অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ১৭, ২০২৪
৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ১৭, ২০২৪
৩রা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অভিজিৎ দাশগুপ্ত -
মঞ্জু সরকারের গল্প : চিত্রণের সত্যরূপ

C:\Users\Administrator\Desktop\RAJNAITIK-GALPO.jpg

আজকের দিনে বিশ্বমানবকে আপনার বলে স্বীকার করবার সময় এসেছে। আমাদের অন্তরের অপরিমেয় প্রেম ও জ্ঞানের দ্বারা এই কথা জানতে হবে যে, মানুষ শুধু কোনো বিশেষ জাতির অন্তর্গত নয়;… মানুষ সর্বদেশের সর্বকালের।

(৭ পৌষ ১৩৩০)

‘বিশ্বভারতী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ কথা যখন বলছেন, তখন তাঁর আন্তরিক আকাঙ্ক্ষাটি মিলেমিশে যায় ইতিহাস বোধের সঙ্গে। শিল্প-সংস্কৃতির অন্যান্য বিভাগের মতো সাহিত্যের দিকেও তার কিছু দায় থাকে। ছোটগল্প সেই যোগসাধনের একটি বড় দিক। খণ্ড উপকরণ কীভাবে অখণ্ড একটি ঐক্যধারা তৈরি করতে পারে তার নিদর্শন বিশ্ব সাহিত্যে কিছু কম নেই । আর এক্ষেত্রে তিন ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে (প্লেটো কথিত) যদি আদর্শ তৈরি করা সম্ভব হয়, তার থেকে ভালো কিছু হয় না।

প্রাবন্ধিক শিশিরকুমার দাশ জানাচ্ছেন, বাংলা ছোটগল্প সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত পত্রিকাতেই প্রথম শুরু হয়। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি এর সূচনা করেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীও বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করতেন ছোটগল্প নিয়ে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে মোহিতলাল মজুমদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখ লেখক বিভিন্ন সময় ছোটগল্পের তত্ত্ব ও প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।

এ কথা ঠিক যে বাংলা ছোটগল্প যখন জন্ম নিচ্ছে সেই সময় ইংরেজি সাহিত্যের একটা প্রভাব বা অন্তরঙ্গতা সেখানে লক্ষ করা যায়। যদিও শক্তিশালী লেখক তার নিজের ক্ষমতার জোরে সেই লেখার মধ্যে দেশজ ভাবনাকে সুন্দরভাবে প্রবেশ করাতে পেরেছিলেন। তবে ইংরেজি সাহিত্য পাঠে আগ্রহী বাঙালি সেদিন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল। এক্ষেত্রে স্পষ্ট প্রভাব যেমন ছিল, আবার অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব পরোক্ষে কাজ করেছিল। তবে যত দিন এগিয়েছে ততই বিশ্ব যেমন ঘরের কাছে এসেছে, ঠিক একইভাবে চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রেও একমুখীনতা দূরে সরে গেছে। বরং সাহিত্যের বিভিন্ন মহাদেশীয় রূপগুলো প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন জনের লেখায়। কখনো ল্যাটিন আমেরিকা, কখনো আফ্রিকা, কখনো মধ্যপ্রাচ্যের স্পষ্ট বা অস্পষ্ট প্রভাব লেখার মধ্যে ঢুকে পড়েছে অলক্ষে।

এখন মনে প্রশ্নটা স্বাভাবিক, মননের মিলন কী করে সম্ভব হয়! বা অতীতেও হয়েছে? শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে তার ব্যাপকতা নিয়ে কোনো জিজ্ঞাসা আমাদের মধ্যে হয়তো উঠবে না। তার কারণ, রাষ্ট্রশক্তি নিজের স্বার্থের জন্যই উপনিবেশগুলোতে এমন এক ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিল যা সূক্ষ্মভাবে সকলের সঙ্গে সকলের যোগাযোগের রাস্তা তৈরি করে দেয়। তাই একে একে ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, জার্মান সাহিত্য পাঠ করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষও বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ পায়। এই স্বাদ তাকে নিজস্বতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সময় যত এগিয়েছে নতুন নতুন সাহিত্য পথের সন্ধান পেয়েছে জিজ্ঞাসু পাঠক। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের হাতে এল ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য। যা আজও পাঠক-লেখককে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

বাংলা সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখব সামন্ততান্ত্রিক ভাবনা-চিন্তার পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যে ১৯৪০-এর দশক থেকে পূর্ণোদ্যমে আত্মপ্রকাশ করে মার্কসবাদ বা প্রগতিশীলতার ধারা। এই সময় বাংলা সাহিত্যকে ভাববাদী দর্শন থেকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমেন চন্দ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, ননী ভৌমিক, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন প্রমুখ। অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কালের পুত্তলিকা’-তে জানাচ্ছেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুঃশাসনীয়’ আর সুবোধ ঘোষের ‘তমসাবৃতা’ গল্প দুটির বিষয়বস্তু একই আকালের দিনে বস্ত্র-সংকটে আর্ত গাঁয়ের গরীব মেয়ে মদ্দ।’ এই দর্শন-ই একসময় বাংলা ছোটগল্পকে শাসন করেছে। যদিও কিছু নির্মোহ ভিন্ন দর্শন মধ্যে মধ্যে উঁকি দিয়ে গেছে বাংলা ছোটগল্পে, তবু তার প্রসার খুব বেশি হয়নি। অবশ্য বিরোধীরা বলতে পারেন বাংলা ছোটগল্পের একটা বিরাট অংশে রয়েছে মনস্তাত্বিক দ্বদ্ব ও প্রেমজ সংকট।

১৯৪৭-এর পর পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ছোটগল্পে একটা ভেদরেখা ফুটে ওঠে। তার কারণটা অবশ্যই রাজনৈতিক-সামাজিক।

‘বাংলাদেশের ছোটগল্পে রূপায়িত হয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধতা, পশ্চাৎবর্তিতা, ধর্মান্ধতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকট, নিম্নবর্গের অনুভূতি, জীবন জটিলতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু এর ঐতিহাসিক পটভূমি এবং রাজনৈতিক-সামাজিক ধারাবাহিকতার অন্বেষণ করতে হয় ৫২-র ভাষা আন্দোলনে, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে, ৭৫-এর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে। এসব ঘটনার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় গল্পকাররা প্রভাবিত হয়েছেন। গল্পকারদের মানসপ্রভাব ও প্রবণতার ছাপ পড়েছে তাঁদের গল্পে। বাংলাদেশের মানুষ আবহমান বাংলার সৌন্দর্যময় প্রকৃতির চেতনা ধারণ করে বড় হয়েছে। এখানকার নদী, জল, পাহাড়, জলাশয়, বিল, হাওর সজীবরূপে প্রভাবিত করেছে মানুষের চেতনালোকে।’

এ কথা জানাচ্ছেন রতনতনু ঘোষ তাঁর প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারা’-তে।

মঞ্জু সরকার বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত কথাশিল্পী। ১৯৫৩ সালে জন্ম মঞ্জু সরকার সাহিত্যের অঙ্গনে ছোটগল্প, উপন্যাস এবং শিশু সাহিত্য রচনায় তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত মঞ্জু সরকারের গল্পে আমরা সময়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই। এবং তা এতখানি বাস্তব যে মনে হয় প্রতিদিনের খবরাখবরগুলো গল্পের আকার নিয়ে তাঁর মুন্সিয়ানার কাছে ধরা দিয়েছে। আমি এই আলোচনায় ২০২১ সালে অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এ লেখকের ‘রাজনৈতিক গল্প’সংকলনের কয়েকটি গল্পের নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখে লেখকের শক্তিমত্তা ও বৈশিষ্ট্যের দিকগুলো দেখানোর চেষ্টা করব।

‘বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আত্মীয়স্বজন’ গল্পের শুরুতেই লেখক নিরক্ষর চাষী চেংটু সাবেদের বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেওয়ার ভাবটি পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন। ‘জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ‘ভায়েরা আমার’ ডাক শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তাদের মধ্যে আমাদের গ্রামের নিরক্ষর চাষি চেংটু সাবেদের সাড়া দেওয়ার আবেগ এবং ধরনটাও ছিল চোখে পড়ার মতো।’ বঙ্গবন্ধুর এমন বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শুনে সে চেঁচিয়ে বলত, ‘বাঙালির এত বড় বন্ধু এ দুনিয়ায় আর কাঁয়ও নাই বাহে!’ শৈশব থেকেই গল্পের কথককে আদর যত্ন করত সে। তবে বঙ্গবন্ধুর কারণেই একসময় এই সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু সরল প্রাণ এই মানুষটি শেষপর্যন্ত স্বাধীনতার স্বাদকে তিক্ত হতে দেখেছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের অভাব, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি তার স্বপ্নকে শেষ করে দেয়! কিন্তু এর জন্য সে দায়ী করত মজুদদার আর চোরাকারবারিদের-ই। কারণ তারাই ‘লুটিপুটি খাইতেছে’। অদ্ভুতভাবে ক্ষমতার পালাবদলের পর যখন প্রেসিডেন্ট জিয়া আসেন, সেই সময়েই কিন্তু চেংটু চাচার মৃত্যুর সংবাদ পায় গল্পের কথক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জন্য এমন অকৃত্রিম দরদ আর দেখা যায়নি বলেই গল্পটির নামকরণের সঙ্গে বিষয়টি এমন একাত্মা হয়ে পড়ে পাঠকের মনজগতে।

‘প্রিয় দেশবাসী’ গল্পে অসুস্থ শরীর নিয়ে আমানুল্লা বারবার আজরাইলকে ডাক দেয়। কিন্তু আজরাইলের পরিবর্তে যখন তখন তার স্মৃতিতে ছুটে আসেন দেশের রাষ্ট্রপতি। খুব সাধারণ এবং প্রায়শই ঘটে এমন একটি ঘটনা নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘প্রিয় দেশবাসী’ গল্পটি। কোনো একবার আমানুল্লার গ্রামে রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টার এসে থামে। থেকে থেকে জিন্দাবাদ ওঠে রাষ্ট্রপতির নামে। অনেক মানুষের ভিড়ে সেও দাঁড়িয়ে ছিল। ‘মুখে চাপা হাসি, চোখে কালো চশমা, রহস্যময় রাষ্ট্রপতি লোকজনকে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাতে জানাতে হাঁটছিলেন। আমানুল্লার কাছটায় এসে থমকে দাঁড়ালেন হঠাৎ। একটু কুঁজো হয়ে বুড়োর হাত চেপে ধরে কিছু বললেন, হয়তো সালাম দিলেন কিংবা কুশল জিজ্ঞেস করলেন বুঝি।’ আর তাতেই আমানুল্লার যেমন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়, ঠিক সেভাবেই গল্পের রং-ও পাল্টে গেল। পাল্টে গেল তার জীবনের কল্পকাহিনী। এই নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি চলে। অন্যায় আবদার চেপে বসে আমানুল্লার ওপর। অথচ শেষ পর্যন্ত গরিব গরিব-ই থেকে যায়। তাই এই সমস্ত অসহায় মানুষের আর্তনাদ পৌঁছায় না রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে। হয়তো তখন তারা জাতির উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ঈশ্বরের নামে শপথ নেয় অথবা আরও নতুন দিন আগমনের ঘোষণা করে।

‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’ গল্পটি আমাদের পরিচিত জগৎকে আরও একবার নির্মমভাবে তুলে ধরে। সরকারি জমিতে দোকান বসানো, হকার্স সমিতির ইচ্ছেমতো স্থান দখল অথবা দুই দলের জমি দখলের লড়াই নিয়েই তৈরি এই গল্প। বাচ্চু মিয়া সবসময় উচ্ছেদ হওয়ার ভয়ে থাকে। এই ভয় শুধু পুলিশ বা অন্য কোনো পার্টিজনিত নয়। ভয়টাও আসে নানা দিক থেকে অথচ এই বাচ্চু মিয়ার আগে দোকান ছিল ফুটপাতে। তখন রোদে জলে তাকে বহু কষ্ট পেতে হয়েছে। কিন্তু এখন টিনের ঝুপড়িতে দোকান সাজিয়ে বসার পর তাকে আর সেই কষ্ট ভোগ করতে হয় না। কিন্তু উচ্ছেদের একটা ভয় সব সময় তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। হঠাৎই একটি অযাচিত ঘটনায় তার নাম জড়িয়ে পড়ে। আর তাতেই হকার্স মার্কেটের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হুমকি দেয়, ‘যে হালারাই মাইরা থাকুক, ঐ বেঈমানের বাচ্চাগো রক্ত দিয়া আমি ঐ পোস্টার মুইছা দিয়া নতুন পোস্টার লাগামু।’ অবশ্যই পোস্টারটা ছিল প্রতিবাদের। সেখানে বেশ কয়েকটি দাবি তোলা হয়। যেমন হকারদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না অথবা মার্কেট লুটের দুই কোটি টাকা কোথায়, এমন হিসেব চাওয়ার মত বিষয়। এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ঠাণ্ডু বাচ্চুকেই সন্দেহ করে। যদিও বাচ্চু অস্বীকার করে এমন কাজের। এই ঘটনার সঙ্গে যথারীতি মিশে যায় রাজনীতি, বিরোধী দলের কারসাজি বা আরও অন্য বিষয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত গল্পটি এক অসহায় মানুষের পরিণতিকে চিহ্নিত করে সমাপ্তি সূচক দাঁড়ি টেনে দেয়। শেষপর্যন্ত শ্রমিক নেতা আনোয়ার ঠাণ্ডুর সঙ্গে বিরোধী লালার তলে তলে ভাব করে দেয়। আর তারপরেই বাচ্চুর উপর নেমে আসে মিলিত আক্রমণ। প্রথমে ঘুষি, পরে চাকুর আঘাত। বাচ্চুর নাক মুখ থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। আর গল্প শেষ হয় একটি অজানা প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যাশায়, ‘কিন্তু এভাবে কি প্রেসিডেন্ট-বাহিনীর ঝরানো রক্ত দেহের ভেতর আটকে রাখা যায়?’

‘শান্তিপ্রিয় একজন’ গল্পে ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার বিধ্বস্ত হওয়ার ঠিক তিনদিন পর রাত্রি বারোটা ৩৭ মিনিটে ঢাকা নগরীর সবুজবাগ থানার অধীন মধ্য বাসাবোর একটি চারতলা বাড়ির এক তলার ফ্ল্যাটে হাত বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সামান্য এই ঘটনাটাকে সামনে রেখে লেখক গল্পের জাল বুনে চলেন। স্ত্রী ছেলে মেয়েকে নিয়ে অমরের নির্ঝঞ্ঝাট শান্তির সংসার। সেখানে হঠাৎ তার জানালায় কে বা কারা বোমা ছুড়ল, তাই নিয়েই এই গল্পের অন্তরমহলে চলেছে কাটাছেঁড়া। সেখানে একে একে হানা দিয়েছে নির্বাচনজনিত ঘটনা, সন্ত্রাস, সন্দেহ, সমবেদনা আর সব শেষে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি। নিজের পরিচয় অসাম্প্রদায়িক দিতেই ভালোবাসে অমর। অথচ সেখানে দাঁড়িয়েই একে একে তাকে দেখতে হয় ধর্ম কীভাবে সম্পর্কের ভেতর, সমাজের ভেতর মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। শেষপর্যন্ত স্বভাবে শান্ত অমর নিজের ভেতরের বিস্ফোরণকে চেপে রাখতে পারে না। নিজের রুদ্রমূর্তি বাড়িওয়ালার কাছে প্রকাশ করে সে যেন এক ধরনের শান্তি খুঁজে পায় বর্তমান অসহিষ্ণু সমাজের ভেতর।

‘পুনর্জন্ম’ গল্পে সামাদ সাহেব বহুদিন পর তার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু চেনা মুখগুলো কেউই আর সামনে নেই। পরিবর্তে রাজনৈতিক কর্মী আর সমর্থকদের সংখ্যাই বেশি। তিনি স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রতিটি স্থান। তার মনে পড়ে যায় বাড়িতে কাজ করত বুদা নামে একটি মানুষ। আজ এতদিন পর তাকে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে হয় সামাদ সাহেবের। ভাটিয়াটাড়িতে গিয়ে বুদাকে শেষপর্যন্ত দেখতে পায় সামাদ সাহেব। এখন সে বৃদ্ধ অথর্ব। তার মধ্যেই সামাদ সাহেবকে একটা অনুরোধ করে বুদা। ‘হামাকে তোমরা নিজের ঘাড়ত করিয়া কবরে থুইয়া আইস, শান্তিতে ঘুমাব আমি।’ এমন জীবনবিমুখ আর্জি শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না সামাদ সাহেব। তাই শেষপর্যন্ত জনসভার উদ্দেশ্যে যাওয়াই সঠিক বলে মনে করেন তিনি।

‘রাজবন্দীর বোধশোধ’ গল্পে শাদুল্লাকে পুলিশ ধরতে আসে তার বিরুদ্ধ রাজনৈতিক কথাবার্তার জন্য। তার দাদা আসাদুল্লার এতে হাত আছে বলে সে মনে করে। তাদের বুড়া বাপ দুই ছেলের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করে চলে। শেষপর্যন্ত শাদুল্লা পালিয়ে যায় পুলিশের ভয়ে। অদ্ভুতভাবে এই গল্পটির শেষ করছেন লেখক। শাদুল্লা যখন হতাশা নিয়ে চুপচাপ খালের ধারে বসে আছে, সেই সময় তার মনে পড়ে যায় এখানেই একসময় পানি ছেঁকে তারা অনেক মাছ ধরত। তখন ‘শত্রুদের গতিবিধি বোঝার জন্য শাদুল্লা আর গ্রামের দিকে ফিরেও তাকায় না। পরনের লুঙ্গি নেংটি বানিয়ে কষে বাঁধে। থুয়ের সঙ্গে সকল ভয়-ভাবনাও ঝেড়ে ফেলে। তারপর পল্লী বিদ্যুৎ, সরকারি পুলিশ এবং এ-বি দলের পলিটিক্স-পীড়িত জনবসতি পশ্চাতে রেখে, মাছ ধরার জন্যে শাদুল্লা বিলের কাদা-পানিতে একাকার হয়ে যায়।’

‘স্বতন্ত্র মানুষ’, ‘ভিতরে মানুষের কান্না’, ‘দুই ভাইয়ের গল্প’ ইত্যাদিতে বারবার ফিরে এসেছে সাধারণ মানুষের যাপনের মুহূর্তগুলো। কীভাবে সমাজ বিশেষ করে উচ্চশ্রেণি, অর্থবানশ্রেণি, রাজনৈতিক নেতা তাদের বিভিন্নভাবে বন্দি করছে, শৃঙ্খলাবদ্ধ করছে তার-ই কাহিনী বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে গল্পগুলোতে।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে আমরা দেখি খণ্ড উপকরণের মধ্যে কীভাবে অখণ্ড এক ঐক্যধারা বয়ে চলেছে। পল্লী জীবনের ছোট ছোট ঘটনাগুলো তাঁর গল্পে মানব ইতিহাসের নতুন সৃষ্টিকে দিক নির্দেশ করে। মঞ্জু সরকারের গল্পগুলো পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে এই খণ্ড ক্ষুদ্র উপকরণগুলো বৃহৎ আকার নিয়ে তাঁর রচনায় ধরা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গেই আমি আরেকটি বিষয় এখানে আনতে চাই। বিষয়টি হলো মিথ। অধ্যাপক রিচলে ক্রাপো একবার ‘মিথ’ নামক ভাবনাটিকে তাঁর সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টি নিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন। সত্য এবং বাস্তব এই দুটিকে মিথ-এ বহু ইঙ্গিত প্রতীকী দিয়ে ধরার চেষ্টা হয়েছে বারে বারে। মিথ আমাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে সঙ্গে মননেরও প্রতিফলন ঘটায়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে মিথ হলো অমৃতের ভাণ্ডার। মিথ কাহিনীকে নানাভাবে পরিবর্তন করে তার সংযোগ-বিয়োজন ঘটায়। সাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের কোনো কোনো গল্পে তার পূর্ণ প্রয়োগ লক্ষ করি। ‘রাজবন্দীর বোধশোধ’ গল্পে শাদুল্লা পুলিশের ভয়ে একসময় বাড়ি থেকে ছুটতে শুরু করে। বিলের পানিতে এসে তার মনে পড়ে যায় শৈশবের এক স্মৃতি। ‘এই বিলের পানিতে গাঁয়ের কসিমুদ্দি একবার লাশ হয়ে ভেসে উঠেছিল। গ্রামবাসী ভেঙে পড়েছিল দেখার জন্য। পুলিশ এসে গরুগাড়িতে লাশ এবং লাশের ভাই শরফুদ্দিনকেও কোমরে দড়ি বেঁধে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে রাত- বিরাতে গাঁয়ের লোক বিলের ধারে আসতে ভয় পায়। কারণ মৃত্যুর পর আয়তনে অন্তত দশ গুণ লম্বাচওড়া হয়ে কসিমুদ্দি বিলের পানিতে খলবল করে হেঁটে বেড়ায়। অনেকে দেখেছে। এছাড়া তার নানারকমের বিদেহী সঙ্গীরা তো আছেই।’

বিভিন্ন গল্পে মিথ ব্যবহার অনেকেই করেছেন। কেউ সফলতা দেখিয়েছেন, কারও কারও লেখায় সেই সাফল্য লক্ষ্য করা যায় না। আসলে মিথ কোনো একটি গল্পকে অন্তর্নিহিত শক্তি দেয়। কিন্তু তাকে যদি প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তা শরীরের অতিরিক্ত অঙ্গের মতো কার্যক্ষমতাহীন বিসদৃশ হয়ে পড়ে। কিন্তু মঞ্জু সরকার ‘রাজবন্দীর বোধশোধ’ গল্পে মিথের যে প্রয়োগ করেছেন তার মধ্যে দিয়ে গল্পের মূল ভাবনা সুচারুভাবে ঢুকে পড়েছে। এখানেই প্রয়োগের সার্থকতা, বলতে পারি। এর সঙ্গেই আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হলো ভাষা। চরিত্র অনুযায়ী ভাষার প্রয়োগ গল্পগুলোকে সজীব করে তোলে। তাই শাদুল্লার বাপ (‘রাজবন্দীর বোধশোধ’) যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষায় কথা বলতে শুনি না শ্রমিক নেতা আনোয়ারকে (‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ থেলা’)। আবার ‘শান্তিপ্রিয় একজন’ গল্পে অমর বা অমরের স্ত্রীর কথার মধ্যে শিক্ষিত রুচিশীল শহুরে মানুষের পরিচয় ফুটে ওঠে।

মঞ্জু সরকারের গল্প-উপাখ্যানে একটা কথাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে, তা হল সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা। মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে তিনি সর্বদা সচেতন। প্রকৃত ধর্ম সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি এবং অসাম্প্রদায়িক মনোভাব চরিত্রগুলোর ভেতর স্পষ্ট। বিশেষ করে গ্রামের রাজনীতি তিনি যে স্বচক্ষে দেখেছেন, তা তাঁর পাঠক সহজেই ধরতে পারেন গল্প-উপন্যাস পাঠের সময়। আমরা অপেক্ষা করে থাকব তাঁর আগামী লেখাগুলোর জন্য।

রাজনৈতিক গল্প

মঞ্জু সরকার

অনুপ্রাণন প্রকাশনী

প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০২০

মূল্য : ৪০০ টাকা

 

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)