অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুলতানা রাজিয়া -
নৈঃশব্দ্যের বিকেল : নোনা জলে বোধের বাতাস

‘ঢাকা শহরের চিরচেনা রূপ পাল্টে গেছে। অফিস আদালত, স্কুল কলেজ সব বন্ধ। রাস্তা ফাঁকা। বাসের হর্ন নেই। নেই রিকশার টুনটান শব্দ। খালি রাস্তা পেয়েও শালিক আর বসে না মাঝ রাস্তায়, করে না অলস বিচরণ। হরতালের সময় স্কুলপড়ুয়া ছেলেরা, বাসা থেকে নেমে এসে, ফাঁকা রাস্তায় বল বা ক্রিকেট খেলত, এখন তারাও বাসা থেকে বের হয় না। মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া প্রতিদিন ফজরের নামাজের সময়, ‘আসসালাতু খায়রুম মিনার নাউম— ঘুম থেকে নামাজ উত্তম’ উচ্চস্বরে বলে বলে ঘুমন্ত মানুষদের ডেকে মসজিদে নিয়ে যেত, সে মানুষটিও এখন আর মসজিদে যায় না। ঘরে নামাজ পড়ে। ভোরে যারা পার্কে বা রাস্তার ধার ঘেষে হাঁটাহাঁটি করত, তাদের সংখ্যাও এখন কমতে কমতে শূন্য।’

এভাবেই শুরু হয়েছে সৈয়দ নূরুল আলমের উপন্যাস ‘নৈঃশব্দ্যের বিকেল’। শুরুতে এধরনের বর্ণনায় পাঠকের মনে এক ধরনের মাইন্ডসেটআপ সৃষ্টি হয়ে যায়। পাঠক উপন্যাসের ভেতরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান এবং মজার ব্যাপার লেখক কোথাও বলেননি, অথচ পাঠক বুঝে যান, কোন সময়ের উপর ভিত্তি করে লেখা এ উপন্যাস। এটা লেখকের মেধা ও মননের পরিচয় বহন করে।

সৈয়দ নূরুল আলম কবি, না গদ্য লেখক? পাঠকের মধ্যে এ প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। কারণ তিনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, সমানভাবে লিখছেন। তবে তিনি গদ্য লেখক হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর গল্প বা উপন্যাসে এক ঘোরলাগা মাদকতা থাকে। যার প্রমাণ তাঁর প্রতিটি লেখায় দেখা যায়।

বইমেলা, ২০২৩-এ অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘নৈঃশব্দ্যের বিকেল’। আমাদের সমাজের নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনের যে জলরঙ ছবি তা-ই, তিনি এ উপন্যাসে এঁকেছেন। করোনার সময়ে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়েছে। সে এক ভয়ংকর-রুদ্ধশ্বাস সময়। এ সময়কে তিনি ধরেছেন উপন্যাসে। একই সাথে আছে আমাদের সমাজের অনাচার-অনিয়ম, প্রেম-বিরহ, পাওয়া-না পাওয়ার গল্প।

সৈয়দ নূরুল আলমের গদ্য ভাদ্র মাসের রোদের মতো খটখটে, দীপ্তিময়। আবার কখনও সমুদ্রের পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মতো জীবন্ত-চপলা। একটি ঢেউ ভেঙে মিলিয়ে যাওয়ার পরে, পরক্ষণে আরেকটি ঢেউ বর্ণময় হয়ে ভেসে ওঠে, দর্শক সেই ঢেউয়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য যেমন অপেক্ষায় থাকে। এ উপন্যাসেও পাঠক রুদ্ধশ্বাসে আপেক্ষায় থাকে, একটি ঘটনার পরে, আরেকটি ঘটানা জানার জন্য। এই গতিময়তাই সৈয়দ নূরুর আলমের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একটু দেখে নিই—

“‘আনোয়ারের কথা শেষ হতে পারে না। ওর মুখের কথা টেনে নিয়ে, একটু অভিমানের স্বরে রায়না বলে, ওর সাথে কেন আসব, আমি একা আসতে পারি না?’

আনোয়ার কফি খাওয়া রেখে রায়নার দিকে তাকায়, সে দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন।

‘ওভাবে অবাক হয়ে কী দেখছেন?’

‘না, আপনার যখন ইচ্ছে, তখন আসবেন। আমি না থাকলেও, স্নেহার মা— বিথী তো সব সময় বাসায় থাকে।’

রায়না মনে মনে বলে, আমি এলে তো আপনার কাছে আসব। বিথী কেন? প্রথম ভালোলাগা বলে কথা।

‘একটা জিনিস চাইব, দেবেন?’

‘কী! এতবিনয় করে বলছেন কেন?’

‘আপনি আগের মতো আমাকে ‘তুমি’ বললে খুশি হব। আপনি আপনি বলতে, শুনতে, ভালো লাগছে না। কানে বড্ড বেসুরা লাগছে। মনে হচ্ছে অনেক দূরের কেউ কথা বলছে।’

রায়না একটু থেমে আবার বলে, ‘আর রিফাতের সামনে বলতে অসুবিধা হলে, আমরা যখন দু’জন থাকব, তখন বলবেন। প্লিজ, আমার এ কথাটা রাখবেন।’”

এতটুকুতেই একজন পাঠক জেনে যাবে সৈয়দ নূরুল আলমে গদ্যের সৌন্দর্য, শব্দ বুননের সরলতা সর্বোপরি ভাষার গতিময়তা।

শিরোনাম- নৈঃশব্দের বিকেল         লেখক- সৈয়দ নূরুল আলম        প্রকাশক- অনুপ্রাণন প্রকাশন     প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি ২০২৩,         মূল্য- ৳ ৩৫০/-

ছয়-সাতটি চরিত্র যেমন, আনোয়ার, বিথী, রায়না, রিফাত, রাব্বি, মনিরা ভাবী, পুতুল— এদের নিয়ে এই দীর্ঘ উপন্যাস। অল্প কয়েকটা চরিত্র থাকার কারণে পাঠক সহজে মাথায় ধারণ করতে পারেন। কোনো গোলমাল পাকায় না। অল্প চরিত্রের মধ্যে বিরাট জাল বিস্তার করা একজন লেখকের বড় গুণ। অনেক উপন্যাসে দেখা যায়, কোনো সংযোগসূত্র ছাড়া অনেক চরিত্র পর্দায় ঢুকে পড়ে, আবার হুট করে চলে যায়। পরিমিত বোধ না থাকার কারণে সে উপন্যাস বিরক্তির উদ্রেক করে। পাঠককে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। তেমনটি আলোচিত উপন্যাসে নেই। এখানে আনোয়ার, রায়না ও রিফাত ভার্সিটির তিন বন্ধু। রায়না, আনোয়ারকে ভালোবাসলেও পরিস্থিতির কারণে আনোয়ার বিয়ে করে তার খালাতো বোন বিথীকে। এবং আনোয়ার বিথীকে ঠেলে দেয় রিফাতের দিকে। একসময় চাকরির সূত্রে আনোয়ার-রিফাত দূরে চলে গেলেও, আবার একই শহরে ফিরে আসে এবং একই ফ্লাটে থাকা শুরু করে, আর তখনই শুরু হয় অতিমারি করোনা।

রিফাত চিকিৎসা করাতে সিঙ্গাপুর গিয়ে আটকা পড়ে, ওদিকে বীথি, বাবার বাড়ি বরিশালে গিয়ে আটকা পড়ে। ফ্লাটে উপর-নিচে দুই তলায় রায়না-আনোয়ার থাকে। করোনায় বিরক্তময় সময়ে, রায়নার মনে জেগে ওঠে পুরোনো প্রেম। চা খাওয়ার অজুহাতে রায়না আনোয়ারের ফ্লাটে যায়। কিন্তু আনোয়ার বন্ধুত্বকেই বড় করে দেখে, একটা দূরত্ব রেখে চলতে চেষ্টা করে। এধরনের একটা প্রেমের গল্প উপন্যাসিক বলতে চেয়েছেন এখানে। এছাড়া করোনায় এক সাংবাদিকের ছেলে মারা যায়, স্থানীয় কবরস্থানে তাকে কবর দিতে বাধা দেয় সাধারণ মানুষ, করোনাকালীন সেই ভয়াবহতার চিত্রও উপন্যাসে এসেছে।

দীর্ঘ উপন্যাসে পাঠক ধরে রাখা একটা কঠিন কাজ। সেই ক্ষেত্রে উপন্যাসে যদি ডায়ালগ থাকে, তাহলে পাঠক একটু রিলিফ পান, একটু আলাদা ভালোলাগার জায়গা তৈরি হয়। যা এ উপন্যাসে আনেক জায়গায় আছে। এটা লেখকের একধরনের দক্ষতার পরিচায়ক। দু’একটা জায়গা আমরা দেখে নিতে পারি—

“ঠিক আটটায় রায়না টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে আনোয়ারের ফ্লাটে গিয়ে হাজির হয়।

‘দরজা খুলে রেখেছ, আমি আসব সে জন্যে?’

‘হয়তো তাই। তুমি দেখি ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় চলে এসেছ।’

‘এসে অসুবিধায় ফেললাম?

‘বাঙালি তো সময় মেপে চলে না। তোমার সময়জ্ঞান দেখে ভালো লাগছে।’

‘ধন্যবাদ।’

‘তোমার খাবারের বহর দেখে মনে হচ্ছে, বিরাট আয়োজন।’

‘খেতে বসে দেখবে। তা এখন দেব?’

‘দশ মিনিট। নিউজটা শেষে করে নিই। তাছাড়া রাতে আমি একটু দেরি করে খাই।’

‘কী নিউজ দেখছ? নিউজ দেখতে আমার ভালো লাগে না। সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি একই খবর। শুধু কোভিড-১৯, কোভিড-১৯। এখন কোভিড ছাড়া তো কোনো খবর নেই’।”

অথবা—

“মিলা লিখেছে, তুমি বলেছিলে রাতে ফেসবুকে থাকো না। আজ?

‘বিশেষ কারণে।’

‘কারণটা জানতে পারি?’

‘এখন অফিসে। এক বন্ধুর প্রক্সি দিচ্ছি।’

‘তাহলে তো তোমার সাথে সারা রাত কথা বলব, তুমি রাজি?’

‘কথা বললে হবে? অফিসে কাজ আছে না?

‘তোমার কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলব। এতে করে তোমার মনও ভালো হয়ে ওঠবে।’

‘মন ভালো করে দিতে পারলে, অসুবিধা নাই।’

‘কীসে তোমার মন ভালো হয়?’

‘সেটা তুমি বলবে। এতদিনের বন্ধু, তুমি বোঝ না?’

রাব্বি মিলাকে ছেড়ে দেয়।

পিয়া লিখেছে, শুভ সন্ধ্যা।

‘শুভ সন্ধ্যা।’

‘কী করছ?’

‘এই তো অফিসে।’

‘কী করো?’

‘বসে আছি।’

‘তুমি কী করো?’

পিয়া মেয়েটা ঠোঁটকাটা। মুখে কিছু আটকায় না। যা মনে আসে বলে ফেলে।”

এভাবে অনেক জায়গায় ডায়ালগ দেখা যাবে।

উপন্যাসে আরেকটি বিশেষ অনুসঙ্গ প্রকৃতির বর্ণনা। যাঁর প্রকৃতি দেখার গভীরতা যত বেশি, তাঁর উপন্যাস তত মজবুত, তাঁর সাহিত্য ততটা সৌন্দর্যময়। এ উপন্যাসের একটা অংশ এরকম—

“রেলস্টেশনের কথা ওঠলে, কোলাহল, লোকের হৈচৈ, ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক, বোচকা-বেডিং মাথায় করে কুলিদের দ্রুত হেঁটে যাওয়া, এসব দৃশ্য চোখে ভাসে। কিন্তু এ স্টেশনে এসবের কিছুই নেই। নীরব-ছায়াময় একটি স্টেশন। রায়না ছাড়া আরও দু-তিনজন লোক ট্রেন থেকে নামার পর, ট্রেন হুশহাশ শব্দ করে চলে যায়। মাত্র কয়েক মিনিট থেমেছে এখানে।

প্রায় সব স্টেশনে দেখা যায়, চায়ের স্টল, ছোট ছোট পান সিগারেটের দোকান, শিঙ্গাড়া-সমুচা খাবারের দোকান, চুলকাটার সেলুন। এখানে শুধু একটা চায়ের স্টল ছাড়া আর কিছু নেই। চায়ের স্টল দেখে রায়নার চা খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা চায়ের স্টলের সামনে বেঞ্চে বসে চা খেতে আলাদা একটা আনন্দ আছে। সেটা কি এই গ্রাম্য পরিবেশ ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যাবে?”

লেখক হিসেবে সৈয়দ নূরুল আলম শুধু তাকান না, দেখেন। দেখা আর তাকানোর মধ্যে যে পার্থক্য আছে, সেটা এ লেখা পড়ে সহজে বোঝা যায়।

এ উপন্যাসে আরেকটি চরিত্র রাব্বি। রাব্বি সাংবাদিক। এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে করোনাকালীন সাংবাদিকদের অবস্থান নিপুণভাবে লেখক তুলে ধরেছেন। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক যে কতটা আসক্ত হয়ে পড়েছে তরুণ ছেলে-মেয়েরা, তারও খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে এ উপন্যাসে। এই ফেসবুকের মাধ্যমেই রাব্বির সাথে পরিচয় হয় রায়না ও পুতুলের। রাব্বি অনেকটা সময় পুতুলের সাথে হাঁটে এ উপন্যাসে, অন্যদিকে রাব্বি, রায়নার স্বামীকে সিঙ্গাপুর থেকে আনতে এবং স্বামীর মৃত্যুর পরে নানাভাবে সাহায্য করে। একসময় উপন্যাসের শেষে এসে দেখা যায়, রাব্বি, পুতুলের না, রায়নার পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং রায়না, আনোয়ারকে অনুরোধ করে, বরিশালে বিথীর কাছে ফিরে যেতে। সুন্দর পরিসমাপ্তি।

পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, কোনো কোনো চরিত্র আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত। যেমন পুতুল চরিত্রটা। পাঠকের এক সময় মনে হবে পুতুলই হবে এ উপন্যাসের নায়িকা। কিন্তু উপন্যাসে সেটা দেখা যায় না, এমনকি এ চরিত্রের পরিণতিও অস্পষ্ট থেকে যায়। একইভাবে সেঁজুতি চরিত্রও হঠাৎ এসে হঠাৎ শেষ হয়েছে। এদের অবস্থান আরেকটু হতে পারত। এছাড়া উপন্যাসের ৯৫ পৃষ্ঠা, ১২ নম্বর লাইনে লেখা আছে ‘এ নিয়ে তিনবার রায়না রাব্বিকে স্পর্শ করল’। প্রকৃতপক্ষে হবে, ‘এ নিয়ে তিনবার পুতুল রাব্বিকে স্পর্শ করল’। একটু সতর্ক হলে এসব বিচ্যুতি এড়ানো যেত।

সবশেষে বলা যায় ‘নৈঃশব্দ্যের বিকেল’ সমকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি চমৎকার প্রেমের উপন্যাস। অভিনন্দন লেখককে।

 

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *