বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ, এমনকি কাগুজে মুদ্রা প্রস্তুতকালে নকল পরিহারের জন্য একধরনে ছাপ বা চিহ্ন এঁকে এনডোর্স করা হয়। এই ছাপ তৈরিতে জলের প্রয়োজন হোক বা না-হোক, নাম তার ‘জলছাপ’ (ওয়াটার মার্ক)। ‘বিম্বিত’ অর্থ `ইমেজ হিসেবে প্রতিফলিত’। জগত সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি যা কিছু ঘটে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও যা কিছু ঘটবে প্রতিটা ক্ষেত্রে সময় এক অন্যতম নিয়ামক। সময় না থাকলে ঘটনার কোনো মূল্য নেই। সেই অর্থেই হয়তো কবি তাঁর গ্রন্থটির নামকরণ করেছেন ‘জলছাপে বিম্বিত সময়’। যে কোনো গ্রন্থ পাঠের শুরুতেই গ্রন্থকার সম্পর্কে একটা মোটামুটি ছবি পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। লেখক লোকটা কেমন, কী তাঁর চিন্তাদর্শন— এইসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে চলে পাঠের গতি। শুধু মানবসৃষ্ট গ্রন্থ নয়, ঐশীগ্রন্থ বলতে আমরা যেগুলো বুঝি, সেগুলোর ক্ষেত্রেও তেমন একটা প্রতীতি ভেসে ওঠে বা ভাসিয়ে তোলা হয় পাঠকের মানসপটে। প্রচলিত এই ধারণা মাথায় রেখে কাব্যগ্রন্থ খুলতেই অদ্ভুত চেহারার এক কবি পাঠকের ঘাড়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যান। আধপেটে মানুষটির উস্কোখুস্কো চুল, দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, ঢিলেঢালা মলিন পোশাকে আচ্ছাদিত কলেবর। কাঁধের ঝোলায় হয়তো রক্ষিত আছে জগতের যাবতীয় গূঢ় রহস্য। চপ্পলের চটপট ধ্বনি তাঁর কবিতার সুর-ছন্দ-তাল নির্দেশ করে। দরাজ কণ্ঠে দূর থেকে হয়তো ভেসে আসে কবির স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করা বিশেষ কোনো কবিতার চরণ। এইসব ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়েই পাঠক এগিয়ে চলেন। ওল্টানো হয় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। তবে ‘জলছাপে বিম্বিত সময়’ বইটির পাতা উল্টালেই পাঠকের ভ্রান্তি ভাঙবে নিশ্চিত।
আলোচ্য গ্রন্থের কবি ঠিক ওই ফরমেটের কবি নন। তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী। বইটির শুরুতেই কবির ‘আত্মকথন’ শিরোনামের কবিতাটি পড়লেই পাঠক বুঝে নেবেন এ কবি এক অন্য ধাঁচের। সম্পূর্ণ এক নতুন ছাঁচে গড়া স্বতন্ত্র সত্তার এক খাপছাড়া কবি। আসুন দেখে নেওয়া যাক কবির আত্মকথন— আমি মানুষটা একটু পাগলা গোছের বিজ্ঞানে খুঁজি কবিতা, কবিতায় হাতড়াই দর্শন অর্থনীতি তছনছ করে ওড়াতে চাই লালঝাণ্ডা খাপছাড়া আমাকে বুঝে প্রেমিকা পালিয়ে যায় নিয়মমানা মানুষের হাত ধরে— সেই থেকে কালো প্রজাপতিকে খুঁজে বেড়াই ঝলমলে মুক্তির সনদ। অতি অল্প কথার এই কবিতা পড়লেই বুঝে নেওয়া যাবে গ্রন্থটির মধ্যে কী কী আছে। বিজ্ঞানের মতো একটা দুর্বোধ্য বিষয়কে অতি সযতনে বাংলা কবিতার ললাটে এঁকেছেন তিনি নিজস্ব ভঙ্গিমায়। শব্দ উপমায় স্থান পেয়েছে বিজ্ঞান-নির্ভর বহু কথা। অন্যান্য কবি যেখানে ধনুকের ছিলার মতো উপমা নিয়ে আজও বসে আছেন, সেখানে তিনি অণু-পরমাণু থেকে গ্যালাক্সির গূঢ় রহস্য কবিতায় টেনে আনেন।
যেমন ‘গতিতত্ত্ব’ শিরোনামের কবিতায় বলেছেন— অরবিটে আলো ফেলে দ্যাখো, মাইক্রোস্কোপে কিংবা টেলিস্কোপে সবকিছুই বহমান….. থেমো না তোমরা, থেমে গেলে নদী মরে যায় থেমে গেলে ব্ল্যাকহোল হাহাকার… মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর কবিতায় বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিলেও অন্তরালে খুঁজেছেন দর্শনের বাণী। চেতনা ছেড়ে অবচেতনে বুঁদ হয়েছেন সৃষ্টিতত্ত্বের অজানা রহস্য উদ্ঘাটনে। ‘শূন্যের মহিমায়’ কবিতার কথাই ধরা যাক— তুমিই আমার স্রষ্টা, কিংবা আমি তোমার— ভাবতে ভাবতেই শূন্য এসে সামনে দাঁড়ায়— হেমলক পেয়ালায় ঠোঁট রেখে সক্রেটিস বলে, ‘এক চুমুক চেখে দ্যাখো অমৃতের স্বাদ!’ আমি শূন্যের চোখে চোখ রাখি ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে যায়, ‘শূন্যেরও ভ্যালু আছে, নিরর্থক নয়!’ কবি সাম্যবাদের গহনকথা তুলে এনেছেন কবিতার ভাষায়। ধারণ করেছেন মহামতি মার্ক্স-এর সেই সারপ্লাস ভ্যালুর গোপন-গহন কথা। ব্যক্ত করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায়— এখনো ঝরে নোনা ঘাম উদ্বৃত্ত মূল্যেই তাবদ জেল্লা শ্রমিকের ঝুলিতে পড়ে থাকে ভেরেণ্ডাভাজা শোষিতের রক্তেই বিশ্বায়নের দৌড় নারীবাদ নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলেন। এইক্ষেত্রে কবি গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসেননি। নিজের ভাবনায় তিনি অনন্য। অটুট থেকেছেন নিজস্ব দর্শনে। গ্রন্থের পাতায় এঁকে দিয়েছেন সেই নিগূঢ়তম সত্য কথাটি— পারলে নারী তুমি পুরুষ হও পারলে পুরুষ তুমি নারী হও পারবে হতে? পরিপূরক তুমি আমি এসো হয়ে যাই উভলিঙ্গী পূর্ণমানব বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প— সবকিছু ছাড়িয়ে আমরা যে পরিচয়ে মানুষ, সেইটা হলো আবেগ। এই আবেগের শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ প্রেমে। কবি মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর দর্শনতত্ত্বে বুঁদ হলেও, আবেগ-অরণ্যে টইটম্বুর। তাইতো কবিতার কৃষিক্ষেত্রে তিনি অনন্য এক প্রেমিক চাষি। তাঁর অধিকাংশ কবিতায় ফুটে উঠতে দেখি প্রণয়বাদ্য-প্রেমরস, অমর-অক্ষয় বাণী। বস্তুত তিনি এক জাত কবি, মননে-মজ্জায় যার প্রেম বহমান।
এখানে ‘দেহাতীত ভালোবাসা’ শিরোনামের কবিতা থেকেই কথাই বলা যাক— তোমার শরীর ভাঁজ, ছন্দায়িত নিতম্ব ঢাল, পেলব-পুষ্ট স্তনের আবেগী উল্লম্ফন কামজ চোখে চকিত চাহনি জানান দেয় তোমার অস্তিত্বের ভূভাগ— বছরের পর বছর করছি শরীর খেলা নিঝুম রাতে চরম পুলকে পুলকিত তুমি, শীৎকারে বলে ওঠো ‘ভালোবাসি’, ‘ভালোবাসি’… জীবন থাকলে মৃত্যু থাকা স্বাভাবিক। পদার্থবিদ্যায় যাকে বলে ‘শক্তির রূপান্তর’। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যতই এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ, ততই দূরে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুকে। প্রশ্ন আসতেই পারে— মানুষ কি আদৌ অমর হবে? যতকাল এই প্রশ্নের মীমাংসা না হবে, ততদিন মৃত্যভয় অর্থাৎ সবকিছুকে ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় চিন্তাশীল প্রতিটা মানুষের মধ্যে কাজ করবে। মৃত্যুভাবনা কবি মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীরের মনেও নানা কথার জন্ম দেয়, জাগিয়ে তোলে সংশয়। আলোচ্য গ্রন্থের শেষ কবিতা ’মুনকার-নাকিরের প্রশ্নবাণে’ পড়লে বোঝা যায়— আমি তখন রিমান্ডে, মুনকার-নাকিরের প্রশ্নবাণ— ‘তোমার রব কে?’ কবিতা ছাড়া কিছুই মনে পড়ে না আমার কবিতা পাঠের শুরুতেই পাঠক মনে জেগে উঠতে পারে ছন্দ-দোলার এক মাধুর্যময়ী পাঠ। হ্যাঁ, এই কাব্যগ্রন্থে প্রতিটা কবিতায় পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে গ্রন্থিত আছে কবির এক নিজস্ব ছন্দের আভাস। ছন্দ বলতে আমরা প্রচলিত যে সব ছন্দকে বুঝি, বিশেষ করে— স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত; কবি তাঁর কবিতায় এগুলোর কোনোটাকেই হুবহু মেনে চলেননি। আমার মনে হয়েছে, তিনি অক্ষর সাজিয়েছেন অনেকটা অক্ষরবৃত্তের ফরমেটে, তবে ধ্বনিতে আনার চেষ্টা করেছেন কিছুটা মাত্রাবৃত্তের স্বর। প্রথাগত ছন্দকে ভেঙে ফেলার এক নিরন্তর প্রচেষ্টা ছত্রে ছত্রে পরিলক্ষিত হয়। কবিতার গায়ে অন্যতম অলঙ্কার ‘অনুপ্রাস’ জড়িয়েছেন বেশ দক্ষ হাতে। কবির অন্যতম একটা বিশেষত্ব হলো— বেশ কিছু চটুল শব্দের চয়ন। বাংলা ভাষায় যেসব শব্দকে ব্রাত্য বিবেচনায় অন্যান্য কবি এড়িয়ে চলেন, মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর সেই সকল শব্দকে বার্নিশ করে ব্যবহার করেছেন বিশেষ দক্ষতায়। সমগ্র গ্রন্থটিতে দুই একটা বাদে, প্রায় অধিকাংশ কবিতা অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে লিখিত। এটা ডিজিটাল সময়ের প্রভাব কিনা ঠিক জানি না। তবে বাচিক শিল্পীগণ এত ছোট ছোট কবিতায় সন্তুষ্ট হতে পারবেন বলে মনে হয় না।
পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই— আলোচ্য গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই পাঠককে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভাবাবে; আবিষ্ট করে রাখবে কিছুকাল।
জলছাপে বিম্বিত সময়
মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীর
প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৩
প্রচ্ছদ : মো. ময়েজুল ইসলাম
মূল্য : ২৪০ টাকা
One Comment
অসামান্য পাঠ প্রতিক্রিয়া।