অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ২৮, ২০২৪
১৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভাস্কর চৌধুরী -
স্বপ্নজাল উপন্যাস সম্পর্কে লেখকের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য

একজন লেখক তাঁর জীবনের সকল অতি গোপন অনুভূতি, চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও বাসনাকে তাঁর উপন্যাসে যত সফলভাবে ঢেলে লেখেন সে উপন্যাস তত জীবন্ত হয়।

আমি আমার লেখা দীর্ঘ ৫২৯ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘স্বপ্নজাল’ যতবার পড়ি ততবার কাঁদি। বোধকরি আমার সমস্ত ইচ্ছা, বাসনা আর অভিজ্ঞতার ঝুড়ি উজাড় করে প্রতিটি চরিত্র সৃষ্টি করেছি, আমি সব চরিত্রকে আপন বানিয়েছি। চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়া, এ এক বিরল অনুভূতি।

লেখকের লেখার সীমানা কতদূর?

উপন্যাস বা গল্পে লেখকের লেখার এলাকা কতদূর? মানুষ লেখার উদ্যেশ্য ঠিক। লেখক মানুষ ও তাদের জীবন নিয়েই লেখেন। আর পাঠকও মানুষ। কিন্তু লেখকের তৈরি যেসব চরিত্র সেগুলোর অস্তিত্ব আছে কি?

এখানেই লেখক স্বাধীন। নিজের মনমতো এলাকা মানুষ ও তার পারিপার্শ্বিকতা তাদের অনুভূতি, সম্পর্ক তৈরি ও নিবিড় বা সামান্য কিন্তু ওই সামান্যটুকুও তিনি সবচে গুরুত্বপূর্ণ। সকল লেখক মনের আড়ালে বিবেক সৃষ্টি করেন। নীতি বা নৈতিকতা এখানে বিবেচ্য নয়। এসবের প্রয়োজনীয়তা আসল। লেখক অনেক সময় চরিত্রগুলোর বসবাসের কাল্পনিক এলাকাও তৈরি করেন। সেখানেই লেখার মঞ্চ। জীবন তরী ভেসে চলে। ডুবে বাঁচে বা মরে।

সে হিসেবে লেখক সৃষ্টিকর্তা ও ধ্বংসকারকের ভূমিকা পালন করে।

স্বপ্নজাল উপন্যাসের কিছু চরিত্র এর অস্তিত্ব সত্য। কিন্তু তাদের ও তাদের সাথে লেখক সৃষ্ট ভূমি, ঘটনা ও সম্পর্ক এক গোলকধাঁধা। যত সামনে যাবেন ততই অবাক হবেন।

লেখকের লেখার মান ও ভাষা ও টার্মলজি নিয়ে কথা বলা যায়। কিন্তু চরিত্র চিত্রন সম্পর্কে প্রশ্ন রাখা যায় না।

আমিও স্বপ্নজাল উপন্যাসের চরিত্র চিত্রন সম্পর্কে জবাব দিতে পারব না।

স্বপ্নজাল উপন্যাসের মূল চরিত্র সুব্রত।

এ উপন্যাসে তিনটি বড় চরিত্র। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ১৯৪৫ সালে কলকাতায় এক ক্লাসে পড়া বন্ধু সুব্রতের বাবা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের পুলিশের প্রধান মন্মথ চৌধুরী। আড়াল ও প্রকাশ্যে তাঁরা সুব্রতকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এর ভেতর মন্মথ চৌধুরী উপন্যাসজুড়ে সুব্রতের বাবার ভূমিকা পালন করেছেন। একেকটা সংকটে তিনজন একত্রে সুব্রতের সামনে চলার পথ তৈরি করে দিয়েছেন। মন্মথ চৌধুরী ছিলেন মূলত পুরো উপন্যাসের কার্যকরী নির্দেশক। সুব্রতের আশ্রয় ও ভালোবাসার মানুষ কলকাতার ‘দাদু’। এই বৃদ্ধের ভালোবাসা আশ্রয়ে সুব্রত সব কাজ করেছে।

এই উপন্যাসের মূলত মূল চরিত্র বিবেক। নৈতিকতা নয় অনৈতিকতাও নয়, প্রয়োজনে সুব্রতের বিবেক সব সময় মানবকল্যাণে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে। তার কথায়, টাকা নিজের জন্যে নয়। খরচের জন্যে। সব টাকা ট্রাস্টকে দান করে নিজস্ব থেকেছে।

আরেক নিয়ন্ত্রক চরিত্র সুমনা। সুমনার স্বামী সুজিত সুব্রতের জীবনে দর্শনের শিক্ষক হয়ে এক ফাঁকে সুব্রতের জীবনে মূল দর্শন শিক্ষা দিয়ে গেছেন। ‘নতুনের ভেতর কিছু নেই রে। পুরাতন জিনিসে সব লুকিয়ে আছে।’ সুব্রত সেই পুরনোর মাঝেই মূলত পেয়েছিল জীবনের সকল অর্জন।

দাদুটাও পুরনো মানুষ।

সুমনা-সুব্রত জোড়া আমার মতে সবচে রহস্যময় জীবনজুটি। আমি যখন এ কথা পড়ি যে, সুমনার অকার্যকর লিভারের চিকিৎসায় সুব্রত তার নিজের লিভারের অংশ দান করে বাঁচিয়ে তুলেছিল তখন আমি নিজে কেঁদে ফেলি।

আরেক প্রেমিকা ও স্ত্রী রোমান-জার্মান নারী সমবয়সী লিসা। এ প্রেম ছিল সকল প্রেমের ঊর্ধ্বে, স্বার্থহীন। তারা থাইল্যান্ডে দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর প্রেমে ভরা সংসার করেছিল।

আরেক রহস্য ছিল সুব্রতের একান্ত আদরের স্ত্রী সৌদি বেদুইন নারী মুনতাসা। মুনতাসা খুব কম বয়েসী নারী। জেদ্দা থেকে মদিনার পথে পুরো এলাকার বেদুইন সমাজের সাথে সুব্রতের সম্পর্কের মূলে ছিল তাদের দিয়ে ও সংসার। স্বার্থ ছিল। কিন্তু সুব্রত মুনতাসার পেটে বাচ্চা আসার পর ১৩৫টি বেদুইন গ্রামে ডাক্তার ও নার্সসহ মাতৃসদন বানিয়ে দিয়েছিল।

সৌদি আরবে পা রাখার পর বেদুইন সমাজে ঢোকার পথ হিসেবে সুব্রত শেইখের মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত উম্মে হাসিনাকে বিয়ে করে সৌদি আরবের বিশাল ব্যবসার আশ্রয় পেয়েছিল। এদুটি বিয়ে স্বার্থের জন্য হলেও তাদের কম ভালোবাসেনি।

কিন্তু ভারতে ঢোকার পর সতেরো বছর বয়সে যে অর ‘অন্ধটিকে বিয়ে করেছিল নিছক আশ্রয়ের জন্যে অনেক ভাঙাগড়ার পরে উপন্যাসের শেষ দৃশ্য ছিল ভালোবেসেও বাঁচাতে না পারা অন্ধটির চিতা।

এসব নারীর ভেতর থেকেই পাঠককে সুব্রতের জীবনের ভালোবাসার মূল খুঁজে নিতে হবে।

লেখকের ভেতরের কথা।

স্বপ্নজাল উপন্যাস উত্তম পুরুষে লেখা। নায়ক সুব্রত মানে আমি আর আমি। উত্তম পুরুষে লেখা কঠিন ও বিপদজনক। পাঠক ভাবতে পারেন এটি লেখকের জীবনকাহিনী। বাস্তবে কিন্তু সেটি ঘটে না। তবে অসাবধানে লেখকের জীবনের কিছু কথা চলে আসে। যেমন কলেজ জীবনে ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে লেখকের বাবা, মন্মথ চৌধুরী বন্ধুর মতোই ছিলেন।

কিন্তু মন্মথ চৌধুরী কি সৌদি আরবে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন? তিনিই কি বাদশাহ ফাহাদের সাথে সুব্রতর ঘনিষ্ঠতা তৈরি ও বাড়িয়ে সুব্রতের কর্ম পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন?

এমন প্রশ্ন আসলে লেখকের কিছুই বলার থাকে না। গল্প নিজেই প্রয়োজনে সুব্রতকে বাদশার অন্দরমহলে হীরার জুয়েলারি ব্যবসা ঢুকিয়ে দিয়েছিল। কফি বাগান তৈরি ও কবি কোম্পানি তৈরির জন্য ইথিওপিয়া পাঠিয়েছিল। বড় উপন্যাস চলতে চলতে শত বা হাজার চরিত্র ও ঘটনা সৃষ্টি করে। লেখক যত নিপুণভাবে ঘটনা ও চরিত্র চিত্রণ করেন, ততই সফল হন।

সুব্রত চরিত্র সৃষ্টির পরেই লেখক ক্রমশ ঘটনা, স্থান, চরিত্র আর তার কর্মের ব্যাপ্তি আপন অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, ভ্রমণ ও বোধের ব্যাকরণ মেনে সৃষ্টি হয়ে গেছে। এখানে বাংলাদেশের রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধশিশু সমস্যা, সুব্রতকে ভারতীয় ইডেন্টিটি দান, কর্মভূমি, প্রবাসী ভারতীয় ব্রিটিশ ও আমেরিকান কমিউনিটির সাথে যৌথ উন্নয়নে যোগ দেওয়া, তার ট্রাস্টের অংশীদার, ভারতীয় সফল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতায় আসার নেপথ্যে কাহিনী ও সাক্ষাৎকার ঘটেছে।

গ্রাম সৃষ্টি, গ্রামীণ স্যানিটেশন তৈরি থেকে আরম্ভ করে সুব্রত ট্রাস্টের অধীনে চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সৃষ্টি হয়েছে।

এসব করতে গিয়ে আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর সাথে সুব্রতকে জড়াতে হয়েছে। কিন্তু লেখক খুব সাবধানতার সাথে অহেতুক কোনো বিতর্কিত কাজে সুব্রতকে জড়িয়ে যেতে দেননি।

সুব্রতকে দিয়ে লেখক বাংলাদেশের চিকিৎসক, গার্মেন্টস ও শেয়ারবাজার সিন্ডিকেটের মুখোশ খুলে দিয়েছেন।

সুব্রতকে পুরো সৌদি সাহায্য নিয়ে উত্তরায় বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল তৈরি করতে গিয়ে শেখ হাসিনার সানিধ্য এনে দিয়েছেন।

সব মিলে উপন্যাসটি সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক, নৈতিক ও নেতৃত্বের অবস্থাটি তুলে ধরেছেন।

 

Read Previous

দাঁড়ানো

Read Next

চন্দনকৃষ্ণ পাল – গুচ্ছকবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *