প্রকাশিত হলো শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণনের ৫ম সংখ্যা। ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে অন্তর্জালে অনুপ্রাণনের যাত্রা শুরু হয়। ইতিপূর্বে আমরা ৪টি সংখ্যা প্রকাশ করেছি। অনুপ্রাণন অন্তর্জাল ৫ম সংখ্যায় ১৭টি বিভাগে মোট ৮০টি লেখা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই লেখাগুলো মূলত আমাদের দেশের সাহিত্যজগতের তরুণদের। বিগত প্রায় ১২ বছর যাবত অনুপ্রাণন তরুণদের সাহিত্যচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে এবং তাদের
সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে ক্রমাগত পরিচিত হয়ে উঠছেন কবি রুদ্র সাহাদাৎ। উদীয়মান তরুণ লেখকদের মধ্যে অন্যতম। ধৈর্য ও অনলস শ্রম তাঁকে কবিতার গভীরে প্রবেশে অনুপ্রাণিত করছে। প্রচুর লেখা পড়ি নিয়মিত, জাতীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রিন্ট, লিটল ম্যাগাজিন, অনলাইন পত্রিকাতেও লিখছেন ভালো। ইতোমধ্যেই তাঁর একটি অনুরাগী পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তিনি কবিতা, বুক রিভিউ, প্রবন্ধ, লিখেছেন দুহাতেই, যা মাঝেমধ্যেই দৃষ্টিতে পড়ে। পাঠকপ্রিয় এই কবি নিরীক্ষাধর্মী লেখায় আগ্রহের কারণে বিভিন্ন পরিসরের কবিতা রচনা করছেন। অনুসন্ধিৎসু মানসে তিনি আঙ্গিক ও উপস্থাপন, প্রকরণ ও বিন্যাস, ভাষা ও শব্দচয়নে গড্ডলিকায় গা না ভাসিয়ে নিজস্ব রীতি ও বিন্যাসে নির্মাণের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর প্রায়োগিক সাফল্য কবিতাগুলোকে আলোকিত করেছে, পাঠকের পাঠস্পৃহাকে উজ্জীবিত করেছে। কোনো দুর্বোধ্য শব্দ, ভাষা তিনি উচ্চারণ করেননি তাঁর কবিতায়। সহজ সরল ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ চোখে পড়ে। যা দৃষ্টিনন্দন বটে।
এই প্রাচীন হরিকেল জনপদে/ আমিও এক মুখোশপরা মানুষ ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টাই/ স্বার্ধে দৌড়াই অষ্টপ্রহর/ স্বপ্ন খুঁজি ভালোবাসা খুঁজি বারংবার পেয়ে হারাই/ মানুষ নদীর মতন ছুটে চলে গন্তব্য থেকেও/ মাঝে-মধ্যে দিক হারায়।/ এই প্রাচীন হরিকেল জনপদে আমার পূর্বপুরুষের/ কাল থেকেই মানুষ ছুটছে, আজও/ পৃথিবীর মোহ মায়ার খেলা…। (কবিতা : এই প্রাচীন হরিকেল জনপদে)।
স্বল্প পরিসরে বৃহত্তর বক্তব্য প্রকাশের একটি প্রবণতা তাঁর কবিতায় সমুপস্থিত। এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখতে চাই। বাহুল্য বর্জিত নিরাভরণতায়, সহজ শৈলীতে গভীর ও ব্যাপক জীবনানুভব প্রকাশ সহজসাধ্য নয়। সেই দুরূহ কাজটিই কবি সাগ্রহে সম্পাদনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। তরুণ কবি’র সন্মুখযাত্রায় দীর্ঘ পথ। সাহসী এবং সম্পন্ন পথযাত্রায় ঋদ্ধিমান অব্যাহত পথযাত্রা তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে, সঙ্গত ও যৌক্তিক এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। জোড়া চোখ দেখি শীতের বিকেল/ গোধূলি আকাশ, রঙিন উল্লাস, পিঠা উৎসব/ স্বজনের মায়ামুখ, মিলনমেলা/ মগজের ভিতর শৈশব উঁকি দেয়, স্মৃতির চলচ্চিত্র। (কবিতা : মগজের ভিতর শৈশব উঁকি দেয়)।
অনুভূতির প্রগাঢ় গভীরতা একটি সন্নত শুদ্ধ চেতনায় তাঁকে শাণিত করে। দীপ্র বোধের সমুজ্জ্বলতায় তিনি জীবনের অন্তঃস্থ ও বহিরঙ্গের সকল সুষমা ও শ্রী অবলোকনে ব্রতী হন। সত্য সুন্দরের বোধ তাঁকে আকৃষ্ট করে, পুষ্ট করে, সংরাগে বিভূষিত করে। প্রকৃতিগতভাবে সুন্দর পৃথিবীর বর্ণময়তার সকল সম্ভার যেমন কবি মানসকে শুদ্ধতায় নিবিষ্ট করে, তেমনই যাবতীয় প্রতিকূল, বিনাশী, অসুন্দর, অনন্দের সাথে তার সাংঘর্ষিকতা অবিদিত থাকে না। জীবনের মৌল সুরাঞ্জলি আহরণ প্রয়াসী কবি সব অশুভের দানব প্রাকার গুঁড়িয়ে সত্য সুন্দরের উদ্বোধন ও আবাহনে নিবেদিত থাকুন। যা কিছু বৈরী, যা কিছু অপ্রভ, যা কিছু আনন্দ, তার প্রতিই কবি’র প্রবল অনীহা ও বৈরিতা।
বইটির ফ্ল্যাপ লিখেছেন শ্রদ্ধেয় কবি ও প্রাবন্ধিক হাফিজ রশিদ খান।
রুদ্র সাহাদাৎ কবিতাপাড়ার পরিচিত স্বর, পরিচিত মুখ। নিরলস সাধনায় তার সহজ কবিমন সর্বক্ষণ যেন তাকিয়ে আছে পৃথিবীর প্রতিটি মুহূর্তের দিকে। বর্ণনা করা যায় না, এমন কিছু অপার্থিব সুন্দর তাকে চঞ্চল করে রাখে জীবনের পথে পথে। বেদনা ও কষ্টের মানবিকতা তাঁর সত্তাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে পরিশুদ্ধির উত্তাপে। প্রেমপূর্ণ ও প্রকৃতিমগ্ন এই কবি অন্ধকার ও অন্ধতার সকল দুয়ার ভেঙে আলোয় ভুবন রাঙাতে বদ্ধপরিকর। তাঁর কবিতার শব্দচয়ন ও চলনের গতি সংবেদী পাঠককে সেই বার্তা দিচ্ছে বারবার।
শ্রেণিবিন্যস্ত সমাজের সীমাবদ্ধতা ও কলুষতা তাকে পীড়িত ও ন্যূব্জ করে। কবিতার ব্রহ্মাস্ত্রে তিনি তাই প্রতিবাদী। হতাশা ও পরিব্যাপ্ত অপাপ্তির ক্ষোভ তাকে প্রকৃত সংবেদনের কাছে নতজানু করেছে, যা কখনো বা নিয়তি বা ললাটলিখনের নামান্তর। পৃথিবীর বহু যুগন্ধর কবি শিল্পীই এই নিয়তির তটে তাদের চেতনার রুধিরাক্ত অর্ঘ্য অর্পণ করে গেছেন সজল নয়নে। একালের মানুষও কি তা থেকে মুক্তি পেয়েছে খুব বেশি? কবির একটি উচ্চারণ সেদিক ইঙ্গিত করছে যেন বড় মর্মান্তিকভাবে—
বারবার কেন যে জিততে জিততে হেরে যাই
প্রভু সব জানে, সব দেখে—
চার ছক্কার চক্করে মইহীন পা…
রুদ্র সাহাদাৎ সাচ্চা প্রেমিক ও ভৈরব। কবি ও কবিতার এই কুঞ্জ ও রুদ্রের অভিঘাতেই বেঁচে থাকে নিরন্তর। কবি রুদ্র সাহাদাৎ কাব্যচর্চার নিরন্তর নিবিষ্টতার যে চাষবাস করে চলেছেন, তাঁর আরেকটি উদযাপন হচ্ছে। চেতনায় একাত্তর হৃদয়ে বাংলাদেশ। এখানে নতুন প্রজন্মের চোখে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি রেখাচিত্র পাওয়া যাচ্ছে অনুভূতিদেশের আলো হয়ে। গ্রন্থটি বেশ কিছু কবিতা সমবায়ে সজ্জিত। এখানে স্বাধীনতার মানে মুক্তচিন্তা, মুক্তমন এই ধারণাকে ভিত্তি হিসেবে ধারণ করা হয়েছে—
‘শহিদ মিনার’ কবিতায়— লাল সবুজ পতাকা হাতে দৌড়ায় মুখ/ দেখি হাস্যোজ্জ্বল বালকের দল চৌদিক/ সারি সারি সুশৃঙ্খল পা,/ জোড়া জোড়া অজস্র ভেজাচোখ/ কী যেন খুঁজে বেড়ায়/ হাতে রঙিন ফুলের মালা/ শ্লোগান উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম/ নতুন কথামালা শুনি নতুন সুর…
‘মানুষ’ কবিতার পঙক্তিমালায় শুনি—
মানুষই কবি মানুষই কবিতা
মানুষের এক একটা জীবন এক একটা কবিতা।
কিংবা শুনি—
মানুষ কাঁদলে মনে হয় মানবতা কাঁদে/ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম।
আবার ‘দীর্ঘশ্বাস’ কবিতার দেখি— আমাদের সমসাময়িক জীবনধারা যা বাস্তব। যা জীবনমুখী।
মানুষ হতে গিয়ে অমানুষ হচ্ছি/ আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি/ অমানুষের তালিকায় উচ্চশিক্ষিতরাই বেশি/ দিন দিন জাহিলিয়াতের দিকে ধাবিত হচ্ছি/ দিন দিন শূন্য খাতায় শূন্যতাই কেবল আঁকছি…।
দিকে দিকে বারেবার/ কানে পেতে শুনি জয় বাংলা জয় বাংলা শ্লোগান/ লাল পতাকা তলে বিজয়ের ধ্বনি/ কান পেতে শুনি বাংলাদেশ বাংলাদেশ শ্লোগান/ আবাল বৃদ্ধ বনিতার চোখে মুখে।
আরও একটি বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন এভাবেই—
অরণ্য কিংবা সমুদ্রের ডাকে মানুষ হয়ে ওঠে কবি
চোখে দ্যাখা বাস্তবতায় শিল্পী আঁকেন প্রকৃতি ও মানুষের ছবি।
কবি রুদ্র সাহাদাতের কবিতার পঙক্তিতে স্বদেশপ্রেম যেভাবে পাই— নিজ এলাকার কথাই যেন বলতে চান। গোরকঘাটা হাঁটে কবিমন/ অজানা শঙ্কায় কাঁদে চোখ/ হতাশাগ্রস্ত অসহায় মুখ/ পথভ্রষ্ট ক্লান্ত পথিক ঘুরেফিরে দরিয়ানগর… (কবিতা : পথভ্রষ্ট ক্লান্ত পথিক)।
মৈনাকপর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতিপাঠ করতে গিয়ে কেবলই শুনি/ কান্নার ধ্বনি ভেসে আসে নীরব দীর্ঘশ্বাসে ভারি বাতাস/ নাড়ির বন্ধন কি আর রবে না! পিতৃভূমি হারানোর দুঃস্বপ্ন ঘুমের ঘোরে বারেবারে চমকে ওঠি…
(কবিতা : বিষণ্নতার চাঁদের ঢাকা চৌদিক)।
চাকরিজীবী মানুষ শুক্রবার এলে নিজেকে স্বাধীন মনে করে তারই উদাহরণ পাওয়া যায় কবির কবিতার ভেতরে—
‘শুক্রবার এলে চায়ের কাপে ঝড়/ আড্ডা তপনদার টি স্টল’
কিংবা—
হলুদ জামায় হিমুর হাঁটা দূরের কোনো আলোআঁধারি পথ।
কিছু অণুকাব্য রয়েছে যা বারবার করে পড়েছি। যতবার পড়েছি মুগ্ধ হয়েছি—
০১.
কাল রাতে লিখতে লিখল হাত, মুখ বলেছে যা
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
০২.
শুক্রবার এলে বাবাকে দেখতে যাই— মা’কেও
রাব্বির হামহুমা কামা রব্বাইয়ানীর সাগিরা…
০৩.
ঝিনুক মন নীলজলে ভাসে, কাঁদে পোড়া চোখ
কাঁদে পোড়া মুখ/ শূন্যতায় ঘুরে হাওয়া ঘুরে যৌবন…
০৪.
মানুষের ভিড়ে মানুষেরা মানুষহীন
স্বপ্নরা স্বপ্নহীন বড্ড ক্লান্তজীবন…
০৫.
মুখোশে হাসি মুখোশে কাঁদি
মুখোশের ভিতর আরও মুখোশ
০৬.
ভালোবাসা আজকাল রঙহীন ফ্যাকাশে
ইচ্ছেরা উড়ে যায় দূর বহুদূর আকাশে…
০৭.
ভূপৃষ্ঠের কোনোখানে সুখ বলে কিছু নেই/ দুঃখ বেচে খাই/ কোথাও কেউ সুখে নাই মরীচিকা মায়ার সংসার/ চোরাবালির বালিচরে বেঁধেছি ঘর…
চেতনায় একাত্তর হৃদয়ে বাংলাদেশ বইটি পাঠে সহজ সরল মনের ভাষায় সহজ ভাবে প্রকাশ করেছেন। এত ছন্দ মেনে জীবন যেমন চলে না তেমনি কবিতাও যায় না লেখা। তারই উদাহরণ এই কিতাবখানা। তেমন কোনো দীর্ঘ কবিতা নেই, তবে অল্প কথায় তিনি যেন ব্যাপক বলেছেন যা একটা খতম দিলেই বোঝা যায়। বইটি দেশপ্রেমজাতীয় হলেও প্রকৃতিপ্রেম ও সমসাময়িক বাস্তবতার অনেক লিখা চোখে পড়ে।
রুদ্র সাহাদাতের প্রকাশিত অন্য কাব্যগ্রন্থসমূহ— শঙ্কায় আয়না দেখি না-২০১৮, নৈঃশব্দ্যে সমুদ্র পাঠ-২০১৯. সমুদ্র নিকটবর্তী পানপাতার সংসার-২০২০, স্বপ্নহীন চোখ বসন্ত খোঁজে না-২০২১, কবিমন হাঁটে দরিয়ানগর-২০২১, জীবনের জলছবি আঁকছে জেলেমন-২০২২।
দারুণ একটা প্রচ্ছদ এঁকেছে প্রিয় চিত্রশিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। তবে বুক বাইন্ডিং প্রকাশক মহোদয় চাইলে আরও ভালো করতে পারতেন। কেননা অনুপ্রাণন প্রকাশনের কাজ ভালো হয়। যা অন্যান্য বইপাঠে জেনেছি । কবিতা ও কবিতার বিষয় নির্বাচন চমৎকার। কবির পরবর্তী কাব্য পাঠের জন্য ব্যাকুল পাঠক মন। জয় হোক কবি ও কবিতার।