অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আদিমা মজুমদার -
একুশে বইমেলা ঢাকা অমর রহে

মায়ের ভাষায় কথা বলাতে

স্বাধীনতার পথ চলাতে

হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ

সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান…

জীবন কোথায়! তাই খুঁজে বেড়াই। অনেক দিনের স্বপ্ন বুকে গাঁথা ছিল, বাংলাদেশ ঢাকার একুশে বইমেলায় জীবিত থাকতে একবার যোগদান করব। যাব যাব বলে সময় করতে পারছিলাম না, সংসারের গ্যাঁড়াকলে জড়িয়ে ছিলাম ফেবিকল দিয়ে। চাবিটা কত কেঁদেছে তালার ভেতর ঢুকবে বলে, এবার তাকে লাগিয়ে দিই সংসারের তালায়, ইচ্ছেমতো স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে। বেরিয়ে পড়ি আসাম ইউনিভার্সিটির ফাইনাল সেমিস্টারের ল’ বিভাগের ছাত্রী নাতনি রূপালীকে সাথে নিয়ে গত ১৮/0২/২০২৪ তারিখে।

মাতৃভাষার টান চুম্বকের মতো। বরকত সালাম রফিক জব্বার শফিউর… এমন শহীদের রক্তে ভেজা মাটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে অমর একুশে বইমেলা ঢাকায় চলে যাই।

ভ্রমণের প্রতি পদে পদে ছিল বিস্ময় আর বিস্ময়। শিলচর থেকে সকাল সাড়ে আটটায় আগরতলা এক্সপ্রেস চড়ে চলে যাই করিমগঞ্জে। ট্রেনে সঙ্গী মিলে যান লিংক রোডের দাদা সত্যব্রত দাস পুরকায়স্থ, ওয়াটার রিসোর্স ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন, এখন অবসরপ্রাপ্ত। আরেকজন দাদা তারাপুরের, সুব্রত ধর, আসাম ইউনিভার্সিটিতে কাজ করেন। কথার পিঠে কথা বলতে বলতে করিমগঞ্জের এশিয়া বিখ্যাত শনবিলের কথা উঠে আসে। ২৪, ২৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মস্ত বড় অনুষ্ঠান হবে শনবিলে। আসাম ইউনিভার্সিটির মানবেন্দ্র দত্ত চৌধুরী স্যার ইউটিউবে খবর প্রচার করছেন। আমাদের আশার পারদ বেড়ে যায়, একদিন খুব সুন্দর পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে এই জায়গায়। চারপাশে সবুজ বৃক্ষ মধ্যে বিরাট জায়গা জুড়ে জল, নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। জলের উপর পদ্মপাতায় খেলা করে সাপ। এই অনুষ্ঠান ছাড়া যাবে না, দেখতে হবে। ঢাকা থেকে আসতে চাই ২৫ ফেব্রুয়ারির আগেই।

গল্প করতে করতে এসে পড়ি নিউ করিমগঞ্জে। স্টেশনের পাশেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল আমার নাতনি রূপালীর এক বন্ধু, সে আমাদের নিয়ে যায় ডলার নিতে শম্ভুসাগরদিঘির বিপরীতে মানি একচেঞ্জ অফিসে, সেখান থেকে ২০ হাজার ভারতের টাকা দিয়ে ২০০ ডলার পাই। ১০ দিন আগে টাকা ও পাসপোর্ট দিয়ে এসেছিলাম ভিসা লাগানোর জন্য। একজনের ভিসায় উনি ২,৫০০ টাকা নেন। ত্রিপুরা থেকে গেলে কম টাকায় হয়। তারপর চলে যাই সুতারকান্দি বর্ডারে।

এপার ওপার দুই ইমিগ্রেশনের অত্যাচার সহ্য করি। ভুলে যাই এই বিরাট পৃথিবীর মানুষ আমরা একই মায়ের সন্তান। সামান্য কাঁটাতার ডিঙিয়ে আরেকটা দেশ। ভারতের সাথে যে ছিল তাতে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারবে না। একটা সিএনজি নিয়ে চলে যাই বাংলাদেশের দু’ভাগ বাসস্ট্যান্ডে। আমাদের এখানের মতো অটোকে তারা সিএনজি বলে। মানে, কমপ্রেশড ন্যাচারাল গ্যাসচালিত অটো।

ব্যাগ টানাহ্যাঁচড়া আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না, একটা বোবা ছেলে কোথা থেকে এসে আমাকে নো ম্যানস ল্যান্ড পার করে দিল। আলহামদুলিল্লাহ, হঠাৎ আল্লাহর কথা মনে পড়ে গেল, ছোটবেলা দাদি খুব ভয় দেখাতেন আল্লাহ-রাসুলের গল্প করে। মাঝে মাঝে বলতেন যেখানে ঠেকবে আল্লাহকে স্মরণ কর। সত্যিই কি ছেলেটা আল্লাহর ফেরেশতা ছিল? জানি না। আমি তখন মোবাইল ফোন বের করে ভিডিও করছিলাম আর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে আওড়াচ্ছিলাম প্রয়াত কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন— যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সেই কেড়েছে ভয়/ আকাশজুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়…।

পুলিশ ধমক দিচ্ছিল, ‘এখানে ভিডিও করা মানা, ভিডিও করা মানা।’

কে শোনে কার কথা, মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিই।

দু’ভাগ থেকে বাসে করে চলে যাই সিলেট কদমতলী বাসস্ট্যান্ডে, সেখানে দুজন অচেনা প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হয়। মির্জা ভাই ইঞ্জিনিয়ার, আর মিজান ভাই কাস্টমস অফিসার। চা না খাইয়ে ছেড়ে দেবেন না। ভারতীয় শুনে খুবই আদর করলেন। আমাদের শিলচরে কি কেউ পথটা ভালো করে দেখিয়ে দেবে, সন্দেহ! দারুণ আড্ডা হয় চা স্টলে। তারপর আমাদের সিএনজিতে তুলে পাঠিয়ে দেন কবি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে। চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাব। ‘হরিপুর বড়বাড়ি’ কামাল বাজার খাজাঞ্চি রাস্তায় স্টেশন রোড ভাবনা হোটেলের মোড়ের সামনে জিঞ্জির শাহের মাজার থেকে আরও কিছু আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিতে হয়। পাশেই সুরমা নদী। মনে পড়ে বিশিষ্ট কথাকার রণবীর পুরকায়স্থের উপন্যাস ‘সুরমা গাঙের পানি’ এবং তার চরিত্র বইতলের কথা।

সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়, পাখিরা ঘরে ফেরে। বারান্দায় বসে মোস্তাফিজুরদার বউ ছেলের বউ অপেক্ষা করছেন। মোস্তাফিজুরদা বাজার করতে গেছেন। মস্ত বড় বাড়ি নানা জাতের গাছগাছালি বাঁশঝাড়, ভেসে আসছে পাখির ডাক, যেন আমাদের ওয়েলকাম করছে পাখিরা।

সে কী আপ্যায়ন, বাবারে বাবা। সইলতা টেংগার স্বাদ লেগে আছে জিহবায়। রূপালি বলে, ‘নানু, আমাদের মতোই তারা কথা বলে রান্না করে!’

ওর কথা শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। রূপালি প্রথম এসেছে, ওর কত বিচিত্র ভাবনা।

পরের দিন শাহজালাল দরগা এবং শাহপরান দেখতে যাই পুরো পরিবার। দরগার দিঘিতে গজার মাছ, একেকটার ওজন হবে ৮/১০ কেজি।

আমি হাঁটতে যাই না, বসে বসে মানুষের ভণ্ডামি দেখি। দেখি কী দুর্বল মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত কাণ্ডকারখানা। মোমবাতি জ্বালিয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন, তাদের একটা ছেলে চাই, কেউ চাইছেন স্বামী যেন পরকীয়া না করে, কেউ রোগ থেকে মুক্তি চাইছেন।

২০ ফেব্রুয়ারি। আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। ঘর থেকে ফোন করছিলেন, শিলচর বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা বাসের টিকিট করে বিকেল চারটায় রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। গাড়ির জঙ্গলের ভিড়ের কথা বলে লাভ নেই। রাত সাড়ে বারোটায় পৌঁছালাম বাংলাবাজারে।

মোস্তাফিজুরদা আমাদেরকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দেন। হোটেলের রুম দেখে রূপালি বেঁকে বসে। বলে, এই নোংরা রুমে আমি থাকতে পারব না।

মোস্তাফিজুরদা বলেন, এ রুমে কবি শামসুর রাহমান থাকতেন। কবিতা নাটক লিখতেন। বাইরে সাইনবোর্ড লেখা দেখ নাই? বিউটি বোর্ডিং বাংলাদেশের ঢাকার পুরোনো বাংলাবাজারে ১ নম্বর লেনে অবস্থিত একটি দোতলা পুরাতন বাড়ি, যার সাথে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস জড়িত। গুণী মানুষের আড্ডাখানা।

বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে সেখানে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল এ পত্রিকায়। দেশভাগের সময় পত্রিকা অফিস কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

বিউটি বোর্ডিংয়ের জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী শিল্পী সাংবাদিক রাজনীতিক চিত্রপরিচালক নৃত্যশিল্পী গায়ক অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

এখানে যারা আসতেন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, হায়াৎ মামুদ, ভাষাসৈনিক ও পুস্তক প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান…।

‘কবিরা এতো নোংরা হয় জানতাম না’ বলে ওঠে রূপালি। ওকে চুপ থাকতে বলি। এত রাতে কোথায় যাই, কাল চলে যাব অন্যত্র। কোনোরকম ঘুমিয়ে যাই। রাস্তায় জান্নাত রেস্টুরেন্ট ও রিসোর্টে খাওয়াদাওয়া করে এসেছি। দুটো ক্লোনাজিপাম সেবন করে শুয়ে পড়ি।

ভোরে উঠে পড়ি, টেনশন। সকাল নটায় যেতে হবে বাংলা একাডেমিতে। দেখি রূপালি নেই, মহাফ্যাসাদে পড়ি। স্নান সেরে নিই। বাইরে বেরিয়ে দেখি ছেলেদের সাথে জগিং করছে, মোস্তাফিজুরদা অনেক সাবধান করে বলেছিলেন, মাথায় অন্তত কাপড় দিলে ভালো দেখাবে।

আমাদের তো এ অভ্যেস নেই। উনার কথা মানতে পারিনি।

রূপালি বলে, আমার বন্ধু ঢাকার এডিশনাল পুলিশ সুপার, আবুল হাসান খুব ব্যস্ত আজ। কথা হয়েছে ফোনে, আমাদের অন্য হোটেল ঠিক করে দেবেন। সাথে সাথেই জিরো পয়েন্টে হোটেল এম্পিরিয়েল বুক করে দেন, ফোন মারফত।

রূপালিকে ছেড়ে চলে যাই, বাংলা একাডেমিতে।

বিশাল বড় স্টেজ। নাম লেখালাম কবিতা পাঠ করব, সিরিয়াল নম্বর ১৮৩! হায় হায় কী করি। চলে যাই পাশে বইয়ের স্টলে।

বইয়ের স্টল দেখে মাথা ঘুরে যায়। আমার ছেলে সীমা ম্যাডাম জাহিদ রুদ্র কিছু বই এবং স্টলের নাম লিখে দিয়েছিল, স্টল তো খুঁজে পাই না। আবার চলে আসি স্টেজে, শেষপর্যন্ত নাম ডেকে, ভারত থেকে আগত সংবাদ মাইক্রোফোনে এনাউন্সমেন্ট করতেই মোবাইল ফোনে ফটো তোলার হিড়িক পড়ে যায়।

কবিতা পাঠ করে মঞ্চ থেকে নামতেই ফোন নম্বর বিনিময় পর্ব শুরু হয়। যিনি প্রথমেই কফি খাওয়ালেন, উনার নামটা জিজ্ঞেস করা হয়নি।

ইতোমধ্যে রূপালির বন্ধু ঢাকার এডিশনাল এসপি সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হন বাংলা একাডেমিতে আমাদের নিয়ে যাবেন বেড়াতে।

এত পুলিশ দেখে লেখক গোষ্ঠী অবাক হয়ে আমাকে ঘিরে ফেলেন, ভারত থেকে না জানি কত বড় মাপের লেখক আদিমা মজুমদার এসেছেন! মনে মনে হাসি। ঢাকার রিকশাওয়ালার কথার মধ্যেও কাব্যিক রস আছে। আমি কোন ছাই। বিনীত অনুরোধ করি, আমি যেতে পারছি না। লেখক-গবেষক মনিরুজ্জামান, উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি, তিনি তাঁর অফিস রুমে কয়েকজনকে নিয়ে আড্ডা দিতে চান। প্রেসমিটও আছে।

রূপালি একা চলে যায় বন্ধুর সাথে। টিপটিপ বৃষ্টিতে জমকালো আড্ডা বসে। বই বিনিময় হয়। বিজয়া কর সোমের প্রবন্ধ সংকলন ‘ভালো থেকো দেশ’ মনিরুজ্জামানদার হাতে তুলে দিতেই তিনি নামটা উচ্চারণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমরাও তাই চাই’।

‘স্বপ্নের জগৎ’-এর স্বপনের হাতে তুলে দিলাম বিজয়ার গল্প সংকলন ‘রেন্ডি’। একটা মুচকি হাসি দিয়ে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন ‘পড়ব’।

আমার নিজের বই আগেই শেষ হয়ে গেছে।

ভাবিনি এত লেখকের সাথে পরিচয় হবে। ফটোশুট আর শেষ হয় না। চা নাস্তা করে আমরা বেরিয়ে পড়ি অধ্যাপক গবেষক ড. শহীদুল্লাহ আনসারী স্যারের দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।

তোপখানা রোডস্থ মেহেরবা প্লাজায়।

গাড়িতে নয়, পায়ে হেঁটে। শর্টকাট রাস্তা।

রুমালি রুটি কয়েক প্রকার ডাল, সব্জি, সালাদ, দই। হোটেলের ছেলেরা এসে বলে, আর কিছু লাগবে? বড় আন্তরিক ব্যবহার। পেটের ক্ষুধায় অমৃত মনে হচ্ছিল। ক্ষুধা সকলে বুঝতে পারে না। ধন্যবাদ, স্যার।

খাবার শেষ হলে আরেক দফা বই বিনিময় হয়।

আবার হাঁটা। আমি হাঁটছি মাইলের পর মাইল। চেন্নাইর ডাক্তার বলেছিল আমার নাকি অস্টিওপরোসিস, হাড্ডিগুলো থার্মকল হয়ে গেছে। সাবধানে চলতে হবে। মোচড় খেলেই ভেঙে যাবে। ২০১৭ আমার ফোর ফিফথ লাম্বার ভার্টিব্রা অপারেশন হয় (leminectomy)।

ডাক্তারের কথা আমি মিথ্যে প্রমাণ করলাম।

আজ আর বেশি বই দেখা হলো না। ঢাকার সাংবাদিক লেখক বায়জীদ মাহমুদ কল করলেন, উনার স্টল নাম্বার ২৫৭-তে যেতে। খুঁজেই পাইনি। ফোন কলও যায় না ওয়াইফাই নেই। দুঃখিত বায়জীদ মাহমুদ ভাই। হাজারের উপর স্টল, হাবুডুবু খাচ্ছি।

রাত আটটায় ‘স্বপনের জগৎ’ স্টুডিওতে চলে যাই। টিপু সুলতান রোডে। আমার কোনো হয়রান লাগেনি। এক রিকশায় তিনজন মেয়ে উঠি। আমি পাদানিতে বসি। লিপি আর নাসরিন রীনা বসে উপরে। ঢাকা শহর কেঁপে ওঠে আমাদের গানে— আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে লালন বাউল কিছু বাকি থাকেনি।

২১ ফেব্রুয়ারি আমার সোনা মেয়ে জয়ীষার জন্মদিন। ভুলেই গিয়েছিলাম, ছোট্ট করে মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছা জানাই। দিনটি আমার কাছে অন্য একটা কারণেও তাৎপর্যমণ্ডিত। ‘স্মৃতিবিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিরোনামে একটি লেখা আমাদের লোকাল পত্রিকায় দিয়ে এসেছি, জানি না ছাপলেন কিনা।

পত্রিকা দপ্তরের সাথে যোগাযোগ তেমন নেই। তেল মারা সহ্য হয় না।

অধ্যাপক গবেষক ড. শহীদুল্লাহ আনসারী, কবি মোস্তাফিজুর রহমান, আশরাফ হোসেন, আবুল বাশার, নাসরিন সুলতানা, জেসি আক্তার, নাসরিন জাহান, রিনা দিলওয়ার হোসেন ডালিম, আঁখি আলমগীর, মাসুমা সোমা, একজন থেকে একজন বড় গায়ক, সংগঠক।

স্বপন তার বাবার স্মৃতিতে ‘জসিম উদ্দিন ললিত কলা একাডেমি’র বাচ্চাদের নিয়ে বসে আঁকো প্রতিযোগিতা করায়। রাত বারোটা বেজে যায়, গান আর বক্তৃতায়। আবুল বাশার ভাই আমাদের পৌঁছে দেন জিরো পয়েন্টে।

২২ ফেব্রুয়ারি মর্নিংওয়াক করে চলে যাই বাংলাদেশের জাতীয় কবি, আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারে। আমার তীর্থক্ষেত্র। গোলাপ গেন্দা জুঁই মালতী বেষ্টনীতে লাল গালিচায় মোড়া সিঁড়ি, জুতো খুলে উপরে উঠতে চাইলে সিকিউরিটি নিষেধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই। করব দেখেই আমার বুক ফেটে কান্না আসে। অবিশ্রাম সে কাঁদনে ভিজে যায় চারদিক। এত সকাল পাশে কেউ নেই। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আমার চোখের নোনাপানি মুছে দিতে চায়। এই পথিকের মনের ব্যথা কে বুঝবে।

কেন মেঘ আসে হৃদয়াকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না…।

বলি— জীবনে কত কষ্ট ছিল তোমার হে কবি। শুয়ে আছ বকুল বিছানো পথে। স্পষ্ট শুনতে পাই—

আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না/ বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত…।

ঝালকাঠি আর বরিশালে যাওয়া হলো না, আফসোস। কবি জীবনানন্দের বাড়ি দেখলাম না। আবার যাব।

রুমে এসে তৈরি হয়ে আবার বইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাই। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে নানা জাতির লোক এসেছে, একুশের বইমেলা দেখতে, কোথাও রাইতে কেন শালুক ফোটে… আবার কোথাও, জলের ঘাটে দেইখা আইলাম কী সুন্দর শ্যামরাই… গান নাচ ধামাইল চলছে, পেছেনে বিরাট বড় স্টেজে অনবরত চলছে বই উন্মোচন। হঠাৎ দেখি ঢাকার বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ঘিরে ধরেছে সাংবাদিকরা। সাংবাদিকরা যখন চলে যায় উনি স্টেজে ওঠেন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে, আমিও সেই স্টেজে ওনার সঙ্গ দিই, এবং অপেক্ষা করছিলাম উনাকে একা পেতে। পেয়েও যাই। কোনো রকম দুটো কবিতার লাইন শোনাই। কম. অনিল সরকারের—

একুশ কাঁদে ঢাকার বাড়ি

উনিশ শিলচরে

একুশ উনিশ ভাষার কান্না

সকল ভুবনজুড়ে।

তখন তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুমি কি লেখ? গল্প নাকি কবিতা?

আমি বললাম, গল্প-কবিতা দুটোই লিখি।

উনি বললেন, আসাম তো যাইনি কোনোদিন, কলকাতায় গিয়েছি। খুব বেশি করে পড়বে…।

এ আমার পরম পাওয়া।

প্রথিতযশা কবি, বীর বাঙালী পত্রিকার সম্পাদক নজরুল বাঙালী তাঁর অনুভবে তুমি বইটি এই মঞ্চে উন্মোচন করেন। সাংবাদিকের সামনে আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হয়।

আমরা কয়েকজন লেখক একটা গ্রুপ হয়ে ঘোরাফেরা করি, চা খাই বিড়ি খাই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিই, বই কেন পড়া কমে গেছে। একই জবাব, মোবাইল ফোনের নেশা। মিলন হয় আরও দুজন ঢাকা, কুমিল্লার মজুমদারের সাথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, রোজী মজুমদার ও মমতা মজুমদার। রোজী গায়ক, মমতা লেখক। মনে হয়েছে যেন কত যুগের পরিচয়। মমতার সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই ‘প্রিয়তম দুঃখ আমার’ নেওয়া হয়নি, সময় নেই।

নেকাব হিজাব বোরকার ধর্মান্ধতা যেমন দেখেছি, দেখেছি প্রকাশ্যে ইউনিভার্সিটির মেয়েদের হাতে সিগারেট। এরকম মেয়েদের সাথে বন্ধু হতে কতক্ষণ? ধূমপানের সাথে সাথে কথা বলা শেষ হয় না, মন্দিরের কাছেই এই জায়গাটা। ভাবলাম দুনিয়াটা একটা নেশা। নেশায় নেশায় মানুষ বাঁচে। বিড়ি-সিগারেটের নেশার মতো কারও মদ গাঁজা আফিম এমনকি নারীকে উপভোগ করার নেশাও আছে। কারও বইয়ের নেশা। নেশায় কিছু বই কিনি কিছু উপহার পাই। লক্ষ্মীপুরের নাসরিন জাহান রীনার কাছ থেকে ‘বিজন মনের কূজন’ কবিতার বই, ড. ইসমাত মির্যার ‘হুমায়ূন আহমেদ, পরী ও কিছু চিঠি’ আফরোজা জেসমিনের ‘হৃদয় পথের বাঁকে’ কবিতার বই ড. শহীদুল্লাহ আনসারীর ‘নিটোল পৃথিবী’। বাংলা একাডেমি থেকে ‘প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’, শফিকুল ইসলাম স্বপন দেন ‘হিমালয় কন্যা সিকিম’। মোস্তাফিজুরদা বাংলাদেশ পোয়েটস ক্লাবের স্মারক গ্রন্থ ‘সাহিত্য সম্ভার’ ও কিছু পত্রিকা উপহার দেন। আরও অনেক বই, ব্যাগ ভারি হয়ে যায়। একুশে বইমেলা ভীষণভাবে এনজয় করি। অভিজ্ঞতার ঝুলি উপচে পড়ে।

সুষুপ্ত পাঠক-এর ‘সুষুপ্ত পাঠক এর কথোপকথন’ বইটি অনেক খুঁজেও পাইনি। সময় থাকলে আরও খুঁজতাম।

শফিকুল দাদার সাথে লেখক প্রবীর মিত্র দাদুকে দেখে সরাসরি প্রশ্ন করি, ‘দাদু, আমাদের ভারতের সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখতে পাই বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর মুসলিমরা অত্যাচার করে…।

দাদু বলেন, এ তাদের দুর্ভাগ্য। সংখ্যালঘুরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক কিছু তো দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বড় ভালো লাগে উনার কথাগুলো।

এবার ফেরার পালা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।

রূপালিকে নিয়ে সবাই ফটো ওঠাতে, ভিডিও করতে থাকেন। কান্নাকাটি হয়। আবুল বাশারদা ইলিশ সিদ্ধ নিয়ে আসেন। খেয়েদেয়ে আমরা হোটেলে অপেক্ষা করি গাড়ির। সুন্দর যুবতী একটা মেয়ে সঙ্গে থাকলে অনেক উপকার হয়। হাড়ে হাড়ে টের পাই!

২৩/0২/২৪ রাত সাড়ে বারোটা আবুল হাসান তার পুলিশের গাড়ি পাঠিয়ে দেন, সঙ্গে লন্ডন এক্সপ্রেস সুপারের টিকিট। পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে তারপর যান। কৃতজ্ঞতা আদায় করতে দেননি। মনে থাকবে যতদিন বাঁচি। বিষাদের একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

সকাল সাড়ে ছ’টায় পৌঁছে যাই সিলেট। মির্জা ভাই অপেক্ষা করছিলেন। খুব টেনেছেন তাদের ঘরে যেতে, যাইনি। ওয়েটিং রুমে ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে চা নাস্তা করি। মির্জা ভাই গরুর মাংসের পোলাও ভরে দেন টিফিনে রাস্তায় খাবার জন্য।

বাংলাদেশ বর্ডারে এসে ধরা পড়ি, রোড ট্যাক্স দিয়ে আসিনি। এক হাজার টাকা ফাইন দিলাম। হোয়াটসঅ্যাপে তারা অনলাইন রোড ট্যাক্স দিয়ে রসিদ দেন। ব্যাগ খুলে সব বই তছনছ করে, বইয়ের পরতে পরতে কী খোঁজেন বুঝিনি।

আসলে এত ব্যস্ততার মধ্যে ভুলেই গিয়েছিলাম। ঘটনা হলো গায়ক স্বপনকে যখন তার স্টুডিওতে বলছিলাম, ডলার ভাঙতে সোনালি ব্যংকে যেতে। ও বলে যেতে হবে না, আমি ব্যাংকের একজন কর্মীকে ডেকে দিচ্ছি। উনি এসে ডলার এক্সচেঞ্জ করে দেন, তখন আমি রোড ট্যাক্সের কথা ভুলে যাই।

যাক, ইমিগ্রেশন অফিসের ঝামেলা মিটিয়ে শিলচর পৌঁছাতে বেলা ডুবে যায়। রূপালির চোখে জল, ভুলতে পারে না ভিনদেশের মাত্র চারদিনের আত্মীয়তার কথা, অনবরত চলছে মেসেঞ্জারে ভালোভাবে পৌঁছে যাওয়ার খবর।

চারদিনের কৃত্রিম স্বর্গ হতে বিদায়। হৃদয়বিদারক। সবার মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এডিশনাল পুলিশ অফিসার আবুল হাসান, মোস্তাফিজুরদা কাউকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। আপনারা থাকবেন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। একুশে বইমেলা ঢাকা অমর রহে।

ঘরে ঢুকতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে।

শিলচর, আসাম, ভারত থেকে

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

কৃষ্ণচূড়া

Read Next

ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ : ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *