অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২০, ২০২৪
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমির মুহম্মদ খসরু -
ফোঁটা ফোঁটা আলো বনাম পরিকীর্ণ আঁধি।।

ফোঁটা ফোঁটা আলো বনাম পরিকীর্ণ আঁধি।।

আমির মুহম্মদ খসরু

৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং এর বিজয়-পরিণতি মানেই বাঙালির ইতিহাসের এক মহান অর্জন, প্রশ্নরহিত কোনও অমেয় কীর্তি। বাজারচলতি এরকম একপেশে প্রচারণা আর কল্পিত মীমাংসার বাইরে থেকে তিনি মেলে ধরেন ইতিহাসের কিছু অনধীত পাতা। দৃশ্যপটে জাগিয়ে তোলেন অমাচিহ্নিত নানা উপাখ্যান। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গৌরব যে অনেকখানিই বানানো আর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা সত্য-মিথ্যার মিশ্রমিথ, তা থেকে সমস্ত কৃত্রিম রঙ নিংড়ে নিয়ে একে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন নির্জলা নিরেট সারল্যে, এর শরীর থেকে যাবতীয় বক্রতা, অতিরঞ্জন এবং অসত্যকে অপসারিত ক’রে। খুলে দেখান তার ভেতরের নানা বিরোধপূর্ণ উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হবার পরেও এ কারণে তাঁর এ-বিষয়ক সমুদয় গল্প হয়ে উঠেছে আমাদের স্বাধীনতার অব্যয় দলিল; আলো-আঁধারের দ্বৈরথ। কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের সৃষ্টি মানেই তাই বরাবর ভিন্নতর কিছু; সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর’-এর ‘টোপ’ গল্পটি পড়তে গিয়ে এ সত্য আবার মনে উদয় হলো।

আটটি গল্প নিয়ে ঢাকার অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে তাঁর এ বই। এর প্রথম তিনটি গল্পে আছে করোনাকালের নানা সঙ্কট, মৃত্যুভয় আর রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের জালে-বন্দী জনমানুষের বিবিধ দুর্ভোগের বর্ণনা। গল্পের আদলে ধরা আতঙ্কতাড়িত জীবনের বাস্তব বিভীষিকা, স্বার্থপরতা এবং সেইসাথে ‘ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত’ মানবীয় অনুভূতির কিছু ছেঁড়া আখ্যান। করোনা যেন হঠাৎ ক’রেই পাল্টে দিয়েছে সবকিছু। অবরুদ্ধ পরস্পরবিচ্ছিন্ন জীবনের ভেতরে আচানক এসে হাজির এমন সব বিষয় যাতে চেনা সম্পর্কের মানবিক গল্পগুলি মুহূর্তেই রঙ বদলে নতুন রূপে ধরা দিয়েছে। কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকার এই সময়টার ভেতর উঁকি দিয়ে দেখেছেন। তার মধ্য থেকে তুলে এনেছেন সেইসব চিরকম্পন, এই সংকটেও যার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, যার মধ্য দিয়ে মানুষের মৌলিক হৃদয়াকাঙ্ক্ষা, ভালবাসা পেয়েছে একইসাথে মিলনান্ত এবং বিয়োগান্ত পরিণতি। দমবন্ধ এক পরিস্থিতি তবু তারই সঙ্গে এসে মিলেছে ছেঁড়া ছেঁড়া কৌতুক যে উপাদানটি তাঁর গল্পের শরীর থেকে কোনও অবস্থাতেই হারিয়ে যায় না। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত আর অন্ত্যজ মানুষের জীবন সমান কৌতূহলের চোখে তিনি পড়েন; খণ্ড দৃশ্যগুলির গায়ে উন্মোচন করেন নানা দ্বন্দ্ব, অর্থ, প্রেম, রিরংসা আর এমনই আরও সব নানা অচ্ছেদ্য জীবনোপচার।

তো আলোচনাটা শুরু করেছিলাম তাঁর ‘টোপ’ গল্প নিয়ে। সেখানেই ফিরে যাই। যা বলছিলাম, গল্পকার মঞ্জু সরকার তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনও গল্পেই বর্ণিত ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলক কৃত্রিম আর একপেশে ধরনে উপস্থাপন করেন নি। মুক্তিযুদ্ধ ও সদ্যস্বাধীন দেশের অব্যবহিত পরের ঘটনাগুলিকে শুদ্ধ দেশপ্রেম ও বীরত্বের অতিরসালো রঙে জবজবে ক’রে লিখতে গিয়ে এমন হাস্যকর অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য ক’রে তুলেছেন কেউ কেউ যে সেগুলিকে আর আমাদের দেশ ও সমাজের কাহিনি ব’লে মনে হয় না। সেসব যেন মাটির স্পর্শ থেকে আলগা হয়ে সব ঊর্ধ্বচারী হয়েছে, ভূলোকের লোকস্তর পেরিয়ে দেশহীন কোনও রাজ্যে শূন্যের উপর রঙ খেলিয়ে কিম্ভূত দৃশ্যমালা সাজিয়ে তোলার কসরৎ করছে। জীবনের দ্বান্দ্বিক আর সহজাত চেনা কামনা-বাসনার দাগ তাতে নেই, এমনই মহান কিছু! এই মহানতার প্রক্ষিপ্ত আরোপনে কাহিনি তার বিশ্বাস হারায়। পড়তে গিয়ে পাঠকের নির্ঘাৎ বিবমিষা জাগে। যুদ্ধকে মাহাত্ম্যদান — হোক তা প্রতিরোধ যুদ্ধ — আর হত্যা-প্রতিহত্যার কীর্তন কখনও কোনও প্রকৃত লেখকের অভিপ্রায় হতে পারে না। যুদ্ধের আবহের ভেতর থেকে তিনি আহরণ করেন মানবিকতার উপাদান, লহু আর অশ্রুর অপার বেদনা, বিশ্বাসহননের পাপ, সেইসাথে গৃহশান্তি ও সুখের জন্য মানুষের চির হাহাকার ও আর্তনাদ। এবং উল্লেখ্য, এ কারণেই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েও আর্নেস্ট হেমিংওয়ে লিখতে পারেন ‘আর যুদ্ধ নয়’ (আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’), জার্মান ঔপন্যাসিক এরিখ মারিয়া রেমার্ক লেখেন ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, যেখানে যুদ্ধে-অংশ-নেওয়া সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ সৈনিকদের চোখে খেলা করে ছেড়ে-আসা পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে কাটানো ঘনিষ্ঠ সময়গুলির স্মৃতি, মিখাইল শলোখভের ‘ব্যালাড অব আ সোলজার’-এর সেই একাকী সৈনিক যুদ্ধশেষে নিজ গ্রামে ফিরে এসে যে ক্লান্ত শূন্য চোখে চেয়ে রয় ধ্বংস হয়ে যাওয়া তার প্রিয় বাড়িটির দিকে আর সেই দগ্ধ ধ্বংসাবশেষের ভিতর খুঁজতে থাকে তার হারানো স্বজনদের পুড়ে-যাওয়া দেহের হাড়।

তাঁর ‘অপারশন জয়বাংলা’ শিরোনামের গল্পটি (এটি অবশ্য আলোচ্য গ্রন্থভুক্ত নয়) যেদিন পড়েছিলাম, বিস্মিত আর পুলকিত হয়েছিলাম প্রথমবারের মত। এটি কোনও সাধারণ গৎবাঁধা গল্প নয়, এই প্রত্যয় মনে জেগেছিল। এরকম গল্প লিখতে ভিন্নরকমের দৃষ্টি লাগে। ভালবাসার সাথে লাগে সত্য বলার অকৃত্রিম ব্যাকুলতাও। আমার মনে হয়েছে, গল্পলেখার জন্য এই যে অবলোকনগত শক্তি ও উদ্দীপনা, এর একটি দুর্ভিক্ষ আছে এইদেশে। আছে এরকম নিরপেক্ষতারও অভাব। মুক্তিযুদ্ধের অপরাপর গল্পগুলি যেন জোর ক’রে লেখা। কিছুই তার বিশ্বাসযোগ্য নয়। ‘টোপ’ গল্পে কিছুটা ভিন্নভাবে এসেছে গল্পকথকের সেই একই পর্যবেক্ষণ। যুদ্ধদিনে নানা অন্যায় ঘটেছে। বিবদমান দুই দলই সংঘটন করেছে অপরাধ। আবার মানবিকতার উপাদানগুলি যে দুই পক্ষেই আছে, তাও তিনি খুলে দেখাতে দ্বিধা করেন নি। এই স্বচ্ছদৃষ্টি মুক্ত অন্বেষা একজন সত্যলগ্ন লেখক হিসাবে তাঁকে বিশেষ আলাদা ক’রে চিহ্নিত করে। তাই তিনি অনাড়ষ্ট অনায়াস এই কথা ব্যক্ত করতে পারেন যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তারাই বেশী জোরালোভাবে উচ্চারণ করে, যারা যুদ্ধ করে নি। এবং এরাই মুক্তিযুদ্ধ সনদ নিয়ে কালে ব’নে গেছে মুক্তিযোদ্ধা; প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই সেই সনদ নিতে আগ্রহী হয় নি, কারণ দেশকে ভালবেসে তারা যুদ্ধে গিয়েছিল, সনদ বাগিয়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিতে তারা আগ্রহী ছিল না। আসল মুক্তিযোদ্ধারা তাই দারিদ্র্যে, অবহেলায় কালযাপনশেষে লোকচক্ষুর আড়ালে মারা যায়। কেউ কেউ পঙ্গু আর ভিক্ষুক হয়ে চিরবিদায় নেয়। এই সত্য আরও নির্মম হয়ে ওঠে যখন ক্ষমতার সঙ্গে থাকা দুর্বৃত্তরা প্রকৃত সৎ মুক্তিযোদ্ধাদের ‘রাজাকার’ ও ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেয় নিজেদের দুর্নীতি আর লুটপাটকে আড়াল করার উদ্দেশ্যে।

সদ্যস্বাধীন দেশের কোনও এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশ জনের একটি দল, যে-দলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা মাত্র তিনজন, লুকিয়ে-থাকা দুশমন রাজাকারদের খুঁজতে বের হয়। কিন্তু সেই লুকানো দুশমনদের সন্ধান কেউ দিতে পারে না। অবশেষে জানা যায়, দূরের চরে এক গরীব ভূমিহীন চাষীর ঘরে আশ্রয় নিয়েছে একজন ‘রাজাকার’। শত্রুসন্ধানে-নামা সেই উত্তেজিত দলটি অনতিবিলম্বে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। তারা জানতে পারে, নিঃসন্তান ঐ গরীব গৃহস্থ ‘রাজাকার’টিকে নিজ সন্তানের মতোই স্নেহ করে। বিহারী হওয়ায় যুদ্ধের সময়ে মুক্তিসেনারা ওর বাবা-মা ও ভাই-বোনদের মেরে ফেললে গৃহস্থ-বউ সেই পরিবারের একমাত্র জীবিত ছেলেটিকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। বিহারী ছেলেটি তাকে ‘মা’ ডাকে, এবং তার স্বামীকে ডাকে ‘বাবা’। সে যে রাজাকার নয় এবং কারও কোনও ক্ষতি করে নি, এই কথা কেঁদে কেঁদে বার বার বলতে থাকে গৃহস্থ-বউ। কিন্তু কে শোনে সে-কথা। ইতোমধ্যে কেউ একজন এসে খবর দেয়, সে ঐ ‘রাজাকার পোলা’কে দেখেছে দৌড়ে খালের দিকে যেতে। অমনি গোটা দল ছোটে শত্রুকে ধরবার জন্য। দলটি দ্রুত খালের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুলে পলায়নপর সেই শত্রু জান বাঁচাতে লাফ দিয়ে খালে নামে। মহা উৎসাহে ওকে ধরে যখন উপরে তোলা হয়, দৃশ্যপটে ছুটে এসে হাজির হয় চরের সেই নিঃসন্তান প্রান্তিক কৃষকের বউ; কেবল বিহারী পরিবারের সন্তান হবার কারণেই ছেলেটিকে না মারার জন্য সজল চোখে উপর্যুপরি অনুরোধ করতে থাকে। “আমারে মাইরা  নদীতে ভাসায় দাও, তবু এতিম পোলাডারে মাইরেন না গো।” দলের একমাত্র শিক্ষিত তরুণ মুক্তিযোদ্ধার মন বিচলিত হয় —“জাত-ধর্মের সীমা-ডিঙানো মাতৃহৃদয়ের আবেগ, নিজ জীবনের বনিময়ে হলেও ছেলেটিকে বাঁচানোর আকুলতা দেখে আমি কিছুটা থমকে যাই। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের আবেগ, এবং স্বাধীনতার অবশিষ্ট শত্রুদের খতম করার আক্রোশ এবং অপারেশনে এসে এত দৌড়ঝাঁপ করার হয়রানি কি সামান্য এক নারীর কান্নায় এত সহজে ধুয়ে-মুছে যেতে পারে! …আশ্রয়দাত্রী মহিলার কান্না ছাড়াও নদীতে হাবুডুবু-খাওয়া শত্রুর বিধ্বস্ত চেহারা আমার ভিতরের উত্তেজনা শুষে নিতে শুরু করেছে। কত বয়স হবে ছোট্ট ছেলেটার? বড়জোর তের-চৌদ্দ? এ যেন বনে বড় বাঘ মারতে এসে ইঁদুর ধরা!”

গল্পের এই পর্যায়ে ঐ তরুণের হস্তক্ষেপেই বাবা-মা হারানো নাবালক বিহারী ছেলেটি ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড থেকে নিষ্কৃতি পায়। জীবিকার তাগিদে শহরে থিতু-হওয়া সেদিনের সেই তরুণ বহু বছর পর যখন গ্রামে ফেরে, গঞ্জের হাটে লাউয়ের খোলের একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা-করা এক খুনখুনে অস্থিচর্মসার বৃদ্ধকে দেখে। জানতে পারে, সেই অনাথ বিহারী ছেলে বসিরই আজকের গায়ক ভিখিরি। নিজের রচিত বাংলা গানে নিজেই সুর যোজনা ক’রে গায় আর গামছা বিছিয়ে সেই গামছায় এক টাকা, দুই টাকা ক’রে শ্রোতাদের দেওয়া ভিক্ষা সংগ্রহ করে…।

গল্পকার মঞ্জু সরকার বেশ দক্ষ হাতে বর্ণনা করেছেন একটা সময়ের হাস্যকর বালখিল্য উত্তেজনা, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে ফুটিয়েছেন তার বিচ্যুতি, তার বালসুলভ ভ্রষ্টাচার। গল্পের ‘টোপ’ নামটিও এক গভীর প্রতীকী ব্যঞ্জনায় ধরেছে অতীত ও বর্তমানকে, একইসঙ্গে। তবে এই গল্পে আদতে ধরা আছে একের ভিতর অনেক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের নানা বিভ্রম আর ভ্রান্তি; স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, অলীক উন্নয়নের যাবতীয় মিথ্যা প্রচারণার পাশে আমাদের দৈন্যপ্রকট হা-জীবনের ছবি, দগদগে ঘা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে অদ্যাবধি এই দৈন্য অনড়, বরং অনিশ্চয়তার আরও ঘোর অন্ধকারের দিকেই এর লজ্জাময় সরণ।

‘মুখোশের আড়ালে’ গল্পটি করোনাকালীন সময়ে জীবিকার অনিশ্চয়তা, হতাশা এবং স্বজনবিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ জীবনের নিষ্করুণ পরিণতি নিয়ে লেখা এক দরিদ্র রিক্সাচালকের কাহিনি। প্রতিদিন রিক্সা না চালালে যাদের পেটের ভাত জোটে না, সরকার-ঘোষিত ‘লক ডাউন’ তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটি যেন ছিনিয়ে নিতে উদ্যত। অতিমারি-কালের এই খুব-চেনা গল্পটির সাথে লেখক আরও কিছু জুৎসই বিশ্বস্ত উপাদান যোগ করেছেন; আছে নাটকীয়তা। এতে গল্পটি বেশ গাঢ় আবেদনে জীবন্ত ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। একে তো করোনার এই সঙ্কট, ভীতি, সঙ্গে যুক্ত হলো ‘লক ডাউন’, তায় আবার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নিজের মোবাইল ফোনটি হারিয়ে রিক্সাচালক কমরের মানসিক অস্থিরতা বাড়ে। গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত স্ত্রী-কন্যার সাথে প্রতিদিন কথা বলত কমর। তাদের খোঁজখবর নিত। ফোনে-সেইভ-করা স্ত্রী আছিয়ার বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠাত। কিন্তু ফোন হারিয়ে ফেলার পর সেই নম্বর মুখস্থ না থাকায় টাকা পাঠানো কিংবা যোগাযোগ কিছুই আর করতে পারে না। অতিমারির সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরেও বাড়ি ফিরে না গিয়ে কমর একদিন স্ত্রীকেই শহরে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা জানালে আছিয়া তাকে ফোনে বলেছিল, “তোমারে করোনায় ধরলে ঢাকা যায়া মুই কার বাল ফেলাইম?”

স্ত্রী-সন্তানের জন্য ভালবাসার অনুভূতি সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই এক। একই তার গাঢ় রঙ ও প্রকাশভাষা। গ্রামে গিয়ে স্বজনদের মুখ দেখবে ব’লে পনেরো দিন রিক্সা চালিয়ে একটা নতুন মোবাইল ফোন, মেয়ে উম্মি আর স্ত্রী আছিয়ার জন্য নতুন দুই জোড়া থ্রী-পীস পোশাক এবং আরও কিছু জিনিস কিনে বাড়ি রওনা দেয় কমর। লক ডাউনে বাড়ি যাওয়াটাও সহজ নয়। প্রথমে পিক-আপ ভ্যান, তারপর মালবাহী ট্রাকে, অতঃপর লেগুনায়, শেষে বেশ কিছু পথ হেঁটে গ্রামের কাছে বাজারে গিয়ে হাজির হয়। এদিকে টানা পনেরো দিন তাকে ফোনে না পেয়ে বাড়ির সবাই ধারণা করেছিল, সে করোনায় মারা গেছে। কিন্তু তাকে আজ হঠাৎ বাজারে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠে গ্রামের একজন। মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় তার আগমনের খবর। পনেরো দিন স্কুলঘরে তাকে আইসোলেশনে থাকার হুকুম দেওয়া হয়। বাবার জন্য খাবার-নিয়ে-আসা কন্যা উম্মিও বাবার স্নেহের ডাকে কাছে আসে না। বলে, “না, তুমি করোনা আনছ।”

একটানা পরিশ্রম, অপুষ্টি, গরমে দীর্ঘপথ ভ্রমণ, পায়ে হাঁটা — হয়তো এসব কারণে দেহে জ্বর ওঠে কমরের। অসুস্থ শরীর নিয়েই স্ত্রী-সন্তানকে একনজর দেখার জন্য তবু আইসোলেশন অমান্য ক’রে রাতের আঁধারে পায়ে হেঁটে বাড়ির উঠানে এসে হাজির হয়; হাতে একটা পলিব্যাগের ভিতর ওদের জন্য আনা উপহার। অনুচ্চকণ্ঠে স্ত্রীর নাম ধরে ডাকে। কিন্তু আছিয়া ভয় পেয়ে যায়। আতঙ্ক আর অশিক্ষার সাথে গ্রামীণ কুসংস্কার যোগ হয়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে, “ও বাজান, ও বুজান! বাড়িত করোনা আইছে। করোনায় উনার ভেক নিয়া ডাকে আমারে।” আছিয়ার চিৎকারে বাড়ির লোকজন সবাই জেগে উঠলে কমর হাতের উপহারের ব্যাগটি একটা আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসে। ভোরে পায়ে হেঁটে উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেয়।

গল্পের শেষ অংশ বড় করুণ। হাসপাতালের বারান্দায় নিথর পড়ে আছে মুখে-মাস্ক এক লোকের মৃতদেহ। করোনা সন্দেহে নিকটজনদের কেউ আসে না তাকে কবর দিতে। লোকটার মোবাইল ফোন থেকে উদ্ধার হয় তার পরিচয়। পুলিস সেই মৃতদেহ সমাধিস্থ করে। মৃত্যুর মুহূর্তেক আগেও লোকটা ভাবছিল, আমগাছের ডালে ঝোলানো সেই উপহার তার স্ত্রী-সন্তানে পেল কিনা।

ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর                লেখক- মঞ্জু সরকার                  প্রকাশক- অনুপ্রাণন প্রকাশন    প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ার- ২০২৩        প্রচ্ছদ- মামুন হোসাইন                             মূল্য – ৳ ৪০০/-

‘মুখোশের আড়ালে’ এভাবেই নির্দয় এক সময়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। যখন সব মানুষেরই মুখ মুখোশে ঢেকে যায়, তখন তারা পরস্পরের কাছে অচেনা, অনধিগম্য; এমনকি এতোদিনের চেনা খুব কাছের মানুষটিও। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী যত না প্রকৃতির খেয়াল, তার চেয়ে বেশী দায়ী মানুষেরই নির্বোধ স্বার্থান্ধতা। একটি কেবল জীবন নিয়ে রচিত তবু এই গল্পে আঁকা ঐ জীবন হয়ে উঠেছে বহু মানুষের জীবনের প্রতিভূ।

‘জেলে একা ডা. আফ্রিনা আখতার’ প্রকরণে কিছু জটিলতর। এটিও করোনাকালের আরেক অন্ধকার দিক নিয়ে লেখা। লোভীর পাতা অসাধু পুঁজির জাল কিভাবে অন্যের জীবনে অশনি সংকেত হয়ে আসে, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক ডা. আফ্রিনার সুখ্যাতি ও তাঁর একাকীত্বকে একটা সঙ্কটে ফেলে দেখিয়েছেন; শাসনক্ষমতার হাতে বন্দী দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা ও তৎসঙ্গে প্রভাবশালীর দুর্নীতি, এ দুয়ের যৌথলীলার কাছে জিম্মি যে সমাজ, তারই বয়ান এই গল্প। এদের নেপথ্যলীলা একটি সঙ্কটের ভেতর টেনে আনছে দুরতিক্রম্য আরেক সঙ্কট ও বিপন্নতা। বিজড়িত করছে বহুজীবন। তার পরিণতি ও দায় পোহাতে হচ্ছে নিরপরাধকে। এটিও একটি চমৎকার গল্প।

‘ডিজিটাল দেশের কৃষ্ণবিবর’-এ ধৃত হয়েছে স্মার্ট ফোনের বিষফাঁদ ও অপরাধীচক্রের অদৃশ্য হাতের ডাকে হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্প। প্রযুক্তির হাতছানিতে প্রকৃতি ও ভুমিলগ্ন জীবনের সারল্য থেকে যেদিন মানুষ বিচ্ছিন্ন হল, সেদিনই রচিত হল ট্র্যাজেডি। দেশ ও সমাজ তলিয়ে যেতে লাগল এক অতলান্ত অন্ধকারে। লেখক এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অপরাধমূলক ব্যবহারের দিকে পাঠকের নজর আকর্ষণ করেছেন এবং এক বৈরীকালের হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার সমূহ বিপদ সম্পর্কে তাকে দিয়েছেন সাবধানী হবার পাঠ।

‘একটি হ্যান্ডশেক ও হাজার দীর্ঘশ্বাস’-এর গল্পভাবনাটি নিঃসন্দেহে খুব ভালো। তবে প্রকরণে এটি অন্য গল্পগুলির চেয়ে দুর্বল ব’লে আমার ধারণা। দু’জনের দীর্ঘ সংলাপ দিয়ে গল্পটি শুরু ও শেষ হয়। এই গল্প প’ড়ে আমার মনে হয়েছে, একে অন্যভাবে উপস্থাপন করা যেত। তবে দ্বিতীয় চিন্তায় এই ভাবনা মনে আসে, সামাজিক বাস্তবতার প্রকাশে কখনও কখনও লেখককে ভিন্ন পথেরও আশ্রয় নিতে হয়।

‘উৎসমূলের আগুন’ ফেসবুকীয় সম্পর্ক এবং তা থেকে উদ্ভূত জটিলতা নিয়ে লেখা। আধুনিক কালের নানা প্রবাহের মধ্যে গল্পকারের এই সাহিত্যিক সন্তরণে লেখক পাঠকের বিস্মিত সমীহ ও সম্ভ্রম আদায় ক’রে নিতে পেরেছেন।

বৃদ্ধকালের একাকীত্ব ও প্রেম নিয়ে রচিত ‘মৃত্যুঞ্জয়ী লম্ফ’। প্রেমের অনুভবে, ভালবাসায় লোকে নতুন ক’রে জন্মায়। মৃত্যুচিন্তার থেকে ফিরে আসে জীবনের নিগূঢ় সীমানার ভেতর। এই গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক একটি বিশেষ বয়সের মনস্তাত্ত্বিক মানচিত্র ও জীবনঘনিষ্ঠ অধিকার সচেতনতার বলিষ্ঠ ছবি এঁকেছেন।

গল্পবইটির বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বেশকিছু বানান ভুল আছে যা কিছুটা পীড়াদায়ক। কিন্তু সব মিলিয়ে সময়ের শক্তিমান কথাকার মঞ্জু সরকারের এই নতুন গ্রন্থটির পাঠ আমাকে প্রভূত আনন্দ দিয়েছে। এবং সচেতন সব পাঠককেই একইরকম আনন্দ দেবে ব’লে আমার বিশ্বাস।

Read Previous

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৪র্থ সংখ্যা (এপ্রিল-২০২৩)

Read Next

ট্রেজার বক্স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *