অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৮, ২০২৪
২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৮, ২০২৪
২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সুশীল সাহা -
রূপান্তরের গল্পগাথায় কঠিন বাস্তবের আবরণে অতলান্ত বিষাদ

মঞ্জু সরকারের লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় আমার বহুদিনের। সেই কবে তাঁর ‘অবিনাশী আয়োজন’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তারপর ননা সময়ে তাঁর লেখা কিছু গল্প ও উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা হলেও তাঁর লেখক সত্তাকে জানার ও তাঁর লেখালেখি সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমার হয়নি। মূলত এর কারণ, কলকাতায় বাংলাদেশের বইপত্র সেইভাবে না পাওয়া। নানারকম উপায়ে সেই বাধা অতিক্রমের চেষ্টা করা হলেও কোথায় একটা অদৃশ্য কাচের দেয়াল যেন রয়ে গেছে। তাই অনেক লেখকের সঙ্গে চোখের আড়ালের সঙ্গে সঙ্গে মনের আড়াল তৈরি হয়েছে অবশ্যম্ভাবী কিছু কারণে।

চল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে লেখালেখির জগতে থেকে যিনি সর্বক্ষণের লেখক হয়েছেন, সেই তিনি আজ সত্তরে উপনীত একজন প্রাজ্ঞ লেখক, যার অস্তিত্বের পরতে পরতে রয়েছে একজন সফল লেখক হওয়ার চূড়ান্ত বাসনা। সফল কী বিফল, সেই বিচারের ক্ষমতা আমার নেই। শুধু জানি রংপুরের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন যৌবনের প্রারম্ভে মহানগর ঢাকায় এসেছিলেন লেখক হওয়ার বাসনায়। সম্প্রতি তাঁর কয়েকটি আত্মজৈবনিক লেখা পড়ে বুঝতে পেরেছি লেখক হওয়ার কী অসীম প্রণোদনায় অশেষ কৃচ্ছসাধনকে ব্রত করে মহানগরের কষ্টসাধ্য জীবনকে বরণ করে নিয়েছিলেন হাসিমুখে। সম্মানজনক এক জীবিকার অনুসন্ধানের পাশাপাশি বইপত্র পড়া এবং নিজেকে লেখক হিসেবে একটু একটু করে তৈরি করেছেন তিনি। লেখালেখিকে অবলম্বন করে এতদূর এসেছেন চরম নিষ্ঠা ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো একটি সারস্বত প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন কাজ করার পরেও আরও দশ বছর ঢাকার দুটি নামী সংবাদপত্রে যুক্ত ছিলেন তিনি। তারপর সব ডালপালা ছেটে দিয়ে তিনি এখন সর্বক্ষণের লেখক। গল্প উপন্যাস মিলিয়ে তার লেখা গ্রন্থের সংখ্যা এখন প্রায় একশ। তা থেকে মাত্র একটি গ্রন্থ বেছে নিয়েছি আমার এই আলোচনার ভরকেন্দ্র হিসেবে। জানি এই ক্ষুদ্র পরিসরে লেখক সম্পর্কে সেইভাবে মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবু তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে কিছু বলার দুর্লভ সৌভাগ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না কোনোমতে। প্রাজ্ঞজনের বহুমুখী লেখালেখির পাশাপাশি থাকুক না এই সামান্য লেখাটা।

যে গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তার নাম ‘রূপান্তরের গল্পগাথা’। দশটি গল্পের সমাহার বইটি প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার অনুপ্রাণন প্রকাশন থেকে। প্রকাশকাল ২০১৪। সমর মজুমদারের অসাধারণ প্রচ্ছদশোভিত গ্রন্থটিতে সংকলিত গল্পগুলো যেন লেখকের মনোজাগতিক এক দিগন্তবিস্তারি সমাহার। একেকটি গল্প যেন এক এক দিগন্তের সন্ধান দেয়। প্রথম গল্প ‘টাকার উপর মেয়েটি’-তে লেখক অর্থনির্ভর এই দুনিয়াদারির এক ঝলক দেখিয়েছেন। মূল্যবোধ ও নৈতিকতার পেছনে যে অর্থের অদৃশ্য অঙুলিহেলন, যার ইঙ্গিতে চলছে এখনকার সমাজব্যবস্থা— তারই এক নগ্ন চিত্র উপহার দিয়েছেন লেখক এই গল্পে। একজন নিরীহ নারী ব্যাংককর্মী রেহানা ও ফার্নিচারের এক দোকান মালিক আজমলকে নিয়ে এই গল্পের পটভূমি। আত্মনির্ভরতার কারণে ঘর থেকে বেরিয়ে আসা সেই নারীর প্রতি অকারণ ঝোঁক ও দৃষ্টি পড়ে আজমলের, আর তারই রেশ ধরে চলে গল্পের গতিপ্রবাহ। ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর অসহায় অবস্থানকে নিয়ে লেখক যেন কঠিন-কঠোর এক বাস্তবকে সামনে আনতে চান। তাই আপাত গাম্ভীর্যের আড়াল ভেঙে মেয়েটিও যে একসময় তার সযত্নে লালিত মূল্যবোধ বিসর্জন দেয় এবং নানাভাবে যে মানুষটা প্রচলিত ধারায় তাকে উৎপীড়ন করছে তারই পাতা ফাঁদে পা দেয়। সত্য শিব সুন্দরের পূজারি পাঠককূলের হয়তো গল্পের এই পরিণতি মেনে নিতে কষ্ট হবে। কিন্তু সময়টা যে নতুন শতাব্দীর। ভাঙতে ভাঙতে তা যে এই সভ্যতা সমূহ এক ধ্বংসের কিনারে এসে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের, সে কথা আমরা মানি বা না মানি, লেখকের দূরদৃষ্টি কিন্তু বাস্তবের নগ্ন সত্যকে উদ্ঘাটিত করে, করতেই থাকে। তাই গল্পের পরিশেষে রেহানার একটিমাত্র সংলাপ তার আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত বয়ে নিয়ে আসে।

‘কুড়িয়ে পাওয়া মোবাইল’গল্পটি দারিদ্র্যপীড়িত এক পরিবারের করুণ হাহাকারের কথা শোনায়। গ্রামীণ জীবনের খুঁটিনাটি নানা অনুষঙ্গের আভাস লেখক অতি সহজেই আমাদের উপহার দেন। এ যেন তাঁর চিরচেনা জনগোষ্ঠী, যাদের সত্যি সত্যি প্রতিদিনই নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যায়, সেই তাদের একজনের একটা দামি মোবাইল ফোন কুড়িয়ে পাওয়া এবং তা নিয়ে নানা বিপত্তির মোড়কে লেখক আদতে বাংলাদেশের অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের দুঃখ-কষ্টের গাথা রচনা করেন। শেষপর্যন্ত সেই বস্তুটিকে মাটিচাপা দিয়ে রেহাই পায় তারা। একেবারে শেষে গল্পের প্রধান চরিত্র এমাদের দীর্ঘশ্বাসযুক্ত একটি সংলাপ বাংলাদেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর অন্তরের হতাশাই যেন মূর্ত করে তোলে— ‘হায় আল্লা সারাজীবন তোমার কাছে চাইলাম কী আর তুমি হামাকে দিলেন এ কি যন্তন্না!’ এ বড় নগ্ন নির্জন অভিঘাত।

নানা কারণে এই গ্রন্থভুক্ত একটি গল্প আমার বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। প্রথমত গল্পটি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীভুক্ত একজন অসহায় ভাগ্যবিড়ম্বিত নারীর, দ্বিতীয়ত গল্পটিতে অপর যে মানুষ দুটির কথা বলা হয়েছে তারা সাবিত্রী বালা নামের এক নারীর প্রতি কোনো না কোনোভাবে অনুরক্ত, কিন্তু তা এতই নিরুচ্চারিত যে পঞ্চাশ বছর পরে তাদের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটা প্রকৃত কারণ সম্পর্কে শেষপর্যন্ত একটা ছোট্ট ধোঁয়াশা থেকেই যায়।

প্রাইমারি স্কুলের সহপাঠী দুই বন্ধু বিধবা সাবিত্রী বালাকে দেখতে চাওয়ার অভিলাষে পথ হাঁটছে এবং তা পঞ্চাশ বছর পরে। গল্পের শুরুতেই এই চমকটা দিয়েছেন লেখক। প্রশ্ন ওঠে কী অভিপ্রায়ে ওদের দুজনের এই অভিযান? এর কোনো জবাব দেননি লেখক। কেবল বুঝিয়েছেন, কোনো না কোনোভাবে এই দুজন অর্থাৎ গল্পে দুই বৃদ্ধ ইয়াসিন অর্থাৎ মৌলভী মাস্টার আর মাইনুল অর্থাৎ যার পরণে প্যান্ট-শার্ট, চোখে চশমা, মাথায় টাক— সে আসলে শহরবাসী এক ভদ্রলোক, ওই সাবিত্রীর প্রেমে পড়েছিল একসময়। সেই প্রেম বালক বয়সের নিরুচ্চারিত এক কল্পনাবিলাস ছাড়া আর কী! কিন্তু এতদিন ধরে অন্তরে লালন করা সেই অঘোষিত প্রেমের টানে পঞ্চাশ বছর পর দুজনের একসঙ্গে সাবিত্রীকে দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনার মধ্যে লুকিয়ে আছে এই গল্পের বীজ।

দুই বন্ধুর পথচলার মধ্যে তাদের কথোপকথনে ভেসে আসছে তাদের ফেলে আসা অতীতের কিছু স্মৃতি, যার প্রায় সবটাই আজকের উদ্দীষ্ট সাবিত্রীকে ঘিরে। কিশোরী সাবিত্রীর প্রতি সাধারণ চেহারার বর্ণনার পাশাপাশি তার প্রতি দুজনের অমোঘ আকর্ষণের খুঁটিনাটি বর্ণনা এসে পড়ে তাদের কথায়। দুই সহপাঠী বন্ধু জীবন ও জীবিকার তাড়নায় একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এক সময়। মাইনুল চলে যায় শহরে আর ইয়াসিন পড়ে থাকে গ্রামেই। তাই সাবিত্রীর জীবনে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনা ও দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী সে। গ্রামের চ্যাংড়া ছোকরাদের ঢিল ছোড়ার অবকাশ না দিয়ে সাবিত্রীর বাবা জমি বেচে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন মাইল পাঁচেক দূরের এক গ্রামে। সেই পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো হলেও সাবিত্রীর কপালে সুখ লেখা ছিল না। মাত্র ছ’বছরের দাম্পত্য জীবনের শেষে তার স্বামী গত হন। সাবিত্রীর কোলে তখন এক নবজাত। ইতোমধ্যে একাত্তরের যুদ্ধ এবং শরণার্থী হয়ে দেশান্তরী হওয়া ও স্বামীকে হারিয়ে পুত্র কোলে সাবিত্রীর বাবার ভিটাতে ফিরে আসার অনুপুঙ্খ বর্ণনা শোনে মাইনুল তার বন্ধু ইয়াসিনের মুখে। আর শোনে বিধবা সাবিত্রীর সঙ্গে জড়িয়ে গাঁয়ের যুবক নিখিলের কেচ্ছা-কাহিনী। তবে সাবিত্রী পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে শেষপর্যন্ত স্বামীর ভিটাতেই ফিরে আসে এবং কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে ধীরে ধীরে ছেলেকে বড় করে। পড়শি ইয়াসিনের পরোক্ষ সহায়তা ছিল বরাবরই। ছিল সাবিত্রীর সঙ্গে তার যোগাযোগ। তাই এই গল্পের মূল কথক ইয়াসিন আর তার শ্রোতা মাইনুল।

বালক বয়সের মুগ্ধতা কিংবা দুর্বলতা যাই থাকুক না কেন, ইয়াসিনের সঙ্গে সাবিত্রীর একটা নিরাপদ দূরত্ব ছিল। কিন্তু সাবিত্রীর প্রতি তার অদৃশ্য টান কখনওই হারায়নি সে, দেখা-সাক্ষাৎ তার সঙ্গে যত কমই হোক না কেন। তাই তো সাবিত্রী যখন তাকে ডেকে পাঠায় একবার নিজস্ব প্রয়োজনে তখন ইয়াসিনের অন্তর পুলকিত হয়, মুহূর্তে তার বালক বয়সের চনমনে হৃদয় জেগে ওঠে। সাবিত্রীর কোনো উপকারে আসার জন্যে সে ব্যাকুল হয়। কিন্তু তার এই উদ্বেল চিত্তের কোনো বিকার ঘটে না শেষ পর্যন্ত। একেবারে নিরাপদ দূরত্বে বসে সে তার বাল্য বয়সের ভালোলাগা এক নারীর উপকার করতে চেয়েছে। তাই তো লেখকের ভাষায় বলা যায়, …ঘনিষ্ঠ পড়শিসুলভ সুসম্পর্ক বজায় রাখার সুযোগ পেয়েও ইয়াসিন মাস্টার সাবিত্রীর খোঁজ নেয়নি এতকাল’। অন্যদিকে সাবিত্রীর তরফের কোনোরকম দুর্বলতার সুলুকসন্ধান দেননি লেখক। আমরা তাই ধরে নিতে পারি ব্যাপারটা ছিল একেবারেই একতরফা। তাই তো পঞ্চাশ বছর পরে বাল্যপ্রেমের আকর্ষণে শহর থেকে মাইনুলের এই গ্রামে আসার মধ্যেও থেকে যাচ্ছে এক ধরনের নিরুচ্চার কৌতূহল। তবে তা সত্যিকারের কৌতূহল না চোরা কোনো আকর্ষণ, সেটা সেইভাবে ব্যক্ত করেননি লেখক। তার সব ব্যাপারটাই আমাদের অনুমাননির্ভর। তবে লেখকের হাত ধরেই আমরা গল্পে ওই সময়টার পটভূমি বিবেচনা করব।

‘…সাবিত্রীর ভয়ের আসল কারণটাও জানতে পেরেছিল ইয়াসিন। হিন্দুবসতির কাছে নতুন বাড়ি করেছে ওয়ারেস হাজির বেটা হান্নান। সেই এখন সাবিত্রীকে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়, এ দেশে এখন শুধু ইসলাম ধর্মের লোকেরা থাকবে। বাঁচতে চাইলে স্বামীর জায়গাজমির ভাগ বেচে দিয়ে মুসলমানদের এ দেশ ছেড়ে শৈবালকে নিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাক। নইলে তার ভাসুরেরা সব বেচে দিয়ে সাবিত্রীকে ভিটেছাড়া করে কোনদিন যে পালিয়ে যায়। কিন্তু সাবিত্রী পণ করেছে স্বামীর ভিটামটি ছেড়ে ইন্ডিয়া তো নয়ই, বাপের বাড়িও পালাবে না আর।’ সময়টা এরশাদ জামানার, এটা কিন্তু মনে রাখা দরকার।

এ হেন একজন ভাগ্য বিড়ম্বিত নারীর সঙ্গে তার ছোটবেলার দুই সাথী দেখা করতে এসেছে এবং তাও পঞ্চাশ বছর বাদে। এই পটভূমিতে লেখক খুবই সন্তর্পণে একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বয়স্কা বিধবা নারীর অন্তর্জগত ও বহির্জগতের নানা অনুষঙ্গের আভাস দিয়ে সরাসরি গল্পের পরিসমাপ্তি টেনেছেন। অর্থাৎ তাদের দেখা-সাক্ষাতের পর্বটি লেখক সমাধা করেন অনেক কৌতূহল ও প্রশ্নের নিরসন ঘটিয়ে। ‘…মাইনুল বাড়িভিটা ঘুরে দেখে। এই বাড়িতে অর্ধ শতাব্দীকাল তার শৈশবকাল ও কৈশোরের দুরন্ত ভালোলাগা সাবিত্রীবালা টিকে আছে কী হালে, সেটা তো ঘরদুয়ারের গরিবি হাল দেখেও আন্দাজ হয়, কিন্তু কীসের জোরে একা মেয়েমানুষ নাতনিকে নিয়ে টিকে আছে এখনও, সেই জোরটা কোথায়— কীভাবে তা দেখতে পাবে মাইনুল?’

এই নির্মোহ বর্ণনার অব্যবহিত পরই ওই ঘরে সাবিত্রীর আবির্ভাব ঘটে। ষাটোর্ধ সেই বিধবা রমণীর বর্ণনাতেও লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে দর্শনার্থী মাইনুলের মনোজগতের এক অপরূপ চিত্রকল্প উপহার দেন— ‘… পরনে বিধবার মতো সাদা ধান, ধবধবে সাদা নয়, সাদা আকাশী রঙ। কপালে সাদা উল্কি আঁকা, মাথাতেও সাদা চুল তবে এখনও তারা সংখ্যালঘু। মৌলভী ঠিকই বলেছে, তেমন বুড়িয়ে যায়নি এখনও। আঙিনায় চেনা মৌলভীর উদ্দেশ্যে তার হাসি দেখে মাইনুলও মুহূর্তেই চেনা সাবিত্রীকে খুঁজে পায়।’ সাবিত্রী মাইনুলকে চিনতে পারে না। এরপর ইয়াসিনই তাকে চিনিয়ে দেয়। রসিকতা করে বলে, ‘চিনতে পারিস দিদি? ছোটবেলায় তোকে ভালোবেসে দেওয়ানা হয়েছিল।’ এই কথায় বৃদ্ধ মাইনুল খুবই লজ্জিত বোধ করে। সঙ্কোচের বিহ্বলতা কাটিয়ে সেও সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। সাবিত্রী চটজলদি শৈশবের দিনগুলোর কথা মনে করায়। তার মন থেকে যে মাইনুল বিস্মৃত হয়নি, এই অনুভবে সে উদ্বেলিত হয়। জানতে চায় সে কেমন আছে। সাবিত্রী উত্তর দেয়, ‘…এসিন মৌলভীর কাছে শুনিস নাই কেমন আছি? আগে গ্রামের দুই এক ঘর মুসলমান, সেই সাথে জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা তাল দিত সাবিত্রীবালাকে ভিটেছাড়া করার জন্য। এখন যে ছেলেকে এতকাল লড়াই করিয়া মানুষ করলাম, সেই ছেলেও এখন মাকে ভিটাছাড়া করার ষড়যন্ত্রে তাল দেয়।’

গল্প আর বেশি দূর এগায় না। দুই বন্ধু তাদের বাল্যকালের ভালোলাগার মানুষটিকে দিদি সম্বোধন করে। সামান্য কিছু কুশল বিনিময়ের পরে সাবিত্রীর নাতনির জন্য পাঁচশ টাকা দেয় মাইনুল। এটা দেওয়ার জন্য বন্ধু করাচ্ছে মৃদু ভর্ৎসিত হয়ে সে— ‘টাকা কি এ যুগে এমনি কাউকে দেয় রে মাইনুল? এ কথার পিঠে তার একটি নিঃশব্দ মন্তব্য— ‘ছি! তোর মনটা এত ছোট!’ আমরা লেখকের কলমে তার মনের কথাটা জানতে পারি। জানতে পারি শৈশবের ভালোলাগার মূল্য হিসাবে এ টাকা খুব সামান্য ধন। কিন্তু এই সরল সত্যটা সে তার বন্ধুকে বোঝানোর কোনো চেষ্টা করে না। তারা দুজনে চলে আসে। গল্প শেষ হয়।

বাংলাদেশের পটভূমিতে একজন নিঃস্ব সংখ্যালঘুর বেদনামথিত এই গল্পের শত্রু-মিত্র বিচারে আমাদের হিসেব গুলিয়ে যায়। আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই আর যারাই হোক না কেন, বাল্যকালের দুই ভিন্নধর্মী প্রতিবেশী সাবিত্রীর শত্রু নয়। তারা সাবিত্রীর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বেই থেকে গেছে বরাবর। এমনকি পঞ্চাশ বছর পরে দেখতে আসার মধ্যেও কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। অপার কৌতূহল হয়তো ছিল কিন্তু নিষিদ্ধ কোনো আবেগের তাড়নায় এ সাক্ষাৎকার ঘটেনি।

সাবিত্রীর শত্রু বরং তার দেশ কাল ও সমাজ। যে দেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষিত হয়ে যায় সেই দেশে সাবিত্রীর মতো অসহায় বিধবার পাশে দাঁড়ানো লোকের যে অভাগ ঘটবে, তাতে আর বিস্ময়ের কী। একদিকে সীমাহীন দারিদ্র্য অন্যদিকে আত্মীয়-পরিজনদের বঞ্চনা আর অবহেলার মধ্যে বাল্য বয়সের দুই মুগ্ধ বালকের পরিণত বয়সে তার কাছে আসাকে সাবিত্রী একটি সৌজন্য সাক্ষাৎকার হিসেবেই গণ্য করে। বস্তুত তাদের এই স্বল্পকালের কথোপকথনের মধ্যে অন্য কোনো ইঙ্গিত বা ইশারা অবকাশ রাখেননি লেখক।

গল্পের সাবিত্রী আমাদের আবহানকালের বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধত্ব করেই তার ভূমিকা নির্বাহ করে। তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একরৈখিক। জলের উপর দাগ কাটার মতো তার উপস্থিতি যা অতি করুণ হলেও বাস্তব, দুঃসহ হলে অমোঘ। গল্পকার একজন দুঃস্থ সংখ্যালঘু বিধবা নারীর নানাদিক এইভাবেই উন্মোচন করেছেন। আপাতভাবে তার এই বর্ণনা নিস্পৃহ ও নির্লিপ্ততার পরাকাষ্ঠা মনে হলেও আসলে তা এক কঠিন আবরণে ঢাকা এক অতলান্ত কোমল বিষাদ। সেই বিষাদের রেশ গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরও থেকে যায় আমাদের মনে।

‘নবিতুন বেওয়ার দুই আনা’ গল্পের নবিতুন আসলে এই কঠিন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার এক জীবন্ত প্রতিনিধি। আবার ‘ইব্রাহিম দারোগার শৌর্যবীর্য‘গল্পের ইব্রাহিম পুরুষশাসিত সমাজের কথাই জোর গলায় বলে। আবার এই সংকলনের সবচেয়ে দীর্ঘ গল্পটি (জান্তব) ঠিক যেন গল্প নয়, একটি উপন্যাসিকা। এছাড়া আত্মসমর্পণ গল্পে আছে খানিকটা জাদু বাস্তবতার ছোঁয়া। ধর্মের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের পাশাপাশি গোড়ামির পর্দা ছিড়ে লেখক দেখিয়েছেন নিরন্ন দেশের অধিকাংশ মানুষের কিছু বদ্ধ সংস্কার। মাঝে মাঝেই তা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লাল সালু’র কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু কেবল ওই মনে করানোটুকুই। কেননা বক্ষমান গল্পের কেন্দ্রবিন্দু বা অভিমুখ একেবারেই ভিন্ন।

ছোট-বড় মিলিয়ে দশটি গল্পের সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পরিসর এটা নয়। তাই আমার ভালোলাগা আরেকটি গল্পের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেই এই লেখার ইতি টানব। গল্পকারের দক্ষতার এক সম্যক পরিচিতির জন্যে আশা করি এইটুকুই যথেষ্ট।

গল্পের নাম ‘শৌখিন ট্যুরিস্ট গাইডের স্বপ্নযাত্রা’। এটি একাধারে নগরজীবনের একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবকের স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নভঙ্গের এক চমৎকার উপাখ্যান। ‘দুই সপ্তাহের জন্যে অচেনা একটি আমেরিকান মেয়ের দোভাষী ও ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করতে হবে জেনে অনীক স্বর্গরাজ্য ও রাজকন্যা লাভের সম্ভাবনায় পুলকিত হয়।’ এভাবেই গল্পের শুরু। মাত্র দুটি লাইনের মধ্য দিয়েই লেখক একজন উচ্চাভিলাষী যুবকের স্বপ্নযাত্রার এক নান্দীমুখ রচনা করে দেন। ইংরেজিতে মাস্টার্স করে অনীকের ইতোমধ্যে বহু ঘাটের পানি খাওয়া হয়ে গেছে। বেশকিছু ইন্টারভিউ দেওয়া ছাড়া বিসিএস দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নে ডিভি লটারিতেও অংশ নিয়ে ছিল একবার। কোনো কিছুতেই তার ভাগ্য সহায়তা দেয়নি। অবশেষে এক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষক হয়ে বাড়তি কিছু ট্যুইশানি করে যখন বিয়েশাদি করার কথা ভাবছে, এমন সময় এই সুযোগ তার কাছে ভাগ্য বদলের এক ইঙ্গিত যেন। সুযোগ এসেছে এক ট্রাভেল এজেন্ট তথা ট্যুর অপারেটর আতিক মামার মাধ্যমে। বস্তুত একঘেয়ে জীবনের মাঝে এমন একটা সুযোগ অনীকের কল্পনার দৌড়কে অনেকদূর নিয়ে যায়। সে অলস কল্পনা যে এক অভূতপূর্ব হিস্টিরিয়ার জন্ম দেবে কে জানত।

যথাসময়ে মেয়েটি আসে এবং এয়ারপোর্টে থেকে শুরু হয় অনীকের তথাকথিত স্বপ্নযাত্রা। নানারকম ঘটনা ও দুজনের আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে অনীকের মনোজগতে মেয়েটি সম্পর্কে নানারকম স্বপ্ন-কল্পনার উঁকি দেয়। দুদিন ধরে মেয়েটিকে ঢাকা থেকে রংপুরে নিয়ে আসার সবটুকু দায়িত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে অনীক পালন করে। কিন্তু রংপুরে পৌঁছানোর পরে সে টের পায়, এরপরই তার দায়দায়িত্ব শেষ। এরপর থেকে ওখানকার ব্যবস্থাপকেরা মেয়েটির সবরকম দেখভাল করবে। অনীক বুঝতে পারে তার আতিক মামার চাতুরি। তাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজটি করিয়েছে। মুহূর্তে তার ফোন নম্বরটি নিজের সেট থেকে মুছে দিয়ে মেয়েটি সম্পর্কে ভাবতে থাকে। একবার ভাবে ওর দেওয়া নম্বরটি মুছে দেবে। ‘সম্ভাবনাময় এক সম্পর্কের সেতু থেকে ধাক্কা খেয়ে হতাশার বিবরে তলিয়ে যেতে যেতে নিজের মোবাইলে সেভ করা লিন্ডা জ্যাসনের নাম নাম্বার তাকিয়ে দেখে অনীক। লিন্ডা সহাস্য বাই ও ফোন করার আশ্বাসটিও মনে পড়ে। এটুকু মুছে ফেললে এ যাত্রায় আর থাকল কী তার?’

এমনই সব গল্প লেখেন মঞ্জু সরকার। তাঁর চারপাশের মানুষের ভেতরকার আশা-আকাক্ষ্মার কথা যেমন আছে, তার সঙ্গে আছে নানারকম স্বপ্ন দেখা ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিকথা। রূপান্তরের গল্পগাথায় খুঁজে পাই কঠিন-কঠোর বাস্তবের আবরণে অতলান্ত এক বিষাদের উদ্ভাস, পাঠ শেষ হলেও যে বিষাদের কোমল রেশ মনে রয়ে যায়।

রূপান্তরের গল্পগাথা

মঞ্জু সরকার

অনুপ্রাণন প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০১৪

মূল্য ২৮০ টাকা

 

Read Previous

দাঁড়ানো

Read Next

চন্দনকৃষ্ণ পাল – গুচ্ছকবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *