অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ১৭, ২০২৪
৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ১৭, ২০২৪
৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাবণী মণ্ডল -
বোধ ও বোধন

সাহিত্যের প্রতিটি শাখার যেমন মৌলিক মানদণ্ড রয়েছে, কবিতারও তেমন একটি শক্তিশালী মৌলিক ভিত্তি রয়েছে। তবে কবিতাকে সংজ্ঞাবদ্ধ করা সহজ কাজ নয়। সাহিত্যের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো কবিতাও সর্বজনীন নয়। সব কবিতা সবার ভালো লাগবে বা ভালো লাগতে হবে এমনও নয়। আবার সময়ের আবর্তে ভালোলাগা কবিতাও দিশা বদলায়। ভিন্ন কোনো কবিতা ভালোলাগার তালিকায় যুক্ত হয়। একটা সময়ে কবিতার ভাবার্থের ক্ষেত্রে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন তার উপর জোর দেওয়া হতো। তবে বিদ্বজ্জনদের মতে, কোনো কবিতার ভাবার্থ পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়াটাই যৌক্তিক। কারণ যখন কবিতাটি প্রকাশিত হয়ে যায়, তখন তার ভাবার্থ নির্ধারণ আর কবির হাতে থাকে না। পাঠক নিজের মতো করে ওই কবিতা বুঝবে, তার ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে, এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনা হবে—এটাই কাম্য। তবে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে সেরকম সাহিত্য আলোচনা খুব বেশি চোখে পড়ে না। এটিকে এখানকার সাহিত্যের দৈন্য বাস্তবতাই বলতে হবে।

বিশ্বখ্যাত গ্রিক কবি ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘কবিতা দর্শনের চেয়ে বেশি, ইতিহাসের চেয়ে বড়।’ এই এক লাইনেই কবিতার সঙ্গে মানুষ ও তার সমাজ ভাবনার গভীরতা প্রকাশ পেয়েছে। কবি মূলত তার ভাবনা, অভিজ্ঞতা, বাস্তবতাই কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। এমনটাই দেখা গেছে কবি, প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, গবেষক গোলাম কিবরিয়া পিনুর ‘মানুষ পোশাক পরলেও উলঙ্গ মনে হয়’ কাব্যগ্রন্থে।

গোলাম কিবরিয়া পিনু মূলত কবি। তবে প্রবন্ধ, ছড়া, শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যাঙ্গনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান রয়েছে। গবেষণামূলক কাজেও যুক্ত। তাঁর কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে—জীবন-সমাজ-প্রকৃতি এবং সর্বোপরি মানুষ। যে মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশ-সময়কাল-প্রতীকের ব্যঞ্জনা। আছে রূপক, আছে ছন্দের বৈচিত্র্য, অনুপ্রাসের নতুনমাত্রা, মিলবিন্যাসের নিরীক্ষা ও অন্যান্য সূক্ষ্ম কারুকাজ। তিনি একেক কাব্যগ্রন্থকে একেক বৈশিষ্ট্যে সাজিয়েছেন।

কবিতা সম্পর্কে গোলাম কিবরিয়া পিনুর মূল্যায়ন তিনি তুলে ধরেছেন ‘চিন্তাসূত্র’ সাহিত্য পত্রিকায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘কবিতা লেখাকে একটি সংগ্রাম হিসেবে মনে করি, তাই কবিমাত্রই সংগ্রামরত। একদিকে কবি তাঁর নিজের বোধ ও দর্শনকে সংহত করেন, অন্যদিকে সমাজের অন্যান্য মানুষের রুচি ও মনোভাব লেখার প্রশ্রয়ে সূক্ষ্মভাবে তা নির্মাণ করেন। এ এক মিথস্ক্রিয়া : গ্রহণ ও বর্জন, নেওয়া ও দেওয়া, অপূর্ণ ও পূর্ণতায়। কবিতার জন্য শৈশব থেকে একাগ্র ও নিবেদিত থেকেছি। কিশোর বয়স থেকেই নিয়মিত লিখছি। শুধুই লেখার জন্য আত্মপ্রতিষ্ঠার ভিন্ন পথে যেতে পারিনি; এজন্য কোনো হতাশাবোধ নেই আমার। এজন্য অনেক কিছুকে জীবনে সম্পাদনা করেছি। লেখার মূলধারায় নিজেকে স্থাপন করার জন্য কবিতা লেখাকে জীবনের মূল কাজ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছি।’

(আমি জানি আমার কবিতা কতটা ব্যতিক্রম)

একজন লেখক যখন এ কথাগুলো বলেন, তখন তাঁর আত্মশক্তি বাড়ে। মানুষ যখন নিজের দুর্বলতা-সবলতাকে মূল্যায়ন করতে পারে, তখন তাঁর কর্ম আরও মোহনীয় হয়ে উঠে। যে সৃষ্টির মোহনীয়তায় অপরকে ধারণ ও আকৃষ্ট করা যায়। তিনি সে কথাগুলোই বলেছেন।

কিশোর বয়সে লেখালেখি শুরু করেন পিনু। গাইবান্ধা থেকে পোস্টমাধ্যমে লেখা পাঠাতেন। বিভিন্নজনের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও সহযোগিতা পেয়েছেন বরারবই। বেড়েওঠার সময়টিকে নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের এমন এক পরিবেশের মুখোমুখি আমরা তখন, একদিকে বিধ্বস্ত অবকাঠামো ও স্বজন হারানোর বেদনার্ত সময়, আর অন্যদিকে নতুন করে গড়ে উঠবার উদ্দীপনা ও স্বপ্নের আন্দোলিত প্রেষণা।…’ তখনকার কিশোর বয়সের জীবন ছিল এমন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাঘর, ছাত্র সংগঠন এবং বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন। প্রতিনিয়ত পাবলিক লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসা ছিল তাঁর এবং সে সময়কার পড়ুয়া বন্ধুদের।

ছোট শহর, গাইবান্ধায় বসেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন পিনু। সে সময় স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ দিবস উপলক্ষে বহু সাহিত্য সংকলন প্রকাশ হতো, যা এখন বিরল। এসব সংকলনে তিনি লিখতেন এবং সাহিত্যসভা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকতেন। তখন তিনি সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছেন। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে লেখা ধরা দিতে শুরু করে। গাইবান্ধা থাকাকালীন জাতীয় পত্র-পত্রিকায় ছড়া ও কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে, এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার লিটল ম্যাগাজিনেও তাঁর ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল।

প্রায় চার দশক ধরে লিখছেন কবি। এর মধ্যে কবিতা-ছড়া-প্রবন্ধ ও গবেষণা মিলে অন্তত ২৯টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে। বিভিন্ন পত্রিকা-সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে কবিতা। অনেক উল্লেখযোগ্য সংকলনেও তাঁর কবিতা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য পঠন-পাঠন ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষাগ্রহণ করেছেন পিনু। ফলে তাঁর ভেতর যে সামাজিক দায়বোধ জন্মেছে, তা কবিতার মধ্য দিয়ে পাঠকের বোধে সঞ্চারিত হয়। ইতিমধ্যে কবির ১৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। যা নির্দিষ্ট পাঠকমহলে প্রচারিত ও আলোচিত।

কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু ‘মানুষ পোশাক পরলেও উলঙ্গ মনে হয়’ কাব্যগ্রন্থে খুঁজে পাওয়া যায় মানুষ, সমাজ, প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবনের কথা। কাব্যগ্রন্থটিতে ৭৮টি কবিতা রয়েছে। প্রত্যেকটা কবিতা পাঠ করার পর, একটা থেকে আরেকটার ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। একজন কবিকে ভাষানির্মাতা, শব্দশিল্পী এবং দৃশ্যশিল্পী হতে হয়। দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি থাকলেই, তা শব্দের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায়। যার জন্য চিন্তার গভীরতা জরুরি। যেটি কবি এই গ্রন্থে দেখিয়েছেন। ‘জীবনবীমা’ কবিতায় তিনি বলেন—

হারিয়ে যাওয়ার এত ভয় কেন?

অস্তিত্ব মানেই ক্ষয় আর লয়!

জয় করা রাজ্যও থাকে না

নিজের কাছে সবসময়!

সূর্য একসময়ে চুপসে যাবে—

তোমার তো আরও ক্ষীণআয়ু,

সেই বায়ুও থাকবে না!…

কবিতাটির মূল সারমর্ম হলো—সবকিছু শেষ হয়ে যায়। অর্থবিত্ত, মানুষের জীবন কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। তবুও কেন মানুষে-মানুষে এত বিভেদ! এগুলো আমাদেরই কথা। নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাবলি। জীবনের সঙ্গে হেঁটে চলে কবিতার শব্দগুলো। হয়তো আমার কিংবা আপনারই জীবন তুলে ধরা হয়েছে ছন্দের তালে তালে।

‘দুঃসহ স্মৃতি’ কবিতায় কবি জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো ঝেড়ে ফেলার কথা বলেছেন। যা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দীর্ঘপথ হাঁটার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছেন। জীবনের ভারে ন্যূব্জ হয়ে বোঝা হয়ে পড়ার যে অনুভূতি, তা থেকে নিজেদের মুক্তি পাওয়াটা জরুরি। কবি বলেছেন—

…মুষড়ে পড়ার আগে

যন্ত্রণাকাতর হওয়ার আগে

আধিক্লিষ্ট হওয়ার আগে

ঘর থেকে দুঃসহ স্মৃতির একেকটি বস্তা টেনে তুলে ফেলে দাও!

তোমাকেও ঘরে থাকতে হবে—

হাঁটতে হবে দীর্ঘপথ,

এর কোনোটা মরুপথ—এর কোনোটা পাহাড়ের শৃঙ্গপথ!

কুঁজো হয়ে গেলে

ঘাড় মটকে গেলে

অলিগলিও পার হতে পারবে না!’

কবিতার মধ্য দিয়ে যেমন বিশ্বজয়ে অবদান রাখা যায়; তেমনি এ শক্তি ব্যবহার করা যায় শোষকের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে। কবিতাও হয়ে উঠতে পারে শোষকের মরণকামড়। কবিতার এই বৃহৎ শক্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটা জরুরি। অপমান, অবহেলায় কাব্যকে ফেলে রাখার যে সংস্কৃতি, তা থেকে বের হওয়াটা জরুরি। ইতিহাসের দ্বারস্থ হলে দেখা যায়, কালে কালে কবিতার দাপট ভীষণ স্পষ্ট। সব মহৎ অর্জনের পেছনে রয়েছে কবিতার দৃঢ় শব্দচয়নের প্রেরণা।

কবিতা নিয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বলেন—‘কবিতা নিছক আনন্দের বিষয় নয়, চৈতন্যের বহু স্তর উন্মোচিত করে। জীবনের খণ্ডখণ্ড অনুভূতির মধ্য দিয়ে জীবনের তাৎপর্য কবিতায় উন্মুক্ত করতে পারি—সেজন্যও লিখি। কবিতা মানুষকে ভাবায়, ভাবতে শেখায়, জাগিয়ে তোলে, কৌতূহল সৃষ্টি করে। কবিতা সমকালের হয়েও আগামীকালের ও চিরকালের হয়ে উঠতে পারে। ভালো কবিতার শিল্প-সৌন্দর্য স্বতঃস্ফূর্ত ও আনন্দময় অনুভূতির জন্ম দেয়। এজন্য আরও লিখি—কবি অগ্রজ্ঞান নিয়ে অগ্রগামী থাকেন, এই মর্যাদায় কবির যে দায় রয়েছে—তা পালনের জন্যও লিখি। নিছক আত্মসর্বস্ব সুখকে গুরুত্ব না দিয়ে জীবনবোধের প্রেষণায় লিখি। কবিতা লিখে যে আনন্দ, স্বাধীনতা, স্পর্ধা ও জীবনের বিভিন্ন দিক সূক্ষ্মভাবে উন্মোচনের যে অধিকার পাই, তা আর অন্য কাজে পাই না; তাই লিখি। যা কিছু অনৈতিক, অন্যায়, নৈরাজ্যপূর্ণ ও নেতিবাচকতা—তার বিরুদ্ধে এক ধরনের নিজের বিবেচনাবোধ তুলে ধরার জন্য মানুষের কণ্ঠলগ্ন হয়ে লিখি। মানুষের চেতনা ও ভাবজগৎ ছুঁয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে লিখি। এজন্য নিজেকেও রূপান্তর করি—লেখাকেও রূপান্তরিত করি।’

কবির এ কথাগুলোর মূল্যায়ন হতে পারে তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে। গোলাম কিবরিয়া পিনুর ‘হিসেব’ কবিতা থেকে—

…ভুঁইফোড় মালিকের সাথে

ভোরবেলায় হেঁটে যে কিশোরী গার্মেন্টস কারখানায় যায়

তার হিসেব মিলবে না!

বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে পণ্য বিক্রয় করে

সেই ফেরিওয়ালার সাথে

ফেরিঘাটের ফেরিওয়ালার হিসেব মিলবে না!

ডাকঘরে দ্রব্যাদির মোড়ক তৈরিতে যে ব্যস্ত

তার সাথে কোনো অনুষ্ঠানে

বইয়ের মোড়ক উন্মোচনকারী অতিথির হিসেব মিলবে না!

নতুন জলে মাছও কেমন লাফায়!

বর্ষায় যখন পুকুর উপচে পড়ে—

তখন পুকুরের মাছও পুকুরে থাকে না!

এ কবিতায় তিনি দেখিয়েছেন, জীবনের হিসাব একেকজনের একেক রকম। আবার একজন মানুষেরই সময়ের সঙ্গে জীবনের হিসাবও ভিন্ন। বাল্যবেলায় আমাদের জীবনের যে হিসাব থাকে, তার সঙ্গে শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের হিসাব মেলে না। এটি প্রাণ-প্রকৃতি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে কথাগুলো নিজের জীবনের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়াটা কষ্টকরই বটে। তা সম্ভব হলে জীবনকে আরও সুন্দর করে উদযাপন করা যায়। হতাশায় নিমজ্জিত হয় না মনোজগত। প্রত্যেকের আলাদা হিসাব রয়েছে, আলাদা জগত রয়েছে—কখনো তা ইচ্ছের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলে, কখনও নিজ গতিতে। এটাই জীবনের হিসাব। যে হিসাব বাদ দিয়ে জীবন চলে না। কবি সে কথাই শব্দের কৌশলে সাজিয়ে তুলেছেন।

‘মানুষ পোশাক পরলেও উলঙ্গ মনে হয়’ কাব্যগ্রন্থে কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু যে ভাষাশক্তি প্রয়োগ করেছেন, তা সহজ-সাবলীল। সরল ব্যঞ্জনা, নেই দুর্বোধ্য শব্দচয়ন। এটি তাঁর কবিতার নিজস্বতা। এক স্বতন্ত্র দ্যোতনায় ছন্দ সাজিয়েছেন তিনি ওই কাব্যগ্রন্থগুলোতে। সেই দুরন্ত কৈশোরে যে সৃজনশীল লেখালেখির শুরু—৬৬ বসন্ত পার করে তাঁর কলম এখন আরও ঋদ্ধ। শুধু কবিতা লেখেন এমন নয়। স্বরচিত কবিতার আবৃত্তিও করেন, পাঠকদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেটি শেয়ার করেন। যা তাঁর কবিতার পাঠকদের উদ্বেলিত করে।

তবে তাঁর কবিতায় যে জায়গাটি বিশেষভাবে আলোচ্য, তা হলো—যে কোনো অসঙ্গতি, অন্যায়-অবিচার, সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানির প্রশ্নে সচল ভূমিকা রাখতে পারা। এটি একই সঙ্গে তাঁর সমাজ-ভাবনারও বহিঃপ্রকাশ। তাঁর কবিতা একই সঙ্গে বিয়োগান্তক দুঃখ-বিগ্রহ এবং শোককে শক্তিতে পরিণত করার দ্বৈতসত্তা ধারণ করে। যা পাঠককেও ব্যথিত ও প্রতিবাদী করে তোলার প্রেরণা জোগায়। কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু মুক্তিযুদ্ধকে একচোখে দেখেননি।

কাব্যগ্রন্থটিতে ‘নদী যখন নদীকে চুমো খায়’ কবিতায় তিনি নদীর উৎসধারা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। ছন্দের তালে এক জটিল ভৌগোলিক বিশ্লেষণ। যা পড়লে মনে হবে চোখের সামনে যেন এর মঞ্চায়ন ঘটছে। তিনি লিখেছেন—

নদী এঁদোপুকুরও নয়—

নদীর জলপ্রবাহ নিয়ে

তালপুকুরও হয় চনমনে!

নদীতে নদীতে মৈত্রী হলে

জোয়ার ও দীপ্রগতি!

নদী যখন নদীকে চুমো খায়

তখন মাছেরা স্বচ্ছন্দ ও লাফায়

মাঝিরা মাঝপথে গিয়ে আরও প্রাণ পায়

নিজেদের ভাটিয়ালি গান গায়!

কবি গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা বা প্রবন্ধ কোনোটাই তথাকথিত ভার-ভারিক্কিতে ভরপুর নয়। শব্দের খেলা আছে। তবে শব্দের জটিল গাঁথুনিতে পাঠক আটকে যাবেন না। তাঁর লেোয় বহুমাত্রিক বিষয়াদি স্থান পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সমকালীন বিষয়ের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। তবে সমাজ-সচেতন বোধের স্ফূরণ তাঁর কবিতার নিত্যসঙ্গী। এখানেই তাঁর বোধের জাগরণ। কাব্যের শব্দধ্বনিতে তিনি কার্যত মানুষের অন্তর্জগত জাগ্রত করার ধ্বনি বাজাচ্ছেন। এখানেই লেখক-পাঠকের সম্মিলন। দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বিকাশের সম্ভাবনাকে জাগ্রত রাখা।

কারও সৃষ্টি যখন অপরের মাঝে স্বপ্ন জাগায়, আন্দোলিত করে, দ্রোহের স্ফূরণ ঘটায়, অথবা চিন্তায় কষাঘাত করে; তখনই সেই সৃষ্টি সার্থক হয়ে উঠে। কবি ঠিক সে কাজটিই করার চেষ্টা করছেন। যে চেষ্টাকে আরও পুনরুজ্জীবিত করার দায় আমাদের প্রত্যেকের। কারণ মানুষই পারে মানুষকে অগ্রগামী পথে ধাবিত করতে। সৃষ্টির মোহনায় নিয়ে যাওয়ার যে আনন্দ রয়েছে, তা ভাগাভাগি করার মধ্য দিয়ে আরও দৃঢ় হয়।

মানুষ বেঁচে থাকে চিন্তাচেতনায়, কাজেকর্মে। আর যখন তার স্বকীয়তা হারায়, তখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। তার নিজস্বতার কাছে পরাজয় ঘটে। পরগাছার মতো জীবনকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। ‘মানুষও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়’ কবিতায় তিনি লিখেছেন—

মানুষও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়!

পাউরুটি, দুগ্ধজাত খাবার ও চকলেট

তারা তো তাদের গায়ে লেখা নির্ধারিত তারিখে

মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়,

মানুষের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার হয়তো কোনো তারিখ নেই—

কিন্তু মানুষও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়—যেকোনো দিন,

যেকোনো সময়!

সাহিত্যের নোংরা রাজনীতিতে নিজেকে ভাসিয়ে দেননি কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু। যখন চলছে একে অপরের পিঠ চাপড়াচাপড়ি। দলাদলির পুরস্কারে মেতে আছেন একদল কবি-সাহিত্যিক। নিজেদের মেরুদণ্ডের দৃঢ়তা গেছে ক্ষয়ে। সমাজের বৈষম্য-শোষণ-নিপীড়ন কোনো কিছু নিয়েই তাদের ভেতর কোনো চিন্তা নেই। এমন সময় কিছু মানুষ সাহিত্যের জন্য নিজেদের অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। কাব্যের প্রতি অনুরাগ, প্রেম-প্রীতি, অনুভূতির প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।

তাঁর সব কবিতায় ‘রাজনীতি’ আসেনি; আবার রাজনীতির বাইরেও থাকেনি। রাজনীতি সচেতনতা তাঁর কবিতার একটি বিশেষ দিক। তাঁর কবিতায় ভৌগোলিক-সামাজিক এবং জীবন বাস্তবতার অনুরণন অনুভব করা যায়, পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের বহুবিধ অনুষঙ্গ ও সমকালীন বহুবিধ ছবিও কবিতায় পাওয়া যায়। রয়েছে তাঁর সমাজ-ভাবনার রসায়নে জীবন-জিজ্ঞাসা, নৈতিকতা, দর্শন, কাঙ্ক্ষিত জীবনের স্বপ্ন, মানব-মানবীর সম্পর্ক ও ব্যক্তিজীবনের কথকতা। ভাসা-ভাসাভাবে স্পর্শ করলে তা হয়তো সেভাবে বোঝা যাবে না; অনুসন্ধানমূলক দৃষ্টিতে তাঁর কবিতাকে ছুঁয়ে দেখলে তা হয়ে উঠতে পারে বর্ণচ্ছটা। তবে তাতে কবিতার শিল্পমান ক্ষুণ্ন করেনি। কবিতা বহুবিধ শৈলীর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি-আবেগ নিয়ে প্রাণ পায়। আর এখানেই ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর বহুবিধ অলঙ্কারের তাৎপর্য।

কবির ভাবনা জগতকে উপলব্ধি করা যায় তাঁর লেখার স্পষ্টতা দেখে। তিনি বিনয়ী কিন্তু স্পষ্টভাষী। সম্মানের সর্বোচ্চ অবস্থান দেন মানুষকে; কিন্তু নিজের চিন্তাকে বিকোন না। যা তাঁর গদ্য-পদ্যের মধ্য দিয়েই প্রস্ফুটিত।

তাঁর কবিতায় যেমন ব্যক্তির বিভিন্ন দিক যেমন উন্মোচিত হয়েছে, তেমনি সমাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও অনুরণন বহুভাবে ধরা পড়েছে। জীবনের বহুবিধ জিজ্ঞাসা ও প্রতিক্রিয়া কবিতায় মূর্ত হয়েছে, বিভিন্ন বোধের বিভিন্ন রূপসৌন্দর্য কবিতায় ধারণ করতে পেরেছেন বলেই তা হয়ে উঠেছে বোধন।

লাবণী মণ্ডল : সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক

 

+ posts

Read Previous

প্রখ্যাত তাজিক কবি লায়েক শের আলির কবিতা

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন – ৪র্থ সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *