অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
অক্টোবর ২৩, ২০২৪
৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিমিখা দত্ত -
কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের বিদায়বেলায় শ্রদ্ধার্ঘ্য

সময়টা ২০১১ কি ২০১২। আমি তখন একাদশী ব্রজবালিকা। নাহ! বয়সে এগারো নই, তবে শ্রেণিতে ‘একাদশ’ এই। অংকের মতো কঠিন গুণ, ভাগ, বিয়োগের ক্যালকুলাস টিউশন ব্যাচে প্রথম যোগ হলো এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। যার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করিয়েছিল ‘অর্জুন’, পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার পাতায়, তার সাথেই নব আলাপ রচিত হলো ‘উত্তরাধিকার’ সূত্রে। তিনটি বই, তিনটি চরিত্র আর তিনশ’ পেরিয়ে হাজার রকম অনুভূতি মনের কোণে এঁকে দিল সম্পর্কের এক নতুন ক্যানভাস। তাতে সবটাই রঙিন তা বলব না, তবে ধূসরতা রিক্ত জীবনের যে চিত্রাঙ্কন করল, তা রোজদিনের আবহমানতার দিনলিপিই বটে।

‘ট্রিলজি’। হয়তো মানে তত ভালো বুঝতাম না তখন, তবে যেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তা হলো নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ‘নারীত্ব’ হিসেবেই অধিক প্রস্ফূটিত এবং অমলিন চিরকাল।

মাধবীলতা। যাকে নিয়ে উপন্যাস নয়, যে নিজেই একটি উপন্যাস। যতবার ‘কালবেলা’ পড়েছি, ততবার মনে হয়েছে এর থেকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বোধহয় লেখকের আর নেই। যদিও সবটাই ব্যক্তিগত অভিমত। আসলে, মাধবীলতাদের গন্ধ থাকে না তো, তাই যখন বৃষ্টি পড়ে তখন কেমন করে নুইয়ে গিয়েও যেন জড়িয়ে রাখে ওরা স্থান কাল আর পাত্রকে। ওরা গোলাপের মতো সুন্দরী নয়। ক্রোশের পর ক্রোশ মাতিয়ে রাখা সুরভিতও নয়, তবে রোদ জল উপেক্ষা করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকার এক অদ্ভুত ঋজুতা ওদের সহজাত। তাই বোধহয় আমাদের মতো যারা রোজের জীবনে লড়াই করে নিত্য, যারা তিরতিরিয়ে বয়ে চলে আপন পথে, তারাই মনখারাপের বিকেলে হার চুরি ঝুমকো করে অলংকার করে তোলে ওদের। মাধবীলতারা হারায় না। নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তার মিশ্রণ যখনই ঘটে তখনই জন্ম নেয় এই মাধবী বা দীপাবলিরা। যাদের কাছে সম্পর্কই শেষ কথা, সমাজ নয়।

‘স্বীকৃতি’ শব্দটার ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল বোধকরি সেকালেই। যেখানে বেলঘড়িয়া থেকে উঠে আসা সাধারণ এক নারী নিজ সিদ্ধান্তে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে উঠে শুধু হৃদয়কে সাক্ষী ‌মেনেছিল। আনুষ্ঠানিকতা, মন্ত্র, আচার কিছুই সেখানে প্রাধান্য পায়নি। কতটা মনের জোর থাকলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় সিগারেটের ওই আগুনে দহন সহ্য করেও দাঁতে দাঁত চিপে থাকা যায়। কই? সে স্ত্রী তো ছিল না! কতখানি প্রেমিকা ছিল তাও বলা দায়। কিন্তু সে ছিল। পাশে ছিল সারাজীবন, যেভাবে একজন মানুষের ‘আশ্রয়’ হয়ে ওঠা যায়। সংসার না হোক একটা বাসা অন্তত বাঁধা যায়। শারীরিক পারিবারিক পঙ্গুত্ব সয়েও নীরবে সঙ্গী হওয়া যায়।

তাই মাধবীলতা আমার সই, সেইদিনগুলো থেকে আজও। হয়তো অনিমেষেই ফ্যান্টাসি খোঁজে সবাই, তবে আমার কাছে সমরেশ মজুমদার মানেই মাধবীলতা আর কালের নিয়মের চলে যাওয়া তার কালবেলা। শুধু নিবেদনেই প্রেম নয়, অনুভবেও বাঙ্ময়তার এক ছোট্ট নিদর্শন লেখক নিজেই।

‘গর্ভধারিনী’ থেকে ‘সাতকাহন’ প্রত্যাশার পারদ ক্রমাগত এক উচ্চতা থেকে অন্যতায় পৌঁছেছে। সাথে বেড়েছে মেরুদণ্ডের শক্তি, নিজের প্রতি ভরসা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ওপর সপাটে চড় হেনেছে দীপাবলি। পুরুষের ছত্রছায়ায় নারী নয়, বরং যতন স্পর্শে নারী হয়ে ওঠে বটবৃক্ষ। শিক্ষাই বহন করবে নারী জাতির মর্যাদা, গড়ে তুলবে আত্মসম্মান বোধ এই ভাবনার অন্যতম দিশারী কিন্তু ছিলেন লেখক নিজেই। তাই আজ যখন সময় বড়ই অস্থির, তখন উপলব্ধি হয় সমরেশ বাবুর চরিত্রের রূপকে তুলে ধরা প্রকৃত সারসত্য।

প্রিয় লেখক, এই কথাগুলো আপনাকে বলতে চেয়েছিলাম কোনো না কোনোদিন। কিন্তু অপূর্ণতার হিসেবের খাতায় আরেকটা ইচ্ছে হয়তো জমাই রইল চিরকালের মতো। আপনার সাথে মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়তো হলো না, কিন্তু আপনার লেখায় আপনি চিরকাল স্বকীয় ভাবধারার ধারক ও বাহক হিসেবেই রয়ে যাবেন আমার কাছে। যতবার চারপাশে মাধবীলতা অনিমেষ দীপাবলীদের খুঁজে পাব বা কোনো এক অর্ককে দেখব প্রজন্মের শিক্ষার মশাল হাতে এগিয়ে যেতে, ততবার ওদের অন্তরালে আপনাকেই অনুভব করব। জ্বলজ্বল করবেন আপনি আপনারই সৃষ্টি মাঝে।

মৃত্যুর পরপার বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেখানেই আবার দোয়াত কলম নিয়ে বসবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকব নতুন কোনো গল্পের নামভূমিকার।

দিব্যান লোকান স গচ্ছতু। প্রণাম নেবেন। ভালো থাকবেন।

অনিমিখা দত্ত

অনিমিখা দত্ত-র নিবাস : রানাঘাট, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।

পেশায় শিক্ষক। পড়াতে ভালোবাসেন। বই যদি নেশা হয়, লেখালেখি তবে প্যাশন। নিত্যনতুন বিষয়ে ভাবতে এবং চারপাশের মানুষজনসহ পরিবেশকে খুঁটিয়ে দেখে বৈচিত্র্যযাপন তার অন্যতম শখ। রসায়নে মাস্টার্স হলেও সম্পর্কে গাছ হয়ে ওঠায় বিশ্বাস করেন, যাতে উপড়ে ফেলতেও টান লাগে। পুরাতন বাড়ি থেকে পুরোনো মানুষ অতীতচর্চায় বড়ই আগ্রহী।

বেড়াতে ভালোবাসেন, কারণ তিনি মানেন ‘পথ চলাতেই আনন্দ’। তবে শুধু এ-দেশ ও-দেশ নয়, স্ব জীবনেও।

 

Print Friendly, PDF & Email

Read Previous

নিঃশব্দ আহমেদ – গুচ্ছকবিতা

Read Next

অণুগল্পগুচ্ছ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *