অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৫, ২০২৪
১২ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সাঈফ ফাতেউর রহমান -
সমুদ্রের নীলজলে সাঁতার দেয় কবিমন

বই: কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর
ধরন: কাব্যগ্রন্থ
কবি: রুদ্র সাহাদাৎ
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রকাশক: অনুপ্রাণন প্রকাশন,
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৬৪
মূল্য: ১৬০ টাকা

কামাল উদ্দিন, আর করিম, মংলাওয়ান, মো. আরফান এবং যারা প্রকৃতি দেখেন প্রকৃতি আঁকেন হৃদমাঝারে-সমুদ্র ভালোবাসেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত রুদ্র সাহাদাৎ-এর কাব্যগ্রন্থ ‘কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর’।
এ যাবৎ প্রকাশিত কবি রুদ্র সাহাদাৎ-এর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা পাঁচটি। বর্তমান কাব্যগ্রন্থটি ছাড়াও অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ হলো- শঙ্কায় আয়না দেখিনা, সমুদ্র নিকটবর্তী, পানপাতার সংসার, নৈঃশব্দ্যে সমুদ্রপাঠ, স্বপ্নহীন চোখ বসন্ত খোঁজে না।
কবি রুদ্র সাহাদাৎ কবিতাঙ্গনে ক্রমেই পরিচিত হয়ে উঠছেন। ধৈর্য এবং অনলস শ্রম তাঁকে কবিতা গভীরে প্রবেশে অনুপ্রাণিত করছে। ফেসবুকে লিখছেন যেমন, অনলাইন পত্রিকাসহ বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকাতেও সমানতালে লিখে চলেছেন। ইতোমধ্যেই তাঁর একটি অনুরাগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। পাঠকপ্রিয় এই কবি নিরীক্ষাধর্মী লেখায় আগ্রহের কারণে বিভিন্ন পরিসরের কবিতা রচনা করছেন। অনুসন্ধিৎসু সুমানসে তিনি আঙ্গিক ও উপস্থাপন, প্রকরণ ও বিন্যাস, ভাষা ও শব্দচয়নে গড্ডালিকায় গা না ভাসিয়ে নিজস্ব রীতি ও বিন্যাসে নির্মাণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রায়োগিক সাফল্য কবিতাগুলিকে আলোকিত করেছে, পাঠকের পাঠ স্পৃহাকে উজ্জীবিত করেছে।
স্বল্প পরিসরে বৃহত্তর বক্তব্য প্রকাশের একটি প্রবণতা তাঁর কবিতায় সমুপস্থিত। আমি এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই। বাহুল্য বর্জিত নিরাভরণতায়, সহজ শৈলীতে গভীর ও ব্যাপক জীবনানুভব প্রকাশ সহজসাধ্য নয়। সেই দুরূহ কাজটিই কবি সাগ্রহে সম্পাদনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তরুণ কবির সম্মুখযাত্রায় দীর্ঘপথ। সাহসী এবং সম্পন্ন পথযাত্রায় ঋদ্ধমান অব্যাহত পথযাত্রা তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে, সঙ্গত ও যৌক্তিক এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

অনুভূতির প্রগাঢ় গভীরতা একটি সন্নত শুদ্ধ চেতনায় তাঁকে শাণিত করে। দীপ্র বোধের সমুজ্জ্বলতায় তিনি জীবনের অন্তস্থ ও বহিরঙ্গের সকল সুষমা ও শ্রী অবলোকনে ব্রতী হন। সত্য সুন্দরের বোধ তাঁকে আকৃষ্ট করে, পুষ্ট করে, সংরাগে বিভূষিত করে। প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর পৃথিবীর বর্ণময়তার সকল সম্ভার যেমন কবি মানসকে শুদ্ধতায় নিবিষ্ট করে, তেমনই যাবতীয় প্রতিকূল, বিনাশী, অসুন্দর, অনন্দের সাথে তার সাংঘর্ষিকতা অবিদিত থাকে না। জীবনের মৌল সুরাঞ্জলি আহরণ প্রয়াসী কবি সব অশুভের দানব প্রাকার গুঁড়িয়ে সত্য সুন্দরের উদ্বোধন ও আবাহনে নিবেদিত থাকুন। যা কিছু বৈরী, যা কিছু অপ্রভ, যা কিছু অনন্দ, তার প্রতিই কবির প্রবল অনীহা ও বৈরিতা।
অন্তর্গত সহজাত সৌন্দর্যবোধ তাঁকে আবিষ্ট রাখে। সাধারণ্যে দৃশ্যমান নয় এমন গভীর অনুভবও দ্যূতিময় হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। প্রকৃত ও প্রাকৃত বোধ তাঁকে সঞ্জীবিত করে, কখনো মগ্নতায় নিমজ্জিত করে। যাপিত জীবনের আনন্দ আহরণ ও একইসাথে বেদনা, হতাশা, হুতাশনের আর্ত, ক্ষতাক্ত যন্ত্রণাবোধ তাঁকে পীড়িত করে, অস্থির করে তোলে। দ্রোহের চেতনা কাজ করে মননের গভীরে। অন্ধকারের নিকষতা সুদূরে তাড়িয়ে আলোর উদ্ভাস ঘটাতে চান। অসুন্দরের নির্বাসনে সুরম্য নন্দন বাসযোগ্যতা চান। বিভাজিত সমাজের নিপীড়ন এবং আগ্রাসে হতবিহ্বলতার অবসান চান। সাম্য সুন্দর পৃথিবীর আলোকময়তার আবাহনী সংগীত গাইতে থাকেন। হতাশার অবরুদ্ধ দুয়ার ভেঙে আলোকিত ভুবন চান। গুঁড়িয়ে দিতে চান অনাচার আর বৈষম্যের সকল কপাট। এর মাঝ দিয়েই উঁকি দেয় জীবন সুন্দরতা, জীবনের সকল বর্ণিলতা, মানবীয় স্বভাবজাত আবেগ-অনুভব, সম্পর্কের গীতল দ্যোতনা। কবি রুদ্র সাহাদাৎ-এর ‘কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর’ হয়ে ওঠে সম্পন্ন সুখপাঠ্য মানবিক কবিতার নিভাঁজ দলিল আর জীবন চলনের প্রতি পদক্ষেপে আর কবিতার প্রতি পঙক্তিতে তিনি এঁকে যান যাবতীয় অসঙ্গতি আর অশোভন-অসুন্দরের প্রতিপক্ষে নিনাদিত শব্দস্বর।
‘কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত কবিতার সংখ্যা ৫৬টি। স্বল্পায়তনে সীমিত অধিকাংশ কবিতা।
এমনকি দুই পঙক্তির কবিতাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা মুগ্ধকর।

কবিতা- তুমিহীন দরিয়ানগর
—————————–
কথাহীন আজ কতোদিন হারিয়ে গেলে অচিনপুর
প্রতীক্ষায় আছি প্রকৃতির সংসার দেখে দেখে তুমিহীন দরিয়ানগর।

কবিতা- মানুষ
————
মানুষ মুখ খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে ফেলে মন
মানুষ জীবন সাজাতে সাজাতে হারিয়ে ফেলে যৌবন
মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব যেন আজীবন।

অবয়ব নির্বিশেষে প্রতিটি কবিতা স্বতন্ত্র পৃষ্ঠায় উপস্থাপন সুরুচি ও শোভনতার পরিচয় বহন করে।
কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম কবিতা ‘কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর’।

‘আজও কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর
হিমছড়ির ঝরনাধারা দেখতে দেখতে সময় পার
সমুদ্রের নীল জলে সাঁতার দেয় একঝাঁক সাঁতারু চোখ
নব নব কথায় শুনায় গান ঝাউবন, সাদা গাঙচিলের দল–
লাল কাঁকড়ার লুকোচুরি দেখতে দেখতে অজান্তেই প্রকৃতি পাঠ।

শিরোনাম কবিতার ভেতর দিয়েই কবির অন্তর্মানসের পরিচয় প্রতিভাত হয়। অবারিত প্রকৃতি সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা কবির দরিয়ানগর কোনো স্থান বিশেষ! না তার মানসলোকের অভ্যন্তরে লালিত এক বোধ! কবি বেড়ে উঠেছেন সাগর সান্নিধ্যে। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর অবারিত নিসর্গ সান্নিধ্য আজন্ম তাঁর মানস গঠনে অনির্বচনীয় প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন কবিতায় প্রত্যক্ষে পরোক্ষে সাগর এবং দ্বীপ নানা আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে।

‘মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যাই অচিনপুর’ কবি মানসের আরেক দরিয়ানগরের আত্মোনুসন্ধান।
‘মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যাই অচিনপুর
কখনো গোবরঘটা কখনো ইনানীচর
কখনো দৃষ্টি সীমানা পেরিয়ে আরো দূর বহুদূর
কখনো সমুদ্রজলের ঢেউ কাছে টানে বারংবার
ফের ফিরে ফিরে আসি চেয়ে দেখি পানপাতার সংসার।’

‘উদ্বাস্তু জীবন’ অনিকেত মানবীয় অঋদ্ধ পরিক্রমার চালচিত্র-
‘আমার শহরজুড়ে কোনো বসন্ত নেই
ফুল নেই ফল নেই
শুকনো পাতায় ছিটানো চতুর্দিক
ফ্যাকাশে যৌবন—আমার পৃথিবী অন্যরকম
উলটো পথে হাঁটি উলটো দৌড়—’

‘হারিয়ে ফেলেছি স্মৃতিচিহ্ন’ নস্টালজিক অনুভবে জীবন খতিয়ান অন্বেষণ-
‘ক্লান্তচোখ দৌড়ায় বঙ্গোপসাগরের দিকে
বাঁকখালী নদীতীরে হারানো শৈশব খুঁজি
কানের ভিতর জলজ মিউজিক বাজে অহর্নিশ—।’

বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা একটি উদ্বেগসঙ্কুলতায় পূর্ণ অভিঘাত। অতি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় ভিনদেশি বিপুল সংখ্যক মানুষের দায়িত্ব গ্রহণ এবং ভারবহনের বাস্তবতা নেই। মানবিক বিষয় বিবেচনায় রাখলেও বহন অযোগ্য এই সমস্যা সমগ্র দেশ বিশেষত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সন্নিহিত অঞ্চলগুলির জনজীবনে এবং সামাজিক পরিবেশে নিদারুণ অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি করছে। ক্রমেই ঘনীভবনে দুর্বহ এই সমস্যার বাস্তবচিত্র কয়েকটি মাত্র পঙক্তিতেই সমুজ্জ্বল ‘আমার সাজানো উঠানে রোহিঙ্গা দৌড়ায়’ কবিতায়-
‘আমার সাজানো উঠোনে রোহিঙ্গা দৌড়ায়
একজন দু’জন করে এগার লাখ
উখিয়া টেকনাফ ভাসানচর দখলে
শঙ্কিত চোখ শঙ্কিত স্বজন
কান পেতে শুনি সীমান্তে সীমান্তে হাঁটছে
আরো ঝাঁকে ঝাঁকে অচেনা মানুষ।’

বৈশ্বিক অতিমারী ‘করোনা’র হন্তারক থাবায় সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশও রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণাক্ত অসহনীয় দুর্ভোগের নিরাপত্তাহীন জীবন অতিক্রমণ করছে। এর মাঝেও সংবেদি মনোভাবের পাশাপাশি কিছু অমানুষ মানুষের পাশবিক অশীলন চলছেই।
‘আমরা যেন কেউ কোথাও নেই’ কবিতায় এই দুর্বিষহ যাপিত জীবনচিত্র পরিস্ফূট-

‘মাস্কগুলো ঝুলে আছে সীমান্তে ঝুলে থাকা ফেলানীর মতন
লাল নীল আকাশি বেগুনি হলুদ রঙে
অথচ আজও করোনার থাবা যত্রতত্র দেশে দেশে
দোকান রাস্তা বাড়ি অফিস সর্বখানেই অবাধ বিচরণ।’

‘আজকাল’ কবিতায় সাম্প্রতিক জীবনবিমুখ বাস্তবতা অসামান্য বাঙ্ময়তায় প্রকাশিত হয়-
‘আজকাল কি যে হয় জানি না কিছুই
হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেলি
কাঁদতে গিয়ে বোবা মুখ
নিস্তব্ধতায় হাঁটে জোড়াচোখ।’

‘কোথাও কেউ নেই-২’ মনোজ অনুভবের দ্যোতনায় বেদনা সংগীতের মতো অনুরণিত হয়-
‘-মেঘহীন বৃষ্টি ঝরছে আমার হৃদরাজ্যজুড়ে—
কোথাও কেউ নেই
অদৃশ্য ছায়া মরীচিকা মায়া পিছু পিছু
ঝাউপাতার বিরহী সংগীত বাজে
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত—’

বোধের গভীরতায় অনন্য মাত্রা পেয়েছে ‘মানুষের ভিড় দেখি শুধুই মানুষ দেখি না’-কবিতাটি
‘গভীর আন্ধারে বইস্যা আছি দেখা যায় না কিছু
আকাশের তারাগুলো মিটিমিটি হাসে–
আন্ধারে আরো আরো আন্ধার খুঁজি
হায় রে মনুষ্যজনম! আজও মানুষ হতে পারিনি
মানুষের ভিড় দেখি শুধুই মানুষ দেখি না।’

কবি-মানসে নিরন্তর বহুমাত্রিক অনুধ্যানতাড়িত তাপিত রুধিরাক্ত করে। জীবন সহজিয়া ব্যঞ্জনায় ধরা দিতে দিতেও দেয় না। এক অধরা, অস্পর্শ জীবন-সুন্দর লিকোচুরি খেলে নিয়তই। জীবনের ব্যাকরণ অনায়ত্ত থেকেই যায় আমাদের কাছে-

‘চলতি পথে মাঝেমধ্যেই থমকে দাঁড়াই
আজও জীবনের ব্যাকরণ বুঝি না
কোনোদিন যোগ-বিয়োগের হিসাব মিলে না
শীতের সকালে কুয়াশার ভিতর চেয়ে দেখি
প্রকৃতির সংসার’।

‘নৈঃশব্দ্যের গান’ রূপকের আড়ালে সমকালীন জীবন বাস্তবতার উপস্থাপন-
‘রাত্রির নিস্তব্ধতায় হাসলেই শোনা যায়
কাঁদলে কেউ বোঝে না
কেউ শোনে না
গভীর আঁধারের নৈঃশব্দ্যের গান’।

চলমান বাস্তবতায় ঘুরেফিরেই করোনা ফিরে ফিরে আসে জীবন প্রাত্যহিকে। কবিও বিমুক্ত থাকতে পারেন না-
‘জীবন মানে কী এলোমেলো ভাবনাবৃন্দের খেলা
করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো
শেষ হয়ে আসছে ভবরঙের মেলা’।

‘মানুষ একটি অসমাপ্ত কাব্য’ ভিন্ন ব্যঞ্জনায় জীবনোপলব্ধির সুমিত নির্মিতি-
‘মানুষ সর্বদা দ্বিধাদ্বন্দ্বে হাঁটে
মানুষ শুধুই মানুষ খোঁজে
মানুষ একটি অসমাপ্ত কাব্য
ছন্দ তাল লয় অন্তমিলহীন।’

চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত হৃদঅনুভবের অনির্বচনীয় কবিতা-
‘তুই ড-অত ন’থাইলে বেগগিন আন্ধার আন্ধার লাগে’-
‘তুই ন’পরিলে আর কবিতা বেগগুনের আগে-অকবিতা মনে অয়
তুই ড-অত না’আইলে ভালোবাসা বেগিগন—মিছা মিছা লায়
তুই ড-অত আয়
মন তুরে চায়-
তুই ড-অত ন’থাইলে বেগগিন আন্ধার আন্ধার লাগে
তুই ড-অত থাইলে ভালা ভালোবাসা জাগে—-’।

কাব্যগ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত কবিতাসমূহের মাঝে ‘শহিদ মিনার’ ব্যতিক্রমধর্মী-
‘লাল সবুজ পতাকা হাতে দৌড়ায় মুখ
দেখি হাস্যোজ্জ্বল বালকের দল চৌদিক
সারি সারি সুশৃঙ্খল পা
জোড়া জোড়া অজস্র ভেজাচোখ
কি যেন খুঁজে বেড়ায়
হাতে রঙিন ফুলের মালা…’।

সঙ্গত কারণেই সীমিত পরিসরে অন্তর্ভুক্ত ৫৬টি কবিতারই স্বতন্ত্র বিশ্লেষণ সম্ভব হলো না। তবে কাব্যগ্রন্থের অন্তরের ব্যঞ্জনাময় সুর অনুভবে এতে প্রতিবন্ধক দেখা দেবে না কোনো। বঙ্গোপসাগরের সন্নিকটবর্তী আবহ ও পরিবেশে জন্ম ও বর্ধনসূত্রে কবির কবিমানসে সাগর, প্রকৃতি, আকাশ, মেঘ, ঢেউ, ইনানী সৈকত এবং ইত্যকার স্থান/ বিষয়াবলি ঘুরেফিরে এসেছে। পরিমিতি এবং পরিচর্যায় কবির কবিতা ইতিবাচকতায় অগ্রবর্তী হবে এটা সঙ্গতভাবেই বলা যায়।
কিছু কবিতার অমল কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করি-
-‘আমার শহরজুড়ে ধু ধু বালিচর যেন সাহারার প্রান্তর (আমার শহরজুড়ে)
-‘দৌড়ানোই হয়তো মানুষের ধর্ম (শরৎ শুভ্রতায় কাটছে দিন);
-‘ঘুমাতে গিয়ে সারারাত্রি জেগে থাকি সারারাত নিশাচর মানুষ (আজকাল);
-‘আমাদের পদচিহ্নসমূহ প্রতিদিন হারিয়ে যায়’ (পদচিহ্ন);
-‘মানুষ মুখোশের ভিতর হাঁটে’ ( মুখ ও মুখোশ ৯);
-‘যেতে যেতে মেঠোপথ সব মিশে গেছে রাজপথে’ ( উদ্বাস্তু চোখ);
-‘হাসপাতালের বারান্দায় ঘুমহীন চোখ জানে জীবন কী’ (জীবন);
-‘মানুষ জীবন সাজাতে সাজাতে হারিয়ে ফেলে যৌবন’ (মানুষ);

কবি রুদ্র সাহাদাৎ-এর কাব্যগ্রন্থটির বিশেষ আকর্ষণীয় দিকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বিস্তৃত বক্তব্য প্রকাশের প্রয়াস। জীবনলগ্নতা তাঁর সহজাত। প্রকাশভঙ্গি ক্রমান্বয়ে ঋজুতর হবে, এ প্রত্যাশা করাই যায়। সুস্মিতির প্রগাঢ়তার মাঝেও কিছু সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক। কবি অগ্রবর্তী হচ্ছেন, হতে থাকবেন। দরিয়ানগর অধরা থাকবে না তাঁর কাছে। তাঁর কবিতা কৌমুদীর সুবাস-স্নিগ্ধতায় কাঙ্ক্ষিত দরিয়ানগর তাঁর অন্তর্গত অনুভবে মিশে যাবে।
কাব্যগ্রন্থটির সার্বিক উপস্থাপনা ভালো। কাগজের মান ভালোই। প্রচ্ছদ আরেকটু মানসম্মত হতে পারতো। প্রুফ সংশোধনে আরেকটু যত্নবান হওয়া যেতো। কাব্যগ্রন্থটির ধার্যকৃত মূল্য যৌক্তিক।
অব্যাহত সৃজনী লেখা আমরা উপহার পেতে থাকবো, কবি রুদ্র সাহাদাৎ-এর কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমি গ্রন্থটির সার্বিক সাফল্য ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি।

———————–

সাঈফ ফাতেউর রহমান
লালমাটিয়া, ঢাকা
এপ্রিল ২৫, ২০২১ খ্রি.

Read Previous

ফালতু লোকের প্রতি ভাবনা

Read Next

স্খলনকালের গল্প: শব্দের আলপনায় আঁকা জীবনের প্রতিচিত্র

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *