
‘‘বিভাজন ও বিচ্ছিন্নতা, তা ব্যক্তির দলের সম্প্রদায়ের কিংবা মহৎ-সমষ্টির; প্রকৃতপক্ষে তা মানুষের সংকট। দেশকালের গ-িকে ছাড়িয়ে এটি প্রকৃতই সামগ্রিক মানুষেরই সংকট। প্রসঙ্গটি না জাতীয়তার না সাম্প্রদায়িকতার।” দেশভাগ, সংকীর্ণ রাজনীতি বা জাতীয়তাবাদের সমস্যা বিষয়ে লিখতে গিয়ে এভাবেই শুরু করেছেন প্রাবন্ধিক শামীম। শুরুতেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, সামগ্রিকতার দৃষ্টিতে না দেখলে এই সংকটের স্বরূপ উন্মোচিত হবে না।
শামীমের দেখবার ভঙ্গি তাত্ত্বিক এবং এমনই তাঁর বিশ্লেষণক্ষমতা যে, আশ্চর্য হই পড়তে পড়তে। আমাদের প্রজন্মে তাঁর মতো মেধাবী প্রাবন্ধিক চোখে পড়েছে কি আমার?
সহজ অর্থে আমরা যেভাবে দেশ ও ভাগ শব্দ দুটি উচ্চারণ করি, দেশভাগ ধারণাটি তার চেয়ে অনেক ব্যাপক। দেশ ধারণাটির সঙ্গে মানুষের স্বাতন্ত্র্য, বৈচিত্র্য ও সংহতিবোধ যুক্ত হয়ে আছে। আর দেশের বিপরীতে থাকে আরো আরো দেশ ও মানুষ। ‘‘এই সমাজ-রাষ্ট্রিক ব্যবস্থার ভিতর মানুষেরা মূলত তাদের বৈচিত্র্যের, স্বাতন্ত্র্যের দাবিতে বিচ্ছিন্ন হয়; বিভাজিত হয় বিপরীতরূপে ঐক্যের নামে, সংহত হওয়ার মানসে। সুতরাং মানুষের চেতনায়, প্রকৃতিতে সর্বদা এক অনির্ণেয়, প্রতিকারহীন বৈপরীত্য বিরাজ করে। মানুষ বৈপরীত্যে বসবাস করে, বাস করে দ্বন্দ্বের ভিতর, দূরত্ব ও নৈকট্যের বিপরীতমুখী প্রবণতায়।’’ এই পর্যন্ত এসেই অনেকখানি চিন্তা করতে হয়। কেননা তাঁর প্রবন্ধ টানা পড়ে যাওয়া যায় না। ভাবতে ভাবতে এগোতে হয়।
বিশ শতকে যে ভারতভাগ হল, এই সংকটের কারণ কী?
ভারতে বহু জাতি হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও, ভারতভাগ হল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে!
সমগ্র উনিশ শতক জুড়ে হিন্দুত্ব কীভাবে জাতীয়তা হয়ে উঠল, উল্টোদিকে মুসলিমরা খুঁজে নিচ্ছিল আরেকটা জাতীয়তার ধারণা। এই জটিল বিষয়টি নিয়ে শামীম বিস্তৃত আলোচনা করেছেন ‘বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট: সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম’ প্রবন্ধে। ‘‘এমন মানসিকতায় হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই—বাঙালি বৌদ্ধ, জৈন, ক্রিশ্চিয়ান, সহজিয়া মতের জনকুল, বাউল, চার্বাক প্রভৃতি ধর্ম ও মতের মানুষকে হিসেবেই রাখতে চায় নি।’’
ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মের সংকীর্ণ আদর্শের দোহাই দিয়েও সংহত করা যাচ্ছিল না, তার জন্য দরকার একটা প্রতিপক্ষের। এই প্রতিপক্ষ হল এদেশীয় মুসলমান। কিন্তু ‘‘জাতীয়তার আদর্শে আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে উপনিবেশ থেকে মুক্তির প্রশ্নে প্রতিপক্ষ হবার কথা ছিল বিদেশী শাসক ইংরেজগণই। যদিও আধুনিক জাতীয়তাবাদ সমূহও প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িকই। কিন্তু সম্প্রদায়ের পরিচয় যদি হয় ধর্মের পরিচয়ে এবং সেই ধর্মসম্প্রদায় যদি এমন সংঘাত মানসে অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রতী হয় ও স্বতন্ত্রতা রক্ষার নামে করতে থাকে প্রতিপক্ষকে অন্যায্য আঘাত, তখন ধর্মাদর্শের মাহাত্ম্য আর থাকে না।’’ (দেশভাগ: সংকীর্ণ রাজনীতি, জাতীয়তা ও সংস্কৃতি চেতনার বহুচ্ছিন্ন বৈজয়ন্তী)
বাঙালি জাতির নানাবিধ সংকটকে বুঝতে শামীম সাঈদের এই বই পড়তেই হবে।
আলোচ্য গ্রন্থ: বাাঙালির দ্বিধার চলক
লেখক: শামীম সাঈদ
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন (ঢাকা: ২০২০)
প্রচ্ছদ- তৌহিন হাসান
পৃষ্ঠা- ৮০
মূল্য- ১৭৫/-
শামীম সাঈদ, কবি ও গল্পকার। জন্ম- ১০ জানুয়ারি ১৯৭৯। কলসনগর, লালপুর নাটোর।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- এই কথা বৃষ্টিবাচক, এভাবে খুলবে না আঁচলের খুঁট, সদা ভাগতেছে ভববান।
গ্রন্থটিতে সংকলিত প্রবন্ধসমূহ:
১. বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট: সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম
২. দেশভাগ: সংকীর্ণ রাজনীতি, জাতীয়তা ও সংস্কৃতি চেতনার বহুচ্ছিন্ন বৈজয়ন্ত
৩. ভাষার অশ্বমেধ যজ্ঞ ও বাঙালির বায়ান্নর একুশ