‘স্টুডিও গ্র্যান্ড লুক’-এর সামনে আসতেই মালিকের কর্কশ কণ্ঠস্বর আর জনতার ভিড় দেখে থমকে দাঁড়াতেই হয় শামসুর রহমানকে। যদিও এই মুহূর্তে সে ভীষণ ব্যস্ত, তারপরও ভিড়ের মধ্যে মাথা গলিয়ে জাস্ট একনজর দেখেই এগিয়ে যাবে নিজের কাজে- এই ভেবে সে ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখনই তার সাথে চোখাচোখি হয় ভিড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে কাচুমাচু বসা বিনয়ব্রতর সাথে। শামসুর রহমানের নিজের চোখ দু’টো বিশ্বাস হয় না- যে মানুষটি পরিবারের কাছ থেকেও পালিয়ে বেড়ায় একা থাকার জন্য, তাকে ঘিরে এতবড় জটলা আর এতসব উচ্চবাচ্য! শামসুর রহমানকে দেখে চোখ দু’টো জ্বলে ওঠে বিনয়ব্রতর। হা করে শ্বাস নেবার ভঙ্গিতে কিছু বলতে যায়, কিন্তু গলা থেকে কোনো স্বর বের হয় না। বার দুই চেষ্টা করার পর মাথাটা নিচে দিয়ে চুপ করে থাকে।
শামসুর রহমান কিছু একটা আন্দাজ করে নেয়। স্টুডিও মালিককে বজ্রগম্ভীর স্বরে ধমকে বলেন- একজন ভদ্রলোকের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় পরিবারের কাছ থেকে সে শিক্ষা পাওনি? নাও ওকে ভিতরে নিয়ে বসাও।
তারপর রবাহুত জনতাকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনাদের কি খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই? দাঁড়িয়ে মজা দেখছেন? যে যার কাজে চলে যান। আমার বন্ধুর ব্যাপারটা আমিই দেখছি।
শামসুর রহমান শহরের ডাকসাইটে উকিল। শহরের ছেলে-বুড়ো একনামে তাকে চেনে না এমন মানুষ নেই। তার কথা অমান্য করে সাধ্য কার! মুহূর্তেই ভিড় মিলিয়ে যায়। স্টুডিও মালিক উকিল সাহেবকে দেখে মিইয়ে যায়। এতক্ষণ জনতার ভিড়ে চুপ করে থাকা প্রতিপক্ষের সামনে তর্জন-গর্জন করে বেশ একটা হিরো হিরো ভাব জেগেছিল। সে জবাবদিহির সুরে বলে- দেখুন উকিল সাহেব, এই শহরে স্টুডিও গ্র্যান্ডলুকের একটা সুনাম আছে। দুই যুগের বেশি সময় ধরে একটু একটু করে এটা অর্জন করেছি। কিন্তু এই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন- প্রায় বছরখানেক ধরে আমার ইমেজ, আমার ইগোয় আঘাত করে চলছেন। আমার ছবিতে নাকি পারফেক্ট লুক আসে না, ছবি বিষণ্ন-মলিন দেখতে লাগে। প্রথমদিকে কথাগুলো শোনার পরে ওর ছবি আমি নিজে প্রিন্ট করেছি। একাধিকবার স্ন্যাপ নিয়ে ফটোশপে এডিট করে যতটুকু ন্যাচারাল সুন্দর করা যায়, আমি চেষ্টায় ত্রুটি করিনি। কিন্তু তিনি এসে ফটোগ্রাফের মূল্যশোধ করে বলেছেন- এ ছবিটা মনে হয় যেন আতঙ্কিত কোনো লোকের হবে। আমি এটা নিতে পারছি না। আপনি আবার তুলুন।
অনেক দিন প্রায় একই রকমের নেতিবাচক কথা শুনে শুনে আজ আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারিনি। এই দেখুন, এতদিন ধরে ওর একগাদা ছবি জমে আছে। গত সপ্তাহে তোলা এই যে শেষ ফটোগ্রাফটা আজ নিতে এসে আমাকে বলেন- ফটো তোলায় তোমার স্টুডিওর সুনাম আছে বলে এতদিন ধরে একটা ভালো ছবির চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু আজকের ছবিটা একদম ক্রীতদাসের চেহারার মতো হয়েছে। আমি কি দেখতে সত্যিই এরকম? তোমার কাছে আর ছবি তুলতে আসব না।
কথাটা শুনে আমার আত্মবিশ্বাসে ভীষণ রকম ধাক্কা লেগেছে। একটা ছবি যতটুকু সুন্দর করা যায় আমি চেষ্টা করি। এজন্য একাডেমিক শিক্ষা নিয়েছি। তারপর একাগ্রতার সাথে নিজের সবটুকু সৌন্দর্যচেতনা ঢেলে দিয়ে এক একটা ফটোগ্রাফ প্রিন্ট করি। গ্রাহক এসে যদি সেই ফটোগ্রাফের নিন্দা করে, তখন অসহায় বোধ হয় না?
সত্যিই তো! স্টুডিও মালিকের কথা অযৌক্তিক তো কিছু নয়! অনেকগুলো ফটোগ্রাফ জমা হয়েছে, যার কিছু কিছু বিবর্ণ হয়ে গেছে। শামসুর রহমান জিজ্ঞেস করেন- সব ছবির মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে?
-হ্যাঁ। ইনি ছবি নিতে এসে প্রতিবার মূল্য শোধ করে গেছেন। কিন্তু কোনো একটা অজুহাতে ছবিগুলো নেননি।
-ঠিক আছে। সব প্যাকেট করে দাও। আমি নিয়ে যাচ্ছি। কিছু টাকা স্টুডিও মালিকের হাতে জোর করে গুঁজে দিয়ে বলেন- কিছু মনে করো না যেন। এটা তোমার ভালো কাজের পুরস্কার। তারপর বিনয়ব্রতকে নিয়ে রাস্তায় নামেন।
কলেজে সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে বিনয়ব্রত আর শামসুর রহমানের পরিচয়। বাংলার অধ্যাপক ফজলুল হক স্যারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিল বিনয়ব্রত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাহিত্য বিষয়ে চমৎকার আলোচনা করত। শামসুদ্দীন তখন ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক। কি খেয়াল হলো, একদিন একটা প্রেমের কবিতা লিখে বিনয়ব্রতর কাছে হাজির। কবিতাটা পত্রিকায় ছাপাতে হবে। বার দুই পড়ে বিনয়ব্রত বলে- এটা এখন পর্যন্ত কবিতা হয়ে ওঠেনি। তবে একটা আইডিয়া আছে। চেষ্টা করলে কবিতা বানানো যায়। বাড়ি গিয়ে বসে যাও, এক সপ্তাহ পরে নিয়ে এসো। আর একটা কথা, কাউকে ইমপ্রেস করার জন্য কবিতা লিখো না, নিজের আনন্দের জন্য লিখবে।
ছাত্রনেতা শামসুদ্দীন ক্ষুব্ধ, বিরক্ত আর কিছুটা হতাশ মনে কবিতাটা নিয়ে ফিরে যায়। ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদকের কথা তুচ্ছজ্ঞান করে এমন স্পর্ধা! ছাত্রনেতা হিসেবে তার ইগোতে খুব লাগে। তবু সে অধ্যবসায় সহকারে কবিতাটা নিয়ে বসে। এক সপ্তাহ পর যখন বিনয়ব্রতর কাছে যায় কবিতাটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলে, আজ থেকে তোমার নাম শামসুর রহমান। কি একটা নাম বয়ে বেড়াচ্ছ! এই বিখ্যাত কবির নামটি ধারণ করলে দেখবে তুমিও একদিন বড় কবি হয়ে উঠতে পারবে। তোমার মধ্যে সম্ভাবনা আছে। দেখো না আমি কবি বিনয় মজুমদারের নামানুসারে বিনয়ব্রত নাম রেখেছি! তুমি ওসব রাজনীতি-ফিতি ছাড়। এখন থেকে কবিতা লিখতে লেগে যাও। দেখবে ওসব হৈ-হুল্লোড়ের চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পাবে।
-তুমি বরং রাজনীতিতে নেমে পড়। তাহলে আমরা একজন সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ পাব, যেমন লেনিন পেয়েছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কিকে।
-কবি-সাহিত্যিকরা রাজনীতি না করলেও কম-বেশি রাজনীতি সচেতন। আমিও তা থেকে বাদ যাই না। কিন্তু তুমি শুধু রাজনীতিটাই যা একটু বোঝ। সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো ধারণা নেই। শুধু তুমি কেন, আমাদের দেশের সিংহভাগ রাজনীতিবিদদের সেটা নেই।
সেদিন থেকে বলতে গেলে প্রায় বিপরীত প্রান্তের দুটি বিষয়- রাজনীতি আর সাহিত্যে বিচরণকারী দু’জন যুবকের বন্ধুত্ব অটুট হয়ে ওঠে। কলেজ ক্যাম্পাসে তারা একটা সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। তারপর একদিন শামসুর রহমান আইন ব্যবসা আর বিনয়ব্রত শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়ে। শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা চললেও শামসুর রহমান ফৌজদারি আইন নিয়ে লেগে থাকে। শহরের গুন্ডা-মাস্তান, ভূমিদস্যু, ব্যবসায়ী সকলের ত্রাণকর্তা হয়ে ওঠে। জীবনে আর কোনোদিন কবিতার একটা লাইনও মাথায় আসেনি। কিন্তু ওকালতি পেশায় এসে অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল।
হাঁটতে হাঁটতে শামসুর রহমান জিজ্ঞেস করে- তোমার কি হয়েছে? এই বয়সে এত ঘন ঘন ফটো তুলছো কেন ভাই? অভিনয়-টভিনয় করতে নামবে নাকি?
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিনয়ব্রত বলে- কি হয়েছে বলতে পারি না। তবে আজকাল সবকিছুতে কেন যেন কেবলই হেরে যাচ্ছি। গভীর হতাশা আর আশঙ্কার আঁধারে হাবুডুবু খাই সবসময়। এসব থেকে মুক্তি পেতে নানারকম চেষ্টা করি। শুনেছি ফটোগ্রাফে নাকি সত্যিকারের প্রতিরূপটা দেখা যায়। কিন্তু তাও দেখি নিজের ফটোগ্রাফ নিজের কাছেই অচেনা মনে হয়।
-তোমার লেখালেখি কেমন চলছে?
-লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছি। আমি যে কোনোদিন লিখতে পারতাম তা-ই মনে হয় না। অনেক ভাবনা-চিন্তার পরও একলাইন কবিতা মাথায় আসে না।
শামসুর রহমান থমকে দাঁড়ায়- সৃষ্টিশীলতা যার ধ্যান-জ্ঞান, বন্ধুকে লেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে, প্রতিদিন লেখক-সাংবাদিক-শিল্পীদের নিয়ে আড্ডা-তর্কে মেতে থাকত, তার মাথায় লেখা আসে না! এটা তো সহজ কথা নয়! এ তো অপমৃত্যুর নামান্তর! কিন্তু কেন এমন হলো?
শামসুর রহমানকে নিয়ে বাড়ি ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিনয়ব্রতর স্ত্রী তনুজা। দীর্ঘদিন ধরে কাছের লোকটাকে নিয়ে দুর্ভাবনায় থেকে থেকে মুখের হাসিটাই মিলিয়ে গিয়েছিল। স্বামীর বন্ধু এবং সুহৃদ শামসুর রহমানকে দেখে মন থেকে একটা গুরুভার পাষাণ নেমে যায়। নিজেকে বেশ নির্ভার মনে হয়।
দেখতে দেখতে ঝমঝম করে এক পশলা বৃষ্টি নামে। ভাপসা গরমে বেশ একটা স্বস্তির পরশ বুলিয়ে যায় দেহ-মনে। বিনয়ব্রত শৌচাগারে ঢুকলে শামসুর রহমান ফটোগ্রাফগুলো তনুজার হাতে দিয়ে বলে- বিনয়ের কি ইদানীং কোনো সমস্যা যাচ্ছে বৌদি?
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থেকে তনুজা বলে- ইদানীং নয়, বেশ কিছুদিন ধরে মানুষটা অস্বাভাবিক আচরণ করে চলছে। সবসময় হতাশ, মন মরা একটা ভাব। কোনো কাজকর্মেও মন নেই। শুধুমাত্র স্কুলের দায়িত্বটুকু পালন করে। আর ছুটির দিন বাজারটা করে আনে। অবসরে তার কাজ হচ্ছে নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকা। কাছেই তো নদী! যেটুকু সময় পায় ওখানে কাটায়। আগে লেখালেখির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারত। কিন্তু বছরখানেক হলো লেখার টেবিলে যায়ই না! আমি খাতা-কলম দিয়ে হাত ধরে লেখার টেবিলে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পরে গিয়ে দেখি আনমনে বসে খাতায় হিজিবিজি দাগ কাটছে।
বছরখানেক আগেও সময় একটু পেলেই দৌড়ে গিয়ে লিখতে বসত। একদিন হলো কি- দুপুর বেলা আমরা সবাই খেয়ে-দেয়ে দিবানিদ্রায় আছি। আপনার বন্ধু লিখতে বসেছে। হঠাৎ একটা ফোন আসে। শব্দ পেয়ে আমিও উঠে পড়ি। গিয়ে দেখি সে পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল বসে আছে। মনে হলো তার চোখ-মুখ যেন আতঙ্কে বিবর্ণ। অনেক পীড়াপীড়ি করেও সারাদিনে কোনো কথা বলাতে পারিনি। সবাই দুশ্চিন্তায় অস্থির! হঠাৎ কি হলো লোকটার!
রাত এলে না খেয়ে গিয়ে বিছানায় পড়ে রইল। গভীর রাতে অনেক প্রশ্নের পর বলে- সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম একটা কাজ হলো আজ আমাদের দেশে!
-কি হয়েছে বলো! আমার কিন্তু খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে!
-প্রগতিকামী মানুষের বিবেক বলে অভিহিত এক বিখ্যাত লেখককে উগ্র মৌলবাদী কোনো গোষ্ঠী হত্যা করতে চেয়েছিল। কোনোমতে প্রাণে বেঁচে আছে। এখন সে মৃত্যুর সাথে লড়ছে।
-কেন, তার অপরাধ কি?
-সবসময় দুঃসাহসী সত্য উচ্চারণ করা তার প্রথম অপরাধ। ভুলটাকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে কঠোর স্বরে উচ্চারণ করতেন তিনি। রাজনীতিক, ধর্মযাজক- যারা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে কারবার করে তাদের মসনদ কেঁপে গিয়েছিল তার সত্যভাষণে। তারই পরিণাম হিসেবে তাকে মৃত্যু উপহার দেয়া হলো। যেখানে সত্যের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া হয়, সেখানে শিল্প-সাহিত্য, নান্দনিকতার চর্চা হতে পারে না। প্রতিদিন সেখানে আঁধার জমে জমে অন্ধকূপ তৈরি হবে! এই যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো এটা আরো অসংখ্য হত্যা ডেকে আনবে। আমাদের দেশটা পিছিয়ে যাবে। রাস্তাঘাট, কলকারখানা বাড়লে তো আর দেশ উন্নত হয় না! এটা বড়জোর মানুষের মুখে দু’টো খাবার তুলে দেবার ব্যবস্থামাত্র। দেশ উন্নত হয় মানুষের প্রাণশক্তি বিকশিত হলে, প্রাণে আনন্দের সঞ্চার হলে। যেখানে আনন্দ নেই সেখানে জীবন বিকশিত হয় না।
-তুমি এখন ঘুমোও। কাল আবার বলবে।
-ঘুমাবো কী করে বলো! জগতের সব মতেরই বিরুদ্ধ মতবাদ থাকবে। কারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই আলাদা। তার বোধ, অনুভব, শিক্ষা, সংস্কার সবই আলাদা। তাকে মেনে নেবার সহিষ্ণুতাটুকু আমাদের থাকবে না! বিরুদ্ধ মতবাদের বক্তব্যকে ভয় পেয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া কত বড় নির্মমতা ভেবে দেখো! আগামী দিনের পথচলা কত বড় সংশয় চিহ্ন হয়ে দাঁড়াল! অথচ এই ভূখণ্ডের জল-বাতাস, হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দেশের মানুষের কোমল স্বভাব সবই কত উৎকৃষ্ট! তাহলে কোথা থেকে কাদের হাত ধরে ধর্মান্ধতা, হত্যা-লুণ্ঠন এলো! প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাংলার অন্তর্লোক কত ঋজু, কত উদার! সেই দেশে আজ প্রগতিশীলতাকে বিষনজরে দেখা হচ্ছে! হত্যার মতো ঘৃণ্য, বীভৎসতা ঠাঁই পাচ্ছে! আমরা কি আর কোনোদিন আলোর চর্চা করতে পারব?
-কাল দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে!
-আশা ছেড়ে দিয়ে তো আর মানুষ বাঁচতে পারে না! তাই আমরা এমনটা ভাবছি। কিন্তু কিছুই ঠিক হবে না। বরং একটা আলোর পাখিকে হত্যা অসংখ্য হত্যার জন্ম দেবে। আমাদের দেশটা ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপ হয়ে উঠবে। হয়তো কোনোদিনই আর শান্তিতে ঘুমুতে পারব না। অনিদ্রার অভিশাপ গ্রাস করে নেবে শান্তিপ্রিয়, সংস্কৃতির পূজারীদের।
বিনয়ব্রত শৌচাগার থেকে বের হয়ে তনুজাকে কথা বলতে দেখে তিরস্কারের সুরে বলে- তুমি কি আতিথেয়তাও ভুলে গেলে নাকি?
লজ্জিত মুখে তনুজা ঘরে গেলে শামসুর রহমান জিজ্ঞেস করে- আজকাল কি নিয়ে লেখালেখি করছ?
-লেখালেখি তো কবেই ছেড়ে দিয়েছি!
-সে কী! কেন?
-কী হবে লিখে? আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র কি আদর্শগতভাবে শিল্প-সাহিত্য, নান্দনিকতা লালন করে? বরং শিল্প-সাহিত্য, প্রগতিশীলতা, জ্ঞানচর্চাকে বিষ নজরে দেখে। এখানে অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে, গুরুত্বের সাথে ধর্মান্ধতা এবং অপরাজনীতিকে উৎসাহিত করা হয়। দু’টোই জ্ঞানচর্চার পথে মস্ত বাধা। ওই তোমরা যাকে করপোরেট সভ্যতা না কি সব ভালো ভালো আধুনিক শব্দ বলো না, ওটা যারা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে অন্ধ করে রাখলেই তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেল! তাই সংস্কৃতিহীনতাকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে যাতে মুক্তবুদ্ধির চর্চা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। চোখের সামনে দেখছি প্রতিদিন অন্ধকারে সব ঢেকে যাচ্ছে। অথচ হাত-পা গুটিয়ে আমাদের অথর্বের মতো বসে থাকা ছাড়া কোনো কাজ নেই।
-এর মধ্য দিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে। থেমে থাকলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?
-তোমার কাজগুলো তো সেই অপরাজনীতিকেন্দ্রিক! ওসব করা যায়। কিন্তু সাহিত্যচর্চার মতো অকাজের কাজ করা যায় না বন্ধু!
-তুমি এসবের প্রতিবাদ করে লেখ।
-যতই দুঃসময়ের তরঙ্গ উঠুক না কেন জীবন এক মহার্ঘ্য প্রাপ্তি। এটাকে উপভোগ করার প্রচণ্ড ইচ্ছা নেশাচ্ছন্ন করে রাখে যে! কে যেচে গিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়ায় বল?
-কিছু কিছু মৃত্যু হাজার মৃত্যুকে রুখে দিতে পারে। তুমি যার জন্য কথাগুলো বলছ তিনি মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরে এসে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠেছে। এটা মৃত্যু নয়, বলতে পারো নির্ভীক সত্য উচ্চারণের জন্য নিজেকে উৎসর্গ। অসুরদের হাত থেকে দেবতাদের সুরক্ষা দিতে দধীচি মুনি একদিন এই আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তিনি এই সময়ের দধীচি। নিজের জীবনকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে তার মতো সহস্র জ্ঞানতাপসের জীবনকে তিন নিষ্কণ্টক করে গেছেন। আবার তো তিনি আত্মশক্তি বলে সেখান থেকে ফিরেও এসেছেন!
-সেটাকে অলৌকিক বলতে পারো। কিন্তু না ফেরাটাই স্বাভাবিক ছিল।
-তুমি আমার চেয়ে ভালো জানো- সক্রেটিস, ব্রুনো থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কত জ্ঞানসাধকই তো সত্যের জন্য, আলোর জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন! তাঁদের এই উৎসর্গের জন্যই আজও সত্যের কণ্ঠ সুউচ্চে আছে।
-জানি না তোমার কথা ঠিক কিনা। আমার মনে হয় মিথ্যার কণ্ঠই জোরালো। সত্য আড়ালে বসে ফিসফিস করে।
-তোমার এই নেতিবাচক ধারণা, বিশ্বাস ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সকলে জন্যই অকল্যাণকর। কতখানি হতাশা, যন্ত্রণার দহনে তোমার এই ভীতি, গ্লানি সেটাও বুঝি। এখান থেকে যে করেই হোক তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। আচ্ছা, তার আগে বলো তো ‘স্টুডিও গ্র্যান্ড লুক’-এ আজ কি হয়েছিল?
-তুমি যা শুনেছ সবই ঠিক। সে লোকটা এক বর্ণও মিথ্যে বলেনি। বছরের বেশি সময় হয়ে গেল নিজেকে নিয়ে বড্ড সংশয়ে থাকি। কখনো মনে হয় আমি খুনি, আবার কখনো মনে হয় আমাকে খুন করা হচ্ছে। ভীষণ আতঙ্ক ভর করে মনে। মাথাটা ঠিক রাখতে পারি না। দেখি- কোনো অন্ধকার অতল গহ্বরের দিকে প্রচণ্ড বেগে ভেসে চলছি। নিজেকে দেখার জন্য ফটো তুলি। কিন্তু ফটোতে নিজেকে খুনির সামনে মুখ থুবড়ে অসহায় পড়ে থাকা মানুষের মতো দেখি। সেটাই বুঝিয়ে বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লোকটা ক্ষেপে গেলে আমার চুপ করে থাকা ছাড়া আর পথ ছিল না। আমার কথা কে বিশ্বাস করবে! কিন্তু ভিতরের দহন, ক্ষয় ক্রমাগত আমাকে শেষ করে ফেলছে।
বিনয়ব্রতকে বলার মতো কোনো ভাষা জোগায় না আদালতপাড়ায় কথার জালে প্রতিপক্ষকে তুলোধুনা করে দেয়া দুঁদে উকিল শামসুর রহমানের মুখে। সে বন্ধুপত্নীকে আপ্যায়নের সুযোগ না দিয়ে পালিয়ে চলে যায়।