অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৪, ২০২৪
২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৪, ২০২৪
২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাহীন খন্দকার -
শাহীন খন্দকার – গুচ্ছকবিতা

রোডম্যাপ

বধুর ওষ্ঠের মতো লোভ নিয়ে সূর্যাস্তে আছি

আমি জানি, এভাবেই প্রতীক্ষা করতে হয় …

সভ্যতাকে সভ্য পোশাকে চিনব বলে

বাজার থেকে কিনে আনি প্রথম সূর্যের মতো জামদানি সুতো

পাইজাম চালের মতো ফুরফুরে সুঁচে সেলাই চলুক …

একটা পোশাক তৈরি হবে মানবিক!

যার হাত হবে খোরাসানের… সেলাই চলুক।

গলা হবে নাজাফের… সেলাই চলুক।

সিনা হবে রামাল্লার… সেলাই চলুক।

আমি এ পোশাক পরেই হব জাতিসংঘের মহাসচিব।

তারপর আমি হেঁটে যাব সাবসাহারার দুই লক্ষ কুড়ি হাজার নরকঙ্কাল পায়ে মাড়িয়ে; দেবদূতের মতো আমার হাতে থাকবে লোভনীয় রুটির গন্ধ। মেঘের দঙ্গল থাকবে চোখের মোড়কে। তারপর— আমি হেঁটে যাব মায়ের মুখের মতো রূপকথা নিয়ে আল-আকসার মহাবিহ্বল প্রান্তরে। সেখানে প্রণয়ের গজল রোপন করে সিত্তুই আর কিরকুকের মহাহিংসা আমি মুখস্থ করতে থাকব। আমি মুখস্থ করতে থাকব আমার পিতার হিস্যার দলিল। সবুজ জরায়ুর আয়ুগুলো, বিপর্যস্ত রক্ত-মাংসের ভূমিগুলো আমি মুখস্থ করতে থাকবো। আমি মুখস্থ করতে থাকব নিপীড়িত আগুনের বিদ্যা। তারপর…

একটা পোশাক তৈরি হবে আণবিক।

যার হাত হবে হোয়াইট হাউসের… সেলাই চলুক।

গলা হবে ব্রিটেনের… সেলাই চলুক।

সিনা হবে তেলআবিবের… সেলাই চলুক।

আমি সে পোশাক না পরেই হব পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৈনিক।

জেনে রেখো আজীবন বিক্ষুব্ধ কবিই একদিন ট্রিগার টেনে দেবে।

চোর কিংবা তোর শরীরে লুকিয়ে রাখা উষ্ণতা খেয়ে বেড়ে ওঠা ভয়

সারাটা শহর উষ্ণতা খুঁজে খুঁজে ফিরে গেছে সংঘের চাকুরে।

শহরের কোত্থাও আর এতটুকু উষ্ণতা নেই।

আগুন নেই।

রোদ নেই।

রেডওয়াইনের গ্লাসে করে রোদের অবশেষটুকু নিয়ে গেছে আমেরিকান জাহাজ।

হোয়াইট হাউস উষ্ণ হবে। তারপর আবার ব্রুম ব্রুম…

আমি প্রচণ্ড শীতার্ত বাঁকা হেসে তোকে স্পর্শ করি…

তোর বন্দরেও কোন জাহাজ এসেছিল চুপি চুপি কাল রাতে!

বার্ন ইউনিট

পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলে একদিন এই লাশগুলো হবে

একটি সমাবেশ। নিহত ব্যথা নিয়েই একদিন ঘুমুতে যাবে

মা, স্ত্রী-পরিজন।

চোখের অজুহাতে একদিন বাঙালি লজ্জা বানাবে।

একদিন এইসব ক্ষতগুলো থেকে জন্ম নেবে গণতন্ত্র।

সংবিধান একদিন মানুষ হবে।

পাথরবন্দনা

পেস্তা, আপনার শোকে আপনি তো যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে কাঁদান পাথর।

কিন্তু পাথর-রানি আপনি কি জানেন, আপনার হুইল চেয়ারটাকে কবি কতটা ভালোবাসে?

বহুবিধ শূন্যতা ঘিরে চারদিক রেখে শোকের আলো, নাগরিক বিচ্ছিন্নতা

নিয়ে পরিত্যক্ত জ্যোৎস্না হয়েছো। যমুনার জলে কলোজল খেলাগুলো

কী নিষ্ঠুরের মতো তোমার দীর্ঘশ্বাস হোলে, যন্ত্রণার নগরে ফুলেরা সুবাসহীন।

বিষাদ উনুনে তোমার সুখগুলো সখী পুড়িয়ে পুড়িয়ে পৃথিবীর সব শোক

শরীরে মাখো। আর সঙ্গমের তাড়াগুলো ধ্বংসের সংগীত শেষে

মৃত্যুশোকের মতো পাথর-বন্দনায় পাথরের আত্মা হোলে সখী…

আর আমি ? কবিতা লেখার জন্য ক-ত হেঁটেছি…

ফসলের কীর্তন দেখেছি সেইসব হাঁটাহাঁটির দিনে; ফসলের লুট হয়ে

যাওয়াও। পথে পথে রক্তের প্রণয় দেখেছি আর মৃতদের স্বজনের

ক্রন্দনও। যমুনার জলে কিশোরীর উচ্ছল সিনান দেখেছি আবার যমুনায়

যুবতীর আত্মহননও। ডাস্টবিনে টোকাইয়ের কী করুণ উৎসব খেলা,

বঞ্চিতের ফুটপাথ, পথঘাট; বাড়িঘর হওয়াও। আর শ্বেত শেয়ালের

কাছে আমাদের অর্ধেক আয়ু বিক্রয় হয়ে যাওয়াও দেখেছি হাঁটার সঙ্গীতে…

যান্ত্রিক ব্যস্ততার এই যে এইসব এই ভয়াবহ দুর্গন্ধে পাথর-রানি আর নাইবা হাঁটলে

হুইল চেয়ারটা খুব বোঝা হলে যুবতী-পাথর তুমিই আমার কবিতা হও

আর হুইল চেয়ারটা ইতিহাস…

তোমার ভ্রান্তিগুলো ভেঙে ভেঙে সহানুভূতির সংজ্ঞা

যদি বোঝাতে পারতাম হায়! কবিদের ভালোবাসা করুণা নয়।

কনফেসন

মানুষ দুঃখ পেলে জ্যোৎস্না হতে চায়

মানুষ সুখ পেলে জ্যোৎস্না হতে চায়

মানুষের জ্যোৎস্নাগুলো কখনো মানুষ হতে চায় না

মানুষ এতটাই অন্ধকার…

স্বপ্ন ও সমকাল বৃত্তান্ত

স্বপ্নমহাশয়ের আঙুল ধরে একদা ঘুমদেশ ভ্রমণে এলে মুসাফির শহর— প্রধান ফটকে সাতটি স্বর্গ সারিবদ্ধ অপেক্ষমান। শিবের ছলাকলা চেনেন না শহরের সুমহান পুংস্তাদি, যেমন যুবতীর অমায়িক তলপেট বোঝেন না বেওয়ারিশ। সুনিয়ামত আব্রুরা কেমন নিশ্চিন্তে শুকোন মায়েদের, বোনদের। নূর-উজ্জ্বল পোশাকে পুরুষের দাড়িগুলোয় দৈনিক পাঁচবার গোসল সারেন পরমাত্মীয় ওযু-জল। কী আশ্চর্য স্বর্গরা চোখের সামনেই সাতটি ফুটফুটে শিশু হলো। আমি ফেরদৌস ওয়াহিদকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘খোকা আমার সাথে যাবি?’ ঘুমেরা রাজি হতেই— রাজাবৃন্দকে ভাঁজ করে সিন্দুকে তুলে রাখলেন মূর্খ বিবেক।

সুস্বাদু আহারে আছেন তারা। এখন স্বর্গরা তাদের আহার্য।

একটা নতুন মানচিত্র হবে দুগ্ধবতী গাভীর বিপরীত

হাড়ের দৌরাত্ম্যে মা শান্তির লবণ হারিয়েছেন— দুর্ভিক্ষের হাট। ত্রাণ নিয়ে এবার বেরিয়ে পড়ব। যে হাড়গুলো শুয়ে আছে মা’র কোলে তাকে বোন বানাতে মরুর কৌশলপত্রে স্বাক্ষর করি। এবার ত্রান নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। দুধের সংকটে ঘুমাও ক্ষুধার চোয়াল নিয়ে ছোট্টবোন সাবসাহারা। দুধের নগর নিয়েই আমরা বেরিয়ে পড়ি…

নাসপাতি চুম্বন তাড়া করে তাকে বিস্তীর্ণ জলের সান্নিধ্য। তার জন্য জলের ভাতার নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ব। রুটির বাজার বসিয়ে বিনিময় হবে দাসত্বের তিলক। আর এখন প্রার্থনা ও দয়ায় হাড় ও অস্থিগুলো অসুস্থ পরস্পর। আমরা উপযুক্ত দাওয়ায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। সাবসাহারা গিলে খাক দুর্ভিক্ষের হাট। আর মানবিক কাঁচুলি খুলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি…

(এখানে ভাঙা মাস্তুল, কীভাবে প্রাণময় করি আশার সাঁতার—

কেবল ডোবে, ভাসে আহা সনাতন সাবসাহারা।)

আমাদের ত্রাণ কোনোদিন পৌঁছে না

জলের সান্নিধ্য, দাওয়ায় কোনোদিন পৌঁছে না

আমাদের অশ্রু কোনোদিন পৌঁছে না

তবু পরমায়ু পেয়েছে বোন। হাড় গুনে গুনে সযত্নে রাখি তার রুটির বিকার সভ্যতার ব্রেকফাস্টে…

তুইকাহিনী, ওপাড়া ও অন্যান্য অভিমান

আব্দুলাপুর রোডে দাঁড়ানো যুবকটি তোকে কিছু বলতে চেয়েছিল…

তার আয়ত চোখ পৌঁছে গিয়েছিল টঙ্গী কলেজ পেরিয়ে, অদূরে…

তোকে কিছু বলেছিল সেই চোখ।

কিছু বলতে চেয়েছিল তোকে কবিতার ছলে

এড়িয়ে যেতে যেতে কৌশলে

তোর ঠোঁট হয়েছিল জলবিন্দু।

এড়িয়ে যেতে যেতে কৌশলে

তোর ঠোঁট দিয়েছিল যন্ত্রণা।

এড়িয়ে যেতে যেতেই কৌশলে

তোর ঠোঁট ডেকেছিল মৃত্যু।

এড়িয়ে যেতে যেতে এভাবেই

যুবকের বুকে তুই দিয়েছিলি ক্ষত

ওপাড়ায় আজ তাই যুবক প্রয়াত।

মধ্যবিত্ত

একটিমাত্র চুমুর শেষপ্রান্তে ঝুলে গেছে পুরো সংসদ ভবন।

কাউকে বলতে না পারা সেই ঠোঁটের নাম এবং আমি

মুখোমুখি বসি; এই মানচিত্রে…

 

কী ভীষণ যন্ত্রণাকাতর এই সবুজ!

এবং এই মুদ্রাস্ফীতির সময়ে আমার আয়ের মতো লাল রং থেকে

ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরছিল…

 

আমি সারাজীবন চোখ মুছে দেয়া জনগণ।

তোমাকে ছোঁয়া হলো না; প্রিয় প্রজাতন্ত্র!

 

Read Previous

ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি 

Read Next

লর্ড ডানসানি’র সাতটি উপকথা

২ Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *