অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এলিজা খাতুন -
এলিজা খাতুনের গুচ্ছ কবিতা

আশ্বিনের শেষবেলায়

দিনরাত আয়ু খসে পড়া ঘর
ছিঁচকাঁদুনে বর্ষার জ্বালাতন সইতে সইতে
অভাবের ছাউনি তলে অভাব এসে দাঁড়ায়
যাবতীয় আহ্লাদ গা ঢাকা দেয়
আশ্বিনের পড়ন্ত বেলায়

চুল-দাড়ি ছাঁটা বকেয়া মজুরি আদায়ে নাপিত লক্ষ্ণা
তার বউকে পাঠায় ধানের খবর নিতে
নাড়িকাটা দায়- মা আসে
এক পোয়া আলো চালের আশায়
বেদেনিরা ভোলে না নবান্নের কথা
এই পথে যেতে যেতে একবার উঁকি দেয় উঠোনে
সাপ ধরে নিয়ে গেলে ওদের ঝাঁপিতে
কিছু ধানও দিতে হয় তো!

আর তো কয়েকটা দিন!
আশায় গিঁট পড়ে শক্তপোক্ত
কার্তিকেও থাকে যে বড় অনটন!

খোরাকহীন গোলা, শূন্য কুলা, ঘুণ ধরা ঢেঁকিঘরে
অভাব আরো মুখরিত
যেন নাকে এসে লাগছে-
আর-বচ্ছরকার তুষ-আগুনে পাতিলে সেদ্ধ ধানের ভাঁপ
কী করে লুকোবো সে স্মৃতিঘ্রাণ থেকে!

আশ্বিনের এ বেলায় উদরে ক্ষুধার ঘোর-উৎসব
পাঁজরে অঘ্রাণের অপেক্ষা!
ঘরের ভিতে অন্ধকার গর্তে ধ্যানমগ্ন সাপেরাও
জপ করে অঘ্রাণ

কার্পাসের সাদা হাসি ভালোবেসে
যাবতীয় যান্ত্রিকতা দূরে ঠেলে একদিন
কার্পাস পাতার শান্ত সবুজে লীন হতে চেয়েছিলাম
হেমন্ত মাঠের বুকে শেষ বিকেলের নরম রোদে
আমার শীতার্ত ক্ষেত আর দুরন্ত ফড়িং ছিল
পৌষের ভোরে শিশির সিক্ত তুলোর হাসি ভালোবেসে
কার্পাসের ফাটা ঠোঁটে হাত বুলিয়েছি কত!
তখনও ছিল প্রজাপতির নিমগ্নতা
কাচপোকাদের এলোপাথারি ওড়াউড়ি
তখনও ছিল বাতাসের প্রবল প্রবাহ
তারপর কতদিন হতভম্বের মতো দেখেছি
অশুভ বাতাসে কার্পাসের সাদা হাসি
কেমন উড়ে উড়ে যায়!
সেই থেকে শীতকালীন বাতাসকে বেহুদা বলি আমি
তুলোক্ষেত বেড়ে ওঠার মতো
আমার এখনও হেমন্ত আছে
অথচ তুলোর সাদা রঙ
আমার ভীষণ সাদামাটা মনে নিরবধি বিরাজ করেও
নীরবে ম্লান হয়ে গেলো
আমার ক্ষেত আছে
মাটি আছে
মন আছে
শুধু কার্পাস তুলো নেই আর

চায়ের চুমুকে রোজনামচা
যানজট; চায়ের দোকানে বসে প্রতিদিন দেখি
ভাদ্রের গুমোট তাপদাহে
দ্রুতবেগে হেঁটে চলে নিরলস পিঁপড়ের দল
টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ওরা ফ্যাক্টরিমুখো পিচপথে
দুরন্ত চলা জীর্ণশীর্ণ কর্মীর হাড়ে লোহার আওয়াজ
চাকার ঘূর্ণন, মুঠোভর্তি শব্দ মাতম
ওদের সরল রোদের সোনালি ভোর
বহুযুগ আগে খুলে নিয়ে গেছে নীল নখর
রোজ রোজ দেখি
ঘাম-লেপ্টানো মুখগুলো যেন
ফুটন্ত চায়ে ফুঁসে ওঠা কালো কেতলি
সংবাদ ফ্রেম আর ক্লোজশট পিছু ছাড়ে না ওদের

সুদীর্ঘ যাত্রা
বৃক্ষছায়ায় রোদের বসবাস!
নাকি রোদের পিঠে চড়ে বসেছে বৃক্ষ কাঠামো!
নিসর্গের এই সকল দৃশ্যপট থেকে
বেরিয়ে আসতে না আসতেই
সম্মুখে হাজির হয়ে গেলো কিছু রক্তাক্ত চিত্র

অযুত অযুত মাইল অগণিত কৃষকের বহর
মাটির গভীরে নিরুপায় উর্বরতা
কংক্রিট গাঁথুনির খাঁজে বোবা যাপনচিত্র
নক্ষত্র-রাজ্যে আটকে গেছে স্বাপ্নিক মুখাবয়ব

এইসব চালচিত্র ভাবনার গাছে তুলে শাখা-পাতায়
দক্ষিণ বাতাস আরাধনা করে কী এমন সুরাহা মেলে!

অতঃপর নিশ্চুপ ষড়যন্ত্রের মতো যাদের নরম কণ্ঠস্বর
আর কাদা নিয়ে শৈল্পিক ছোড়াছুড়ি কাজে-
যে সমস্ত হাত পারদর্শিতায় পেলবপুষ্ট
তাদের চকচকে খ্যাতি ম্লান হবার পূর্বেই
সুদীর্ঘ যাত্রার মতো এক ন্যায্য প্রতিবেদন হওয়া
কম জরুরি নয়! তবে প্রার্থনা এই যে-

অরণ্যঘেরা মধ্যরাতের খসড়া পৃষ্ঠাগুলো যেন
মানবিক বিপর্যয়ের বধ্যভূমি না হয়ে ওঠে!

চাবি এবং চাষ
সাবানের গায়ে ছাপ বসিয়ে আমার কিছু চাবির
হুবহু প্রতিকৃতি উদ্ভাবন করতে গেছে কেউ কেউ

পূর্বে বহুবার তারা পাড়াগাঁয়ের মানুষের মতো
পোশাক পরার প্রশিক্ষণ-আয়োজন করেছে
সেসব চুকিয়ে এখন পূর্ণোদ্যমে তাদের
আত্মসাৎকৃত অন্তর্লীন ডিপোজিটের সদ্ব্যবহার করছে

তারা বিকলাঙ্গ চোখে গোপনে সৃষ্ট চাবি এনে
খুলতে চেয়েছে আমার সমূহ সিন্দুক
উদগ্রীব হয়ে কল্পিত কাগজের নোট ও ধাতব অলঙ্কার
খুঁজতে গিয়ে চার-দেয়ালের ভেতর দাঁড়িয়েই তারা
জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে-
অবারিত দিগন্ত মাঝে শস্যে সঞ্চারিত আমুন্ড-আমাকে

আমার উন্মুক্ত সিন্দুকে মুকুলিত অরণ্য, মেঘের বিচরণ
বালুময় তীর, চাঁদমাখা মাঠ, বাঁশবনের বিনম্র উচ্চতা
এসব দেখে ওরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে-
নিয়মতান্ত্রিক কোনো চাবিগুচ্ছে খোলা যায় না এ সিন্দুক

আকাশের নিচে দাঁড়াতে গেলে যে চাবি দরকার
একথা শুনে ইতোমধ্যে ওরা নতুন করে বিশেষ ধরনের
চাবি তৈরির প্রজেক্ট হাতে নিতে থাকে

আর একাগ্র চাষির মতো আমি সবুজ চাষ করতে করতে
একসময় দেখি- আমারই অজান্তে প্রত্যুষের কোমল-
সুঘ্রাণময় রোদের চাষ হয়ে চলেছে আপনা-আপনি

কাল্পনিক
রঙিন জলে উদরপূর্তি করে মঞ্চে নাচন-কুদনরত
প্রাণিগুলোর নিজস্ব আস্তানায় ফেরার ভঙ্গি
কল্পনা করতে করতে চোখের সামনে ভেসে উঠলো
খাদ্য না পাওয়া মধ্যরাতের তেলাপোকাদের
শ্লথ পায়ে হাঁটার দৃশ্য
আফসোস হচ্ছে
অভুক্ত তেলাপোকার বদলে
ছাল-চামড়া উঠে যাওয়া তৈলাক্ত সারমেয় দৃশ্য
কেন এলো না কল্পনায়?
নিরুপায় মনকে প্রবোধ দিতে হলো
কল্পনা বা স্বপ্নে কারো কোনো হাত নেই!
—————————————– ০০ ——————————————-

+ posts

Read Previous

দ্বীপ সরকারের একগুচ্ছ কবিতা

Read Next

ক্ষমা মাহমুদ-এর গুচ্ছ কবিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *