অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মার্চ ২৮, ২০২৪
১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
মার্চ ২৮, ২০২৪
১৪ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আবুল কাইয়ুম -
খাতুনে জান্নাত : বস্ত্তনিষ্ঠ ও মুক্ত মানসিকতায় সত্যান্ধ কবি(সূত্র : তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নিসর্গে নিমগ্ন নামতা’)

খাতুনে জান্নাত : বস্তুনিষ্ঠ ও মুক্ত মানসিকতায় সত্যান্ধ কবি(সূত্র : তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নিসর্গে নিমগ্ন নামতা’)
আবুল কাইয়ুম*
….
খাতুনে জান্নাত : নব্বুই দশকে আবির্ভূত এক আলোসন্ধানী কবির নাম। তিনি স্বভাব কবির মতো মনের খেয়ালে কবিতা লেখেন না। তাঁর প্রতিটি কবিতা বুদ্ধিদীপ্ত – ভাষিক ও বৈষয়িক উভয় দিক দিয়েই। সৌন্দর্যবোধ, গভীর চৈতন্য ও চিত্রকল্প ব্যবহারের নিপুণতার জন্য তাঁর কবিতাকে গুণেমানে বিশিষ্ট বলা যায়। তাঁর কবিতাগুলোর শৈলী ও মর্ম পাঠকের চোখের তৃপ্তি ও ভাবনার খোরাক জোগানোর উপযোগী। তাঁর দর্শন নানামুখো চৈতন্যের সংশ্লেষে গড়া; নিসর্গপ্রীতি, মানবিকতা, রোমান্টিকতা, স্বদেশসংলগ্নতা ও ঐতিহ্যচেতনার সমন্বয়ে তাঁর কবিমানস। সবচেয়ে বড়ো কথা, তিনি নিসর্গ-সৌন্দর্যের অভিনিবেশী দর্শক ও উপস্থাপক।
নানা উপচার, বক্তব্য ও দৃশ্যপটের সমাহারে গঠিত কবি খাতুনে জান্নাতের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘নিসর্গে নিমগ্ন নামতা’। বাংলা বাজার, ঢাকার ছিন্নপত্র প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত। ১৬০
নিসর্গে নিমগ্ন নামতা।                 প্রচ্ছদ শিল্পী:খাতুনে জান্নাত     প্রকাশক: ছিন্নপত্র প্রকাশনী।  প্রাপ্তিস্থান: পাঠক সমাবেশ, শাহবাগ, ঢাকা।কবিতা ক্যাফে, কাঁটাবন, ঢাকা। মূল্য :৩৫০ টাকা।

 

পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ১৩৫টি কবিতার প্রতিটি কবিতা যেন এক একটি মুক্তোদানা। কবিতাগুলোর ভাব ও ভাষা অনির্বচনীয় সুষমায় আস্তীর্ণ এবং প্রায়শ ছত্র থেকে ছত্রে ভিন্ন ভিন্ন নান্দনিক বোধে উৎক্রান্ত। আসলে কবির মননে সমকালের তাবৎ বিষয় বিম্বিত হওয়ার এ এক অমোঘ পরিণতি। অবশ্য এখনকার কবি একটিমাত্র বিষয় টেনে নিয়ে একরৈখিক চিত্রপট আঁকায় ধাতস্ত হবেন এমনটা কাম্য নয়। কারণ ছড়া বা পুরানো ধাঁচের কবিতার মতো একটিমাত্র কেন্দ্রীয় ভাবকে নিছক আবেগ তাড়িত ভাষায় উপস্থাপনের যুগ আর নেই। এক-একটি কবিতা হবে অসংখ্য শক্তির আধার, অনেক কিছুর ফটোগ্রাফ, তা বাস্তব, পরাবাস্তব বা বিমূর্ত – যা-ই হোক না। সমকালিক জগৎ ও জীবনের বধিষ্ঞু সংকট ও সমস্যা জান্নাতের কবিসত্তাকে বিপুলভাবে আলোড়িত করেছে বলেই তাঁর মাঝে সর্বভূমিতে বিচরণের প্রতিজ্ঞাটি মূর্ত হয়ে উঠেছে। আর তা প্রকাশের জন্য তিনি প্রবহমান বন্ধরীতিকে খুব একটা প্রশ্রয় দেননি, তাঁর অধিকাংশ কবিতা অপ্রবহমান বন্ধে রচিত। প্রসঙ্গত একটি উদাহরণ দেওয়া যাক —
‘ ব্যথাদায়ক শব্দ ভেঙে তৈরি হোক মায়া
তারপর ছড়িয়ে পড়ুক আকাশগঙ্গায়
চোখের নদী বেয়ে ফসলের হাসি
জোড়া হোক সম্পর্কের গুণ
মোচড়ানো পাতিহাঁস প্রহর —
জোড়া দিতে দিতে তালি বাড়ে
সম্পর্ক থেকে টুটে যায় নূপুর
ভাঙা সুরের ক্রন্দন এধারে ওধারে
চকমকে পোশাক পরে কারা হেঁটে যায়! ‘
(‘শব্দ’)
এখানে প্রতিটি পঙক্তির বক্তব্য পৃথক, এক পঙক্তির ভাব অন্য পঙক্তিতে প্রবাহিত হয়নি। আবার প্রতিটি পঙক্তিই একটি করে সরল দৃশ্যমান চিত্রকল্প(simple visual image) ধারণ করে আছে। বহুমুখী ভাবের প্রবাহও নান্দনিক গাঁথুনির কারণে শিল্পমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।
উপর্যুক্ত আটটি পংঙিতে আটটি চিত্রকল্প, কিন্তু সেগুলো একটি থেকে অন্যটি অন্বয়বর্জিত। চিত্রকল্পগুলো ক্যামেরায় তোলা বা পেন্সিলে আঁকা স্কেচের মতো বাস্তব দৃশ্যের প্রতিরূপ নয়। হৃদয়ের আবেগ ও কল্পনার রঙ ছড়িয়ে সাজানো সব ছবি। প্রতিটি চিত্রকল্পের শব্দ প্রবাহের অর্থের প্রকৃতিও সাংঘাতিকভাবে ব্যতিক্রমী। এভাবে তাঁর প্রতিটি কবিতা কতকগুলো যূথমুক্ত ভাব নিয়ে আলাদা আলাদা ফোটোগ্রাফের একেকটা এলবাম যেন, যা কবির বহুমাত্রিক চিন্তা-চেতনার ফসল। আর এই অর্থবহ স্বতন্ত্র ছবিগুলো সার্বিকভাবে মিলে সৃষ্টি করেছে একটি পটের স্বরূপ বা একটি মূল অর্থের দ্যোতক। খণ্ডিত অনুভূতিগুলোও পৃথকভাবে সৌন্দর্যবহ। তাঁর লেখায় একটি বিমূর্ত ভাব আছে, আছে অসম্ভবের পাঁয়তারা, – অ্যাবস্ট্রাক্ট বা অ্যাবসার্ড চিত্রকর্মে যেমন। আধুনিক কবিতায় এটিও সিদ্ধ বলেই স্বীকৃত।
চিত্রকল্প ছাড়া জান্নাতের বাণীবন্ধ নেই বলেই চলে। সমকালীন কবিতায় এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। গ্রাম, নিসর্গ, নগর, আধুনিক জীবন – এসব নানা ক্ষেত্র থেকে তিনি তাঁর কবিতার ছবি আহরণ করেছেন। চিত্রকল্প, শব্দকল্প, ব্যতিক্রমী বিশেষণ শব্দ ও গাঢ়বদ্ধ শাব্দিক বুননের কারণে তাঁর অনেক কবিতার বাচ্যগুলো পৃথকভাবে সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে। এক কবিতায় বহুভাব ও অসমঞ্জস বিন্যাস বিশ্বের অনেক কবির কবিতাতেও দেখা যায়; সে লেখাগুলো কবিমনের জটিল চিন্তার কবিত্বময় প্রতিফলন হিসেবেই স্বীকৃত। এসব ক্ষেত্রে কবির মগ্নচৈতন্যে ধরা-দেওয়া বিষয় স্বপ্নময়তার মাঝে বাস্তব হয়ে ওঠে, শিল্পিত বর্ণনা যা অনেক সময় বাস্তবের চেয়েও বাস্তব হয়ে অনুপম সৌন্দর্য প্রকাশ করে। জান্নাতের কবিতা যেমন চাক্ষুষভাবে শিল্পদর্শন ঘটায়, তেমনি এর মাঝে পরিস্ফুট কবিমনের চিন্তাগুলোও পাঠককে ভাবিত করে। তাঁর ভাষা বেশ ধোপদুরস্ত, একেবারে ঘষামাজা। তাঁর অনেক লেখার পৃষ্ঠদেশে প্রকাশিত অর্থের (surface meaning) আপেক্ষিক বিশেষত্ব, অর্থেরও বিভিন্নতা এবং এ সবের সমীকরণ বা সম্পর্কীকরণ – এগুলো নিঃসন্দেহে এক অভিনব বিনির্মাণ রীতিরই (deconstruction approach) বৈশিষ্ট্য। এর ফলে আমার ধারণা, তাঁর কবিতা ভাষা ও বিষয় উভয় দিক দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে মহিমাময় হয়ে উঠেছে। 
এই কাব্যে কবি জান্নাত একজন সম্পন্ন চিত্রকল্পশিল্পী। বাস্তব-পরাবাস্তব ও মূর্ত-বিমূর্ত ছবি এঁকে এঁকে তিনি তার কবিতার পঙক্তিগুলো নির্মাণ করেছেন। আর এসব চিত্রকল্প গড়ায় তিনি উপমাঘটিত ও বর্ণনাত্মক – এ উভয় প্রকৃতির বাণীবন্ধ ব্যবহার করেছেন। কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক—
উপমাঘটিত চিত্রকল্প
…………………………..
১.
ঝরে পড়া অশ্রুর মতো তোমার অহংকার কুড়িয়ে কুড়িয়ে বাঁচি
যেন ওরা হাওয়াহরিৎ উৎসবে কাগজি লেবুফুল
যেন ওরা দিন শেষে বীণ বদলের তামাম তালিম!
(‘কামড়’)
২.
সম্পর্কের শিমুলে বৃষ্টি জমেছে —
যেমন বটতলার আসর ভেঙেছিল উড়নি হাওয়া।
(‘তুমি নিয়ে যাচ্ছো রোদ’)
৩.
মায়াহরিণের ক্রন্দনের মতো ইচ্ছার রিংটোনে বিভেদ সংগীত।
(‘মায়াবতী’)
৪.
প্রেমের স্পর্শের মতো ভোর
(‘আতর’)
৫.
আমি ও শব্দ গুটিদানার মতো ঘুরতে থাকি শিশিরের সাথে।
(”অবকাশ ‘)
বর্ণনাত্মক চিত্রকল্প
……………………….
১.
‘সন্ধ্যার পূরবীতে পাখিদের ডানা থেকে ঝরে যায় ঘাম
বিহাগ আলাপে বিলিকাটা মিহিরাত’।
(‘মুগ্ধতা’)
২.
‘ছাইরঙা উঠোনে জ্যোৎস্নার আলোড়ন
তুমি কি এসেছো?’
(‘আয়ুষ্মান-২’)
৩.
‘শিমুলের সাথে ঝরে পড়ে আততায়ী অনুরাগ’
(‘মনোগ্রাম’)
৪.
‘কিশোরীর দৌড়ে আসা কামরাঙা পথে মুখ থুবড়ে পড়ে ডাহুকির ডাক’
(‘শস্যের শীষ’)
৫.
‘বেগুনি নরম রোদে প্রাণ পায় দুপুরের শিস;
কলসে ভোরের সুর, রাঙা মন, জলের লিখন।’
(‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি)
কবি জান্নাতের কবিতা বিচিত্র বিষয়-সম্ভারে ঋদ্ধ। প্রেম, বিরহ-বিচ্ছেদ, হারানোর বেদনা, জীবনযন্ত্রণা, সমকালীন সংকট, সম্প্রীতি-সাম্য-মানবিকতা, দেশ-প্রেম–সবকিছুর বর্ণনা নিসর্গ-সুষমায় আস্তীর্ণ। নিসর্গই তার কবিতার প্রাণ। একদিকে তিনি যেমন বাংলার সুষমামণ্ডিত প্রকৃতির হরেক চিত্রপট এঁকেছেন, অন্য দিকে বাঙালির গ্রামীন জীবন ও সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ উপস্থাপন করে তাঁর কবিতাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন। আমাদের ঐতিহ্যের আমিষ শুঁষে নিয়ে তিনি তৈরি করেছেন মুগ্ধকর পঙক্তিমালা। বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সংকটে কিংবা সভ্যতার পাথুরে আঁচড়ে ক্লিশ্যমান স্বদেশের মুখ দেখে কবির আত্মদহনের অবধি নেই। তাই তো এই আর্তি– ‘জ্বলছি তো জন্ম থেকে বিভেদ আগুনে/পাথর সভ্যতা চরায় জংধরা পা'(‘আত্ম পরিচয়’)। আবার সভ্যতার নামে অপসভ্যতার তোড়ে জীবন-শিল্প-সমাজের ঈপ্সিত আলোগুলো অপস্রিয়মাণ দেখেও কবির উচ্চারণ –‘পড়ে আছি সভ্যতার ক্রুশকাঠে যীশুর জীবন’ এবং তাঁর অনুভবে এই নেতিবোধ জাগ্রত হয়—
‘ প্রতিদিনের ভগ্নতা ও দমনে নিঃস্ব চিৎকার গ্লাসে গ্লাসে পান করি।
মেরুদণ্ড ভাঙার মড়মড় শব্দ
গলিত মাংসের গন্ধে দলিত শ্বাসযন্ত্র।
চিরহরিৎ শ্যামলতায় বাস করে রুক্ষতা
শব্দেরা নিজস্ব ধ্বনিসহ চলে যায় অচেনা গঞ্জের দিকে
আর অনুভূতি আঙুল কামড়ে বসে থাকে পরকীয়া আঙিনায়। ‘
(‘পরকীয়া উঠোন’)
প্রিয় স্বদেশের বুকে জেঁকে বসা হরেক দুঃখ -দুর্দশায়ও কবি বিচলিত, বেদনাপ্লুত। নানা ক্ষেত্রে বিরাজমান সমসাময়িক ধ্বস্ত দশার প্রতি কবি জান্নাতের পরোক্ষ দৃকপাত লক্ষ করা গেল বেশ কয়েকটি কবিতায়। এমনকি ‘নাব্যতা’ কবিতায়, যেখানে মা ও মাটি কবির বোধে লীন হয়ে আছে, সেখানেও বিষদষ্ট সময় নিয়ে তাঁর ব্যথাতুর সহজাত প্রতিক্রিয়া পরিদৃশ্যমান। ‘জাহান্নাম’ শীর্ষক কবিতায় মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার অপমৃত্যু নিয়ে বিষণ্ণ মনোভঙ্গি প্রকাশ করার পর ‘প্রশ্ন’ শীর্ষক কবিতায় এসে সমকালের যে বাস্তব, অথচ বীভৎস ছবি এঁকেছেন তা-ও প্রণিধানযোগ্য। আর এসব বাস্তবতার আরও দীপ্ত রূপারোপ দেখা গেল ‘সিগারেট’ কবিতায়—
‘শহরের দলিতজনের পাশে ভেসে ওঠে গলিত ক্যানভাস
আর নর্দমার জলে যৌবনপ্রবাহ
বিদ্যুতের তারে ঝোলে মৃত কাক
চোখের ঢেউয়ে তবু সোনালী চড়ুই
তোর কথা মনে হলে একটি সিগারেটে আগুন ধরাই
দেখি বিশটি বছর জ্বলে পুড়ে ছাই’
পহেলা বৈশাখ, শহীদ দিবস ও বাংলা ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ, অতিমারি করোনা, ঘূর্ণিঝড় আম্পান, পরিবেশদূষণ,দুর্নীতি, হত্যা, লুটপাট, নারী নিবর্তন,অনাহার -দারিদ্র্যসহ অসংখ্য বিষয় তাঁর কবিতায় খণ্ড খণ্ড চিত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে। মানব হিতৈষণায় উজ্জীবিত এই কবি মানুষের দুঃখকষ্টে সর্বদাই সমব্যথী থেকেছেন। নানা অন্যায় অপঘাতে কবি-অন্তরের দারুণ রক্তক্ষরণ লক্ষ করি এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায়।
বস্তুনিষ্ঠ ও মুক্ত ও মুক্ত মানসিকতায় সত্যাসন্ধ এই কবি ধর্মান্ধতা, নারী-নিবর্তন ও নানা সংকট নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তার অল্পকিছু শিল্পোর্তীর্ণ দৃষ্টান্ত নিন্মে তুলে ধরা হলো—
১. ধর্মান্ধতার কারণে সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সমূহ ক্ষতি ও অবক্ষয়ের বাস্তবতা —
‘চোখের জলের সাথে মিশে থাকে ধর্মান্ধতার ক্রোধ
যা সব অর্জনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটায়
(‘বিচ্ছেদ’)
২. নারী নিবর্তন নিয়ে সত্যকথন—
‘এ সময়–
পলায়নপর পথের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কোমরবাঁধা নারী
পুরুষেরা বেদম পেটাচ্ছে!
ছেঁড়া বাতাসের শাড়িপরা বয়সী সময়।’
(‘পতন’)
৩. নারীনিবর্তক পুরুষচরিত্র নিয়ে অসাধারণ পঙক্তিমালা—
‘সন্তান জন্ম দিতে দিতে আমরা কখনো পাথর প্রসব করি
পাথর মাতাকে চেনে না, চেনে না বোনও
শুধু গড়িয়ে পড়তে জানে
দেশের বুকে পাথর পেরেক হতে জানে’
(‘বাতিহীন পারাবার)
৪. নানা সংকটের মুখোমুখি হয়ে কষ্টক্লিষ্ট কবিমানসের অসাধারণ অনুভূতি—
‘চুলায় জ্বলছে মৃন্ময়ী শরীর,
রিংটোনে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে সন্ধ্যা ;
সন্ধ্যা ছুটছে রাত্রির দিকে
রাত্রির বেলবটমে টমটম নৃত্য;
প্রাগৈতহাসিক শহরের ইতিবৃত্ত
ডাস্টবিনের খাবারে যার দিনরাত্রি–
তাকে শেখায় স্বাস্থ্যবিধি নিঃসার্থ মন্ত্রণালয়।’
(‘নীতিকাব্য’)
৫. সমকালে প্রাদুর্ভূত অতিমারি করোনা সম্পর্কে আতঙ্কিত কবি–
‘নিজস্ব কোয়ারান্টাইনে হাত ধুতে ধুতে- ধুতে থাকি জীবন-
মুখ দেখতে গিয়ে দেখি
চরিত্রহীন করোনা শোবার ঘরের আয়নায়!’
(‘প্রণোদনা’)
কিন্তু এ-সকল নেতি ও সংকট থেকে উদ্ভূত মর্মপীড়া কবিকে চূড়ান্তভাবে দখল করে নিতে পারেনি। প্রত্যাশা ও নির্বাণের আকাঙ্ক্ষায় প্রায়শ উদ্বেল হয়ে ওঠেন। যেমন দেখা যায় ‘নির্বাণ’ শীর্ষক কবিতায় —
‘দেবীর ঘরে ঘণ্টি বাজবে, আজানে বাতাস,
বুকের কাছে ষোড়শী ফুলেরা ঘাগড়া উড়িয়ে পরাগ ছড়াবে
হাজার বছরের পুরনো পুঁথির গন্ধে কালির অক্ষর
জাফরান গান বইবে কূল উপকূলে’
এসব ছাপিয়ে একজন প্রেমিক কবি হিসেবেও তাঁর আলোকিত উঁকি লক্ষ করা যায় বেশ কিছু কবিতায়। তাঁর প্রেমদর্শনও মহত্ত্বমণ্ডিত প্রেমের উদ্ভাস এবং এর পরিণতির অমোঘতা নিয়ে ‘ভষ্ম’ শীর্ষক কবিতায় তাঁর এই উচ্চারণ —
‘তুমিহীন এ জীবন ভষ্মসম,/ ভষ্ম থেকে উঠে এসে ভষ্ম বিলীন।
‘ আবার ‘হে প্রেম কবিতায় প্রেমের যে জয়গাথা রচনা করেছেন তা তুলনা রহিত–
‘তোমাকেই তুলে রাখি পূজার বেদীতে
ফুলের সুঘ্রাণ, হে প্রাত্যহকাল ভোরের মিনতি
হে বর্তমান, প্রেমের পাপড়ি মেখে চোখ,
হে দক্ষিণ, স্পর্শের অধীর ঘ্রাণ মেখে মন বলে
তুমি একক, অবিনশ্বর।
(‘হে প্রেম’)
কবি জান্নাতের কবিতার পঙক্তিগুলো কখনও নিরেট গদ্যে, কখনো-বা গদ্যছন্দে অথবা দু-য়ের মিশেলে গড়া। তিনি শব্দের ব্যঞ্জনা এবং আবেগের দীপ্রতা ছড়িয়ে বাণীবন্ধে কাব্যিকতা এনেছেন। বিশেষণ ও শব্দকল্পের ব্যবহারে তিনি অনবদ্য। চুলগন্ধী ফুল, স্নেহময়ী জল, অমরাবতী বিস্ময়, বৃষ্টিধোয়া বন, বিলিকাটা মিহিরাত, মায়াবতী মহাকাল, অনাহারি ভাবনা, অধীর ঘ্রাণ, অলক্ত শোক, শ্রাবণী কবিতা, জলরঙা দিন, মুকলফোটা বেলা – এ ধরনের যত ব্যতিক্রমী বিশেষণ প্রয়োগে তিনি তার কবিতা বিশিষ্ট করে তুলেছেন। তার উপর বিশেষ্য শব্দকে বিশেষণরূপে ব্যবহার তাঁর কবিতার শৈলিকে আরও উৎকর্ষমণ্ডিত করেছে, যেমন উর্ণনাভ সময়, হামাগুড়ি ইচ্ছে, সন্ধ্যা-মন, পারিজাত উড়ন, কলমিলতা হাসি, বেলি হাসি, উজ্জয়িনী তৃষা, কলমিলতা মন, বিরিশিরি মায়া, প্রত্নতত্ত্ব ইশারা, কামরাঙা পথ, উর্বশী দোলা, সুতানলী দিন, জামরুল জ্যোতি, কালিদাস বর্ষা ইত্যাদি। চিত্রকল্পের মতোই এগুলো দৃষ্টিনন্দন প্রয়োগ আর চুমকির মতো বসানো শব্দকল্পগুলোও তাঁর ভাষিক সৌন্দর্যকে আরও এককাঠি বাড়িয়ে দিয়েছে। ব্যাকরণের রীতি মেনে এক শব্দে একটি চিত্র আঁকা কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। শব্দকল্প আসলে চিত্রকল্পেরই ঘনবিন্যস্ত রূপ। বর্ণনাত্মক চিত্রকল্পের পাশাপাশি দেশ বিদেশের আধুনিক ও অধুনান্তিক কবিতাকে নবপ্রাণে সঞ্জীবিত করেছে। কবি জান্নাত সম্ভবত এই বিষয়টি জানেন বলেই।–স্মৃতিঝড়, ঘুমপথ, রাতগাথা, ভ্রমরচোখ, পাতিহাঁস কাল, শব্দভ্রূণ, নিয়নসন্ধ্যা, হিমাগুন, ইচ্ছেমাছ, মাধবী মায়া, কামমুকুল, রঙধনু কাল, চলবিদ্যুৎ ইত্যাদি উজ্জ্বল ও দৃষ্টি সুখকর শব্দকল্পে তাঁর কবিতাকে ঋদ্ধ করেছেন। 
পরিশেষে বলব, শব্দ-বিশেষণ প্রয়োগ, ভাষাবন্ধ নির্মিতি, অনুপ্রাসের দ্যোতনা, চিত্রকল্প গঠন এবং বিষয় চিন্তা –সব দিক দিয়েই তাঁর কবিতা উত্তীর্ণ। চিত্রকল্প, আত্মনিবিষ্ট কথকতা ও বিবৃতিমূলক উচ্চারণ — এই তিন নিয়ে তার বাণীবদ্ধ। আবেগ ও বৌদ্ধিকতার মেলবন্ধনে সেই ভাষা আরও দীপ্র হয়ে উঠেছে। তিনি জীবন, জগত, ঐতিহ্য ও নিসর্গ থেকে অজস্র উপাদান ও তথ্য সন্নিবেশ করেছেন, সময়কে নানাভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর ভাষা গঠনে অল্পস্বল্প চটক-চমকও আছে, যা সমকালীন অনেক কবির বেলাতেই পরিদৃষ্ট হয়। সবকিছু মিলিয়ে তাঁর কাব্য’ নিসর্গে নিমগ্ন নামতা’ এক অনবদ্য সৃষ্টি। তাঁর কবিতার বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কাম্য।
———————————————————————————————————————————————————————————
আবুল কাইয়ুম
“লেখক পরিচিতি : *আবুল কাইয়ুম (জন্ম – ১৯৫২) একজন প্রবন্ধকার, সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবে পাঠক মহলে আলোচিত ও পরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতায় জড়িত থাকার পর একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সত্তর দশক থেকে তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দশটি।”
—————————————————————————————————————————————————————————————–
কবি ও সাহিত্যিক খাতুনে জান্নাত ভালোবাসেন মানুষ ও প্রকৃতি; দুর্বলের প্রতি সহিংসতা ও অভিন্নতার মুক্তি চান তিনি। তাঁর কবিতা নস্টালজিক অনুভূতি, নারী মুক্তি, প্রকৃতি, বোধ ও বিভেদমুক্তির ও উজ্জীবন মূলক। কবির জন্ম সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার, ঘিলাছড়া ইউনিয়নে। তবে তাঁর পৈতৃক ও মাতৃক ঠিকানা: লক্ষ্মীপুর জেলাধীন লক্ষ্মীপুর থানার গোপীনাথপুর গ্রামে।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কবিতাগ্রন্থ: দিনান্তে দেখা হলে (২০০৯) জীবনের কাছে ফিরে (২০১০), নিরন্তর রোদের মিছিলে (২০১২), মুঠো খুলে দেখি(২০১৬), নিসর্গে নিমগ্ন নামতা(২০২২),
উপন্যাস গ্রন্থ:শিউলির কথা (২০১৯), বিলেতের বাউরি বাতাস(২০২২)।
নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ গ্রন্থ‘ দ্য রে অফ লাইফ এন্ড নেচার‘ প্রকাশিত হয় ২০১৩, অনুবাদ ব্রজেন চৌধুরী।
লিটলম্যাগ ও জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত লিখছেন। বাংলাদেশ ভারত, যুক্তরাজ্যসহ,যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের জাতীয় দৈনিক, ব্লগ ও অনলাইন পত্রিকায় বাংলা ও ইংরেজি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, প্রবন্ধ ও তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হচ্ছে।তিনি গান, শিশুতোষ ছড়া, সাহিত্য ও নারী বিষয়ক প্রবন্ধ , নিবন্ধ লেখার পাশাপাশি অনুবাদ করছেন।
+ posts

আবুল কাইয়ুম (জন্ম - ১৯৫২) একজন প্রবন্ধকার, সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবে পাঠক মহলে আলোচিত ও পরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতায় জড়িত থাকার পর একটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার পদে চাকরি করে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। সত্তর দশক থেকে তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দশটি।"

Read Previous

বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট ও দেশভাগ

Read Next

সিকস্তি আর পয়োস্তির গল্প- পাথুরে মাটির কিষাণ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *