‘৫২-র ভাষা আন্দোলনে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ তাঁদের মধ্যে এক অনন্য পথিকৃৎ। তিনি একাধারে ভাষাসৈনিক, পরমাণু বিজ্ঞানী, কবি, ধর্ম গবেষক, সমাজসেবক। আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি, ভিয়েনা, অস্ট্রিয়ায় কর্মরত ছিলেন। এই কিংবদন্তি ভাষা সংগ্রামী স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন— ৭৫/৪ ইন্দিরা রোড, ঢাকায়।
উপমা-খোলাচিঠি আয়োজিত আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সাক্ষাৎ পাওয়ার। অনুষ্ঠান হয়েছিল ৩০ নভেম্বর, ২০১৬ সালে। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি, ঢাকা। আয়োজনে ছিল অর্বাচীন-উপমা সাহিত্য পত্রিকা, পিয়াল প্রিন্টি এন্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা, বাংলাদেশ। খোলা চিঠি সাহিত্য পত্রিকা, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত। উপমা, খোলাচিঠি ও অর্বাচীন পত্রিকার সম্পাদক যথাক্রমে সৈয়দা নাজমুন নাহার, তারক দেবনাথ, আকমল হোসেন খোকন। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল— রউফিয়ান রিদম। অশীতিপর তরুণ তুর্কি ড. জসীমউদ্দিন আহমেদ সেই দিন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন। শুধু আমি নই, সেইদিন অনুষ্ঠানের সবাই-ই মুগ্ধ হয়েছিলেন। এমনকি আমাদের সঙ্গী পশ্চিমবঙ্গের কলকাতাবাসী রণধীর দে মহাশয় তাঁকে সসম্মানে নমস্কার জানাতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। সেইদিন অনুষ্ঠানে আমি কয়েকটা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলাম। এবং মঞ্চ থেকে নেমে আসার সময় তিনি তাঁর লেখা— ‘আমার দেখা একুশে ফেব্রুয়ারি’ মূল্যবান গ্রন্থখানি আমাকে উপহার দিয়েছেন। গ্রন্থখানি হাতে পাওয়ার পর আমার মনে হয়েছিল আমি যেন চাঁদ হাতে পেলাম। গ্রন্থখানিকে সম্বল করে এই লেখার অবতারণা।
১৯৪৭ সাল। দীর্ঘ ১৯০ বছর অখণ্ড ভারতবর্ষ পরাধীন থাকার পর স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু অখণ্ড ভারতবর্ষ দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গেল। নতুন দু’টি রাষ্ট্রের নাম হলো, যথা— ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান। ভৌগোলিক কারণে পাকিস্তান দু’ভাগে বিভক্ত হলো। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ভাষা বিভ্রাট দেখা দিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মতামত যাচাই না করে স্বাধীনতার পর পরই দেখা গেল নতুন মুদ্রা, পোস্টাল খাম, ডাকটিকিট, মানি অডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি উর্দু লেখা শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের গণমানসে চিন্তার উদ্রেক সৃষ্টি হলো— বাংলা কেন ব্রাত্য। এদিকে আবার ১৯৪৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পশ্চিম পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গৃহীত হয় উর্দু ও ইংরেজি। বাংলার উল্লেখ নেই। পূর্ব পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য ধীরেন দত্ত বাংলাভাষাকেও পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবি করেন। তাতে মুসলিম লীগের নেতারা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সর্বদলীয়ভাবে প্রতিবাদ সংগঠন গড়ে ওঠে। এবং তখন থেকেই এই ভাষা আন্দোলন বেগবান হতে থাকে।
১৯ মার্চ ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ২১ মার্চ রমনা মাঠে জনসমাবেশ এবং ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কার্জন হলে উর্দুভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিতে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনসহ অন্যরাও প্রতিবাদে প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। জিন্নাহ তাতে কর্ণপাত করেনি। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ জিন্নাহ-র মৃত্যু হলে নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৮ নভেম্বর ঢাকায় এলে পর তাঁকে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হলে। জিন্নাহের মতোই তিনিও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুকেই প্রাধান্য দেন।
অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু ছিল না, শুধু অভিজাত শ্রেণির কথ্য ও লিখিত ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত। তারপরেও ৪টি প্রদেশের ৪টি মাতৃভাষা, যথা— পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি ও পশতু। সব ভাষাকে উপেক্ষা করে সেইদিন তাঁদের কাছে উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় প্রাধান্য পেয়েছিল।
১৯৫১ সালের অক্টোবরে লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু ঘটলে প্রধানমন্ত্রী হন— খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা আসেন এবং পূর্ব প্রশাসকদের মতোই তিনিও ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪২ সালের ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালিত হয়। অতঃপর ২১ ফেব্রুয়ারি পর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক অধিবেশন বসে এবং ভাষা দিবস পালনের উদ্দেশ্যে শপথ গ্রহণ করেন। আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে ক্রমাগত একমাস ঢাকা জেলার সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি করেন। ১৯৫২ সাল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-ছাত্রীরা এক সভার আয়োজন করেন। এবং সভার সভাপতি নির্বাচিত হন গাজীউল হক। ছাত্র-ছাত্রীদের চাপে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় প্রদান করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে গেলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করে অন্যত্র নিয়ে গেলে আন্দোলন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ছাত্র-ছাত্রী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে বেলা প্রায় ৩ টের সময় ভাষা সৈনিক ড. জসীম উদ্দীন আহমেদ পুলিশের উপর আস্ত ইট একটুকরো ইট নিক্ষেপ করেন। তাতে করে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে হোস্টেলের মধ্যে ঢুকে ছাত্রদের বেধড়ক পেটায়। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেট কোরেশীর সিদ্ধান্তে বেলা ৩টার পর বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, সালাম, শফিক, রফিক, জব্বারসহ অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে তখন পুলিশের প্রতি ক্রোধে তিনি পাগল প্রায়। আবুল বরকতকে কোলে তুলে নিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়ালেন। সামনে তিনি একা আর কেউ নেই, বন্দুকের গুলির ভয়ে সবাই পিছনে চলে গেছে। তিনি একা বন্দুকধারী তিনজন পুলিশের মুখোমুখি প্রায় তিন মিনিট পর দেখতে পেল পুলিশ তিনজন বন্দুক হাঁটুর উপর থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো এবং পেছনে সরে গেল। ডান দিকে ফিরে নিচের দিকে তাকাল। বারান্দার মেঝেতে বেশ কিছু জায়গাজুড়ে রক্ত জমে আছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি মুখ দিয়ে কোনো ভাষা বের করতে পারেননি। মুহ্যমান ছিলেন কিছুক্ষণ।
‘আমার দেখা একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থে তিনি লিখছেন, ‘আবুল বরকত আমার চেয়ে লম্বা। পরনে ছিল সদ্য ইস্ত্রি করা খাকি রঙের প্যান্ট আর ডোরাওয়ালা সাদা শার্ট। পূর্বে তাকে চিনতাম না। পুলিশের গুলিতে পড়ে যাওয়ার পর তার তাজা খুনে সিক্ত হয়ে তাকে চিনলাম। এই সেই আবুল বরকত যার আহ্! শব্দটি আজ ৬৩ বছর ধরে আমার কানে একই আওয়াজ ধ্বনিত হয় যার ঊরু হতে কলকল ধারায় নির্গত রক্ত প্রবাহ একই তাজা রক্তে আমার মানসে অহরহ ভেসে উঠে। এই সেই আবুল বরকত যার রক্তমাখা দেহের স্পর্শ আমার বুকের অণু-পরমাণুতে নিয়ত অনুভব করি।
ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, শিক্ষা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ-এর জীবন ব্যাপী সাধনা ও নিষ্ঠাপূর্ণ অবদান যেমন গৌরবময় তেমনি বিস্ময়কর। তিনি উর্দুর বিপক্ষে ছাত্রাবস্থা থেকেই আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নকালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাচর্চায় অপরিসীম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। এবং ভাষা আন্দোলনে এক অনন্য শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী ব্যাক্তি। জাতির জন্য অনস্বীকার্য। এদেশের ভাষা স্বাধীনতার ইতিহাসে ঐতিহ্যের সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ প্রণীত ‘আমার দেখা একুশে ফেব্রুয়ারি’ গ্রন্থ থেকে আরও জানা যায়, আবুল বরকতের তাজা রক্তে ভেজা তাঁর কাপড় ও জুতা বহুদিন সযত্নে রাখতে পারেননি বলে তিনি আফসোস করেন এখনও।
২০০০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন। সে প্রায় ৪০টি দেশের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপদেষ্টা ছিলেন। ভিয়েনায় মসজিদ নির্মাণ সহায়তাসহ জাতিসংঘ বিল্ডিংয়ে জুম্মার নামাজের ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় ১২ বছর সেখানে জুম্মার খুতবা প্রদান করেন।
কাব্যসাধক ড. জসীম উদ্দিন আহমেদের বিরচিত গ্রন্থ ৩৬টি। তিনি ২০১৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এটিএন বাংলায় প্রচারিত নৈশব্দ যোদ্ধা শিরোনামের একটি টিভি নাটকে অভিনয় করেন। খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে একুশে পদক লাভ করেন।
ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ মৃত্যুবরণ করেন ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালের বুধবার বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর । ব্রেইন স্ট্রোক হলে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিশিষ্ট জ্ঞানতাপস, ভাষাসৈনিক, শিক্ষাবিদের জন্ম ১৯৩৩ সালের ১ জানুয়ারি। জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির গলিয়ার চর গ্রামে। পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে ওয়াজ উদ্দিন আহমেদ, রাহাতুন্নেছা। গৌরীপুর সুবল আফতাব উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ মেট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫০ আইএসসি ও বিএসসি। ১৯৫২ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া মহাবিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হন। এবং এমএসসি ১৯৫৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পাস করেন। সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে এবং এমএসসি-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৫৬ ঢাকা সরকারি মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক, ১৯৫৭ পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে যোগদান ও উচ্চশিক্ষার্থে আমেরিকায় যান। আণবিক বিকিরণ নিরাপত্তা বিষয়ে এমএস ডিগ্রি লাভ ১৯৫৯। পাকিস্তানে ফিরে করাচি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশন ল্যাবরেটরিতে যোগদান।
১৯৬১ ঢাকায় বদলি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউক্লিয়ার মেডিসিন কেন্দ্রে স্থাপনের দায়িত্ব। ১৯৬৩ পুনরায় আমেরিকা ইউনিভার্সিটি অব মিসিগান থেকে ১৯৬৬ পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ করাচি হেড অফিসে বদলি হন এবং ডিরেক্টর পদে থাকাকালীন ১৯৭০ সরকারের স্পন্সরশিপে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি ভিয়েনাতে যোগ দেন। উক্ত বিভাগের পরিচালক এবং প্রধান থাকাকালীন ১৯৯৪ অবসর গ্রহণ। ২০০০ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও পূর্ব পাকিস্তানের গণমানসে স্বাধীনতার চেতনা সুপ্ত হয়নি। স্বাধীন হয়ে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যায়। এবং ভাষা আন্দোলন থেকে দেশকে স্বাধীন করে ছাড়বে। একুশ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তানের দামাল ছেলেরা সশস্ত্র সংগ্রাম ও বিপ্লবের ইতিহাস রচনা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে। এটা সম্ভব হয়েছে অনেকগুলো কারণের মধ্যে বিশেষ একটি কারণে। সেটা হচ্ছে— জ্বলন্ত ভাষাপ্রেম। ভাষাপ্রেমীদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না। ব্যক্তিগত কোনো লাভ তারা আশা করেনি। তথাপি একটা সুসজ্জিত শক্তিশালী পরাক্রান্ত বাহিনীর মোকাবেলা করতে দ্বিধা করেনি।
ট্রেনিং ছিল অল্প দিনের। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছিল সামান্য। তবুও কারও প্রলোভনে নয় বলপ্রয়োগে নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাপ-মাকে না জানিয়ে ভাষার হাতছানিতে একদিন তারা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে বেরিয়ে পড়েছে। স্বদেশ কিংবা যে-কোনো আদর্শে উদীপ্ত হলে খর্বকায় শীর্ণদেহ তরুণ ও ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতে পারে। আগ্রাসনের মুখে স্বাধিকার রক্ষায় জ্বলন্ত দেশ প্রেমই প্রধানতম অস্ত্র হয়ে ওঠে। অস্ত্রের চেয়ে আত্মত্যাগ ব্যাপক সদ্ব্যবহার দেখিয়েছে বাংলাদেশের তরুণ যোদ্ধারা।
উল্লেখ্য, এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ দিতে পারি। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালালে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে আব্দুল বরকত, সালাম, শফিক রফিক জব্বারসহ অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। এই খবর পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে প্রচারিত হয়। এই খবর শুনে ড. জসীম উদ্দিন আহমেদের মা রাহাতুন্নেছা অস্থির হয়ে পড়েন এবং স্বামী ওয়াজ উদ্দিন আহমেদকে তড়িঘড়ি ছেলেকে আনতে ঢাকা পাঠান। যথাসময়ে তিনি ছেলের কাছে পৌঁছেওছিলেন। কিন্তু ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে অসমর্থন হন। তার কারণ সেদিন আবুল বরকতের রক্ত মাখা জামা কাপড় দেখিয়ে ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ বাবাকে বলেন, এ অবস্থায় আমি বাড়ি যেতে পারি, বাবা? বাড়ি ফিরে গিয়ে আম্মুকে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলুন, বাবা-মায়ের চেয়ে এখন ওদের কাছে দেশ, বরকতের তাজা রক্তের দাম দেওয়া জরুরি।
এখানেই ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ ভাষা আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ। তাই তো বলতে হয়।
মাগো, ওরা বলে,
সবার কথা কেড়ে নেবে
তোমার কোলে শুয়ে
গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাই তো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্য কথার কুঁড়ি নিয়ে
তবেই না বাড়ি ফিরব।
সেদিন ভাষা সৈনিকদের অর্থাৎ ড. জসীম উদ্দিন আহমেদ-এর কাছে মা-বাবা, আত্মীয়-বন্ধু সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই-সংগ্রাম।