এক মধ্যবয়সী সাধু হেঁটে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। হুট করে এক ক্রুদ্ধ যুবক এসে তাকে জাপ্টে ধরে রাস্তার পাশের একটা কুয়োর মধ্যে ফেলে দিল। পাহাড়ের অন্য টিলা থেকে নেমে আসা এক কাঠুরিয়া ব্যাপারটা দেখে হল্লা জুড়ে ছুটে এল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে ক্রুদ্ধ যুবকের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাস করল, কেন সে নির্দোষ সাধুকে কুয়োয় ফেলে দিল? উত্তরে ক্রুদ্ধ যুবক বলল, তার ইচ্ছা হয়েছে তাই সে ফেলে দিয়েছে। কারণ সে একেক দিন একেক ধরনের লোকদের দু’চোখে সহ্য করতে পারে না। তাই সে তাদের শাস্তি দিয়ে থাকে। আজ সকাল থেকে তার মনে হচ্ছিল সাধু লোকেদের জীবন সত্যিই অসহ্যকর একঘেয়ে! তাই সে ভোর থেকে সাধু খুঁজে বেড়াচ্ছিল শাস্তি দিয়ে নিজে শান্তি পেতে!
কাঠুরিয়া পুরো ব্যাপারটা শুনে সময় না দিয়ে মুহূর্তে ক্রুদ্ধ যুবককে ভূপাতিত করে পায়ে দঁড়ি বেঁধে সেই কুয়োর মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিল। গভীর কুয়োর পড়ে ক্রুদ্ধ যুবক ভয়ে চিৎকার কান্নাকাটি জুড়ে ব্যারাছ্যাড়া লাগিয়ে ফেলল এবং আবিষ্কার করল জলে সেই সাধু তখনো ভেসে আছে! সাধু তার শান্ত অভিযোগহীন চোখে তাকিয়ে বলল, যতক্ষণ তলিয়ে না যাচ্ছ ততক্ষণ তাকিয়ে থাকো, দেখে নাও! অযথা চিৎকার করে সময় নষ্ট না করে দেখো আকাশ এখনো আছে মাথার উপরে। তলিয়ে যাওয়ার পর আর পার্থিবের সঙ্গ পাব না আমরা! আমাকেও পাবে না তুমি, আমি না তোমাকে।
ক্রুদ্ধ যুবকের পায়ে বাঁধা দড়িতে টান পড়ল। উপর থেকে কাঠুরিয়া কপিকল ঘুরিয়ে টেনে তুলছে তাকে! ফলে ক্রুদ্ধ যুবক সাধুর দুই বাহু জাপ্টে ধরল এবং তারা দুজন উপরে উঠে এল। কাঠুরিয়া ক্রুদ্ধ যুবকের পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই সে দৌড়ে গিয়ে আবার কুয়োয় ঝাঁপ দিল। সাধু বিস্ময়ে বলল, ঘটনা কী?
কাঠুরিয়া বলল, প্রায়শ্চিত্ত করতে ঝাঁপ দিয়েছে। আপনার সান্নিধ্যে কিছু সময় থাকার ফল!
সাধু বলল, ধুর! বলেই সে নিজের এক পায়ে দড়ি বেঁধে কুয়োর লাফিয়ে পড়ল! জলে পড়ার পর সাধু বলল, ঝাঁপ দিলে কেন?
ক্রুদ্ধ যুবক বলল, গত পরশু আমি এক কিশোরকে ফেলেছিলাম এর মধ্যে, তাকে খুঁজছি আমি! সাধু বলল, কিশোরকে ফেলেছিলে কেন? ক্রুদ্ধ যুবক বলল, ইচ্ছে হল! ওর চেহারা দেখে খুব আফসোস হল নিজের জন্যে! আমি ওর ওখানে আর ফিরতে পারব না! কিন্তু ও আমার এখানে আসতে পারবে! রাগ হল খুব তাই ফেলে দিলাম! সাধু বলল, আমাকে ফেলে কি তুমি তোমার আগামীকে আটকাতে পারবে ভেবেছিলে?
ঠিক তখন উপর থেকে কাঠুরিয়া হুড়মুড়িয়ে পড়ল তাদের উপর! জানা গেল, গত পরশু যেই কিশোরকে এক উন্মাদ যুবক এই কুয়োর মধ্যে ফেলেছিল তার পরিবার বদলা নিতে কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠুরিয়াকে দেখে সেই উন্মাদ বা ক্রুদ্ধ যুবক ভেবে কুয়োয় ফেলে দিয়েছে; কাঠুরিয়ার আকুতি বা যুক্তি তারা কানে তোলেনি! কিছুক্ষণের মধ্যে কুয়োর মধ্যে কুয়োর দড়ি এসে পড়ল। কাঠুরিয়া বলল, আর আমাদের বাঁচার কোনো লাইন নেই! শেষ সব।
ক্রুদ্ধ যুবক বলল, আমার জন্য আপনাদের এই অবস্থা হল।
সাধু বলল, দেখা যাক, এটা না হলে তো এগুলো এবং এর পরেরগুলো হত না বা হবে না!
কিন্তু সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মিনিটে মিনিটে কুয়োর জল বাড়ছিল। আর জলে ভেসে তারা উপরের দিকে উঠে আসছিল সেই আজব কুয়োর মধ্যে থেকে। কিন্তু তারা টের পাচ্ছিল না। মধ্য রাত্রে চাঁদ যখন খুব প্রকট তখন হঠাৎ আবিষ্কার করল তারা কুয়োর দেয়ালের কিনারা ছুঁয়ে ভাসছে, আরেকটু হলেই উপচে মাটিতে পড়বে! আহ্লাদে কাঠুরিয়া বলল, এ কী আজব কুয়ো সাধু? জল উগরে দেয় মানুষকে? তার মানে কি সবই মিথ্যে?
ক্রুদ্ধ যুবক বলল, ওরে সর্বনাশ! তার মানে সেই কিশোরও মরেনি? মাঝরাতে ভেসে ডাঙ্গায় ফিরে গেছে?
সাধু আকাশের চাঁদের দিকে ঘোরগ্রস্তের মতো তাকিয়ে বলল, কই? আমরা তো জলের মধ্যেই আছি। মীন হয়ে গেছি। ঐ দেখো আকাশে চাঁদ! এসো জলকেলি করি, এ চন্দ্র যাপন না করলে ফুরিয়ে যাবে!
২৬ আগস্ট, ২০২২