
উনুনের দাউ দাউ আগুনে কিছু একটা জ্বলছে। পাশে দাঁড়িয়ে শীর্ণকায় তরুণ এক নাট্যকার। চোয়াল শক্ত। চোখে বেদনার অশ্রু। আগে অবশ্য কিছু কবিতা লিখেছেন। তা ছাপাও হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু মন ভরেনি। স্বপ্ন নাট্যকার হওয়ার। মনে আশা তাঁর নাটক মঞ্চে মঞ্চস্থ হোক। নিজের লেখা নাটকের খাতা নিয়ে একদিন নামকরা এক নাট্যকারের সঙ্গে কলকাতায় গেলেন। তিনি আবার তাঁর আত্মীয় হন। উদ্দেশ্য কলকাতার জনপ্রিয় নাট্যগ্রুপের ম্যানেজারের হাতে পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়া। সে ভদ্রলোক পড়া তো দূর কথা, ছুঁয়েও দেখলেন না। উলটো চরম অসম্মান ও অপমান করলেন সেই নাট্যকারকে। তাঁর জন্য উমেদারি করার জন্য। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে তরুণ নাট্যকার সব শুনে নিজেও ভীষণ ব্যথিত ও অপমানিত বোধ করলেন। কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে এই চরম সিদ্ধান্ত। পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ছাই করে দিলেন।
সেদিনের সেই তরুণ নাট্যকার কিন্তু পরবর্তীতে ১২টি নাটক লিখেছেন। তাঁর রচিত কাহিনীর নাট্যরূপ দিয়ে অজস্র মঞ্চসফল নাটক অভিনীত হয়েছে। হয়েছে যুগান্তকারী চলচ্চিত্র। বিশ্ববরেণ্য পরিচালকরা তাঁর কাহিনী নিয়ে ছবি করেছেন। তবু তিনি কবি নন, নাট্যকার নন, বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের এক শক্তিশালী ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি আর কেউ নন, গণদেবতা, কবি, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা উপন্যাসের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি লিখেছেন, ‘কালো যদি মন্দ তবে, কেশ পাকিলে কান্দো কেনে।’
১৮৯৮, ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক ভগ্ন জমিদার বংশে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম। পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা প্রভাবতী দেবী। গ্রামের পরিবেশেই তিনি বড় হয়ে ওঠেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর নিজ গ্রামেরই মেয়ে উমাশশী দেবীর সঙ্গে লেখকের বিয়ে হয়ে যায়। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় আসেন। প্রথমে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। পরে আশুতোষ কলেজ, তখন নাম ছিল সাউথ সুবার্বন কলেজ। কিন্তু কলেজে পড়ার সময় তিনি অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এবং কারাবাস করেন। এক বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে কিছুদিন কলকাতায় কয়লার ব্যবসা করেন, পরে চাকরি নিয়ে কানপুরে চলে যান। সুবিধে করতে না পেরে পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসেন এবং সমাজসেবামূলক কাজ ও সাহিত্যচর্চাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন।
কলকাতায় এসে তিনি কিছুদিন বৌবাজারে এক মেসে থাকতেন। এখানে বসে তিনি অনেক বিখ্যাত গল্প রচনা করেন। তাঁর প্রথম রচিত গল্প রসকলি। তখনকার সাড়া জাগানো ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় ১৯৩৭। এ গল্প পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লেখককে প্রশংসা করেন। এরপর লেখেন অগ্রদানী, ডাইনি, ডাক হরকরার মতো সব কালজয়ী গল্প। প্রথমে বিভিন্ন জায়গায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। পরিশেষে টালাপার্কে নিজে বাড়ি করেন। সেখান থেকেও এক সময় আবার বরানগরে চলে যান।
তিনি কালের কবিয়াল। মানবজীবনের অকৃত্রিম জয়গানই তাঁর সাহিত্য। সমাজের অন্ত্যজ প্রান্তিক মানুষজনের কথা তিনি যেভাবে বলেছেন, তাঁর আগে বাংলা সাহিত্যে তেমনভাবে কেউ বলেননি। তারাশঙ্কর ছিলেন রাঢ়বঙ্গের মানুষ। লালমাটির দেশ, বাউল কবিয়াল বৈষ্ণব সুফি শাক্ত আর সতীপীঠের দেশ। উত্তর রাঢ়ের জনপদ, তার গ্রাম জীবন, লৌকিক দেবদেবী, চণ্ডিমণ্ডপ, মঠ, ভাঙা দেবদেউল, তান্ত্রিকের আসন, ধর্মঠাকুর— এইসব নিয়ে তাঁর আখ্যানের কাঠামো গঠিত হয়েছে। সেখানকার মানুষের বিশ্বাস, লোকাচার, পালাপার্বণ জীবন্ত শরীর পেয়েছে তাঁর কাহিনীতে। রুক্ষ রূঢ় মাটি ও প্রকৃতির গল্প তিনি বলেননি, বলেছেন সেখানকার মানুষের গল্প। বোষ্টম, সাঁওতাল, বেদে বাগদি, কাহার, দুলে— এইসব অন্ত্যজ মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাদের সরলতা, লোভ, আশাভঙ্গ হিংসা-প্রতিহিংসা ও স্বপ্নের গল্প। গ্রাম ছাড়িয়ে জনপদ ছাড়িয়ে, জেলা প্রদেশ ছাড়িযে এক অখণ্ড ভৌগোলিক বিস্তার পেয়েছে তাঁর সাহিত্য। তিনি আন্তর্জাতিক সীমানায় পৌঁছে গেছেন। বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর রচনা। দু’ দু’বার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর।
এই যে আবহমান দেশ, তার মৃত্তিকা প্রকৃতি মানব সম্পদ ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিয়ে বিরাজমান, তার কি শুধু সম্পন্ন জমিদার-জোতদার মহাজন স্বত্বভোগীদের? কখনোই না। ভূমিহীন দরিদ্র জনমজুর কৃষকেরও। কারখানার কালিঝুলি মাখা শ্রমিকেরও। এই বোধ তিনি আমাদের মধ্যে জাগিয়েছেন। শিল্পবিপ্লবের ফলে আধুনিক গ্রাম জীবন ভেঙে নতুন নগর জীবন গড়ে উঠছে, এই উদ্যোগ পর্বের স্পষ্ট চিত্র যেমন তাঁর উপন্যাসে আছে, তেমনই ক্ষয়িষ্ণু জমিদারি প্রথা অবলুপ্তির বিলাপ, নতুন পুঁজির আগমন— মানুষকে এক অনিকেত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত তিনি রেখেছেন ‘জলসাঘর’ ‘অভিযান’ প্রভৃতি গল্পে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেকার সময়সীমায় রচিত হয় লেখকের প্রথম পর্বের উপন্যাসগুলো। একটা রাজনৈতিক বিশ্বাস তাঁর ছিল, কিন্তু সেই রাজনীতি তাঁর লেখকসত্তাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তিনি সত্যনিষ্ঠ দ্রষ্টার মতো যা দেখেছেন, উপলব্ধি করেছেন, তা স্পষ্ট ঋজু এক ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। মানব জীবনের ইতিহাস লিখেছেন তারাশঙ্কর। আধুনিক সভ্যতার সর্বগ্রাসী বিস্তার, ধনতান্ত্র ও পুঁজির আগ্রাসনে বাংলার গ্রামজীবনের যে ভাঙন, তা তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্ত ও জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী, গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম প্রভৃতি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।
তারাশঙ্করের দ্বিতীয় পর্বের উপন্যাসগুলো নগরকেন্দ্রিক। সেখানে মানুষের বহিরঙ্গের নয়, অন্তরঙ্গ জীবনের গল্প বলেছেন। চরিত্রের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, জয় পরাজয়, সম্পর্কের জটিলতা, মনোবিকলন— এ সবই অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। সপ্তপদী, বিপাশা, অভিনেত্রী, ফরিয়াদ, মঞ্জরী অপেরা, শুকসারি কথা, যোগভ্রষ্ট, আরোগ্য নিকেতন প্রভৃতি লেখকের নাগরিক উপন্যাসগুলো চলচ্চিত্রায়ণের জন্য সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে ঠিকই কিন্তু তাঁর নাগিনী কন্যার কাহিনী, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী প্রভৃতি আঞ্চলিক ধ্রুপদি উপন্যাসগুলো তারাশঙ্করকে বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন দিয়েছে।
বাংলা সাহিত্যকে তারাশঙ্কর প্রান্তিক মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিংবা বলা যায় প্রান্তিক মানুষজন যাঁর লেখায় উঠে এসেছিল আশ্চর্য আন্তরিক এক দৃঢ়তায়। তাদের ক্ষোভ বঞ্চনা লড়াই আর বিদ্রোহ নিয়ে। কালের নিয়মে অবলুপ্তির পথে যে প্রান্তিক জনজাতি, তাদের জীবনেতিহাস, সংস্কৃতি, তাদের গাথা-গল্প, সংস্কার জনশ্রুতি— সবই তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর তাঁর সাহিত্যে সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ এক মেদহীন সরল অথচ ঋজু গদ্যভাষায় বর্ণিত হয়েছে l আপাত নিরস ও রুক্ষ হলেও সে ভাষার অর্ন্তনিহিত মাধুর্য এবং আন্তরিক সাবলীলতা আমাদেরকে মুগ্ধ করেl
কথাসাহিত্যক তারাশঙ্করের উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় ৬৫। গল্পগ্রন্থ আছে ৬৩। ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণ কাহিনী, একটি প্রহসন ও একটি কবিতা সংকলন ‘ত্রিপত্র’। তাঁর রচিত কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রভূত সাফল্যের মুখ দেখায়, তিনি মুম্বাই থেকে ডাক পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের কাহিনীকার হিসেবে যোগ দেওয়ার। উচ্চ বেতনের প্রলোভন ছিল। কিন্তু যাননি। সাহিত্য রচনায় তিনি সাফল্যের শীর্ষে উঠেছিলেন। পেয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার। রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য আকাদেমি, জ্ঞানপীঠ, শরৎ স্মৃতি পুরস্কার, জগত্তারিণী স্মৃতি পদক। পেয়েছেন পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধি। ১৯৫৭ সালে চিন সরকারের আমন্ত্রণে সেদেশে সফরে যান। ১৯৫৮ তে অ্যাফ্রো-এশিয়ান লেখক সঙঘের প্রস্তুতি সভায় যোগ দিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যান। এরপর তাসখন্দে অনুষ্ঠিত অ্যাফ্রো-এশিয়ান লেখক সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। তবুও ‘গেঁয়ো’ ‘স্থূল লেখক’ এ অপবাদ সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে।
তারাশঙ্কর ছিলেন জীবনরসিক। অভাব দুঃখ স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে লড়াই করেছেন আজীবন। আর এই শক্তি তিনি পেয়েছিলেন মা প্রভাবতী দেবী ও স্ত্রী উমাশশী দেবী, তাঁর ‘বড়বৌ’-এর কাছ থেকে।
জীবনকে পুরোপুরি ভালোবেসেছিলেন। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো তাই দোষেগুণে রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। তিনি যেমন মানুষকে ভালবেসেছিলেন, নিজ পরিবার আত্মজনকে ভালোবেসেছিলেন, সর্বোপরি নিজের দেশকেও ভালোবেসেছিলেন। তাঁর সাহিত্য তাই এক অর্থে দেশবন্দনা। ধাত্রীদেবতা, কালিন্দী, গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম উপন্যাসের আখ্যান চরিত্র সেই কথাই বলে। তবু তিনি বারবার অন্যায় বিরূপ সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন। প্রতি পদে রক্তাক্ত হয়েছেন। সন্দীপন পাঠশালা উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হতে এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে হেয় করা হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে তাঁকে হাওড়ায় শারীরিকভাবে নিগৃহীত করা হয়। যখন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চলছিল, অপরাধীদের চিনতে পেরেও তিনি অস্বীকার করেছিলেন। পরে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ওদের ক্ষমা করে দিলুম। আসলে ওরা তো আমার এই দেশের মানুষ। তাছাড়া ওরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করেনি, পিছন থেকে ওদের উত্তেজিত করেছিল ও নির্দেশ দিয়েছিল কোনও রাজনৈতিক বড় মাথা।’ এই হলেন তারাশঙ্কর। তিনি পুরস্কারে যতটা উচ্ছ্বসিত আনন্দিত, আবার অপমান ও তাচ্ছিল্যে ঠিক ততটাই আহত হন। তবু প্রকৃত জীবন রসিকের মতো মেনে নিয়েছিলেন এই অমৃত ও গরলকে।
বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের যে তিনটি উপন্যাস জনপ্রিয়তায় মিথ হয়ে আছে, তা হলো ‘শেষের কবিতা’, দেবদাস’ ও ‘কবি’। রাঢ়বঙ্গের কবিগান ও ঝুমুর নাচের প্রতি তাঁর খুব টান ছিল। তিনি রাত্রি জেগে এইসব পালাগান ও আসরের নাচ দেখতেন। সেই অভিজ্ঞতায় রচনা করলেন ‘কবি’ উপন্যাস। লুপ্তপ্রায় ঝুমুর ও কবিগানকে অমর করে দিলেন কাহিনীতে। নিতাই কবিয়াল, বসন, ঠাকুরঝি, রাজন আর তাদের জীবনকে নিয়ে এক মায়ার জগৎ তৈরি করলেন। আমার মনে হয় তারাশঙ্কর নিজেই সেই কালের কবিয়াল। মানুষ আর দেশ-এর প্রতি আবুক ভালোবাসায় তিনি যেন সারাজীবন ধরে জীবনের কবিগান গেয়ে গেছেন। তবু সাধ মেটেনি। কবি উপন্যাসের শেষে কবিয়াল নিতাইয়ের মুখ দিয়ে তাই তিনি বলিয়েছেন, ‘ভালোবেসে মিটল না সাধ, হায় জীবন এত ছোট কেনে!’
১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়।
rabindranathbasu616@gmail.com
One Comment
আন্তরিক ধন্যবাদ আর অভিনন্দন জানাই সম্পাদকমণ্ডলীকে।