অনুপ্রাণন, শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল এ আপনাকে স্বাগতম!
এপ্রিল ৩০, ২০২৪
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এপ্রিল ৩০, ২০২৪
১৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তানজীর সৌরভ -
উন্নতি কোং লিমিটেড

আরে এত ভাইবে মন খারাপ কোইরে না। খুব শীঘ্রই দেখবা লোকেজনে এলাকা ভইরে যাবে। তহন বেচাকিনা বাড়বে। ব্যবসা বাড়বে। মিন্টু বলল আক্কাসকে।

আক্কাস বলল, গরিবির ভাঙা কপাল, ও আর জোড়া লাগবে না নে। চল চা, বিড়ি খাইয়ে বাড়ির দিক যাব। কাইলকে আবার মাজারের হাট আছে। তোর আর কি, শোউর বাড়িত্তে দুই লাখ পাইছিস, মোটরসাইকেলও পাইছিস। আমার তো পুরান ভাঙ্গা নৌকো।

—আচ্ছা হইছে, আর কতি হবে না। চলো মজিতের চা দোকানে।

আক্কাস গুনগুন করতে করতে হাঁটা শুরু করল।

মজিতের দোকানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে হঠাৎ বিজলি চমকে বৃষ্টি নামল। মজিতের ঝুপড়ি চায়ের টং দোকান। চা, বিড়ি, সিগারেট এবং বাংলা কেক, পাউরুটি, বিস্কুট, কলা ইত্যাদি পাওয়া যায়। মজিতের এক পা ভাঙা। খানবাড়ির সুপারি গাছ থেকে পড়ে ভেঙেছে। তারপর সমিতি থেকে ক্ষুদ্র লোন নিয়ে দোকানটা দিয়েছে। ঘর বাড়ি নেই কিছু। তবে গেল বছর গুচ্ছগ্রামে একটা ঘর পেয়েছে বহু তদবির করে। বউটা কলার পাতা কেটে পানের হাটে বিক্রি করে। ছেলেমেয়ে দুটো স্কুলে যায়।

মিন্টু বলল, মরার বৃষ্টি আসার আর সোমায় পালো না। এ মজিত, মিষ্টিকড়া চা দে দুইটে।

—বাইশশে কালে ডক তো যহনতহন আসে রে ভাইপো। আগে দুইখেন বিস্কুট দে মজিত। পানি দে।

মজিত বলে, খবরে শুনলাম আগামী এক সপ্তা ধইরে বলে ডক হবে বেশি। বিস্কুট নেও। পানির জগ গিলাস এই সামনে থুলাম।

মজিত চা ঘোটে অন্যদিকে টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে। কেউ যেন কাউকে শুনতে চায় না। তবু শব্দের ঝুমুর ঝনঝনিয়ে বাজে। আলো আঁধারি ভেজা রাতে কাজল এসে দাঁড়ায় দুয়ারে।

কাজল, ও কাজল বাড়ি আছিস মা? ঠকঠক করে মিনু দরজা আঘাত করে।

কাজল দরজা খুলে বলে, কী হইছে ও কাকি? এত রাইতে ঝড়বৃষ্টির মদ্দি তুমি?

আর কইস না মা, তোর চাচা এখনো হাটেততে ফিরিনি। চাইর কৌটো চাইল দে। ভাত কইডা চড়ায়ে দি। তোর কাকা বাজার আনলি ফেরত পাবি।

কাজল বলল, কী কও এহনো রান্দো নি! এতক্ষণ কি করিছ! ঘরে উইঠে বসো। আমি চাইল নিয়ে আসি।

মিনু বলল, আর বসপো না। গা ভিজে। তুই চাইল নিয়ে আয়।

কাজল চাল এনে দিলে মিনু তা নিয়ে ঘরের দিকে রওনা হলো। খুব বৃষ্টি। থেকে থেকে দমকা বাতাস। আজ যেন বৃষ্টি পণ করেছে সব অভিমান, অভিযোগ একবারে ঝাড়বে মানুষের উপর। আক্কাস ভিজে-পুড়ে বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরে। মিনু খেতে দেয়। ভাত, আলু ভর্তা, ঝিঙে দিয়ে টাকি মাছের ঝোল। মিন্টু যায় কাজলের কাথার নিচে। বৃষ্টি শুধু একলা ঝরে আপন রাগ অনুরাগে।

নদীর বুক চিরে সূর্য ওঠে। থোকা থোকা হরগোজা বন। ফুলের উপর মৌমাছি ওড়ে। ওপারে কেওড়া গাছের সারি। পুব পাশটা ঘিরে চ্যাটার্জিদের বিরাট বকুল বাগান। পশ্চিমে খানদের বাড়ি। নদীর উত্তরমুখো বাঁকে আজদাহা এক অশ্বত্থ গাছ। নিচে থাকে কানাই বাউল। সংসার বলতে একটা দোতরা আর গোল পাতার এক ঝোপড়া। কানাই বাউল বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। রাত জেগে কী সব গান বাঁধে। তার গানে মন ছোঁয় লোকের কিন্তু রুহ ছোঁয় না। রুহানি দারজায় অধিকাংশ লোকের জং পড়ছে। এই নিয়ে কানাই বাউল খুব মনোকষ্টে ভোগে।

ভেদের সুরা অভেদ্য মানুষ কেন বোঝে না?

নকল রেখে আসল পথে কেন হাঁটে না?

ও কানাইদা, কানাইদা, ঘুমেত্তে উঠিছো? মোক্তার তাকে ডাকে।

কানাই বলে, ঘুমোতি আর পারি কই! রাইতভর মেশিন বসানোর শব্দ। কি যে হলো আমাগো গিরামের! কয়দিন আর থাকতি পারবো তা কিডা জানে। কম্পানি যা শুরু কোরিছে!

মোক্তার বলল, বুঝিছি এই ফ্যাক্টরি বসানো তোমার মনে ধোরি নি মনে হয়। যাক, শোনো আমি ডাব নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছি। তোমার কোন ভক্ত নাকি ঢাকায় থাকে, ওর ফোন নাম্বার বা ঠিকানাডা দাও।

কানাই বাউল মোক্তারকে একটা ফোন নাম্বার সহ ঠিকানা লেখা ডাইরি বের করে টুকে নিতে বলে। মোক্তার স্মার্ট ফোনে একটা ছবি তুলে নেয়। বিশ্ব রোডে মোক্তারের ডাবের ট্রাক লোড হয়ে আছে ভোর রাত থেকে। সে ডাবভর্তি ট্রাক নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলো।

মোক্তারের ফোন বেজে উঠল।

—হ্যালো, এত সক্কাল সক্কাল ফোন দিলি যে?

কাজল বলল, কয়দিন হলো তোমারে দেহি না। কথা হয় না। সকালেই বুকে মোচড় দেলো তুমার জন্যি।

মোক্তার বলল, মিন্টু কই?

—ওর কথা ক্যান? আমার কথা মনে পড়ে না এহন আর তেমন?

মোক্তার থতমত খেয়ে বলে, আরে সে বিষয় না, এত সকালে ফোন দিস না মিন্টু থায়ে বইলে…।

—আরে আইজকে মাজারের হাটে গেইছে ভোর রাত্তিরিই।

—ও আচ্ছা।

কাজল হেসে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, গাড়ির শব্দ শুনি, কই যাও এই সাতসকালে?

—ঢাকা যাই ডাবের ট্রাক নিয়ে। তোর জন্যি কী আনবো ক?

কাজল হাসে আর বলে, এট্টা থ্রি পিস আইনো আর একখান লাল শাড়ি।

মোক্তার হেসে দিয়ে বলে, আচ্ছা। আর কিছু?

কাজল বলে, না। এখন কাম সাইরে তাড়াতাড়ি সাবধানে গিরামে ফিরে আসো। তুমারে গুলাপ ফুলের ঘ্রাণ মাখায়ে দেব…।

ট্রাক ড্রাইভার দুই পাটি দাঁত বের কোরে জিজ্ঞেস করে, কি মিয়া ভাই, বউ নাকি ডার্লিং?

মোক্তার হেসে দিয়ে বলে, আরে বাদ দ্যাও। ন্যাও, সিগারেট ধরাও। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মদ্দি ঘুম আসে খালি। সিগারেটে টান দিয়ে চাঙ্গা হই।

মোক্তারের সাবেক প্রেমিকা ছিল কাজল। কিন্তু মোক্তারের বছরখানেক আগে তেমন কোন রুজি-রোজগার ছিল না। মিন্টুও ঘুরঘুর করত কাজলের পিছনে। মিন্টুর কাঁচা তরিতরকারির ব্যবসা। বিভিন্ন হাট করে বেড়ায়। কাজলকে মাঝে মাঝে হাত খরচের টাকা দিত। বিভিন্ন উপহার দিত। এই সবে কাজলের মন মিন্টুর দিকে বেশি ঝুঁকে গেল। ঘনঘন রাতের বেলায় বেলতলায় তারা দেখা-সাক্ষাৎ করতে গিয়ে হঠাৎ ধরা খেয়ে গেলো বাবা-মার কাছে। পরদিন কাজী ডেকে কলমা। এখন মোক্তার ভালো টাকা উপার্জন করে। বিভিন্ন মৌসুমি ফল নিয়ে ঢাকায় গিয়ে পাইকারি বিক্রি করে। সুতরাং কাজলের পুরান প্রেম উথলে উঠেছে। চুপি চুপি আফসোস করে। চুপি চুপি দেখা করে তারা বিখ্যাত বেলতলায়।

চেয়ারম্যানবাড়ি সরগরম থাকে সবসময় কম-বেশি। ইদানীং বাইরের লোকের প্রচুর ভিড়। খান সাহেব উন্নতি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির ১০ হাজার কোটি টাকার এক প্রজেক্ট গ্রামে নিয়ে আসছে। উন্নতি গ্রুপের মালিকের ছেলের সাথে খান সাহেবের ঢাকায় এক রাজনৈতিক সভায় পরিচয়। কথায় কথায় উন্নতি গ্রুপের মালিকের ছেলে বলেছিল তারা নাকি প্লাইউডের একটা ইন্ডাস্ট্রি করতে চায়। কিন্তু মনপুত জায়গা পাচ্ছে না। খান সাহেব সেই মনপুত জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তার গ্রামে। প্রায় ২০০ বিঘা জমি নদীর পাড় ঘেঁষে। অনেকের বাগান, চৌদ্দ পুরুষের ঘর-ভিটা, দিঘি, নদীর চর সব একাকার করে মনপুত জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ন্যায্য দামও দিয়েছে জমি মালিকদের। শুধু বিষয়টা কানাই বাউলের তেমন পছন্দ হয়নি। বাকী গ্রামবাসী বেজায় খুশি। উন্নতি গ্রুপের ছোঁয়ায় গ্রামজোড়া শুধু টাকা উড়বে। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দিচ্ছে সবাই।

খান সাহেবের বলে— সাদিক ভাই, আপনি একদমই ভাববেন না। বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী সাহেব আমার ঘনিষ্ঠ লোক। আমি চেয়ারম্যান থাকতে তার বহু ঝামেলা থেকে উদ্ধার করে দিছি। আমার কথা ফেলবে না। কোনো ঝামেলা তিনি করবে না। আর এমপি সাহেব তো আপনার মালিকের সাথে বৈঠক করেছেন। আশা করি পরিবেশের সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন সহজে। কোনো আর্জি কেউ জানাবে না। শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেনা-পাওনাটা আপনারা ঠিক রাখলেই হবে। আর বর্তমান চেয়ারম্যানকে লাখ ৫০ দিলে সে টু শব্দটাও করবে না।

কোম্পানির ভিজিটর সাদিক বলেন, কিন্তু এই যে ১০ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইন নেওয়ার ব্যাপারে গ্রামবাসীর আপত্তি এ ব্যাপারে কী করবেন? আমাদের সাফ তারা জোট বেঁধে বোলেছে, গ্রামের ভেতর থেকে এত ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইন নেওয়া যাবে না।

—খান সাহেব, আরে এসব টুকটাক সমস্যা নিয়ে আপনি একটুও ভাববেন না। জমি যেভাবে কম বা বেশি দিয়ে লোকেদের ম্যানেজ করেছি। সেভাবে মাথাধরা কয়েকজনকে কিছু টাকা দিয়ে সম্মতি নিয়ে নেব। আর কেউ টু শব্দ করবে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন।

সব শুনে সাদিক বললেন, তো এই সম্মতির জন্য মোট কত টাকা লাগবে?

খান সাহেবে একটু ভেবে বলেন, বেশ কয়েকজনকে ভাগ দিতে হবে। আপনি মোট কোটি খানেক দেন। বাকিটা আমি সামলে নেব।

সাদিক চশমা ঠিক করে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, আচ্ছা। বিষয়টা হাইয়ার অথরিটিকে জানিয়ে টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

বেলা ১১টায় বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী ঢোকেন খান সাহেবের ড্রইংরুমে। মেঘলা আকাশ তখন আবার কেঁদে ওঠে। কষ্টে নাকি সুখে তা বোঝা গ্যাল না; তবে করুণ সুরে ডেকে উঠল ভৈরব। যেন মরা নদীর রেখা।

ফ্যাক্টরির সামনে যাদের জায়গাজমি ছিল তারা মহা আনন্দে আছে। খুব আগ্রহ নিয়ে টাকাপয়সা খরচ করে কিছু পাকা দোকান করে নাম দিয়েছে সুপার মার্কেট। বিভিন্ন ব্যবসায়ী এসে দোকান বরাদ্দ নিচ্ছে। বেশ টাকা এডভান্স দিয়ে দোকানগুলো ভাড়া নিয়েছে লোকে। কেউ মুদি, কেউ রেস্টুরেন্ট তো কেউ চা, সিগারেট কিংবা ফাস্টফুড ইত্যাদি ব্যবসা দেবে।

ঢাকায় পৌঁছে মোক্তার পাইকারি দরে সব ডাব খালাশ করেছে। লেনদেন সব চুকিয়ে বাকি টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করেছে। এখন কানাই বাউলের সেই ভক্তকে ফোন দিল। ভক্তের নাম জয়া। ফোন ধরেই তার নতুন বাসার ঠিকানা দিল জয়া। মোক্তার, জয়া ও তার ১০ বছরের ছেলের জন্য চকলেট, মিষ্টি, চিপস ইত্যাদি কিনে নিয়ে রওনা হলো। সায়দাবাদ থেকে ৮ নাম্বার গাড়িতে উঠেছে। নামবে শ্যামলী। বাসে বসেই বেশ লম্বা একটা ঘুম দিল মোক্তার। বাস থেকে নেমে ফোন বের করতে গিয়ে দেখে ফোন নেই। পকেট কাটা। মোক্তারের মাথায় হাত। রাগে, দুঃখে বলল, এই বালের ঢাকায় আসাও এক বিপদ!

জয়ার ঠিকানা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। সে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে শ্যামলী হাউজিংয়ের ৯ নম্বর রোডে জয়ার বাসায় পৌঁছে যায়। কলিং বেল একবার টিপতেই জয়ার ছেলেটা দরজা খুলে দেয়।

জয়া এসে বলে, পাক্কা ৬ মাস পর দেখলাম তুমারে।

মোক্তার বলে, বালের ঢাকায় এসে আবার পকেট কাটা গ্যালো। মোবাইলডা গেইছে। বহু কষ্টে বাসা খুঁইজে পাইছি।

—কী কও! জলদি ভিতরে আসো। শরীরে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি তো?

—না। তা হয়নি। যাইগগে, এখন গোসল করা লাগবে। বাথরুম কোন পাশে?

জয়া বাথরুম দেখিয়ে দিল। তারপর খাবার গরম করতে শুরু করল। রাত তখন ৯টা বাজে।

মোক্তার বাথরুম থেকে বের হলে জয়া বলল, টেবিলে খাওন বাইড়ে রাহিছি। খাইয়ে ন্যাও। আমি ছুয়ালডারে মাদ্রাসায় দিয়ে আসি। সন্ধ্যায় ছুটি নিয়ে মার কাছে আইছিল। দরজাডা লক কইরে খাতি বসো।

জয়া চলে গেলো। মোক্তার দরজা দিয়ে খেতে বসল। কলমি শাক ভাজি আর মুরগি দিয়ে ভাত। সাথে পাতলা ডাল। মোক্তারের খাওয়া শেষ হতে না হতে জয়া চলে এল।

মোক্তার জিজ্ঞেস করল, তুমি খাবা না?

জয়া বলল, তুমি আসার ইট্টু আগে ছেলে নিয়ে খাইছি।

আবার কলিং বেল বাজল। জয়া দরজা খুলে দিল। জয়ার বাসার সাবলেট দম্পতি এসেছে। সাবলেট দম্পতিসহ জয়া, মোক্তার প্রায় রাত ১২টা অব্ধি গল্পসল্প করল। ওরা ঘুমোতে গেল। শহরের বৃষ্টিরা নেমে এল। ভিজে যাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল।

জয়া চাকরি করে গার্মেন্টসে। ছেলেটাকে হেফজখানায় পড়ায়। জয়া এক সময় কানাই বাউলের সাধন সঙ্গী ছিল। কিন্তু ভোগের অসুখ থেকে মুক্তি পায় নি। তাই কানাই বাউলকে ছেড়ে ঢাকায় এসেছিল স্বপ্নের সংসারের টানে। তা প্রায় ১ যুগ আগের কথা। এসে দেখে যে পুরুষের প্রেম ও সংসারের টানে ঢাকায় এসেছে তার অলরেডি সংসার আছে। সুন্দরী বউ, দুই সন্তান আছে। জয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কিন্তু জয়া ছাড়া কেউ কাঁদল না। শুধু বটগাছতলায় বিচ্ছেদের গান গাইতে গাইতে কাঁদল কানাই বাউল; অশ্বত্থ তার জলজ্যান্ত সাক্ষী। এরপর জয়া হাল ছাড়েনি। জয়ার প্রেমিকের নাম ছিল আহসান। আহসান তাকে বিএনপি বাজারের এক বস্তিতে বাসা ভাড়া করে দিল। দিনে মাঝে মধ্যে আহসান আসত। বাজার নিয়ে আর প্রেম নিয়ে। দিয়ে যেত উভয় রসদ। কিন্তু জয়ার পরাণ বাঁধা কানাই বাউলের ঘাটে। জয়া নিশিদিন হাঁটে আর কাঁদে। আহসান তাকে গার্মেন্টসে চাকরি দিল। ঐ গার্মেন্টসে আহসান সুপারভাইজারি চাকরি করত। চাকরি পেয়ে জয়ার মন ভালো কিছুটা। কিন্তু পরাণ পোড়ে নাড়ির টানে, পরাণ পোড়ে নীড়ের টানে; কানাই বাউল রোজ স্বপ্নে আসে। কত কথা, কত গান গায়; রসের সংসার। ৬ মাস পর জায়া ৩ দিনের ছুটি নিয়ে কানাই বাউলের কাছে গেল। গিয়ে দেখে কানাই বাউলের ছোটঘর, ছোট খেত সব নদীর পেটে। বাউল থাকে বটতলায় ঝোপড়া বেঁধে। খুব কাঁদল। কিন্তু কে কাকে ধরে কেউ টের পেল না। ৩ দিন ৩ রাত কানাই বাউল আর জয়া কে কার ভেতর ছিল কেউ কিছুই টের পেল না। পরদিন ঘুম ভেঙে দেখে জয়া আবার নেই হয়ে গেছে। ঢাকায় ফিরলে আবার আহসান এবং চাকরি নিয়ে জয়ার ব্যস্ততা শুরু। হঠাৎ সপ্তাহ ২ পরে জয়া টের পেল সে গর্ভবতী! কানাই বাউল নাকি আহসান— কার সন্তান? জয়া তা আজও জানে না। জানে শুধু মানুষের বাচ্চা। জয়ার প্রেগন্যান্সির খবর শুনে আহসান তার সাথে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আহসান চাকরি ছেড়ে অন্য গার্মেন্টসে চাকরি নিল। এরপর বহু চড়াই উৎরাই নিয়ে চলছে জয়ার জীবন।

দিনরাত এক করে কাজ চলছে উন্নতি গ্রুপের। খুব তোড়জোড়। ট্রাক, রুলার, ট্রলার, কার্গো, ক্রেন ইত্যাদি সব ভারি সরঞ্জাম নিয়ে। অতিকায় ভবন উঠছে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে। গাছের ব্যাপারিরা দলে দলে খোঁজ নিচ্ছে। কবে শেষ হবে নির্মাণ কাজ। শুরু হবে গাছ কাটার রমরমা ব্যবসা। তখন দেখা যাবে মেশিন এবং বনে মধ্যে কার কোমরে কত বল। খান সাহেব, চৌধুরী সাহেব দিনে কয়েকবার খোঁজখবর নেন; তদারকি করেন। পুলিশ ঢু মারে। রাত ১২টার পর রাস্তায় কাউকে পেলে পাকড়াও করে। চেকিং করে। জেরা করে। এলোমেলো কিছু দেখলেই কিছু হাদিয়া সংগ্রহ করা যায়।

বিশ্বরোড বাসস্ট্যান্ডে এসে মোক্তার নামল। সন্ধ্যে ৭টা বাজে তখন। নতুন মেবাইল ফোন কিনেছে সে। আগের থেকে স্মার্ট। চা দোকানে ঢুকে চা খেল। দোকানদারদের ছবি তুলল। তারপর অটোভ্যানে ফিরল গ্রামে। সোজা কানাই বাউলের কাছে গ্যালো। গিয়ে দ্যাখে কানাই বাউল পান চিবোচ্ছে আর দোতারাটা শান দিচ্ছে।

মোক্তার বলল, কানাইদা, সফর খুব ভালো হইছে। তুমার ভক্ত খুব ভালো যত্ন করিছে। তোমার জন্যি পাটিসাপটা পিঠা বানায়ে পাঠাইছে। তুমি নাকি ভালো খাও এই পিঠে।

কানাই বাউল তেমন আগ্রহ দেখায় না। যেন কোন পরনারী তাকে করুণা করছে। এমন করুণার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা সে করে না।

শুধু বলল, রাখ এহেনে। আমার একটু সাধন ভজন আছে। এখন যা। সকলে আসিস। মোক্তার চলে গেল। কানাই বাউল গান ধরল…।

মোক্তার তার ঘরে ফেরে। মা-বাবাহারা এতিম সে। চাচার ঘরে মানুষ হয়েছে। এইচএসসি পাস করেছে। আর পড়াশোনা হয়নি। হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নেয় মোক্তার। মেঘ গর্জন করে আসে বৃষ্টি নূপুর।

চাচি তাকে বলে, এবার বিয়েডা কইরে আমারে মাফ কর। সেই হাইস্কুল থেকে তোর জ্বালাতন সহ্য করতিছি।

মোক্তার কোনো কথা বলে না। শোবার জন্য চলে যায়। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে টের পায় কাজল তাকে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু সে ধরতে পারে না। ঘুমে তলিয়ে যায়।

আজকে হাটবার। ভোররাত থেকেই বাজার সরগরম। আক্কাস মজিতকে চা দিতে বলে। মজিদ চা দেয়। একটু পর মিন্টু আসে। সিগারেট ধরায়। কানাই বাউল আসে চা দোকানে।

মজিত বলে, কীরে বাউল, ভোর রাত্তিরি বাজারে ক্যান?

কানাই চা চায়, সিগারেট চায়।

আক্কাস কানাই বাউলকে বলে, কী গো বাউল এহন আর আগের দিন নেই। বাউলা গানের আসর হয় না। হয় আধুনিক গান, ব্যান্ডের গান। গানবাজনা ছাড়ো এবার। আল্লাহ-বিল্লাহ করো। ঝোপড়ায় বইসে মাছের জাল বোনো। দিব্বি বাকি জীবন ভালো কাটবে। এই বাউলাগিরির জন্যি অত সুন্দর বৌডা গেল চইলে।

কানাই বাউল কথা বলে না। মুচকি হাসি দেয়।

মিন্টু বলে, বাউল থাকলি তো ভালো। মাঝে-মদ্দি যাইয়ে গান শোনা যাবে রাইত-বিরাতে।

মজিত বলে, ও বাউল তোমার ঝোপড়া কুয়ানে সরাবা এখন? কম্পানির মেইন গেট ঐ বটগাছ বরাবর হবে।

কানাই সিগারেট টানতে টানতে বলে, ভৈরবে গা ভাসায়ে দেব। তারপর আরেকখান বটগাছ পালি সেহেনি ঝোপড়া বানবো।

সবাই হাসে। কানাই বাউলও হাসে। হাসি গুলো বিনা কারণে ক্ষয়ে যায়। বয়ে যায় সময়।

কোম্পানি তরতর করে গজাতে থাকে। যেন হাইব্রিড ফসল। বছর পার হতে না হতে কোম্পানি চালু হয়ে যায়। বাইরের লোকজনও আসে তবে সীমিত পরিমাণে। কারণ কোম্পানিতে শ্রমিক বলতে কিছু মেশিন অপারেটর লাগে। কিছু গার্ড লাগে। আর তেমন লোকের প্রয়োজন নেই। মেশিনের যুগ। রোবটের যুগ। মানুষের শারীর বা মেধা তেমন খাটাতে হয় না। শুধু কমান্ড দিলেই পণ্য প্রসেস ও রেডি হয়ে যায়। গ্রামবাসী কম-বেশি হতাশ হয়। ট্রাক ও কার্গোর আনাগোনা বাড়ে। সেখানেও চালক আর হেল্পার। লোক আর কই! কিছু গাছের ব্যাপারি ফুলে ফেঁপে ওঠে। এর মধ্যে কিছু আবার পরের পয়সায় ব্যবসা করে। জন জীবনে তেমন আর পরিবর্তন দেখা যায় না। আক্কাসের কথার মতন, ভাঙা কপাল আর জোড়া লাগে না।

বটগাছ আর নেই। কানাই বাউলকেও মাতুব্বরদের ধরাধরি করে গ্রামবাসী গুচ্ছগ্রামে একটা ঘর পাইয়ে দিয়েছে। সে ঘরে বসে গান গায় আর মাছের জাল বোনে। হাটে বিক্রি করে। মজিতের চায়ের টং আগের মতোই। মোক্তার একটা বিয়ে করেছে। নতুন ঘর বেঁধেছে দুই কাঠা জমি কিনে। কাজলের একটা বাচ্চা হয়েছে। কিন্তু বাচ্চার বাবা মোক্তার নাকি মিন্টু— সে বিষয়ে বাহাস আছে। মোক্তার, কাজল এখনো গোপন যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। মিন্টু কাঁচামালের ব্যবসা ছেড়ে বাবার খেত করে। আক্কাসের সেই পুরাতন জীবন। টিনের চালের মটকা বর্ষা এলেই ছিদ্র বের হয়। এর ভিতর মজিতের বউটা ভেগে গেছে বাচ্চা দুটো রেখে। মুদি দোকানদার করিমের দ্বিতীয় বউ সে এখন। কোম্পানির সামনে গ্রামের দালালগুলো, বখাটেগুলো ঘুরঘুর করে। যদি কোন ধান্দা ধরা যায়। গাছের ব্যাপারিগুলো কোম্পানির গেটের সামনে অফিস খুলে বোসেছে। বৃক্ষ নিধন অফিস।

কানাই বাউল জানে না কেন প্লাইউড লাগে; গাছের কাঠ থেকেই তো ভালো, মজবুত এবং টেকসই আসবাব হয়, ডেকোরেশন হয়। জীবনযাত্রার মান কতটা উন্নত হলে মানুষের তুষ্টি আসবে! গ্রাম ধীরে মফস্বলের দিকে যাচ্ছে। কানাই বাউল ভেবে পায় না, উন্নতি মানেই কি শিল্পায়ন, নগরায়ন! প্রকৃতি আর মেশিনের যুদ্ধ কেন সাজায় মানুষ! কানাই বাউল রাতভর ভাবে। কূল পায় না। তখন দোতারা বাজায় আর গান ধরে।

ফজরের পর বিদ্যুৎ চমকায়— বৃষ্টি শুরু হয়। জয়া কানাই বাউলের দরজায় ধাক্কা দেয়। দরজা খুলে যায়। কিন্তু কানাই বাউল আর নেই…।

 

Read Previous

মুদ্রিত দুঃখের ধারাপাতে

Read Next

শিল্প-সাহিত্যের অন্তর্জাল, অনুপ্রাণন, ৫ম সংখ্যা (অক্টোবর-২০২৩)

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *