
সে রাতে খুব কালবৈশাখের ঝড়-ঝঞ্ঝা ছিল। সেই ঝড়ের মধ্যে মা অন্য এক ঝড় মোকাবেলা করছিলেন। মায়ের প্রসব বেদনা উঠেছিল। মায়ের পাশে ছিলেন বাবার বড়ো মামি। বাবার এই বড়ো মামিকে আমরা ডাকতাম কালাবু। বড়ো হয়ে মায়ের কাছে শুনেছি, এই কালাবু ছিলেন আমার দাইমা।
আমার জন্মের সময় শুধু এই কালাবু ছিলেন মায়ের পাশে। আমাদের ঘরের একেবারে মধ্যের রুমটায় তখন মাকে নিয়ে কালাবু অবস্থান করছিলেন। আমাদের ঘরের চারপাশে চারটা বারান্দা ছিল। মাঝখানের এই ঘর থেকে সব বারান্দায় যাওয়া যেতো। কিন্তু আমার জন্মের মুহূর্তে অন্য বারান্দায় যাবার দরজাগুলো কালাবু ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কালাবুকে সহযোগিতা করার জন্য ঘরের দক্ষিণ পাশের বারান্দায়, যেখানে মা-বাবা ঘুমাতেন, সেখানে তখন অবস্থান করছিলেন বাবা, আমার দাদি, সেজো কাকি, ছোটো কাকি, জোহরা ফুফু আর আমীর দুদু। ঘরের উত্তর পাশের বারান্দায় অবস্থান করছিল আমার বড়ো ভাইবোনেরা (দুই ভাই ও তিন বোন) আর ছোটো কাকা।
ঘরের পশ্চিম পাশের বারান্দায়, যেটা আমাদের সামনের বারান্দা, সেখানে অবস্থান করছিলেন সোনাখালু, ছোটো খালা আর জামির মামা। জামির মামা তখন আমাদের বাড়িতে থাকতেন। আমাদের সকল গৃহস্থ কাজ দেখাশোনা করতেন। মা’র দূর সম্পর্কের ভাই হলো জামির মামা।
কালাবু মাঝে মাঝে শুধু ঘরের দক্ষিণ পাশের দরজা খুলে ওই রুমের সবাইকে মা’র পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে তা জানাচ্ছিলেন। প্রায় দুই-আড়াই ঘণ্টা ঝড়-বৃষ্টি হলো। ঝড় যখন প্রায় কমে এসেছিল, মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টির মধ্যে, তখন কেবল মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। তখন কালাবু আবার দরজা খুলে জোহরা ফুফুকে ভেতরে নিলেন।
ঠিক তার কয়েক মিনিটের ভেতরেই আমার জন্ম হলো। মেঘের গর্জন ছাপিয়ে আমার কান্নার চিৎকারে গোটা বাড়িতে তখন খুশির বন্যা নেমে এসেছিল। সামনের বারান্দা থেকে ছোটো খালা আর দক্ষিণ পাশের বারান্দা থেকে ছোটো কাকি তখন জোর করে সেই ঘরে ঢুকেছিলেন আমাকে দেখার জন্য।
আমাদের ঘরের ঠিক উত্তর পাশে সেজো কাকার ঘর। সেই ঘরে ঝড়ের সময় ছিলেন আমার ছোটো ফুফু। ছিলেন না বলে বলা যায় ঝড়ের সময় আটকা পড়েছিলেন। নইলে বেগম ফুফুও বাবার সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ পাশের বারান্দায় থাকতেন তখন। আমার জন্মের খবর মুহূর্তে সেজো কাকার ঘরে পৌঁছালে বেগম ফুফু বৃষ্টি, কাদা মাড়িয়ে হুড়মুড় করে আমাদের ঘরে এসেছিলেন।
আর ছোটো খালা ও ছোটো কাকিকে হারিয়ে দিয়ে ছোটো ফুফুই কালাবু’র কাছ থেকে সবার আগে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। আর আমার নামটা ছোটো ফুফু রাখবেন বলে তখনই আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন সকালে ছোটো ফুফু আমার নাম ঘোষণা করলেন।
বাবার হাতের ঘড়ির সময় অনুসারে, আমার জন্ম হয়েছিল সোমবার দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরের দেড়টার একটু এদিক সেদিক সময়ে। মানে ৮ই বৈশাখ ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের মঙ্গলবার। ইংরেজি ১৯৭০ সালের ২১শে এপ্রিল। আমাদের সব ভাইবোনদের জন্মক্ষণ, দিন, তারিখ বাংলা ও ইংরেজি মাস ও বছর অনুযায়ী বাবা তার নীল ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। বাবার সেই নীল ডায়েরির লেখা বড়ো হয়ে আমি দেখেছি।
বাবার বন্ধু ডা. শিবচন্দ্র হিরা জ্যোতিষচর্চা করতেন। শিব কাকার পরামর্শ মেনেই বাবা আমাদের ভাইবোনদের জন্ম তারিখ লিখে রাখায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। তার একটা কারণও ছিল। পরে শিব কাকা জন্মক্ষণ, দিন, তারিখ অনুযায়ী আমাদের কুষ্ঠি গণনা করতেন। পরদিন সকালে বাবা শিব কাকার কাছে গেলেন আমার কুষ্ঠি গণনা করাতে।
শিব কাকা আমার সম্পর্কে প্রথম যে কথাটি তখন বলেছিলেন সেটি হলো- এই ছেলে প্রচন্ড রকমের রাগী ও বদমেজাজি হবে। ভারী দুরন্ত হবে। দুদণ্ড ঘরে থাকতে চাইবে না। দেশ-বিদেশ ঘুরবে। লেখাপড়ায় পটু হবে। তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তির অধিকারী হবে। এই ছেলে যত বড়ো হতে থাকবে, ততই ওর নামে বাড়িতে নানান কিসিমের নালিশ আসতে থাকবে। ওর নামে নালিশ না শোনা ছাড়া তোমার পেটের ভাত হজম হবে না, নানা।
শিব কাকার কুষ্ঠি গণনা শুনে বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখে কাকা তখন বলেছিলেন, দুঃশ্চিন্তার কিছু নাই, নানা। এই ছেলে মাছ ধরায় যেমন পটু হবে মারামারিতে তেমন পটু হবে, খেলাধুলায়ও পটু হবে। আর স্কুলে যদি যায় তো লেখাপড়ায়ও সাংঘাতিক পটু হবে। সবকিছু নির্ভর করবে তুমি ওকে কোনদিকে নামাবা তার উপর। স্কুলে না গেলে নামকরা ডাকাত সর্দারও হতে পারে। হা হা হা হা…
জ্যোতিষশাস্ত্র যা বলে তা হলো- এই ছেলে সাংঘাতিক ডানপিটে হবে। পারতপক্ষে কারো কথায় পাত্তা দেবে না। নিজের যা ভালো মনে হবে তাই করবে। ও শান্তির মা, আমাদের আরেক পশলা পান দাও, বলে শিব কাকা আমার কুষ্ঠি গণনায় তখন এভাবেই ইতি টানলেন।
শিব কাকা বাবাকে ডাকতেন নানা। আর বাবা শিব কাকাকে ডাকতেন নাতি। আমরা তাকে শিব কাকা ডাকতাম। বাবাকে শিব কাকার মা ধর্মবাবা ডেকেছিলেন। সেই থেকে শিব কাকার মাকে আমরা বড়দির মতো জানতাম। আমরা তাকে ডাকতাম ঠাম্মা। ঠাম্মা যতদিন বেঁচে ছিলেন রোজ এক-দুবার আমাদের বাড়িতে আসতেন।
আমাদের বাড়ির চারপাশে পুকুর ছিল। আমি যখন হামাগুড়ি দেওয়া শিখলাম, তখন প্রায়ই নাকি ক্লোরিং করে করে সেই পুকুরে গিয়ে নামতাম। আমাকে আটকানোর জন্য তখন পুকুর ঘাটে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে বেড়া দেওয়া হয়েছিল। আমি সেই বাঁশের বেড়া টপকেও নাকি পুকুরে নেমে যেতাম। পরে হামিদ জামাই আর জামির মামা বিশেষ কায়দায় ঝুনা নারকেলজোড়া দিয়ে আমাকে সাঁতার শেখালেন। ছোটোবেলায় যে কারণে আমি হাঁটা শেখার আগেই এভাবে সাঁতার শিখেছিলাম।
বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মহেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যাকে আমরা ডাকতাম দাদু। মহেন্দ্র দাদু রোজ আমাদের বাড়িতে আসতেন। বাবাও রোজ মহেন্দ্র দাদুর বাড়িতে যেতেন। শিব কাকাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়ি হলো মহেন্দ্র দাদুর বাড়ি। সবাই বলতো বৈরাগী বাড়ি। মহেন্দ্র দাদুর ছোটোছেলে প্রকাশ হলো আমার ছোটোবেলার বন্ধু। প্রকাশ বয়সে আমার চেয়ে ঠিক সাড়ে চার মাসের ছোটো। কিন্তু আমরা ছোটোবেলা থেকেই একসঙ্গে একই ক্লাসে পড়তাম। আমাদের পড়াশুনায় হাতেখড়ি হয়েছিল দিনো’র মা’র পাঠশালায়।
মহেন্দ্র দাদু খুব চা পছন্দ করতেন। দাদু আমাদের বাড়িতে আসলেই মাকে দেখতাম চা বানাতে। সেই সুযোগে আমি তখন চুরি করে চিনি খেতাম। দাদু বারান্দায় বসে বাবার সঙ্গে খুব মজার মজার গল্প করতেন। আর দুজনে ভারী অট্টহাসিতে গোটা বাড়ি একেবারে কাঁপিয়ে দিতেন। কিন্তু সেই হাসির উৎস কী তা তখন আমি একদম বুঝতাম না। দাদুর চা খাওয়া শেষ হলে প্রায় সময় কাপ নেবার জন্য আমি ওত পেতে থাকতাম। কারণ কাপের নিচে একটু চা আর একটু চিনি জমা হয়ে থাকতো। কাপ নিয়ে ওটা আমি তখন ইচ্ছেমতো চেটেপুটে খেতাম।
আমাদের পাঠশালার পাশেই ছিল হরিসভা। দিনো’র মা’র পাঠশালা আর হরিসভার মাঝখানে লাগোয়া ছিল বিপদভঞ্জন দাদুর বাড়ি। বিপদ দাদু কীর্তন করতেন। তিন মেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে তার একটা কীর্তনের দল ছিল। দাদু খুব লম্বা ছিলেন। কীর্তনের সময় দাদু খোল বাজাতেন। আর বাড়িতে ছেলেমেয়েদের গানের তালিম দিতেন।
বিপদ দাদুর একমাত্র ছেলে বিনয় আমাদের সঙ্গে দিনো’র মা’র পাঠশালায় পড়তো। হারমোনিয়াম বা ঢোলের শব্দ শুনলেই আমার পড়ালেখার তখন বারোটা বেজে যেতো। আমি বিনয়ের সঙ্গে বা কখনো একা একা পাঠশালা থেকে পালিয়ে বিপদ দাদুর ঘরে গিয়ে সেই গান শেখানো দেখতাম। বিপদ দাদু তখন আমাকে কোলের মধ্যে বসিয়ে হারমোনিয়াম, ঢোল বা খোল বাজাতেন।
পাঠশালা ছুটির সময় হলে আমি বিপদ দাদুর বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে বাল্যশিক্ষা পাঠের লাস্ট সেশনে যোগ দিতাম। সাধারণত পাঠশালা ছুটির সময় আমাদের লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে একজনকে অনুসরণ করে পড়া শেখার নিয়ম ছিল। অনেকটা মিছিলের স্লোগান ধরার মতো।
সেখানে বিভিন্ন ঘরের নামতা, সতক্ষিয়া, কড়াক্ষিয়া এসব চিৎকার করে কোরাস করার নিয়ম ছিল। সাধারণত উপরের ক্লাসের কেউ সেই কোরাসে লিড করতো। যে লিড করতো সে বলতো- ক’য় আ-কারে কা। আমরা সবাই পরপরই গগণবিদারী চিৎকারে বলতাম ক’য় আ-কারে কা। ক’য় রসসি কারে কি। আমরাও বলতাম- ক’য় রসসি কারে কি। কিংম্বা- পাঁচ ওক্কে পাঁচ, পাঁচ দুই গুনে দশ, তিন পাঁচা পনের, চার পাঁচা কুঁড়ি, পাঁচ পাঁচা পঁচিশ, পাঁচ ছয় গুনে ত্রিশ, পাঁচ সাতে পঁয়ত্রিশ, পাঁচ আটা চল্লিশ, পাঁচ নং পঁয়তাল্লিশ, পাঁচ দশে পঞ্চাশ। এভাবে নামতা পড়া শেষ হলেই আমাদের পাঠশালা ছুটি হতো।
পাঠশালায় এই শেষ সেশনটা আমার খুব মজা লাগতো। তাই ওটাতে আমি প্রায় সবসময়ই যোগ দিতাম। ছোটোবেলায় তালের পাতায় দোয়াতে গোলানো কালিতে আমরা লিখতাম। যার কালি গোলানো যতো ভালো হতো, তার লেখা ততো স্পষ্ট হতো। প্রায়ই আমি একবার কি দুবার দিদিমণিকে লেখা দেখানোর পরেই এক ফাঁকে পালিয়ে বিপদ দাদুর ডেরায় গিয়ে হাজির হতাম।
আর পাঠশালা ছুটির আগে আগে ওই কোরাসে গিয়ে যোগ দিতাম। একবার কি নিয়ে যেনো বিনয়ের সঙ্গে আমার মারামারি হলো। এখন তা আর মনে নেই। পরদিন যথারীতি পাঠশালা থেকে পালিয়ে বিপদ দাদুর ডেরায় গিয়ে গান শেখানো দেখছিলুম। বিনয় হয়তো আমার উপর নজর রেখেছিল। তারপর আমার পালানোর খবর দিদিমণির কানে গেল।
কিন্তু সেদিন নামতা করার সময় দিদিমণি কিচ্ছু বললেন না। পরদিন স্কুলের সময় আমি যথারীতি যখন পালিয়ে বিপদ দাদুর গান শেখানো দেখছিলুম, ঠিক পাঠশালা ছুটির অনেক আগেই সেখানে বাবা গিয়ে হাজির। পরে বুঝেছিলাম, দিদিমণি বাবাকে কাউকে দিয়ে আমার পালিয়ে এই গান শেখা দেখার ব্যাপারে নালিশ দিয়েছিলেন। যা হাতেনাতে ধরার জন্য বাবা সেদিন সেখানে গিয়েছিলেন। বাবা গিয়ে একটা ঝামেলা করেছিলেন। বিপদ দাদুকে বলেছিলেন, ওদের পাঠশালা চলাকালীন সময়ে গান-বাজনা বন্ধ রাখার জন্য। পরদিন পাঠশালায় গিয়ে আর বিপদ দাদুর কোনো সাড়া পাই না। একবার হিসু দেবার অছিলায় বিপদ দাদুর বারান্দায় উঁকি দিলাম। দেখলাম, বিপদ দাদু ভারী মনযোগ দিয়ে পঞ্জিকা পড়ছেন।
তারপর থেকে পাঠশালা চলাকালীন সময়ে আর গান-বাজনা হতো না। আমারও তখন পাঠশালায় আর ভালো লাগতো না। ততদিনে আমি তালের পাতা ছেড়ে সিলেটে লেখার যোগ্যতা অর্জন করেছি। বাবার উপর সেই ক্ষোভ মেটাতে পাঠশালা থেকে ফেরার পথে আমি নতুন সিলেট তালগাছের সঙ্গে আছার মেরে গুড়া করতাম।
পরের কয়েক দিন সেই ভাঙা সিলেট নিয়ে পাঠশালায় যেতাম। আর দিদিমণি খুব বকা দিতেন। হাটের দিন বাবা আবার নতুন সিলেট কিনে দিতেন। যার দশাও এক সপ্তাহ পরে একই হতো। পরে বাবা কৌশল করে মাটির সিলেটের বদলে আমাকে কাঠের সিলেট কিনে দিলেন। এবার আর সিলেট ভাঙতে পারি না। তখন এক বুদ্ধি বের করলাম, কাঠের সিলেটে লেখা তেমন উজ্জ্বল হয় না। অস্পষ্ট দেখায়। ওতে আমি লিখব না। আমার কাগজ, পেনসিল চাই- এমন আপত্তি তুললাম।
বাড়িতে এসে মা’র কাছে দাবি তুললাম, হয় আমাকে খাতা, পেনসিল কিনে দিতে হবে নইলে আমি আর পাঠশালায় যাবো না। খাতা, পেনসিল পেলে আমি বড়ো বুজির সঙ্গে প্রাইমারিতে যাবো। কিন্তু প্রাইমারির আগে খাতা দেবার তখন নিয়ম নাই। আগে পাঠশালা থেকে দিদিমণি সুপারিশ করলেই কেবল পাঠশালা ছেড়ে প্রাইমারি যাবার পারমিশন মিলবে।
আর সবার তখন ধারণা ছিল, প্রাইমারিতে ছোটোদের ক্লাসে তেমন লেখাপড়া হয় না। যা শেখার দিনো’র মা’র পাঠশালায় ভালো করে শিখেই তারপর প্রাইমারি যেতে হবে। যাকে বলে ওই সময় আমাদের মতো লিলিপুটদের জন্য মহাফাঁপর আরকি!!
তারপর নতুন বুদ্ধি করলাম। রোজ পাঠশালায় গিয়ে এর-ওর সাথে মারামারি করি। এক সময় দিদিমণি অতিষ্ট হয়ে বাবাকে ডেকে বললেন, এই ছেলে রোজ এসে যার তার সঙ্গে মারামারি করে। ওকে আর আমার পক্ষে সামলানো সম্ভব না। আসল ঘটনা হলো, আমাদের সঙ্গে পাঠশালায় আসতো শশোদা। শিব কাকার ভাগ্নে।
শশোদা আমাদের চেয়ে বয়সে একটু বড়ো। ভারী দুষ্টু। কিন্তু অজ্ঞাত রহস্যময় কোনো কারণে শশোদা আমাকে খুব পছন্দ করতো। একটা কারণও ছিল, প্রায়ই আমি শশোদার লেখা লিখে দিতাম। শশোদা আমার লেখাই দিদিমণিকে দেখিয়ে পার পেয়ে যেতো। কিন্তু দিদিমণি পড়া জিজ্ঞেস করলে আর পারতো না। তখন খুব বকাঝকা আর মারধরের ব্যাপার ছিল।
তো শশোদা একদিন আমাকে বললো, ‘ভাডি, চল আমরা এক কাজ করি। রোজ কাউরে না কাউরে মাইর দি। দিদিমণি অতিষ্ট হয়ে আমাদের পাঠশালা থেকে তাড়িয়ে দিক। তাইলে দুজনেই বাঁচি।‘ শশোদার বুদ্ধি আমার খুব পছন্দ হলো। তারপর থেকে রোজ কাউরে না কাউরে মাইর দেওয়া ছিল আমার আর শশোদার মিশন। এক সময় দিদিমণি অতিষ্ট হয়ে বাবাকে ডেকে নালিশ দিলেন। বাবা আমাকে পাঠশালা থেকে ছুটিয়ে প্রাইমারিতে ভর্তি করে দিলেন। আমার পাঠশালার প্রায় সকল বন্ধুবান্ধবও কিছু দিনের মধ্যে প্রাইমারিতে চলে আসলো।
কিন্তু শশোদা আর স্কুলে আসে না। স্কুলের সময় কিন্তু ঠিকই আমাদের সঙ্গে খেলতে আসে। একদিন শশোদার মা আর বড়ভাই মরাইদা (নলীনিদা) বাবার কাছে নালিশ দিলেন যে, শশো আর স্কুলে যায় না। বাবা শশোদার বাড়িতে গিয়ে শশোদাকে ভালোমতো শাসিয়ে প্রাইমারিতে নিয়ে আসলেন।
চাপে পরে শশোদা প্রাইমারিতে ভর্তি হলেন বটে কিন্তু পড়াশুনায় তার ভারী অনীহা। শশোদা প্রায়ই আমাকে তার মনের কথা বলতো- ‘ভাডি, লেহাপড়া আমার ভালো লাগে না। চল বলেশ্বরে গিয়ে ডুবাডুবি করি।‘ আমিও শশোদার ঢোলের বাড়িতে তখন একপায়ে খাঁড়া।
বলেশ্বরে ডুবাডুবি করার জন্য প্রায়ই স্কুলে যাবার সময় একটা প্যান্টের উপর লুকিয়ে আরেকটা প্যান্ট পড়তাম। যেদিন প্যান্ট নিতে না পারতাম, সেদিন বার্থডে ড্রেসেই বলেশ্বরে আমাদের ডুবাডুবি চলতো। এখনো আমি বলেশ্বরের সেই ডুবাডুবি খুব মিস করি। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কতো যে বলেশ্বরে ডুবাডুবি করেছি, আহা সেই দিনগুলি কোথায় যে হারিয়ে গেলো।
ওই সময় আমাদের সঙ্গে স্কুলে যোগ দিলেন জীবনদা। জীবনদার বড়ো ভাই চিত্তদা আর কাকিমা এসে বাবার কাছে নালিশ দিলেন যে, অভিলাষকে যে করেই হোক স্কুলে পাঠান। ওর নালিশ শুনতি শুনতি আমরা অস্থির। চিত্তদা বললেন, কাকা, পারলি ওর হাড়গোড় গুড়া কইরা হলিও ওরে একটু স্কুলে দেন। আর নালিশ সহ্য হয় না।
পরবর্তী সময়ে হাইস্কুলে নাইনে যখন রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে তখন জীবনদা নিজের নাম পাল্টে জীবন কৃষ্ণ ঘরামী রাখছিলেন। এর আগ পর্যন্ত জীবনদা ছিল অভিলাষ ঘরামী। আমরা ডাকতাম হরবিলাশ।
তারপর থেকে রোজ গ্রামের যেখানে যেখানে স্কুল পালানো পোলাপাইন চাঁপা বা মার্বেল খেলতো, সেখানে সেখানে বাবা হামলা করা শুরু করলেন। তারপর বাবার তাড়া খেয়ে অভিলাষ এসে স্কুলে ভর্তি হলো। এবার দুষ্টামি করার মাত্রা আমাদের আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল।
আমাদের গ্রামের স্কুল পালানো পোলাপাইনদের প্রায় সবারই বাবার হাতের মাইর খেয়ে স্কুলমুখি হবার রেকর্ড আছে। আর এরা সবাই আমাদের চেয়ে বয়সে বড়ো হলেও পড়তো আমাদের সঙ্গে আমার ক্লাসে।
আমরা যখন থ্রি-ফোর ক্লাসের স্টুডেন্ট, তখন এই অভিলাষের পাল্লায় পরেই প্রথম দাঁড়ি-গোঁফ শেভ করা শুরু করলাম। অভিলাষ স্কুলে ভাঙা ব্লেড নিয়ে আসতো। অভিলাষের তখন একটা দুইটা দাঁড়ি-গোঁফ হয়েছে। পুরপুরো শেভ করার মতো না। কিন্তু সে স্কুলে ভাঙা ব্লেড নিয়ে আসতো।
আমরা বলেশ্বরের হাঁটুজলে কাদামাটি মুখে মেখে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর অভিলাষ আমাদের সেই ভাঙা ব্লেড দিয়ে সবার একে একে শেভ করে দিতো। শেভ করার পর কয়েকদিন পর্যন্ত পুরো গাল একদম লাল হয়ে থাকতো। একটু জ্বালা পোড়াও করতো। পরে প্রকাশ আর আমি বুদ্ধি করে অভিলাষকে বেশ কয়েকবার নানান কিসিমের নাকানি-চুবানি দিয়েছিলাম।
আমরা যখন হাইস্কুলে পড়তাম, তখন একবার অভিলাষের উপর আমি চরম বিরক্ত হলাম। প্রকাশ আর আমি বুদ্ধি পাকিয়ে জোড়াসাঁকোর একটা থেকে ওকে খালে ফেলে দিয়েছিলাম। আরেকবার অভিলাষকে মারার জন্য গজারি কাঠের আড়াই হাতের লাঠি বানালাম। স্কুল থেকে ফেরার সময় অভিলাষ নানান ছুতায় আমাদের সঙ্গে বিবাদ করতো।
আমাদের ইরিধানের আইলের পাশে আগেরদিন লাঠি লুকিয়ে রেখেছিলাম। স্কুল থেকে সেই পথে ফেরার সময় হঠাৎ অভিলাষের উপর আমি লাঠি নিয়ে চড়াও হয়েছিলাম। বিশেষ করে ওর পায়ে যে মাইরটা দিয়েছিলাম, এখনো মনে পড়লে আমি নিজেই আঁতকে উঠি, কেমনে পেরেছিলাম!!
মূলত, আমার সেই গজারির লাঠির মাইর খাওয়ার পর থেকে অভিলাষ আর কখনোই আমার সঙ্গে লাগতে আসতো না। পরে আমাদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বন্ধুত্বের দিকে এগিয়েছিল। এরকম কতো হাজার দুষ্টামিতে যে আমার ছোটোবেলা ভরপুর ছিল, তা আর কি বলবো।
শশোদা আর হাইস্কুলে যায়নি। প্রাইমারি থেকেই ঝড়ে গিয়েছিল। আমরা কলেজে ওঠার আগেই শশোদা বিয়ে করলো। অভিলাষ মানে আমাদের জীবনদা এখন একজন পাক্কা রাজমিস্ত্রি। আমার ছোটোবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জীবনদা। আমার ‘হরিবোল’ সিনেমায় অভিনয়ও করেছে। প্রকাশ কানাডায় ইমিগ্র্যান্ট হয়ে এখন পুরোপুরি কানাডিয়ান নাগরিক।
আমরা হাইস্কুলে ওঠার পর বিপদ দাদু বিনয়দের নিয়ে কলকাতা চলে গেলেন। আমাদের সঙ্গে আরও যারা তখন পড়তো যেমন ঋষিকেশ, কৃষ্ণ, বীরেন ওরাও ভারতে চলে গেলো। সুনীল এখন মুদি দোকানদার। আমার ‘হরিবোল’ সিনেমায় অভিনয়ও করেছে। বাড়িতে গেলে এখনও সুনীলের দোকানে বসে বসে দাবা খেলা আমার একটা অন্যতম প্রধান কাজ।
শৈশবে যাদের সাথে খুব মারামারি করেছি, বড়ো হতে হতে তাদের সাথেই জীবনের এক অন্যতম হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে। এই সম্পর্কটা একদম খাঁটি। এরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে, আমিও এদের সবাইকে ভালোবাসি। ছোটোবেলায় মারামারি করা, একসঙ্গে খেলাধুলা করা, সাঁতার কাঁটা সেই সব বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে এখন কতো যে আপন লাগে তাদের।
কতো মধুর মধুর স্মৃতি যে তাদের সঙ্গে, যা সবই আমার এক জীবনের অন্য সকল ঘটনার মতো সত্য। এই সত্য কখনোই আমি আড়াল করতে চাই না। কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে। আহা কতো মধুর ছিল ছেলেবেলার সেই সব দিনগুলি। জয়তু অমর বাল্যকাল! জয়তু আমার বন্ধুরা!
___________________
৮ই বৈশাখ, ১৪২৯
২১শে এপ্রিল, ২০২২
ঢাকা।