অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আনোয়ার হোসেন বাদল -
দ্বীপান্তরের দিনগুলো

দেশের মানচিত্রে সর্বদক্ষিণের একটি উপজেলার নাম হচ্ছে মহেশখালী। ছবির মতো সুন্দর একটি দ্বীপ। কক্সবাজার থেকে পনেরো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। ইতিহাসবিদদের মতানুসারে এক সময়ে মহেশখালী চট্টগ্রামেরই একটি অংশ ছিল। কয়েকশো বছর আগে কোনো এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে মহেশখালী বিচ্ছিন্ন হয় এবং মহেশখালী চ্যানেল দ্বারা আলাদা একটি ভূখণ্ডে রূপলাভ করে।

বাংলাদেশে যত দ্বীপ আছে তন্মধ্যে মহেশখালী হচ্ছে একমাত্র পার্বত্য দ্বীপ। মোট চারটি দ্বীপ আছে এ উপজেলায়, মহেশখালীই সবচেয়ে বড়। বাকি তিনটি হচ্ছে সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা। কয়েক বছর আগে মহেশখালী নদীর উজানে মাতামুহুরি নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করে চকরিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছে মহেশখালী দ্বীপ। তবে মহেশখালী উপজেলা সদর গোরবঘাটা যা উপজেলার সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এবং তা কক্সবাজার জেলা সদরের কাছাকাছি হওয়ায় মানুষজন কক্সবাজার থেকে স্পিড বোট বা গামবোটে স্বল্প সময়ের নদীপথটিই বেশি ব্যবহার করে থাকে।

ফাল্গুন মাসের শুরু, বসন্ত আসি আসি করছে। স্পিডবোটে পাড়ি দিয়ে আমরা যখন মহেশখালীর ভূমিতে পা রাখি তখনও শীত একেবারে বিদায় নেয়নি। বিদেশ থেকে আসা পাখিদের মধ্যে যারা একটু অলস প্রকৃতির তারা যাই যাচ্ছি করে এখনও দু’চারটে দেখা যাচ্ছে। তাদের ওড়াউড়ি দেখতে দেখতে সামনে এগুচ্ছি। ঘাট থেকে জেটির ব্রিজ ধরে হেঁটে হেঁটে মূল ভূখণ্ডের দিকে যাচ্ছি। ব্রিজের দু’পাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের ঘন জঙ্গল। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই সবুজ অরণ্য। দেখে অনেকটাই সুন্দরবনের মতো মনে হচ্ছে। নদীর ওপারে সবুজ দ্বীপের মতো আরেকটি ভূখণ্ড দেখে স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটি চকরিয়া এলাকা। চারিদিকে তাকিয়ে মহেশখালীর রূপমাধুর্যে মোহিত হলাম। আমার ছেলে তূর্য আনন্দে ছুটোছুটি করছে। সুলতানা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সবুজ প্রান্তরের দিকে।

তাদের তাড়া দিয়ে বললাম— জলদি কর। আগে বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নিই। পরে সব দেখা যাবে।

মহেশখালীতে ভারী যানবাহন নেই। সবই সিএনজি, রিকশা আর ব্যাটারিচালিত অটো। আমরা যাব ইলা কমিউনিটি সেন্টারে। খুব বেশি দূরে নয়; অটোর ভাড়া ত্রিশ টাকা। অটোওয়ালার সাথে পরিচয় হয়ে গেল। তার নাম সাদিক, বয়স বছর বিশেক, বাড়ি মহেশখালীর শাপলাপুর।

আমাদের ভাষা শুনেই বললেন— আপনারা কি বরিশালের মানুষ?

বললাম— হ্যাঁ। বুঝলে কী করে?

বলল— আমার মামা বাড়ি ঝালকাঠিতে।

শুনে অবাকই হলাম।

সে আবার বলল— আমার বাবা লবণের খ্যাপ নিয়ে ঝালকাঠি গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আমার মাকে বিয়ে করে আনেন।

শুনে আনন্দিত হলাম। মনে মনে বললাম যাক, ভাগ্নেকে তো পাওয়া গেল।

বলল— ঘুরতে এসেছেন?

বললাম— হ্যাঁ।

মোবাইল ফোন নম্বর দিল সাদিক। বলল যে কোনো প্রয়োজনে তাকে যেন স্মরণ করি।

ভালো লাগল, অজানা অচেনা জনপদে তবু একজন আত্মীয়ের মতো পেয়ে গেলাম।

মহেশখালী দ্বীপটির পূর্ব প্রান্ত দিয়ে উত্তর দক্ষিণমুখে মহেশখালী চ্যানেলের সমান্তরালে রয়েছে সুদৃশ্য পর্বতমালা যার পাদদেশে সবুজ ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। এতেই ধারণা হয়, দ্বীপটি একসময় মূল ভূ-খণ্ডের সাথে যুক্ত ছিল।

দীর্ঘ জার্নিতে আমার ছেলে ও তার মা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবে অনেকদিন পর মেয়ের সাথে দেখা হয়ে ক্লান্তি ভুলে মিলনানন্দে মত্ত হয়ে আছে। আমি কিন্তু ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম। আগে বাজারটা ঘুরে-ফিরে দেখতে হবে।

খুব বড় কোনো বাজার নয়। বাজার ঘেঁষেই শতাব্দীর পুরোনো বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ বিহারের পাশেই বড় রাখাইনপাড়া। রাখাইনপাড়ার ঘরদোর সব পাকা দালানকোঠা। কুয়াকাটাসহ অন্যান্য জায়গায় দেখেছি রাখাইনরা মাটি থেকে সাত আট ফুট উঁচুতে মাচা তৈরি করে তার উপর ঘরদোর তৈরি করে। এখানে দেখলাম সব দালানকোঠা আর সবই মাটিতে। তবে তাদের ঘরের নির্মাণ পদ্ধতি আমাদের চেয়ে ভিন্নতর। বাজারে ঢুকতেই দেখা মিলল উপজেলা মাজিস্ট্রেট কোর্ট ভূমি অফিস ইত্যাদি। তার পাশেই গোরবঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাইস্কুল।

একটি ভাঙাচোরা গাড়িতে সারারাত ভ্রমণশেষে সুলতানা আর তূর্য একেবারে ক্লান্ত-শ্রান্ত। তারা আসার পর থেকে নড়াচড়াই করছে না! আমিও দুপুরে খেয়েদেয়ে খানিক ঘুমিয়েছিলাম। উঠে দেখি পাঁচটা বেজে গেছে। সুলতানাকে বললাম— বের হবে?

সে কৃত্রিম ধমকের সুরে বলল— রেস্ট কর। এত দীর্ঘ জার্নির পর রেস্ট না করলে শরীর টিকবে কেন?
আমি বললাম— ঘুমিয়ে থাকার জন্যে কী ভ্রমণে এসেছি? বলেই সন্ধ্যা ছ’টার দিকে আবার বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য উ বোদিয়ানা মহাথেরোর ডেরায়। বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে তাকে পাওয়া গেল না। তার বাসার ঠিকানা পেলাম কিন্তু বাসায় তিনি ব্যস্ত আছেন কিনা, এই সন্ধ্যেবেলায় যাওয়া ঠিক হবে কিনা ভেবে আর গেলাম না। ফিরে এসে আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে বসে সিগারেট জ্বালিয়ে দেখছি অজানা-অচেনা জনপদের নানান বেশের নানান মানুষ।

সমগ্রজীবন মানুষ দেখে দেখেই কাটিয়ে দিয়েছি। মানুষই আমার একমাত্র সাবজেক্ট। জীবনে যতটা না বই পড়েছি তার বহুগুণ পড়েছি মানুষ। মানুষের চেয়ে বিস্ময়কর কিছু কী আছে? কত প্রকারের মানুষ! কত জাতপাত! মানুষ পড়া কি অত সহজ? তবু জীবনব্যাপী মানুষের কাছেই যা কিছু শিক্ষা।

মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অস্তিত্ব ভাবা যায়? জ্ঞানীরা বলেন— মানুষের মাঝেই ঈশ্বরের বসবাস। সে মানুষকে পাঠ করা মোটেই সহজ কাজ নয়। সম্ভবত সে কারণেই লালন সাঁই বলেছেন—

মানুষ ছাড়া খ্যাপারে তুই মূল হারাবি,

মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।

সন্ধ্যে নেমে এসেছে ঘণ্টাখানেক আগে। যে স্থানটিতে বসে আছি তার একপাশে মহেশখালী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অপর পাশে লবণের খেত। দিনের আলোতে স্তূপকৃত লবণ দেখেছি এখন অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

একা একা বসে লালনের একটি গান গুনগুন করছি। দেখছি নানান বয়সের, নানান শ্রেণির মানুষ। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে তাদের মাতৃভাষায় কীসব যেন বলাবলি করছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। রাখাইন মেয়েরা লুঙ্গি আর থামি পরে যাচ্ছে। আমাকে দেখে কীসব কী বলে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে। আমি ভাবছি— আহা, তাদের ভাষা যদি বুঝতে পারতাম! ধীরে ধীরে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হচ্ছে, আমার সত্তাজুড়ে তখন ফেলে আসা যৌবনের মধুময় স্মৃতিকাতরতা। সহসা ছোট মেয়ের ফোন—

বাবা, বাইরে ঠাণ্ডা পড়েছে বাসায় এসো, ঘোরাঘুরির কাজ আবার কাল সকাল থেকে করবে। এখন বাসায় এসে বিশ্রাম নাও।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০২

গতকাল গাড়িতে থাকায় প্রাতঃভ্রমণ হয়নি। কিন্তু আজ খুব সকালে উঠে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে নামার বাজার পর্যন্ত চলে যাই। স্থানীয়রা বলেন লামার বাজার। এর অর্থ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা। তবে এখানে লামার বাজার মানে মূল বাজারের বাইরে নদীর দিকে বোঝানো হয়েছে। হেঁটে হেঁটে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে একেবারে ঘাটে চলে এসেছি। গতকাল স্পিডবোট থেকে এ ঘাটেই নেমেছিলাম।

এখানেই পরিচিত হলাম নাসির সাহেবের সাথে। নাসির সাহেব একজন গ্রাম্য ডাক্তার, নিজেকে পরিচয় দিলেন আরএমপি (রুরাল প্রাকটিশনার) ডাক্তার হিসেবে। তবে তার বাড়ি মহেশখালীতে নয়, তিনি এসেছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা থেকে। বৈবাহিকসূত্রে এখানে বসবাস করছেন। শুদ্ধ বাংলা বলতে পারেন। বললেন—

ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের কাছে মহেশখালী দ্বীপ একটি আকর্ষণীয় স্থান। এখানে দেখার জন্যে যা আছে তা দু’চার দিন দেখে তৃপ্তি মেটে না। থাকতে হয় কম হলেও ১০-১৫ দিন। নয়তো অতৃপ্তি নিয়েই ফিরতে হয়।
নাসির সাহেব বললেন— মহেশখালীতে আছে ঐতিহাসিক বৌদ্ধ মন্দির যা আনুমানিক প্রায় ২৮৩ বছর পূর্বে নির্মিত বলে জানা যায়। আছে আদিনাথ মন্দির যা পঞ্চদশ শতকে নির্মিত। এসব দেখেই আপনি আনন্দ পাবেন না। মূল আনন্দটা এসব জায়গায় দু’চারদিন না থাকলে হয় না।

নাসির সাহেব বয়স্ক মানুষ। ডায়াবেটিক পেশেন্ট। আলাপচারিতায় জানা গেল তার স্ত্রী
মহেশখালীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। একমাত্র মেয়ে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। বললেন— মৈনাক পর্বতের চূড়ায় আদিনাথের মন্দির, তার সামান্য দূরেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জাদির নামে আরেকটি নিদর্শন আছে।

বললাম— জাদির মানে কী?

হাসলেন নাসির সাহেব, বললেন— তা তো জানি না ভাই। ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। তবে সেখানে বৌদ্ধ রাখাইনদের নানান অনুষ্ঠান হয়।

তারপর হেসে বললেন— এ জন্যেই বলেছিলাম, এসব কি বাইরে থেকে দেখে জানা যায়? বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে হলে তাদের সংস্পর্শে বহুদিন থাকতে হয়।

বললাম— রাখাইন মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দির বলা হয় নাকি?

বললেন— কেউ কেউ বলেন।

বললাম, কেন?

নাসির সাহেব হাসলেন। বললেন— এসব মানুষের অতিরঞ্জন। ভেতরে আছে পেতলের মূর্তি আর বাইরে মন্দির হচ্ছে সোনালি রঙের। এতেই কি স্বর্ণমন্দির হয়ে গেল?

বললাম— তা ঠিক।

নাসির সাহেব বললেন— ভারতের স্বর্ণমন্দির দেখেছেন? যেটা অমৃতস্বরে?

বললাম— আমি ভেলোরের শক্তি আম্মার স্বর্ণমন্দির দেখেছি।

তিনি বললেন— দু’বছর আগে ঘুরতে যেয়ে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দেখে এসেছি। অসম্ভব সুন্দর সে মন্দির।

নাসির সাহেবকে যথেষ্ট গুণী এবং সমৃদ্ধ একজন মানুষ বলে মনে হলো। তিনি বড় রাখাইনপাড়া মন্দির সম্পর্কে অনেক কথাই বললেন। বললেন, ২০০৪ সালে মন্দিরটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে। ভেতরের বড় পিতলের মূর্তিটি ১০১ বছর আগের।

বললাম— আপনি তো বেশ জানেন দেখছি।

হেসে বললেন— বহু বছর এখানে আছি, এটুকু জানা কি খুব বেশি হয়ে গেল?

বললেন— মন্দিরের ভেতরে স্থির দাঁড়িয়ে যে মূর্তিটি তা কিন্তু সম্পূর্ণ একটি গাছকে খোদাই করে বানানো, বিরল এই মূর্তি আনুমানিক ১১২ বছর আগের। গাছের খোদাই করা আর কোনো বৌদ্ধমূর্তি বাংলাদেশে নেই।

নাসির সাহেব একজন ধার্মিক মানুষ, নামাজের দাগ পড়ে গেছে কপালে। কাঁচাপাকা শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখচ্ছবিতে নূরাণী ছাপ। কিন্তু ভেতরে পুরোদস্তুর মডারেট বলেই মনে হলো। তিনি আরএমপি ডাক্তার এমন পরিচয়ের সূত্র ধরে বললাম আমি নিজেও আরএমপি ডাক্তার হিসেবে অনেকদিন প্রাকটিস করেছি, এখন অবশ্য কিছুই করছি না। বেগম সাহেবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মেয়েরাও কর্মজীবী।
তিনি হেসে বললেন— তবে তো এক পথেরই পথিক। আমার স্ত্রীও শিক্ষক।

বললেন— গৌতম বুদ্ধ বৌদ্ধত্ব লাভের পর ০৭টি পুণ্যস্থানে ০৭ দিন করে ধ্যানরত ছিলেন। তিনি ৬ষ্ঠ সপ্তাহ অতিবাহিতকালে মন্দিরের ভেতরের মুং জা লিংদা নামক পুকুরে ধ্যানমগ্ন থাকাকালীন প্রবল ঝড় বৃষ্টি হয়। তখন নাগরাজ নিজ দেহকে আশ্রম তৈরি করে গৌতম বুদ্ধের মস্তকের উপর ফণা আকৃতি করে এক সপ্তাহব্যাপী অবস্থান করেছিলেন। এ থেকে গৌতম বুদ্ধের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর রাখাইনরা মুং জা লিংদা পুকুরে বর্ষাব্রত পালন করে।

গ্রাম ডাক্তার নাসির সাহেবের মাধ্যমে মহেশখালীর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন সম্প্রদায় এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে অনেক কিছুই জানলাম।

মূল জনস্রোতের সাথে মিশে রাখাইনরা শিক্ষা সংস্কৃতিতে একাত্ম হয়ে কাজ করছেন। জীবিকার জন্যে বেছে নিয়েছেন স্বর্ণকারের ব্যবসা, মহাজনী, মুদি, কাপড় বোনা, নানান ধরনের ব্যবসাপাতি। কিছু রাখাইনরা জেলের কাজও করেন। মহেশখালীর রাখাইন সম্প্রদায় মোটামুটি স্বচ্ছল বলেই জানালেন।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা তার বাসার সামনে চলে এসেছি। তাকে এত প্রশ্ন করায় তিনি কিন্তু বিরক্ত হচ্ছেন না। আমি নিজে অনেক বছর হাতুড়ে ডাক্তার হিসেবে প্রাকটিস করেছি। বললাম— নাসির সাহেব, আপনি গ্রাম ডাক্তার শুনে ভালো লাগছে কেন, জানেন? কেননা আমিও আরএমপি প্রাকটিশনার হিসেবে বহুদিন প্রাকটিস করেছি। এতে মানুষের জন্যে সেবার কাজটি খুব কাছে থেকে করা যায়।

বললেন— এখন প্রাকটিস নেই?

বললাম— না, এখন বাচ্চাদের একটি স্কুল চালাই। জীবনে কোনো কাজই স্থায়ীভাবে করা হয়নি। যৌবনের প্রারম্ভে কিছুদিন সীমান্ত বাহিনীতে ছিলাম, স্বেচ্ছায় চলে এসেছি। এখন বেগম সাহেবা স্কুলে শিক্ষকতা করেন, মেয়েরাও কর্মজীবী। নিজে এখন লেখালেখির কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

এবার তিনি হা হা করে হাসলেন, বললেন— তবে তো আপনি আমার ভাই। আমার বেগমও স্কুলশিক্ষক আর আমিও এক সময় আর্মিতে ছিলাম। বললেন— চলুন, নাস্তা না করে আর যেতে পারবেন না।

একরকম জোর করেই বাসায় নিয়ে গেলেন।

এবার আমার চোখ কপালে ওঠার দশা।

সামান্য একজন গ্রাম ডাক্তার নাসির। অথচ তার বাসায় এক সুবিশাল লাইব্রেরি। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখকদের সাহিত্য ছাড়াও রয়েছে বিশ্বসাহিত্যের নানান লেখকের কালেকশন। সন্দেহবশত বলেই বসলাম— আচ্ছা নাসির সাহেব, লেখালেখির কাজটা কত বছর ধরে করেন?

তিনি হেসে বললেন— ও কাজ আমার নয়, স্যার। অভ্যেসটি ঘরের মানুষের। এবার আলোয় বেরিয়ে এলেন সেই আলোকিত নারী। যার রয়েছে দু’টি গল্পগ্রন্থ। বিস্ময় তখনও শেষ হয়নি। হাতে তুলে দিলেন— তিনটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। বললেন— বই দু’টো কক্সবাজার থেকে ছাপিয়েছেন তবে উপন্যাস নিয়ে ঢাকায় যেতে চান।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, রাঙাবালী, তালতলীতে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন থাকলেও তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিল না। নাস্তা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে জানলাম— রাখাইন বিয়েতে পুরুষদের পণ দিতে হয়, ফলে সমাজে অবিবাহিত নারীর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে নানাবিধ সমস্যা যেমন: অসামাজিক কর্মকাণ্ড ও জন্মহার হ্রাস প্রভৃতি দেখা দিচ্ছে। রাখাইন সমাজে নারীপুরুষের সমান অধিকার। সম্পত্তিও পুরুষ-কন্যারা সমান সমান পায়।

কথায় কথায় প্রায় নয়টা বেজে গেল। ছোট মেয়ে সাইমার অফিস। সে ফোনে তাগিদ দিয়ে বলল— আদিনাথ মন্দিরে যাবে না? বেলা তো বেড়ে যাচ্ছে!

বললাম— এই তো মা, এখনই আসছি।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০৩

দাঁড়িয়ে আছি হিমালয়পুত্র বলে খ্যাত মৈনাক পর্বতের চূড়ায়। মৈনাক পর্বতমালা মহেশখালী দ্বীপের অলংকার। দ্বীপের অহংকারও বটে। মৈনাক পর্বত নিয়ে মিথ আছে। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণমতে মৈনাক হচ্ছে হিমালয়পুত্র। প্রাচীনকালে সকল পর্বতের নাকি পাখা ছিল। এই পাখায় ভর করে, তারা শূন্যপথে ভ্রমণ করত। কিন্তু কোথাও মাটিতে বসলে, এদের চাপে মানুষসহ অন্যান্য জীবজন্তু মৃত্যুবরণ করত। এই কারণে দেবতা ও ঋষিরা এই পর্বতদের কারণে সবসময় ভয়ে ভয়ে কাটাতেন। এর প্রতিকারের জন্য ইন্দ্র সকল পর্বতের পাখা কেটে দেওয়া শুরু করেন। মৈনাক তখন পবনদেবের সহায়তায় সাগরতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই কারণে, ইনি ইন্দ্রের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যান।

ঐতিহাসিক আদিনাথ মন্দির এখানেই। আদিনাথ মন্দিরের গল্প শুনে শুনে আজ যখন মন্দির দর্শনে রওনা হই। সুলতানা বলে যে সেও যাবে।

হেসে বললাম— তুমি তো ধার্মিক মানুষ, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম পড়ো। তোমার মন্দিরে যাওয়া কি ঠিক হবে?

সে বলল— তাতে কী? আমি তো আর পুজো দিতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে। দর্শনে পাপ নাই, পাপ হচ্ছে লালনে, বিশ্বাসে।

আমি অবশ্য ছেলেটিকেও সাথে আনতে চেয়েছিলাম, সে এল না। জানাল সে বোনের সাথে তার অফিস দেখতে যাবে। দু’বোনের আদুরে ভাই। অগত্যা আমরা দু’জন সকাল দশটায় চলে এলাম আদিনাথ মন্দির দেখতে।

আদিনাথ হচ্ছে বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত একটি হিন্দু মন্দির। মহেশখালী উপজেলা সদরের পাশেই মৈনাক পর্বতের চূড়ায় এর অবস্থান। পাহাড় বেয়ে মন্দিরে ওঠার জন্যে আধুনিক মানের সিঁড়ি নির্মাণ করা আছে।
আদিনাথ মন্দিরে ওঠার জন্যে যে সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছে সে সিঁড়ির গোড়ায় সিঁড়ি বরাবর নদীর দিকে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ব্রিজ। ব্রিজ ধরে আধা কিলোমিটার গিয়ে তবেই নদীর ঘাট। চমৎকার একটি জেটি রয়েছে ঘাটে। শেষ ফাল্গুনে পনেরোদিনব্যাপী মেলা হবে এখানে। তখন ভারত, চীন, নেপাল, ভুটান, ইন্দোনেশিয়াসহ দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পুণ্যার্থী কক্সবাজার হয়ে এ ঘাট দিয়ে মন্দিরে আসবে।

আজ কোনো পর্ব নেই। তাই লোকজনের তেমন ভিড়ও নেই। পর্যটকদের দলগুলো এখনও এসে পৌঁছায়নি। আমরা মন্দির দেখার জন্যে সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে উঠছি। দেখি একজন সাধু তরতর করে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছেন। সাধুর নাম জগদীশ। পরিধানে গেরুয়া রঙের কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। বড়, লম্বা চুলগুলো মাথার উপর চূড়ো করে বাঁধা। ভরপুর দাড়ি গোঁফে চোখ দুটো ছাড়া মুখমণ্ডলে তেমন কিছু দেখা যায় না। তবে চোখ দু’টো যেন জলন্ত দু’টি অগ্নিপিণ্ড কিন্তু শান্ত, স্নিগ্ধ। সাধুর দু’হাতের তালুতে দু’টি অচেনা ফুল দেখে কৌতূহল হলো। সুলতানাও হিন্দু ধর্মের কোনো সাধু সন্ত বা যোগীকে এই প্রথম দেখল। বলল— উনার সাথে কথা বলে দেখো তো, উনি এমন পোশাক কেন পরেছেন?

সাধুকে বললাম— ও বাবা, একটু কথা বলা যাবে?

তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, বললেন— জি। বলুন?

আমার স্ত্রী জানতে চাচ্ছেন— আপনি এই বেশ কেন ধরেছেন? আপনি কি সাধু?

বাবাজি হাসলেন। বললেন— তা তো জানিনে ভাই। সাধু হওয়া কি সহজ কথা। ঠাকুর দয়া না করলে কী সাধু হওয়ার উপায় আছে? বলেই ফুলসমেত দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে অদৃশ্যে থাকা ঠাকুরের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানালেন।
বললাম— সাধু বা যোগীদের সম্পর্কে একটু বলবেন? জানার খুবই আগ্রহ।

সাধু তেমন গ্রাহ্য করলেন না। তিনি চলে যেতে উদ্যত হলে সুলতানা আমার পরিচয় দিয়ে বললেন— ইনি একজন নামকরা লেখক। আপনাদের নিয়ে কিছু লিখতে চান। কিছু মনে না করে যদি বলতেন…।

সাধু বললেন— বসুন। তিনিও সিঁড়ির পাশে নির্মিত বেঞ্চিতে বসে পড়লেন। বললেন— সাধক যিনি, তিনিই সাধু। তবে এ বড় কঠিন পথ। ধর্মের পথে বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষু, যারা ভিক্ষা করে খায় আর মোক্ষলাভের জন্যে হিন্দুর মধ্যে যারা সংসার ত্যাগী সন্যাসী তারাই সাধু বা যোগী।

বললাম— লালন শাহ’র মাজারে সাদা পোশাকে অনেককে দেখেছি। তারাও নিজেদের একে অপরকে সাধু সম্বোধন করেন। তারা কোন ধর্মের বলতে পারেন?

এবার হাসলেন জগদীশ সাধু। তারপর নিজের বুকে আঙুল দিয়ে বললেন— আমার নাম জগদীশ। বললেন এটি ঠাকুরের একটি নাম। কিন্তু আমি তো পাপী, আমি কি সাধুর বেশে থাকলেও তা কি হতে পেরেছি? মোক্ষলাভ অত সহজ নয় ভাই, ঠাকুরের দয়া থাকতে হয়।

বলেই অদৃশ্যে জোড় হাত ঠেকালেন।

বললাম— আপনার হাতের ফুলদু’টো সম্পর্কে যদি বলতেন! এরকম ফুল জীবনে দেখেছি বলে মনে হয় না। একটু জানতে চাচ্ছিলাম।

তিনি বললেন— ওহ, এটি? এর নাম পারিজাত ফুল। এটি স্বর্গের ফুল। বাংলাদেশে একমাত্র এ মন্দিরের সামনেই একটি গাছ আছে।

বললাম— তা ফুল নিয়ে আপনি কোথায় চলেছেন?

হেসে বললেন— গঙ্গা মায়ের পুজো দেব ভাই।

মন্দিরে দেবেন না?

তিনি ঘাড় নির্দেশ করে মন্দিরের পাদদেশে ঘাটের দিকে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে বললেন— ঐদিকে গঙ্গা মা’র মন্দির আছে, ওখানেই পুজো দেব।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম— আদিনাথ মন্দিরটি কত বছরের পুরোনো, বলতে পারবেন?

তিনি বললেন— মন্দিরের সামনে পরিচিতি ফলকে সব লেখা আছে, সেখানেই সব জানতে পারবেন।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি। দীর্ঘ পথ, পা যেন আর চলছে না। বুক ভারী হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পথে পথে বসার জন্যে বেঞ্চি পাতা। তারই একটিতে দপ করে বসে পড়লাম।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার হাঁটা শুরু। উপরে গিয়ে দেখলাম মন্দিরের মূল চত্বরে প্রবেশের পথেই হাতের বাম দিকে পরিচিতি ফলক। কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তাতে লেখা আছে আদিনাথ মন্দিরের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০৪

আদিনাথ মন্দিরের ক্যাম্পাস। পাহাড়ি চড়াই পথের দীর্ঘ সিঁড়ি পেরিয়ে অবশেষে উঠে এলাম মন্দিরের চত্বরে। চেয়ে দেখি সুলতানার মুখখানা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। আর আমি যেন হাঁপরের মতো হাঁপাচ্ছি, কথাই বলতে পারছি না। মনে মনে বলছি, ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে…’ মুখে হেসে বলছি— আর হবে না?

সুলতানা জিজ্ঞাসু মুখে তাকালে বললাম— আর হবে না মানব যৌবন, আল্লাহ বলে ডাকো। কত বড় বড় পাহাড় ডিঙিয়েছি আর এতটুকুতে হাঁপিয়ে উঠলাম।

সে অভয় দিয়ে বলল— অনেক জায়গা। তাও তুমি বীরদর্পে উঠে এলে।

কিছু না বলে চারিদিকে তাকালাম। দেখি— প্রধান ফটক থেকে মন্দির পর্যন্ত লাল গালিচা পাতা। চত্বরে ঢুকেই বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি পরিচিতি ফলক আর ডানদিকে উন্মূক্ত মাঠ। ফলকের শিরোনাম লেখা ‘সংক্ষিপ্ত পরিচিতি’ কিন্ত পড়তে গিয়ে গলদঘর্ম হওয়ার জোগাড়।

কী আর করার, তবু পড়তে তো হবেই। ফলকে লেখা আছে যে, আদিনাথ মন্দিরের বর্তমান কাঠামো তৈরি করা হয়েছে খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে। কিন্তু তারও হাজার হাজার বছর পূর্বে ত্রেতাযুগে মন্দিরটির গোড়াপত্তন হয়। একথার একটি ঐতিহাসিক সত্যতাও আছে বলে লেখা রয়েছে। প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, রামায়ণ, বিভিন্ন পুরাণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা।

সনাতন ধর্মের লোকজন মনে করেন আদিনাথ জ্ঞানময়, কল্যাণময়, চিরসত্য, শাশ্বত , সনাতন। তিনি ব্যক্ত চরাচরে অব্যক্ত ভগবান তাই সনাতন জনগন মাত্রই শিবভক্ত, শিব উপাসক। মোক্ষ লাভের ও মনোস্কামনা পূরণের জন্যে সনাতন ধর্মের লোকজন এখানে পুজো দিতে আসেন।

আদিনাথ কি কোনো ব্যক্তির নাম? তিনি কে ছিলেন? এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব কেউ দিতে পারছেন না। তবে খোঁজখবর নিয়ে যতদূর জানা যায় তা হচ্ছে, আদিনাথ একটি পৌরাণিক চরিত্র। হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ পুরাণে আদিনাথ চরিত্রটির উল্লেখ আছে। জৈনদের মতানুসারে আদিনাথ হচ্ছে প্রথম ঈশ্বর বা কাল—চক্রার্ধের প্রথম তীর্থঙ্কর। আর সনাতন মতে মহাপ্রভু শিবই হচ্ছেন আদিনাথ।

হিন্দু পুরাণমতে আদিনাথের গোড়াপত্তন ত্রেতাযুগে রাম-রাবণের যুদ্ধের সময়। রামায়ণে উল্লেখ আছে, রাবণ লঙ্কা যুদ্ধে রামের সঙ্গে জয়লাভের জন্য মহাদেবের কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করেন। মহাদেব তখন কৈলাসে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। তিনি রাবণকে এ শর্তে বর দেন যে শিবরূপী উর্ধ্বমুখী শিবলিঙ্গ কে কৈলাস থেকে লঙ্কায় নিতে হবে কিন্তু পথে কোথাও রাখা যাবে না। রাখলে মহাদেব সেখানেই অবস্থান নেবেন এবং রাবণের অভীষ্ট সাধন হবে না।

শর্তানুসারে রাবণ শিবলিঙ্গ বহন করে লঙ্কার উদ্দেশ্য গমন করেন তবে পথিমধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে বর্তমান মহেশখালীর মৈনাক পর্বতে থামতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে শর্তানুসারে রাবণ শিবলিঙ্গ পুনরায় উঠাতে ব্যর্থ হন এবং মহাদেব এই মৈনাক শিখরেই অবস্থান গ্রহণ করেন। সেই থেকে এখানে এই আদিনাথ মন্দির বা শিবমন্দির।

মন্দিরের পথে সাধুর হাতে পারিজাত নামের দু’টি অচেনা ফুল দেখেছিলাম, সাধু বলেছিলেন ওগুলো স্বর্গের ফুল। মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে দেখি সগৌরবে সেই ফুলগাছটি দণ্ডায়মান। বহু বছরের পুরোনো গাছটির মগডালে চড়ে একজন মানুষ হাতে বালতি নিয়ে ফুল সংগ্রহ করছেন। আমরা ভক্তিসহকারে গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি একটি ফেস্টুনে লেখা— ‘ইহা স্বর্গীয় পারিজাত ফুলের গাছ, গাছের গায়ে হাত দিয়ে কেউ ইহার পবিত্রতা নষ্ট করবেন না।’

আমি সেখানে দাঁড়িয়ে গাছটির কয়েকটি ছবি তুললাম। আমার মনে হলো এরকম বৃক্ষ আমি ঢাকার কার্জন হলের সামনে বা অন্য কোথাও দেখেছি।

সুলতানা বলল— কী ভাবছ? চল পেছনটা একটু ঘুরে দেখে আসি।

বললাম— চল।

সেখানে গিয়ে দেখা গেল আরেকটি অচেনা ফুলগাছ। গাছটির ডালে ডালে ছোট্ট কাপড়ের ফিতায় ভক্তরা তাদের মনস্কামনা লিখে বেঁধে রেখে আসেন। তারপর যখন তার কার্যসিদ্ধি হয় তখন এসে আদিনাথে পুজো দেন।

আমিও একটি ফিতে বেঁধে দিলাম। সুলতানা বলল— কী লিখে বাঁধলে?

বললাম— আবার যদি জন্মাই, তোমারেই যেন পাই।

একথায় সে বলল— কখনো না, তোমার মতো বাউণ্ডুলে আর ছন্নছাড়ার সাথে…। বলে হেসে একেবারে কুটিকুটি। তার হাসি দেখে মনে মনে ভাবলাম— আহা, কত সহজেই এই নারী জাতিকে সন্তুষ্ট রাখা যায়!

আমরা মন্দিরের চারপাশ ঘুরে দেখছি আর ছবি তুলছি। মন্দিরের পেছনে জোড়া পুকুর। সাগর থেকে এত উঁচুতে পুকুর দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। লোকেরা বলে চারিদিকে সাগরের লোনাজল কিন্তু ঠাকুরের কৃপায় এত উঁচুতে এই পুকুর দু’টিতে কখনও মিষ্টিজলের অভাব হয় না। এই পুকুরে শতশত মানুষ তার মনস্কামনা পুরনে ডুবদিয়ে স্নান করে থাকে।

মন্দিরের আঙিনা ঘুরে এসে আবারও পারিজাত ফুল গাছটির সামনে দাঁড়ালাম— গাছটির নিচে পরপর তিনটি ঘরে নানান দেব-দেবতার প্রতিমা আছে। দেখলাম ইতোমধ্যে পুণ্যার্থীদের আগমন ঘটে গেছে। তাদেরই কেউ কেউ পুজো দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

ফুল গাছটির নিচে এক সাধুকে দেখা গেল। এ সাধু একদম খালি গায়ে। তিনি নানান ফুলে পুজোর আয়োজন করেছেন। খালি গায়ে সাধুর কোমরে গোঁজা একটি মোবাইল সেট। সে মোবাইল ফোন থেকে তারস্বরে মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছে। ডিজিটাল পুজো দেখে মনে মনে পুলকিত হলাম। সাধুর চারিদিকে নানান মানুষ ঘোরাফেরা করছে আমি গোপনে ভিডিও করছি কিন্তু সেসব দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তিনি নিবিষ্টচিত্ত হয়ে পূজার কাজে মগ্ন হয়ে আছেন।

সাধুর কাছ থেকে আবারও মন্দিরের পরিচিতি ফলকের সামনে দাঁড়ালাম। আমাকে আবারও গভীর মনোযোগে মন্দিরের পরিচিতি ফলক পড়তে দেখে সুলতানা বলল এখানে যেসব কাহিনী লেখা আছে তা কি তুমি বিশ্বাস করো?

তার কথায় হাসলাম। বললাম— আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে আদিনাথের কিছু যায় আসে না। ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই এই ভক্তবৃন্দেরও। প্রকৃতির সন্তান মানুষ, এ মানুষ সকল অবস্থায় অসহায়। এইসব অসহায় মানুষের অন্তরে মুক্তির দূত হিসেবে জেগে আছে আদিনাথ। মানুষের মৃত্যু আছে, আদিনাথের মৃত্যু নেই।

সে বলল— মানুষের বলছ কেন? বল হিন্দুদের।

বললাম— তারা কি মানুষ নয়? তাদের অন্তরের এ বিশ্বাস হাজার বছর ধরে পরম্পরায় চলে এসেছে। তোমার মনের মধ্যে যেমন পীর-পয়গম্বরের প্রতি বিশ্বাস, আউলিয়ার দরবারে ছুটে যাওয়ার বিশ্বাস। এদেরও তেমনই আদিনাথে ছুটে আসার বিশ্বাস। ভারতবর্ষের মানুষ এই একটি জায়গায় একাত্ম। এখানে এসে কোনো যুক্তি, দর্শন কিংবা বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কার পথ খুঁজে পায় না।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০৫

ফাল্গুন মাস, তেমন শীতও নেই, গরমও নেই। এ সময়ে পাহাড়ি ঝরনাগুলো মৃতবৎ বেঁচে থাকে, সবুজ অরণ্যও হয়ে ওঠে তামাটে রঙের। ভ্রমণে প্রাণভরে প্রকৃতি দর্শনের জন্যে উপযুক্ত সময় হচ্ছে শরৎকাল। আর বর্ষাকাল হলে তো কথাই নেই। বর্ষায় বাংলা প্রকৃতির একেবারে উপচেপড়া যৌবন, উচ্ছ্বসিত প্রগলভতা। বর্ষার জলে অরণ্যে থাকে বুনোফুলের সমাহার। তখন তার মৌ মৌ গন্ধে হাজারো প্রজাপতির ভিড়, গাঢ় সবুজাভ পাহাড় থেকে তখন আর দৃষ্টি ফেরানো যায় না। পাহাড়ের বুক চিরে বাঁধ ভাঙা ঝরনার কলতানে তখন আমারও যেন বাঁধ ভেঙে যায়। তবে ঝড়-ঝঞ্ঝার কারণে সমুদ্রে ভ্রমণ তখন একেবারেই নিরাপদ নয়।

সুলতানার ইচ্ছে ছিল বান্দরবানের নীলগিরি, নীলাচল দেখবে। শঙ্খ নদী দেখবে, পাহাড়ি ঝরনা দেখবে। বলেছিলাম— পাহাড়ে যাব বর্ষাকালে। পাহাড়ের রূপ-রস এখন পাওয়া যাবে না, সে এখন বুড়িয়ে গেছে, ঘুমিয়ে আছে। এবারের ভ্রমণে তাই পাহাড়, অরণ্যকে বাদ দিয়ে দেখতে চলেছি সেন্টমার্টিন দ্বীপে। পথে যেতে যেতে দেখে চলেছি দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় উপকূল এবং তার দূরবর্তী দ্বীপ-দ্বীপান্তর।
মূলত সাগর কিংবা নদীপথে ভ্রমণ এই বসন্তকালেই ঢের নিরাপদ। নদী-সমুদ্র তখন শান্ত, স্নিগ্ধ। নদীপথে ভ্রমণবিলাসী মানুষদের জন্যে তাই বছরের এই মাস একটা উপযুক্ত সময়। কিন্তু কে জানত যে দ্বীপান্তরের এই মহেশখালীতেও আছে এমন অনিন্দ্য সুন্দর পর্বতমালা! এ দ্বীপে ঘুরতে এসে তাই মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেয়ে গেলাম।

এই বসন্তবেলায় দেখতে দেখতে মৈনাকের চূড়ায় আদিনাথ মন্দিরের আঙিনায়ও ভ্রমণপিপাসু নানান বয়সী মানুষের ভিড় জমে গেল। সকাল দশটায় যখন মন্দির প্রাঙ্গণে এসেছিলাম তখনও তেমন লোকজন ছিল না অথচ ঘণ্টাখানেকের ব্যবধানে এখন লোকে একেবারে লোকারণ্য।

আদিনাথ মন্দির চত্বর থেকে বেরিয়ে দেখি পাহাড়ের চূড়ার দিকে আঁকাবাঁকা সিঁড়ি দিয়ে আরেকটি সর্পিল পথ উপরের দিকে উঠে গেছে। সবাই বলছে ওখানে বৌদ্ধদের একটি মন্দির আছে। আসলে মন্দির নয়, সেটি একটি জাদি। হেঁটে হেঁটে সুলতানা একেবারে ক্লান্ত, বলল— তুমি গিয়ে দেখে এসো, আমি পারব না।
তার হাত ধরে বললাম— মহেশখালী জীবনে দ্বিতীয়বার কি আসতে পারবে? কষ্ট হলেও চলো, আমার হাত ধরে এগুতে থাকো।

নিচ থেকে অনুমান করতে পারিনি যে মৈনাক পর্বতের চূড়া এতটা উঁচুতে। উঠতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাধ্য হয়ে অর্ধেক পথে উঠে সুলতানাকে বললাম এখানে একটু বস। সেও যেন আর পারছিল না। একেবারে ধপ করে বসে পড়ল। আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি মহেশখালী মৈনাক পর্বতের অনিন্দ্য সুন্দর রূপমাধুর্য। মৈনাক শুধু একটি পর্বত নয়, মৈনাক হচ্ছে পর্বতমালা। মহেশখালী দ্বীপের উত্তর থেকে দক্ষিণে অর্থাৎ গোরবঘাটা থেকে কয়েক মাইল দূরে শাপলাপুর পর্যন্ত নদীকে ডানে রেখে সমান্তরাল এই পর্বতমালা।

পাহাড়ের একপাশে বিস্তীর্ণ ম্যানগ্রোভ বনভূমি তারপর নদী, নদীর ওপার চকরিয়া থানা। পাহাড়ের অন্যপাশে মাঝে মাঝেই নজরে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানের বরজ। মহেশখালীর মিষ্টি পানের চাষ।
আমাদের সামনে দিয়ে অল্প বয়েসী ছেলে-মেয়েরা দুষ্টুমি করতে করতে তরতর করে উঠে যাচ্ছে। কেউবা প্রেমিকার হাত ধরে মনের আনন্দে নেমে আসছে ফিরতি পথে। উপরের দিকে তাকিয়ে বিষম খাই। ওরে বাব্বাহ এতটা উপরে!

সুলতানা শ্রান্ত দেহে রিল্যাক্স মুডে বসে আছে, তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। ছোট-খাটো মানুষ, তবু বয়সের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। মনে মনে বলি— আহা, সময়! যখন খাগড়াছড়ি কিংবা বান্দরবানে চাকরি করেছি তখন নিয়মিত পাহাড় অতিক্রম করতে হতো। কী নিরুদ্বেগ আর নির্দ্বিধায় উঠে যেতাম সেসব পাহাড়ে! আর আজ? আজ এই মৈনাকের চূড়ায় উঠতেই এতটা কষ্ট! কষ্ট কেন হবে না? বুকের ভেতরে বাসা বেঁধেছে নানান ব্যাধি-ঘাতক ব্যাধি। আজকাল এসব ভাবনা বড় বেশি তাড়িত করে।

সুলতানা তখনও একমনে বসে আছে। তার পেছনে বসে আমি আবৃত্তি করছি—

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি, বছরের পার—

তখন হঠাৎ যদি মেঠোপথে পাই আমি তোমারে আবার!

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে

সরু-সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের,

ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!

জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার—

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!

পর্বতের চূড়ায় উঠে অবশেষে বৌদ্ধ জাদি’র সমুখে যখন দাঁড়াই তখন সূর্য একেবারে মাথার উপর। ফাল্গুনের নাতিশীতোষ্ণ সকাল পেরিয়ে দুপুরের গনগনে তাপে সবাই অস্থির। তবু জাদি’র চারপাশে নানান রকম ছবি তুলে ফিরতিপথে দেখি বেশ ক’জন হুজুর পাহাড় বেয়ে উঠছেন। বোধকরি কোনো মাদ্রাসার শিক্ষক-মোহাদ্দেস হবেন। মুখোমুখি হতেই হেসে বললাম— শোকর আলহামদুলিল্লাহ, আর কোনো ভয় নেই। তাদের একজন লক্ষ্য করে বললেন— কীসের ভয়?

হেসে বললাম— দোজখের ভয়?

বললেন— মানে?

বললাম— আমরা তো আম মুসলমান। না বুঝে ঘোরাঘুরি করতে এসে মন্দির, জাদি এসব দেখছি, এসব দেখে পাপ হচ্ছে না? কিন্তু আপনাদের মতো খাস মুসলমানরাও যখন এসেছেন তাতে কিছুটা আশ্বস্ত হচ্ছি যে এগুলো দেখতে এসে খু্ব বেশি পাপ হয়তো করিনি।

হাসলেন তারা, কিছুই বললেন না।

ফের বললাম— একই পাহাড়ে একটা মসজিদ থাকলে আরও ভালো হতো। হুজুররা ফের আমার দিকে তাকালেন।
বললাম— হিন্দুদের মন্দির, বৌদ্ধদের জাদি আর মুসলমানদের মসজিদে প্রার্থনা করে নেমে যেতাম। আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সাড়া দিতেন।

এবার হুজুররা খুব সরু চোখে তাকালেন, মুখে কিছুই বললেন না। বুঝলাম শেষ কথাটি তাদের ভালো লাগেনি। না লাগুক, থোড়াই কেয়ার করি। ধর্ম আমার কাছে এমনই। যার যা খুশি একটা মানলেই হলো। না মানলেই সমস্যা।

নিচে নেমে দেখি পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড়। তৃষ্ণায় কণ্ঠ শুকিয়ে কাঠ হওয়ার জোগাড়। মন্দিরে ওঠার পথেই অনেক দোকানে ডাব বিক্রি হচ্ছে। সুন্দর ব্যবস্থা, মন্দিরের ভগবান দর্শনে তৃষ্ণাকাতর মানুষরা পকেটের পয়সায় ডাব খাবেন এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সুযোগ বুঝে দ্বিগুণ দামে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ডাব। আমরাও কিনে খেয়ে নিলাম।

অনেকে আবার চড়া দামে কিনে পাহাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছেন ভগবানকে দিতে। ভগবান যদিও এসব কিছুই খাবেন না তবু ভক্তের দানে তিনি তুষ্ট হবেন। এই আকিদায় ভর করে চলছে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাস।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০৬

মহেশখালীতে এসেছি আজ নিয়ে তিনদিন। গত দু’দিনে চিনে নিয়েছি বাজার-ঘাট, দুধওয়ালার দোকান, ফার্মেসি, চা পানের আড্ডাখানা আর একটি বইয়ের দোকান। ডাক্তারের পরামর্শে ভাত খাওয়া নিষেধ। দুবেলা রুটি খাই আর এক কাপ করে চার বেলা নিয়ম করে গরুর দুগ্ধ পান করতে হয়। সুতরাং দুধের আর ওষুধের দোকানটাই আগে। মহেশখালী উপজেলা যে সকল দ্বীপ নিয়ে গঠিত তার মধ্যে মহেশখালী, মাতারবাড়ি আর সোনাদিয়া দ্বীপ বিখ্যাত। সোনাদিয়া দ্বীপের সুখ্যাতি বহুকাল যাবৎ আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। আমার শৈশবে চট্টগ্রামে বসবাসকারী আমার এক গ্রাম্য ভাইয়ের কাছে সোনাদিয়া দ্বীপের গল্প শুনেছিলাম।
সোনাদিয়া দ্বীপ জেলেদের মাছ শিকারের জন্যে বিখ্যাত। তেমনি জেলে পরিবারের পুরুষটি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে যখন মাছ ধরার জন্যে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার আয়োজন করে তখন তার প্রণয়িনী তাকে বিরহের যে গান গেয়ে বিদায় দেন তা অনেকটা এ রকম—

স্ত্রী : তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু মাছ মারিবার লাই…

স্বামী : শাড়ি চুড়ি হানোর বালি আনুম তোঁয়ার লাই…

স্ত্রী : নো লাইবো শাড়ি চুড়ি, নো লাইবো হানোর বালি

বোষের হালে নো যাইও ফালাই…

এসব কারণে মহেশখালী এসে নাগাদ সোনাদিয়া আর কুতুবদিয়া দ্বীপে যাওয়ার নানান উপায় খুঁজে চলছিলাম।
লাইব্রেরিয়ানের নাম সহিদ, পড়ুয়া ছেলে। আঠারো-বিশ বছর বয়েসী ছেলেটির বাড়ি মহেশখালীর গোরকঘাটায়। আমাকে সে খুব খাতির করল। বলল— সোনাদিয়া গেলে বলবেন ওখানে আমাদের মাছের গদি আছে। বলে দেব আপনাকে সসম্মানে সবকিছু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাবে।

সহিদই জানাল— সেনাদিয়া দ্বীপে যেতে হলে প্রথমে গোরকঘাটা থেকে সিএনজিতে করে ঘটিভাঙ্গা যেতে হবে। ওখান থেকে একটি নদী পার হতে হয় যা জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভরশীল। জোয়ারের সময় আধা ঘণ্টা হাঁটতে হয়। তবে ভাটার সময় নদী শুকিয়ে গেলে কম হলেও দেড় ঘণ্টার পথ। তাছাড়া নৌপথেও ব্যবস্থা আছে। মহেশখালীর গোরকঘাটা থেকে বোট রিজার্ভ করেও যাওয়া যায়। আসা-যাওয়ার ভাড়া দু’হাজারের মতো।

সিদ্ধান্ত নিলাম দু’একদিন পরে হাঁটা পথেই যাব। যদিও শরীর একদম সায় দেয় না তবু মনকে শক্ত করলাম— ঘুরতে যখন এসেছি কোনো কিছুতে দমে গেলে চলবে না।

লাইব্রেরিটি মহেশখালী আদর্শ স্কুলের সামনে। এই লাইব্রেরির খানিক দূরেই একটি চা দোকান। এখানে এসেই রোজ সকাল সন্ধ্যায় চা ইত্যাদি খাই। স্থানীয়দের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটাই। এখানেই পরিচিত হলাম মহেশখালীর কবি শামীম ইকবালের সাথে। শামীম ইকবাল মহেশখালী আদর্শ হাই স্কুলের শিক্ষক।

সকালে হাঁটতে নেমেই আরএমপি ডাক্তার নাসির আর কবি শামীম সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গেল। তারা দু’জন জোড়া বেঁধে হাঁটেন। শামীম শাহেব বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন কিন্তু দু’জনেই শিল্প-সাহিত্যের মানুষ। তাদের সাথে বাংলা সাহিত্যের নানান বিষয়ে কথা হলো। কবি শামীম তার কবিতা পড়ে শোনালেন।
আমরা রাখাইনপাড়া দিয়ে বাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছি। ছোট ছোট রাখাইন শিশুরা এই সকালবেলায়ই খেলাধুলায় মেতে উঠেছে। একদল ভিক্ষু আমাদের পাশ কাটিয়ে লাইন ধরে বিহারের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় তখনও দোকান-পাট তেমন খোলেনি। গোরকঘাটা হাই স্কুলের সামনে একটিমাত্র চা দোকান। দোকানের সামান্য দূরেই সিএনজি স্ট্যান্ড। দেখলাম আমাকে দেখেই তারা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে—
বদরখালি… বদরখালি…।

দোকানী একজন রাখাইন। তিনি চলে এসেছেন। পানির ছিটামিটা দিয়ে গ্যাসের উপর চা বসিয়ে দিয়েছেন। কাস্টমার হিসেবে বেশির ভাগই সিএনজি আর অটোওয়ালা। তাদের মধ্যে পরিচিত একজন এসে সালাম দিয়ে বলল— কেমন আছেন মামা? কেমন দেখলেন মহেশখালী দ্বীপ?

প্রথমে চিনতে পারলাম না কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো আরে, এ তো সেই অটোওয়ালা! প্রথমদিন ঘাট থেকে যার অটোতে এসেছিলাম। যার মামাবাড়ি ঝালকাঠিতে। যার বাবা লবণের খেপে গিয়ে তার মাকে ঝালকাঠি থেকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন।

বললাম— আরে ভাগ্নে সাদিক মিয়া না? তা তুমি কেমন আছ?

সাদিক চট্টগ্রাম আর বরিশালের ভাষার সংমিশ্রণে বলল যে তার মা অসুস্থ। তবে আমাদের কথা মার কাছে বলায় তিনি আমাদের তার বাসায় যেতে বলেছেন।

চা খেতে খেতে নানান বিষয়ে কথা হলো। ডাক্তার সাহেব, কবি শামীম আর ভাগ্নে সাদিকের কাছে জানলাম মহেশখালী দ্বীপের নানান গল্প, নানান উপকথা। কথা বলতে বলতে আটটা বেজে গেল। বাসার জন্যে রুটি-ভাজি নিতে হবে। বিল মিটিয়ে উঠে যেতে চাইলে কোনোক্রমেই তা পারা গেল না। সাদিক বলল— তা হবে না মামা। তাহলে ভাগ্নের ইজ্জত থাকবে না।

সাদিকের আন্তরিকতায় মনে হলো, সত্যি সত্যি সে যেন আমার ভাগ্নে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় যেতে যেতে ভাবলাম এই তো বাংলার চিরায়ত রীতি। এই তো বাঙালির সংস্কৃতি। কক্সবাজারের দূরবর্তী দ্বীপ এই মহেশখালীতেও যে বাংলার অতিথিবৎসল একদল মানুষের বসবাস তা এই সাদিকই প্রমাণ করে দিল।

বাসায় ফিরে সুলতানাকে বললাম— নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে নাও। বোধিঞাণা ভন্তের ওখানে যাব।

ভন্তের কথা শুনে তারও খুব আগ্রহ হলো।

বোধিঞাণার সাথে এটাই প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি রাখাইন জাতির একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু, ধর্মীয় জ্ঞানসাধনায় তিনি একজন মহাথের। মহাথের তাদের ধর্মীয় সম্মানসূচক ডিগ্রি। পুরো নাম উ বোধিঞাণা মহাথের। আমি বলি বোধিঞাণা। তিনি মহেশখালী বৌদ্ধ বিহারের ভন্তে। ভন্তে হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের একজন সম্মানিত ব্যক্তি যিনি থেরবাদে বিশ্বাসী। ‘থেরবাদ’ মূলত পালি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে প্রাচীনপন্থী সম্প্রদায়।
এই ভন্তে জন্মসূত্রে মহেশখালীর মানুষ। তিনি আমার এক পুরোনো রাখাইন বন্ধু তালতলী’র অং থানের সম্পর্কে বিয়াই হন। অংথানের বোন নিয়েছেন এই ভন্তের বড় ভাই। ভন্তের সাথে অংথানের মাধ্যমেই পরিচয়।
সপরিবারে আমরা যখন মহেশখালী বড় রাখাইনপাড়ার ভন্তের বড়িতে যাই তখন সন্ধ্যা আসন্নপ্রায়। আমার ধারণা ছিল তিনি তাদের ধর্মশালায় বসবাস করছেন। কিন্তু তার বাড়িতে ঢুকে রীতিমতো অবাকই হলাম। দ্বোতালা বিল্ডিংয়ের বেশ বড়সড় বাড়ি। বাড়ির সামনে খোলামেলা লন। সামনে-পেছনে অনেকখানি জায়গাজুড়ে নানান জাতের ফুল ও ফলের বাগান।

ভন্তে বোধিঞাণা নিজেই এই বাগানের পরিচর্যা করেন। আমরা বাড়িতে ঢুকে বৈঠকখানায় অল্প সময় বসতেই তিনি দেখা দিলেন। তাকে দেখামাত্র শ্রদ্ধায় নত হলাম আমি। আমার কল্পনার চেয়েও অসম্ভব সুন্দর একজন মানুষ। ভিক্ষুদের গেরুয়া পোশাক পরিহিত গৌর বর্ণের এক জ্যোতির্ময় পুরুষ ভন্তে উ বোধিঞাণা মহাথের।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০৭

ফাল্গুন মাস। ভন্তে বোধিঞাণা’র বৈঠকখানায় ঢুকতে ঢুকতেই তার বাগানের কোন এক বৃক্ষশাখায় তীব্র অথচ ভীষণ মধুর কণ্ঠে কোকিলের ডাক শোনা গেল। আমাদের আসন পেতে দিলে তাতে বসতে বসতে দেখি সন্ধ্যা আসন্ন প্রায়। অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজে ট্রে হাতে বের হয়ে এলেন। কিছু ফল এবং পেঁপের সরবত দিয়ে চমৎকারভাবে সাজানো একটি ট্রে। সামনের টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন— নিন, ফলগুলো সবই নিজের গাছের।

গ্লাসের সরবত দেখিয়ে বললেন— নিজ গাছের পেঁপে দিয়ে বানানো, খেয়ে দেখুন।

আমরা সরবত নিতে নিতে বললাম— এত বড় বিশাল বাগান, এত বড় বাড়ি! কে এসবের পরিচর্যা করেন?
হাসলেন ভন্তে, বললেন— সব নিজেকেই করতে হয়। তেমন কোনো কাজ তো নেই, সব ছেড়েছুড়ে এখন এই নির্জনে বসে এসব নিয়েই সময় কাটাই। কথা বলি ফুলের সাথে, প্রজাপতির সাথে। তাদের সৌন্দর্য দেখি, পাখিদের গান শুনি। গাছের বেড়ে ওঠা দেখি। এসবের একটি নেশা আছে, যারা এসব করে তারা বোঝে।

বললাম— আরে বাহ, আপনি তো তাহলে একজন সুখী মানুষ!

হাসলেন ভন্তে, বললেন— তা মন্দ বলেননি। সুখ ভাবলে সুখ, অসুখ ভাবলে অসুখ। ফের আমাকে বললেন— আপনিও কম কীসে? এই যে সপরিবারে দ্বীপ দ্বীপান্তর ঘুরে বেড়াচ্ছেন চিত্তে সুখ না থাকলে এসব কি সম্ভব?

বললাম— একদম ঠিক বলেছেন মান্যবর। চিত্তের সুখের জন্যই তো ধার-কর্জে হলেও দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়াই।
ভন্তে নিজেকে ইঙ্গিত করে বললেন— তবে অধমের বিষয়টি একটু ভিন্ন। সংসার যাকে বিসর্জন দিয়েছে তাকেও তো কিছু একটা নিয়ে সময় কাটাতে হয়!

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেল। আজ পূর্ণিমা। নাস্তা-পানি শেষে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সুলতানাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ভন্তেকে নিয়ে বসে গেলাম। বন্ধু অং থানের মাধ্যমে ফোনে ফোনে আগেই যোগাযোগ ছিল, ভন্তের সাথে নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনা হবে ধর্ম-দর্শন, সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে। তিনি সময় দেবেন বলে সম্মত হয়েছেন। এ আলোচনা হবে একান্তে, নিভৃতে।
আজ ফাল্গুনী পূর্ণিমা, পূর্ণিমার আলোয় তার বাগানবাড়ি একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের একটি ধর্মীয় পার্বণও বটে। বুদ্ধের স্মরণে এ উৎসব পালিত হয়। বৌদ্ধরা বলেন ‘জ্ঞাতিমিলন পূর্ণিমা’ বা ‘জ্ঞাতি সম্মেলন তিথি’।

বৈঠকখানায় আমাকে বসিয়ে রেখে ভন্তে কিছুক্ষণের জন্যে ভেতরে গেলেন। কোনো প্রার্থনা সারতে গেলেন কিনা কে জানে। বললেন— একটু বসুন।

তিনি ভেতরে গেলে আমি তার বৈঠকখানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। আহামরি কোনো সাজগোজ নেই, আসবাবপত্র একেবারেই সেকেলে আর সাদামাটা টাইপের। কেবল একদিকের একটি বিশাল আলমারিতে ঠাসা রয়েছে নানান বিষয়ের অসংখ্য বই আর ইংরেজি ও বর্মী ভাষার কিছু পত্রিকা। সামনে পুরোনো আমলের একসেট চেয়ার-টেবিল। তারই অদূরে একটি আরাম কেদারা। এটিতেই ভন্তে বসেন। এই সামান্য আসবাবেই বৈঠকখানাটি এক অসামান্য সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সন্ধ্যে সাতটা। বাইরে আকাশে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ, বৈঠকখানার ভেতরে তার আলো এসে পড়েছে। আমি বারান্দায় নেমে আসি। চারিদিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত মোহাবিষ্টতা পেয়ে বসে আমাকে। এক অপার্থিব পরিবেশ। ঘরের মধ্যে বাতি জ্বলছে কিন্তু আমার মন চাচ্ছে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে চাঁদের আলোতে বসি।

সামান্য সময় পরেই বোধিঞাণা চলে এলেন। বললেন, দুঃখিত আপনাকে একা বসিয়ে রেখেছি। দেখলাম বৌদ্ধ ধর্মসাধক এই ভন্তে দেখতেই শুধু সুপুরুষ নন, তার ব্যক্তিগত আচরণেও আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট।

আলাপচারিতায় ভন্তে নিজে থেকেই জানালেন তার বায়োগ্রাফি। টেকনাফের বিখ্যাত জমিদার মং চ হ্লা চৌধুরী’র সন্তান তিনি। ছয় ভাই আর এক বোনের মধ্যে বোধিঞাণাই সর্বকনিষ্ঠ। বোধিঞাণা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স শেষ করে এবি ব্যাংকের অফিসার হিসেবে কিছুদিন কাজ করে গ্রিন কার্ড নিয়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। বুয়েট থেকে পাস করা তার দু’ভাই আগে থেকেই আমেরিকাতে ছিলেন। কিন্তু আমেরিকার বিলাসবহুল জীবনও ভন্তেকে আটকে রাখতে পারেনি। তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে এসে ভিক্ষুর জীবন গ্রহণ করেন।

আমি মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম— এত বড় পরিবারের সন্তান হয়েও সংসার জীবন ত্যাগ করে সন্ন্যাস যাপন কি চাট্টিখানি কথা!

বললেন— তারপর কী খাবেন? চা চলবে?

হাসলাম, বললাম— পেটের ক্ষিধে তো খানিক আগে পূর্ণ হলো। তাছাড়া খেতে তো আসিনি, এসেছি মনের ক্ষুধা মেটাতে।

ভন্তে এবার যেন একেবারে সংকুচিত হয়ে গেলেন, বললেন— আমি ক্ষুদ্র মানুষ, আপনার সামনে আমার কীইবা বলার আছে। আমি কতটুকুইবা জানি।

বললাম— না না, সে হচ্ছে না। আজ শুধু আপনার কথাই শুনব। তিনি আমার দিকে স-সংকোচে তাকালেন। বললাম— জ্ঞাতিমিলন পূর্ণিমা সম্পর্কে বলুন।

এবার তিনি সিরিয়াস হয়ে উঠলেন। নড়েচড়ে বসে বললেন— এগুলো সবই বইপুস্তকের কথা। বললাম, তাই শুনব।

তিনি বললেন— মহামতি সিদ্ধার্থ যখন বুদ্ধত্ব লাভ করেন তারপর বুদ্ধের সাথে অনেকদিন পিতা-স্ত্রী-সন্তানসহ জ্ঞাতিদের দেখা হয়নি। পিতা শুদ্ধধনও পুত্রমুখ দর্শনে উদ্গ্রীব ছিলেন। রাজা শুদ্ধধন বুদ্ধের নিকট দূত পাঠান। কিন্তু যাকেই পাঠান তিনিই বুদ্ধবাণীতে আত্মহারা হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বুদ্ধের নিকটই থেকে যায়। রাজা হতাশ হন, অবশেষে কালুদায়ি নামে সিদ্ধার্থের এক বাল্যবন্ধুকে প্রেরণ করেন।
তার নিকট পিতার মানসিক অবস্থার কথা শুনে বুদ্ধ যেতে সম্মত হন এবং একদিন কপিলাবস্তুতে গিয়ে পরিবারবর্গের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে তিনি পিতা শুদ্ধধন, স্ত্রী যশোধরা ও পুত্র রাহুলসহ অন্যদের শ্রামণ্যধর্মে দীক্ষা দেন। সে দিনটি ছিল ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন। তাই এ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ।

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা অতিক্রম করে রাত গভীর হতে থাকল। কথা আর ফুরায় না। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, সমকালীন রাজনীতি নানান বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের এক চলমান উইকিপিডিয়া মহৎ মানুষটি। তাকে ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছিল না। তবু বাসায় তো ফিরতে হবে।

বললাম— মনের ক্ষুধা আরও বেড়ে গেল, ভন্তে।

তিনি জিভ কেটে বললেন— ছি, অমন বলবেন না, বরং আপনার কাছ থেকে অনেককিছুই জানলাম।

অনেক রাতে তার কাছে বিদায় নিলে তিনি অনেকটা পথ এগিয়ে দেন। বলেন— মহেশখালী যে ক’দিন আছেন একবার করে আসবেন।

তার বাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। মনে হলো ভন্তে কী এক যাদুমন্ত্রে আমার মাথার উপর থেকে সকল বিভ্রান্তি সরিয়ে দিয়েছেন। মনে মনে ভাবছি এমন কেন হলো? তখন হঠাৎ মনে পড়ল ধর্ম কী এ সম্পর্কে ভন্তের কাছে জানতে একবাক্যে জানতে চেয়েছিলাম।
তিনি বলেছিলেন— ধর্ম কোনো আচার-অনুষ্ঠানে নয়। ধর্ম হচ্ছে মানবতা, ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টিপ্রেম।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-০৮

দাঁড়িয়ে আছি মহেশখালী লঞ্চঘাটে। কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চ যাবে কুতুবদিয়া দ্বীপে। এ ঘাটে ভিড়বে সকাল ন’টায়। দু’দিন আগে কক্সবাজার থেকে আমরা এসে এ ঘাটেই নেমেছিলাম। এই সকালবেলাও শত মানুষের ভিড়ে লঞ্চঘাট একেবারে মুখরিত। মিনিটে মিনিটে স্পিডবোট এসে লাগছে, আবার ছেড়েও যাচ্ছে। কম করে হলেও শ’খানেক বোট ঘাটে বাঁধা আছে। ঘাটের সামান্য উজানে জেলেদের অনেকগুলো অলস বোট নোঙর করে রাখা। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি তার পাশেই একটি খালি চেয়ার। ধারণা হচ্ছে, ঘাটে কোনো ইজারাদার অথবা কোনো সম্মানীয় লোকের আগমন ঘটলে তাদের জন্যে চেয়ারের ব্যবস্থা।

ঘাটের একটু উপর দিকে পাশাপাশি কয়েকটি পানের দোকান। সেখানে নানান পদের মশলাপাতিযোগে নান্দনিকভাবে পান সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এগুলো মহেশখালীর পর্যটকদের স্বাগতম জানানোর জন্যে। দোকানীরা বেশ রসিকও। নিজেরা পান চিবিয়ে ঠোঁট যেমন লাল করে আগন্তুকদের দেখাচ্ছে তেমনি শেফালী ঘোষের বিখ্যাত গানটিতে মাঝে মধ্যেই সুর দিয়ে শোনাচ্ছে—

যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম…

যদি নয়া একখান মুখ পাইতাম…

মহেশখাইল্যা পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম…

এসেছি ঘণ্টাখানেক আগে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা একেবারে ব্যথা হয়ে গেছে। বাসা থেকে নিষেধ করে বলেছিল— অনেক হয়েছে, এবার দু’দিন রেস্ট কর। বড় মেয়ে এসে পৌঁছালে তিন-চারদিনের জন্যে আবার টেকনাফ, সেন্টমার্টিন কোথায় কোথায় যাবে…।

কিন্তু আমি কী তাদের কথা শোনবার লোক? না জীবনে কখনও শুনেছি? এই মহেশখালী, মাতারবাড়ি কিংবা কুতুবদিয়া, সোনাদিয়া আর কি আসার ভাগ্য হবে? জরা-ব্যাধি শরীরকে কাবু করে নিচ্ছে, হার্ট-কিডনি অকেজো। দিনে দিনে দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। এমনি করে যেদিন ঈশ্বরপ্রদত্ত চোখ দু’টো চিরতরে নিথর হয়ে যাবে সেদিন আর কী কিছু দেখা যাবে? তখন কি সাহিত্যিক শরৎবাবুর মতো ঈশ্বরের সৃষ্টি দেখে বলতে পারব—

‘ভগবান! এই চোখ-দুটি যেমন তুমিই দিয়াছিলে, আজ তুমিই তাহাদের সার্থক করিলে। এতদিন ধরিয়া তো সংসারে সর্বত্র চোখ মেলিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু তোমার এই সৃষ্টির তুলনা তো কখনও দেখিতে পাই নাই।’

অতএব তাদের কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশেই বয়স্কা এক হিন্দু মহিলা এক ভদ্রলোকের সাথে চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা-বার্তা বলছেন। দু’জনই বয়স্ক মানুষ, তবে চেহারা আর চালচলনে সম্ভ্রান্ত বলেই মনে হলো।

ভদ্রলোক নিজে থেকেই এগিয়ে এলেন। বললেন— অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, চেয়ারটাতে বসুন। তিনিও বয়স্ক মানুষ। বললাম— না না আপনিই বসুন।

ভদ্রলোক কণ্ঠে আন্তরিকতা এনে বললেন— না না, আপনি মহেশখালী’র মেহমান। আপনিই বসুন।

বুঝলাম, পর্যটক দেখে দেখে এরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাই মানুষ দেখলেই বুঝতে পারেন— কে স্থানীয়, কে বহিরাগত। আর আচরণে এমন ভদ্রতায় আমিও যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। মুগ্ধতা নিয়ে তার সাথে আলাপচারিতায় জানা গেল, ভদ্রলোকের বাড়ি এই গোরকঘাটায়, সাথের মহিলা তার আপন বোন। বোনের শ্বশুরবাড়ি কুতুবদিয়া। আমাকে বললেন— কুতুবদিয়ায় যাচ্ছেন?

বললাম— হ্যাঁ, ওখানে একদিন থাকব।

বললেন— সমস্যা নেই, ওখানে আমার বোনের বাড়ি। সাথের মহিলাকে দেখিয়ে বললেন— ও বেড়াতে এসেছিল। এখন বাড়ি যাচ্ছে।

আমাদের কথা-বার্তার মধ্যেই কথিত লঞ্চখানা চলে এল। এটাকে লঞ্চ না বলে বোট বলাই শ্রেয়। কেননা এর চেহারা এবং আকৃতি একেবারেই মাছ ধরা বোটের মতো। কাঠের নির্মিত বোট, বোটের উপরেও কাঠের তৈরি ছই। ছইয়ের উপর প্রশস্ত পাটাতন, লোকে বলে আপার। ছইয়ের নিচে খোলের ভেতর নুয়ে নুয়ে ঢুকতে হয়। ভেতরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। পথের যাত্রী ছাড়া কুতুবদিয়ার যাত্রীরা পুরো চারঘণ্টা শুয়ে-বসে কাটিয়ে তবে গন্তব্যে পৌঁছাবে। ছইয়ের উপরেও আসন পেতে বসার আয়োজন আছে।

বোট দেখে মনটা একেবারে দমে গেল। সাকুল্যে ৫০-৬০ জন যাত্রীর ব্যবস্থা। চার ঘণ্টা জার্নি, কোনো বাথরুমের ব্যবস্থাও নেই। তবু যেতে তো হবেই। সুতরাং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দ্রুত বোটে উঠে বসার জন্যে স্থান খুঁজতে থাকলাম। দেখি বোটের ভেতর থেকে এক তরুণী বেরিয়ে এসে আমার সাথে বোটে ওঠা ভদ্রমহিলার হাত ধরে তাকে নিয়ে বোটের ভেতরে চলে গেল। আমি পেছন দিকে চলে গেলাম। যেখানটায় বোটের চালক হাল ধরে বসে আছেন তার পাশে খানিকটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে সেখানেই বসে গেলাম।
খানিক পরেই মেয়েটি বোটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এবং ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের উদ্দেশে হাত নাড়তে লাগল। বোট ইতোমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে।

ভদ্রলোক হাত নেড়ে বলছেন— পরশু দিনই চলে আসিস।

তরুণী বলল— আচ্ছা, চিন্তা কোরো না বাবা।

বুঝলাম ঘাটে পরিচিত হওয়া ভদ্রলোকের মেয়ে এই তরুণী। সে তার পিসিমা’র বাড়ি যাচ্ছে।
মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে বোটের গলুইয়ের দিকে, আমি পেছনে। তার খোলা চুল নদীর মুক্ত বাতাসে উড়ে এসে নাকে-মুখে পড়ছে। মেয়েটির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম। চোখাচোখি হতেই হাত নেড়ে কী যেন বলল। ইঞ্জিনের শব্দে বুঝতে পারলাম না। ছইয়ের উপর অনেক মানুষ তাদের ডিঙিয়ে মেয়েটির কাছে চলে গেলাম।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি। কাছে গিয়ে অবাকই হলাম। মেয়েটি যেমন লম্বা তেমনি সুশ্রীও। তাকে দেখে আপনি-তুমির একটা দোটানায় পড়ে গেলাম। শেষে দ্বিধা নিয়েই বললাম— তুমি আমাকে কিছু বলেছ?

বলল— হ্যাঁ, আমার পিসিমা আপনার কথা বলেছেন। বললেন আপনিও নাকি কুতুবদিয়ায় যাবেন?

খুবই আন্তরিক প্রশ্ন, বলার ধরনটাও সহজ-সরল। আমাকে অবাক করল তার বাচন ভঙ্গি। মনে হলো মহেশখালীতে জন্ম হলেও মেয়েটির প্রমিত উচ্চারণে কথা বলার এই দক্ষতা অর্জনে যথেষ্ট প্রাকটিস করতে হয়েছে। বলার ধরনে ব্যক্তিত্বের আভাসও স্পষ্ট। বললাম— তুমি করে বলছি, কিছু মনে করনি তো?
মুক্তোদানার মতো দাঁত বের করে সংযত হাসি হাসল মেয়েটি। বলল— অবশ্যই আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন। ঘাটে দাঁড়ানো মানুষটি আমার বাবা। আপনি তো তারই বয়েসী।

বললাম— তুমি কক্সবাজার থেকে এসেছ?

সে বুঝতে পেরে আমার দ্বিধা কাটানোর জন্যে বলল— জ্বী আমি ওখানেই থাকি, চাকরি করি সেভ দ্য চিলড্রেন-এ। ছুটিতে আছি তাই পিসিমার বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি।

বোট মহেশখালী চ্যানেল দিয়ে উত্তর দিকে এগিয়ে চলছে। হাতের বামে মহেশখালীর চোখ ধাঁধানো সবুজ বন, মৈনাক পর্বতমালা। ডান দিকে চকরিয়া এলাকার সবুজ বনানী। দু’চারটে গাঙচিল আমাদের সাথে উড়ে চলেছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট মাছের ঝাঁক। দু’একটি পানকৌড়ি। নদীর জল স্বচ্ছ নীল। নিস্তরঙ্গ, স্রোতহীন অথৈ জলধি। এক অপার্থিব আনন্দে তন্ময় হয়ে আছি আমি।

যাত্রীরা ইতোমধ্যে যে যার মতো করে আসন পেতে বসে পড়েছেন। কেউ কেউ চাদর বিছিয়ে শুয়ে ঘুমের আয়োজনে ব্যস্ত। এরা সবাই এপথের নিয়মিত যাত্রী। বোধকরি আমি একাই আগন্তুক। যাত্রীরা জনে জনে আলাপচারিতায় ব্যস্ত কেবল আমিই ঈশ্বর প্রদত্ত দু’চোখ মেলে তারই সৃষ্টির দিকে অবাক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।

দ্বীপান্তরের পথে-০৯

কুতুবদিয়া আঁরো বাড়ি পরি নো যাইও

যাইবার সমত আঁরো ঘাডত সাম্পান ভিড়াইও।

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুতুবদিয়া দ্বীপের এটি একটি জনপ্রিয় গান। হ্যাঁ, যাচ্ছি সেই মনোহরি দ্বীপ, সমুদ্রকন্যা কুতুবদিয়া উপজেলায়।

দ্বীপটি মহেশখালী থেকে খুব বেশি যে দূরে এমন নয়। সড়কপথে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। কিন্তু মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সাগরের ভেতরে এ দ্বীপে যাতায়াত অনেকটাই দুর্গম। কেননা পশ্চিম দিকে কুতুবদিয়া নদী আর বাকি তিন দিকে সমুদ্রবেষ্টিত এ দ্বীপের সাথে কোনো দিক থেকেই সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চটিই ভরসা। অথচ ঢিমেতালে চলা বোটসদৃশ এই লঞ্চ পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় লাগতে পারে অন্তত ঘণ্টা চারেক। লঞ্চটি মহেশখালী ছেড়েছে সকাল নয়টায় হিসাবানুযায়ী দ্বীপে নোঙর করতে করতে দুপুর একটা বেজে যাবে।

যদিও কুতুবদিয়া দ্বীপে যাওয়ার আরও একটি রুট আছে। দেশের যেকোনো স্থান থেকে যেতে হবে চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলা সদরে। সেখান থেকে পেকুয়া হয়ে কুতুবদিয়া চ্যানেলের মগনামা ঘাট। এ ঘাট থেকে স্পিডবোট অথবা গামবোট পাওয়া যায়। স্পিডবোটে দশ মিনিটের মতো আর গামবোটে ত্রিশ মিনিট। তার অর্থ দাঁড়ায় কুতুবদিয়া চ্যানেল বা নদীটি পদ্মার মতোই চওড়া। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এ নদীর স্রোতের গভীরতা আর তীব্রতা পদ্মার চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর, আরও বিপজ্জনক। শীতকালে যদিও বোট পারাপার সম্ভব কিন্তু বর্ষার মৌসুমে লঞ্চটিই একমাত্র ভরসা।

মাছধরা বোটসদৃশ লঞ্চটির মধ্যে এই দীর্ঘ সময় একা কাটানো বিরক্তিকর এবং এক ধরনের বিড়ম্বনাও বটে। তবু নদীর অপার সৌন্দর্য আর নিঃস্বর্গ আমাকে সেই বিড়ম্বনা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিয়েছে। যতদূর দৃষ্টি যায় গাঢ় নীল জলরাশি। ফাগুনের মেঘমুক্ত আকাশ তাতে লুকোচুরি খেলছে। নদীর একপারে মহেশখালী দ্বীপ অন্যদিকে দূরে দৃশ্যমান হচ্ছে চকরিয়া থানার অংশবিশেষ।

মহেশখালী নদীটির মোহনা কক্সবাজারের কাছাকাছি। সেখানে নদী এতটাই চওড়া যে সমুদ্র ভেবে ভুল হতে পারে। এখানে চারিদিকে তাকালে কেবলই অগাধ জলরাশি। তখন শুধুই কবি জসীম উদ্‌দীনের লেখা কালজয়ী গানটির কথা মনে পড়ে যায়— নদীর কূল নাই, কিনার নাইরে…।

তবে নদীপথে আমরা যতটা এগিয়ে যাচ্ছি ততই ছোট হয়ে আসছে নদী। ছোট হতে হতে ডৌয়াতলী, বদরখালী বা উজানদিয়ার দিকে অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গেছে।

যাত্রীরা ইতোমধ্যে আসন পেতে যার যার মতো গুছিয়ে নিয়েছে সংসার। সংসারই তো, দো পলকা দুনিয়ামে এক পলকা জীয়ন। পথের শেষে ভেঙে যাবে খেলাঘর, পড়ে থাকবে পদচিহ্ন। এই কয়েকঘণ্টা সফরের মতো পৃথিবীর সবাই তো পথিক, সবাই মুসাফির। কিন্তু সবাই কি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে? আবার পৌঁছালেও তার পথ কি শেষ হয়ে যায়?

আজ লঞ্চটিতে যারা যাচ্ছে তাদের পথ কি ফুরাবে? আমি নিবিষ্ট হয়ে এসব ভাবছি আর দেখছি যাত্রীদের ঘরকন্নার রকমারি চিত্র। তাদের ভাষা যেমন বৈচিত্র্যময় চেহারায়ও তদ্রূপ ব্যতিক্রম। অনেকটাই আমাদের বরিশাল অঞ্চলের মানুষের মতো।

ছোটবেলা যখন দোতলা লঞ্চের ডেকযাত্রী হয়ে ঢাকা যেতাম তখন দেখতাম যাত্রীদের এক রাতের পাতা সংসারে গেরস্থালির চিত্র। কম তো নয়, সে ছিল প্রায় আঠারো-বিশ ঘণ্টার ভ্রমণ। দুপুর থেকেই আয়োজন। পটুয়াখালী বা বরিশাল ঘাটে গিয়ে কমপক্ষে বিকেল চারটের সময় আসন বিছিয়ে শুয়ে বসে থাকা। অতঃপর পরের দিন সকাল আটটা-নয়টায় দেখা মিলত ঢাকা সদরঘাটের। এই সময়টুকুর জন্যে চাদর বিছানো শুয়ে-বসে থাকার সে জায়গাটুকুর মালিক তো যাত্রীরাই!

অনেক যাত্রীই বাড়ি থেকে ভাত-তরকারি রান্না করে নিয়ে আসত। লঞ্চের হোটেলেও খাবার ব্যবস্থা ছিল, এখনও আছে কিন্তু বড্ড চড়া দাম। সে লঞ্চে সপরিবারে যাতায়াত করত কেউ কেউ। তখন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মা হয়তো খাবার বণ্টনে বসেছেন বাবা গেছেন পানি বা লবণ আনতে। কত যাত্রীর বিছানা মাড়িয়ে, কতজনকে ধাক্কা দিয়ে কতজনের বিশ্রী গালাগাল শুনে তবেই না লবণ কিংবা পানির ব্যবস্থা। পরিবারের জন্যে এটুকু তো সহ্য করতেই হয়, এর নামই তো সংসার। সংসার করা কী এতই সহজ!

আজ কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা এখানের এই ছোট্ট লঞ্চটিতেও চার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাবে। এ সময়ের জন্যে মোটামুটি সংসারই তো। এই দীর্ঘ সময়ও যাত্রীরা যার যার মতো গুছিয়ে নিয়েছে তাদের গেরস্থালি। যারা সিঙ্গেল যাত্রী তাদের মধ্যে কেউ কেউ মোবাইলে চ্যাটিং করছে, কেউবা ইউটিউব দেখছে। সবার হাতে তো এন্ড্রয়েড নেই, তাই সেকেলে মোবাইলে কেউ কেউ অডিও গানে মত্ত। আর আমার মতো আগন্তুকরা নতুন জনপদের প্রকৃতিক সৌন্দর্যে নিমগ্ন।

ক’টি গাঙচিল আমাদের পিছু পিছু আসছে। কতদূর এগিয়ে পানিতে গিয়ে বসছে আবার পেছনে সরে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই দেখা মিলছে পানকৌড়ির। ইতস্তত বিচ্ছিন্ন দু’একটি মাছধরা নৌকা অথবা বড় সাইজের ফিশিং বোট।

এমুহূর্তে বামদিকের সবুজ ম্যানগ্রোভ বন ফুরিয়ে গেছে, অদৃশ্য হয়েছে পর্বতমালাও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা বেজে গেছে। আমার পাশেই মহেশখালীর সে মেয়েটি নিবিষ্ট চিত্ত হয়ে এন্ড্রয়েড নিয়ে বসে আছে। আমি মাঝে মধ্যে এন্ড্রয়েড দিয়ে কখনও নদীর, কখনও পানকৌড়ি বা অন্য কিছুর ছবি তুলছি, ভিডিও করছি। দু’একবার তীর্যক দৃষ্টিতে দেখে নিচ্ছি মেয়েটিকে। অসাধারণ সুন্দর একখানি মুখ। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। আহা, পারিজাত ফুলের মতো যেন নিষ্পাপ একটি স্বর্গীয় পুষ্প। মেয়েটির বয়স অনুমানের চেষ্টা করলাম। মনে হলো চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না। আলাপ করতে মন চাইল কিন্তু আমাদের আলোচনার তেমন কোনো বিষয় যেন খুঁজে না পেয়ে আপন মনেই বললাম— বাপরে বাপ! চার ঘণ্টা কি এমনি এমনি এভাবে বসে থাকা যায়?

এবার মেয়েটিও যেন কথা খুঁজে পেল। সে বলল— ঠিকই বলেছেন। আসার সময় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ নামের একটা বই হাতে নিয়েও তাড়াহুড়ো করে টেবিলে রেখে এসেছি। আহা আনলে সেটি অন্তত পড়ে শেষ করতে পারতাম!

বললাম— এটা তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস। তুমি এ জাতীয় বই পুস্তক পড় নাকি?

সুন্দর করে হাসল মেয়েটি। বলল— হ্যাঁ, আমার কাকা’র খুব বড় লাইব্রেরি আছে। পারিবারিক কালেকশন। ছোটবেলা থেকে তার লাইব্রেরির বই পড়ে পড়ে একেবারে বইপোকা হয়ে গেছি।

অসম্ভব গুছিয়ে কথা বলা মেয়েটির সাথে আলাপচারিতায় জানলাম তার নাম সোমা দাশ। বাবার নাম দুলাল দাশ। বাবা মহেশখালীর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার কাকার নাম দীলিপ দাশ। মহেশখালী উপজেলার কম্যুনিস্ট পার্টির সভাপতি তিনি।

বললাম— তোমরা তো তাহলে প্রগতির লাইনের লোক।

মেয়েটি আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল— প্রগতি ছাড়া পৃথিবী কি এগুতে পারে? আজকের সভ্যতা কি প্রগতির উপর নির্ভরশীল নয়?

বললাম— বাহ্, তোমার দৃষ্টিভঙ্গি আমাকে মুগ্ধ করেছে।

তারপর বললাম— বই পড়তে চাও? আমার সাথে একটি বই আছে। পড়বে নাকি?

মেয়েটি অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। অতঃপর বলল— বই তো এখন তেমন কেউ পড়েন না। বহন করা তো দূরের কথা। থাকলে দিন।

বললাম— আমার কাছে আছে। বলেই ‘বিবর্ণ পাণ্ডুলিপি’ নামে আমার একখানা উপন্যাস ব্যাগ থেকে বের করে দিলাম। সোমা আগ্রহভরেই নিল। নিয়েই ডুবে গেল বইটির মধ্যে। কিছুক্ষণ পর বইয়ের পাতা থেকে মুগ্ধ-বিস্মিত চোখ তুলে বলল— বইটি কি আপনার নিজের লেখা? আপনি একজন লেখক?

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-১০

আমার লেখক পরিচয় পেয়ে সোমা দাশের চোখেমুখে খুশির জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ল। অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তবে তেমন কোনো আলোচনা না করেই ফের ডুবে গেল বইয়ের পাতায়।
আমারও কথা ফুরিয়ে গেল। অনেকক্ষণ তবু তার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে মনে মনে ভাবলাম— মেয়েটির বোধহয় আমার মতো বুড়োর সাথে কথা বলার আগ্রহ নেই। অগত্যা তার কাছ থেকে সরে এসে নদীর সৌন্দর্যে মন দিলাম।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি শুয়ে বসে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ নড়েচড়ে বসল। সামনে তাকিয়ে দেখি বোট একটি বন্দরে ঘাট দেওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে। একজন খালাসী আমাকে সরিয়ে পাকানো কাছি ছুড়ে দিল ঘাটের দিকে। দেখলাম ঘাটে দাঁড়ানো এব যুবক একটি গাছের গুড়ির সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল বোট। ঘাটের দোকানপাটের সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম বদরখালী।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজনের ওঠানামা দেখছি। তাদের চাটগাঁইয়া ভাষায় কথোপকথন শুনে বেশ আনন্দও পাচ্ছি। ঘাটের চেঁচামেচি, চিৎকার, লোকজনের ওঠানামার ফাঁকে চেয়ে দেখি সোমা হাত ইশারায় আমাকে কাছে ডাকছে। কাছে যেতেই বলল— চলুন, নাস্তা সেরে আসি।

বললাম— কীভাবে, কোথায়?

সোমা বলল— অনেকদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি তো। পিসিমা’র কাছে মা তাই আমার জন্যে পিঠা বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

বললাম— না না, আমি খেয়ে আসছি।

সে বলল, চলুন তো। ফ্লাক্সে গরম গরম চাও পাবেন। বলেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল।

লোকজন সরিয়ে, মাথা নিচু করে একেবারে কুঁজো হয়ে তার পিসিমার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বোট ফের ছেড়ে দিল।

সোমা এতক্ষণ আমার সাথে কথা না বলে কেন চুপচাপ ছিল তা এবার বাঁধভাঙা স্রোতের মতো কলকল করে বের হতে লাগল। বইটি ইতোমধ্যে সে অনেকটাই পড়ে ফেলেছে। বলল— আমি মোটামুটি বইপোকা। পিসিমাও বই পড়েন। পাঠক হিসেবে বলব— বহুদিন এমন ভালো কোনো উপন্যাস পড়া হয়নি।

তারপর আমাকে দেখিয়ে তার পিসিমাকে বলল— উনি খুব বড় মাপের একজন লেখক। তার পিসিমা সসম্মানে আসন পেতে দিয়ে পিঠা বের করে দিলেন। বললেন— সোমা কিন্তু ভালো সঙ্গীতও করে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে সে খুব ভালো।

বললাম— তাই নাকি! তবে তো আমার সৌভাগ্য বলতে হবে যে সোমার মতো একজন গুণী মানুষের সাথে আমার পরিচয় হলো।

পিসিমা বললেন— সোমা উদীচী’র সাধারণ সম্পাদকও।

চা খেয়ে, গল্প করে আবার আমরা খোলা ছাদে চলে এলাম। বোট তখন বদরখালী ব্রিজ অতিক্রম করছিল। ব্রিজ দেখিয়ে সোমা বলল— বছর পাঁচেক আগে এ ব্রিজটি দিয়ে মহেশখালী দ্বীপ চকরিয়া মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে। দেখলাম এখানে নদীটি একেবারে সরু হয়ে আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে গেছে। নদীর দু’পারেই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে লবণের চাষ। বসতবাড়ি খুব একটা নজরে পড়ছে না।
আমার মনে হলো এটি পুরোপুরি চরাঞ্চল। নদীর মধ্যে জেগে ওঠা এসব চর এখনও বাড়িঘরের উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠেনি। মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে শুধুই লবণের খেত। লবণ চাষিরা মাঠে মাঠে কাজে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে বালির ঢিবির মতো ধবধবে সাদা লবণের স্তূপ। কোথাও কোথাও লবণের বোট নোঙর করে তাতে লবণ বোঝাই করার কাজ চলছে। কাঁচা লবণ নিয়ে এসব বোট চলে যাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সেখানে রিফাইন করে তবেই নানান ব্রান্ডের লবণ।

খোলা আকাশের নিচে সোমা আর আমি নানান বিষয়ে কথা বলে চলেছি। সোমার মুখে গল্প শুনছি এ অঞ্চলের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে। মহেশখালী আর কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে। তেইশ চব্বিশ বছরের মেয়েটির কথা বলার দক্ষতা আর জীবনমুখী অভিজ্ঞতায় আমি বারবার মুগ্ধ হচ্ছি।

দেখতে দেখতে আমাদের বোট মাতারবাড়ি, উজানদিয়া প্রভৃতি ঘাট পেছনে ফেলে কুতুবদিয়া চ্যানেল দিয়ে এগিয়ে চলছে। সোমা বলল— আমরা কুতুবদিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছি। সোমার সাথে ফোন নম্বর লেনদেন করলাম। ফেসবুকে কানেক্ট হয়ে গেলাম। এখন ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত।

সে বলল— কিছু মনে না করলে আপনার সাথে ভ্রমণের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আমি ক্যামেরাবন্দি করতে চাই। সোমা তার ক্যামেরা দিয়ে পাশাপাশি বসে আমাদের কয়েকটি যুগলবন্দি ছবি তুলে নিল। বলল— ফেসবুকে আপলোড দিয়ে দেব, সেখান থেকে আপনি পেয়ে যাবেন।

দেখতে দেখতে কুতুবদিয়া ঘাটে নোঙর করলে সোমা বলল— আপনি এ ঘাটেই নামবেন কিন্তু আমরা নামব পরের ঘাটে। এরপর বলল— আপনার সাথে দেখা হলো কিন্তু মনে একটা আফসোস থেকেই গেল।
বললাম— কী আফসোস?

সে বলল— বইটি পুরোপুরি পড়তে পারলাম না।

আমি বইটিতে অটোগ্রাফ দিয়ে তার হাতে তুলে দিলাম।

সোমা বলল— মেসেঞ্জারে আমার ঠিকানা দিয়ে রাখব। আপনার উপন্যাসগুলো পাঠিয়ে দেবেন, আমি যথাযথ মূল্য দিয়েই কিনতে চাই।

হেসে বললাম— আগে এটি শেষ কর, ভালো লাগলে পাঠানো যাবে।

আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই বিদায় আসন্ন হয়ে উঠল। লোকজন ঘাটে নামার জন্যে তাড়াহুড়ো করছে। আমাকেও নামতে হবে কিন্তু আমার ভেতরে যেন স্বজন বিচ্ছেদের আসন্ন বিরহব্যথা মুচড়ে উঠছে। হাত নেড়ে সোমার পিসিকে বললাম আসি।

সোমা বলল— আপনাকে আমি একটা প্রণাম করতে চাই, বলেই নিচু হয়ে আমাকে প্রণাম করে ফেলল। আমার ভেতরটা তখন যেন ভেঙে যাওয়ার জোগাড়। মনে মনে বললাম— তুমি বেঁচে থাকো, দীর্ঘজীবী হও, আলোকিত হও। মুখে বললাম— যাই।

ঘাটে নেমে এলে সে হাত নেড়ে বিদায় জানাল। দূর থেকে মনে হলো এ বালিকার অন্তর যেন প্রিয়জন বিদায় বিরহের ঢেউয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছে। আমারও মনে হতে লাগল মাত্র কয়েক ঘণ্টায় অচেনা অজানা মেয়েটি যেন আমার হৃদয়ের পুরোটা আসন দখল করে নিয়েছে।

লঞ্চ ছেড়ে দিচ্ছে, দেখি বিরহ ব্যথায় কাতর বালিকার দু’টো চোখ আমার দিকে তখনও নির্নিমেষ তাকিয়ে। আমি আর তাকাতে পারলাম না। তাদের দিকে পেছন ফিরে অচেনা পথে হাঁটতে হাঁটতে টিস্যু পেপারে চোখের জল মুছলাম। চশমার কাচ পরিষ্কার করলাম। অতঃপর কুতুবদিয়ার মাটি কপালে ঠেকিয়ে মনে মনে বললাম— আমি ধন্য হে বঙ্গজননী, তোমার কোলে জন্মেছি বলে চারিদিকে এত এত মায়ার হাতছানি।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-১১

চারিদিকে পানিবেষ্টিত দ্বীপটিতে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র সাড়ে বারোটা। যে লঞ্চটিতে এসেছি সেটি আগামীকাল সকাল আটটায় ছেড়ে যাবে। রাত্রিযাপন করতে হলে থাকতে হবে ঘোড়াঘাট নামক স্থানে হোটেল সমুদ্রবিলাসে। কিন্তু তাতে একদিন সময় নষ্ট হয়ে যায়।

মনে মনে অঙ্ক মিলিয়ে নিলাম— বিকেল পাঁচটার মধ্যে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হয়ে মগনামা ঘাটে পৌঁছাতে হবে। শুনেছি ওপারে পেকুয়ার মগনামা ঘাট থেকে চকরিয়া হয়ে মহেশখালীর গাড়ি পাওয়া যাবে। সুতরাং দেরি না করে এই সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় দ্বীপটিকে যতটা সম্ভব দেখে নেওয়া যাক। পাঁচ ঘণ্টা সময় তো কম কিছু নয়। কিন্তু কোথায় যাব, কীভাবে যাব? আর দেখবইবা কী?

সামান্য দূরেই বাজারের মতো কয়েকটি দোকান দেখতে পেয়ে সেদিকেই পা চালিয়ে দিলাম। হ্যাঁ, ছোট্ট একটি বাজার এটি। ভাবলাম, এখানে চা খাবার ছলে দোকানী বা স্থানীয়দের কাছে দ্বীপের দর্শনীয় স্থানসমূহের খোঁজখবরটা জেনে নিই। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বসে গেলাম একটি দোকানের বেঞ্চিতে। মুড়ি আর কাঁঠালী কলায় চমৎকার নাস্তা। ক্ষুধার্তের মুখে যা দেবে তাই অমৃত বলে যে কথাটির প্রচলন আছে দেখলাম তা মোটেই মিথ্যে নয়।

অনতিবিলম্বে প্রমাণিত হলো— কুতুবদিয়ার মানুষের অতিথিপরায়ণতা। চা দোকানে থাকা ভদ্রলোকরাই আগন্তুক হিসেবে আমার পরিচয় নিলেন। অতঃপর আমাকে সংক্ষিপ্ত আকারে ব্রিফ দিলেন তাদের সুন্দর দ্বীপ সম্পর্কে। দ্বীপটি যে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আর এর নাম যে সমুদ্রকন্যা তা বলতেও ভুল করলেন না। ভদ্রলোকদের একজনের নাম— আবদুস সালাম কুতুবী অন্য দু’জনের নাম মনে করতে পারছি না। তাদের একজন স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক অন্যজন কুতুবদিয়া কবি জসীম উদ্‌দীন হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক।

হালকা পাতলা গড়নের লোক আব্দুস সালাম কুতুবী একজন রাজনৈতিক নেতা, সরকারের বিপক্ষে তার দল। পরিচয় পেয়ে পরিহাস ছলে বললাম— সরকারের বিপক্ষের লোকজন আজকাল তো লুকিয়ে থাকেন। ক্ষমতাসীনদের তাড়া খেয়ে তারা এখন অনেকটাই ছুপাহুয়া রুস্তম।

কুতুবী সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ। আমার ঠাট্টা বুঝতে পেরে তিনিও বললেন— ভাইরে কে কারে তাড়া করবে? চারিদিকে সমুদ্র, আমাদের তাড়া করে তারাইবা শান্তিতে ঘুমাবে কী করে?

হাসি মশকরা শেষে বললাম, কুতুবদিয়া খুব সহজে এবং স্বল্প সময়ে দেখে নেওয়ার উপায় বলুন।

সালাম কুতুবী সাহেবকে অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ বলে মনে হলো। বললেন— এসেছেন যখন সবই দেখতে পাবেন। তার সাথীরা বললেন— দু’একদিন না বেড়ালে ভালো করে দেখবেন কী!
বললাম— যথার্থই বলেছেন জনাব। তবে, আগামী পরশুদিনই সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা হতে চাই। পথে টেকনাফ একদিনের রাত্রি যাপন। সুতরাং এখানে দু’একদিন থাকার সুযোগ হবে না। চা পানশেষে সালাম কুতুবী সাহেব একটি বাইক ঠিক করে দিলেন। চালককে বললেন— ইনি পটুয়াখালী থেকে এসেছেন। একজন লেখক, আমাদের মেহমান। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সব দেখিয়ে দিও। আমাকে বললেন— পাঁচশ’ টাকার মতো ভাড়া হবে, আপনি আমাদের মেহমান। ভাড়াটা তো আমাদেরই দেওয়া উচিৎ। বলেই পকেটে হাত ঢোকালেন কুতুবী সাহেব।

বুঝলাম— দ্বীপাঞ্চল হলেও এখানের লোকজনের ভদ্রতাবোধ আছে।

বললাম— থাক থাক, অনেক করেছেন। বরং চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে বললাম— একটি প্রশ্ন ছিল ভাই? এতদূরে এই দ্বীপাঞ্চলে কবি জসীম উদ্‌দীনের নামে স্কুলটি কাদের উদ্যোগে হলো?

ভদ্রলোক বললেন— উদ্যোগ ছিল কুতুবদিয়াবাসীর। পল্লী কবির জামাতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তখন মন্ত্রী। তিনি কী একটা কাজে এখানে এসেছিলেন। আমাদের প্রস্তাবে তিনিই যথাযথ শর্তপূরণ সাপেক্ষে তার শ্বশুরের নামে স্কুলটি করেন।

হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাদেরকে বিদায় জানিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

হযরত কুতুব শাহ বা কুতুব আউলিয়া নামক জনৈক বুজুর্গের নামানুসারে কুতুবদিয়া দ্বীপের নাম। বিষয়টি কুতুবদিয়ার দরবারঘাট বাজারে এসে স্থানীয়দের কাছে নিশ্চিত হলাম। কুতুবদিয়া দ্বীপের ইতিহাস প্রায় ছয়শ’ বছরের পুরোনো তবে দ্বীপের জন্ম তারও বহু বছর আগে। পঞ্চদশ শতকে যখন আরাকান থেকে মুসলমানরা দ্বীপটিতে মাইগ্রেট করতে থাকে তখনই এই কুতুব আউলিয়ার আগমন।

একটি বিষয় উল্লেখ না করেই পারছি না— আমার নাতিদীর্ঘ এই ভ্রমণকালীন উপকূলীয় অঞ্চল কিংবা দ্বীপাঞ্চলের মানুষের ধর্মভীরুতা আমাকে যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনি তাদের অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কারও আমাকে বিদ্ধ করেছে। বলাবাহুল্য, এ বিষয়ে সকল জাত-পাত বা ধর্মমতের মানুষ যেন একই মোহনায় মিলিত।

খুব ছোট্ট এক উপজেলা এই কুতুবদিয়া। মাত্র ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। নির্বাচনী আসন মহেশখালীর সাথে যুক্ত। কুতুবদিয়া নামক একটি গভীর ও প্রশস্ত চ্যানেলের মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সাথে দ্বীপটি বিযুক্ত। কুতুবদিয়া চ্যানেলটি চওড়ায় পদ্মানদীর চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হলো না। স্থানীয়রা বলেন সাগরের দ্বীপটি ভাঙনের কবলে পড়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। ভেঙে গেছে দুইটি ইউনিয়নের অনেকগুলো গ্রাম। ব্রিটিশ সময়ে নির্মিত বিখ্যাত বাতিঘরটি দেখতে গেয়েছিলাম। সেটিও এখন সমুদ্রের জলে বিলীন।

বাইক চালকের নাম মন্টু। মন্টু বলল— বায়োবিদ্যুৎ প্লান্টে যাবেন? সেটা কিন্তু কাছেই। বললাম— চল, দেখে আসি। মিনিট পাঁচেক চালাবার পর সামনে বেরিয়ে এল বায়োবিদ্যুৎ প্লান্টের কাণ্ডকারখানা।

বায়োবিদ্যুৎ প্লান্ট বা উইন্ড টারবাইন প্রকল্পের মাধ্যমে কুতুবদিয়া দ্বীপে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। মাঠের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিশাল বিশাল পাখা লাগিয়ে বিশেষ উপায়ে উৎপাদন করা হয় এই বিদ্যুৎ। সে এক দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। সাগরের উপর দিয়ে প্রবাহিত খোলা মাঠের এ দৃশ্য কেবলই দেখার এবং উপভোগ করার বিষয়। কিছুক্ষণ এই মনোহর দৃশ্য দেখে কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। উপরে বিশাল বিশাল পাখা আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে লবণের চাষ।

উইন্ড টারবাইনগুলো দেখতে দেখতে মনে হলো আমাদের কুয়াকাটার খুব কাছাকাছি হাজীপুর নামক স্থানে এরকম দু’টি বায়োবিদ্যুৎ যন্ত্র বা উইন্ড টারবাইন লাগানো আছে। তবে সেগুলো আরও উঁচুতে এবং পাখাগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির।

এসব ভাবনার মধ্যেই চালক মন্টু বলল—স্যার, নামাজের সময় হয়ে গেছে। চলেন, দরবার শরীফে নামাজ আদায় করবেন।

বললাম— কুতুব আউলিয়ার দরবার?

সে বলল হ্যাঁ। কুতুব শরীফে নামাজের পর তবারকের ব্যবস্থা আছে। কুতুবদিয়া এসে দরবারের তবারক না নিলে আল্লাহপাক নারাজ হবেন।

হেসে বললাম— চল।

দরবারে পৌঁছে কিছুটা কনফিউজড হয়ে গেলাম। দরবারের গেটে লেখা রয়েছে হযরত আবদুল মালেক শাহ আল কুতুবী রহ. দরবার শরীফ।

বললাম— ইনিই কী কুতুব আউলিয়া?

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-১২

কুতুব আউলিয়ার নামে কুতুবদিয়া দ্বীপ। এ নামকরণ হয়েছে অন্তত পাঁচশ’ কিংবা ছয়শ’ বছর আগে। কিন্তু এ মুহূর্তে যে দরবার শরীফের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এটি কুতুব আউলিয়ার দরবার নয়। এ দরবার হচ্ছে হযরত মালেক শাহ আল কুতুবী (রহ.)-এর দরবার। এই পীর সাহেবের জন্মের অন্তত পাঁচশ’ বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে দ্বীপে আস্তানা গেড়েছিলেন হযরত কুতুব শাহ, যার নামে দ্বীপের নাম।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনা থেকে অন্তত চল্লিশ কিলোমিটার দূরে গভীর সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপটি কমপক্ষে দেড় হাজার বছরের পুরোনো। কিন্তু এখানে মানুষের আবাসন শুরু হয় মূলত পঞ্চদশ শতাব্দীতে। আর তখনই এই দ্বীপে বিখ্যাত অলি হজরত কুতুব উদ্দিন আউলিয়া (রহ.)-এর আগমন ঘটে। কুতুব আউলিয়ার ইতিহাস কেউ যে সংরক্ষণ করে রেখেছেন এমনটি নয় বরং মানুষের মুখে মুখে নানান মিথ হয়ে আছে।

আসলে বৃহত্তর চট্টগ্রামকে বলা হয় বারো আউলিয়ার দেশ। বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশ দ্বারও বলা হয় চট্টগ্রামকে। মধ্যযুগে ইরান, ইরাক, মক্কা থেকে আরব বণিকগণ সমুদ্রপথে চীন পর্যন্ত যেতেন। তখন তাদের অনেকই চট্টগ্রামে আস্তানা গড়ে তোলেন। ক্রমে তারা ছড়িয়ে পড়েন বাংলার আনাচেকানাচে। আজও তাই চট্টগ্রামের যত্রতত্র অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা আর ধর্মীয় নানান প্রতিষ্ঠান লক্ষ করা যায়।

এসকল আউলিয়া দরবেশদের ইসলাম প্রচারের ইতিহাস এখনও ধর্মীয় উপকথা হিসেবে মানুষের অস্তিত্বের মূলে প্রথিত হয়ে আছে। কুতুব দরবেশ হয়তো তেমনই একজন। দ্বীপে নেমেই রাজনীতিবিদ জনাব সালাম কুতুবী সাহেবও এসব কথা বলেছেন। তাছাড়া বাইক চালক মন্টুর কাছে পথে আসতে আসতে এসকল আউলিয়া দরবেশদের অনেক অলৌকিক কাহিনীর কথা শুনেছি।

আগেই বলেছি উপকূলীয় অঞ্চলের বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষজন খুবই ধর্মভীরু। কুতুবদিয়া দ্বীপবাসী যেন আরও এককাঠি উপরে। এখানে গ্রামে গঞ্জে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা। এসবের পেছনে যে মানুষের ধর্মভীরুতা এবং আউলিয়াদের প্রভাব রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

দ্বীপের ধুরং ইউনিয়নের অন্তর্গত ধুরং বাজারেই অলীয়ে কামেল আবদুল মালেক শাহ আল কুতুবী মুহিউদ্দিন আজমী (রহ.) সাহেবের দরবার শরীফ। ‘তিনি কুতুবদিয়ার শাহ সাহেব’ নামে অধিক পরিচিত। এই পীর সাহেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।

পীর সাহেবের মাজার এবং মসজিদ কমপ্লেক্স-এর সামনে লেখা রয়েছে তার জন্ম-মৃত্যুর সন। আমরা যখন মাজার কমপ্লেক্সে প্রবেশ করি তখন জোহরের নামাজ শেষ হয়ে গেছে। গেট দিয়ে ঢুকলে ডানদিকে যে গলিটি গেছে তার শেষ মাথায় হেফজখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং ও ইয়াতিমখানা। গলির দু’পাশে দূর-দূরান্ত থেকে আগত অতিথিদের থাকার জায়গা, যাকে বলে মুসাফিরখানা।

সূর্যাস্তের পরে এ দ্বীপে কেউ যাওয়া আসা করতে পারে না। উত্তাল কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিয়ে কোনো বোট কিংবা নৌযান রাত্রিকালীন পারাপার হয় না। সুতরাং কোনো পর্যটক কিংবা দরবারে আসা লোকজন থাকতে চাইল হয় তাদেরকে ঘোরাঘাট হোটেল সমুদ্র বিলাসে যেতে হবে নয়তো হযরত মালেক শাহ আল কুতুবীর দরবারে আশ্রয় নিতে হবে।

দরবার শরীফের যে গেট দিয়ে ঢুকেছি সেখান থেকে নাক বরাবর যে গলিটি চলে গেছে সেখানে চলছে এলাহি কাণ্ড। দেখি বেশ কয়েকটি ভ্যানে করে মাটির বাসনে শত শত মানুষের খাবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সড়ক ধরে সোজা তাকিয়ে দেখি প্রাচীর ঘেরা আরেকটি গেট। সেখানে লেখা আছে মহিলাদের স্থান, পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। বুঝলাম দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হুজুরের দরবারে আগত মহিলাদের খাবারের আয়োজন।
ড্রাইভারকে বাইরে রেখে এসেছি, কোনদিকে যাব দোটানায় পড়ে গেলাম। একজন এগিয়ে এসে বললেন, বামে যান। বামে গিয়ে দেখা মিলল হুজুর পাকের মাজার শরীফ।

মূলত হযরত মালেক শাহ আল কুতুবী (রহ.)-এর কবরস্থান মসজিদের ঠিক মধ্যিখানে। কবরের চারপাশে এসএস পাইপের গ্রীল দিয়ে আটকানো। মসজিদটি ছাপড়া দেওয়া তবে সুবৃহৎ এ মসজিদে কমপক্ষে হাজার দুই মানুষ একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন।

সে মসজিদের মাঝখানে কবরের চারপাশে কয়েকশ’ মানুষ বসে আছেন। আমাকে একজন খাদেম এসে বললেন— এখনই তবারক দেওয়া হবে। বসে যান।

দেখলাম বসে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। খাদেমরা তাদের মুখোমুখি কাতারবদ্ধ হতে সাহায্য করছেন। মাইকেও নির্দেশ দিচ্ছেন। এখনই খাবার পরিবেশন হবে। স্থানীয়দের ভাষায় তবারক। ভাবলাম সবার যখন তবারক নামের বস্তুটা চাই আর এটা যখন এত বরকতময় তখন আমিইবা বাদ যাব কেন। কিন্তু তার আগে অলির দরবারে যখন এসেছি অন্তত এবেলার নামাজটা এখানে পড়ে নিলে মন্দ কি?

নামাজ পড়তে পড়তে বৈঠক শুরু হয়ে গেল। সবাই বসে পড়েছেন আমি মাথা তুলে দেখে নিলাম আয়োজন। কম হলেও অর্ধ সহস্র মানুষের জন্যে ব্যবস্থা। আমাকে একজন আগ্রহ করেই পাশে বসালেন। বয়স্কমতো এ ভদ্রলোকের নাম আবদুল জলিল মিয়া। ভদ্রলোক কুতুবদিয়া বাতিঘরের সাবেক কর্মচারী
অত্যন্ত পরিপাটি আর সুশৃংখল আয়োজন। কোনোদিকে সামান্য ত্রুটি হওয়ার সুযোগ নেই, অলির দরবার বলে কথা।

মুখোমুখি আসন পেতে বসা মানুষদের মাঝখান দিয়ে এক ব্যক্তি এক হাতে পানিভর্তি বালতি অন্য হাতে কালো রঙের দীর্ঘ দস্তরখানা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। নিয়ম অনুযায়ী দু’পাশের মানুষরা কব্জি ডুবিয়ে ধুয়ে নিচ্ছেন হাত। অতঃপর দস্তরখানায় মুছে খাবার জন্যে এন্তেজার করছেন। বহু মানুষ যে পাত্রের পানিতে কব্জি ডুবিয়ে হাত ধুয়েছে সে পাত্রে হাত ধুতে আমার রুচি হলো না। আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাই হাত ধোয়া থেকে বিরত থাকলাম।

পাশে বসা ভদ্রলোক যিনি কুতুবদিয়া বাতিঘরের সাবেক কর্মচারী, তিনি বললেন— হাত ধুলেন না কেন? খাবার আগে হাত ধোয়া সুন্নত।

আমতা আমতা করে বললাম— এত লোকে হাত ধুয়েছে, ও পানি তো নোংরা। ওতে হাত ধোয়া মানে হাতে ময়লা লাগানো।

জবাব শুনে জলিল মিয়া ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে বললেন— এটা কামেল পীরের দরবার। এখানের তবারকে আল্লাহর রহমত আছে। একই বালতিতে হাত ধুলেও আজ অব্ধি কারও কোনো সমস্যা হয়নি।

তার কথায় বিব্রত হলাম, কোনো জবাব দিলাম না। ভাবলাম— অলির দরবার, হাত না ধুয়ে কোনো বেয়াদবি করলাম না তো! শুরু হলো মাটির বাসনভর্তি তবারক বিতরণ। বাসনে পর্যাপ্ত ভাত তার উপর আলুর তরকারি। পাশের লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানলাম এ ব্যবস্থা চিরন্তন।

চোরের মন পুলিশ পুলিশ। দেখলাম ডানে বায়ে খাবার বিতরণ হলেও আমাদের দু’জনের খাবার এল না। মনে মনে শংকিত হলাম। হাত না ধুয়ে বোধহয় বেয়াদবি করেছি। কিন্তু না, অনতিবিলম্বে জনৈক খাদেমের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি দৌড়ে গিয়ে খাবার নিয়ে আসলেন। মনে মনে হাঁফ ছাড়লাম— যাক, তবারক তাহলে কিসমতে ছিল, বেয়াদবি হয়নি।

সেই খাদেম সাহেব এসে জানতে চাইলেন রাত্রিযাপন করব কিনা? খাদেমের নাম হাফেজ আবদুল বাছেত। হাফেজ বাছেত সাহেবের বাড়ি দরবারঘাটে। বললাম— না, দিনাদিনি চলে যেতে চাই। ফের হাফেজ সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করলাম— এত মানুষের আয়োজন, তা এসবের খরচাপাতির জোগান কীভাবে হয়?

হাসলেন খাদেম সাহেব, বললেন— হুজুরের দোয়া। আল্লাহর পক্ষ থেকেই সব ফয়সালা হয়ে যায়।

খাবার পর হাফেজ বাছেত সাহেব মালেক শাহ আল কুতুবীর দরবার শরীফ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন। দরবার থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি হুজুরের জীবনদর্শন সম্পর্কিত একখানা বই তুলে দিলেন হাতে।

দ্বীপান্তরের দিনগুলো-১৩

কুতুবদিয়া দ্বীপটি বাতিঘরের দ্বীপ হিসেবেও পরিচিত। এই বাতিঘরের একটি ইতিহাস আছে যা বাতিঘরের পুরোনো কর্মচারী জনাব আবদুল জলিল সাহেবের কাছে শোনা। জলিল সাহেব ধুরং ইউনিয়নের বাসিন্দা যার সাথে কুতুবী দরবার শরীফে পরিচয়। চাকরি থেকে অবসর নেওয়া জলিল সাহেবের পূর্ব পুরুষ এসেছিলেন আরাকান থেকে। সে সাত পুরুষ আগের কথা। সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানেন না। বাবার কাছে এটুকুমাত্র শুনেছেন। বললেন—

কুতুবদিয়া আবাসন গড়ে ওঠার অনেক পর সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচলের জন্যে ব্রিটিশ সরকারের কাছে এ দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার নির্মাণ করেন বাতিঘর। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে বাতিঘরের দ্বীপ হিসেবে কুতুবদিয়ার নাম ছিল, অধুনা তা বিলুপ্ত হয়েছে।

জলিল সাহেবের নিকট থেকে জানা গেল তৎকালীন চান্স এন্ড ব্রাদার্স কোম্পানি কর্তৃক মনোনীত ইঞ্জিনিয়ার বার্মিংহাম-এর তত্ত্বাবধানে ১৮৪৬ সালে কুতুবদিয়ার আলী ফকির ডেইল নামক স্থানে আটতলা বাতিঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রথম বাতিঘর ছিল ১২০ ফুট উঁচু। গোলাকার আলোক স্তম্ভের প্রতিটি কক্ষে মূল্যবান কাচের জানালা ছিল। কক্ষের চারদিকে রেলিং ছিল। সর্বোচ্চ কক্ষে বাতিঘরটি প্রজ্জ্বলন করা হতো। শত মাইল দূর থেকে নাকি সমুদ্রের নাবিকরা বাতিঘরের আলো দেখে দিক নির্ণয় করে নিতে পারতেন। প্রথম নির্মিত সে বাতিঘর জলিল সাহেব নিজেও দেখেননি।

প্রবল ভাঙনের ফলে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বাতিঘরটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে দু’কিলোমিটার পূর্বে বাঁধের ভেতরে প্রায় সাত একর জমিতে আরও একটি বাতিঘর নির্মাণ করে। সেই বাতিঘরটিও ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে পুনরায় সাগরে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে মালেক শাহ কুতুবীর দরবারের কাছাকাছি ধুরং এলাকায় টাওয়ার আকারে আরেকটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমান পাতিঘরে আগের সে জৌলুশ যেমন নেই তেমনি নাবিকদের জাহাজ চলাচলে আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় বাতিঘরের গুরুত্বও কমেছে।

আমরা দরবার থেকে তবারক গ্রহণ শেষে বাতিঘর দেখতে যাওয়ার পথেই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্যান্ডেল এবং তারই অদূরে বাবুর্চিখানা দেখে জিজ্ঞেস করতে হাফেজ বাছেত মিয়া জানালেন— গত দু’দিন যাবৎ ওরস মোবারক ছিল। তাতে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিল।

দেখলাম বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিশাল বিশাল আকৃতির শত শত ডেক ডেকচি পড়ে আছে।
হাফেজ সাহেব জানালেন— আগত ভক্ত আশেকানদের খাবার ব্যবস্থা এখানেই হয়। এটি ছিল একুশতম ওরশ। বললেন এবছর গরু এসেছিল নব্বইটি। এছাড়া অগণিত ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি তো ছিলই। সবই আশেকানদের দেওয়া হাদিয়া-তোফা।

হাফেজ সাহেবকে বললাম— আমাদের ফরিদপুরের আটরশিতেও এমন আয়োজন হয়। সেখানে খাজাবাবা ফরিদপুরীর দরবার।

আটরশির কথা হাফেজ সাহেব জানেন কিনা বোঝা গেল না তবে তিনি যেন তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দিলেন। বললেন— হযরত মালেক শাহ দরবারের সাথে বাংলার কোনো দরবারের তুলনা হয় না। হুজুর ছিলেন আধ্যাত্মিকতার উচ্চ পর্যায়ের একজন সাধক।

ইতিপূর্বে তার দেওয়া বই ও ক্যালেন্ডার দেখিয়ে বললেন— এতে হুজুরের জীবনী পাবেন। হাফেজ সাহেবের বর্ণনামতে ফানাফিল্লাহ জগতে বিচরণকারী আল্লাহর অলি হযরত মালেক শাহ (রহ.) ছিলেন বাংলার অলীকূল শিরোমনি। তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীর হালি শহরের বিখ্যাত অলি হযরত হাফেজ মুনির উদ্দিন (রহ.)’র মুরিদ ছিলেন।

হযরত মালেক শাহ্‌ (রহ.)-এর জীবনীগ্রন্থে আছে তিনি যেমন শরীয়তের বড় আলেম ছিলেন তেমনি আমল ও আধ্যাত্মিকতার বলে তরিক্বতের জগতে উপরের দিকে ধাবিত হতে থাকেন। কামেল অলির হাতে বায়াত হওয়ায় হযরত মালেক শাহ্‌ (রহ.) কামালিয়াত হাসেল করে এলমে তাসাউফের জ্ঞান নিয়ে ফানাফিল্লাহ জগতে পৌঁছে যান।

হযরত আবদুল মালেক শাহ আল কুতুবী (রহ.) ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২১ জুলাই তারিখে কুতুবদিয়া নিজ পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পরে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্‌রাসায় ভর্তি হন এবং সেই অল্প বয়সেই সুলতানুল আউলিয়া হযরত হাফেজ মুনির উদ্দীন নুরুল্লাহ (রহ.)’র নিকট বায়াত লাভ করেন। পরবর্তীকালে তার কাছ থেকে খেলাফতপ্রাপ্ত হন। উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য হযরত মালেক শাহ ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দুস্থানের বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্‌রাসায় ভর্তি হন। তিনি শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

১৯৩৪ থেকে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর নানান প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা এবং দ্বীনের খেদমতে কাটান। হযরত মালেক শাহ হুজুর উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলীয়ে কেরামদের সোহবত লাভ করেন। ১৯৬০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের পর তিনি কুতুবদিয়া নিজ বাড়িতে কুতুব শরীফ দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৬-১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ তথা ১০ বছর কুতুব শরীফ দরবারে ৩ দিনব্যাপী সীরাতুন্নবী (স.) মাহফিলের আয়োজন করতেন। তখন দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ওলামা মাশায়েকগণ সেই মাহফিলে তাশরিফ পেশ করতেন।

শুধু তাই নয়, কুতুব শরীফ দরবারের সিরাতুন্নবী জলছায় বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ থেকে শুরু করে উচ্চস্তরের ব্যক্তিত্ববর্গ অংশ গ্রহণ করতেন। এ মহান অলি ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০০ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ইন্তেকাল করেন।

কুতুবদিয়া বায়োবিদ্যুৎ প্লান্ট, হযরত মালেক শাহ কুতুবী (রহ.) দরবার এবং বাতিঘর দেখতে দেখতে বিকেল পাঁচটা বেজে যায়। বাইক চালক মণ্টু মিয়াকে বললাম— এবার তো যেতে হয়।

সে বলল— ঠিক বলেছেন স্যার। সন্ধ্যের পরে বোট চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।

হাফেজ বাছেত মিয়া, বাতিঘরের সাবেক কর্মচারী আবদুল জলিলকে ধন্যবাদ জানালাম। তারা খুব আন্তরিকতা নিয়ে আমাকে সময় দিয়েছেন। দ্বীপের আরেক প্রান্তে রয়ে গেলেন আবদুস সালাম কুতুবী সাহেব যিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ফোন দিতেই খুব আন্তরিকতা নিয়ে বললেন—
আজ রাতে আমার বাড়ির মেহমান হলে খুশি হতাম।

বললাম— সেটি হওয়ার উপায় নেই জনাব। যেতে হবে এখনই।

দরবার থেকে ঘাট পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। আমার সাথে সাথে হাঁটছেন হাফেজ বাছেত আর জলিল সাহেব। নানান কথা বলছেন। আবার আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। দরবার ঘাটের সড়কের দু’পাশে লবণের খেত। স্থানীয় ভাষায় ডেইল। মাঠে মাঠে কৃষকরা লবণের কাজ করছে। মাঠজুড়ে সাদা সাদা লবণের স্তূপ। দেখতে দেখতে ঘাটে চলে এলাম। এপাড়ে দরবার ঘাট ওপারে মগনামা।

বোটে উঠতে উঠতে ছয়টা বেজে গেল। সূর্যের অস্তমিত আবির কুতুবদিয়া চ্যানেলের নীল জলে খেলা করছে। হাত তুলে বিদায় জানালাম দ্বীপবাসীকে। মুহূর্তে স্পিডবোট ছুটে বেরিয়ে পড়ল। ক্রমে অস্পষ্ট হচ্ছে দ্বীপের মানুষ, দ্বীপের সবুজ বনানী কিন্তু আমার মনের গভীরে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে গেল বাংলার মনোহরি এ দ্বীপের অপরূপ ছবিখানি।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

কৃষ্ণচূড়া

Read Next

ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ : ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *