অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৯, ২০২৪
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মজিদ মাহমুদ -
করোনা পরবর্তীকালে বিশ্বে নতুন সামাজিক বিন্যাস

বর্তমানে মানুষের সমাজ নতুন করে তিন ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। যথা— ১. মহাকাশচারী ২. আকাশবিহারী ৩. মৃত্তিকাধারী।

বিশ্বব্যাপী করোনা পেন্ডামিক কালে এই বিভাজনের পথ ত্বরান্বিত হয়েছে। কিছুদিন আগেও পৃথিবীর মানুষ অর্থনৈতিকভাবে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। ১. উচ্চবিত্ত ২. মধ্যবিত্ত ৩. নিম্নবিত্ত।

কেউ কেউ অর্থনীতিক বিভাজনকে সরাসরি ধনী ও গরিবের বিশ্ব বলে উল্লেখ করতেন। মার্কসবাদীদের কাছে প্রোলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া শ্রেণি বলে নিদান ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে তিন শ্রেণিতে ভাগ হয় যায়। জাতীয় ও মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে এই বিভাজন করা হয়। যথা— ১. প্রথম বিশ্ব ২. দ্বিতীয় বিশ ৩. তৃতীয় বিশ্ব। প্রাক্তন ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রথম বিশ্ব, আর উপনিবেশিতরা ছিল তৃতীয় বিশ্ব। এখন যেটাকে উন্নয়নশীল, মধ্যম এবং উচ্চ আয়ের দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এসবের মধ্যেও রয়েছে নানা উপভাগ। এই বিভাজন দ্বারা কেবল একটি সাধারণিকরণই সম্ভব।

এই তিন ভাগের শ্রেণিকরণ আদিকাল থেকেই ছিল। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বিভাজনেও স্বর্ণ, রৌপ্য ও লৌহ-এর মূল্যমান বিবেচনায় মানুষকে ধাতবায়ন করা হয়েছিল। তাদের আলাদা আলাদা দায় ছিল। কারা রাজ্য চালাবে, সৈনিক হবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেবে, দাস ও ভূমিদাস হবে— সবই নির্ধারিত ছিল।

ধর্মের দুনিয়া মানুষকে দেখেছে আস্তিক ও নাস্তিক হিসেবে। সেই বিভাজন অর্থনীতির শ্রেণিকে কোনো পার্থক্য করতে পারেনি। গরিব অবিশ্বাসী আর গরিব অবিশ্বাসীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল অভিন্ন। এসবের মধ্যেও ভাগাভাগি রয়েছে নানা প্রকার। দাস ও মালিক, রাজা ও প্রজা— এভাবেই যুগ যুগ ধরে চলেছে মানুষের সমাজ। প্রকৃতিও মানুষকে নারী পুরুষে বিভক্ত করেছে। প্রকৃতির লিঙ্গভাগের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কিছু দায়িত্বও দিয়েছে। পুরুষ শুক্র দেবে, নারী ডিম ফোটাবে। মানুষ নারীর উদর থেকে ভূমিষ্ট হলেও পুরুষের গর্ভধারণের ঝামেলা না থাকায় কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। রঙের ভাগও অস্বীকার করা যায় না। আদি মানুষের গায়ের রঙ কালো হওয়া সত্ত্বেও বিবর্তিত শাদা রঙের মানুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করেছে। রুডিয়ার্ড কিপলিং কবিতা লিখেছেন— ‘দ্যা হুয়াইট ম্যানস বার্ডেন’। শাদাকে জগত উদ্ধার করতে হবে এই তাদের মনোভাব। মানুষের পরিচয়ের খাতায় এখনো বর্ণ ধর্ম লিঙ্গ গোত্রের উল্লেখ করতে হয়।

সকল ক্ষেত্রে এই বিভাজনের সঙ্গে ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক পার্থক্য রয়েছে। মানুষ সমান মর্যাদা ও অধিকার সম্পন্ন হলে পাসপোর্টের পরিচয়ে এসব লেখার দরকার হতো না। শ্রেণি একটি সাধারণ ধারণা। সমশ্রেণির মধ্যেও শোষণ নির্যাতনের ব্যাপার আছে। নারী পুরুষের তুলনায় অধীনস্ত বিবেচিত হলেও উচ্চবর্গের যে কোনো নারী তার অধস্তন বর্গের পুরুষের চেয়ে ক্ষমতাধর। আবার সমবর্গের মধ্যেও নারী পুরুষ লিঙ্গের ভূমিকায় অভিনয় করে থাকে। যেমন রাজার পুত্রসন্তানের অনুপস্থিতিতে কন্যার রানিরূপে রাজ্য শাসন। এই প্রতীকী পদে পুরুষ খুব একটা আপত্তি করে না, যদি বাহুবলের দ্বারা অর্জিত না হয়।

বর্তমান আলোচনায় এসব শ্রেণি পার্থক্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা উদ্দেশ্য নয়। মানুষের পূর্বেও শ্রেণিকরণ যে ইতোমধ্যে ভেঙে গিয়েছে এটি সংক্ষেপে তুলে ধরাই এ আলোচনার লক্ষ্য।

মাত্র একশ বছর আগে মানুষ উড়ন্ত যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে ভেসে বেড়ানো শিখেছিল। তার আগে মানুষের যন্ত্র ও যানবাহন মাটি ও পানির উপরে কেবল চলাচল করতে পারত। উড়ার যন্ত্র আবিষ্কারের পরে মানুষ পানির নিচে গোপন চলাচল ও অনুসন্ধানের জন্য ডুবো নৌকা তৈরির কৌশলও আবিষ্কার করতে পেরেছিল। এই সব যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে বিগত একশ বছরের মানব জাতির সম্পদের বৃদ্ধি এবং দুর্গম অঞ্চলে অনুগমনের প্রবেশাধিকার বেড়েছে কয়েকশ গুণ। মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। তার আগে প্রায় দশ হাজার বছরের কৃষি সংস্কৃতিতে মানুষ তার শারীরিক শ্রম ও হাতে তৈরি যন্ত্রের দ্বারা কায়ক্লেশে বেঁচে ছিল। তখন শ্রমের দ্বারা যে সম্পদ আহরিত হতো— তা কেবল লুণ্টনের দ্বারা, রাজ্য জয়ের দ্বারা, খাজনা ও কর আদায়ের দ্বারা, অতিরিক্ত মুনাফা ও শ্রম শোষণের দ্বারা কিছু লোকের কাছে পুঞ্জিভূত হতে পারত। এই সব সম্পদের অধিকাংশ ব্যবহার হতো কিছু লোকের ব্যক্তিগত সুখ-সম্ভোগে, আর অধিকাংশ সৈনিক ও অনুগত শ্রেণির বেতন ভাতার জন্য। বলা চলা এই প্রক্রিয়া চালু ছিল একেবারে বিশ শতকের শেষ নাগাদ পর্যন্ত। অর্থ উপার্জন, ধনী গরিবের মাপকাঠি, রাষ্ট্রগুলোর সম্পদের উৎস তখন প্রায় সবটাই ব্যাখ্যা করা যেত— একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে। পুরো বিশ শতক মার্কসীয় অর্থনীতির সূত্র প্রয়োগের ধারা ধন-সম্পদের মালিকানার কিছুটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব ছিল। যন্ত্রের মালিকানাও তখন মৃত শ্রম হিসাবে বিবেচিত হতো। বিশ শতকের মাঝামাঝি তেল ও খনিজ সম্পদের আহরণ ও তা যন্ত্রের গতি বৃদ্ধিতে ব্যবহার— সম্পদ সংগ্রহের একটি বড় উপায় হিসাবে বিবেচিত হতো। কিছু রাষ্ট্র সেগুলোকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে জাতীয় আয় বৃদ্ধির দ্বারা তাদের জনগণের অতিরিক্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে পারত। এর আগে বিশেষত ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর অর্থ সংগ্রহের প্রধান উপায় ছিল ঔপনিবেশিক ব্যবসায়।

কিন্তু একুশ শতকে এসে মানুষের অর্থ উপার্জনের ধরন পাল্টে গেছে। এমন সব ব্যবসার দ্বারা কিছু মানুষ ধন সংগ্রহের পরিমাণ সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে— যা অতীতে ভাবা সম্ভব ছিল না। অদৃশ্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ব্যবহার করে কিছু কোম্পানি শত শত বিলিয়ন ডলারের মালিক বনে গেছে। অতীত অর্থনীতির শ্রম শোষণের সাধারণ তত্ত্বের মধ্যে এই অর্থ আহরণের কোনো সদুত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে এই সব অর্থের মালিক হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জনগণের অংশীদারিত্বের একটা নিয়ম নিশ্চয় করারোপের মাধ্যমে রয়েছে। আর এ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য পুরোনো চালাকির পথ অবলম্বন করতে হয়।

যাক, এ আলোচনার উদ্দেশ্য বর্তমান বিশ্ব পেন্ডামিকে অবরুদ্ধ দুনিয়ায় অর্থনৈতিক শ্রেণির যে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে তারই সরলীকরণ করা। করোনা পেন্ডামিকের শুরুতে মনে করা গিয়েছিলেন, আগামী পৃথিবী ধনী ও গরিবকে প্রায় এক কাতারে এনে দেবে। পেন্ডামিকের শুরুতে বিশাল বিশাল বিমানবন্দরে সারি সারি উড়োজাহাজ উড্ডয়নহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়, পতাকাবাহী জাহাজগুলো করোনা ভাইরাসের ভয়ে বন্দরে নোঙ্গর করতে পারে না, ধর্মশালাগুলো ভক্তহীন শূন্য অবস্থায় পড়ে থাকে, তখন মনে হয়েছিল— এবার প্রকৃতি মানুষের অতিরিক্ত লোভের একটা সমুচিত জবাব দেবে। বিশাল বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি আর কখনো তার পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। মানুষকে যন্ত্রের বদলে মানব শ্রম ও বণ্টনের দিকে ফিরে যেতে হবে— সামষ্টিক অস্তিত্বের স্বার্থে। কিন্তু মানুষের চতুরতার কাছে প্রকৃতি অসহায়। হয়তো উড়োজাহাজ ও জাহাজ কোম্পানিগুলো এখনো তার পূর্বাবস্থা ফিরে পায়নি। হয়তো অনেক কোম্পানি ও পুঁজির মালিকরা আর আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবে না। কিন্তু নতুন পুঁজি নতুন মালিক খুঁজে নেবে। তবে এটি এত দ্রুত হবে ভাবা সম্ভব হয়নি।

এই করোনাকালে অদৃশ্য তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ব্যবহারকারীরা অর্থ আহরণের নতুন মওকা খুঁজে পেয়েছে। মানুষের গৃহবন্দি অবস্থায় তার যোগাযোগের প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভার্চুয়াল ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট, ফেসবুক, জুম, স্ট্রিমিয়ার্ড, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ। এই ইলেক্টিক ম্যাধ্যমকে ব্যবহার করে ব্যবসায় বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট মালিকগণ নতুন পুঁজির মুখ দেখছে। মানুষ যখন করোনা পেন্ডামিকের ভয়ে ঘর থেকে বেরুতে পারছে না, তখন কিছু কোম্পানি তাদের নিজেদের ব্যবস্থাপনায় রকেট নির্মাণ করে মহাকাশ বিহার করে ফিরে আসছে। এই সময়ে দরিদ্র মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে আসছে। মধ্যবিত্ত দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ গরিব দেশ করোনা টিকার ব্যবস্থা করতে পারছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষণা করেছে— ‘এখন বিশ্ব দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে— যেসব দেশ টিকা পেয়েছে, আর যে সব দেশ টিকা পায়নি।’ যারা টিকা পেয়েছে তারা ধনী দেশ, আর যারা পায়নি তারা গরিব দেশ। গরিব দেশের পক্ষে টিকা সংগ্রহ সহজ তো নয়ই, খাদ্য সংগ্রহের টাকা দিয়ে তাদের টিকা কিনতে হবে। এই টিকা উৎপাদন করবে গরিব দেশ। আর এই টিকা এবং টাকা উৎপাদন একটি অতিলোভি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মাইক্রোসফট ও ওয়েব ব্যবসায়ীদের একটি কারসাজি কিনা এতদ্সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সংশয় নিয়ে এখানে উল্লেখ করছি। ভারতীয় ডাক্তার তমাল বি চক্রবর্তী একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন—

‘২০১৫ সালে ৬০০ জন ডাক্তারের তৈরি মেডিক্যাল বোর্ড এক সংগঠন তৈরি করে, নাম দেয় ‘ডক্টর্স ফর ট্রুথ’। উনারা এক প্রেস কনফারেন্সে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেন, ‘কোভিড’ নামের এক ভয়াবহ পরিমণ্ডল তৈরি করার এক ভয়ঙ্কর ভাবনা ভাবা হচ্ছে। যার মূলে রয়েছে ব্যবসায়ীদের ডিজিট্যাল বাজার দখলের নোংরা খেলা এবং প্রতিষেধকের নগ্ন বাজার সৃষ্টি। হতে চলেছে নিকৃষ্টতম গ্লোবাল ক্রাইম। অ্যামেরিকায় এর উপর একটা তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়— ‘প্যানডেমিক’ নামে। ২০১৫ সালে রিচার্ড রথশিল্ড নামের একজন বিজ্ঞানী কোভিড টেস্টিং কিটের পেটেন্ট নিয়ে রাখেন। চুপিসারে চুক্তি স্বাক্ষর হয় পৃথিবীর একমাত্র ধনকুবের বিল গেটস-এর সঙ্গে। ২০১৭ এবং ২০১৮ এই দুবছরে দশ কোটি টেস্ট কিট উৎপাদন হয়, এবং তা সংরক্ষণ করেন বিল গেটস। হ্যাঁ আজ থেকে তিন বছর আগেই কোভিড-১৯ এর রূপরেখা তৈরি হয়ে গিয়েছিল শুধু তাই নয়, কোন দেশে কত রপ্তানি করা হবে তারও ভাগ বাঁটোয়ারা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সে তথ্যও বিল গেটসের সংগঠন WITS (World Integrated Trade Solution) থেকে পাওয়া গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবর ভাইরাল হয়ে যেতেই, ছয় তারিখ পরের দিন উইটস ‘কোভিড-১৯ টেস্ট কিট’ নাম বদলে ‘মেডিকেল টেস্ট কিট’ নামকরণ করে বুলেটিন দিয়ে দেয়। অথচ দু’বছর আগেই অ্যামেরিকা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং চায়নাতে কোটি কোটি কোভিড-১৯ এর কিট্ সরবরাহ হয়ে গিয়েছে। সংক্রমণের নাম গন্ধ কিন্তু ছিল না তখনো।

বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে— ‘কোভিড-১৯’ এমন এক পরিকল্পনা যার ব্যাপ্তি মার্চের ২০২৫ পর্যন্ত চলবে। এবং সেই থেকে পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে ডিজিট্যাল ওয়ার্ল্ড। অটোমেশন যুগের সেটাই হবে শুরু। তখন ব্যাঙ্কে পয়সা রাখলে, আপনাকে শুধু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যাঙ্ককে পয়সা দিতে হবে। শুধু ডিজিট্যাল যুদ্ধ নয়, সাথে দোসর হবে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। নিঃস্ব গরিব এবং বড়লোক জাত হবে কেবল এই দুটো। শুরু হবে ডিজিট্যাল মন্বন্তর। বিল গেটসের পক্ষ থেকে অ্যান্থনি ফৌসি ২০১৭ সালে এক বিজ্ঞান আলোচনায় দৃঢ়তার সাথে অদ্ভুত এক ঘোষণা করে বসেন। উনি বলেন : ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৯ সালে এক বিস্ময়কর জৈব মহামারির সম্মুখীন হবেন। যার সমাধান আমরা তৈরি রেখেছি।’ ২০১৮ সালে বিল গেটস বলেছিলেন— ‘আ গ্লোবাল প্যানডেমিক ইজ অন ইট’স ওয়ে, দ্যাট কুড ওয়াইপ আউট থার্টি মিলিয়ন পিপল— ইট উড্ কনটিনিউড টিল নেক্সট ডিকেড’। এর একবছর বাদে অক্টোবরের ২০১৯ এ পৃথিবীর এক নাম্বার ভ্যাক্সিন ডিলার গেটস নিউইয়র্কে দু’দিনের বিজনেস মিটিং ডাকলেন, তার দ্বিতীয় দিনের অ্যাজেন্ডা ছিল ‘করোনা ভাইরাস প্যানডেমিক এক্সারসাইজ’। সেখানে উনি মার্কেটিয়রদের উদ্দেশে বললেন— ‘উই নিড টু প্রিপেয়ার ফর দ্য ইভেন্ট’। হ্যাঁ এটা হচ্ছে ইভেন্ট-এর খেলা। সাধারণ মানুষ হলো তার উপকরণ।’

উহানে সৃষ্ট এই করোনা ভাইরাসের চরিত্র নিয়ে এখনো কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না। এটি সত্যিই প্রকৃতির খেলা, না লোভী মানুষ ও রাষ্ট্রের হাত আছে সেখানে। ইতোমধ্যেই বিল গেটস তার স্ত্রী ও ব্যবসায়ী অংশীদার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। অনেকের ধারণা এগুলো তাদের কৌশলগত অবস্থান। বিল গেটস সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন উল্লেখের কারণ বর্তমানে এই পেন্ডামিকে যারা বা যে কোম্পানিসমূহ সম্পদের পাহাড় গড়তে পারছে তারা বিল গেটস সৃষ্ট ব্যবসায় ও প্রযুক্তির আদলে সম্প্রসারিত। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে— বিশ্ববিখ্যাত ই-কমার্স কোম্পানি আমাজানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জেফ বেজোস নিজের কারখানায় তৈরি রকেটে মহাকাশ ঘুরে এসেছেন। তার কোম্পানির নাম ব্লু অরিজিন। এই ই-কমার্স ব্যবসায়ী মনে করছেন আগামীতে মহাকাশ পর্যটন খুব জমজমাট হয়ে উঠবে। এদেশীয় তিন কোটি টাকার মতো হলেই নিজের ওজন শূন্যতায় তোলা যাবে। শুধু তাই নয়, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি তিনি। তিনি কেবল স্বপ্নই দেখেননি, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে রকেট কোম্পানি খুলে বসেছেন। তার ব্যবসার ধরনও বিল গেটসের মতো। হাওয়াই মিঠা ব্যবহার করে তিনি মাত্র দুই দশকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন। ট্যাক্স ফাঁকি এবং অস্ত্রের চালাচল সহজ করার অভিযোগও এই কোম্পানির বিরুদ্ধে উঠেছে। সম্ভবত করোনাকালের বস্তুগত যোগাযোগ বন্ধ থাকায় এই সব কোম্পানির হাওয়াই যোগাযোগ শৈনঃ শৈনঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং তার তাদের অর্থকে আরও অর্থময় করতে কোটি কোটি গ্যালন জ্বালানি ধ্বংস করে কয়েক মিনিটের জন্য মহাকাশ বেড়িয়ে আসতে পারছে। বেজোসের কোম্পানির নাম ব্লু-অরিজিন ঠিকই বুঝতে পেরেছে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে এই ব্যবসায় জমজমাট হয়ে উঠবে, বিলাসী পয়সাওয়ালাদের কাছ থেকে পয়সা খসানোর জন্য এটি একটি মওকা হয়ে উঠবে । মহাকাশ ভ্রমণপ্রত্যাশী এক ধনকুবের মহিলা ইতোমধ্যে বলেছে, এ রকম একটা রোমান্সকর ভ্রমণের জন্য দুই তিন কোটি টাকা এমন কিছু নয়। নিশ্চয় টাকাওয়ালাদের কাছে এটি নাগরদোলা ও রোলার কোস্টারে ওঠার চেয়ে বেশি কিছু নয়। যতদূর জেনেছি এই শূন্যতাই পৌঁছানোর মোট সময় মাত্র দশ মিনিট। তাও আবার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে পঞ্চাশ কিলোমিটারের এই ঊর্ধমুখী দূরত্ব পৃথিবীর সীমার খুব কাছাকাছি। বেজোর্সের রকেটের নাম নিউ শেপার্ড, আর তার মহাকাশ যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন তার ছোট ভাই মার্ক বেজোস। বিশ্বের প্রথম দিককার বিমানচালক ৮২ বছরের ম্যারি ওয়ালেচ, এবং নেদারল্যান্ডসের একটি প্রাইভেট ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠানের সিইওর ১৮ বছরের ছেলে ওলিভার ড্যামেন। মনে রাখা ভালো নাসার মহাকাশ গবেষণা আর মহাকাশ পর্যটন-বিলাস এক নয়।

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে আরেকজন ধনকুবের তার নিজস্ব কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাকটিকের তৈরি রকেটে করে মহাকাশের দ্বারপ্রান্ত থেকে ঘুরে এসেছেন। এখন ধনকুবেরদের মধ্যে রীতিমতো তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে মহাকাশ ব্যবসায়ে অতি মুনাফা লাভের আশায় অধিক বিনিয়োগ। অথচ একটি করোনা টিকার জন্য যখন পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অনিশ্চিত জীবন মরণের সংকটে ভূগছে। সরাসরি যোগাযোগ সংকটের ফলে শত শত কোটি মানুষ খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে ভুগছে। এসব দেখে বলতে ইচ্ছে করে, এই করোনা পেন্ডামিক সত্যি মানুষের লোভের সৃষ্টি নয় তো! চীন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, করোনার উৎস সন্ধানে তারা আর সুযোগ দেবে না। কেন, তাহলে কি প্রমাণ করা সম্ভব হবে— এই মহামারি ল্যাবরেটরিতে সৃষ্টি করা হয়েছে!

সম্প্রতি এক খ্যাতিমান তারকার স্বামীর পর্ন ব্যবসাও ভার্চুয়াল যোগাযোগের দ্বারা সৃষ্ট অতিলোভী মানসিকতার ফল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই সব ঘটনা কেবল একটি দুটি উদাহরণ মাত্র। পেন্ডামিক কালে পৃথিবীর মানব সমাজ ও অর্থনৈতিক শ্রেণিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কালের মূল্যবোধ কাজ করছে না। মার্কস-ফ্রয়েড-ডারউইনের যুগ, উত্তরাধুনিক, উত্তর-উপনিবেশ, নির্মাণ-পুনর্নির্মাণের যুগের তত্ত্ব দিয়ে আজ আর এসব ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। পৃথিবীতে এর আগেও মহামারি হয়েছে, যুদ্ধ মন্বন্তর হয়েছে; হয়তো তার মারণঘাতী রূপ আরও ভয়াবহ ছিল, কিন্তু বর্তমান করোনা পেন্ডামিক বিশ্বব্যবস্থার খোল-নলচে পাল্টে দিচ্ছে। একটি কারণ হয়তো আজ থেকে অর্ধ-শতাব্দী আগেও পৃথিবীর দেশগুলো পরস্পরের উপর যোগাযোগের দ্বারা এতটা নির্ভরশীল ছিল না। বর্তমান শতাব্দীর ভার্চুয়াল ব্যবস্থা পুরো পৃথিবীকে একটি বহু-বাহু ড্রাগনের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। যারা কবল থেকে বের হওয়া সামগ্রিকভাবে সম্ভব নয়। পাল্টে যাচ্ছে মানুষের সম্পর্কের ধরন, পরিবর্তন হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা। গড়ে উঠছে নতুন সংস্কৃতি। বয়স্কদের পক্ষে এ পৃথিবীতে বসবাস দুরূহ হয়ে যাচ্ছে। নতুন যুগে রাজকুন্দারা হলো ভার্চুয়াল শরীর সম্পর্কের ব্যবসায়ী। এখন মার্কসীয় শ্রম ও উদ্বৃত্তের ধারণা দিয়ে অর্থের মালিকানা ব্যাখ্যা করা সহজ হচ্ছে না। ভার্চুয়াল যুগে মালিক ও শ্রমিকের ধারণা পরিবর্তন হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বলা সম্ভব নয়, কে কার নিয়োগকর্তা। দৃশ্যত শ্রমিক মালিক উভয়েই স্বাধীন। কিন্তু পয়সা যেখান থেকেই আসুক সকল পয়সার মালিক জনগণ। জনগণের পকেট থেকেই বিল গেটস, আমাজান, ফেসবুক, আলী বাবা— সব অদৃশ্য ব্যবসায়ী পয়সা উপার্জন করে থাকেন। কারও টিকা কিনতে না পারা, আর কারও রকেট মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার সব অর্থ নিশ্চয় একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। এখন প্রশ্ন জনগণের পক্ষে কি সেই অর্থ নিয়ন্ত্রণ কিংবা অর্থ উপার্জন সম্ভব? তারা তো কোনো ব্যক্তির উপর প্রত্যক্ষ শোষণের এই অর্থ উপার্জন করেনি, তাদের মেধা প্রযুক্তি ও পরিশ্রমের দ্বারা, রাষ্ট্রীয় আইনি কাঠামো দ্বারা এই অর্থের মালিকানা তৈরি করেছে। এই অর্থের বৈধ বিনিয়োগ ও গবেষণার পথ সৃষ্টি করেছে। তা সত্ত্বেও ব্যক্তির সকল অর্থের উৎস রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জনগণ। মানুষের প্রজন্ম যখন বিলুপ্তির মুখে তখন দেশসমূহের অর্থ কোন পথে বিনিয়োগ হবে সেই নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রের থাকতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র কখনো সেই দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়; কারণ রাষ্ট্র তাদের দ্বারাই পরিচালিত হয়ে থাকে।

বিগত দশ হাজার বছরের কৃষি সংস্কৃতি মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছিল। তার ভাষা তৈজস ও চেতনা— এখন আর আগের মতো কাজ করছে না। যদিও মৃত্তিকাধারী নিম্নবর্গের মানুষ তাদের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখানে ডারউইন কাজ করছে অথবা করছে না। হয়তো যোগ্যতমের বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরাং-ওটাং ও শিম্পাঞ্জির মতো নতুন জগত পরিণত হচ্ছে। মাটিতে যারা ফসল বোনে, শস্য উৎপাদন করে— তারা প্লেটোর কালে যেমন ভূমিদাস ছিল, এখনো ভূমি থেকে তাদের মুক্তি ঘটেনি। তারা কখনো-সখনো বিশেষ প্রয়োজনে ভূমিতে বিচরণশীল যানবাহন, যেমন বাস-ট্রেনে চড়তে পারে, কিন্তু তাদের পক্ষে কদাচিৎ বিমানচারী হওয়া সম্ভব হয়। কখনো তাদের সন্তানেরা বিমানে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যে কিংবা ইউরোপ-আমেরিকায় মালিকের পক্ষ থেকে শ্রম বেচতে যায়। অথচ বিমানযুগে মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে, বিমানের জন্ম হওয়ার আগে মানুষ কীভাবে দূর-দূরান্ত যাত্রা করতো। অথচ রোমান, অটোমান ও ব্রিটিশরা একসঙ্গে অনেকগুলো মহাদেশ শাসন করেছে বিমান ইঞ্জিন আবিষ্কারের আগেই। পৃথিবীর নব্বই ভাগ মানুষ বিমানে চড়ার আগেই কিছু মানুষ পৃথিবীর মহাকর্ষের টান ছেড়ে মহাবিশ্বের জগতে পাড়ি জমাচ্ছে। হয়তো একদিন তারা চাঁদে, মঙ্গলে নিজেদের নতুন ঠিকানা সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। তখনো মাটির মায়ের সন্তানেরা মাটিতে লাফালাফি করে বেড়াবে। কিন্তু যারা অদৃশ্য সামাজিক যোগাযোগের দ্বারা, অগুনতি অর্থের মালিকানা তৈরি করে মহাকাশে পাড়ি জমাবে, আবাস গড়বে— সেই সব মানুষ কোনো দিক দিয়েই তাদের কেউ নয়— যারা করোনার টিকার অভাবে জ্বরে, নিউমোনিয়ায়, পাতলা পায়খানায়, ফুসফুসে অম্লজানের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবে। সুদূর ভবিষ্যতে কোনো এক ডারউইন হয়তো আবিষ্কার করবে দূর-বিবর্তনে তাদের সম্পর্কের সূত্রসমূহ।

 

Read Previous

জলছবির প্রতিচ্ছবি

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *