির তাঁবেদারির দিক থেকে নয়, স্বভাব-চরিত্রেও লোকটা পাতে দেওয়ার মতো নয়। তদুপরি সে জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়াশীল অংশেরই প্রতিনিধি। খান সাহেব নিশ্চয়ই ওই পটভূমি তালাশ করেই তাকে তুলে এনেছে ক্ষমতার কোলে। আর কী আশ্চর্য! লোকটা জামাইকে দেওয়ার জন্য দখল করেছে এক ব্রাহ্মণের বাড়ি। কথকের ভীতি, অনুমান এবং মিছিল-বিরোধিতা পরিষ্কার সাক্ষ্য দিচ্ছে, মোক্তার আবুনসর চলমান আন্দোলন-সংগ্রামের বিরোধী পক্ষই বটে। কিন্তু না। ওঙ্কার উপন্যাসের জাতীয়তাবাদী বয়ানের জন্য জুতসই না হলেও এ ব্যক্তি সে ভাবাদর্শের শক্ত প্রতিপক্ষ নয়। কারণ সে বোবা মেয়েটির বাবা। স্নেহশীল বাবা। এই স্নেহে রক্তের টান ছিল, যে-পাত্র মেয়ের জন্য সে বাছাই করেছিল, তাতেও গোত্রপ্রীতি প্রবল; কিন্তু মেয়ে গছিয়ে ভারমুক্ত হওয়া তার লক্ষ্য ছিল না। এই মা-মরা সৎ-মায়ের গঞ্জনা-সওয়া মেয়েটির জন্য তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। আসল বোবার সাথে নকল বোবা হয়েই সে মিশতে পারত। কাজেই আবুনসর ওঙ্কারের প্রতিপক্ষ হতে পারে না।

প্রত্যক্ষত গণ-আন্দোলনের বিপরীতে স্থাপন করলেও, বিশেষত বিপ্লবী পরিবর্তনের মূল নিয়ামক মিছিলকে বিপরীতে স্থান দিলেও, আইউব খান ও তার ক্ষমতাতন্ত্র এ উপন্যাসের প্রধান প্রতিপক্ষ নয়। উপলক্ষ মাত্র। কারণ, বোবা বউয়ের বিবর্তনরেখা ধরে গল্পকথককে পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে, আইউবি ক্ষমতাতন্ত্রের কোনো ভাবাদর্শিক পর্যালোচনা ছাড়াই সে মিছিলের বৈপ্লবিক সৌন্দর্য ও ক্ষমতা স্বীকার করে নিয়েছে। তাহলে আর বাকি থাকে কথকের বাবা।

হ্যাঁ। গল্পকথকের নামহীন গোত্রসর্বস্ব পিতাই এ উপন্যাসের প্রধান ভাবাদর্শিক প্রতিপক্ষ। আমরা তাকে যেন তার গোত্র-পরিচয়ে চিনতে পারি, উপন্যাসটি তার আয়োজনে বিস্তর পৃষ্ঠা ব্যয় করেছে। শুধু এদিক থেকে দেখলেই এই অতি কৃপণ উপন্যাসটির এতগুলা পৃষ্ঠা কেন নামহীন কূপমণ্ডূকটার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, এ প্রশ্নের উত্তর মিলবে। কোন গুণে সে এই সম্মান অর্জন করল? তার প্রথম ও প্রধান গুণ, সে অতীতচারী এবং অতীতকে সে জীবনের মোকাম বানিয়েছে বর্তমানের বিনিময়ে। তার যাবতীয় অহেতু আচরণ এবং আত্মঘাতী কাজকারবার ওই এক বিষবৃক্ষেরই ফল। তো, সে করেটা কী? সে তালুকদারি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ‘শরাফতি’ বজায় রেখেছে। বাস্তব পরিস্থিতির সাথে তাল সামলাতে না পেরে, পারার কোনো বাস্তব ভিত্তি না থাকার কারণেই, ওই শরাফতি তার ধ্বংস অনিবার্য করে তুলেছে। অথচ সেটা বোঝার মতো হুঁশও তার ছিল না।

কেন? কারণ সে অতীতচারী। অতীতে তার বংশধারা পবিত্রভূমি থেকে এসেছে এই ম্লেচ্ছ দেশে। তারপর কত রাজা এল-গেল, কত উত্থান-পতন ঘটল দুনিয়ার এ অংশে, আর তামাম দুনিয়ায়। কিন্তু এ বংশের মানুষেরা কম্পাসের কাঁটার মতো স্থির থাকল নিজ কেবলার দিকে। ধর্ম তাদের আশ্রয়। তবে ধর্মাচার কদাচ নয়। মদে-মেয়েমানুষে তারা বংশ-পরম্পরায় নরক-গুলজার করেছে। আমাদের পিতা চরিত্রটিও খুব একটা আলাদা নয়। মদ-মেয়েমানুষের দোষ তার ছিল বলে শোনা যায় না। তবে যৌবনে গেরস্থঘরের সুন্দরী মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে ছাড়াই নিজের ঘরে রাখতে কসুর করে নাই। বোধ হয়, বংশের ধারা রক্ষা করতেই। আরও আছে। তার ফারসিপ্রীতি। এখন বাংলায় কথা বললেও তার বংশলতিকার ভাষা ফারসি। ক্ষয়ে যাওয়া সেই ফারসি নামপঞ্জিই এই লোকের প্রকৃত পরিচয়। তার শেষ অবলম্বন। ওঙ্কার উপন্যাস আর্থিক নয়, বরং এই ভাবাদর্শিক-গোত্রীয় সিলসিলার ধ্বংসের ইতিবৃত্ত। ধ্বংসের মধ্য দিয়েই নতুন ভাবধারার উত্থান ঘটেছে।

কথকের বাবাই-যে বিপ্লবের প্রধান প্রতিপক্ষ, তার আরেক প্রস্ত শক্ত প্রমাণ আছে উপন্যাসে। এ উপন্যাসে মিছিলকারীদের কোনো জাত-পরিচয় নাই। রাজনৈতিক পক্ষ ও সক্রিয়তার ন্যূনতম ফিরিস্তিও নাই। তারা নিশ্চয়ই আকাশ ফুঁড়ে বের হয় নাই। কথকের বাবার পরিচয়সূত্রে আমরা একটা জনগোষ্ঠীর খবর পাই, যাদেরকে এই মিছিলকারী প্রতিবাদী জনগোষ্ঠীর উৎস বলে সাব্যস্ত করতে পারি। বজ্জাত লোকটি চেনা-অচেনা শ্রোতা পেলেই দশ দিগন্তে ইশারা করে বলত, এরা সবাই আমাদের সাত পুরুষের প্রজা। কথক আমাদের নিশ্চিত করছে, দাবিটা সত্য নয়। এরা কেউ কেউ এখনো নামকাওয়াস্তে প্রজা থাকলেও আসলে তালুকদারকে পাত্তা দেয় না। তালুকদার জালেম বলেই ন্যায্য খাজনা দিতেও গড়িমসি করে। মামলা-মোকদ্দমায় সাত ঘাট না ঘুরিয়ে খাজনা শোধ করে না। এরা পড়াশোনা করেছে অনেকেই। অর্থ-বিত্ত-শিক্ষায় অনেকেই এগিয়ে গেছে তালুকদার পরিবারকে ছাড়িয়ে। এরা গান গায়, চিৎকার করে, এবং সেকেলে তালুকদারকে পরোয়া না করে দিব্যি শোরগোল তোলে। তারা বর্তমানময় জীবন যাপন করে। এ জনগোষ্ঠীই-যে প্রতিবাদী মিছিলকারীর মূল জোগানদার, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। সেদিক থেকে তাদের প্রতিপক্ষ হিসাবে নামসর্বস্ব পুরোনো তালুকদারই হয়ে ওঠে উপন্যাসের প্রতিপক্ষ। যদি নিছক ক্ষমতাবদল বা এমনকি ক্ষমতাসম্পর্কের বদল উপন্যাসটির প্রতিপাদ্য হত, তাহলে এ কথা বলা যেত না। কিন্তু চাপা-পড়া অস্ফুট পরিচয়কে প্রক্রিয়াসহ প্রকাশ করাই এর লক্ষ্য বলে, জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শের চেয়ে ছোট কোনো পরিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করা এ উপন্যাসটির জন্য যথেষ্ট নয়।

প্রশ্ন হলো, এ লোকের পয়দা হয়ে কথক চরিত্রটি এ বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ সহচর হয়ে উঠল কীভাবে? সহচর হয়ে ওঠার জন্য তাকে প্রথমে নিরপেক্ষ হতে হয়েছে। পিতার কাজকর্মে তার কখনোই সায় ছিল না। পরে পরিস্থিতিও গেছে পালটে। কাহিনীর সাক্ষ্য মোতাবেক, চুয়ান্নর নির্বাচনে আতরাফদের গদিতে আসাই পুরনো শরাফতির বুকে সবচেয়ে কার্যকর আঘাত হেনেছিল। তারও আগে রক্তসূত্রেই এ যুবক নতুন পরিস্থিতির জন্য বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। তার বাবাটি ‘ফারসি’ময় হলেও মা ছিল খাঁটি বাঙালি। শুধু তা নয়। সে যে আরবি-ফারসি শিখে পশ্চাৎপদ না হয়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল, তার পেছনেও মূল ভূমিকা মায়ের। কাজেই বলতে হয়, ছফা জাত-গোত্র নির্ণয়ের সূত্র কাঁটায় কাঁটায় মান্য করেছেন।

এসব আনুকূল্যসহ কথক চরিত্রটি বর্তমানময় হয়ে ওঠার জন্য প্রস্তুত ছিল। তাকে পরের ধাপে উত্তীর্ণ করেছে সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি কি জীবনযাপন থেকে উদ্ভূত? না। সেরকম বলার উপায় নাই। স্পষ্টতই এটা ‘আদর্শ’চর্চা হিসাবে অনুকৃত। শিখা গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আজতক ঢাকায় বিদ্যমান প্রভাবশালী ধ্যানধারণায় সংস্কৃতিকে এভাবেই দেখা হয়। বাঙালি মুসলমান সমাজে গান-বাজনার হাজিরা বা গরহাজিরা বিষয়েও ওই একই মত। বোন খুব তাড়াতাড়ি গান গাইতে শিখেছে দেখে এ কারণেই সে বিস্মিত হয়েছে। তাদের পরিবারে গান-বাজনার বালাই ছিল না। কাজেই কোনো উত্তরাধিকারের প্রশ্নই আসে না। তাহলে এ গান কি গ্রামে তাদের যে-অনামা প্রতিবেশীদের গানের কথা বলা হয়েছে, সেখান থেকে এসেছে? না, তাও নয়। কারণ গল্পকথক বা তার বোনের মধ্যে এ বস্তু দেখা যায় নাই। গান-বাজনার তাড়নাটা এসেছে বাইরে থেকে; শেখার এনতেজামও কায়দা মেনেই হয়েছে। বোনটি-যে নতুন সংস্কৃতিতে শামিল হতে পেরেছে, তার একটা কৈফিয়ত দেওয়ার দরকার বোধ করেছে কথক। বলেছে, বোধহয় রক্তের জন্য তার বাবার যে কামনা-বাসনা কীটের মতো পাষাণে বন্দি হয়ে ছিল, তা-ই তার বোনের গলায় গান হয়ে মুক্তি পেয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, এ সংস্কৃতি বাইরে থেকে আসা হলেও তাকে নিজের করে পাওয়ার অভ্যন্তর-সক্ষমতা তাদের আছে। তবে তার জন্য চর্চায় শামিল হতে হবে। ভাবাদর্শিক টানাপড়েন থেকে মুক্ত হতে হবে।

এই সংস্কৃতির উৎস কী? সাধারণভাবে উনিশ শতকের কলকাতায় বিকশিত ‘বাঙালি’ সংস্কৃতিকেই উৎস ভাবা হয়। ওঙ্কারে প্রত্যক্ষত সে ধরনের দাবি নাই। তবে পরোক্ষ ইশারা বিস্তর আছে। যে লোকটির খোঁচা খেয়ে কথক তার পশু-জীবন সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন হয়, তার নাম নৃপেণ। অন্তত মনে মনে শ্বশুরের সহায়তা নিয়ে তাকে কলকাতায় তাড়ানোর একটা স্বপ্ন সে দেখেছে। তার মানেই হলো, সে নৃপেণের হিন্দু পরিচয় বিষয়ে সতর্ক ছিল। উল্লেখ করা হয়ত জরুরিই, উপন্যাসটি চরিত্রগুলোর নাম নেয়ার ব্যাপারে বেশ কায়দা করে অনীহা দেখিয়েছে। কাজেই, নৃপেণ নামের উল্লেখ ঠিক হেলাফেলার বস্তু নয়। বাদ্য-বাজনা শুরু করার পরে বোবা বউয়ের যে পরিবর্তন কথক মুগ্ধতার সাথে লক্ষ করছিল, আর বর্ণনা করছিল, তাতে মুসলমানির কোনো চিহ্ন মেলে না। অন্তত একবার সে তার বউকে দেবীপ্রতিমার সাথে, এবং আরেকবার আশ্রমকন্যার সাথে তুলনা করেছে। দুমাস ছুটি নিয়ে মনোরম সংসার যাপনের কালে, অথবা তারও পরে, কথক নিজে, তার বোবা বউ বা তার বোন কোনোরকম ইসলামি বা মুসলমানি চিহ্ন প্রকাশ করে নাই। এটা বাস্তবে অসম্ভব নয়। কিন্তু এই সর্বতো রূপকধর্মী নির্মাণে এসব একরোখা অবস্থানের মূল্য তালাশ না করে উপায় কী?

বাঙালি মুসলমান স্বদেশে না থেকে মধ্যপ্রাচ্যীয় বিদেশে বেওকুফের মতো ঘোরাঘুরি করেছে, আর বর্তমানময় আধুনিকতায় না মজে লিপ্ত থেকেছে মধ্যযুগীয় সংস্কারে; ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার মতি ফিরেছে, এবং চুয়ান্ন-ষাট পেরিয়ে উনসত্তর নাগাদ ভাবাদর্শিক বদলের মধ্য দিয়ে তারা সদলবল ‘বাঙালি’ হয়েছে— বহুকথিত এ কাঠামো, দেখা যাচ্ছে, ওঙ্কার উপন্যাসে বেশ বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রিত হয়েছে। ভাবাদর্শিক বদলের কোরামিন হিসাবে সংস্কৃতির কথিত ভূমিকাও আহমদ ছফা পরোক্ষে আমল করেছেন। এদিক থেকে ওঙ্কার বাংলাদেশের প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী বয়ানের অনুসারী। শুধু ওঙ্কার নয়, আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন নামের বিখ্যাত প্রবন্ধেও একই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আছে।

উনিশ শতকের জাগরণ ও আধুনিকায়নে ইমান রেখে এর বাইরে কোনো প্রকল্প খাড়া করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবে প্রথম থেকেই আহমদ ছফা উনিশ শতকের নানামাত্রিক পর্যালোচনার মধ্য দিয়েও গেছেন। বিশেষত এই মহাবয়ানে বাঙালি মুসলমানের যে-গভীর অপরায়ণ ঘটেছিল, তার নিরাকরণে ছফা সক্রিয় ছিলেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস যদ্যপি আমার গুরু সে চিহ্নই বহন করছে।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *