অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৭, ২০২৪
১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মো. ফোরকান মোল্লা -
এক উপেনের জীবনালেখ্য : মানব মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের আখ্যান

ছোটগল্প নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলমান, ছোটগল্পের আকার-ধরণ, কলেবর নিয়ে মতভেদ চলমান, ছোটগল্পের শিল্পগুণ-মান-মর্যাদা নিয়ে সমালোচনা দৃশ্যমান। ছোটগল্পের কাহিনী, বর্ণনা, চরিত্র সৃষ্টি, সংলাপ নিয়েও মতনৈক্য দেখা যায়। বর্ণনাত্মক শিল্প, না সংলাপনির্ভর শিল্প, না কেন্দ্রীয় চরিত্রনির্ভর শিল্প, না অনেক চরিত্রের প্রাধান্য শিল্প, না চরিত্রশূন্যশিল্প তা নিয়েও আছে আলোচনা-সমালোচনা। চরিত্রের ঘনঘটা থাকবে, নাকি ন্যূন চরিত্র নিয়ে গল্প অগ্রসর হবে, নাকি গল্পহীন গল্প হবে, নাকি গল্পই থাকবে থাকবে না গল্পের বাইরে মেদকথা তা নিয়েও সাহিত্যবোদ্ধাদের মধ্যে মতান্তর আছে। ছোটগল্পের এতদিক বিবেচনা করে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে আজও ছোটগল্পের প্রকৃত সংজ্ঞাটা অধরা থেকে গিয়েছে। তবে সরলমনা, সৌন্দর্যচেতনা, সাহিত্য আস্বাদনপ্রিয়, সাহিত্যের একনিষ্ঠ সমঝদার ব্যক্তিরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে পাঠ থেকে তৃপ্তিটুকু নিয়ে ক্ষ্যান্ত থাকেন। ছোটগল্পে জীবনবোধ, শ্রেয়চেতনা, সৌন্দর্যবুদ্ধির প্রয়োগ, রূপচেতনা, একটু দ্রোহচেতনা থাকলেই আত্মতৃপ্তি থেকে যায়। বর্ণনা বিচিত্র ও বহুধা না হয়েও, বর্ণনা ও চিত্রণ বিচিত্র না হয়েও, বিচিত্র বর্ণনা ও বহুধা না হয়েও ছোটগল্পে গল্পের উপস্থিতি থাকলেই ছোটগল্প স্বার্থক। গল্পহীন বর্ণনার মতো কুৎকৌশলের আশ্রয় নিলে তা কখনো ছোটগল্প হবে না যতই তা ক্ষীণতনু হোক, হোক ঝটকায় শুরু ঝটকায় শেষ। ছোটগল্পের প্রাণভ্রমরা গল্পই, ছোটগল্পে গল্পের মাংস থাকতেই হবে, বর্ণনায় কৌশলতা না দেখিয়ে। কালোত্তীর্ণ হওয়ার চিন্তায় একটি ছোটগল্পকে ছোটগল্প হিসেবে সার্টিফিকেট প্রদান আর অধিকাংশ ছোটগল্পকে মানহীন বর্ণনা বাতুলতা।

মানুষের জীবনবিন্যাস আর দৃষ্টিভঙ্গি থাকে ছোটগল্পে। জীবনচিত্রের কোনো ঘটনাংশ গল্পরূপে প্রকাশ থাকে ছোটগল্পে। মানবচরিত্রের দহন-পীড়ন, ব্যথা-বেদনা, হাস্যরস থাকে ছোটগল্পে। জীবনের বিশিষ্ট খণ্ডাংশ ছোটগল্পে রূপায়িত হয়। নাতিদীর্ঘ সাহিত্য-রূপসৃষ্টি হলো এই ছোটগল্প। বর্ণনাত্মক শিল্প অপেক্ষা হঠাৎ আরম্ভ আর হঠাৎ উপসংসার বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শিল্প ছোটগল্প।

সৌমেন দেবনাথের দ্বিতীয় ছোটগল্পগ্রন্থ ‘এক উপেনের জীবনালেখ্য’ ব্যঞ্জনাধর্মী সৃষ্টিকর্ম। ছোটগল্পগুলোর কাহিনী টানটান, তীব্র গতিবেগসম্পন্ন। গল্পের বর্ণনা, শব্দচয়ন ও অলংকার প্রয়োগ তাৎপর্যবাহী। জীবনকে গভীর ও সূক্ষ্মদৃষ্টিতে অবলোকন করেই ছোটগল্পগুলোর প্লট নির্মাণ করেছেন তিনি। মানব মনস্তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করে কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগিয়ে গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন গল্পকার। দশটি ভিন্ন বিষয়কে উপজীব্য করে তিনি দশটি ছোটগল্প রচনা করেছেন। প্রত্যেকটি ছোটগল্পের ঘটনার ঘনঘটা আর বর্ণনার ছটা নান্দনিক।

‘এক উপেনের জীবনালেখ্য’ ছোটগল্পগ্রন্থটির প্রথম ছোটগল্প ‘এক উপেনের জীবনালেখ্য’। ছোটগল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র উপেনের মধ্য দিয়ে গল্পকার বাংলাদেশের বেকার জীবনের চিত্রকে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপেন কোনো একক ব্যক্তি নয়, সমাজ জীবনে পিষ্ট হতে থাকা সেই প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র যার ভেতর প্রবল যাতনার বাস। নির্মম কঠিন বাস্তব জগৎ উপেনের জন্য কত বেশি দুর্বিষহ উপেন চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে গল্পকার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

‘জল চলে না উজানে’ ছোটগল্পটির কেন্দ্রীয় দ্বীপ চরিত্রের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-ব্যথা-বেদনা তুলে ধরেছেন লেখক। সমাজ বাস্তবতায় কালো মানুষের অবস্থান, হেয় হওয়া, তাদের ঘিরে শ্বেতাঙ্গ মানুষের পক্ষপাতমূলক আচরণ আর পরিণতি তুলে ধরেছেন লেখক। দ্বীপ সেই চরিত্র যার মুখ নিঃসৃত সংলাপে আহাজারি, যার মানসিকভাবে হেরে যাওয়া হৃদয়বিদারী, যেগুলো জীবনদর্শনের সেই পরিস্ফূরণ যেখানে কেবল অন্ধকার।

‘অন্য জীবন কথন’ ছোটগল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র জমিরন ভাবি। জমিরন ভাবি চরিত্রটি সেই প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র যার স্বামী বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছে পরিবার, সমাজ তথা দেশের অগ্রগামিতায় ভূমিকা রাখতে আর সে স্বামী শূন্যতায় বহুগামিতা কামনায় লিপ্ত থেকেছে। জমিরন ভাবি জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্য খেয়ালি, হেঁয়ালি, বিবেকবর্জিত যত কাণ্ডকীর্তি করেছেন তা গল্পের মাধ্যমে সামনে এনেছেন। এক ব্যতিক্রম ও ভিন্নধর্মী রস-ব্যঞ্জনায় লেখক জমিরন ভাবি চরিত্রটি সৃজন করেছেন।

‘দুই বসন্ত’ ছোটগল্পটিতে দুটি বসন্তের দেখা যায় যেখানে এক বসন্তে অনল ও দময়ন্তীর প্রেমের প্রকাশ, অন্য বসন্তে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আদর ও স্নেহার ইঁদুর-দৌড়। দুটি ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির প্রকাশ, অভিব্যক্তির প্রকাশ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে দেখিয়েছেন লেখক।

‘মোহন পরিবারের দর্শনচিন্তা’ ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মোহন ও কমলা। যারা স্বামী-স্ত্রী। মোহন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী মনোলোভায় মুগ্ধ থাকার কারণে মোহন আর কমলার মধ্যে যে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় তা এ গল্পের উপজীব্য। সুন্দর সম্পর্কের মাঝে একটি অযাচিত চরিত্র প্রবেশ করলে কত বেশি প্রভাব ফেলতে পারে তা এ ছোটগল্পটি পড়লে বোঝা যায়। মানবজীবনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, নির্বুদ্ধিতা এ গল্পে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।

‘উষ্ণতার সান্নিধ্যহীনতা’ ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রোকেয়া। রোকেয়া নারী সমাজের সেই প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্র যে স্বামী সংসারের একটু ভালোবাসায় ঘর পায়, একটু বীতশ্রদ্ধায় পর হয়ে ঘর হারায়। নারীর ভালোবাসা পাওয়া, পেয়ে হারানোর ফলে সমাজ বাস্তবতায় পরিণতি কী তা এই গল্পে ফুটে উঠেছে।

‘বঙ্কিমের সিদ্ধান্ত’ ছোটগল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্র বঙ্কিম। বঙ্কিম হলো সেই লোভী চরিত্র যে বিয়ে করে সব পেতে চায়। বিয়ের সাথে সাথে বাড়ি-গাড়ি, প্রতিপত্তি, সহায়-সম্পত্তি, শক্তি সবই পেতে চায় এবং তা পাওয়ার ক্ষেত্রে তার চেষ্টাও ছিল প্রবল। কিন্তু নিজের অবস্থান ভুলে গেলে আঘাত পেয়ে ফিরতে হয়। প্রবল লোভী চরিত্র এই বঙ্কিম চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখক অত্যন্ত বাস্তবধর্মী বিষয়কে সবার সামনে এনেছেন।

এক উপেনের জীবনালেখ্য            সৌমেন দেবনাথ                       প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন          প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন    প্রকাশকাল : অক্টোবর, ২০২২          মূল্য : ২৭০ টাকা

‘যত্নশিল্প’ ছোটগল্পের মূল চরিত্র পূর্বা ও রজত, যেখানে পূর্বা ও রজতের মধ্যে খুবই সুন্দর সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। বাঁচতে হলে ভালোবাসার দরকার, ভালোবাসাহীনতায় অঢেল সম্পদের মাঝেও সুখ মেলে না। পরস্পর পরস্পরকে যত্ন নিলে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শ্বাপদসংকুল জীবনপথ পাড়ি দেওয়া সহজ হয়ে যায়। ছোটগল্পটির মধ্য দিয়ে লেখক জীবনের সূক্ষ্ম কিন্তু সত্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো অত্যন্ত দারুণভাবে উপস্থাপন করেছেন।

‘জীবনের দাবি’ ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আসিফ ও রুমিলা। আসিফের চেয়ে রুমিলা দৃঢ়সম্পন্না চরিত্র। সাংসারিক জীবনের নানা জটিল জীবনপ্রবাহ ‘জীবনের দাবি’ গল্পের উপজীব্য বিষয়। পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা, পাশাপাশি পরের নানা বিষয়কে নিজেদের সাথে তুলনা করলে যে মনোদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় সম্পর্কের মাঝে তা নিখুঁত বুননে তুলে ধরেছেন লেখক।

এবং ‘মুখ বাহাদুর’ ছোটগল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুকীর্তি, যে বাকবহুল মানুষ, বাকবিতণ্ডাপ্রিয়, বাকচাতুর্য যার অবলম্বন; তেমনি কাজচোরা, অলস ও সংসারবিমুখ। কর্মনৈপুণ্যতার চেয়ে মানুষের বাকচাতুর্য বেড়ে গেলে সমাজ-সংসারে যে মূল্যহীন হয়ে পড়ে তা ‘মুখ বাহাদুর’ ছোটগল্পে স্পষ্টতর রূপ পেয়েছে।

গল্পগ্রন্থটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও সাহিত্য সমঝদার মো. ফায়েজ মোল্লা। তাঁর লেখা ফ্ল্যাপটিও অত্যন্ত চমৎকার শব্দচয়নে লেখা। ফ্ল্যাপটি সরাসরি তুলে না ধরলে বইটি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব না। ফ্ল্যাপের লেখা :

‘সাহিত্যের অন্যতম সংরূপ ছোটগল্প। জীবনের খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোকে গল্পকারগণ শিল্পরূপ দিতে ব্যপ্ত হলেও বোদ্ধাদের তীর্যক চোখের তরবারি দীপ্তিতে শিল্পস্বীকৃতি পেতে বাধা পায়। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণদৃষ্টিতে গল্পের ভাব-সুষমা, আঙ্গিক-প্রাঙ্গিক, গঠনশৈলী, পরিবেশনভঙ্গিতে ত্রুটি দৃশ্যত হলেও সৌমেন দেবনাথের গল্পগুলি পাঠান্তে মনে হয়েছে বর্ণনা নান্দনিক, শিল্পশর্তেও উত্তীর্ণ। দৈর্ঘ্যে হ্রস্ব কাহিনী-কল্পে মাধুর্য ও সৌন্দর্য সুপরিস্ফুট। সমাজ-সমস্যা, আদর্শ-বৈষম্য, অসামঞ্জস্য, বিসংগতির পাশাপাশি সৌন্দর্যতন্ময়তা, ভাবাদর্শ, স্বপ্ন-কল্পনার সংমিশ্রণে যে গল্পসৌষ্ঠব নির্মিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। মহাকালের ঘূর্ণাবর্তে ব্যক্তিসত্ত্বা হারালেও সৃষ্টিশীল কর্ম মূর্ত-বিমূর্ত পাতায় বেঁচে থাকে। যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে জন্ম সৌমেন দেবনাথের গল্পের ভেতরের যে জীবন বীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ, চারিত্রিক লীলার বিকার-বিকাশ, রস-সৌন্দর্য, যুগ-চিত্ত চৈতন্য উন্মোচিত তা বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক যা কালোত্তীর্ণ হতেও পারে। সৃষ্টিশীল কর্ম শিল্পমানে অনুত্তীর্ণ হলেও সমালোচনার পরিবর্তে সাধুবাদ জানানো যুক্তিযুক্ত। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘দারিদ্র্যের কাঠগড়ায়’-এর মতোই তাঁর এই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘এক উপেনের জীবনালেখ্য’ পাঠকমহলে জনপ্রিয়তা পাক এবং তাঁর মনের মধ্যের গল্পসাহিত্যের সত্তা চারাটি বৃক্ষ রূপ নিয়ে পত্র-পল্লবে সুশোভিত হয়ে ফুলে-ফলে মঞ্জুরিত-বিকশিত হোক এই প্রত্যাশা থাকল।’

মন শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন হলেই তবে ছোটগল্প লেখা সম্ভব। সৃজনশীল না হলে লিখে সৌন্দর্যসৃষ্টি ও আনন্দদান সম্ভব না। সৌমেন দেবনাথের ‘এক উপেনের জীবনালেখ্য’ গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পে সেই ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফূরণ সুস্পষ্টতা। কাহিনী-কল্পের বিষয়বস্তুও চমৎকার। কাহিনীর গতি ও পরম্পরা, উৎকর্ষ, আকর্ষণীয়তা, উৎকণ্ঠা-উদ্বেগ, পরিসমাপ্তি সবই সুন্দরতর না হলেও সুন্দর। ভূপতি মিস্ত্রীকে উৎসর্গ করা বইটি পাঠকমহলে সমাদৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *