অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
মে ৫, ২০২৪
২২শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মির্জা গোলাম সারোয়ার -
কষ্টের হাসি

দুপুর ১২.৩০ মিনিট। এখন পর্যন্ত একটি বইও বিক্রি হয়নি। আজ হয়তো না খেয়েই থাকতে হবে। দুশ্চিন্তায় করিম মিয়ার মুখটি কালো হয়ে আসে। একবছর যাবৎ তিনি তেজগাঁও ওভারব্রিজের একপাশে বসে ছোটদের বই বিক্রি করে আসছেন। সারাদিন বই বিক্রি করে ৩০-৪০ টাকা লাভ হয়। তা দিয়েই করিম মিয়া রাস্তার ফুটপাত থেকে রুটি ও ডাল কিনে দু’বেলা খান। দিনের বেলা দোকানের একপাশে ছেঁড়া মাদুর ও একটি তেলচিটে ছেঁড়া বালিশ আর জীর্ণশীর্ণ ছেঁড়া কাঁথা গুছিয়ে রেখে রাত্রিতে ফুটপাতের গাছের নিচে তা বিছিয়ে শুয়ে থাকেন।

ও মিয়া বাচ্চাদের এই বইটির দাম কত? ৭ টাকা স্যার। আরে মিয়া এতো দাম চান কেন? পাঁচ টাকা নিন। স্যার ৬ টাকা দিয়ে কিনেছি, এক টাকা লাভ না করলে খাবো কী? ক্রেতা ৬ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে একপ্রকার জোর করেই বইটি নিয়ে চলে যান। টাকা হাতে নিয়ে করিম মিয়া ভাবতে থাকেন এই টাকায় ২টি রুটি কিনে কোনোরকমে আজকের দিনটি চলে যাবে।

ও মিয়া কী খবর? হপ্তার ৫ টাকা এখনও দেও নাই কিসের লাইগা। এই বলে স্হানীয় এক মাস্তান ছোঁ মেরে করিম মিয়ার হাত থেকে ৬ টাকা নিয়ে ৫ টাকা রেখে ১ টাকা ফেরত দেন। করিম মিয়া লোকটির হাত ধরে অনেক কাকুতি-মিনতি করে জানান যে, আজ তার বিক্রি নেই। একটি বই বিক্রি করে যে সামান্য টাকা পেয়েছে তা দিয়ে কিছু কিনে খাবেন। কে শোনে কার কথা। লোকটি পাশের দোকানের হপ্তা তোলার জন্য এগিয়ে যায়।

করিম মিয়া ১ টাকা হাতে নিয়ে তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। এসময় তার দু’চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি ১ টাকা দিয়ে কী খাবেন তা ভেবে পান না। এর মধ্যে হঠাৎ এক গাড়ি পুলিশ এসে ওভারব্রিজসহ নিচের সমস্ত ফুটপাত থেকে তাদের তুলে দিয়ে জানায়, এই রাস্তা দিয়ে বিদেশি অতিথি যাবেন। করিম মিয়া তাড়াতাড়ি বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে অবস্থিত একটি খালি জায়গায় অবস্হান নেন। নর্দমার পচা ও নোংরা পানির দুর্গন্ধে সেখানে থাকাই মুশকিল।

প্রায় দু’ঘণ্ট যাবৎ সেখানে বসে থেকে বিদেশি অতিথি যাওয়ার পর করিম মিয়া পুনরায় ওভারব্রিজের ওপর এসে তার পসরা সাজিয়ে বসেন। কিন্তু এবেলায় আর কোনো বই বিক্রি না হওয়ায় সবকিছু গুছিয়ে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। অবশেষে রাতে নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে এক গ্লাস পানি পান করে শুয়ে পড়েন। রাতে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে করিম মিয়া কোনোরকমে বিছানা গুছিয়ে এক দৌড়ে পাশের একটি মার্কেটের বারান্দায় গিয়ে বাকি রাতটুকু সেখানে বসেই নির্ঘুম কাটিয়ে দেন।

করিম মিয়া একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তার এক মেয়ে এবং এক ছেলে। ছেলে-মেয়ে দুটি অত্যন্ত মেধাবী। ছেলে বুয়েট থেকে পাস করার পর ধনীর মেয়েকে বিয়ে করে স্ত্রীসহ আমেরিকায় বসবাস করে। মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে গেছে। এফআরসিএস করার পর সেখানে এক প্রবাসীকে বিয়ে করে আর দেশে ফিরেনি। করিম মিয়া ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য নিজের বাড়িসহ ভিটেটুকু বিক্রি করে ভাড়া বাসায় থাকতেন। প্রথমদিকে ছেলে-মেয়েরা খোঁজ খবর নিলেও তার অবসরের পর আর নেয় না।

রিটায়ার্ড করার পর যে টাকা পায় তা ঋণ শোধ করতেই শেষ হয়ে যায়। বাড়িভাড়ার টাকা দিতে না পারায় বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে গেলে তারা দু’একদিন থাকার পর বিরক্তিবোধ করে। কয়েকজন তো সোজাসাপটা বলেই ফেলে তাকে বসে বসে খাওয়াতে পারবে না। নিজের আত্মসম্মান রক্ষার্থে অতঃপর তিনি রাস্তার ফুটপাতে বাচ্চাদের বই বিক্রি করে কোনোরকমে বেঁচে আছেন। বিদেশে বসবাসরত ছেলে-মেয়েদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কোনো সন্ধান পাননি।

রাতে রুটি ও গুড় খেয়ে করিম মিয়া গাছতলায় শুয়ে থেকে তার মেয়ের কথা ভাবতে থাকেন। একদিন পঞ্চম শ্রেণিতে ক্লাস নেওয়ার সময় হঠাৎ বাড়ির কাজের ছেলে স্কুলে এসে জানায় তার মেয়ে হয়েছে। স্কুল শেযে বাসায় যেয়ে দেখেন তার একটি ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হয়েছে। খুশিতে তিনি সেদিন রাতেই ১০ কেজি মিষ্টি কিনে এনে পাড়ার সবাইকে খাওয়ান। পরের বছর ছেলের জন্ম। এরপর ধীরে ধীরে ছেলে-মেয়ে বড় হতে থাকে। দু’জনাই অতন্ত্য মেধাবী এবং ক্লাসের প্রথমস্হান অধিকারী। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে করিম মিয়ার গর্বের শেষ ছিল না। তিনি পাড়ার সবাইকে বুক উঁচু করে বলতেন, রিটায়ার্ড করার পর ছেলে-মেয়েরাই তার দায়িত্ব নেবে, তিনি শুধু বসে বসে খাবেন। এ ধরনের আরও কত কথা।

ছেলে-মেয়ের সুখের জন্য করিম মিয়া নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে ভালো কিছু না পরে, ভালো কিছু না খেয়ে তাদের চাহিদা মিটিয়েছেন। অথচ এ কারণে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা ঠিকমতো করাতে পারেননি। দিন দিন স্ত্রী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থা স্ত্রী হাসিমুখে বলতো, ছেলে-মেয়েদের জন্য এতো কষ্ট করছো। বড় হলে তারা তোমাকে দেখাশোনা করবে তো? করিম মিয়া হাসিমুখে জোর দিয়ে বলতেন, অবশ্যই করবে। দেখতে হবে না তারা কার সন্তান। তুমি দেখে নিও। শুনে স্ত্রী খুশি হতো।

একদিন স্কুল শেষে বাড়িতে ফিরে করিম মিয়া দেখেন তার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছে। কী গো অবেলায় শুয়ে আছো যে, শরীর খারাপ নাকি? দাঁড়াও আমি আসছি। এই বলে করিম মিয়া স্ত্রীর কাছে যেয়ে তার কপালে হাত দিয়ে দেখেন তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। তিনি অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করছেন। করিম মিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তিনি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদেন। অনবরত বলতে থাকেন, রহিমা কেন তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে? তোমাকে ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচবো বলো?

রহিমাকে হারিয়ে করিম মিয়া দিশেহারা হয়ে পড়েন। কিন্তু ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে নিজেকে সামলে নিয়ে তাদেরকে মানুষ করতে থাকেন। কখনও তাদেরকে মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। ছেলে-মেয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে যাওয়ার পর করিম মিয়া অসহায় হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে বুয়েট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে যেয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে দেখে আসতেন।

ছেলে-মেয়ে বিদেশ যাওয়ার দিন করিম মিয়া খুব কেঁদেছিলেন। কেন জানি তার মনে হয়েছিল এটাই হয়তো তাদের সাথে শেষ দেখা। তার ধারণাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ছেলে-মেয়ে বিদেশ যাওয়ার পর কিছুদিন খোঁজখবর নিলেও পরে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি। তাইতো বাড়িওয়ালা বের করে দেবার পর থেকেই এই ফুটপাতে তার বসবাস। ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রীর কথা ভাবতে ভাবতে করিম মিয়া একসময় ঘুমিয়ে পড়েন। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে দেখেন তার বইয়ের ব্যাগটি চুরি হয়ে গেছে। তিনি অনেকক্ষণ ধরে হতবাক হয়ে বসে থাকেন।

ভীষণ কষ্ট পেয়ে একসময় উঠে রাস্তায় হাঁটার সময় মানসিক আঘাত সামলাতে না পেরে করিম মিয়া পড়ে যান। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগামী ট্রাক তার ওপর দিয়ে চলে যায়। ফলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। পথযাত্রীরা তার কাছে ছুটে এসে ধরাধরি করে তার মৃতদেহ রাস্তার পাশে গাছের নিচে রাখেন। পরিচয় জানার জন্য তার পকেট থেকে একটি লকেট বের করে দেখেন তার মধ্যে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের ছবি। মেয়েটির ছবির ওপর ইভা এবং ছেলেটির আবির লেখা আছে। করিম মিয়া শতচেষ্টা করেও বাস্তবে ছেলে-মেয়েদেরকে কাছে না পেলেও তাদের ছোটবেলার ছবি গলায় ঝুলিয়ে একটি মুহূর্তের জন্য তাদের সঙ্গ ছাড়তে চাননি। ছেলে-মেয়েরা খোঁজ না নিলেও তিনি রক্তের বন্ধন অটুট রেখেছেন। মৃত্যুর পরও এতেই তার সার্থকতা এবং মুখে একটুকরো কষ্টের হাসি।

লেখক ও কলামিস্ট :
গৌরহাঙা, বিন্দুর মোড়, নিউমার্কেট রোড, রাজশাহী, বাংলাদেশ

Read Previous

বিব্রতকর আলাপ-প্রলাপ

Read Next

ম্যাজিস্ট্রেটের বাপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *