অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৯, ২০২৪
৬ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অনিকেত সুর -
বৃত্তের নিশিচারণ : বহিরাবয়ব ও অন্তঃস্রোত

সাহিত্যের চর্চায় একজন লেখকের অবাধ স্বাধীনতাটাকে আমি চূড়ান্ত বলে মানি এবং এই স্বাধীনতার প্রতি আমি বরাবর শ্রদ্ধাশীল। কী, কেন এবং কীিভাবে লিখবেন, এই সিদ্ধান্ত কেবল তারই নিজের। লেখার মধ্য দিয়ে নিজের স্বাধীনতাকে উপভোগ করেন বলে তিনি লেখেন। নইলে লিখবেন কেন! অন্যদিকে, পাঠকেরও স্বাধীনতা আছে ঐ লেখা নিয়ে নিজের মতো করে ভাবার, প্রতিক্রিয়া জানানোর। কখনো কখনো এরকম প্রতিক্রিয়া বিরুদ্ধবাদী, এমনকি নিন্দাশ্রিতও হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এখন এ দুয়ের মধ্যবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা সম্বন্ধসেতু নির্মাণের কথা ভাবা যেতেই পারে যা লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটা কার্যকর মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে দেবে, লেখার স্থায়িত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যার ভূমিকাটা অস্বীকারের জো নেই। অভঙ্গুর এই সেতু নির্মাণের কিছু আবশ্যিক উপাদান আছে। আমরা সেসব নিয়ে এখন কথা বলব।

শিল্প-সাহিত্যের প্রধান শক্তিটি নিহিত থাকে এর প্রেমঘন মানবিক আবহের ভেতর। মানবিকতার এই রূপায়ণে যে সৃজনকর্ম যত শক্তিমান, তার টিকে থাকার সম্ভাবনা তত জোরালো। দ্বিতীয় উপাদানটির নাম দ্বন্দ্ব। মানুষের জীবন আদি ও অন্তে এবং মধ্যবর্তী স্তরে একটা দ্বান্দ্বিকতার ভেতর দিয়ে গমন করে। এই দ্বন্দ্বময়তাকে উৎকৃষ্টরূপে ধারণ না করতে পারলে শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস ব্যর্থ হবে। এটি প্রথম উপাদানের সাথে ওতপ্রোত জড়িত। প্রধান এ দুটি উপাদানের সঙ্গে আরও কিছু পার্শ্ব-উপাদান আছে, যেসবের ব্যবহার নানা মাত্রায় উপস্থাপিত হয় লেখক বা শিল্পীর নিজস্ব মেধা, দর্শন ও রুচি বা ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে। তবে মূল কথাটি এই, সব শিল্পকর্মই মানুষের প্রতি শুদ্ধ ভালবাসার আবেগ থেকে তৈরি। একটা নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে চলমান জীবনকে প্রত্যক্ষ করা, তার নিরাসক্ত বা নির্লিপ্ত বয়ান সাহিত্য বা শিল্পের কাজ হতে পারে না। আর এ কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘গল্প ফটোগ্রাফি নয়’। যা দেখছি, তার অবিকল প্রাণহীন শুষ্ক বর্ণনায় অন্য কিছু হতে পারে, গল্প নয়। এর সাথে জড়িয়ে থাকে লেখকের অভিপ্রায়ও। এবং পাঠকেরা গল্পের শরীরে সেটিকেই খুঁজে বেড়ায়। সেই সাথে খোঁজে জীবনের দ্বান্দ্বিক রূপটিকে; আর এ দুইয়ের দ্বৈরথে লেখক কাকে জয়ী দেখাতে চান কিংবা কার প্রতি তাঁর কলমের গূঢ় পক্ষপাত। এখন আসা যাক, এ মাপকাঠিতে রেহানা বীথির গল্পগুলো কীরকম উৎরেছে, সেই আলোচনায়।

চৌদ্দটি গল্প নিয়ে তাঁর বই ‘বৃত্তের নিশিচারণ’। বিষয় নির্বাচনে বৈচিত্র্য যেমন আছে, উপস্থাপনার ঢংও তেমনি একটি অন্যটির চেয়ে আলাদা। গল্পকার-কবি রেহানা বীথির, খুব সম্ভবত, দ্বিতীয় গ্রন্থ এটি। গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো পড়ার পর মনে হয়েছে, বইয়ের নামটি এমন কেন? যদিও এ নিয়ে ফ্ল্যাপে লেখকের একটি নিজস্ব স্বল্পভাষণ বক্তব্য মুদ্রিত, আমার কাছে সেটি কিন্তু বোধগম্য হয়নি। এই সাধারণীকরণে একটা আত্মবিচ্ছিন্নতা আছে যা ভ্রান্তিমূলক; কারণ, কিছু গল্পের সাথে এই প্রত্যয়টি ঠিক যায় না। যাই হোক, তবু নামকরণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের আধেয়, যা নিবিষ্ট পাঠকের ঔৎসুক্য তৃপ্তি ও সন্তোষ বিধানের আসল জায়গা। এ কারণে ঐ নামের জোরাজুরিকে একরকমের উপেক্ষা করা যায়।

এই গ্রন্থের সবচেয়ে ভালো গল্পটি ‘জুলেখাচরিত’। একজন পাঠক হিসাবে এর কাহিনীর সাথে একাত্মবোধ না করে পারিনি। বেশ দরদভরা লেখা। গল্পের মূল চরিত্র জুলেখার শ্রম, সংগ্রাম ও স্বপ্নের কথাগুলো একটা দ্বান্দ্বিক পটে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন লেখক। শুরু থেকে শেষ অব্দি এটি পাঠকের ঔৎসুক্য ও মনোযোগ ধরে রাখতে সক্ষম। কাহিনীর অন্তভাগে এর আবেদন আরও ঘন ও গাঢ়। জুলেখার হার-না-মানা জেদি আর সাহসী ব্যক্তিত্বের তুমুল উন্মোচন ঘটে এই পর্যায়ে এসে। একটা নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। একদা নিজ সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার-করা যে-লোকটির জিঘাংসার হাত থেকে গর্ভের শিশুটিকে বাঁচাতে রাতের আঁধারে গ্রাম ছেড়ে একাকী শহরে পালিয়ে এসেছিল জুলেখা, ছয় বছর পর শিশুসন্তানসহ গ্রামে ফিরে গিয়ে সেই লোকটিকেই সবার সামনে ওর গর্ভজাত ছেলের পিতা হিসাবে প্রমাণ করে দেয়। বিস্ময়চকিত চোখে সবাই দেখে, ছেলের মুখের সাথে পিতার মুখাবয়বের অবিকল সাদৃশ্য। গ্রামের অর্ধেক মানুষ পক্ষ নেয় জুলেখার…।

এটিকে বইয়ের সেরা গল্প বলার কারণ এই, একটা মানবিক স্রোতের সঙ্গে দ্বন্দ্বময়তা আর লেখকের অভিপ্রায়টিও গল্পশরীরে একত্র এসে মিলেছে। এর সংলাপগুলো অকৃত্রিম, সংহত এবং কাহিনীর অগ্রগমন বেশ সাবলীল। টের পাওয়া যায় গল্পকথকের শক্তি। তবে নিজের এই শক্তির প্রতি সুবিচারটি লেখক নিজেই সবসময়ে করতে পারেননি।

প্রথম গল্প ‘অচিনপাখি’র বিষয়বস্তু হতদরিদ্র স্বল্পবুদ্ধি এক বালিকার গৃহকর্মী জীবন ও তার অবৈধ গর্ভধারণ। বাড়ির মালিক, যদিও স্ত্রী আছে লোকটির, ‘সুখী’ নামের ঐ আলাভোলা মেয়েটির সারল্যের সুযোগে তাকে নিয়মিত ধর্ষণ করে যায়। এতে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। বিত্তবান গৃহকর্তার যৌনলাম্পট্য ও গোপন যৌনাচার নিয়ে এরকম গল্প বাংলা ভাষায় ইতিপূর্বে বেশকিছু লেখা হয়েছে। অতএব, বিষয়টি পুরোনো। কাহিনীর সমাপ্তিরেখায় এসে গৃহকর্ত্রীর আপাত মধুর ‘সুখী’ সম্ভাষণ এবং মেয়েটির চোখের নীরব প্রতিক্রিয়ায় যে হেঁয়ালি সৃষ্টি করা হয়েছে, তা দুর্বোধ্য নয় যদিও, গল্পের আকর্ষণ তাতে বৃদ্ধি পায় না কিছুতেই। এটি নানা দিকেই একটি দুর্বল সৃজন। এর প্রধান দুর্বলতা এর বর্ণনাভঙ্গি। বোঝা কঠিন, লেখক গৃহকর্তার অবৈধ লালসাটাকে কেন এরকম স্থূলভাবে উপস্থাপন করলেন। এর আগে বেশকিছু লেখককে যৌনদৃশ্যের বর্ণনা তাদের গল্পে একইভাবে করতে দেখেছি যা প্রকারান্তরে একটা ভোঁতা প্রভাব তৈরি করে। গল্পে এই প্রবণতার অনুসরণকে আধুনিক বলা যায় না কিছুতেই। বোঝা যায় না, গল্পকারের পক্ষপাতটা কোনদিকে। এই গল্পের নাম ‘অচিন পাখিইবা কেন! ‘মৃত হাঁস, মাতাল ও মানবিক গাছ’ একইরকম একটি ব্যর্থ গল্প।

তবে ‘জীবন্ত ক্যানভাস’ নিঃসন্দেহে এই লেখকের একটি শক্তিশালী সৃজন। চমৎকৃত হওয়ার মতো। গল্পটি পড়তে পড়তে আমি ভেবেছি, এটি তিনি কীভাবে লিখলেন! এর বয়ান নিখুঁত। আদ্যন্ত একেবারে টানটান। প্রকরণে অনেকটাই ইউরোপীয় ধাঁচের। জাপানি গল্পকার রিউনোসুকে আকুতাগাওয়ার গল্পের মতোও বলা যায় একে। একজন শিল্পী ছবি আঁকছে। গোপন কোনো একটি জায়গায়। স্বগতোক্তির ভেতর দিয়ে সে প্রকাশ করছে তার মনোজগত এবং সেই সাথে ছবিটির বর্ণনা। গল্পের শেষদিকে এসে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এতক্ষণ সে কার ছবি আঁকছিল। আসলে কী ঘটেছে ঐ নারীর ভাগ্যে। যেন কেউ একজন সজোর আঘাত করল আমার মাথায়; আর আমার গোটা দেহটা ভীষণ টলতে টলতে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। দুর্দান্ত আর মর্মস্পর্শী এই লেখা লেখকের শক্তির কথাটি আরও একবার জানান দেয়। কিন্তু আমার নিজস্ব মানদণ্ডে এটি পরিপূর্ণ নিখুঁত নয়। কেউ কেউ বলেন, গল্পকারকে নির্মোহ হতে হবে; তিনি কাহিনীর প্রবাহ থেকে দূরে থেকে একে অবলোকন করবেন। আমি বলি, না! লেখককে অবশ্যই তাঁর দর্শনটি জানিয়ে দিতে হবে, যেমন করেছেন ও হেনরি তাঁর ‘শেষ পাতা’য়; রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিচারক’ গল্পে। ঐ শিল্পীটি যে আদতে এক ঘৃণ্য ও ভয়ঙ্কর অপরাধী, এই কথাটি কেন গল্পকার কোনো উপায়ে গল্পদেহে যুক্ত করলেন না?

‘আসন্ন বসন্তের বেহালাবাদক’ গল্পটি কিছু আলাদা। একটা দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে লুপ্তপ্রায় এক আদর্শ আর মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে। আমার ভালো লেগেছে। তবে লেখক গল্পটিতে আরও কিছু যোগ করতে পারতেন। তাতে আকর্ষণ আরও বাড়ত। আর কবিতাটা হুবহু না দিয়ে কবিতার কথাগুলোকে গদ্যাকারে বর্ণনা করলে ভালো হতো, যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘হারজিত’ গল্পে করা হয়েছে। আর রাণী কী করে জানলেন, কেউ একজন তাঁর কাছে একটি আর্জি নিয়ে যেতে চাইছে? বিষয়টা পরিষ্কার নয়। তবু গল্পটি উপভোগ্য।

‘অবরুদ্ধের আহুতি’ গল্পে কিছুতেই স্পষ্ট নয়, উদ্বন্ধনে ঝুলে থাকা লোকটি কে? কোনো ইঙ্গিতও নেই। ‘বুঝি গো রাত পোহালো’ এক বেকার যুবকের মানসিক অস্থিরতা আর অনিশ্চিত দিনযাপনের কাহিনী। গল্পের শেষাংশে আছে আশাবাদের ইঙ্গিত। দুজন আশাহত মানব-মানবীর সম্পর্কের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে লেখকের দরদি মনের ভাবনা; সেইসাথে ভাঙাচোরা সমাজের একটি খণ্ডচিত্র। যদিও দ্বান্দ্বিকতা তেমন প্রবল নয় এইখানে। ‘একটি ভাঙ্গনের গল্প’ এক হতভাগ্য দরিদ্র নারীর কাহিনী। পারিবারিক জীবনে আশাভঙ্গ আর অসুখী হওয়ার সূত্র ধরে কীভাবে সে একদিন সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; কীভাবে তার জীবন হারিয়ে যায় এক অতল নিরুদ্ধার অন্ধকারে। মোহ আর অপরাধের ফাঁস-লাগা বন্দি জীবন এবং তার একটানা প্রলম্বিত হাহাকার। এই গল্পটিও ভালো। মর্মস্পর্শী। কোনো আশা নেই তবে? এই প্রশ্নে ঘুরপাক খেতে খেতে পাঠকের মন ভিজে যায়; বড় বেদনার্ত হয়ে ওঠে। ভালোবাসা আর সুখী জীবন গড়ার আকাঙ্ক্ষাটি যেন এক অমোচ্য তমসার ভেতর অনিশ্চিত এক ভাবীকালের দিকে চেয়ে থাকে হতাশ্বাস। ‘কুদরত খাঁর নারীঘটিত বিষয়সমূহ’ একটি কৌতুক রসাশ্রয়ী গল্প। গল্পটির ভাষা আর বয়ানঢঙটি নির্মল হাসির খোরাক জোগায়। এই ঘরানায় এটি আদ্যন্ত সার্থক এক রচনা। বেশ উপভোগ্য।

কোনো কোনো গল্পে কিছু অপূর্ণতা আছে, তা ঠিক। তা সত্ত্বেও ‘বৃত্তের নিশিচারণ’ সাহিত্যের সাধনাপথে গল্পকার রেহানা বীথির এক সাহসী ও প্রত্যয়ী পদযাত্রা। নিঃসন্দেহে একটি পুরস্কারযোগ্য গ্রন্থ। সমাজের বিচিত্র সত্যের দিকে তাঁর কৌতূহল ছড়িয়ে গেছে। সাহিত্য তো জীবনের সংকীর্ণ সীমাটি পেরুবার এক সেতু, যার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমরা আবিষ্কার করি নিজেকে, নিজের সম্ভাবনাটিকে; একইসাথে আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে অসীম জীবনের নতুন সব দিগ্বলয়; মানবমনের চিরস্বপ্নের দিগন্তমুখী এই যাত্রায় সামিল হতে আমরা কে না চাই। গল্পকার রেহানা বীথি বৃত্ত ভাঙার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। প্রমাণ করেছেন, একজন সত্যিকার লেখকের কোনো লিঙ্গভেদ হয় না। তাঁর এই শৈল্পিক স্পর্ধাকে আমি স্বাগত জানাই। তাঁর লেখার ব্যাপারে আমি আশান্বিত হয়েছি; সেই সঙ্গে উৎফুল্লও।

গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। ঠিকানা : ঢাকার কাঁটাবনস্থ কনকর্ড এম্পোরিয়াম। আমি এই গল্পগ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।

 

+ posts

Read Previous

দাঁড়ানো

Read Next

চন্দনকৃষ্ণ পাল – গুচ্ছকবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *